wb 10th Bengali

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 1 প্ৰবন্ধ

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 1 প্ৰবন্ধ

West Bengal Board 10th Class Bengali Solutions Chapter 1 জ্ঞানচক্ষু

West Bengal Board 10th Bengali Solutions

প্রবন্ধ রচনা

প্রবন্ধ বলতে বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে গদ্যের আকারে আলোচনা। ‘প্রবন্ধ’ যখন রচনা, তখন তা দুই প্রকারের হতে পারে– [১] বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ এবং [২] আত্মগত বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধ। বিদ্যালয় স্তরে আমরা যে-ধরনের প্রবন্ধ লিখতে শিখি, আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলি তিন ভাগে বিভক্ত— [১] বর্ণনামূলক, [২] কাহিনিমূলক ও [৩] যুক্তিমূলক।

বিজ্ঞান ও পরিবেশ

১. মোবাইল ফোন,
উত্তর –
“এখন নাকি শব্দগুলো এক মুহূর্তে সাগর পেরোয়/ এখন নাকি যন্ত্রগুলো এপার থেকে আমার কথা তোমার পারে পৌঁছিয়ে দেয়/ তবু কিছুই যায় না বলা, শব্দখেলায় কেবল ফাঁকি/ কথার পিঠে কথা সাজাই আমরা/ এখন একলা থাকি …”
-মৌসুমী ভৌমিক
ভূমিকা: বিজ্ঞানের যে ক-টি বিস্ময়কর আবিষ্কার আজকের মানবসভ্যতাকে আরও আধুনিক ও আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে, মোবাইল ফোন সেগুলির অন্যতম। মোবাইল ফোন আধুনিক পৃথিবীর অপরিহার্য অঙ্গ, জীবনের দ্রুত চলমানতার সঙ্গে মানানসই এক আবশ্যিক উপকরণ।
মোবাইল ফোনের ইতিহাস: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় যে মোবাইল টেলিফোন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তাকেই মোবাইল ফোনের আদিরূপ বলা হয়। বেল সিস্টেম মোবাইল টেলিফোন সার্ভিস নামে প্রচলিত এই সংযোগ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় বিশেষ জনপ্রিয় হয়নি। এরপর কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ড. মার্টিন কুপার আধুনিক মোবাইল ফোনকে পৃথিবীর মানুষের কাছে হাজির করেন। সেই আদি মোবাইলটির ওজন ছিল ২ কিলোগ্রাম। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে জাপান প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সেলুলার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা চালু করে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র পৃথিবীতে ১ কোটি ২৪ লক্ষ মানুষ মোবাইল ব্যবহার করতেন। কিন্তু অতি দ্রুত এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বজুড়ে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬ কোটি। ভারতে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মোবাইল ফোনের পরিসেবা বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয়েছে ৪.৫৫ বিলিয়ন। একটি সমীক্ষায় বলছে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮২ কোটি ৯০ লক্ষ। ভারতের মতো দেশের ক্রমবর্ধমান বাজারের কথা মাথায় রেখে দেশীয় এবং বহুজাতিক অনেক সংস্থাই যেমন, বিএসএনএল, ভোডাফোন, এয়ারটেল, আইডিয়া সেলুলার, জিও প্রভৃতি এদেশে মোবাইল পরিসেবা দিতে উদ্যোগী হয়েছে।
মোবাইল ফোনের উপযোগিতা: মোবাইল ফোন এমন একটি বৈদ্যুতিন উপকরণ যার উপযোগিতা আধুনিক জীবনে সর্বত্র। চিঠি লেখার ও পাওয়ার অপেক্ষা এবং অনিশ্চয়তাকে দূর করে মোবাইল নিয়ে এসেছে এসএমএস পরিসেবা। সংযোগকে আরও প্রাণবন্ত করেছে এই ব্যবস্থা। কম্পিউটারের দুনিয়াকেও অনেকটাই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে মোবাইল ফোন। ইমেল, ইনটারনেট—এইসব পরিসেবা এখন মোবাইল ফোনের কারণে সহজে উপলব্ধ। ব্লুটুথ বা ইনফ্রারেড প্রযুক্তি সংযোগব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। স্থির এবং চলমান ফোটোগ্রাফিও অনায়াসে সম্ভব এই মোবাইল ফোনের সাহায্যে। এতে রয়েছে বিনোদনের অজস্র ব্যবস্থা। রেডিয়ো, এমপিথ্রি, গেমিং, এমনকি টিভির অনুষ্ঠানও মোবাইলের সাহায্যে উপভোগ করা সম্ভব। মোবাইলে প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশই উন্নত হচ্ছে। মোবাইল ব্যবস্থা এখন চতুর্থ প্রজন্মে প্রবেশ করেছে। মোবাইলের মাধ্যমে টাকাপয়সার লেনদেনের ক্ষেত্রে নেট ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে যেমন কার্যকর করা হচ্ছে, তেমনই আগামী দিনে এটি ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত হতে চলেছে। মোবাইল ফোন যেন আলাদিনের মায়ার প্রদীপের মতো জাদুশক্তির অধিকারী।
মোবাইল ফোনের খারাপ দিক: বিজ্ঞানের যে-কোনো আবিষ্কারের মতোই মোবাইলেরও কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। কিশোরমনে মোবাইল ফোনের প্রতি যে আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে তা এক নেতিবাচক সামাজিক চাহিদার জন্ম দিচ্ছে। মোবাইলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বিদ্যালয়ের পরিবেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে, আবার ছাত্রছাত্রীদের মনঃসংযোগেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। নানারকম সামাজিক দুষণও এর মাধ্যমে ঘটছে। নাগরিক জীবনে মোবাইলের অসতর্ক ব্যবহার যেমন গাড়ি চালানো কিংবা রাস্তা পারাপার বা লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার দুর্ঘটনা ডেকে আনছে। মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার শ্রবণেন্দ্রিয় ও হার্টের সমস্যা তৈরি করতে পারে এরকমও অনেকে বলেন, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও এমন ধারণাকে সমর্থন করেনি। সবমিলিয়ে মোবাইল ফোনের যথাযথ ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন। বিদ্যালয় স্তরে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।
উপসংহার: বিজ্ঞানের যে কোনো যুগান্তকারী আবিষ্কারের মতোই মোবাইলের সার্থকতা নির্ভর করছে তার ব্যবহারের উপর। নাগরিক সচেতনতা এই আধুনিক উপকরণটির প্রয়োগকে তাই সার্থক করে তুলতে পারে। গতিশীল আধুনিক যুগের ট্রেডমার্ক মোবাইল ফোনকে বাদ দিয়ে একুশ শতককে ভাবা অসম্ভব।
২. বিশ্ব উন্নায়ন
উত্তর –
“উন্মুক্ত বন্দর সব নীল সমুদ্রের/ পায়ে-পায়ে মানুষ ও মেশিনের যৌথ শক্তিবলে/ নীলিমাকে আটকেছে ইঁদুরের কলে।”
—জীবনানন্দ দাশ
ভূমিকা: একুশ শতকে বিজ্ঞানের আলোকিত অগ্রগতি যেমন মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ, ভারসাম্যহীন উন্নয়ন নিয়ে এসেছে আশঙ্কার কালো মেঘ। বিশ্ব উয়ায়ন, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Global Warming এরকমই একটি আতঙ্কের নাম।
বিশ্ব উন্নায়ন কী?: আপাতভাবে বিশ্ব উয়ায়ন কথাটির অর্থ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেলজয়ী সুইডিশ বিজ্ঞানী আরথেনিয়াস বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাঁর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উন্নতা বৃদ্ধির এই হার হবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল হবে মানবসভ্যতার সর্বনাশ।
বিশ্ব উয়ায়ন ও গ্রিনহাউস গ্যাস: বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসসমূহ যেমন— কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কোরোফ্লুরোকার্বন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদির বৃদ্ধি তাপীয় ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। শিল্পবিপ্লবের আগে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ছিল ২৮০ পিপিএম, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮২ পিপিএম। একইভাবে বছরে গড়ে ৪৪০-৬০০ মিলিয়ন টন মিথেন বায়ুমণ্ডলে এসে মিশছে। গ্রিনহাউস এফেক্টে এই মিথেনের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ।
মানুষের দায়িত্ব: পৃথিবীর উন্নতা বৃদ্ধি তথা গ্রিনহাউস এফেক্ট তৈরিতে মানুষেরই ভূমিকা প্রধানতম। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করা, কাঠ এবং জীবাশ্মকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা, সিমেন্ট শিল্পের প্রসার ইত্যাদি বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধি ঘটায়। এ ছাড়া সার শিল্প, অ্যালুমিনিয়াম শিল্প, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর শিল্প ইত্যাদি বাতাসে নানারকম গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে।
প্রভাব: গ্রিনহাউস এফেক্ট এবং বিশ্ব উয়ায়নের ফলে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ গত দুশো বছরে উন্নতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এই অবস্থা বজায় থেকেছে পরবর্তী সময়েও। খরা, বন্যা, তুষারঝড় ইত্যাদি নানান বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এক মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৬২ টি টর্নেডো হয়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। গত ৩০ বছরে সুমেরুর বরফ গলেছে ৩৮,০০০ বর্গকিমি। এর ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে চলেছে বর্তমানে প্রতিবছর ৩.১ মিলিমিটার হারে। ফলে এক বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী ভূখণ্ড চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছে। ডেঙ্গু, এনকেফেলাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি অসুখের প্রাদুর্ভাব ঘটছে—এমনটাই জানিয়েছেন হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের চিকিৎসকরা। জীবকুলের অস্তিত্বও বিপন্ন হচ্ছে। বরফ গলে যাওয়ায় পেঙ্গুইন, মেরুভল্লুক ইত্যাদি প্রাণীরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। প্রতিরোধের প্রয়াস: গ্রিনহাউস গ্যাস বেরোনো বন্ধ করতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেরোতে বসেছিল বসুন্ধরা শীর্ষসম্মেলন। পরবর্তীকালে ২০০২-এ জোহেনসবার্গে, ২০০৫-এ জাপানের কিয়োটো শহরে এবং ২০০৭-এ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একই উদ্দেশ্যে সম্মেলন হয়। কিন্তু এই বিপর্যয়ের জন্য যে উন্নত দেশগুলি প্রধানত দায়ী তাদের অসহযোগিতায় কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তাই আশঙ্কার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে আছে একুশ শতকের বিজ্ঞানপ্রদীপ্ত মানবসভ্যতা।
৩. মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট
উত্তর –
“তোমার কাজ/ আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়/ আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।”
—বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা: পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম হাতিয়ার হল বিজ্ঞান। দৈনন্দিন জীবন থেকে গ্রহান্তরে জীবনের সন্ধান করা—প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানই হয়েছে মানুষের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু সবক্ষেত্রে মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা কখনও মানুষের আবেগ অনুভূতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করে দিচ্ছে কিনা এটাই হয়ে উঠেছে একুশ শতকের চেতনাসম্পন্ন মানুষের অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।
বিজ্ঞানের অবদান: আজকের গোটা মানবসভ্যতাই বিজ্ঞানের অবদান। প্রতিদিনের জীবনে সকাল থেকে সন্ধে বিজ্ঞানকে সঙ্গে নিয়েই মানুষ চলে। বিজ্ঞান যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শরীরে অদৃশ্য ডানা লাগিয়ে মানুষ এখন অনায়াসে চলে যেতে পারে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোন মুহূর্তে সংযোগ গড়ে দেয় অন্য গোলার্ধের কোনো মানুষের সঙ্গে। শুধু কথা বলা নয়, লাইন, স্কাইপ ইত্যাদির সাহায্যে মা তাঁর বহুদূরে থাকা ছেলেকে পর্দায় দেখতে পারেন। কৃষিতে বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে এসেছে যুগান্তর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি মৃত্যুকে হয়তো পরাজিত করতে পারেনি, কিন্তু মানুষের জীবনকালকে আরও দীর্ঘ করেছে। কম্পিউটারের আবিষ্কার আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপের সন্ধান দিয়েছে মানুষকে। নেট ব্যাংকিং, অনলাইন কেনাকাটা থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের হদিস—সবই সম্ভব হয় ইনটারনেট সংযোগের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবীর বুকে আজ মানুষের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
সংকটের স্বরূপ: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের ঝোঁক তাকে ক্রমশই ভোগবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আকর্ষণ মানুষের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে সীমাহীন লোভ ও চাহিদার। মানুষ নিজের সুখের স্বার্থে পৃথিবীর অন্য প্রাণীদের অবহেলা করছে, তাদের থাকার জায়গার সংকট তৈরি করছে, মানুষ তার নিজের স্বার্থে জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করছে। ভোগবাদী চাহিদা যে ইঁদুরদৌড়কে আহ্বান করছে তা শৈশবকে অনাবশ্যক চাপে ফেলে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে মানসিক অবসাদ। আমরা এমন একটা সমাজ তৈরি করছি যেখানে টাকাপয়সাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের প্রধান মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। আর নৈতিক মূল্যবোধ, নান্দনিক ধারণা সেখানে ক্রমশ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষকে যন্ত্রমানবে পরিণত করেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সহানুভূতির জায়গাগুলো ক্রমশই নষ্ট হচ্ছে। মানুষ ক্রমে ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। ফলে সামাজিকতাবোধের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যন্ত্রকে ব্যবহার করে নানা অপরাধমূলক কাজকর্ম ঘটছে। সাইবার ক্রাইম তো আধুনিক সমাজের সর্বস্তরে আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠছে। টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেও নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা, বিশেষত কম্পিউটারের সর্বাত্মক ব্যবহার মানবসম্পদের বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে দিচ্ছে।
উপসংহার: বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহারই পারে এই সংকটমুক্তি ঘটাতে। অব্যাহত রাখতে হবে শিল্প-সাহিত্যের চর্চাকে, আর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নগরায়ণকে। মনে রাখতে হবে বিজ্ঞানের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য বিজ্ঞান। তবেই তৈরি হতে পারে শঙ্কামুক্ত এক সুন্দর পৃথিবী।
8. কম্পিউটার ও আধুনিক পৃথিবী
উত্তর –
“নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র”।
—মুক্তধারা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: মানবসভ্যতার গতিপথকে পালটে দেওয়া বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হল কম্পিউটার। মানুষের জ্ঞান এবং প্রচেষ্টার সীমানাকে বহুদূর অবধি বিস্তৃত করে দিয়েছে কম্পিউটার। পুরোনো পৃথিবীর সঙ্গে নতুনের সীমাহীন ব্যবধান তৈরি করে মানবসভ্যতার সামনে এই কম্পিউটারই হাজির করেছে এক শিহরণ জাগানো ভবিষ্যতের ছবি, যা কিছু বছর আগেও মানুষের ভাবনাচিন্তার বাইরে ছিল।
আবিষ্কার: অনেকে মনে করেন খ্রিস্টের জন্মেরও আগে ‘অ্যাবাকাস’ নামে যে গণনাপদ্ধতি প্রচলিত ছিল তার মধ্যেই নিহিত আছে কম্পিউটারের আদি ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ গণিতজ্ঞ চার্লস ব্যাবেজকে ‘কম্পিউটারের জনক’ বলা হয়। ১৯৩০-এ হওয়ার্ড আইকেন এবং গ্রেস হপার সাধারণের ব্যবহারের উপযোগী কম্পিউটার তৈরি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে, ব্রিটেনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের দ্রুত বিবর্তন ঘটে। সেখান থেকে এখন মানবসভ্যতা এসে পৌঁছেছে পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারে।
ভারতে কম্পিউটার: ভারতে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কম্পিউটার আসে। কিন্তু আটের দশক থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় স্তরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পৃথিবীতে কম্পিউটার উৎপাদনে ভারত যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে তেমন কম্পিউটার গবেষণায় ন্যাশনাল সেন্টার ফর সফটওয়্যার টেকনোলজি, টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়—প্রতিষ্ঠানগুলি নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
কম্পিউটারের প্রয়োগ: আধুনিক সভ্যতায় কম্পিউটারের প্রয়োগ সর্বত্র। যে-কোনো হিসাবনিকাশে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে, মুদ্রণ শিল্পে কম্পিউটারের ব্যবহার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। উপগ্রহ যোগাযোগ, যান চলাচলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা সবই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। আবার রেল-বিমানের আসন সংরক্ষণ থেকে টেলিফোন, ইলেকট্রিক বিল প্রদান—ব্যক্তিগত জীবনেও কম্পিউটারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কম্পিউটারের সাহায্যেই আন্তর্জাতিক সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার চলে আসে ঘরের মধ্যে। তাই হাটে-বাজারে, অফিসে আদালতে, স্কুল-কলেজে কম্পিউটারের আজ সর্বাত্মক ব্যবহার ঘটছে। ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, পামটপ ইত্যাদি নানা চেহারায় কম্পিউটার আজ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
অন্য কথা: কম্পিউটার অসম্ভবের সীমারেখাকে প্রায় মুছে দিয়েছে। কিন্তু এই কম্পিউটারই মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিয়ে মানবসম্পদের সংকট তৈরি করেছে। কম্পিউটার মানুষকে শুধু যন্ত্রনির্ভরই করেনি, জীবনযাপনের অন্য উপকরণগুলি যেমন, বইপড়া, ছবি আঁকা এসব থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সিনেমা, গান ইত্যাদিকে কম্পিউটার এতটাই সহজলভ্য করে দিয়েছে যে, এদের কেন্দ্র করে যে ব্যাবসা হয় তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘকালীন কম্পিউটারের ব্যবহার নানা শারীরিক সমস্যাকেও ডেকে আনছে।
উপসংহার: কম্পিউটার ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলি দেখলে কম্পিউটার সম্পর্কে বিরূপ ধারণাগুলিকে নিতান্তই ছোটো মনে হয়। একুশ শতকের গতিশীল পৃথিবীর কম্পিউটার কোনো অলংকার নয়, মস্তিষ্ক। তাই এর সার্থক ব্যবহার এবং উন্নতিতে আত্মনিয়োগই আধুনিক মানবসভ্যতার অনিবার্য নিয়তি। মার্কিন লেখক যোশেফ ক্যাম্পবেল হয়তো যথার্থই বলেছেন—”Computers are like Old Testament Gods; lots of rules and no mercy.”
৫. পরিবেশদূষণ ও তার প্রতিকার
উত্তর –
“এই নদী, এই মাটি বড়ো প্রিয় ছিল/ এই মেঘ, এই রৌদ্র, এই বাতাসের উপভোগ/ আমরা অনেক দূরে সরে গেছি, কে কোথায় আছি?”
—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ভূমিকা: একুশ শতকের পৃথিবী যে বিপদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন সর্বনাশের প্রহর গুনছে তার নাম পরিবেশদূষণ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে গতিশীল এই সভ্যতা দূষণের আক্রমণে প্রতিমুহূর্তে যেন মৃত্যুর হিমশীতলতাকে অনুভব করছে।
পরিবেশ: যে পরিমণ্ডলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীজগৎ বেঁচে থাকে ও বড়ো হয়ে ওঠে তাকেই তার পরিবেশ বলে। প্রাণীজগৎ ও প্রকৃতিজগতের সমন্বয়ে পরিবেশ গঠিত হয়। চারপাশের গাছপালা, নদীনালা, অরণ্য, পাহাড় কিংবা মরু অঞ্চল মিলে তৈরি হয় মানুষের পরিবেশ। অধ্যাপক সি সি পার্ক বলেছেন—“কোনো বিশেষ সময়ে ও বিশেষ স্থানে মানুষের চারপাশে ঘিরে থাকা সামগ্রিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে।”
পরিবেশের দূষণ: পরিবেশ যখন নানা নেতিবাচক কারণে প্রভাবিত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাকেই পরিবেশদূষণ বলে। পরিবেশদূষণের ফলে পরিবেশের গুণগত মানের অবনমন ঘটে। প্রাকৃতিক দুষণের ক্ষেত্র অনুসারে পরিবেশদূষণকে বায়ুদূষণ, জলদূষণ, মৃত্তিকাদূষণ, শব্দদূষণ ইত্যাদি নানা ভাগে ভাগ করা যায়।
দূষণের কারণ: কলকারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি ক্রমাগত বায়ুকে দুষিত করে চলেছে। শিল্পজাত ও কৃষিজাত বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ, গৃহস্থালির আবর্জনা ইত্যাদি জলদূষণ ঘটাচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, শিল্পের বর্জ্য পদার্থ  ইত্যাদি মাটিতে মিশে গিয়ে মৃত্তিকাদূষণ ঘটাচ্ছে। যানবাহনের শব্দ, শব্দবাজির ব্যবহার, লাউডস্পিকারের শব্দ ইত্যাদি শব্দদূষণের কারণ।
দূষণের ফলাফল: পরিবেশবিজ্ঞানী সেম্পল মানুষকে বলেছিলেন ‘ভূপৃষ্ঠের ফসল’ এবং ‘প্রকৃতির সন্তান’। স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশের বিপর্যয় মানব জীবনকে দারুণভাবেই প্রভাবিত করে। ১. শারীরিক অসুস্থতা: এই দূষণের কারণেই দেখা দেয় ফুসফুস, হৃদযন্ত্রের নানা অসুখ। জল ও মৃত্তিকাদূষণ কলেরা, হেপাটাইটিস, টাইফয়েড এরকম নানা অসুখকে নিশ্চিত করে। ২. বিশ্ব উয়ায়ন: শিল্পসভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত উন্নতির ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে, যা কিনা বিশ্ব উন্নায়নের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মেরুপ্রদেশের বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধ্বংসের বার্তা নিয়ে আসছে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ শ্রেণির অরণ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ৩. বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি পরিবেশদূষণের অন্যতম ফলস্বরূপ পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে প্যাসেঞ্জার পিজিয়ন, তোসমানিয়ান টাইগার, কোয়াগ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, টেকোপা পাপ-এর মতো মাছ।
প্রতিকারের পথ: পরিবেশদূষণ প্রতিরোধের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দূষণের কারণগুলিকে খুঁজে নিয়ে সেগুলি রোধে সচেষ্ট হওয়া। যেমন, যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণ, অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে বায়ুদূষণ ঠেকানো যায়। জৈব সারের ব্যবহার মৃত্তিকাদূষণ কমায়। তবে দূষণ প্রতিরোধে সবথেকে কার্যকরী হল নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করা এবং সামাজিক বৃক্ষরোপণ। নাগরিক সচেতনতা এবং প্রশাসনিক সক্রিয়তা—এই দুয়ে মিলে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: একুশ শতকের সভ্যতার কাছে চাঁদে পৌঁছে যাওয়া যতটা গুরুত্বের বিষয় তার থেকেও পৃথিবীকে রক্ষা করা অনেক বেশি প্রয়োজনের। অনেকগুলো শীর্ষসম্মেলন পার করেও পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কেরা কোনো নিশ্চিত আশার বাণী শোনাতে পারেননি। শঙ্কার এই দিনযাপনই আজকের সভ্যতার নিয়তি।
৬. বিজ্ঞান ও কুসংস্কার
উত্তর –
“Superstition is to religion what astrolog is to astronomy-the mad daughter of a wise mother.”
-Voltaire
ভূমিকা: বিজ্ঞানমনস্কতা আর বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা -এ দুয়ের মধ্যে অনেক তফাত রয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিষয় সম্পর্কে কোনো ব্যক্তি অবহিত হলেই যে তিনি বিজ্ঞানমনস্কও হয়ে উঠবেন, এমনটা নয়। আসলে বাইরের জগতের বস্তুতান্ত্রিক নিয়মের কার্যকারণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করেই বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর সব ঘটনাই যে এই কার্যকারণ সম্পর্কের আওতায় পড়ে, এই সহজ যুক্তিকাঠামোটিকে উপলব্ধি করা এবং সেই অনুযায়ী নিজের জাগতিক ও মানসিক যুক্তিবোধ গড়ে তোলা—এই-ই হল বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ।
সংঘাত: পৃথিবীর সহজ সত্যিগুলোকে মানুষ যখন কুসংস্কারের অন্ধকারে ঢেকে ফেলে, নিজের চোখ বা কানের চেয়েও অন্যের বলা কথাকে চটকের জোরে সত্যি বলে মানতে থাকে, তখনই তৈরি হয় যুক্তি আর সংস্কারের মধ্যে সংঘাত। অন্য সব প্রাণীর চেয়ে মানুষ যেখানে তার বুদ্ধিবৃত্তি ও বিচারশক্তির জোরে, উৎকর্ষ লাভ করেছে, সেখানেই বিজ্ঞানমনস্কতার সূত্রপাত বার হাত ধরে লক্ষকোটি বছরব্যাপী বিবর্তনের ধারায় মানুষ পৃথিবীতে হয়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ প্রাণী। অথ্য বিজ্ঞানের এই বলতো গতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার।
কুসংস্কারের কারণ: আসলে সভ্যতার আদিপর্বে মানুষ যখন বনবাসী, তখন প্রকৃতির কাছে সে ছিল নিতান্তই অসহায়। তার না জানা ছিল প্রকৃতিকে কাজে লাগানোর শক্তি, না জানা ছিল সেই দুর্যোগের কারণ। সে শুধু অজানা ভরে শঙ্কিত হত, বাঁচার রাস্তা খুঁজত। বিশাল প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি তু মানুষের তখন স্বাভাবিকভাবেই ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রমবোধ জাগত। সেই সম্ভ্রমবোধ থেকে মানুষ সেই শক্তির কাছে নতজানু হওয়া শুরু করল। তার নিজস্ব বোধবুদ্ধির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে সেই কাল্পনিক অপদেবতাদের শান্ত করার জন্য কিছু কল্পিত আচার, ক্রিয়াকর্ম সে পালন করতে লাগল। এভাবেই শুরু হয় আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শক্তির ওপর মানুষের অন্ধবিশ্বাসমূলক নির্ভরতার যুগ।
কুসংস্কারের ধরন: কিন্তু, আজও যখন বিজ্ঞানের রথের ঢাকা এগিয়ে গেছে বহুদূর, তবুও আমাদের মধ্যে এই কুসংস্কারের ধারা অব্যাহত। আজও হাঁচি, কাশি, জাতিভেদ, বর্ণভেদ, তাবিজ, কবচ, তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, ডাইনি—সবমিলিয়ে সমাজ করিপ্রার। সেজন্যেই মাউসে ক্লিকরত আঙুলে চকচক করে ওঠে হরেক আংটির ছটা। কার্যকারণ সূত্রের মধ্য দিয়ে সত্যে পৌঁছোনোর চেয়ে, চটজলদি সুখের জন্য হাপিত্যেশ করে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ, আজ পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতেই বেশি স্বস্তি বোধ করেছে। কলে ভদ্ভদের জুয়াচুরির হারও বেড়ে গেছে।
উপসংহার: কুসংস্কারের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই, আছে বিজ্ঞানচেতনার। যুক্তি, মুক্তচিন্তা ও কার্যকারণ সূত্রের মিশেলই মানুষকে এক স্বচ্ছ পৃথিবীর সন্ধান দিতে পারে, বলতে পারে—
‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ
৭. দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান
উত্তর – ভূমিকা: মানুষ যেদিন পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বালাতে শিখল, সেদিন থেকেই শুরু হল তার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথে যাত্রা। আগুন আবিষ্কারই মানুষের বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পথে প্রথম পদক্ষেপ। এইভাবে সভ্যতা যত এগিয়ে চলল, বিজ্ঞানের জয়রথও হল গতিশীল। আর আধুনিক যুগ তো সম্পূর্ণভাবেই বিজ্ঞাননির্ভর। বিজ্ঞান ছাড়া মানুষের এক পা-ও অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা নেই। প্রযুক্তি হল সেই বিজ্ঞানেরই প্রয়োগ।
প্রতিদিনের জীবনে বিজ্ঞান: সকালে খবরের কাগজ আর এক কাপ চা দিয়ে জীবন শুরু তো অনেকদিন আগে থেকেই চলে আসছে। মাথার ওপর ফ্যান, রাতে বিদ্যুতের আলো, বাস, ট্রাম, ট্রেন, প্লেন—এগুলো তো বহুদিন আগেই আবিষ্কার হয়েছে। প্রতিদিন এগুলোকে ব্যবহার করেই আমরা দৈনন্দিন জীবনকে আরামদায়ক ও গতিশীল করেছি। ঠিক এই মুহূর্তে আমরা এতটাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর যে, এক পা এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, একজায়গায় দাঁড়িয়ে একটু নড়তেও পারি না। আমাদের আজকের জীবন সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞাননির্ভর। রান্নার কাজটাও এখন মানুষকে করতে হয় না, করে দেয় মাইক্রোওভেন। ইনটারনেটের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন সাইট থেকে অনলাইনে অর্থাৎ বাড়ি বসে জিনিস কেনাবেচা করা, এ ছাড়া ইনটারনেট ব্যাংকিংয়ের সাহায্যে টাকা জমা দেওয়া, ইলেকট্রিক ও টেলিফোনের বিল জমা দেওয়া এইসবই এখন আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। শুধু তাই নয়, নবপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রোগ নির্ণয়ের বন্ধু পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসেই আমরা জেনে নিতে পারি ডাউন রাজধানী এক্সপ্রেস এখন কোথায় আছে। রেল বা প্লেনের টিকিট কাটতে এখন আমাদের আর লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয় না। বাড়ি বসেই সব পাওয়া যায় মোবাইলের বোতাম টিপে। বলা যায় আমাদের আধুনিক জীবন একশো ভাগই বিজ্ঞাননির্ভর।
অতিরিক বিজ্ঞাননির্ভরতার কুফল। বিজ্ঞান প্রগতির ধারক ও বাহক এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু অতিরিক্ত বিজ্ঞাননির্ভরতা মানুষকে চেষ্টাহীন জড় পদার্থে পরিণত করছে। তার মাথা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নব নব সৃষ্টির আবেগ এবং সংগ্রামী চেতনা। এর ফলে মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কও শিথিল হয়ে পড়ছে। মানুষ যন্ত্রের ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেই যেন একটা যন্ত্র হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যাচ্ছে তার আবেগ। তাই সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন“বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।” আবেগহীন মানুষ তো যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
উপসংহার: এমন দিন বোধহয় আর বেশি দূরে নেই, যেদিন বিজ্ঞানই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এ কথাও অনস্বীকার্য যে, বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন একেবারেই অচল। বিজ্ঞানের সাহায্যেই আমরা বহু প্রতিকূলতাকে অনায়াসে অতিক্রম করতে সক্ষম হচ্ছি। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞাননির্ভরতা আমাদের মানবিক বোধকে যেন নষ্ট না করে। বাইরের জগৎকে আলোকিত করার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান যেন আমাদের অন্তরকেও জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে তোলে।
৮. বনসৃজন ও পরিবেশরক্ষা
উত্তর –
“আয় আমাদের অঙ্গনে অতিথি বালক তরুদল— /
মানবের স্নেহ সঙ্গে নে, চল্ আমাদের ঘরে চল।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: গাছই হল পৃথিবীতে প্রাণের অগ্রদূত। তাই মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই বৃক্ষশ্রেণি মানুষের জন্য খাদ্য ও শীতল ছায়া সৃষ্টি করে প্রতীক্ষা করছিল তার আবির্ভাবের। পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পরে অরণ্যই সেদিন তাকে দিয়েছিল খাদ্য, ছায়া, বিশুদ্ধ অক্সিজেন ও নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু কালক্রমে মানুষই অরণ্য ধ্বংস করে পৃথিবীকে বৃক্ষহীন করে তুলেছে। তবে ক্রমশ মানুষ বুঝেছে এভাবে অরণ্যের ধ্বংসসাধন আত্মহননেরই নামান্তর। বৃক্ষসৃজন মানুষের সেই বোধোদয় ও শুভবুদ্ধিরই প্রকাশ।
বৃক্ষরোপণের উদ্দেশ্য: মানুষ অরণ্য বিনাশের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জলবায়ুকে নষ্ট করেছে। বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে বায়ুস্তরে দুষিত কণা ও উপাদানের পরিমাণ বাড়ে, বৃষ্টিপাত ও ঋতুচক্রের চরিত্র বদলে যায়। ফলে প্রকৃতির সার্বিক তাল-মিলের ছন্দপতন ঘটে।
অরণ্য ও ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ: ভারতীয় সভ্যতা অরণ্যনির্ভর। অরণ্যে ঢাকা শ্যামল পটভূমিকায় স্থাপিত তপোবনই ছিল এই সভ্যতার অন্যতম পীঠস্থান। জনভূমি ও বনভূমির মধ্যে ছিল আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার নগরকেন্দ্রিকতা অরণ্যকে ধ্বংস করে তার ওপর ইট-কাঠপাথরের কৃত্রিম ইমারত স্থাপন করে মানবজাতির কবর রচনা করেছে। ভারতীয় বিজ্ঞানীই প্রমাণ করেছেন যে, গাছেরও প্রাণ আছে। নাগরিকতায় ক্লান্ড কবিও প্রার্থনা করেছেন, “দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর।”
পরিবেশ রোধ ও বনভূমি। মানুষ তার নিশ্বাসের মাধ্যমে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে উদ্ভিদ তা গ্রহণ করে পরিবেশে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। কলকারখানা ও গাড়িঘোড়া থেকে নির্গত দুষিত ধোঁয়া পরিশোধনেও অরণ্য সাহায্য করে। তা ছাড়া ভূমিক্ষয় রোধের দ্বারাও অরণ্য প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
বনসৃজনের উপযোগিতা। অক্সিজেন থেকে শুরু করে খাদ্য বাসস্থান ওষুধ পর্যন্ত সবই অরণ্যের অবদান। যান্ত্রিক সভ্যতার বিস্তার ও অরণ্যনিধনের ফলে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার ভারসাম্য এখন নষ্টের মুখে। বনসৃজনই এর অন্যতম প্রতিকার। তাই আজ বনভূমি ধ্বংস নয়, বনভূমি সৃজনই হোক মানুষের অন্যতম প্রতিশ্রুতি।
সামাজিক বনসৃজন: বর্তমানে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য সামাজিক বনসৃজনের কর্মসূচি গ্রহণ করে বলা হয়েছে, “একটি গাছ একটি প্রাণ।” এই উদ্যোগকে সফল করতে প্রয়োজন আবশ্যিকভাবে বৃক্ষরোপণ এবং একটি বৃক্ষচ্ছেদনের আগে দুটি করে গাছ লাগানো। বৃক্ষরোপণ উৎসব: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আধুনিক ভারতে বৃক্ষসৃজন উদ্যোগের প্রথম ও অন্যতম প্রবর্তক। শান্তিনিকেতনে তাঁর কবিজীবনের গভীর উপলখিকে রূপ দান করতে গিয়ে তিনি জানান,
“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ।
ধূলিরে ধন্য কর করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ।।”
বর্তমান ভারতে শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বে কবি প্রবর্তিত এই বৃক্ষরোপণ উৎসবের উপযোগিতা স্বীকৃতি লাভ করেছে।
উপসংহার: বনসৃজন সমবেত মানুষের উদ্যোগ। বৃক্ষের উপযোগিতা উপলব্ধি করে বৃক্ষচ্ছেদের পরিবর্তে অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে উদ্যোগটি ধরে রাখতে হবে। সভ্যতা, প্রকৃতি ও পরিবেশের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থেই সকলের এগিয়ে আসার প্রয়োজন আছে।
৯. একটি গাছ, একটি প্রাণ
উত্তর –
“অৰ্থ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান/ প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ,/ ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা/ ছন্দহীন পাষাণের বক্ষ পরেচ আনিলে বেদনা/ নিঃসার নিষ্ঠুর মরুতলে।”
—বৃক্ষবন্দনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: সৃষ্টির ঊষালগ্নে এই পৃথিবীতে ছিল একমাত্র গাছ শুধুই অরণ্য। তারপর একসময় এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়। তখনকার প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ প্রাণ ধারণ করেছিল একমাত্র গাছকে আশ্রয় করেই। তারা গাছের ছাল দিয়ে বস্তু তৈরি করে, গাছের ফলমূল খেয়ে গাছের কোটরে বসবাস করতে শুরু করে। এভাবেই তারা তখন জীবন কাটাত। বৃক্ষই একদিন মরু পৃথিবীর বুকে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে ‘মরুর দারুণ দুর্গ হতে মৃত্তিকাকে মুক্তি দিয়েছিল। তাই বৃক্ষই আমাদের আদিপ্রাণ।
বৃক্ষচ্ছেদন ও কারণ: প্রাচীন কালে মানুষ যে-কোনো পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বৃক্ষরোপণ করত। পুত্র জন্ম নিলে তার মঙ্গলের কথা ভেবে বৃক্ষরোপণ করা হত। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার অরণ্যবাসী জীবন ছেড়ে হয়েছে সামাজিক। ক্রমে জনসংখ্যা বেড়েছে। মানুষ অরণ্য কেটে তৈরি করেছে শহর, নগর। আধুনিক সভ্যতার প্রয়োজন মেটাতে আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, যানবাহন প্রভৃতি তৈরির উদ্দেশ্যে ক্রমেই অরণ্যের ধ্বংস সাধন করা হয়েছে। এখনকার যান্ত্রিক সভ্যতায় আমরা অতিমাত্রায় যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি। মানবজীবনে বৃক্ষের গুরুত্ব বা উপযোগিতা ভুলে গেছি।
মনুষ্যজীবনে বৃক্ষের অবদান: মনুষ্যজীবনে বৃক্ষের অবদান প্রচুর। বৃক্ষের আশীর্বাদস্বরূপ আমরা বসবাসের গৃহ, আসবাবপত্র, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, ওষুধ প্রভৃতি পাই। সর্বোপরি বৃক্ষ আমাদের পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের জোগান দেয়। দ্বিতীয়ত, গাছ ভূমিক্ষয়ে বাধা দেয়। তৃতীয়ত, গাছই আমাদের এই বিশাল জীবজগতের খাদ্য ও শক্তির প্রধান উৎস। গাছের মধ্যে যে শক্তি নিহিত থাকে, কাঠ, কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা তা পেয়ে থাকি। চতুর্থত, এই বনজসম্পদ থেকেই বিভিন্নপ্রকার জীবনদায়ী ওষুধ প্রস্তুত হয়, যেমন—কুইনাইন, রেসারপিন, অ্যাট্রোপিন ইত্যাদি। ম্যাপল গাছের পাতার সংস্পর্শে এসে আমাশয়ের রোগজীবাণু বিনষ্ট হয়। অরণ্য সম্পদের ধ্বংসের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন (O3) স্তরের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং ওই স্তর ভেদ করে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট (UV) রশ্মি আমাদের গায়ে সরাসরি এসে পড়ছে। এর ফলে নানাবিধ চর্মরোগ, এমনকি ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য রোগও হচ্ছে। এককথায় বায়ুদূষণ প্রতিরোধ, মৃত্তিকাক্ষয় প্রতিরোধ, জলের পূর্ণ ব্যবহার ও পরিবেশের আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম।
অরণ্য সংরক্ষণ: অরণ্য সংরক্ষণের সহজতম অথচ শক্তিশালী উপায় হল বনমহোৎসব। রবীন্দ্রনাথ বনমহোৎসবের আহ্বান করেছিলেন এই বলে— “মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে/হে প্রবল প্রাণ/ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে/হে কোমল প্রাণ।” আজ এই পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশে প্রধান জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হয় কাঠ। কাজেই সভ্যসমাজের ব্যাবহারিক চাহিদা মেটাতে আমাদের গাছ কাটতেই হবে। সেক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে বনভূমি সৃজনের প্রয়োজন। এই কাজের একমাত্র পথ বনমহোৎসব বা বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন। ভারতে অরণ্যসৃজনের চেয়ে অরণ্যধ্বংসের হার বেশি। যেখানে বিগত ২০-২১ বছরে ভারতে প্রায় ৩৮-৪০ লক্ষ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে বনসৃজন হয়েছে মাত্র ২৩-২৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে।
বনমহোৎসব: ভারতের বনাঞ্চলের আয়তন বেশ কম। যেখানে বনের পরিধি হওয়া উচিত মোট ভূভাগের ১/৩ অংশ, সেখানে ভারতের বনাঞ্চলের পরিধি মোট ভূভাগের মাত্র ১/৬ অংশ। এই ১/৩ অংশের মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ মনুষ্যসৃষ্ট। ভারতের মোট রাজস্বের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা আসে বনজসম্পদ থেকে। যে জ্বালানি সম্পদে ভারত ঐশ্বর্যশালী তার প্রায় ৬০ শতাংশ হল বনজসম্পদের দান।
উপসংহার: বৃক্ষ আমাদের আদিপ্রাণ, আমাদের রক্ষাকর্তা। তাই তাকে রক্ষার জন্য সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। ধ্বংসপ্রায় অরণ্য যেন মমতাময়ী জননীর ন্যায় আজও আমাদের হাতছানি দেয় – “হানো যদি কঠিন কুঠারে,/তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে/ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন।”

ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি

১. খেলাধুলায় বাঙালি
উত্তর – ভূমিকা: বাঙালির সংস্কৃতিতে যেমন গান আছে, কবিতা আছে, তেমনই খেলাধুলাও তার জীবনচর্চার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দেশের মধ্যে তো বটেই, আন্তর্জাাতিক ক্ষেত্রেও বাঙালি নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বারে বারে। দলগত এবং ব্যক্তিগত দু-ধরনের ক্রীড়াক্ষেত্রেই বাঙালির বর্ণময় করেছে।
সাফল্যের অজস্র নিদর্শন জাতির ইতিহাসকে ফুটবলে বাঙালি: ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির যোগ রক্তের। মোহনবাগানইস্টবেঙ্গলকে নিয়ে বাঙালির যে উন্মাদনা তা পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের ফুটবল দর্শকদের আবেগকে ছুঁয়ে যেতে পারে। প্রিয় দল পরাজিত হলে এখানে উমাকান্ত পালধির মতো সমর্থক আত্মহত্যা করেন। ফুটবল-উন্মাদ এই জাতির ঐতিহাসিক গর্বের মুহূর্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইয়র্ক রেজিমেন্টকে হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়। স্বাধীনতার আগে সেদিন আর-এক স্বাধীনতার আনন্দই যেন বাঙালি উপলব্ধি করেছিল। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আসিয়ান কাপ জয় করেছিল। ভারত থেকে এশিয়ান ক্লাব পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সব থেকে বেশিবার প্রতিনিধিত্ব করেছে ইস্টবেঙ্গলই। জাতীয় স্তরের রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতা সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা ৩১ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গোষ্ঠ পাল, শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী, প্রদীপ ব্যানার্জী থেকে সুব্রত ভট্টাচার্য, কৃশাণু দে, কিংবা সুব্রত পাল— সেকাল-একাল মিলিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অজস্র সফল ফুটবলারের জন্ম দিয়েছে এই বাংলা।
বাঙালির ক্রিকেট: এ কথা ঠিক যে ক্রিকেটে ফুটবলের মতো আধিপত্য বাঙালি কোনোদিনই দেখাতে পারেনি। রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতা রঞ্জি ট্রফিতে ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলাকে পরের বারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অর্ধশতকেরও বেশি। কিন্তু পঙ্কজ রায়, সুঁটে ব্যানার্জী, উৎপল চ্যাটার্জী প্রমুখ বাঙালি খেলোয়াড়রা নানা সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। তবে বাংলার ক্রিকেটকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন দেশের সর্বকালের সফল অধিনায়কদের অন্যতম সৌরভ গাঙ্গুলি।
অন্যান্য খেলাধুলায় বাঙালি: ভারতীয় কুস্তিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন যতীন্দ্রচরণ গুহ বা গোবর গুহ। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন মিহির সেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে এই সাফল্য পেয়েছেন মাসুদুর রহমান বৈদ্যও। মেয়েদের মধ্যে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন আরতি সাহা, বুলা চৌধুরি। টেবিল টেনিসেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু বিখ্যাত প্রতিভার জন্ম দিয়েছে বাংলা ৷ অরূপ বসাক, অর্জুন দত্ত থেকে এখনকার মাণ্ডু ঘোষ, পৌলমি ঘটক—এর অন্যতম। লন টেনিসে ভারতের চিরকালীন শ্রেষ্ঠ প্রতিভা লিয়েন্ডার পেজ বাঙালি না হলেও বাংলার। দাবা খেলায় বাংলা উপহার দিয়েছে দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সূর্যশেখর গাঙ্গুলি, সন্দীপন দাস এবং আরও অনেক গ্র্যান্ডমাস্টারকে। অ্যাথলেটিক্সে এশিয়ান গেমস থেকে দেশকে পদক এনে দিয়েছেন জ্যোতির্ময়ী শিকদার, সুস্মিতা সিংহরায়, স্বপ্না বর্মন। তিরন্দাজিতে ২০০৭-এ বাংলার মেয়ে দোলা ব্যানার্জী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
উপসংহার: একদিকে নগরায়ণের চাপে খেলার মাঠগুলি চুরি হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পড়াশোনার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলার সময়। তার ফলে বাঙালির নতুন প্রজন্ম এখন খেলাধুলা, শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই জাতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য, পুরোনো অহংকারকে পুনরুদ্ধারের জন্য এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
২. বাংলার মেলা
উত্তর –
“সোনালি রুপোলি মানুষের শিশু/ মানুষের সঙ্গে সমুদ্রে যায়../ ওদের যাওয়া দরকার।”
—শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা: মিলনের আকুতি থেকেই মেলার সৃষ্টি। ধরাবাঁধা দৈনন্দিনতা থেকে মুক্ত হয়ে সম্প্রীতির সূত্র ধরে পরস্পরের হাত ধরা, আনন্দকে ভাগ করে নেওয়া মেলার মূল কথা। বাংলা দেশের শ্যামল সবুজ জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষ এমনিতেই অনুভূতিপ্রবণ। তাই এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলার যোগও অত্যন্ত প্রাচীন কাল থেকে। ধর্ম, লোকাচার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে, কখনও বা সমাজজীবনের নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলা দেশে মেলার বিস্তার ঘটেছে।
ধর্ম ও লোক-উৎসবকেন্দ্রিক মেলা: গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেছিলেন— “বাংলাদেশের মর্মে মর্মে ধর্ম…”। বাংলার মানুষ অসংখ্য লোকদেবতার পুজো করে। বছরের বিভিন্ন তিথিতে নির্দিষ্ট দেবতার পুজোকে উপলক্ষ্য করে বাঙালি উৎসবে মাতে। সেইসব দেবদেবীর মধ্যে শীতলা, চণ্ডী, সত্যপীর, মনসা কত কিছুই আছে। আর এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবেই মেলার আয়োজন হয়। কোচবিহার কিংবা নদিয়ার শান্তিপুরে রাসযাত্রা উপলক্ষ্যে হয় রাসমেলা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগরে পৌষের শেষে হয় গঙ্গাসাগর মেলা। জলপাইগুড়িতে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে হয় জল্লেশের মেলা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় টুসু পরব উপলক্ষ্যে মেলার আসর বসে। বীরভূমের কেঁদুলিতে জানুয়ারি মাসে হয় বাউল মেলা, নদিয়ার আসাননগরের কদমখালিতে হয় লালন মেলা। এইসব মেলায় ধর্ম আচরণের থেকেও বাউল-ফকির-মুরশিদি শিল্পীদের গান এবং সম্মেলনে লোকসংস্কৃতির প্রাণবৈচিত্র্যেরই প্রকাশ ঘটে। পূর্ব মেদিনীপুরে মাঘ মাসে হয় ভীম মেলা, চৈত্রে চড়কের মেলা। পশ্চিম মেদিনীপুরে হয় গাজনের মেলা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত আর একটি মেলা হল বিন্নুপুর মেলা। একদা মল্লরাজাদের রাজধানী বিন্নুপুরে প্রতিবছর ডিসেম্বরের শেষে অনুষ্ঠিত হয় বিন্নুপুর উৎসব। উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলন এবং ধ্রুপদি নৃত্যের দর্শনী এর উল্লেখযোগ্য দিক। ভারত সরকার একে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দিয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয় বিন্নুপুর মেলা।
নগরায়ণ ও মেলার চরিত্র বদল: যত বেশি নগরসভ্যতার বিকাশ ঘটছে ততই মেলার নতুন নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারিভাবে কোনো এলাকার জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য মেলার আয়োজন হচ্ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে চা এবং পর্যটন উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে দার্জিলিং-এ। দক্ষিণ দিনাজপুরে ফেব্রুয়ারিতে হয় তিস্তাগঙ্গা উৎসব। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বর্ধমানের পানাগড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মাটি উৎসব। এটিকে কেন্দ্র করেও বসছে মেলা।
শহরের মেলা: একুশ শতকের শহরজীবনে সবই প্রয়োজনভিত্তিক। তাই মানুষের জীবনযাপন এবং মানসিক চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা, লিট্ল ম্যাগাজিন মেলা, নাট্যমেলা ইত্যাদি। নাগরিক মনন আর বুদ্ধিচর্চার আদানপ্রদানের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে এগুলি। শুধু শহরে নয়, মফস্সলেও এইসব মেলার প্রসার ঘটছে।
উপসংহার: মেলার মধ্যে মানবজীবন তার স্ফূর্তি খুঁজে পায়। তবে গ্রামীণ মেলার চরিত্র দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সংস্কৃতির বদলের ফলে এই পালটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবুও বাংলার প্রাণময়তার এক বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে মেলার গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
৩. বাংলার কুটিরশিল্প
উত্তর – ভূমিকা: বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঙালির গৌরব। বাউলের গানে, মেয়েদের ব্রতকথায়, ভাদু-টুসুর পরবে, আরও অজস্রভাবে এই যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ঢাকাই মসলিন, বাঁকুড়ার টেরাকোটা, মেদিনীপুরের মাদুর কিংবা কৃয়নগরের মাটির পুতুল। সংস্কৃতি যদি হয় জাতির প্রাণময়তার উৎস, তাহলে সেই শিকড়ের সন্ধানে বাংলার কুটিরশিল্পের কাছে আমাদের যেতেই হবে।
কুটিরশিল্প কাকে বলে?: একজন কারিগর নিজে, পরিবারের লোকজন বা মুষ্টিমেয় দু-একজনকে নিয়ে যদি কোনো শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করেন তাকে কুটিরশিল্প বলা হয়। কুটিরশিল্প সম্পূর্ণ গৃহকেন্দ্রিক। গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা যেমন ছিল কৃষিভিত্তিক, ঠিক তেমনই ছিল কুটিরশিল্প-নির্ভরও। এই শিল্পকে কেন্দ্র করেই সমাজে বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, যেমন— তাঁতি, কুমোর, কামার, শাঁখারি ইত্যাদি। অনেক সময়েই দেখা যেত এক একটি এলাকা একটি বিশেষ দ্রব্য উৎপাদনে খ্যাতি অর্জন করেছে, ওই এলাকার অধিকাংশ পরিবারই যুক্ত থেকেছে সেই বিশেষ শিল্পের সঙ্গে। শিল্পীদের দক্ষতা উৎপন্ন দ্রব্যকে পৌঁছে দিয়েছে উৎকর্ষের শিখরে। তৈরি হয়েছে কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য।
বাংলার কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য; বাংলার কুটিরশিল্পের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্পের কথা। বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া পৃথিবী জুড়ে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণনগরে মৃৎশিল্প প্রসার লাভ করেছিল। শুধু মাটির পুতুল নয়, পণ্ডিতসভা, চড়ক উৎসব ইত্যাদি সামাজিক বিষয়কে মৃৎশিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ডোকরা শিল্প গড়ে উঠেছে। ধাতু দিয়ে মূর্তি, অলংকার ইত্যাদি তৈরি হলে তাকে বলে ডোকরা শিল্প। দেব-দেবীর মূর্তি থেকে অলংকার—ডোকরায় সবই তৈরি হয়। শান্তিনিকেতনে গড়ে ওঠে চর্ম শিল্পের নিজস্ব ঘরানা, মেদিনীপুরের মাদুর শিল্পের খ্যাতিও জগৎবিখ্যাত। চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে ঢাকাই মসলিনের। রোম, গ্রিস, মিশর, ইংল্যান্ডে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। মোগল আমলে এই মসলিন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। মসলিনের শ্রেষ্ঠ রূপ ‘মলমল খাস’, যেখানে একটা গোটা শাড়ি আংটির ভিতর দিয়ে চলাচল করতে পারে। বাঙালি কারিগরের প্রতিভার বিস্ময়কর সৃষ্টি ছিল এই মসলিন। এ ছাড়াও ফুলিয়া এবং শান্তিপুরের তাঁত, বিষ্ণুপুরের বালুচরি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বাংলার কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য বহুদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে।
কুটিরশিল্পের বর্তমান অবস্থা: বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বাংলার কুটিরশিল্পের স্বর্ণযুগ এখন অস্তমিত। ইংরেজের চক্রান্তে বাংলার তাঁত শিল্পের যে সর্বনাশ ঘটেছিল, কৃত্রিম তন্তু থেকে তৈরি শাড়ি আমদানির মধ্য দিয়ে সেই সংকট থেকে তাঁত বা মসলিন শিল্প বেরোনোর পথ পায়নি। একদিকে বাজার ছোটো হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের কারিগরি পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সংকটের মূল কারণ। এর সঙ্গে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি তো আছেই। বিদেশের বাজারে চাহিদা থাকলেও বাংলার কুটিরশিল্প তাই আজ সংকটে।
উপসংহার: সরকারি স্তরে কুটিরশিল্প পুনরুজ্জীবনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ, কাঁচামালে ভরতুকির ব্যবস্থা করা, শিল্পীর উৎপাদিত পণ্য সরকারি সাহায্যে বাজারজাত করা, নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে আকর্ষণীয় করে তোলা—এসবের মধ্য দিয়ে কুটিরশিল্পের হৃত গরিমা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলার সংস্কৃতির এই গৌরবোজ্জল দিকটিকে উপেক্ষার অর্থ নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
8. বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা
উত্তর – ভূমিকা: ইংরেজ আমলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমও হয়েছিল ইংরেজি ভাষা। কিন্তু এর পরিণামে বিজ্ঞানশিক্ষা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। মাতৃভাষার সঙ্গে হৃদয়ের যে সংযোগ তাকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে। তবুও সেই পরাধীন ভারতেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় উদ্যোগী হয়েছিলেন কিছু আলোকিত ব্যক্তিত্ব।
শুরুর কথা: উনিশ শতকের সূচনা থেকেই পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক নানা রচনা বাংলায় অনূদিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে জন ক্লার্ক সম্পাদিত এবং শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত দিগদর্শন পত্রিকা। স্কুল বুক সোসাইটি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে চালু করে একটি প্রাণী বিষয়ক পত্রিকা পশ্বাবলী। এইভাবে খুবই বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা।
বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞান: রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন একজন বিলেতফেরত চিকিৎসক। অন্য অনেক জাতীয়তাবাদী এবং সামাজিক কাজের সঙ্গে মাতৃভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানচর্চা ছিল তাঁর স্বপ্ন। ধাত্রীসহায়, অ্যানাটমি, সংক্ষিপ্ত ভেষজতত্ত্ব, সংক্ষিপ্ত শিশুও বালক চিকিৎসা তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। আর-একজন চিকিৎসক লালমাধব মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেন সি ম্যাকনামারা-র যুগান্তকারী গ্রন্থ এ ম্যানুয়েল অব দি ডিজিজেস অব দি আই, নাম দেন ‘অক্ষিতত্ত্ব’। উনিশ শতকের শেষে বিখ্যাত বিজ্ঞানী চুনীলাল বসু তার গবেষণার পাশাপাশি বেশ কিছু চিকিৎসা ও রসায়ন বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফলিত রসায়ন, রসায়নসূত্র, পল্লীস্বাস্থ্য ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানের ওপরে প্রথম বাংলা বই রচনা করেছিলেন গিরিন্দ্রশেখর বসু।
স্মরণীয় বিজ্ঞানীদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা: পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান বিষয়ক ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর অসামান্য গ্রন্থ অব্যক্ত-তে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছেন হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস, বাঙালির মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার ইত্যাদি গ্রন্থ। প্রফুল্লচন্দ্রের সহকারী প্রিয়দারঞ্জন রায় রচনা করেন অতিকায় অণুর বিচিত্র কাহিনী।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে স্মরণীয় ব্যক্তিগণ: তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত রচনা করেছিলেন ভূগোল, বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চেতনার মিশ্রণে তিনি তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাগুলোকে শিল্পসৃষ্টির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রকৃতি, জিজ্ঞাসা, পদার্থবিদ্যা, বিচিত্রজগৎ, ভূগোলইত্যাদি গ্রন্থে বিজ্ঞান বিষয়ক ভাবনার প্রাণবন্ত উপস্থাপনা লক্ষ করা যায়। বিজ্ঞানের তথ্যকে সহজভাবে পরিবেশন করেছিলেন জগদানন্দ রায়ও। তাঁর গ্রহনক্ষত্র, প্রাকৃতিকী, বৈজ্ঞানিকী, পোকামাকড় ইত্যাদি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার আদর্শ উদাহরণ। বাংলার কীটপতঙ্গ গ্রন্থের রচয়িতা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, নব্যবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যার নবযুগইত্যাদি গ্রন্থের লেখক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়িতে বিজ্ঞানচর্চার এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহ ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ পৃথিবী, সৌরপরিবারবর্তী পৃথিবীইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ে ভাবনার প্রকাশ পাওয়া যায় তাঁর বিশ্ব পরিচয় গ্রন্থে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য আবিষ্কারের চেষ্টা ছিল এই গ্রন্থে।
সাম্প্রতিক কাল: সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যুঞ্জয় প্রসাদ গুহের আকাশ ও পৃথিবী, জিতেন্দ্রনাথ গুহের মহাকাশ পেরিয়ে, দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের মানব কল্যাণে রসায়নইত্যাদি অসংখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বলা যেতে পারে এই ধারাটি এখন ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে।
উপসংহার: বাঙালির নিজস্ব মনন ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ তার বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাগুলি। একদা যে মাতৃভাষাকে বিজ্ঞানচর্চার জন্য অনুপযুক্ত ভাবা হত তাকে আশ্রয় করেই এখন তৈরি হয়েছে সৃজনশীলতার নব-মন্দাকিনী। যে-কোনো বাঙালির কাছেই এ ঘটনা অত্যন্ত গর্বের।
৫. তোমার প্রিয় চলচ্চিত্র
উত্তর –
“চলচ্চিত্র কেবলমাত্র অবসর বিনোদনের সামগ্রী নয়, এটা / একটা সিরিয়াস আর্টও বটে।”
—সত্যজিৎ রায়
ভূমিকা: আমি বই পড়তে যেমন ভালোবাসি, সিনেমা দেখতেও তেমনই ভালোবাসি। দুটোই আমার অবকাশের আকাশকে ভরিয়ে রাখে। কিন্তু সব বই যেমন মনে দাগ কাটে না, তেমনই প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার পর অধিকাংশ সিনেমাই আমরা বিস্মৃত হই। তবে কিছু সিনেমা এর মধ্যেই তার বিষয় ও নির্মাণ দক্ষতায় মনের মধ্যে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। সম্প্রতি এমনই একটা সিনেমা আমি দেখেছি। ছবির নাম ‘চাঁদের পাহাড়’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত একটা অসাধারণ সিনেমা।
কাহিনি: চাঁদের পাহাড় আমার প্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিভূতিভূষণের এই কাহিনি সুদূর আফ্রিকার পটভূমিকায়। সেখানকার প্রকৃতির আদিম সৌন্দর্য, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, পদে-পদে বিপদ আর তারমধ্যে এই বাংলারই গ্রাম থেকে যাওয়া একজন ছেলে, শংকর— সবমিলিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্নালু অথচ রোমাঞ্চকর পরিবেশ রচনা করে। অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে একজন বঙ্গসন্তানের অ্যাডভেঞ্চার পুরো কাহিনিটাকে এক অন্য মাত্রা দেয়।
চলচ্চিত্রায়ণ: উপন্যাসের এই জাদু-বিন্দুগুলোই সিনেমার পর্দায় তুলে এনেছেন পরিচালক কমলেশ্বর। আমার কল্পনার জগৎটাকেই আমি চোখের সামনে তার যাবতীয় রং-রূপ নিয়ে হাজির হতে দেখি। ছবিটির আগাগোড়াই আফ্রিকায় শুটিং করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে একেবারে সত্যিকারের সিংহ, সাপ, জেব্রা এবং হাতি। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কোনো কারসাজি সেখানে নেই। অবশ্য আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের দৃশ্য আর বুনিপকে দেখাতে কম্পিউটার গ্রাফিক্সেরই সাহায্য নিয়েছেন পরিচালক। আসল প্রাণী, জীবন্ত প্রেক্ষাপট আর কম্পিউটারের কৌশলী উপস্থাপনা— সবমিলিয়ে সিনেমার পর্দার ‘চাঁদের পাহাড়’ একেবারে টানটান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। চোখ সরাবার জো থাকে না এতটুকুও। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অভিভূত হয়ে দেখতে হয়। বইটা পড়ার সময় যে রোমাঞ্চ অনুভব করি, সিনেমাটা দেখার সময়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সিনেমার বুনিপ তো আমার কল্পনার বুনিপকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। সেজন্যই এই ছবিটি আমার মনে এত গভীরভাবে রেখাপাত করেছে।
অভিনয়: ছবিটির আর-একটি আকর্ষণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয়। শংকরের ভূমিকায় টলিউডের জনপ্রিয় নায়ক দেব অসাধারণ অভিনয় করেছেন। সিংহ মারার পর তাঁর রক্তস্নানের দৃশ্য এবং কালাহারির মরু অঞ্চলে প্রতিকূল প্রকৃতির মধ্যে একক মানুষ হিসেবে তাঁর তীব্র লড়াইয়ের দৃশ্য, আমি আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন গেরার্ড রুডল্ফ। দক্ষিণ আফ্রিকার এই অভিনেতা আলভারেজের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বইয়ের পাতায় শংকরআলভারেজের জুটির মতোই পর্দায় দেব ও রুডল্ফ পরস্পরকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন। তিরুমলের ভূমিকায় নবীল খানের অভিনয়ও মনে রাখার মতো। মানুষের পাশাপাশি আফ্রিকার সিংহ, বিষাক্ত ব্ল্যাক মাম্বা আর হাতিও দুর্দান্ত অভিনয় করে পুরো ছবিটাকে জমিয়ে দিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের পর্দা সরতেই ইগলের উড়ান আর তারপর হাতির দৌড় শিহরণ জাগায়।
উপসংহার: উপন্যাসের পৃষ্ঠা ধরে ধরে এই চলচ্চিত্র তৈরি হয়নি। তবু এ ছবি দেখার পর উপন্যাস পাঠের আমেজটা ফিরে আসে। ‘চাঁদের পাহাড়’ দেখার পর সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো পাওনা। সারা জীবন এই সিনেমাটার কথা আমার মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল থাকবে।
৬. তোমার প্রিয় উপন্যাস
উত্তর – ভূমিকা: লেখাপড়া, পরীক্ষা আর সিলেবাসের চাপে এখন পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়ার সময় মেলে না। তবুও অবসর পেলেই যে সাহিত্যিকের রচনা আমি উলটে-পালটে পড়ি, তিনি হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ আমার অন্যতম প্রিয় কথাসাহিত্যিক এবং তাঁর লেখা পথের পাঁচালী উপন্যাসটি আমার সবচাইতে পছন্দের। উপন্যাসের কাহিনি: পথের পাঁচালী-তে গ্রামবাংলার একটি অপূর্ব রূপ ফুটে উঠেছে।নিশ্চিন্দিপুর নামের একটি গ্রামের কথা উপন্যাসে বলা হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে অপু নামের এক কিশোর, তার দিদি দুর্গা, মা সর্বজয়া, বাবা হরিহর ও পিসিমা ইন্দির ঠাকরুনকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। পথের পাঁচালী আসলে অপুর বেড়ে ওঠার গল্প। উপন্যাসের ঘটনাক্রমও এগিয়েছে সে কী কী দেখছে, কী কী শুনছে এবং সেগুলি থেকে কী বুঝছে—এইসমস্ত বিষয় অবলম্বন করে। দীর্ঘদিন নিজের পরিচিত গ্রাম্য ঘেরাটোপে থাকার ফলে অপুকে সুদূর অত্যন্ত প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত। এর অন্যতম কারণ ছিল তার কল্পনাবিলাসী মন। দিদির সঙ্গে অপুর যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে উপন্যাসে। দিদিই ছিল তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপনার। অপুর বাবা হরিহর পেশায় যজমান ছিলেন। অত্যন্ত আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত হত। দুর্গার আকস্মিক মৃত্যু অপু, সর্বজয়া এবং হরিহরের জীবনে ছন্দপতন ঘটায়। তারা পা বাড়ায় শহরের দিকে। কাশীতে গিয়ে নতুন করে সংসার বাঁধেন সর্বজয়া। কিন্তু অপুর চিন্তায় ও চেতনায় আজন্ম মিশে থাকে নিশ্চিন্দিপুর। প্রিয় হওয়ার কারণ: পথের পাঁচালীর কাহিনিতে উল্লিখিত গ্রামজীবনের প্রকৃতি, সেখানকার মানুষজনদের সঙ্গে আমি খুব সহজেই একাত্ম বোধ করেছিলাম। ছুটিতে বা সময়-সুযোগ পেলে আমি এখনও নিজেদের গ্রামের বাড়ি চলে যাই। উপন্যাসটি পড়ে আমার এই উপলব্ধি হয় যে, রোজ চোখে পড়ে এমন ঘটনা ও চরিত্রদের নিয়েও কেমন আশ্চর্য সুন্দর আখ্যান লেখা যায়। উপন্যাসের অপু-দুর্গা, অপু-দুর্গার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন সকলেই যেন আমার খুব চেনা পরিচিত হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ঔপন্যাসিকের বর্ণনার দক্ষতা। বিভূতিভূষণের লেখার ভাষা ভীষণ সহজসরল হলেও তার একটি আকর্ষণ ক্ষমতা রয়েছে। পাঠক তাই চট করে লেখা ছেড়ে উঠতে পারে না। অপু-দুর্গার কাশফুলের জঙ্গল পেরিয়ে রেললাইন দেখতে যাওয়ার দৃশ্য, ঝড়ের মধ্যে তাদের আম কুড়োতে যাওয়ার ঘটনা কিংবা দুর্গার মৃত্যুর বর্ণনা ভাষার সৌন্দর্যে কখনও আমাদের বিষণ্ণ করে, কখনও করে বিমর্ষ। নায়ক অপু তার সজীব, সতেজ কিশোর মনের কল্পনায় যা-কিছু ভাবে, চিন্তা করে, যে কারণে দুঃখ পায় কিংবা আনন্দ অনুভব করে—আমিও সেরকম ভাবি। অপুর মতো আমারও অন্যতম প্রিয় চরিত্র ‘মহাভারত’-এর কর্ণ।  অনুভূতিপ্রবণ অপু এবং প্রাণবন্ত দুর্গা ‘পথের পাঁচালী’র অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। অপুর মধ্যে আমি যেন নিজেকে দেখতে পাই।
উপসংহার: বিভূতিভূষণ চমক লাগানো বা জটিল, মনস্তাত্ত্বিক কোনো আখ্যান লিখতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামবাংলার সমাজের যে চালচিত্র অনুপম হয়েও সাধারণের নাগাল ও দৃষ্টির বাইরে ছিল তাকে অবিকলভাবে হাজির করতে। উপন্যাসটি তাই আমার হৃদয়ের খুব কাছের।
৭. তোমার প্রিয় লেখক
উত্তর –
“সাহিত্যের মজা হল যে, যা একবার লেখা হল, সেটা যদি পাঠকদের মনে ধরে যায় তাহলে লেখকের জীবনকালে তিনি যতই আদর পান, তিনি স্বর্গে গেলে, খালি সেরা বইগুলিকেই লোকে মনে রাখে। বাকিগুলো নিয়ে খালি পণ্ডিতরা আর তাঁদের ছাত্ররা মাঝে মাঝে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। কিন্তু যেগুলি সেরা লেখা, সেগুলি সাহিত্যে একটা চিরন্তন আসন পেয়ে যায়।”
—লীলা মজুমদার
ভূমিকা: জ্ঞানের কাঠিন্যকে অতিক্রম করে যাঁর লেখা আমাদের নিয়ে যায় স্বপ্ন-কল্পনার এক মায়াময় জগতে, যাঁর হাত ধরে সহজেই অতি তুচ্ছ রোজকার জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় অনায়াসে—সেই লীলা মজুমদার আমার প্রিয় লেখক।
ভালো লাগার কারণ: কোনো পণ্ডিতি ভাষা, শক্ত গদ্য তাঁর লেখায় পাওয়া যাবে না। সে লেখা পড়লে যেন মনে হয়, গল্প পড়ছি না, গল্প শুনছি স্বয়ং তাঁরই মুখ থেকে। সেসব গল্পের মেজাজ এতই সুন্দর, যে মনে হয় এ যেন আমাদের চেনা পৃথিবীর গল্পই নয়! রসের কারবারি একটি মানুষ তাঁর রসিক চোখে দেখে চলেছেন গোটা পৃথিবী, আর তারপর নিজের সহজাত বর্ণনদক্ষতায় সেইসব গল্প শুনিয়ে আসর জমাচ্ছেন। আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটে তাঁর লেখা চরিত্রদের সঙ্গে। ‘কাগ নয়’ গল্পে ডিমের গায়ে আঁকবাঁকা অক্ষরে, ভুল বানানে লেখা থাকে ‘ডিমের ঠেলা ঠেবি যখণ বুঝবি তখণ বুঝবি’, ‘ময়নাশালিখ’ গল্পে দুই যমজ বোন ময়না আর শালিখ দাদুর সঙ্গে ছুরপি খেতে খেতে পাহাড়ে যায় বাবাকে খুঁজতে, টংলিং’ গল্পে এক আশ্চর্য জায়গার সন্ধান মেলে যার নাম পেরিস্তান, আবার গুপি আর পানু মিলে তাদের ছোটোমামার সঙ্গে জোট বেঁধে নানান রহস্য উদ্ঘাটন করে। তাঁর বাবা ছিলেন বনের জরিপ বিভাগে কর্মরত। বাবার কাছে শোনা বাঘের নানান গল্প, হাতির গল্প জড়ো করে তিনি লিখেছেন বাঘের বই, হাতির বই। খুব ভালোবাসতেন বেড়াল—লিখেছেন বেড়ালের বই।
লিখনশৈলী: তাঁর লেখা ভূতের গল্প তো বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। যত সব অদ্ভুতুড়ে নামক বইতে রয়েছে আশ্চর্য সব ভূতেদের ততোধিক আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা। বেশিরভাগই নিপাট ‘ভালোমানুষ’ শান্তশিষ্ট ভূত—তাদের না আছে রাগ, না আছে ভয় দেখানোর কারসাজি। কেউ কেউ তো আবার এইটাই বুঝে উঠতে পারেনি যে, তারা ভূত হয়ে গেছে। ‘অহিদিদির বন্ধুরা’ গল্পে আবার রয়েছে একদঙ্গল ছানাপোনা ভূত। একা মানুষ অহিদিদির নিঃসঙ্গতা ভোলানোর জন্য প্রতি সন্ধেবেলায় দল বেঁধে তারা অহিদিদির কাছে আসে পরির গল্প শুনতে। আর অহিদিদিও তাদের সাধ মিটিয়ে নিমকি, কুচো চিংড়ি ভাজা, গোলাপি বাতাসা খাওয়ান। আশ্চর্য ভাষা তাঁর, আর তেমনি আশ্চর্য উপমা দেওয়ার ক্ষমতা ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ গল্পে যেমন কখনোই ভোলা যাবে না ‘চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং’-এর কথা, তেমনই ‘বাঘের গল্প’-তে পিসিমার ডবল ডাবের বাড়ি মেরে বাঘ শায়েস্তা করার আশ্চর্য গল্পও রয়েছে। ‘বাতাসবাড়ি’, ‘হাওয়ার দাঁড়ি’, ‘ব্যাঘ্ৰবিজ্ঞান’—এইসব মজায় ভরপুর নানান কল্পবিজ্ঞানের গল্প তাঁর হাতে ফলেছে সোনার মতো।
উপসংহার: সবমিলিয়ে, লীলা মজুমদার এক আশ্চর্য মানুষ—যাঁর হাতে কলম আর কালি হয়ে যায় সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি, যা ছুঁইয়ে পাঠককে তিনি মুহূর্তেই নিয়ে চলেন অচিন দেশের রূপকথায়।
৮. বাংলার উৎসব
উত্তর –
“এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা”
—ঈশ্বর গুপ্ত
ভূমিকা: মানবজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হল উৎসব। মানুষ কেবল খেয়েপরে বেঁচেই সন্তুষ্ট হয় না। সে অনেকের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে চায়, দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি চায়, শ্রমক্লান্ত জীবনে পেতে চায় অনাবিল আনন্দ। আর সেজন্যই মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। উৎসব মানুষকে আনন্দ দেয়, প্রসারিত করে তার অস্তিত্বকে।
ধর্মীয় উৎসব: নানান ধর্মসম্প্রদায়ের বাস এই বাংলায়। সকল সম্প্রদায়ই আপন আপন ধর্মীয় উৎসবে মেতে ওঠে। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপুজো। শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে কয়েক দিনের জন্য ধর্মমত নির্বিশেষে বাঙালিজীবন আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজো ছাড়া কালীপুজো, সরস্বতীপুজো, লক্ষীপুজো, বিশ্বকর্মাপুজো, মনসাপুজো, ধর্মপুজো প্রভৃতিও বাংলার বিশিষ্ট ধর্মীয় উৎসব। এ ছাড়া আরও নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালিত হয় হিন্দুসমাজে। মহরম, ইঁদ, সবেবরাত প্রভৃতি মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবও বাঙালি জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বাঙালি-খ্রিস্টানদের মধ্যে রয়েছে বড়োদিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে প্রভৃতি উৎসব।
সামাজিক-পারিবারিক উৎসব: মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তিগত আনন্দঅনুষ্ঠানকেও সে ভাগ করে নিতে চায় আর পাঁচজনের সঙ্গে। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, উপনয়ন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া—এই পরিবারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলিও শেষপর্যন্ত বাংলার সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। এগুলির মধ্যে দিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সূদৃঢ় হয় সামাজিক বন্ধন।
ঋতু-উৎসব: বিভিন্ন ঋতুতে বাংলা দেশে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণময় উৎসব। এগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল নবান্ন, পৌষপার্বণ, মাঘোৎসব, দোলযাত্রা, নববর্ষোৎসব প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ, বর্ষামঙ্গল, বসন্তোৎসব প্রভৃতি ঋতু-উৎসব বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উদযাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ধারা অনুসরণ করে এই সমস্ত উৎসব আজ শান্তিনিকেতনের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
জাতীয় উৎসব: শুধু ধর্মীয়, সামাজিক-পারিবারিক কিংবা ঋতু-উৎসব নয়, স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, নেতাজি জয়ন্তী ইত্যাদি পালন উপলক্ষ্যে বাঙালি উৎসবে মেতে ওঠে।
উপসংহার: বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। সেজন্যই বাঙালিসমাজে বারো মাসে তেরো পার্বণের সমারোহ। এইসব উৎসব একের সঙ্গে অন্যকে মিলিয়ে দেওয়ার, নিজের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যম। উৎসব আছে বলেই সমস্যাজটিল দুঃখজর্জর জীবনেও বেঁচে থাকার আশ্বাস পাওয়া যায়। উৎসবের মধ্যেই রয়ে যায় বাঙালির প্রাণের পরিচয়।
৯. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
উত্তর –
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?”
—আবদুল গফফর চৌধুরী
ভূমিকা: বাংলা ভাষা আন্দোলন হচ্ছে বাংলা ভাষার অধিকাররক্ষাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) -এ সংঘটিত হওয়া একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারিতে এটি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও অনেক আগে থেকেই এর বীজ বপন শুরু হয়েছিল।
পটভূমি: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-এর ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। আবার পাকিস্তানও ছিল ভৌগোলিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভক্ত। সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও দুটি অঞ্চলের মধ্যে ছিল বিস্তর ব্যবধান। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষাসম্মেলনের ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি মুদ্রা ও ‘ডাকটিকিট থেকেও বাংলা অক্ষর লোপ করা হয়।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া: এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদানের দাবি তোলা হয়।
আন্দোলনের বিস্তার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বয়কট শুরু করে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ ঘটে। ১১ মার্চ থেকে ছাত্রছাত্রী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চরম আকার নেয়। এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, আলি আহাদ, শওকত আলির মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বেরা। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় এসে ২৬ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনকে মুসলিম সমাজের মধ্যে বিভেদ তৈরির ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। তিনি উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে মানুষের বিক্ষোভ, প্রতিবাদআন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে উচ্চকিত কণ্ঠে উর্দুর সপক্ষে সওয়াল করেন। ক্রুদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা চরম আন্দোলনের শপথ নেয়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৪৪ ধারা জারি হয়। নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান আবদুল সালাম, আবদুল বরকত-সহ আরও কয়েকজন। অহিউল্লাহ নামের ৮/৯ বছরের এক শিশুও নিহত হয়। এরপর আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। ২২ ফেব্রুয়ারিতে সরকারের দমননীতির শিকার হয় আরও অনেক সাধারণ মানুষ।
সাফল্য: আন্দোলন চরম সাফল্য পায় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে, যেদিন মুসলিম লিগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।
উপসংহার: পৃথিবীর তাবৎ বাঙালির কাছেই ২১ ফেব্রুয়ারি একটি অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। একে নিয়ে অনেক দেশাত্মবোধক গান, কবিতা, নাটক লেখা হয়েছে। মুনীর চৌধুরির লেখা নাটক ‘কবর’, শামসুর রহমান লিখিত কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ এই সময়ের সাহিত্যিক দলিল হয়ে উঠেছে। এই ভাষা আন্দোলনই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
১০. বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য
উত্তর –
“তপস্বিনী কী তপস্যা করে অনুক্ষণ/ আপনারে তপ্ত করে, ধৌত করে, ছাড়ে আভরণ…/ সূর্য প্রদক্ষিণ করি ফিরে সে পূজার নৃত্যতালে/ ভক্ত উপাসিকা।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ঋতুতে ঋতুতে পৃথিবী পালটে ফেলে তার রূপ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের বিচিত্র দোলনায় দুলে দুলে এগিয়ে চলেছে নতুন দিনের দিকে। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেশে সেজে উঠে সে যেন বন্দনা করে চলে প্রাণপুরুষ সূর্যকে। কখনও তার বুক আগুন গরম, শুষ্ক, কখনও বা হিমস্নিগ্ধ, কখনও আবার কুসুম-কোমল। জলঙ্গির ঢেউয়ে ভেজা এই সবুজ করুণ দেশ—বাংলায় এই মনোরম ঋতুবৈচিত্র্যকে অসামান্য সৌন্দর্যে উপলব্ধি করা যায়।
গ্রীষ্ম: বাংলা পঞ্জিকার প্রথম কয়েকটা পাতাকে আগুনের হলকায় রক্তিম করে তোলে যে ঋতু, তার নাম গ্রীষ্ম। মরুভূমির দহন জ্বালা আদি-অন্ত ভূমিকে করে তোলে দগ্ধ, লেলিহান চিতা শুষে নেয় জীবজগতের প্রাণরস। মাঝে মাঝে বৈশাখী বিকেলে হানা দেয় ঝড়, কেশরফোলা সিংহের মতো ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় আকাশ। দস্যুর মতো ছুটে আসে মাতাল হাওয়া, আলুথালু ডালপালা, উপুড় হয়ে পড়া বনস্পতিকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় একপশলা বৃষ্টি।
বর্ষা: গ্রীষ্মের রুদ্রলীলার পর মেঘে মেঘে আকাশ ঢেকে আসে বর্ষা। বর্ষার আবির্ভাবে মন গলা ছেড়ে গেয়ে উঠতে চায়—
“এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়ে এসেছে ভুবন ভরসা।”
“নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সংবৃত অম্বর”, বাঁধনহারা মাঠে শস্যের শ্যামহিল্লোল, ব্যাঙের ডাক, ভিজে হাওয়া—সবাই মিলে পূর্ণ করে দেয় বর্ষা প্রকৃতির নিটোল চিত্রটাকে। এ যেন নজরুল কথিত সেই দৃশ্য – ‘সুন্দরের চোখে চোখভরা জল’। ফুল ফোটার সময়—কেয়া-কদম্বগন্ধরাজের গন্ধবাহারে মেতে ওঠবার সময় বর্ষা। কিন্তু মাঝে মাঝে অতিবৃষ্টি ডেকে আনে প্রলয়ংকরী বন্যা। তবু বলা যায় বর্ষা আবেগের ঋতু, হৃদয়ের শুষ্ক ধারাপথে জলসিঞ্চনের ঋতু।
শরৎ: বর্ষার হের পর শরৎ আসে আলোয় ধোওয়া দিন, আর জ্যোৎস্নামাখা রাত্রি নিয়ে। আকাশে ভেসে বেড়ায় বর্ষণক্লান্ত সাদা মেঘ, নদীতীরে কাশফুলের মেলা, শিশিরকণায় আলোর ছটা। শিউলির সুবাসে, পুজোর আবহে নেচে ওঠে হৃদয়। একসময় বিদ্যালয়ে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে, প্রবাসীদের ঘরে ফিরিয়ে এনে, পূজাবার্ষিকীর নতুন গন্ধের আমেজ বেয়ে শুরু হয় দুর্গাপুজো। তারপর একে একে আসে লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো। উৎসবের মাস আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়। শরৎ বিদায় নেয়।
হেমন্ত: হেমন্তের মুখ ঢাকা কুয়াশার চাদরে। সে যেন একাকী পড়ছে জীবনের কোনো ধূসর পান্ডুলিপি। শীতের অল্প ছোঁয়ায়, তার বুকে যেন কোনো গহন বিষাদছায়া। তবু হেমন্ত ভরে দিয়ে যায় বাংলার শস্যভাণ্ডারকে। মাঠে মাঠে সোনার ধান গেয়ে ওঠে নবান্নের গান। আসন্ন শীতের শূন্যতার আগে হেমন্ত পূর্ণ করে যায় জীবনের ভাঁড়ার।
শীত: গাছেরা পাতাহারা, প্রাণীকুল মৃত্যুহিম জড়ত্বে কম্পমান। চারিদিকে যেন শূন্যতার একচ্ছত্র সাম্রাজ্য। তবে বর্তমানে বাংলার শীত আর অত রিক্ত নয়। বরং গ্রীষ্মপ্রধান এই দেশে শীত বয়ে নিয়ে আসে কর্মচাঞ্চল্য। মনোরম আবহাওয়ায় আর দুপুরবেলার মৃদু রোদ-শিকারের উদ্যোগে বাংলার শীতকালকে বেশ উপভোগ্যই বলা যায়।
বসন্ত: শীতের রেশ কাটিয়ে বসন্ত আনে প্রমত্ত প্রাণের প্রমুক্ত উল্লাস। পলাশ-কৃষ্ণচূড়া আগুন ধরিয়ে দেয় দিগন্তে-দিগন্তে। বসন্ত উচ্ছ্বাসের ঋতু, নবীন প্রাণকে বিশ্বের আনন্দ সুধায় পূর্ণ করে নেওয়ার ঋতু।
উপসংহার: ঋতু আসে, ঋতু যায়। আমাদের অতি গাণিতিক মগজকেও অল্পস্বল্প বিচলিত করে পালটে যায় প্রকৃতির রূপ-রং। বর্ষায় মন উদাস হয়ে যায়, শীতে স্থবির। উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ বেয়ে ঋতুর জপমালা হাতে নিয়ে আমরা যেন বন্দনা করি নিখিল প্রাণপুরুষকে।

উপযোগিতা

১. নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের কর্তব্য
উত্তর –
“যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও। তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।”
—বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা: সভ্যতার অভাবনীয় উন্নতির আলোকিত দৃশ্যের আড়ালে যে কটি সামাজিক ব্যাধি সভ্যতাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যায়, নিরক্ষরতা তাদের মধ্যে অন্যতম। দারিদ্র্য, অন্ধবিশ্বাস আর সামাজিক অনুন্নয়ন নিরক্ষরতার বড়ো কারণ। নিরক্ষরতাসৃষ্ট চেতনার অন্ধতায় মাথা খুঁড়ে মরে ব্যক্তির বিকাশ কিংবা দেশের উন্নয়ন।
নিরক্ষরতার তত্ত্বতালাশ: ২০১১-র জনগণনায় ভারতের জনসংখ্যা হয়েছে ১২৫ কোটি। যা এক দশক আগের জনগণনার তুলনায় প্রায় ২৫ কোটি বেশি। কিন্তু দেশের পক্ষে অত্যন্ত আশার কথা হল জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি সত্ত্বেও নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা উল্লেযোগ্যভাবে ৩০ কোটি ৪১ লক্ষ থেকে কমে হয়েছে ২৭ কোটি ২৯ লক্ষ। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৯.২১ শতাংশ। এর পাশাপাশি দেশের ক্ষেত্রে আরও ইতিবাচক বিষয় হল, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে ৪৯.১০ শতাংশ হল মেয়েদের উন্নতি, ৩১.৯৮ শতাংশ পুরুষদের। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৮.৩৩ শতাংশ থেকে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সাক্ষরতার হারের ৭৪.৪ শতাংশে পৌঁছে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্তির ক্ষেত্রে দেশের সদর্থক পদক্ষেপ বলেই চিহ্নিত করা যায়। নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি: রবীন্দ্রনাথ লেখাপড়া শেখাকেই জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ তৈরির এবং নিজেদের শক্তিকে উপলব্ধির একমাত্র রাস্তা বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে সাক্ষরতা কর্মসূচিকে সফল করার জন্য দারিদ্র্য্যদূরীকরণ কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে হবে। শিক্ষার সুযোগকে সহজলভ্য করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে বইপত্র এবং শিক্ষা সহায়ক উপকরণ পৌঁছে দিতে হবে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী ছাত্রছাত্রীদের কাছে। বয়স্কশিক্ষা এবং স্ত্রীশিক্ষাকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে সাক্ষরতা অভিযান এবং পরবর্তীতে সর্বশিক্ষা অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। নিরক্ষরের সংখ্যা হ্রাস এইসব কর্মসূচির সাফল্যকে প্রমাণ করে। পরিব ছাত্রদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য ‘মিড-ডে মিল’-এর ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এর পরেও আজও এদেশে জনসংখ্যার একপঞ্চমাংশেরও বেশি মানুষ নিরক্ষর। প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষকেই তাই সক্রিয় হতে হবে দেশকে এই সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য।
ছাত্রসমাজের দায়িত্ব: ছাত্রসমাজ দেশের শিক্ষিত মানুষের অগ্রবর্তী অংশ। তাই সাক্ষরতা নামক সামাজিক কর্মসূচিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পড়াশোনার পরে ছাত্ররা এই কর্মসূচির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারে। প্রত্যেক ছাত্র এক জন নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর করে তুলতে পারে। আবার কয়েক জন মিলে নিজেদের এলাকায় সান্ধ্য বিদ্যালয় বা সাক্ষরতা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। সরকারি উদ্যোগের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করতে পারে। ছাত্ররা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে শিক্ষা বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে। মানুষকে বিদ্যালয়মুখী করে তোলায় তাদের উদ্যোগ নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করবে।
উপসংহার: শিক্ষা আনে চেতনা। এই চেতনা মানুষকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে পারে, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভাষা জোগায়। তাই দেশকে যথার্থ প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাক্ষরতা আন্দোলনের সার্থকতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে নেতার ভূমিকায়।
২. দেশগঠনে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা
উত্তর –
“তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়, উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয়।”
—সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভূমিকা: স্বাধীনতা অর্জন করা যত কঠিন, তাকে রক্ষা করা আরও কঠিন। স্বাধীনতার পরে ছটি দশক পার করেও আজও আমাদের দেশ দারিদ্র্য এবং নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ। তাই দেশের পুনর্গঠন আজও এক কঠিন লড়াই হয়েই রয়ে গেছে। তীব্র জ্ঞানস্পৃহা, প্রবল সাহস আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ে ছাত্রছাত্রীরা হতে পারে এই লড়াইয়ের অগ্রণী সেনানী।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ: নিরক্ষরতা আধুনিক ভারতের অভিশাপ। এখনও এ-দেশের শতকরা চল্লিশ জন মানুষই নিরক্ষর। শিক্ষার আলোর আলোকিত ছাত্রসমাজ পারে পিছিয়ে থাকা মানুষদের শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতন করে তুলতে। এলাকাভিত্তিকভাবে ছাত্ররা কয়েক জন মিলে অবসর সময়ে সাক্ষরতা শিবির পরিচালনা করতে পারে। কিংবা সরকারি উদ্যোগে যে সাক্ষরতা আন্দোলন পরিচালিত হয়, তার সঙ্গেও নিজেদের যুক্ত করতে পারে। জাতির প্রাথমিক ভিত্তি যে শিক্ষা, তার প্রসার ঘটিয়ে দেশ পুনর্গঠনে ছাত্রছাত্রীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
বিজ্ঞানচেতনা প্রসারে ভূমিকা: জাতির উন্নতিকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যায় মানুষের অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার। ছাত্ররাই পারে তাদের শিক্ষার আলো সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিয়ে মানুষের চেতনার মান উন্নত করতে এবং যেসব ভ্রান্ত ধারণা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে বাসা বেঁধে আছে, সেগুলোকে দূর করে মানুষকে যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমুখী করে তুলতে। প্রয়োজনে ছাত্ররা এলাকায় কুসংস্কারবিরোধী পদযাত্রা, পোস্টারিং ইত্যাদি করতে পারে। বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গেও তারা যুক্ত হতে পারে। মানুষের মধ্যে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করতে, চারপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে কিংবা পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে ছাত্রসমাজই পারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে।
কৃষিব্যবস্থার উন্নতিতে ভূমিকা: ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। ছাত্ররাই পারে কৃষি বিষয়ক আধুনিক ধারণা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে। আধুনিক কৃষিসরঞ্জাম, উন্নতমানের বীজ ও রাসায়নিক সারের খবর ছাত্ররা কৃষককে দিতে পারে। আবহাওয়ার পরিবর্তন বিষয়ে তাদের অবহিত করতে পারে, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির যথাযথ জায়গার ধারণাও ছাত্রদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব। মহাজনি ব্যবস্থায় শ্রমের যথাযথ মূল্য না পাওয়া কৃষককুল এভাবে বঞ্চনা থেকে বাঁচার পথ খুঁজে পেতে পারে। শুধু তাই নয়, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ যাতে কৃষকদের কাছে পৌঁছোয়, ছাত্রদের সেদিকেও যত্নবান থাকা উচিত।
নাগরিকতাবোধ সৃষ্টিতে উদ্যোগ; সুষ্ঠু নাগরিকবিধি মেনে চলতে ছাত্ররা সবাইকে সচেতন করতে পারে। জল বা বিদ্যুতের অপচয় বন্ধ করা, এলাকাকে আবর্জনামুক্ত রাখা, ট্রাফিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি নানা বিষয়ে ছাত্ররা ব্যক্তিগত বা সংগঠিতভাবে প্রচার অভিযান চালাতে পারে। তারা নিজেদের যুক্ত করতে পারে বিভিন্ন প্রশাসনিক উদ্যোগের সঙ্গেও।
অন্যান্য ভূমিকা; সমাজে সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনাপ্রসারে ছাত্ররা নানা ভূমিকা নিতে পারে। মহাপুরুষদের জন্মদিন, স্বাধীনতা দিবস, বিশ্ব পরিবেশ দিবস ইত্যাদি উদ্যাপনের ব্যবস্থা করে সমাজে সুস্থ চেতনা তৈরিতে এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ছাত্ররা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি যেসব ধারণা মানুষের জীবনকে তথা জাতিকে বিপন্ন করে, সম্প্রীতি আর সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলে ছাত্রছাত্রীরা তার বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে নামতে পারে। মানুষের মধ্যে তারা জাতীয়তার প্রসার ঘটাতে পারে।
উপসংহার: একদিকে আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্মর লড়াই, অন্যদিকে সামাজিক প্রত্যাশার চাপে আজকের ছাত্রসমাজ যেন সীমাহীন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের সজাগ সৈনিক।
৩. প্রতিবন্ধীদের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য
উত্তর –
“কোথাও রয়েছে যেন অবিনশ্বর আলোড়ন :
……………………………………………………..
এ মাটির কোলে ছাড়া অন্য স্থানে নয়,
সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ।”,
—জীবনানন্দ দাশ
ভূমিকা: পৃথিবীতে মানুষের যে অনিবার্য শ্রেষ্ঠত্ব, তা সম্ভব হয়েছে শক্তি আর বুদ্ধির মিশ্রণে। পরিশ্রম আর মানসিক দক্ষতার সঠিক প্রয়োগই হল মানুষের সাফল্যের রসায়ন। অথচ মানুষের এই গর্বিত বিচরণের পাশাপাশি থেকে গেছে অন্য মানুষেরা, যাদের শারীরিক বা মানসিক বিকাশ কোনো-নাকোনো কারণে ব্যাহত হয়েছে। মূক, বধির, পঙ্গু বা দৃষ্টিশক্তিহীন কিংবা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাই সমাজে ‘প্রতিবন্ধী’ হিসেবে চিহ্নিত। আলোকিত মানবসভ্যতার আড়ালে এ এক হতাশার অন্ধকারময় কাহিনি।
পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে: পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ৬০০ মিলিয়ন মানুষ আছেন যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। এই সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২.৩ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। ২০১১-র জনগণনায় প্রতিবন্ধী মানুষের মোট সংখ্যা ২.৬৮ কোটি। বর্তমানে আধুনিক মানুষের গতিময় জীবন এবং খাদ্যাভ্যাস বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিচ্ছে। নানা কারণে পারমাণবিক দূষণ কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিকলাঙ্গতার সৃষ্টি করে। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মানোর অপর একটি কারণ হল অপুষ্টি। প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রসংঘ। ওই সময় থেকেই প্রতিবছর ১৫ মার্চ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ— এই সময়কালকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ দশক’ হিসেবে। এদের উন্নতির জন্য গ্রহণ করা হয়েছে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা, বিনোদন ও ক্রীড়া ইত্যাদি বারোটি ক্ষেত্রকে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে ‘টার্গেট এরিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতেও প্রতিবন্ধীদের উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে আলাদা দপ্তর রয়েছে, চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য: প্রতিবন্ধীদের সামাজিক পুনর্বাসনে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সহানুভূতি বা অনুকম্পা নয়, ছাত্রছাত্রীরাই পারে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে দিতে। এই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরাই নাগরিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবন্ধীদের পাশে থেকে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার কাজও তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। ইংলিশ চ্যানেলজয়ী সাঁতারু মাসুদুর রহমান কিংবা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস হতে পারেন শিখরজয়ের প্রেরণা। এ ছাড়া এলাকায় প্রতিবন্ধী-ক্রীড়া সংগঠন, প্রতিবন্ধীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—এসবের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা তাদের ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বন্ধু’দের জন্য নিয়ে আসতে পারে আনন্দ আর খুশির বার্তা। স্কুলে সহপাঠী হিসেবে যদি এমন কোনো ছাত্রছাত্রী থাকে তাকে কোনোভাবেই উপেক্ষার চোখে না দেখে, বরং তার দিকে সহৃদয়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
উপসংহার: প্রতিবন্ধীদের সমাজে মান্যতা প্রতিষ্ঠা দেওয়া একটি মানবিক প্রয়াস। আর সেই প্রয়াসে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থহীন সক্রিয় অংশগ্রহণ এই প্রয়াসকে সার্থক করে তুলবে।
৪. সাম্প্রদায়িকতা এবং ছাত্রসমাজ
উত্তর – ভূমিকা: সাম্প্রদায়িকতা সভ্য পৃথিবীতে আদিমতার আস্ফালন। ধর্মকে আশ্রয় করে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আসে হিংসার হানাহানি। রক্তাক্ত হয় মানুষের পৃথিবী, বিপর্যস্ত হয় দেশের অখণ্ডতা এবং সংহতির ধারণা।
সাম্প্রদায়িকতা কী?: যখন নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে অন্য ধর্মের মানুষকে হেয় করা অথবা আঘাত করার চেষ্টা হয় তখনই সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়। সাম্প্রদায়িকতায় ধর্মকে আশ্রয় করে হিংসার সৃষ্টি হয়। মানুষের অন্তর্গত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্ধ মানুষ ধর্মীয় উগ্রতা তৈরি করে। কখনও এর সঙ্গে যুক্ত হয় সংকীর্ণ রাজনীতি, আর এর ফলে মৌলবাদের আত্মপ্রকাশে রক্তাক্ত হয় মনুষ্যত্ব।
সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত ও পরিণাম: ভারতবর্ষে ধর্মীয় সংঘাতের বেশ কিছু নজির মধ্যযুগে পাওয়া যায়। কিন্তু তা শুধুই দুটি পৃথক ধর্মের মধ্যে ছিল না, একই ধর্মের অন্তর্গত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেও ছিল। ইংরেজরা সুকৌশলে ধর্মের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের ঐক্য বিনষ্ট করতে সচেষ্ট হয় এবং তাদের চেষ্টা যে সফল হয়েছিল তা বোঝা যায় স্বাধীনতা সমকালীন দাঙ্গায়। এরপর বারেবারে এদেশে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছোটো-বড়ো এক হাজার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা হয় বা পরবর্তীকালে গোধরা বা গুজরাটে যে দাঙ্গা হয় তা সভ্যতার লজ্জা। একদিকে অজস্র মৃত্যু বা জাতীয় সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনই এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে বৈদেশিক শক্তি দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করতে তৎপর হয়।
সাম্প্রদায়িকতার উলটোদিক: ভারতবর্ষে পাল রাজত্বে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায়। মোগল আমলে এবং বাংলায় মুসলিম শাসনে ধর্মীয় সমন্বয়বাদের অজস্র উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। মধ্যযুগে চৈতন্য, কবির, দাদু থেকে লালন ফকির এই ধর্মসমন্বয়ের আদর্শই প্রচার করেছেন। সুরদাস আর তুলসীদাসের গানে এই সম্প্রীতির বাণীই প্রকাশ পায়। আধুনিক কালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের কবিতায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠই প্রকাশিত হয়েছে।
ছাত্রসমাজের ভূমিকা: মানবতার পরিপন্থী এই সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যে অজ্ঞতা এবং অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয় তা দূর করতে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। মানুষের মধ্যে শিক্ষার এবং বিজ্ঞানচেতনার প্রসারের দ্বারাই এই কাজ সম্ভব হতে পারে। যেসব অশুভশক্তি সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে মহাপুরুষদের বাণী ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কথা প্রচার করে, সম্প্রীতির আবহাওয়ার বিকাশ ছাত্রসমাজই ঘটাতে পারে। তাই রবীন্দ্রনাথের কথায়—
“ও তুই বারে বারে জ্বালাবি বাতি / হয়তো বাতি জ্বলবে না, / তা বলে ভাবনা করা চলবে না।”
উপসংহার: প্রগতির লক্ষ্যে মানুষের যে অনিঃশেষ যাত্রা তা মানবতাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা মানবতার অন্তরায়। তাই এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা থেকে সমাজের মুক্তি সকলের প্রত্যাশিত।
৫. দূরদর্শনের ভালোমন্দ
উত্তর –
“পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দী/ আ হা হা হা……
—মহীনের ঘোড়াগুলি
ভূমিকা: দুরদর্শন আধুনিক মানুষের কাছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উপহার। দূরদর্শন অচেনা পৃথিবীকে ঘরের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি মানুষের জ্ঞানসাম্রাজ্যের পরিধিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। এ ছাড়াও ব্যস্ত মানুষের অবসরজীবনের সঙ্গী হয়ে দূরদর্শন মানবজীবনের নিত্যসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে।
দূরদর্শনের ভালো দিক: ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন—উভয়ক্ষেত্রেই দুরদর্শনের বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব আছে। গণমাধ্যম বিষয়ে তাত্ত্বিক গবেষক মেয়োবিস বলেছেন যে, দূরদর্শনের দৌলতেই মানুষ সেইসব জায়গায় পা ফেলতে পারছে যেগুলি তার একেবারেই আয়ত্তে ছিল না, যেমন গাল্য ওয়ার বা আফগানিস্তানের যুদ্ধ ইত্যাদি। মানুষের ক্রমশ আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা—তা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে দূরদর্শনের সাহায্যে। জাপানে সুনামি কিংবা মার্কিন দেশে উগ্রপন্থীহানা সব কিছুই ঘরে বসেই জীবন্ত হয়ে ওঠে এর কল্যাণে। আন্তর্জাতিক খেলাধুলার সরাসরি সম্প্রচার আমাদের কাছে পৌঁছে দেয় দূরদর্শনই। দূরদর্শন জ্ঞানসাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটায় আবার সমাজসচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও সাহায্য করে। বিখ্যাত মানুষদের সরাসরি দেখা, নানা আলোচনা-বিতর্ক—জীবনে নিয়ে আসে অনুপ্রেরণা। আবার দূরদর্শনই তৈরি করে দেয় বিনোদনের নতুন সংজ্ঞা। সিরিয়াল-সিনেমা-রিয়েলিটি শো–বিনোদনের হাজারো আয়োজন ক্লান্ত মানুষের কাছে সময় রঙিন করে তোলে। দূরদর্শনই বিজ্ঞাপন প্রচারের সবথেকে কার্যকরী ক্ষেত্র। বিপণনকারী সংস্থার সঙ্গে ক্রেতার সংযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দূরদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। শিক্ষার্থীদের কাছেও দূরদর্শনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। শিক্ষামূলক নানা অনুষ্ঠান, শ্ৰীক্ষপ্রস্তুতি বিষয়ক আলোচনা থেকে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়। এভাবে ইডিয়ট বক্স’ হিসেবে নিন্দিত দূরদর্শন মানবজীবনের সমৃদ্ধির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছে নানাভাবে।
দূরদর্শনের মন্দ দিক: ভালো দিকের মতোই দূরদর্শনের নেতিবাচক প্রভাবও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামগ্রিকভাবে সামাজিক বা ব্যক্তিগত অস্থিরতা ও বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে দূরদর্শনের নিবিড় সংযোগ। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড-এর গবেষক জন রবিনসন, স্টিভেন মার্টিন প্রমুখ প্রায় ৩০০০০ মানুষের উপরে দীর্ঘ গবেষণা করে দেখিয়েছেন পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী মানুষরা স্বাভাবিক মানুষদের তুলনায় প্রায় ৩০% বেশি সময় টিভি দেখার জন্য ব্যয় করেন। দূরদর্শনের বেশ কিছু অনুষ্ঠান স্থূল বাণিজ্যিক স্বার্থে অম্লীলতা, হিংসা ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেয়। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখে অপরাধমূলক প্রবণতা বৃদ্ধির কিংবা বিজ্ঞাপন নকল করতে গিয়ে মৃত্যুর নজির যথেষ্টই আছে। তথাকথিত বিতর্কমূলক অনুষ্ঠানগুলি নিরপেক্ষতার অভাবের কারণে অনেকসময়েই দলীয় প্রচারের বাহন হয়ে যায়। স্বাস্থ্যের উপরেও দূরদর্শনের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলে থাকেন বিজ্ঞানীরা। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস অতিরিক্ত টিভি দেখাকে হার্ট অ্যাটাক, স্নায়বিক দুর্বলতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের গবেষকরা ১২ বছরের নীচের শিশু-কিশোরদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে টিভি সংকট তৈরি করে বলে জানিয়েছেন। আমেরিকায় বিজ্ঞানীরা টিভি দেখার নেশাকে অন্য যে-কোনো নেশার সমগোত্রীয় বলে চিহ্নিত করেছেন।
উপসংহার: বিতর্ক সত্ত্বেও দূরদর্শনের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। রাষ্ট্রীয় নজরদারি, চ্যানেল কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষতা এবং সুস্থ রুচির প্রতি আনুগত্য সম্ভব হলে বিজ্ঞানের আশ্চর্য আবিষ্কার এই দূরদর্শন মানবসমাজে বিতর্কহীন এবং বিকল্পহীন এক মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
৬. চরিত্রগঠনে খেলাধুলোর উপযোগিতা
উত্তর – ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দ দেশের তরুণ সমাজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।(শুধু শুষ্ক, তার্কিক আলোচনা কিংবা পাঠাভ্যাস যে একজন ছাত্রকে পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে না, এই বিষয়টি বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন। আমাদের চিন্তা-বুদ্ধি-স্মরণ-মনন সবেরই ধারক এই শরীর। তাই শরীরের অবনতি বা বিলোপ মানেই অস্তিত্বের বিনাশ। ক্ষয়প্রাপ্ত, রোগজীর্ণ কিংবা অপুষ্ট শরীরে মানুষ শারীরিক বা মানসিক কোনো কাজই করতে পারে না। আর তাকে সতেজ রাখতে প্রয়োজন শরীরচর্চা, যার অন্যতম উপায় হচ্ছে নিয়মিত খেলাধুলো করা।
শরীরচর্চা ও খেলাধুলো: খেলাধুলো আমাদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে আধুনিক নগরসভ্যতায় নগরায়ণের কারণে মাঠ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নীরোগ শরীর ও সতেজ মন তৈরিতে খেলাধুলো আজ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। অঙ্গসঞ্চালন, দৌড়ঝাপের মাধ্যমে মানুষের শরীরের জড়তা কাটে, সে হয়ে ওঠে তরতাজা ও প্রাণবন্ত। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় মেনে খেলাধুলো করলে অল্প পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয় না এবং সেখানে হতাশা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা বাসা বাঁধে না।
খেলাধুলোর প্রকারভেদ: মূলত দুই ধরনের খেলাধুলো দেখা যায়। যথা–ইনডোর গেম এবং আউটডোর গেম। ইনডোর গেম বলতে বোঝায় যে ধরনের খেলাধুলো ঘরে বসে করা সম্ভব—যেমন লুডো, দাবা ইত্যাদি। আর আউটডোর গেম বলতে বোঝায় যে খেলাগুলি বাড়ির বাইরে মাঠেঘাটে করা হয়—যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল ইত্যাদি।
চরিত্রবিকাশ ও খেলাধুলো: খেলাধুলো, তা যে ধরনেরই হোক না কেন, সেটি দলগত বিষয়। তাই খেলার প্রথম উপযোগিতাই হল শারীরিক বিকাশসাধনের পাশাপাশি খেলাধুলো আমাদের মানসিক বিকাশেও সাহায্য করে। আমাদের মধ্যে দলবদ্ধভাবে কোনো কাজ করার প্রবণতা, সহমর্মিতা এবং সহানুভূতির বোধের জন্ম দেয়। খেলাধুলোর নিয়মকানুন আমাদের সংযমী হতে শেখায় এবং নিয়মনীতির চেতনায় দীক্ষিত করে। খেলাধুলোর হারজিত যে অবশ্যম্ভাবী, কখনও এক পক্ষ জয়লাভ করে তো, কখনও অন্য পক্ষ—এই ধারণা লাভ করলে আমরা বৃহত্তর জীবনেও উপকৃত হই, জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে সমানভাবে গ্রহণ করতে শিখি।
আধুনিক জীবনে খেলাধুলো: আধুনিক সমাজে ক্রমশ ভাঙনের রোগ প্রবল হচ্ছে। যৌথ পরিবারগুলি ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র আকার ধারণ করছে। একত্রে মিলেমিশে বাঁচার বোধটাই হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে খেলাধুলোই পারে আমাদের মধ্যে সকলে মিলেমিশে থাকার ইচ্ছেকে ফিরিয়ে আনতে। পাঠক্রমের চাপ, পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার ইঁদুরদৌড় বর্তমান সময়ে ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে যে পর্বতপ্রমাণ বোঝা চাপিয়ে দেয়, তা থেকে বাঁচাতে পারে খেলাধুলোই। পরিবেশদূষণের ফলেও আমাদের শরীর দ্রুত ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলো ও স্বাস্থ্যচর্চা এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের পথ দেখাতে পারে।
উপসংহার: শরীর ও মনকে পরিপূর্ণরূপে উজ্জীবিত করতে খেলাধুলো অন্যতম বিষয়। এর মাধ্যমেই স্বাস্থ্য সুগঠিত হয় এবং নৈতিকতা, সহমর্মিতার মতো মানবিক গুণগুলি বিকাশ লাভ করে। আধুনিক সমাজে এর গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭. রক্তদান জীবনদান
উত্তর – ভূমিকা: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। একে অপরের পাশে দাঁড়ানো, অন্যের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া তাই মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো কাউকে যদি জীবনের কূলে ফিরিয়ে আনতে পারি তবেই তো আমরা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠব। রক্তদান এরকমই এক মানবিক কর্তব্য।
রক্তের অভাবের কারণ: দেহে কতটা রক্ত থাকবে তা নির্ভর করে ওই ব্যক্তির দৈহিক ওজনের ওপর। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে প্রত্যেক নীরোগ পুরুষ দেহে রক্ত থাকে প্রতি কেজি ওজনে ৭০ থেকে ৭৬ মিলিলিটার পর্যন্ত। মহিলাদের ক্ষেত্রে সেই পরিমাণটি হল ৬৬ থেকে ৭০ মিলিলিটার। অথচ ভীষণ পরিশ্রমের কাজ করতে হলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতি কেজিতে ৫০ মিলিলিটার রক্তই যথেষ্ট। তাই বলা যায়, আমাদের দেহে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত রক্ত মজুত থাকে। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার কিংবা ক্যানসার রোগীদের কেমোথেরাপি বা Ray দেওয়ার ফলে বেশি পরিমাণে রক্তকোশ নষ্ট হয়ে গেলে একজন মানুষের দেহে বাইরে থেকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর রক্ত তৈরির একমাত্র কারখানা হচ্ছে মানুষের শরীর। তাই রক্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে একজন মানুষকে এগিয়ে এসে তার দেহের অতিরিক্ত রক্ত থেকে কিছুটা দান করতে হয়। তাতে করে মুমূর্ষু রোগী প্রাণ ফিরে পায়।
রক্তদানের ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব: রক্তদানে রক্তদাতার কোনো ক্ষতি হয় না। দেয় রক্তের ঘাটতি পূরণের জন্য ভালো খাবারেরও প্রয়োজন নেই। সাধারণ ভাত-রুটি-সবজিই যথেষ্ট। মানবদেহের স্বাভাবিক নিয়মেই পুনরায় রক্ত তৈরি হয়, আবার প্রতি কেজিতে ৭৬ মিলিলিটারের চেয়ে বেশি রক্ত জমাও থাকে না। তাই এবিষয়ে রক্তের আধিক্য ও ঘাটতি নিয়ে সাধারণের মধ্যে যে ধারণা দেখা যায়, তা একেবারে ভ্রান্ত।
রক্তদানের ইতিবাচকতা: রক্তদানে শুধু গ্রহীতাই উপকৃত হন না, দাতা নিজেও লাভবান হন। জন্ডিস, এইচআইভি প্রভৃতি মারাত্মক রোগজীবাণু দেহে বাসা বেঁধেছে কি না, রক্তদানের সময় এসব নিখরচায় পরীক্ষা করা সম্ভব। পরীক্ষার ফলাফল চূড়ান্ত গোপনীয় রাখা হয় এবং কোনো রোগ ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট দাতাকেই তা জানানো হয়। রক্তদানের পর রক্তদাতাকে রক্তের গ্রুপ সংবলিত একটি কার্ডও দেওয়া হয়, যা রক্তের গ্রুপের নিশ্চিত প্রমাণপত্র হিসেবে কাজ করে। রক্তদানের ফলে দাতার দেহে উৎপন্ন নতুন রক্তকণিকা তার শরীরকে সতেজ চনমনে ক রাখে।
রক্তদানের যোগ্যতা: রক্তদানের যোগ্যতা নির্ধারণের তিনটি প্রাথমিক শর্ত রয়েছে–[ক] রক্তদাতার বয়স ১৮-৬০ বছরের মধ্যে হতে হবে। [খ] তার দেহের ওজন হতে হবে ৪৫ কেজি বা তার বেশি। [গ] ইচ্ছুক দাতার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমপক্ষে ১২.৫ শতাংশ হতে হবে।
উপসংহার: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান; স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এমনকি স্কুলকলেজেও রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়। সমস্ত কুসংস্কার ও ভুলবোঝা থেকে মানুষকে বিরত করে সেই সমস্ত শিবিরে সর্বস্তরের জনসাধারণকে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করাই আমাদের, অর্থাৎ ছাত্রসমাজের দায়িত্ব হওয়া উচিত।
৮. জনজীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা
উত্তর – ভূমিকা: নিজেরা একা একা বা নিজেদের চারপাশের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আমরা কেউ-ই বেঁচে থাকতে পারি না। তাই আমাদের প্রয়োজন হয় বাকি পৃথিবীর খবর জানার। শহর, শহর পেরিয়ে রাজ্য, রাজ্য অতিক্রম করে দেশ এবং বিদেশের দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক হালহকিকত এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলি—আমাদের সকলের মানসিক পুষ্টির জন্য জরুরি হয়ে ওঠে ‘সংবাদ’ বা ‘খবর’। তাই সংবাদপত্র জনগণের প্রতিদিনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
সংবাদপত্রের গোড়ার কথা: একাদশ শতাব্দীতে চিনে এক প্রকারের সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। ঔরঙ্গজেবের আমলে রাজকর্মচারীদের মধ্যে হাতে লেখা এক ধরনের খবরের কাগজ বিলি করা হত। ভারতবর্ষে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়া গেজেট প্রকাশিত হয়। এটিই ভারতের সর্বপ্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম সংবাদপত্রের নাম ছিল ‘আজাদ’।
সংবাদপত্রের বিবর্তন: সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের গঠনগত রূপে বৈচিত্র্য এসেছে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পত্রিকা এখন প্রকাশিত হয়ে থাকে। এইসকল পত্রপত্রিকায় দৈনন্দিন খবর পরিবেশনের পাশাপাশি বিশ্বের রাজনীতি, সমাজনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যাবসাবাণিজ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং বিনোদনমূলক বিষয়ও আলোচিত হয়।
প্রয়োজনীয়তা: যুগে যুগে সংবাদপত্রের দায়িত্ব ও ভূমিকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিবাদী ভাষা বিশ্বের যে-কোনো অঞ্চলের, যে-কোনো সমস্যার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারেও এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ‘রয়টার’ নামের সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর সর্বত্র শাখা বিস্তার করেছে। এই জাতীয় সংস্থা থেকেই সংবাদ কিনে সেগুলি প্রকাশ করতে হয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে এএফপি, এপি, তাস গুরুত্বপূর্ণ। খবরের কাগজ হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের জনমত গঠনের অন্যতম মাধ্যম। জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, অভাব-অভিযোগ মূর্ত হয়ে ওঠে সংবাদপত্রের পাতায়, ফলে সরকার এগুলি সম্পর্কে অবহিত হন। ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সংবাদপত্রের অবদান অনস্বীকার্য। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই কর্মহীন লোকেরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সন্ধান পান, ক্রীড়াপ্রেমীরা জানতে পারেন দেশ-বিদেশের খেলাধুলার বিবিধ তথ্য।
সংবাদপত্রের দায়িত্ব: বলা হয়, “Newspaper is the people’s parliament always in sessions”. তাই সংবাদপত্রের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল সদাসর্বদা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশেন করা। সংবাদপত্র যত বেশি নিরপেক্ষ হবে, ততই তা দেশ ও জাতির পক্ষে মঙ্গলজনক।
আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, শিল্পসংস্কৃতির বিকাশ, রাজনৈতিক তাপ-উত্তাপের বৃদ্ধি পাওয়া—মোটকথা সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে তথ্য ও সংবাদের প্রয়োজনীয়তা তত বেড়েছে। সংবাদের বিকৃতি নয়, বরং দেশদেশান্তরের খবরের সারসত্য যদি অবিকৃতভাবে হাজির করা যায়, তাহলেই জগৎ ও জাতির মঙ্গল।
শিক্ষাবিস্তারে সংবাদপত্রের ভূমিকা: সংবাদপত্র নানান নিত্যনতুন আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানাবিধ খবরাখবর, শিল্প-সংস্কৃতির হালহকিকতকে তুলে ধরে। ফলে সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা, সাংস্কৃতিক বোধের প্রসার ঘটে। সংবাদপত্রের বিভিন্ন কলামে, যেমন—–সম্পাদকীয় কিংবা অন্যত্র বর্তমান সময় ও সমাজ সংক্রান্ত বিষয়কে ঘিরে বিশ্লেষণী নিবন্ধও প্রকাশিত হয়। এর ফলে চিন্তা ও বিচারের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়।
উপসংহার: খবর শুধু তথ্য দেয় না, মানুষকে অন্যভাবে চিন্তা করতেও উদ্বুদ্ধ করে। জনগণ তার চারপাশের প্রতিবেশীকে চিনে নেয় এবং সমাজসচেতন হয়ে ওঠে। দেশকালের ক্ষয়ক্ষতি, উন্নতি—সবেরই চালচিত্র তার সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে সংবাদপত্র। তাই সংশোধন ও সংস্কারের লক্ষ্য সে বুঝে নিতে পারে। এইভাবেই জনজীবনে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
৯. সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তা
উত্তর –
“ভুলে যেয়োনাকো তুমি আমাদের উঠানের কাছে
অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে।”
—শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা: আত্মব্যাপ্তির জন্য সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা, ইহা সাহিত্য”। সাহিত্য জীবনের ছবি আঁকে। জীবন বিচিত্র, তার গতিপথ আরও বিচিত্র। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বলেন”জীবনের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে বিরাটের ক্রমাগত আত্ম-প্রতিষ্ঠার বাসনাই লেখকের প্রেরণা। যুগ যুগ ধরে নানা দেশে নানা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কাজে নিমগ্ন আর পাঠকেরা তার স্বাদ পেতে উদ্গ্রীব”।
আনন্দপ্রাপ্তি: সাহিত্যপাঠের মধ্যে আছে আনন্দ, ভালো লাগার মধ্যে দিয়ে বিশুদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ আনন্দ সত্য শিব সুন্দরের মধ্যে নিহিত। প্রাণ ভরে উপভোগ করার প্রেরণা যোগায় সাহিত্য।এ ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ স্রষ্টা ও পাঠক উভয়েই অংশীদার। সাহিত্য বলতে কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি বোঝায়। সাহিত্যের এই বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে অবিমিশ্র আনন্দের স্বাদ পেয়ে থাকেন সাহিত্যস্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টি পাঠককে কৃতার্থ করে। দর্শন: এক ইংরেজ কবি বলেছেন—সাহিত্য জীবনের দর্পণ। জীবনের মধ্যেই সমাজের অধিষ্ঠান। জীবনের যেমন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ আছে, সমাজে সাহিত্যেও তেমনই রূপ বদলায়। সাহিত্যপাঠে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিধি আরও বেড়ে যায়। আমরা সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে এক বৃহৎ জগতে গিয়ে পৌঁছোই। জীবন সম্পর্কে সত্য ও সুন্দরের ধারণা তৈরি করে দেয় সাহিত্যই।
সাহিত্য থেকে শিক্ষা: সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে আমরা অশেষ শিক্ষা লাভ করি। শুধু নীতিকথা ও উপদেশ নয়, উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। জীবনের সংগতি আর অসংগতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায়। হয়তো আমরা আনন্দের জন্য সাহিত্য পাঠ করি, শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু পরিণামে শিক্ষালাভ ঘটে। আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলির বিকাশ ঘটে সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে। আমাদের বোধ আরও গভীরতা লাভ করে। পরিমার্জিত হয় রুচি। মন আরও সংবেদনশীল হয়। আমাদের ভাষাজ্ঞানের উন্নতি হয়।
নিঃসঙ্গতার অবলম্বন: সাহিত্যপাঠ আমাদের বন্ধুত্বের প্রয়োজন মেটায়, আমাদের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। সাহিত্যপাঠের ফলে সহজেই আমরা বহুবিচিত্র চরিত্র, অনুভূতি, কান্না-হাসির সঙ্গলাভ করি, দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে বৃহৎ জগতের সন্ধান পাই।
জাতীয় ঐক্য তথা বিশ্বমানবিকতা: সাহিত্যপাঠে সংকীর্ণতা থাকে না, মন ক্রমশ প্রশস্ত হয়। মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ থাকে না, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ জেগে ওঠে। উদার মানবিকতাবোধ জাগ্রত হয়। সাম্প্রদায়িকতা থাকে না। জাতি-ধর্ম-ভাষার পার্থক্য ক্রমশ কমিয়ে এনে, জাতীয় ঐক্য গঠনে সাহায্য করে। এক অখণ্ড মানবসমাজের প্রাণস্পন্দনকে খুঁজে পাওয়া যায় যথার্থ সাহিত্যপাঠে।
উপসংহার: সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, সাহিত্য আনন্দ ও শিক্ষার মূল উৎস। সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তা যে কতটা তা বলে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সঙ্গে সংযোগ রেখে, শুভ চিন্তার প্রসারের জন্য সাহিত্যপাঠ ছাড়া আর অন্য কোনো বিকল্প নেই।

আত্মকথা

১. একটি শহরের আত্মকথা
উত্তর –
“এই শহর জানে আমার গোপন সবকিছু,
পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু।”
—কবীর সুমন
ভূমিকা: আমি কলকাতা, আলো-অন্ধকারে ভরা ইতিহাসের এক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমার টিকে থাকা। জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংসের বহু ঘটনা, বহু বিপন্নতা এবং বিস্ময় ঘিরে আছে আমাকে। আর এসব নিয়েই বাঙালির জাতিসত্তার সঙ্গে শতকের পর শতক জুড়ে আমার জড়িয়ে থাকা। বাকি ভারতের কাছে আমার উপস্থিতি স্বাতন্ত্র্যের এবং স্বীকৃতির।
ইতিহাসের পথ বেয়ে: পণ্ডিতেরা বলতেন ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে জব চার্নক নামে এক সাহেব সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা এই তিনটি গ্রাম নিয়ে আমার পত্তন করেছিলেন। ১৯৯০-এ ধুমধাম করে আমার তিনশো বছরের জন্মদিন পালনও হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে মতপার্থক্য হওয়ায় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে হাইকোর্ট আমার অবস্থান ১৬৯০-এর আগেও ছিল বলে মত দেয়। তবে আমার পত্তন নিয়ে পণ্ডিতের মধ্যে তর্কাতর্কি যা থাকে থাক, আমি আছি আমার মতোই। আমার নাম নিয়েও তো কত বিতর্ক আছে। সুনীতিবাবু বলেছিলেন কলিচুনের কেন্দ্র হিসেবে আমার নাম কলকাতা। অন্য মতে আমার বুকে ছিল কালীক্ষেত্র, তাই নাম কলিকাতা। আবার কেউ বলেন কিলকিলা বা সমতলভূমি বলেই আমি কলিকাতা। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য সরকার আমার নাম কলিকাতা থেকে বদলে কলকাতা করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমিই ছিলাম ভারতের রাজধানী। এখনও পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী আমাকেই বলা হয়।
আমার বর্তমান: একদা হুগলি নদীর পূর্ব ধার ধরেই আমার অবস্থান ছিল। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা এবং সময়ের চাহিদা আমার আয়তনকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তরে বারাসত থেকে দক্ষিণে বারুইপুর আমার সীমানা। আমার অধীনে আছে একটি কর্পোরেশন এবং আটত্রিশটি পুরসভা। প্রায় দেড় কোটি মানুষকে জায়গা দিয়েছি আমি। কাজের প্রয়োজনে এর কয়েকগুণ মানুষ রোজ আসেন আমার কাছে।
আমারে তুমি অশেষ করেছ: কত গৌরবের সাক্ষী আমি! রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ বসু—কত ইতিহাস সৃষ্টি করা মানুষের স্মৃতিকে ধরে আছি আমি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ফোর্ট উইলিয়াম, জাদুঘর, জ্ঞানচর্চার স্মারক একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, কত না স্থাপত্য ও দর্শনীয় জিনিস আমার মুকুটে রয়েছে উজ্জ্বল রত্নের মতো। রয়েছে ১৯১১-তে গোরাদের হারিয়ে মোহনবাগানের শিল্ড জয়, বিনয়-বাদল-দীনেশের অলিন্দ অভিযানের স্মৃতিও। এসব নিয়েই ছিলাম, আছি, থাকব। সকলে বলে আমি নাকি ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানীও বটে। রবীন্দ্রসদন, অ্যাকাডেমি, নন্দন, আরও কত মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে কত না নাটক, সিনেমা। গিরিশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়ি থেকে উৎপল দত্ত, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় কত স্বনামধন্য মানুষের পদধূলি মিশে আছে আমার শরীরে। আজও ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ছবি দেখার জন্য আমার বুকে রাত জাগে মানুষ। বইমেলায় লক্ষ লক্ষ লোকের জমায়েত হয়। এসবই আমার গর্ব, আমার অহংকার।
শেষের কথা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানি বোমা আমাকে কাবু করতে পারেনি। আমি দেখেছি তেরোশো পঞ্চাশের মন্বন্তরে গ্রাম থেকে আসা অসংখ্য মানুষের মৃত্যু। স্বাধীনতার ও দেশভাগের সময়েও রক্তাক্ত হয়েছে আমার শরীর। তবু উঠে দাঁড়িয়েছি আমি। অনেক সমস্যাকে নিয়ে আমার টিকে থাকা। বর্ষায় জল জমে, রাস্তায় তৈরি হয় যানজটের সমস্যা। ক্রমে গাড়িঘোড়া আর কলকারখানা কালো ধোঁয়ায় আর দূষণে ঢেকে যাচ্ছে আমার আকাশ। তবু আমি আছি, আমার আবেগ স্বপ্নময়তা আর উজ্জ্বল ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে।
২. একটি সেতুর আত্মকাহিনি
উত্তর – ভূমিকা: আমি একটি বহু পুরোনো কিন্তু অতি বিখ্যাত সেতু। আমাকে তৈরি করতে তখনকার দিনেই খরচ হয়েছিল আনুমানিক আড়াই কোটি টাকা। প্রায় ছাব্বিশ হাজার পাঁচশো টন স্টিল ব্যবহৃত হয়েছে আমার নির্মাণকাজে। হাওড়া ব্রিজ কমিশনারের তত্ত্বাবধানে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে আমাকে তৈরির কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। তবে সাধারণের ব্যবহারের জন্য আমায় খুলে দেওয়া হয় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে। আজ এতগুলো বছর পার করে এসে আমি শ্রান্ত, ক্লান্ত বটে, কিন্তু তবে সাধারণের ভালোবাসার ছোঁয়ায় আমি গর্বিত।
নিজের জীবনের নানা কথা: আমাকে তৈরি করার আগে বিশাল গঙ্গানদী ফেরি নৌকায় পার হতে হত। তাতে বহু বিপদ ঘটত, আর অনেক সময়ও লাগত। তাই এই নদীর ওপর আমাকে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হল। একদিকে হাওড়া শহর ও অন্যদিকে কলকাতা শহর আমার মাধ্যমে যুক্ত হল। আমি হলাম ভারতের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু। সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলাম আমার আনন্দ। কত মানুষ গঙ্গার হাওয়া খেতে আমার কোলে ছুটে আসে। কত মানুষ আমার উপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার ছবি তোলে। তখন আমার খুব মজা লাগে। ‘হাওড়া ব্রিজ’ নামে একটা সিনেমা তৈরি করেছিলেন শক্তি সামন্ত। কিন্তু দুঃখের ঘটনাও থাকে। হয়তো কেউ জীবনের দুঃখ সহ্য করতে না পেরে আমার ওপর থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। কখনও-বা বিকৃতমস্তিষ্ক কোনো অভাগা আমার সবথেকে উঁচু চূড়ায় উঠে বসে। নীচে জনসাধারণ তাকে দেখে অনেক সময় মজাও করে থাকে। কিন্তু আমার তখন বুক ঢিপঢিপ করে— এই বুঝি লোকটা পড়ে গিয়ে বিপদ ঘটায়।
তোমরা আমার অনেক খেয়াল রাখ, যত্ন কর, কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে আলোর মালায় আমাকে সাজিয়ে তোলো। কিন্তু যানবাহনের চাপে মাঝে মাঝে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। দিনে দিনে আমারও তো বয়স বাড়ছে। বয়সের ভারে মাঝে মাঝে আমার শরীর জীর্ণ হয়। তখন তোমরা আমায় মেরামত কর। আমি তাই আজও টিকে আছি। আমার উপর তোমরা ভারী ট্রাম চালানো বন্ধ করে দিয়েছ। আমার ভারবহনের ক্ষমতা কমে গেছে বলে তোমরা গঙ্গাবক্ষে তৈরি করেছ দ্বিতীয় হুগলি সেতু। অনেকে বলে এর ফলে আমার আগের গৌরব নাকি অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু আমি তা মনে করি না। স্বাধীনতা, কত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী আমি। এ গৌরব দ্বিতীয় হুগলি সেতু কোনোদিনও পাবে না।
উপসংহার: আমার জন্য তোমাদের ভালোবাসা কম নয়। ভালোবেসে তোমরা আমার একটা সুন্দর পোশাকি নাম দিয়েছ— ‘রবীন্দ্র সেতু’। বাংলার অমর কবির নামে নামাঙ্কিত আমি, আমার শরীর হয়তো কোনোদিন কালের অতলে বিলীন হবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমাদের মনে আমি চিরদিন অমর হয়ে থাকব।
৩. একটি পুরোনো বাড়ির আত্মকথা
উত্তর –
“পলেস্তারা খসে পড়ছে, দালানে জমেছে ধুলোবালি।/ তারই
মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে/ সমস্ত দুপুর/ নির্জন বাড়িতে একা
ঘুঘু ডাকে, ঘুঘু ডেকে যায়।”
—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
ভূমিকা: স্মৃতির পথের ধুলোবালি সরালে জীবনের কত না জলছবি ভেসে ওঠে। হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতার যে জীবন তাতে মানুষেরই একচ্ছত্র দাবি আছে তা নয়, এই পৃথিবীর জড় ও প্রাণময়—সবাই তো আসলে স্মৃতিধর। পলেস্তারা খসা এক পুরোনো বাড়ি হিসেবে এরকম অনেক স্মৃতিই আমি বয়ে নিয়ে চলেছি।
আমার কথা: গ্রাম-সৈদপুর, পোস্ট-টাকি, জেলা-উত্তর ২৪ পরগনা—এই আমার ঠিকানা। গত শতকের শুরুর দিকে আমার জন্ম। আমার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সতীনাথ বসু নামে এক ভদ্রলোক। খুবই ধনী গৃহস্থ ছিলেন তিনি। সামনে একটা পুকুর। প্রায় পাঁচ-ছ কাঠা জায়গার উপরে আমার জন্ম হয়। বড়ো বড়ো খিলান, বার্মা টিকের দরজা জানালা, দেয়ালে বাহারি নকশা—রাজকীয় চেহারা ছিল আমার। মোট আটখানা ঘর, দুটো তলা ছিল।
আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা এক মনোরম উপস্থিতি ছিল আমার। সেদিন গেছে চলে: এ-বাড়ির লোকেরা কোনোদিনই জমিনির্ভর ছিল না। ফলে উঠোনে গোলাভরা ধান দেখার সুযোগ আমার হয়নি। সকলেই নানা উচ্চপদে চাকরি করায় নানা ধরনের মানুষের আগমন এখানে ঘটেছে। সতীনাথ বসুর ছেলে কুমারনাথ বসুর সময়ে আমার খ্যাতি-বৈভব অনেক বেড়ে যায়। বাইরের ঘরে বৈঠকখানা, পাশের ঘরে লাইব্রেরি, তার ঝুলবারান্দায় লিলি ফুল—বনেদি হয়ে উঠি আমি ভিতরেও। এ-বাড়িরই একটি মেয়ে নীলিমা মাত্র ছ-বছর বয়সে রেডিয়োতে গান গেয়েছিল। তখন সাহেবদের আমল। কত রেকর্ড বেরল, পুরস্কার পেতে শুরু করল। কিন্তু মাত্র ষোলো বছরে হঠাৎই সে মারা গেল। ক-দিন বাড়িটা যেন শ্মশান হয়ে গেল। মানুষগুলোর মতোই আমিও যে কত কেঁদেছি! মহালয়ার দিন তোমরা স্তোত্রপাঠ শোন যার গলায়, সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এখানে এসেছিলেন। এসেছিলেন রেডিয়ো স্টেশনের ডিরেক্টর স্টেপলটন সাহেব। স্বাধীনতার সময় আমার উঠোনেই গ্রামের লোক জড়ো হয়েছিল। ঢাক, কাঁসি বাজিয়ে সবাই মিছিল করেছিল। কী আনন্দ সকলের! আর ভিড় হয়েছিল কুমারবাবু মারা গেলে। হিন্দু-মুসলমান সব মানুষ জড়ো হয়েছিল। দেশভাগের পরে মুসলমানরা যখন এদেশ ছাড়ছে, গ্রামের মুসলমানদের নদীর জলে নেমে তিনিই তো ফেরত এনেছিলেন, তাদের সাহস দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বড়ো গর্ব আছে আমার। গ্রামের সকলেই আমাকে তাই একটু অন্য চোখে দেখে। জমিদারদের পেল্লায় বাড়িগুলোর মধ্যেও আমার একটু আলাদা জায়গা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন উদ্বাস্তুরা এল, তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিল আমার উঠোনে, বারান্দার কোণে। মা-ঠাকরুন তাদের দেখাশোনা করতেন। এ বাড়ির মানুষগুলোর জন্য সত্যিই আমার গর্ব হত। আমার বর্তমান: যে গ্রামে আমার অবস্থান সেখানে এখন শুধুই শূন্যতা। পুরোনো বনেদি মানুষরা সকলেই কলকাতা বা অন্যত্র চলে গিয়েছেন। কুমার বসুর পরিবারও প্রায় তা-ই। ছোটো ছেলে আমাকে ভালোবেসে আজও আছেন। কিন্তু তারপর? এরমধ্যে আমার রূপবদল হয়েছে। কড়ি-বরগার বদলে ঢালাই ছাদ হয়েছে। মেরামত, রংও হয়েছে কিছু কিছু। কিন্তু থাকবে কে? জমিদারদের ভাঙা বাড়িগুলো দেখি আর মনে হয় এটাই হয়তো আমারও ভবিষ্যৎ।
উপসংহার: সব অনিশ্চয়তাকে নিয়ে তবু আমি টিকে আছি। আজও সামনের পুকুরে মাছেরা খেলা করে। উঠোনে হাসনুহানা গন্ধ ছড়ায়, আমগাছের শাখায় বাতাসের কাঁপন লাগে। আর আমি মনে মনে ভাবি, যদি আর-একবার… আগের মতো…।
8. একটি নদীর আত্মকথা
উত্তর –
“এতবড় আকাশের নিচে/ সে তোমাকে সর্বস্ব মেনেছে।/ মমতা,
মায়ার প্রতিনিধি/ চিরকাল থাকো তুমি—নদী।”
—অমিতাভ দাশগুপ্ত
ভূমিকা: নদীর তীরেই একদিন গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতা। সিন্ধু নদের ধারে সিন্ধু সভ্যতা, নীল নদের ধারে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিসের ধারে মেসোপটেমিয় সভ্যতা—এমন কতই না উদাহরণ দেওয়া যায়। তোমাদের পুণ্যতোয়া গঙ্গা বা যমুনাও কম যায় না। ইতিহাসের এই অহংকারকে সঙ্গে নিয়েই আমারও বয়ে চলা। আমি ইছামতি।
আমার বয়ে চলা: আমার উৎপত্তির সঙ্গে যোগ আছে বাংলাদেশের। কুষ্টিয়ার মুনশিগঞ্জের পদ্মার শাখা হিসেবে নদিয়ার মাজদিয়ায় যে মাথাভাঙা নদীর উদ্ভব ঘটেছে তা-ই দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে—একটি চূর্ণী, অন্যটি আমি। এরপরে কখনও বাংলাদেশ, কখনও ভারতের ভিতর দিয়ে আমার বয়ে চলা। আবার কখনও এপারে ভারত, ওপারে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক জল-সীমান্ত হওয়ায় আমাকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবে চলতে চলতেই উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ পেরিয়ে আমি মিশে গেছি রায়মঙ্গলের সঙ্গে। এরপর আমার গন্তব্য বঙ্গোপসাগর।
আমার গর্ব: দীর্ঘ যাত্রাপথে আমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থেকেছে কত মানুষ। তাদের কেউ মাছ ধরে, কেউ খেয়া পারাপার করে, কেউ বা করে চাষবাস। একটা সময়ে নৌকায় করে কত মানুষ এপার থেকে অন্য পারে যাতায়াত করত। আমার মতোই স্বচ্ছল ছিল তাদের জীবন। তোমাদের মানিকবাবু পদ্মা নদীর মাঝি লিখেছিলেন, এরকম কত মাঝি-মাল্লার জীবনই তো আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়—তোমরা তার খবর জানোই না। কত মাছ খেলে বেড়ায় আমার বুকে–চিংড়ি, খয়রা, পারশে, আরও কত নাম-নাজানা মাছ। জ্যোৎস্নায় যখন ভেসে যায় আমার শরীর—সকলে বলে আমি যেন এক রূপবতী কন্যে, আবার সূর্যের প্রথম আলো যখন ছুঁয়ে যায় আমায়, আমি তখন পূর্ণ যৌবনের এক উদ্ভাস। তবে আমার সব থেকে আনন্দের দিন বিজয়া দশমী। দুই বাংলা এক হয়ে যায় আমার বুকে। কয়েকশো নৌকা, হাজার হাজার মানুষ, নৌকায় দেবীপ্রতিমা— যেন অন্যরকম লাগে নিজেকে। যে দুটো তীর সারাবছর প্রায় নীরব থাকে সেখানেই তখন প্রাণের কী উন্মাদনা! নদীতীরে বসে জমজমাট মেলা। তোমাদের রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতির শক্ত বিষয়গুলো দূরে সরিয়ে দুটো দেশ, প্রাণের বন্ধনে আমারই বুকে মিলে যাচ্ছে—এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে!
আমার দুঃখ: পলি পড়ে আমার স্বচ্ছন্দ জলস্রোত আজ অনেকটাই স্তব্ধ, গতিহীন। পদ্মার সঙ্গে জলস্তরের তারতম্য থাকায় গ্রীষ্মকালে আমার উত্তর দিকে জলের ঘাটতি থাকে। বনগাঁর কাছে ক্ষীণস্রোতা হতে হতে আমি এখন প্রায় অদৃশ্য। বসিরহাটেও সেতু তৈরির পরে মজে গিয়ে আমার নাভিশ্বাস অবস্থা। টাকিতে তুলনায় স্বচ্ছন্দ থাকলেও চর জাগছে এখানে ওখানে। মাঝে মাঝে ভয় হয়, কত নদীই তো হারিয়ে গেল চিরকালের মতো— আমারও না তেমন দশা হয়। শুধু তো চেহারা পালটে যাওয়া নয়, সীমান্তরক্ষীদের কঠোর অনুশাসনে নৌকার চলাচল, মাছধরা—এসবও কমে গিয়েছে। একদিন আমার বুক থেকে ভেসে আসত মাঝি-মাল্লাদের গান— যেসব এখন যেন বিগত জীবনের স্মৃতি। জমিদারের বড়ো বড়ো বজরাগুলোও কালের নিয়মে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।
উপসংহার: দখিনা বাতাসকে বুকে নিয়ে, দু-পাশের জনজীবনের ছবিকে বুকে ধরে আজও আমি বয়ে চলেছি। একপাশে আজানের সুর, আর-এক পাশে মঙ্গলশাঁখ আজও ধ্বনিময় করে তুলেছে আমার স্রোতধারাকে। আমি সেই ইচ্ছেডানায় ভর করে বয়ে চলা ইছামতি।
৫. একটি পুরোনো বইয়ের আত্মকথা
উত্তর – ভূমিকা: কতকাল হয়ে গেল, আমি মানুষের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াই না। সকলে প্রথমটায় নেড়েচেড়ে দ্যাখে, তারপর আবার ফুটপাথে বইয়ের বান্ডিলগুলোর ওপর ছুড়ে ফেলে। আমি বই; তবে নতুন নই, পুরোনো, জীর্ণ।
আমার আত্মপ্রকাশ: জন্মমাত্রেই কিন্তু আমার এই চেহারা ছিল না। একগুচ্ছ সাদা কাগজে অনেক লেখা, অনেক কাটাছেঁড়া, ত্রুটি সংশোধনের পর কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর রচনা সম্পূর্ণ করেন। একাধিক কবিতা লেখেন তিনি এবং সবশেষে সেগুলি একত্র করে একটি অখণ্ড কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা চিন্তা করেন; নাম দেন–সাগর থেকে ফেরা”। এভাবেই আমার নামকরণ করা হয়।
শুরুর দিনগুলি : প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর এই বইয়ের জন্য বিপুল সংখ্যক কবিতা নির্বাচন করেননি; হাতে গোনা অথচ গুণগত মানে উৎকৃষ্ট কবিতা বেছেছিলেন। তাই আমি আকারে শীর্ণকায় হলেও গড়ে উঠেছিলাম কবির ভালোবাসায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অসামান্য প্রচ্ছদ ও নিখুঁত মুদ্রণ। তাই সবমিলিয়ে আমি বিপুল জনসমাদর লাভ করেছিলাম।
ফেলে আসা দিনগুলি: আমি কিন্তু বইটির প্রথম সংস্করণ নই, ষষ্ঠ সংস্করণ। প্রকাশিত হওয়ার পরেই গ্রন্থটি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার ও আরও নানান সম্মান অর্জন করার ফলে বাজারে এর কাটতি বেড়ে যায়। হু-হু করে বিকোতে থাকে বই। এরই মধ্যে অন্য একটি প্রকাশনা সংস্থা বইয়ের স্বত্ব কিনে নেয়। তাই আমি যে প্রকাশনালয় থেকে বেরিয়েছিলাম তার বিক্রিতে ভাটা পড়ে ও পুনর্মুদ্রণ বন্ধ হয়ে যায়।
আমার সুখ-দুঃখ: আমার সুদীর্ঘ জীবনে আমি অনেক বিখ্যাত গবেষক, লেখক থেকে শুরু করে তোমাদের বয়সি পড়ুয়া, ছাত্রছাত্রীদের সান্নিধ্য পেয়েছি। বিভিন্ন কাব্যপাঠের আসরে অনেক আবৃত্তিকার যখন আমায় হাতে নিয়ে মঞ্চে উঠে উদাত্ত কণ্ঠে একাধিক কবিতা পাঠ করতেন, তখন গর্বে আমার বুক ভরে উঠত। অনেক নিবিষ্ট পাঠক আমার পাতায় পাতায় পেনসিল বোলালে যন্ত্রণা নয়, বরং শব্দ ও পক্তির গুরুত্ব, বাক্যের চমৎকারিত্ব তাদের খুশি করছে জেনে আমিও আহ্লাদিত হয়ে উঠতাম।
আবার একটি স্থানীয় গ্রন্থাগারে যখন ঠাঁই পেয়েছিলাম তখন কেউ কেউ যখন শুরুর কিছু পাতা উলটে, ভালোভাবে একখানা কবিতাও না পড়ে আমায় ফেলে রেখে যেত তখন খুব দুঃখ হত। বই কতটা মজবুত সেদিকে নজর না দিয়ে অনেকে এই সেদিন পর্যন্তও ফোটোকপি করত। তাতে করে আমার বাঁধাইও আলগা হয়ে যেত, খসে পড়ত একাধিক পাতা। এতখানি আহ্লাদযন্ত্রণা, আনন্দ-অনাচার গায়ে মেখেই এখন আমি আলগা বাঁধাইয়ের, অনেকখানি পাতাবিহীন জীর্ণ, দীর্ণ বই।
উপসংহার: তবে এখন আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই, থাকা উচিতও নয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কালজয়ী রচনা হিসেবে আমার নাম এখনও উচ্চারিত হয়, ভবিষ্যতেও হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সময়ের বিচারে সমস্ত বস্তুগত জিনিসই পুরোনো হয়; কিন্তু সৃষ্টি কখনও মলিন হয় না। তাই আমি বহিরঙ্গে পুরোনো হলেও ভেতরে এখনও সজীব, সতেজ। আমার মধ্যেই রয়েছে ‘জং’ নামের একটি অসামান্য কবিতা। আমার একাকী, নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোয় আমি এখন সেটিই আওড়ে যাই
“হাওয়া বয় শন শন/ তারারা কাঁপে| হৃদয়ে কি জং ধরে/পুরানো খাপে?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিষয়ক

১.  একটি শিক্ষামূলক ভ্রমণ
উত্তর – ভূমিকা: ভ্রমণ মানে অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানা। আর সেই ভ্রমণ যদি হয় বন্ধুদের সঙ্গে, পাশে থাকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের নির্দেশনা ও সাহচর্য— তাহলে তো কথাই নেই। কিছুদিন আগে আমার এরকমই এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। স্কুলের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্য মুরশিদাবাদ ঘুরে এলাম।
যাত্রা শুরু: ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি লালগোলা এক্সপ্রেস ধরব বলে আমরা সকলে শিয়ালদহ স্টেশনে জড়ো হলাম। আমরা মানে ক্লাস নাইনের তেতাল্লিশ জন ছাত্র, তিন জন স্যার আর ট্যুর অপারেটরের লোকজন। আমাদের আনন্দ তখন দেখে কে। পাখি যেন উড়তে শিখেছে। বাবা-মায়ের মুখগুলো দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল—যেন ছেলেরা অনেকদিনের জন্য অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। ঠিক ১০.৩০ মিনিটে আমাদের ট্রেন ছাড়ল।
অতঃপর মুরশিদাবাদ: আমরা নির্ধরিত সময়ে মুরশিদাবাদ পৌঁছোলাম। হোটেলের ঘরে আমার তিন সঙ্গী হল আকাশ, সৌম্য আর সায়ন। ব্যাগপত্তর রেখে তিনজনে ঘরের মধ্যে খানিক হুটোপাটি করে নেমে এলাম হোটেলের লনে। বাবা-মার শাসনহীন এক মুক্ত জীবনের উল্লাস যেন আমাদের পেয়ে বসেছে। ২৮ জানুয়ারি সকালে আমরা গেলাম হাজারদুয়ারি, মিউজিয়াম প্যালেস। নবাবি আমলের অজস্র জিনিস মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। এরপর গেলাম ইমামবড়া আর ঘড়িঘর দেখতে— ঘড়িটা অবশ্য অচল হয়ে আছে। সিরাজ-উদ্‌দৌলার নিজের হাতে তৈরি মদিনা এবং কামানও দেখলাম। অদূরে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা, তার তীরে সিরাজের সমাধি। এই গঙ্গা যেন সেই ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী। পরদিন গেলাম কাটরা মসজিদ। এই মসজিদেই রয়েছে নবাব মুরশিদকুলি খাঁ-র সমাধি। সেখান থেকে গেলাম জাহানকোষার তোপখানা দেখতে। সুজিত স্যার আমাদের বললেন, ‘জাহানকোষা’ কথাটির অর্থ বিশ্ববিধ্বংসী। সেখান থেকে মতিঝিল ৷ বিশাল অর্ধচন্দ্রাকৃতি ঝিলের পাশে এক অতি প্রাচীন মসজিদ যেন তার রহস্যময়তা নিয়ে আমাদের আহ্বান করছিল। শেষদিনে আমরা গিয়েছিলাম কাঠগোলা বাগান দেখতে। এটি একটি জৈন মন্দির। পুকুরগাছপালা দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরে মাইকেল এঞ্জেলোর একটি মর্মর মূর্তি রয়েছে। এরপর নূরপুরে গেলাম রেশমচাষ দেখতে। মুরশিদাবাদের স্মারক হিসেবে দু-একটা রেশমগুটিও সংগ্রহ করে নিলাম।
অন্যকথা: দেখলাম অনেক কিছু, জানলাম অনেক না-জানা বিষয়। আর তার সঙ্গেই অনুভব করলাম জীবনের এক অচেনা দিক। এতজন বন্ধু একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, থাকা, ঘুরতে যাওয়া, নতুন কিছু দেখার আনন্দ ভাগ করে নেওয়া—এসব সারা জীবনের সঞ্চয়। স্যারেদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর সম্পর্কটা যেন অনেক সহজ মনে হতে লাগল। সুজিত স্যারের মজা করা, প্রদীপ স্যারের আবৃত্তি—স্যারেদের এভাবে ক্লাসরুমে তো পাই না। তাই ফেরার সময় স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ হয়ে গেল। ট্রেনে ওঠার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত তা ছিল। হয়তো এই মন খারাপই আরও মধুর করে রেখেছে মুরশিদাবাদের স্মৃতি।
২. একটি শীতের সকাল
উত্তর – ভূমিকা: বাংলার ঋতুরঙ্গশালায় শীত আসে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে। শীতের সকালেও থাকে সেই স্বাতন্ত্র্যের ছোঁয়া। মানুষের রোজকার জীবনকে আলস্য আর উপভোগের চাদরে মুড়ে রাখে শীতের সকাল। গরমের অস্বস্তি আর বর্ষার আশঙ্কার বাইরে শীতের সকাল মানে এক অন্যরকম জেগে ওঠা।
শীতের স্বাতন্ত্র্য: শীত আমাদের বর্ষার মেঘমল্লার শোনায় না, কালবৈশাখীর প্রলয়তাণ্ডবে নিয়ে আসে না নটরাজের প্রলয়নৃত্যের মূর্ছনাও। শীত অনেক বেশি আত্মমগ্ন। শীত মানে বাজারে নতুন সবজি, আপেল আর কমলালেবুর সমারোহ। শীত মানে নলেন গুড়ের পিঠে, পায়েস, জয়নগরের মোয়া। শীত মানে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকার ফুটে ওঠা। শীত এলেই গলির ক্রিকেট, বড়োদিনের কেক আর দেশের সীমানা ভুলে নিউ ইয়ারের হুল্লোড়। শীত মানেই পিকনিকে যাওয়ার হুড়োহুড়ি, সারারাত ধরে গানের আসর আর বইমেলা, চলচ্চিত্র উৎসব। শীতকাল মানে দিনকে ছোটো করে দিয়ে সূর্যের হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, শীত মানেই বন্ধ ঘরে উন্নতার খোঁজ।
একটি শীতের সকাল: শীতের সকাল মানেই কম্বলমুড়ি দিয়ে অলস শুয়ে থাকা, বিছানা ছাড়তে ঘোরতর অনিচ্ছা। মায়ের বারবার ডাকাডাকিতে উঠে পড়তে হয় বটে, কিন্তু মন হয়ে থাকে জবুথবু। সোয়েটার, মাফলারে নিজেকে মুড়ে শুরু হয় দিনের চলা। উয়তার খোঁজে হরলিকসে গলা ভেজানো। জানলা দিয়ে বিছানায় এসে পড়া রোদ্দুরকে তখন বড়ো প্রিয় মনে হয়। কুয়াশার চাদর সরিয়ে তার আসাও সহজ নয়। জানালার সামনে বসে দেখি আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির লোকজন একটা গাড়িতে উঠছে। তার মধ্যে নীল, সোনাইরাও আছে। ওরা আমার বন্ধু। মনে পড়ল ওরা আজ পিকনিকে যাচ্ছে। সামনে পরীক্ষা না থাকলে আমরাও যেতাম। শীতের মজাই তো পিকনিক। যেতে না পারায় আবার মন খারাপ। মন খারাপ কাটল মা যখন কড়াইশুঁটির কচুরি আর জয়নগরের মোয়া নিয়ে এলেন। বাবা এলেন বাজার থেকে। ব্যাগে উকি দিচ্ছে ফুলকপি, পিঁয়াজকলি। আজ রবিবার। বাবা বাজার থেকে এনেছেন কমলালেবু, নলেনগুড়ের রসগোল্লা। শীতকে ধন্যবাদ। আমাদের জন্য এই বিপুল আয়োজন করে দিয়েছে সে। ইতিমধ্যে চারপাশের কুয়াশা প্রায় সরে গেছে। ঝলমল করছে রোদ্দুর। রাস্তায় একজন হেঁকে যাচ্ছে “চাই নলেন গুড়, পাটালি”। কে জানে কোন্ সকালে কোথা থেকে কত শিশির গায়ে মেখে এই মানুষটা তাঁর যাত্রা শুরু করেছেন। চলার পথের ধারে পড়েছিল কত সোনালি ফুলের সরষের খেত, গোলাভরা ধানের কত জনপদ। আমার জানতে ইচ্ছা হল ওর বাড়িতেও আমার মতো কোনো ছেলে আছে কি না। মনে হল হয়তো তার কোনো । নেই। ঠান্ডাকে দূরে রাখতে সে তার মার সঙ্গে হয়তো আগুনে হাত সেঁকছে। আমার মনে পড়ল সুকান্তের সেই কবিতাটা—
“হে সূর্য! তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে/উত্তাপ আর আলো দিও,/আর উত্তাপ দিও/রাস্তার ধারের ওই উলঙ্গ ছেলেটাকে।” এভাবেই শীতের সকাল আমার ভাবনাতরঙ্গে তৈরি করে দেয় অজস্র অভিঘাত। সেই উপলব্ধি যেমন আনন্দের, উপভোগের আবার তেমনই বিষণ্নতারও।
উপসংহার: শীতের সকাল এক অলস জাগরণ, সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা। শীতের সকাল মানেই বৈচিত্র্যের বিপুল সমারোহ। পড়াশোনা এবং প্রাত্যহিকতাকে একটুও দূরে না সরিয়ে তা নিয়ে আসে নতুন কিছুকে পাওয়ার শিহরণ। শীতের সকাল তাই আমার অভিজ্ঞতায়, বছরজুড়ে জেগে থাকা এক উন্মুখ প্রত্যাশা।
৩. শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলি
উত্তর –
“বয়স তখন ছিল কাঁচা, হালকা দেহখানা। ছিল পাখির মতো, শুধু ছিল না তার ডানা।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: মানুষের জীবন এক বিরামহীন এগিয়ে চলা। নতুন ঘটনা, নতুন অভিজ্ঞতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনার বাঁকে বাঁকে জীবন নিজেকে সম্পন্ন করে। আজকের বর্তমান কাল হয়ে যায় অতীত। তবুও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত মানুষ নিজস্ব নির্জন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকায়; শুশ্রূষার প্রলেপ খোঁজে আদরের অতীত থেকে।
আমার শৈশব: আমার শৈশব কেটেছে ইছামতি নদীর ধারে এক মফস্সল শহরে। জায়গাটার নাম টাকি। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত এই জায়গাটা অত্যন্ত বনেদি। অনেকগুলো জমিদারবাড়ি, স্কুলকলেজ-লাইব্রেরি নিয়ে টাকি একটা সমৃদ্ধ অঞ্চল। আবার খুব কাছেই ধানখেত, ইতিউতি পুকুর-ডোবা, আর ছিল সরল-সহজ মানুষজন। এখানকারই টাকি সরকারি স্কুলে কেটেছে আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম পর্ব।
শৈশবের স্মৃতি: আমার শৈশব মানে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে ঠাকুমার কাছে গল্প শোনা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া টুকটুকে ফরসা আমার ঠাকুমাই আমাকে শুনিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ক্ষীরের পুতুল’। সেই অবুঝ বেলাতেও আশি পার করে দেওয়া এক বৃদ্ধা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন কল্পনার জগতে। সন্ধে হলে মা-র কাছে দোতলার ঘরে পড়তে বসতাম। সস্তার কাগজে ছাপা ‘ধারাপাত’, বিদ্যাসাগরের ছবি আঁকা গোলাপি কাগজে মোড়ানো ‘বর্ণপরিচয়’। আজও সেসব বইয়ের কথা মনে পড়ে। গরমকালে জানলা দিয়ে হাওয়া আসত, আর সঙ্গে হাসনুহানার গন্ধ। বাবা সন্ধে বেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে টিভিতে খবর দেখতেন। আমার টিভি দেখা বারণ ছিল। শুধু ছোটোদের সিনেমা হলে ডাক পড়ত। আজ শহর কলকাতার ধোঁয়া-কালি মাখা দিনগুলোয় হারিয়ে গেছে শৈশবের হাসনুহানা।
আমার স্কুল; প্রথম যেদিন স্কুলে ভরতি হতে গেলাম, কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, “মা না এলে কিছুই বলব না।” বাবা বলেন, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন সেই হৃষীকেশ স্যার আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। রিকশায় করে ছোটোবেলার বন্ধু জাহাঙ্গিরের সঙ্গে স্কুলে আসা। সেদিনের হৃষীকেশ স্যার, সনাতন স্যার, বাদল স্যার—মনে আছে সকলের কথা। মনে আছে স্কুলের গাছ থেকে জামরুল পাড়ার ব্যর্থ চেষ্টা, পড়ে গিয়ে কপাল ফাটার মতো কত ঘটনা। বইয়ের অক্ষর ছাপিয়ে সে ছিল আমার সবুজ স্কুল।
স্মৃতি সতত সুখের: এক ছুটে খেলার মাঠ, কিছুই খেলতে না শেখা দিনগুলোতে সবুজ ঘাসে গড়াগড়ি কিংবা হাঁটুজলে দাপাদাপি, বাবার বেদম মার—যন্ত্রণার স্মৃতি ভুলে আজ সবই মধুর। কলকাতা শহরের ফ্ল্যাটবাড়িতে এখন আমি থাকি। স্কুল বাসে যাতায়াত করা। আমার সেই শৈশব আজ যেন বিগত গল্পের স্মৃতি। গরমকালে দুপুরবেলা লুকিয়ে আম কুড়ানো, বৃষ্টিতে ভেজা—মনে পড়ে সব। সেদিনের বৃষ্টিতে আজও মনে মনে ভিজে যাই আমি। উপসংহার: মাধ্যমিক, জয়েন্ট এনট্রান্স, আইআইটি—আমার মগজজুড়ে আজ ঝাঁ-চকচকে আধুনিক জীবন কিন্তু হৃদয়ে আমার আজও নদীর ধার, সবুজ ধানখেতের পাশে দাঁড়িয়ে বহুদূরে ট্রেন যেতে দেখা, দেওয়ালের গায়ে রংপেনসিলের দাগ, চাঁদের বুড়ি, আমার বুড়ি ঠাকুমা…। আমার জীবন্ত শৈশব তাই আজকের এই বর্ণহীন শহরে বহুদূর থেকে ভেসে আসা সবুজের হাতছানি।
8. একটি নির্জন দুপুর
উত্তর –
“যখন একটু বড়ো হইয়াছি এবং চাকরদের শাসন কিঞ্চিৎ শিথিল হইয়াছে….তখন এক একদিন মধ্যাহ্নে সেই ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইতাম।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা: দিন-রাত্রির বিবর্তনের সুরে বাঁধা আমাদের জীবন। বিভিন্ন সময় তৈরি করে দেয় এক নিজস্ব মেজাজ যা প্রভাবিত করে মানুষের জীবনের ছন্দস্পন্দকে। তারই মধ্যে আবার তৈরি হয় কিছু বিশেষ মুহূর্ত, যা সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকে। খর-মধ্যাহ্নের এমনই এক স্মৃতি ঘিরে আছে আমাকেও। সকাল গড়িয়ে দুপুর: তারিখটা ছিল ৩০ মে, ২০২২ শুক্রবার। সবে কয়েকদিন হয়েছে গরমের ছুটি শুরু হয়েছে। সপ্তাহের শেষ কাজের দিন, তাই বাবা-মা দুজনেই অফিসে। বাড়িতে আমি একা। যে শিবানী মাসি আমাকে দেখাশোনা করে সে-ও গেছে তার দেশের বাড়িতে। আমি একা। ঠাকুরদার তৈরি আমাদের বেশ পুরোনো দোতলা বাড়িতে আমার সঙ্গে আর কেউ নেই—এই ভাবনা আমার মনে একইসাথে বেশ ভয় এবং রোমাঞ্চ জাগিয়ে তুলল। মা-কে ফোন করলাম, একবার ভাবলাম পাশের বাড়িতে পাপানের সঙ্গে খেলি কিন্তু ঘরে তালা দিতে হবে বলে সাহস করলাম না। টিভিতে ইউরো কাপের একটা খেলা দেখাচ্ছিল। কিছুক্ষণ দেখলাম। মন বসল না। মা বলে গেছেন পড়াশোনা করতে। সে তো যা এলেও করতে হবে। অতএব বই বন্ধ।
নিস্তব্ধ দুপুরে একা আমি: গিয়ে বসলাম দোতলার জানলার কাছে। উঠোনের কৃষ্ণচূড়াটায় ফুল এসেছে। লাল হয়ে আছে গাছটা। তপ্ত গ্রীষ্ম যেন গাছে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একজন মানুষ চলেছেন ঝুড়ি মাথায়। সব্‌জি বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। এবার বাড়ি ফিরছেন। কোথায় বাড়ি আমি জানি না, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো উনি বাড়ি ফিরে যাবেন। ওঁরও ছেলের হয়তো গরমের ছুটি চলছে। সেই ছেলেটি বাবা-মা-র সঙ্গেই দুপুরে খেতে বসবে। কিন্তু আমি একা। আমার তখনই মনে হল উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই কৃষ্ণচূড়া, বাঁদিকে পাঁচিলের কোনায় ওই নারকেল গাছ, ওই যে টেলিফোনের তারে বসে থাকা বিষণ্ণ কাক ওরাও তো একা। চারপাশের প্রকৃতি আমাকে আরও ভাবুক করে তুলল। রাস্তাঘাটে লোকজন খুবই কম চলাচল করছে। এরই মধ্যে একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সাহায্য চাইছেন, খুব কষ্ট হল আমার। মুহূর্তে আমার মনে হল মা টিফিনের জন্য কিছু কেক, মিষ্টি রেখে গেছেন। আমি নীচে নেমে গেলাম। দরজা খোলা বারণ। তাই জানলা দিয়ে বৃদ্ধাকে ডাকলাম। ওকে কেক, মিষ্টিগুলো দিলাম। উনি হাত তুলে প্রণাম করলেন। এতক্ষণের বিষণ্ণতার মধ্যে হঠাৎই যেন একটু আনন্দ খুঁজে পেলাম। এই বৃদ্ধা—যাঁকে আমি হয়তো আর কোনোদিনও দেখব না, তিনি এই নির্জন দুপুরে জড়িয়ে গেলেন আমার মনের সঙ্গে। এই তো আমার দেশ। কত মানুষের না খেতে পাওয়া, বিষণ্ণতার কাহিনি লেখা আছে এর বুকে। এই বিষণ্ণ দুপুরের মতোই তাদের জীবন। শেষ বিকেলে: কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। অজস্র ভাবনার পথ ধরে চলতে চলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা ফিরে এসেছেন। সূর্যও এখন অনেক ম্লান। নির্জন রাস্তায় আবার দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষজন। এভাবেই দুপুর গিয়ে সন্ধ্যা নামে। অপেক্ষা থাকে নতুন সকালের। তারই মধ্যে সেদিনের নির্জন দুপুরের মতো কিছু মুহূর্ত নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় নিজেকেই। যেখানে দীর্ঘতর হয় জীবনের আলো-ছায়া—যার কিছুটা জানা, কিছু অজানা।
৫. তোমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা
উত্তর – ভূমিকা: বহতা নদীর মতো এগিয়ে চলে মানুষের জীবন। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চড়াই উতরাই ভেঙে সে চলা নতুনের উপকূলে। কিন্তু পথ চলতে চলতে বারবার পিছন ফিরে তাকায় এই মানুষই। সেখানে ভেসে ওঠে কত মুখ, কত ঘটনা। স্মৃতির উত্তাপে সঞ্জীবিত হয় সে।
আমার কথা: আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনেও ভিড় করে আছে কত ঘটনা। সেখানে প্রথম রাজ্য ছাড়িয়ে বেড়াতে যাওয়া, প্রথম বইমেলা দেখা, প্রথম প্লেনে চড়া কিংবা প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে পুজোর ঠাকুর দেখতে যাওয়ার স্মৃতি যেমন আজও সজীব হয়ে আছে, ঠিক তার পাশে চোখে ভেসে ওঠে একদিন সকালে চা খেতে খেতে দাদুর মৃত্যু। হাসি-কান্নার আলোছায়ার এই আবহে একটিমাত্র স্মরণীয় ঘটনা বেছে নিতে বললে সেটি হল আমার প্রথমদিন হাই স্কুলে যাওয়া।
সলতে পাকানোর কাল: আমি আমার প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছি টাকি সরকারি বিদ্যালয়ে। সকাল সাড়ে ছটায় আমার স্কুল শুরু হত। নিত্যদা ঢং ঢং করে ঘণ্টা দিতেন আর আমরা গিয়ে দাঁড়াতাম স্কুল গ্রাউন্ডে প্রার্থনা সংগীতের জন্য। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি – কৃষ্ণ স্যার, বলাই স্যার, মেনকা ম্যাডাম এঁদের স্নেহচ্ছায়ায় কেটে গেছে আমার জীবন। তারপর পঞ্চম শ্রেণির রেজাল্ট বেরোনো। বাবা বললেন আমার সকালে আসার দিন শেষ। শুরু আমার হাই স্কুলের জীবন।
প্রথম সে দিন: স্কুলের নতুন পোশাক পরে বাবার সঙ্গে স্কুলে পৌঁছোলাম ঠিক সাড়ে দশটায়। সেই একই বিল্ডিং, একই ক্লাসঘর, শুধু মানুষগুলোই আলাদা। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে বড়ো বড়ো দাদারা। মাথা উঁচু করে দেখতে হয়, এগারো-বারো ক্লাসে পড়ে ওরা। পাশে বাবাও নেই। জনারণ্যে কেমন যেন একা একা লাগতে শুরু করল। প্রার্থনাশেষে এগারোটায় ক্লাশ শুরু হল। দীর্ঘদেহী একজন শিক্ষকমশাই রোলকলের খাতা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। গম্ভীর গলা, পরে জেনেছি নাম দুর্গাদাস বাবু। ইংরেজি গ্রামার পড়ালেন। কিছু গল্পও করলেন। তারপর একে একে এলেন বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল আর আঁকার স্যার। ইতিহাসের স্যার তারকবাবু খুব মজা করেছিলেন। আস্তে আস্তে মনের ভয়টা কেটে গেল। শুধু টিফিনের সময় মাঠে যাইনি, কারণ ওখানে বড়োরা খেলছিল। এরই মধ্যে একবার হেডস্যার ক্লাসে ঘুরে গেলেন। পিঠে হাত দিয়ে আমাদের কেমন লাগছে জানতেও চাইলেন। ঠিক চারটেয় ছুটি হল। গেটের বাইরে গিয়ে বাবার হাত ধরলাম।
উপসংহার: সেদিনের আড়ষ্টতা কাটিয়ে আমি এখন ক্লাস টেন। স্কুলমাঠে খেলতে এখন আর আমার কোনো দ্বিধা নেই। বাংলার বিজয়বাবু, অংকের চঞ্চলবাবু, ইতিহাসের তারকবাবু—স্যারেদের নামগুলোই শুধু জানিনি, পেয়েছি তাদের স্নেহ-ভালোবাসা। এখন আমি নিজেই স্কুলে আসি। এ বছর মাধ্যমিক দেব। স্যারেরা বলেন আসল পরীক্ষা এবারই শুরু হবে। স্কুল ছাড়িয়ে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—এগিয়ে চলবে জীবন। কিন্তু স্কুলের ঘাসে প্রথমবার রেখে যাওয়া আমার পায়ের ছাপ, প্রথম দিনের সমস্ত ঘটনা সে তো স্মৃতি থেকে বারবার আমাকে ডাকে। বিদ্যালয়ের প্রথম দিনের এই স্মৃতি চিরভাস্বর, চির অমলিন হয়ে থাকবে আমার জীবনে।
৬. একটি ফুটবল ম্যাচের স্মৃতি
উত্তর – ভূমিকা: দিনটা ছিল রোববার। সেদিন বিকেলবেলায় আমি আর আমার বন্ধুরা আমার বাবার সাথে গিয়েছিলাম বৃন্দাবনী ময়দানে, ইউনাইটেড ইয়ংস এবং শান্তি ভারতী ক্লাবের মধ্যে আয়োজিত ‘সুপার কাপ’-এর ফাইনাল ম্যাচ দেখতে। আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। কিন্তু দিনটি আমার কাছে আরও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, বৃন্দাবনী মাঠের সুবিশাল গ্যালারিতে বসে ফুটবল ম্যাচ দেখবার লোভ ছিল আমার বহুদিনের। নানা কারণে সেটা ততদিন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে বাবা যখন এসে ফাইনাল খেলা দেখতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমায় দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।
যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব: ‘সুপার কাপ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল মালদহ, দুই দিনাজপুর, মুরশিদাবাদ এবং জলপাইগুড়ি জেলার অনেকগুলি নামজাদা ক্লাব। ফলে টুর্নামেন্ট ঘিরে মালদহ জেলার জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল তুঙ্গে। ফাইনালের চাহিদা আগেভাগে আঁচ করতে পেরে সাত দিন আগে থেকে বাবা টিকিট কেটে রেখেছিলেন। সুদৃশ্য, সুবিশাল গ্যালারি আমাকে বরাবর আকৃষ্ট করত। কিন্তু ময়দানের মাঠে কিংবা গ্যালারিতে—কোথাওই প্রবেশের ছাড়পত্র আমাদের ছিল না। সেখানে বিভিন্ন ক্লাবের প্র্যাকটিস এবং প্রতিযোগিতা হত। তাই আকর্ষণ ছিল প্রবল।
শনিবার রাতে ঘুম হয় না, রবিবার সকালে অঙ্ক করতে গিয়ে দেখি উত্তর মিলছে না। কখন দুপুর হবে সেই প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি।
টুর্নামেন্টের কথা: পাঁচটি জেলা থেকে মোট বারোটি ক্লাব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। তাদের চারটি গ্রুপে প্রথমে ভাগ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপের সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জনকারী দল সরাসরি সেমিফাইনালে ওঠে। সেমি-ফাইনালের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয় মালদহের ইউনাইটেড ইয়ংস এবং জলপাইগুড়ির ত্রিবেণী যুবক সংঘ। অন্য সেমিফাইনালে আমার জেলার অন্য ক্লাব শান্তি ভারতীর সামনে পড়ে দক্ষিণ দিনাজপুরের নেতাজি স্পোর্টস ক্লাব।
প্রথম সেমিফাইনালে একপেশে লড়াইয়ে ইউনাইটেড ইয়ংস ৫-০ গোলে চূর্ণ করে তার প্রতিপক্ষকে। অন্য ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়—–শান্তি ভারতী জেতে ৩-২ গোলে। ফাইনালে জোর টক্কর হবে জেনেও অধিকাংশ জনসাধারণই ইউনাইটেড ইয়ংসকে এগিয়ে রেখেছিল, সেমিফাইনালে দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্সের কারণে।
ম্যাচের কথা: উন্মাদনা সঙ্গে নিয়েই মাঠের পথে পা বাড়াই। কাতারে কাতারে জনতা স্টেডিয়ামের মূল দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল। অনেক ভিড় ঠেলে অবশেষে নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসি।
খেলা শুরু হয়। প্রথমার্ধের প্রথম দশ মিনিট ইউনাইটেড ইয়ংস আধিপত্য দেখালেও শান্তি ভারতী ধীরে ধীরে ম্যাচে ফেরে। একসময় সমানে সমানে লড়াই চলে। দুই টিমের স্ট্রাইকাররাই বেশ কিছু সহজ সুযোগ মিস করে। প্রথমার্ধের খেলা গোলশূন্য ভাবে শেষ হয়। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই শান্তি ভারতী অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে যায়। তাদের স্ট্রাইকার রণজিৎ দত্তের দূরপাল্লার শটে গোল হয়। গ্যালারির অর্ধাংশ উল্লাসে ফেটে পড়ে। ঠিক তিন মিনিট বাদে শান্তি ভারতী ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। বাকি সময়টায় ইউনাইটেড ইয়ংস চাপ বাড়ালেও বিপক্ষের দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভাঙতে পারেনি। তাই ফাইনালের কাপ হাতে তোলে শান্তি ভারতী-ই।
উপসংহার: ফাইনালে আমার সমর্থন ছিল দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু শান্তি ভারতী বাড়ির নিকটতম ক্লাব হওয়ায় সমর্থনের পাল্লা তাদের দিকেই বেশি ঝুঁকেছিল। তাই ফাইনালে তাদের জয়লাভে খুশিই হয়েছিলাম। বিপুল দর্শক সমাগম, গ্যালারির গর্জন, ফুটবলারদের দক্ষতা—সবমিলিয়ে ম্যাচের স্মৃতি আমার মনে এখনও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
৭. একটি বৃষ্টিমুখর দিনের অভিজ্ঞতা
উত্তর –
“এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে ফেরে/ আষাঢ়ে গল্পে সাক্ষী তো ছিল সে-ই/ আমরা গিয়েছি সময়ের কাছে হেরে/ শুধু বৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।”
—শ্রীজাত
ভূমিকা: সকালেও সেদিন আমার ঘুম ভেঙেছিল মুখের ওপরে এসে পড়া আলতো রোদের আঁকিবুকিতে। চারপাশে সদ্য-হওয়া সকালের ব্যস্ততা আর শব্দ—–বারান্দায় কাগজওয়ালার সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ, রাস্তায় বাজারমুখী তপনকাকুর চটির ফটাস ফটাস শব্দ, রান্নাঘরে চায়ের জল ফোটার শব্দসবমিলিয়ে সকালটা অন্য আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল কর্মমুখর। কিন্তু, ন-টা বাজতে না বাজতেই আকাশ একেবারে আঁধার করে এল। দিনটা ছিল রবিবার। তাই সেদিন স্কুলে যাওয়ারও কোনো তাড়া নেই। আমি বহুদিন পর আঁকার খাতাটা বের করে আঁকতে বসে গেলাম। আপন মনে এঁকে চলেছিকালো হয়ে আসা আকাশ, তার গায়ে ঘনিয়ে ওঠা জলভরা মেঘ—কখন যে মা এসে পিছনে দাঁড়িয়েছেন, টেরই পাইনি। হঠাৎ শুনলাম, মায়ের গলা“ঈশান কোণে ঐ যে ঝড়ের বাণীযগুরুগুরু রবে কী করিছে কানাকানি।” এমন সময় ঝোঁপে বৃষ্টি নামল। আর আমিও অমনি রং, তুলি ফেলে, পাততাড়ি গুটিয়ে সটান জানলার ধারে গিয়ে বসে পড়লাম। জানলায় বসেই দেখতে পাচ্ছি, পথের সব লোকজন দৌড়োদৌড়ি লাগিয়ে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সব লোকজন ভিড় করে এ-দোকানের ছাউনি, ও-বাড়ির রোয়াকে গিয়ে আশ্রয় নিল। শুনশান রাস্তার কালো পিচ ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভিজে চকচক করছে। দেখতে দেখতে রাস্তায় একহাঁটু জল দাঁড়িয়ে গেল।
কী করলাম; আমার বৃষ্টি দেখা তখনও ফুরোয়নি। মা তাড়া লাগিয়ে স্নান সেরে আসতে বললেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় জানলার ধার ছেড়ে উঠলাম। খেতে বসে দেখি গরম গরম খিচুড়ি আর সঙ্গে কতরকম ভাজা। মনটা আবার খুশি হয়ে গেল। সত্যিই তো, এমন শিরশিরে ঠান্ডা বৃষ্টির দিনে খিচুরি হলে আর কী চাই। এদিকে সারাদিন ধরে বৃষ্টির থামার কোনো লক্ষণই নেই। এইবার আমার একটু একটু মন খারাপ করতে লাগল। বিকেলের আলোটা মরে আসছে, আর তারই মধ্যে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি—কখনও টিপটিপ করে, কখনও ঝমঝমিয়ে — চলেছে তো চলেছেই। আমার মনে পড়ছে সেই গানটার লাইনগুলো—“মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে।”
দিনের শেষ: ক্রমশ অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আমার পড়তে বসতেও একদম ইচ্ছে করছিল না। কী করব ভাবছি, এমন সময় মস্ত কালো ছাতা মাথায় ছপছপ করতে করতে গরম পেঁয়াজির ঠোঙা হাতে বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকলেন মিত্তিরদাদু। তাঁকে দেখামাত্রই মনটা যেন ‘হুররে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। মিত্তিরদাদু আসা মানেই নানান মজা শুরু। কারণ, মিত্তিরদাদু প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর ভাঁড়ারে অজস্র গল্প। কিন্তু আজ সন্ধের মেজাজটা বুঝতে পেরেই বোধহয় মিত্তিরদাদু দেশ-বিদেশের গল্প না শুনিয়ে, ভূতের গল্প বলা শুরু করলেন। আমরা সবাই দাদুকে গোল করে ঘিরে বসে গরম গরম চা আর পেঁয়াজি সহযোগে ভূতের গল্প শুনতে লাগলাম। কখন যে বৃষ্টি থেমে গেছে টেরই পাইনি। দাদুর চলে যাওয়ার সময় দেখলাম, আর বৃষ্টি নেই, মেঘও নেই। শুধু পরিষ্কার আকাশে জ্বলজ্বলে এক টুকরো চাঁদ ঝুলে রয়েছে।
৮. একটি অলৌকিক অভিজ্ঞতা
উত্তর – ভূমিকা: ছোটোবেলা থেকেই কোনোদিন ভূতপ্রেতে আমার বিশ্বাস ছিল না। যদিও নানাসময় নানা অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে শুনেছি কিন্তু কোনোদিনই মন থেকে এসব বিশ্বাস করিনি। এই সব কিছুই ছিল আমার কাছে আজগুবি গল্পের মতো, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কিন্তু আমার এই বিশ্বাস, অর্থাৎ অলৌকিক ঘটনা বলে কিছু হয় না, ভূতপ্রেতের কোনো অস্তিত্ব নেই এই ধারণাটা ভেঙেছিল নিজের সঙ্গে হওয়া একটি ঘটনার পর থেকে। আজও আমি সেই ঘটনার বা আমার সেই অভিজ্ঞতার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। যুক্তিযুক্ত কোনো উত্তরও খুঁজে পাইনি।
কোথায় হয়েছিল: ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক দু-বছর আগে এক শীতের রাতে। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমরা তিন বন্ধু তালডাঙা বলে একটা জায়গায় প্রাইভেট টিউশন পড়তে যেতাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে করে কুড়ি মিনিট লাগত সেই জায়গায় পৌঁছোতে। বাস থেকে নেমে দশ মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে আমরা স্যারের বাড়ি পৌঁছোতাম। যাওয়ার পথে একটা ভাঙাচোরা মন্দির দেখতে পেতাম। সেই মন্দিরের আশেপাশে কোনো জনবসতি ছিল না। এই মন্দির নিয়ে নানা আজগুবি গল্প প্রচলিত ছিল। ওই মন্দিরের রাস্তা দিয়ে বিশেষ কেউ যাতায়াতও করত না। কিন্তু খুব কম সময়ে বড়ো রাস্তায় পৌঁছোনো যেত বলে ওই মন্দিরের রাস্তাই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা।
কী হয়েছিল: এইরকমই একদিন পড়ে ফিরছি, হঠাৎ মনে হল কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। সেদিন আমি একাই ছিলাম, আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। প্রথমে ভাবলাম আমি ভুল শুনেছি। তাই থেমে গিয়েও আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু আবার শুনতে পেলাম সেই ডাক। মনে হল মন্দিরের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করে বলছে তাকে বাঁচাতে, সে সেখানে অনেকদিন ধরে বন্দি। কিন্তু এইসময় ওই জায়গায় কারও থাকার কথা নয়। কারণ ওই মন্দিরের দূরদূরান্তে কোনো জনবসতি নেই আর এই রাস্তা দিয়ে কেউ আসেও না। মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে সেই ডাক অনুসরণ করে আমি এগিয়ে গেলাম। যে দরজার ভেতর থেকে আওয়াজ আসছিল অর্থাৎ যে দরজাটায় ধাক্কা দিয়ে কেউ ডাকছিল, সেটা তালাবন্ধ না থাকায়, আমার হাতের সামান্য একটু ধাক্কাতেই তা খুলে গেল। কিন্তু খুব অদ্ভুত ব্যাপার, দরজা খুলে ভেতরে কাউকে দেখতে পেলাম না। এই ঘটনায় আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সেখান থেকে দৌড় লাগালাম। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ফলে চিৎকার করার ক্ষমতাটুকুও আমার ছিল না। কোনোমতে দৌড়ে বড়ো রাস্তায় পৌঁছোতে মনের সাহস কিছুটা ফিরে এল।
প্রতিক্রিয়া: বাড়িতে ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা সকলকে বললাম। কিন্তু কেউই সেটা বিশ্বাস করল না। সেই দিনের সেই অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিলাম কেবল আমি নিজে। সেই চিৎকার যেন আজও আমি শুনতে পাই। আর সেই দিনের সেই ঘটনাটা ভেবে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়, যেটা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। সেই দিনের সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়তো সারাজীবন আমার সঙ্গী হয়ে থাকবে।
৯. তোমার প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র
উত্তর – 
ভূমিকা: জীবনের সীমায়িত পরিধিতে যে কয়টি স্থানে আমি ভ্রমণ করেছি, তার মধ্যে আমার প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হল মুরশিদাবাদের হাজারদুয়ারি। ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের এমন মনোরম স্থান পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও নেই। পশ্চিমবঙ্গে যে কয়টি পর্যটন কেন্দ্র বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয়, হাজারদুয়ারি তাদের মধ্যে গাম্ভীর্যে এবং গৌরবে অতুলনীয়।
অবস্থান: মুরশিদাবাদ জেলার বহরমপুর মহকুমার অন্তর্গত লালবাগে এই ঐতিহাসিক সৌধটি অবস্থিত। ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে এই সৌধটির সংলগ্ন ইমামবাড়াও প্রাচীনত্বে মহনীয়। সিরাজ-উদ্‌দৌলার মৃত্যুর পর হুমায়ুন জা হাজারদুয়ারি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটি ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে। এখানে নবাবি আমলের বহু নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এটি মূলত একটি সংগ্রহশালা। এই হাজারদুয়ারির নিকটবর্তী স্থানে আছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কাঠগোলা বাগান, জগৎশেঠের বাড়ি, নবাব বংশের সমাধিস্থল, মীরজাফরের বাড়ি, কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, খোসবাগ ইত্যাদি। নবাব সিরাজ-উদদৌলার স্মৃতি বুকে নিয়ে এই জায়গাগুলি বহু পর্যটকের সংবেদকে আকর্ষণ করে চলেছে। ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে খোসবাগে আছে আলিবর্দি খাঁ, আমিন ও সিরাজের সমাধিস্থল।
কেন প্রিয় ভালোলাগা, মন্দলাগা ব্যাপারটি মানুষের রুচির ওপর নির্ভরশীল। আমার কাছে যা প্রিয়, অন্যের কাছে তা নাও হতে পারে। তবে মুরশিদাবাদের একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা আছে। বাংলার স্মরণীয় ইতিহাসের একটা অধ্যায় এখানে নীরব হয়ে আছে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদদৌলার স্মৃতি যেন প্রাচীন প্রাসাদগুলির অলিন্দে অলিন্দে আজও অক্ষত হয়ে আছে। এক অনির্বচনীয় ভাবাবেগে মন আবিষ্ট হয়। মনে হয় বাংলার এক গৌরবময় ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগে মনের মধ্যে তৈরি গভীর ভাবাবেগ। তাই হাজারদুয়ারি আমার প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
সরকারি পদক্ষেপ: বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। তবে মুরশিদাবাদের প্রতি সরকারি পদক্ষেপ আরও জরুরি হওয়া প্রয়োজন। বহু প্রাচীন সৌধ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায়। সেগুলি অধিগ্রহণ করে অবিলম্বে সংস্কার করতে হবে। রাস্তাঘাটও উন্নত নয়। পর্যটকদের যাতায়াতে খুব অসুবিধা হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণে ঐতিহাসিক সৌধগুলির সংস্কার সাধন করতে পারলে বাংলার এই ঐতিহাসিক স্থানটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
উপসংহার: কেউ ভালোবাসে পাহাড়, কেউ সমুদ্র, কেউ বা অরণ্য। আমি ভালোবাসি ইতিহাস। ছোটোবেলা থেকেই ইতিহাসের কাহিনি আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। মুরশিদাবাদের হাজারদুয়ারি দেখে আমি যেন আড়াইশো বছর আগের এক ধূসর অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম। আজও স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদদৌলাকে। আজও যেন কানে বাজে তাঁর জলসাঘরের টপ্পাঠুংরি। চিরদিন এই স্থানটি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
১০. বইপড়া
উত্তর – 
“He who loves reading has everything within his reach”
-William Godwin,
ভূমিকা: আজকের জেটগতির জীবনে মানুষের সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। সাফল্যকে পাখির চোখ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই করে যাচ্ছে সকল ছাত্রছাত্রী থেকে আমজনতা। যেটুকু সময় তারপরেও থাকে তা চুরি করে নিচ্ছে টিভি বা মোবাইল ফোন। বই যেন এক প্রান্তিক বিষয় হয়ে উঠেছে আজকের জীবনে। অথবা নিতান্তই তা ঘর সাজানোর উপকরণ হয়ে গেছে। অথচ বই সেই বাতিঘর যা আমাদের পৌঁছে দেয় অন্ধকারের পথ ধরে আলোর দেশে।
বই যখন কাজের জন্য: ছাত্রছাত্রীদের কাছে বই এগিয়ে চলার প্রধান “উপকরণ। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্যের হাতিয়ার হল বই। মা বই দেখে শিখে নেন নানান ধরনের রান্না। বাবার হাতে থাকে “হোমিও ওষুধে নিরাময়।” বছরের শেষে একবার ভ্রমণসঙ্গী হাতে নিয়ে চলে পায়ের তলার সর্বের খোঁজ। আর পরীক্ষার ভালো ফল করার জন্য দিদি হাতে ধরিয়ে দেয় “The brief history of time”। ঠাকুমাকে দেখেছি ‘কথামৃত’ নিয়ে বসতে। এভাবেই চাওয়া-পাওয়ার মনের শুদ্ধিতে, রসনায় এবং সাধনায় বই সেতুর মতো কাজ করে চলেছে।
রইব তোমার ফসল খেতের কাছে: রুশো থেকে রবীন্দ্রনাথ, শেকসপিয়র থেকে সতীনাথ ভাদুড়ি, জেমস্ জয়েস থেকে জীবনানন্দ—বইয়ের হাত ধরেই আমাদের ঘরের মধ্যে এসে হাজির হন। পথের পাঁচালির অপুর হাত ধরে যেমন আমরা পৌঁছে যাই চিরকৈশোরে। দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান সবই আমাদের কাছে পৌঁছায় বইয়ের সৌজন্যে।
অবসরে বই: বইয়ের থেকে ভালো অবসরের বন্ধু নেই। একঘেয়ে পড়াশোনা কিংবা জীবনযাত্রার মধ্যে বই এক অন্য দিগন্ত নিয়ে আসে। পরশুরাম কিংবা শিবরাম-আনন্দের বহুবিচিত্র আয়োজন সবই পাওয়া যায় বইয়ের মধ্যে।
উপসংহার: আধুনিক যন্ত্রজীবনে বই এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। মানুষ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত, বইয়ের জন্য সামান্য মাত্র সময়ও সে ব্যয় করে না। ভোগবাদের তাড়নায় সৃষ্টিশীলতা যত বিপন্ন হচ্ছে বইও ততই প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবনে। তবুও মন ও সমাজের সুস্থতার জন্য বইপড়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারবেন না কেউই।
১১. পরিবেশ সুরক্ষায় ছাত্রসমাজের ভূমিকা
উত্তর – ভূমিকা: উদ্ভিদ ও জীবজগৎ-সহ যে প্রাকৃতিক ঘেরের মধ্যে আমরা বাস করি, তা-ই হল পরিবেশ। প্রাকৃতিক নিয়মে এই পরিবেশের মধ্যে যুগ যুগ ধরে ভারসাম্য রক্ষিত হয়ে আসছে বলে জীবকুল আজও পৃথিবীতে সুন্দ স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারছে। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যরক্ষার একটি অনিবার্য সম্পর্ক রয়েছে।
আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা বেশের ভারসাম্য: আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যে সংকটের সূচনা ঘটেছে। জীবনযাপনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আমরা হাতের কাছে পেয়েছি অজস্র উপকরণ, গড়ে উঠেছে বড়ো বড়ো কলকারখানা। যত বেশি আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে উল্লসিত হয়েছি তার থেকে অনেক কম মনোযোগ দিয়েছি পরিবেশের ভারসাম্যের দিকে।
ভারসাম্যের সংকট: পরিবেশের প্রতি মনোযোগের অভাবের জন্য পরিবেশে দেখা দিয়েছে নানা প্রতিকূলতা। বাতাসে, জলে, মাটিতে দেখা দিয়েছে মারাত্মক দূষণ। অজস্র যানবাহন আর কলকারখানা থেকে প্রতি মুহূর্তে বের হচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। বনজঙ্গল কেটে নগরায়ণ করতে গিয়ে এবং শিল্পের প্রসার ঘটাতে গিয়ে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড ও সালফার ডাইঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসে ভরে গেছে বাতাস। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ এবং কলকারখানা থেকে যে বর্জ্য পদার্থ বের হচ্ছে, তা থেকে দুষিত হচ্ছে নদী, সমুদ্র ও ভূগর্ভের জল, দূষিত হচ্ছে মাটি। শব্দদানবতো আজকের যুগের একটি বড়ো সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যানবাহনের শব্দ, বাজি ও মাইকের আওয়াজে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এসবের সঙ্গে আছে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের ফলে ছড়িয়ে পড়া দূষণ। সবমিলিয়ে আমাদের পরিবেশ যে ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে, তাতে দেখা দিচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এবং নানা অসুখ।
ভারসাম্যরক্ষায় ছাত্রছাহ্রীদের ভূমিকা: সমস্যা আছে, অতএব প্রতিকারও চাই। এই প্রতিকারে পৃথিবীর সমস্ত স্তরের মানুষেরই ভূমিকা আছে। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকাটি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। পরিবেশের ভারসাম্যরক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও বনসংরক্ষণ খুবই জরুরি, বলা যায়, এই সমস্যাসমাধানের অন্যতম প্রধান উপায়। ছাত্রছাত্রীরা বন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন মহলে দাবি জানাতে পারে। তারা পরিকল্পিতভাবে রাস্তার ধারে, বিদ্যালয়ে কিংবা পোড়ো জমিতে বৃক্ষ রোপণ করতে পারে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। জল ও বাতাসকে যথাসম্ভব বিশুদ্ধ রাখার জন্য মানুষকে পরিবেশের ভারসাম্যের সংকটের কথা বোঝানোর চেষ্টা করবে। এর জন্য তারা আলোচনা সভা, পথ নাটিকা প্রভৃতির আয়োজন করতে পারে। কেন না যারা আজকের ছাত্রছাত্রী, ভবিষ্যতে তারাই হবে দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক। সুতরাং এখন থেকে তারা যদি সচেতন হয় ও সক্রিয় ভূমিকা নেয় তাহলে পরিবেশকে রক্ষা করা অসম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
উপসংহার: একটি বিষয়ে আমরা সবাই বোধহয় একমত যে, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশও যে খুবই প্রয়োজন, সে বিষয়ে আমরা এখনও সবাই সচেতন নই। এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের গুরুদায়িত্ব রয়েছে। তারা অদম্য প্রাণশক্তি দিয়ে এগিয়ে এলে চারপাশের মানুষকে পরিবেশ সচেতন করে তোলা অসম্ভব হবে না নিশ্চয়ই।
১২. তোমার বিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন
উত্তর –  ভূমিকা: স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়েই মানুষ পথ চলে। স্মৃতির উত্তাপে সে তার মনকে সেঁকে নেয়। আবার সেই স্মৃতিই কখনও ভিজিয়ে দেয় বর্তমানকে। স্কুলজীবনের একটা পর্ব শেষ করার মুখোমুখি এসে এই স্কুলের প্রথম দিনের স্মৃতি বারে বারে মনের দরজায় কড়া নাড়ছে।
স্মৃতির সরণি ধরে: আমার স্কুলের নাম মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়। আজ থেকে দশ বছর আগে এই স্কুলেরই প্রাথমিক বিভাগে এসেছিলাম ভরতির জন্য। সেদিনের ঘটনার অনেক কথাই আজ ঝাপসা হয়ে গেছে। মনে আছে বাবার হাত ধরে যখন প্রথম স্কুলের গেটের ভিতর ঢুকেছিলাম খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এত বড়ো বাড়ি। এখানে মা-বাবা পাশে থাকবে না। আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। একজন ধুতি পরা লোক আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম তিনিই ছিলেন স্কুলের প্রধানশিক্ষক। তিনি আমাকে একটা লজেন্সও দিয়েছিলেন। ক্লাসে ঢুকে দেখেছিলাম আমারই মতো অনেকগুলো ছেলে বসে আছে। তাদের অনেকে আমারই মতো কাঁদছিল। ঘরের দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা ছিল। আর কাদের যেন ফটো লাগানো ছিল। এখন বুঝি ওগুলো ছিল বরেণ্য সব মহাপুরুষদের ছবি।
যাত্রা হল শুরু: একজন আন্টি প্রথম ক্লাসে এসেছিলেন। আমাদের নাম জ্ঞিজ্ঞাসা করেছিলেন। তারপরে কিছু একটা গল্প বলেছিলেন। আমার খুব ভালো লেগেছিল। চোখের জলও ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। ঠিক মা-এর মতো মনে হয়েছিল আন্টিকে। তারপরে ঘণ্টা বাজল। আন্টি চলে যাওয়ার পরে একজন স্যার এলেন। তাঁর কাছেই পরে আমরা অঙ্ক শিখতে শুরু করি। এরপরই আমাদের প্রথম দিনের ছুটি হয়ে যায়। বাবার হাত ধরে আবার বেরিয়ে পড়ি বাড়ির পথে।
উপসংহার: দশ বছরের যাত্রা এবার শেষ হওয়ার পথে। যদি সুযোগ পাই ইচ্ছা আছে এগারো-বারো ক্লাস এখানেই পড়ার। সেই প্রথম দিন আলাপ হয়েছিল জাহাঙ্গির নামে একটা ছেলের সঙ্গে। সে আজও আমার প্রিয় বন্ধু। আর প্রিয়তম বন্ধু আমার স্কুল—মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়।
১৩. ছুটির দিন
উত্তর – ভূমিকা: “মাগো আমায় ছুটি দিতে বল/সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা/এখন আমি তোমার ঘরে বসে/করব শুধু পড়া পড়া খেলা।”—ছুটির জন্য মানুষের এই আকুলতা চিরন্তন। ছুটি ক্যালেন্ডারে লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া কিছু নির্দিষ্ট দিন নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় কিছু বৈচিত্র্য সংযোজনের মধ্য দিয়ে ছুটি মানুষের জীবনে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করে। ফলে শরীর ও মন নতুন উৎসাহে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
ছুটির প্রয়োজনীয়তা: একজন ছাত্র তার ক্রমশ বাড়তে থাকা পড়ার বইয়ের চাপে যখন দিশেহারা, বাড়ি স্কুল বাড়ির ধরাবাঁধা রুটিনে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তার শৈশব ও কৈশোর, তখন ছুটির আনন্দেই সে খুঁজে নিতে পারে প্রাণের স্ফূর্তি। কখনও টিভির সামনে, কখনও খেলার মাঠে, কখনও নীল আকাশের নীচে বন্ধুদের সঙ্গে মুক্ত জীবনের উল্লাসে সে খুঁজে পায় তার মনের রসদ। একইভাবে কর্মক্লান্ত মানুষ তার অবসরের সার্থকতা খোঁজে কখনও বেড়ানোর আনন্দে, কখনও সৃষ্টিশীল কাজে, কখনও বা বিনোদনের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়েই একঘেয়েমি কাটিয়ে সে নিজেকে প্রাণময় করে তোলে। মানসিক অবসন্নতা আজকের সমাজে একটা বড়ো অসুখ। ছুটি যন্ত্রজীবন থেকে মানুষকে বের করে ইচ্ছে ডানায় তাকে ভাসিয়ে অবসন্নতা থেকে মুক্তি ঘটায়।
ছুটি কাটানোর উপায়: ছুটির অর্থ শুধু অলস দিনযাপন নয়। অবসরের মুহূর্তেই শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি হয়, জন্ম হয় সার্থক কবিতার, ক্যানভাসে ফুটে ওঠে চিত্রকলা। এ হল নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে এবং চারপাশকে বুঝে নেওয়ার অবসর। এর পাশাপাশি ছুটির দিন মানুষকে যুক্ত করে বৃহত্তর সমাজজীবন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। বিজ্ঞান সচেতনতা বৃদ্ধি, দূষণবিরোধী আন্দোলন, সাক্ষরতা আন্দোলন ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ছুটি সার্থক হয়ে উঠতে পারে। আবার বড়ো কিছু না করেও, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মেশার যে সুযোগ তৈরি হয় ছুটির দিনে তা নতুন করে সামাজিক সম্পর্ককে ঝালিয়ে নেয়। ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘Leisure is time for doing something useful’ উক্তিটি মনে রাখলে আমাদের অবকাশের মুহূর্ত আলোকিত হতে পারে মনুষ্যত্বের আলোয়।
উপসংহার: ছুটি কাটানোর উপায়ের রকমফের থাকলেও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ছুটির ছোঁয়া পেয়ে অবসাদগ্রস্ত মানবজীবন নতুন আনন্দ ও শক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“সত্যকে খুব বড়ো করে ধ্যান করবার এবং উপলব্ধি করবার মতো মনের উদার অবকাশ প্রয়োজন।” ছুটির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শেষ কথা সম্ভবত এটাই।
১৪. তোমার প্রিয় ঋতু 
উত্তর – 
“তোমার নাম জানি নে, সুর জানি। তুমি শরৎ প্রাতের আলোর বাণী।।”
—রবীন্দ্রনাথ
ভূমিকা: বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্য প্রকৃতি ও মানবজীবনে নিয়ে আসে বহু বর্ণময়তা। কালবৈশাখীর রুদ্র রূপ থেকে বর্ষার যৌবনোচ্ছ্বাস কিংবা পলাশরাঙা বসন্ত – —প্রকৃতির যে নানা প্রকাশ তার আবেদন ও প্রভাবকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু তারই মধ্যে শরৎ আমার প্রিয় ঋতু। গ্রীষ্ম, বর্ষা বা শীতের চরম চরিত্রের পাশে শরৎ তার প্রশান্ত উপস্থিতি আর স্নিগ্ধ মাধুর্য দিয়ে তৈরি করে দেয় হৃদয়ের আনন্দগান।
শরতের আগমন: বর্ষার প্রমত্ত উচ্ছ্বাসে যখন দিশেহারা মানববিশ্ব, সর্বনাশের প্রহর গোনার সেই দিনযাপন শেষ হয় শরতের আগমনে। আনন্দিত কবিচিত্ত বলে ওঠে— “আজি শরততপনে প্রভাত স্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।” নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা নিয়ে আসে। এক নির্মল প্রসন্নতায় ভরে ওঠে বিশ্ব চরাচর, শোনা যায় শরতের আবাহন গীত—
“আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা—
নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।।
এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,
এসো নির্মল নীলপথে…”।
উৎসবের ঋতু শরৎ: উঠোন জুড়ে পরে থাকা সোনা রঙের রোদ, শিউলি ফুল আর আন্দোলিত কাশফুলে থাকে উৎসবের আগমনি। এই শরতেই হয় দুর্গাপুজো। এই উপলক্ষ্য দেবী দুর্গাকে কন্যা উমারূপে পূজা করা হয়। প্রতি বছর চারদিনের জন্য পিতৃগৃহে আগমন হয় দেবী উমার। কিন্তু দুর্গাপুজোর আনন্দ কোনো ধর্মের সীমায় আবদ্ধ থাকে না। জাতিধর্মনির্বিশেষে সমস্ত মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে প্রাণের আনন্দে। নতুন জামাকাপড়পরা, মণ্ডপে ঠাকুর দেখা, বিজয়ার ভাসান—এ সবের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব কখন যেন হয়ে ওঠে শারদোৎসব। শুধু তো আনন্দ উদযাপন নয়, প্রতিমা ও মণ্ডপ নির্মাণ, আলোকসজ্জা, প্রচার থেকে ফুল বিক্রেতা, ঢাকি কত মানুষের দিনান্তের সঞ্চয় সম্ভব হয় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে। শরৎ তাই প্রাণেরই নয়, জীবনেরও ঋতু। শুধু দুর্গাপুজো নয়, এই শরতেই বাঙালি আবাহন করে সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে, অশুভ শক্তিকে নাশ করার দেবী নৃমুন্ডমালিনী শ্যামাকে। এই শরতেই হয় ভাইফোঁটা।
শারদ সাহিত্য এবং অন্য আয়োজন: শরতের উৎসবমুখরতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই প্রকাশিত হয় শারদ সাহিত্য। নামি-অনামি নানা পত্রিকার পুজো সংখ্যায় বিখ্যাত লেখকদের পাশাপাশি বহু নতুন লেখকেরও আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই সুযোগে বাঙালিও আরেকবারের জন্য ঝালিয়ে নিতে পারে সাহিত্যপ্রীতিকে। একইভাবে পুজোকে সামনে রেখে প্রকাশিত হয় অসংখ্য গানের অ্যালবাম আয়োজিত হয় জলসা। এককথায় জীবনের তুচ্ছতা থেকে মুক্তির সুযোগ শরতই এনে দেয় বাঙালিকে।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই: শরৎ শুধু উৎসব নিয়ে আসে না, এনে দেয় উৎসব উদ্যাপনের অবকাশও। দেবীর বোধনের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজে ছুটি পড়ে যায়। কর্মব্যস্ত জীবনকে পিছনে ফেলে কিছুদিনের জন্য হলেও ঘরে ফেরে বাঙালি। তাই শরৎ শুধু প্রাণের নয়, পূর্ণতারও ঋতু।
দেখি নাই কড়ু দেখি নাই: গ্রীষ্ম-বর্ষা অথবা শীত বৈপরীত্যের সমাহার। আর শরৎ শুধুই কেয়াপাতার নৌকা ফুল দিয়ে সাজিয়ে মুগ্ধতার কাহিনি। শুধু নির্মলতা আর প্রসন্নতার বিচিত্র বিস্তার। বিক্ষত হৃদয়ে শরৎ শুশ্রূষার প্রলেপ। ভাঙনের পরে সুরের গুঞ্জরণ। তাই শরৎ আমার প্রিয় ঋতু, হৃদয়ের ঋতু।

সাম্প্রতিক ঘটনা

১. বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯
উত্তর – 
“No Cricket should be played for at least a month anywhere in the world after a World Cup”
–কপিল দেব
ভূমিকা: বিশ্ব ক্রিকেটের বর্ণময় উদযাপন বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এখন টিটোয়েন্টি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার কালেও ক্রিকেট বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় একদিনের ক্রিকেট থেকেই। গত ৩০ মে থেকে ১৪ জুলাই ক্রিকেটের আঁতুরঘর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হল এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট।
বিশ্বকাপ সংগঠন: ২০১৯-এর বিশ্বকাপ হল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বারোতম সংস্করণ এবং ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আই সি সি-র পূর্ণ সদস্য ১০ টি দেশ। যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল দুটি পূর্ণসদস্য দেশ জিম্বাবোয়ে এবং আয়ার্ল্যান্ড। রাউন্ড রবিন ও নকআউট পদ্ধতিতে মোট আটচল্লিশটি খেলা হয় ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস্-এর এগারোটি স্টেডিয়ামে। ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে উদ্বোধন ম্যাচটি হয় ওভালে। আর নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডের ফাইনাল ম্যাচটি হয় লর্ডস্-এ।
বিশ্বকাপের ইতিহাস: ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম আয়োজন হয়। ২০১৯-এর আগে সব থেকে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া – ৫ বার। ২০১৫-র বিশ্বচ্যাম্পিয়নও তারাই। ভারত এই প্রতিযোগিতায় দু-বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক শচীন তেন্ডুলকর (২,২৭৮ রান)। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি গ্লেন ম্যাকগ্রা (৭১ উইকেট)।
বিশ্বকাপ চন্ডা: রাউন্ড রবিন লিগ শেষে সেমিফাইনালে উঠেছিল চারটি দেশ-অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড এবং আয়োজক ইংল্যান্ড। সেমিফাইনালে ফেভারিট অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত— – দুটি দলই পরাজিত হয়। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম সেমিফাইনাল সম্পূর্ণ হয় দু-দিনে এবং নিউজিল্যান্ড ১৮ রানে ভারতকে হারিয়ে ২০১৫-র পরে আবারও একবার ফাইনালে চলে যায়। অন্য সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড অনায়াসে আট উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে যায় নতুন চ্যাম্পিয়নের আবির্ভাব মঞ্চ।
ফাইনাল: গোটা বিশ্ব দেখল সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল, ইংল্যান্ডনিউজিল্যান্ডের খেলায় উত্তেজক, রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য। প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড করে আট উইকেটে ২৪১। জবাবে ইংল্যান্ডের ইনিংস ও শেষ হয়ে যায় ২৪১ রানে। টাই ম্যাচের নিষ্পত্তির জন্য সুপার ওভার খেলা হয়। কিন্তু তাও টাই হয়। অতঃপর বিশ্বকাপের নিয়মে ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি মারার নিরিখে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবার। ১৯৭৫-এ লর্ডসে যে বিশ্বকাপের সূচনা হয়েছিল সেই লর্ডসেই ইংল্যান্ডের অধরা বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
উপসংহার; এই বিশ্বকাপ নতুন অনেক নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছে। এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের শচীন তেন্ডুলকরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন রোহিত শর্মা। এই বিশ্বকাপে তিনিই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (৬৪৮)। চেতন শর্মার-র পরে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে বিশ্বকাপে উইকেট সংগ্রহে হ্যাটট্রিক করেছেন মহম্মদ শামি। বাংলাদেশের সাকিব উল হাসান ব্যাট-বলে তাঁর সাফল্যে গোটা বিশ্বের সমাদর আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু সব কিছুর পরে এই বিশ্বকাপ মনে থাকবে অবিশ্বাস্য ফাইনালের জন্য। ইংল্যান্ডের স্টোকস্এর অতিমানবীয় ব্যাটিং, সুপার ওভারে আর্চারের হিমশীতল মস্তিষ্কে বোলিং, নিউজিল্যান্ডের বোল্টের বোলিং দক্ষতা দেখিয়ে দিল ক্রিকেট কোন্ উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। শেষপর্যন্ত রেকর্ড বইয়ে হয়তো লেখা থাকবে বিজয়ী হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম। কিন্তু আসলে জিতল ক্রিকেট-লড়াই-এর অসামান্য দ্যুতি বিচ্ছুরণে।
২. সাম্প্রতিক জলসংকট
উত্তর – 
“Water is the driving force of all nature”
—লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
ভূমিকা: ‘জলই জীবন।’ কিন্তু ভারত সরকারের নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী আগামী বছর থেকে ভয়ানক জলসংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে দেশের একুশটি শহর। ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ মানুষের কাছে পানীয় জল পাওয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না।
শেষের শুরু: ১৯ জুন, ২০১৯ চেন্নাই নগর নিগমের পক্ষ থেকে চেন্নাইকে জলশূন্য ঘোষণা করা হয়। যে চারটি জলাধার থেকে শহরে জলসরবরাহ করা হয় সেগুলো সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই এই অবস্থা। এই মুহূর্তে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ এই দেশে চরম জলসংকটের মুখোমুখি। জল দূষণের কারণে প্রতিবছর গড় দু লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে এই দেশে। ভারতে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের বাড়িতে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। ভূগর্ভের জলস্তরের অস্বাভাবিক নেমে যাওয়া, আর জনসংখ্যার অসম্ভব বেড়ে যাওয়ার কারণে নিকট ভবিষ্যতে বেঙ্গালুরু আর মানুষের বাসযোগ্য থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স-এর বিশেষজ্ঞরা। রাজধানী দিল্লিতেও সংকটের ছায়া ক্রমশই দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিবছর ১০ সেমি করে জলস্তর নেমে যাচ্ছে সেখানে। বদরপুর, দ্বারকা ইত্যাদি অঞ্চলে তীব্র জলকষ্ট দেখা দিয়েছে।
এই রাজ্যের কথা: ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের এক সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, ভূগর্ভস্থ জলের নিরিখে রাজ্যে আধা সংকটজনক ব্লকের সংখ্যা ছত্রিশ থেকে বেড়ে হয়েছে সাতাত্তর। মুরশিদাবাদের একটি ব্লকে অতি সংকটজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে এই সতর্কতাও জারি করা হয়েছে যে, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুরের মতো জল নিয়ে আপাত নিশ্চিন্ত জেলাগুলোতেও দ্রুত নামছে ভূগর্ভের জলস্তর। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলো এমনিতেই জলসংকটে থাকে, বিশেষত গ্রীষ্মকালে। তবে সবথেকে চিন্তার কারণ অবশ্যই কলকাতা। কলকাতার জলস্তর ইতিমধ্যেই অনেকটা নেমে গেছে।
সংকটের কারণ: নগরায়ণের কারণে পুকুর এবং জলাভূমি বোজানো হয়েছে নির্বিচারে। বন্ধ হয়েছে জলের উৎস। বৃষ্টির জলও ভূগর্ভের প্রবেশের কোনো পথ পাচ্ছে না। আর তাই জলের উপর নির্ভরতা বেড়েছে গভীর নলকূপের। নির্মাণক্ষেত্রে এবং কৃষিজমিতে মাত্রাছাড়া নলকূপের ব্যবহার ভূগর্ভের জলস্তরকে নামিয়ে দিচ্ছে। নদী মজে যাওয়া জলসংকটের আরেকটি কারণ। আর এই সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে নাগরিকদের সচেতনতার অভাব। শুধু শহর কলকাতাতেই, পুরসভার হিসেব অনুযায়ী প্রতিদিন দৈনিক ২০ লক্ষ টাকার জল অপচয় হয়।
সমাধানের লক্ষ্যে: অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। বিপন্ন বেঙ্গালুরু আগামী দশ বছর নতুন আবাসন তৈরি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুকুরজলাশয় বোজানো বন্ধ করতে হবে। নদীর সংস্কারও জরুরি। বৃষ্টির জলের ব্যবহারও অতি প্রয়োজনীয়। সবমিলিয়ে জলের বিকল্প উৎস খুঁজে নিতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে জলের ব্যবহার সর্বাধিক। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যেই জল বাঁচাতে বোরো ধানের বদলে ভুট্টা চাষে জোর দিয়েছে। ২০২১-২২ সালের বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার জল জীবন মিশনের জন্য দু-লক্ষ সাতাশি হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। রাজ্য সরকার নদী সংস্কারে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা খরচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সকলের আগে দরকার নাগরিক সচেতনতা। জলের অপচয় বন্ধ না হলে সকলেরই ধ্বংস নিশ্চিত। উপসংহার: আমাদের দেশে প্রতি ৯জন লোকের মধ্যে একজনের পরিশ্রুত পানীয় জল জোটে না। প্রাপ্ত জলের পরিমাণের নিরিখে ভারতের স্থান পৃথিবীতে ১৩২। এরপরে সেই জলটুকুও জুটবে না। আমরা বোধহয় সেই শেষের দিনের অপেক্ষায় আছি। “কোথায় লুকোবে? ধু ধু করে মরুভূমি/ ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।/আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই”।
(সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
৩. দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর
উত্তর – 
“শুধু একবার একবার দ্রবণের মতো এই পরম বাংলায় স্পষ্ট বলীবর্দ এক ঈশ্বরের জন্ম হয়েছিল। উড়নি ধুতি পরা ছিল বলে । আমরা তখন তাকে ঠিকমত চিনতেই পারিনি।”
—সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
ভূমিকা: বিদ্যাসাগর এক বাতিঘরের নাম। উনিশ শতকে একদিকে যখন ইংরেজের অনুগ্রহভাজন হয়ে ছদ্ম আধুনিকতার পাঠ নিচ্ছে বাঙালি, অন্যদিকে মনের ভিতরে মধ্যযুগীয় অন্ধকার— সেই সময় আত্মমর্যাদা ও শিক্ষায় জাতিকে আত্মদীপ্ত করে তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর—বাঙালির জীবন্ত ঈশ্বর। বিদ্যাসাগর শুধু একজন ব্যক্তি নন, যুগসন্ধির ফলে তিনি বাঙালির ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক।
জন্ম ও পরিচয়: ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের জন্ম। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা ভগবতী দেবী। মাত্র ন বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভরতি হন। এই কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর বারো বছর পড়াশোনা করেন এবং ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলংকার, বেদান্ত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ইংরেজিতে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ছাত্র অবস্থাতে মেধাবী বিদ্যাসাগর অনেক বৃত্তি ও পুরস্কার অর্জন করেন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তার প্রশংসাপত্রেই প্রথম ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহার করা হয়। পরে সংস্কৃত কলেজের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রশংসাপত্রে ‘বিদ্যাসাগর’-এর উল্লেখ থাকে। এর মধ্যে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে দীনময়ী দেবীর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বিবাহ হয়।
কর্মজীবন: ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে বিদ্যাসাগর যোগদান করেন। ১৮৪৬-এ সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে পদত্যাগ করে ফিরে যান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। অল্পদিনের মধ্যেই অবশ্য সংস্কৃত কলেজে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে অধ্যাপক হিসেবে। ১৮৫১-তে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি সংস্কৃত কলেজের দরজা অ-ব্রাত্মণ ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিদ্যাসাগর নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন।
সমাজ সংস্কার: বিদ্যাসাগর সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে নারীশিক্ষার প্রসারে বিশেষ উদ্যোগী হন। তাঁর উদ্যোগে বিভিন্ন জেলায় মেয়েদের জন্য পঁয়তিরিশটি স্কুল স্থাপিত হয়। মেয়েদের শিক্ষায় সাহায্য করার জন্য গড়ে তোলেন নারীশিক্ষা ভাণ্ডার। তবে বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বিধবাবিবাহ প্রচলন করা। তাঁর উদ্যোগেই ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার বিধবাবিবাহ আইন প্রচলন করে। নিজের একমাত্র পুত্র নারায়ণ চন্দ্রকেও তিনি একজন বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন।
সাহিত্যকীর্তি: শিশুশিক্ষার জন্য ‘বর্ণপরিচয়’ বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু স্মরণীয় অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন, যেমন—সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস, কথামালা, বোধোদয়, বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদি। বিধবাবিবাহের পক্ষে এবং বহুবিবাহের বিপক্ষে তিনি একাধিক পুস্তিকা রচনা করেন। মার্শম্যানের History of Bengal অবলম্বনে রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস। তত্ত্ববোধিনী, সোমপ্রকাশ, হিন্দুপেট্রিয়ট ইত্যাদি পত্রিকাতে বিদ্যাসাগরের লেখা প্রকাশিত হত।
দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর: জন্মের দুশো বছর অতিক্রান্তেও বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক। সে-কথা মনে রেখে রাজ্যসরকার যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যালয় স্তরে প্রাক্‌প্রাথমিক এবং প্রথম শ্রেণিতে বিনামূল্যে বর্ণপরিচয়-কে ঐতিহ্যপূর্ণ বই হিসেবে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে গড়ে তোলা হবে একটি মিউজিয়াম। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরের ২১ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত স্কুলগুলিতে বিতর্ক, আলোচনা প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে বিদ্যাসাগর চর্চা হয়েছিল। বিদ্যাসাগর কলেজকে হেরিটেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
উপসংহার: বিদ্যাসাগর কোনো নাম নয়, এক জীবনচর্চা। উদারতা, প্রগতিশীলতা, সংস্কারহীনতার সমন্বয়ে তাঁর যে জীবনাদর্শ তা বাঙালিকে মেরুদণ্ড ঋজু রাখার শিক্ষা দেয়। জাতিকে তার কাছেই নতজানু থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথায়—“তাঁহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়েছেন তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালি জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।”
৪. কন্যাশ্রী প্রকল্প
উত্তর – 
“আমরা তো জানি পৃথিবী রমণী আকাশ আদিম পুরুষ/ তবে কেন তুমি আমার দুহাতে শেকল পরিয়ে রেখেছ?/ হাজার বছর ধরে কেন তুমি সূর্য দেখতে দাওনি?”
—মল্লিকা সেনগুপ্ত
প্রেক্ষাপট: কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে সামাজিক বৈষম্য ও বখনার এক করুণ ইতিহাস। ২০১১-র জনগণনায় দেখা গিয়েছে যে পশ্চিমবাংলায় বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীর মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৩ লক্ষ। এর মধ্যে ৪৮.১১ শতাংশই হচ্ছে মেয়ে। কিন্তু এই যে বিপুল নারীশক্তি, তাদের জীবনবিকাশের পথ কিন্তু একেবারেই মসৃণ নয়। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হয়েই এদের বিরাট অংশকে জীবন কাটাতে হয়, অনেকেই হারিয়ে যায় সমাজের অন্ধকারে। ২০০৭-০৮-এর সমীক্ষায় শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের নিরিখে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবাংলার স্থান পঞ্চম। পরিসংখ্যান অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৫৪.৭ শতাংশই দ্রুত বিবাহের শিকার। এই দ্রুতবিবাহের ফলে একদিকে যেমন এইসব মেয়েরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনই তারা নানারকম অপুষ্টির শিকার হয়, যা পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে। সমাজের দুর্বল, পিছিয়ে পড়া এবং হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এই মেয়েদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করে কন্যাশ্রী প্রকল্প, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়— “To reduce dropout rate and prevent early marriag” |
প্রকল্পের রূপরেখা: নারী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রক জানিয়েছিল যে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি যে মেয়েদের পরিবারের বার্ষিক আয় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বা তার কম, তারা বছরে ৫০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য পাবে এবং ১৮ বছর অবধি পড়া চালিয়ে গেলে ১৮ বছর বয়সে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকার এককালীন ২৫ হাজার টাকা প্রদান করবে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের রাজ্য বাজেটে এই বৃত্তির পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘কন্যাশ্রী’র পঞ্চম বার্ষিকীতে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে এই প্রকল্পের জন্য আয়ের কোনো ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না। অর্থাৎ সব কন্যাই কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পাবে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা আজও যথেষ্ট, সেখানে মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষায় এই প্রকল্প যে যথেষ্ট কার্যকরী তা বলাই বাহুল্য। কন্যাশ্রীর উদ্দেশ্য হল কন্যাসন্তানকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রথাগত বা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে সম্মানজনক পেশায় প্রতিষ্ঠিত করা, অন্তত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের বিবাহকে বিলম্বিত করা এবং তার আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলা। সরকারি তথ্য অনুসারে প্রায় ৫৬ লক্ষেরও বেশি মেয়ে ইতিমধ্যেই এর দ্বারা উপকৃত হয়েছে।
সম্মান ও স্বীকৃতি: কন্যাশ্রী প্রকল্প দেশ এবং দেশের বাইরে একাধিক শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ এশিয়া এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কন্যাশ্রী পেয়েছে মন্থন অ্যাওয়ার্ড। ২০১৪-১৫-তে পেয়েছে ভারত সরকারের ই-গভর্ননেন্স অ্যাওয়ার্ড। ২০১৪-তে পার্ল সামিট-এ কন্যাশ্রী প্রকল্পকে বলা হয়েছে best practice amongst several international initiatives for the girl child.”। তবে কন্যাশ্রীর মুকুটে শ্রেষ্ঠ পালকটি সংযোজিত হয়েছে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন। রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে জনপরিসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতিতে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পেল কন্যাশ্রী প্রকল্প। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাংলার সাফল্য।
উপসংহার: কিং উইলিয়াম আলেকজান্ডার হলে রাষ্ট্রসংঘের পুরস্কার বিতরণী মধ্যে পুরস্কার গ্রহণের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন—“প্রতিটি কন্যাশ্রী মেয়ে আজ গর্ববোধ করছে।” কন্যাশ্রী আসলে বাংলার মেয়েদের কাছে গর্ব আর প্রত্যয়ের প্রতিশব্দ।
৫. সৰ্বশিক্ষা অভিযান
উত্তর – ভূমিকা: সর্বশিক্ষা অভিযান এমন একটি প্রকল্প, যা জেলাস্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে আঞ্চলিক অধিবাসীদের দ্বারা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যবস্থাকে পরিচালিত করেছে এই প্রকল্প। এটি সমগ্র দেশের অন্যান্য সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকেও নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
সূচনা ও বিকাশ: ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ এবং ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ওই শিক্ষানীতির সংশোধিত লক্ষ্য অনুযায়ী একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ৬-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের দেশের সমস্ত শিশুকে ব্যবহারোপযোগী এবং নির্দিষ্ট মানসম্পন্ন ন্যূনতম আবশ্যিক শিক্ষার (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) অন্তর্ভুক্ত করা। এই লক্ষ্য অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার ২০০০ খ্রিস্টাব্দে সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্প চালু করে। সর্বশিক্ষার এই প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করবার জন্য সর্বশেষ সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২০১০ খ্রিস্টাব্দ।
বৈশিষ্ট্য: [ক] সারা দেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয় শিক্ষার মানের উন্নতি সাধন করা এবং এই শিক্ষা যাতে শিশুর জীবনে কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। [খ] এই প্রকল্পকে সর্বতোভাবে সফল করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটির সার্থক রূপায়ণের জন্য রাজ্য সরকারকে এই প্রকল্পে শামিল করেছেও তার পাশাপাশি জেলা পরিষদ, গ্রাম পঞ্জয়েত, ক্লাবকেও এই অভিযানে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। [গ] এই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী সংস্থা ও ব্যক্তি যাতে স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যকে বজায় রেখে নিজ নিজ কর্মসূচির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারে সে-বিষয়ে ওইসব সংস্থা এবং ব্যক্তিদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ তাৎপর্য: সর্বশিক্ষা অভিযানের বিশেষ তাৎপর্য হল ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যালয় শিক্ষার কার্যকারিতার উন্নতি সাধন করা এবং এক-একটি জনগোষ্ঠীর পরিচালনায় সমাজসেবামূলক মনোভাব নিয়ে নির্দিষ্ট বয়সের শিশুদের উপযুক্ত মানের ন্যূনতম আবশ্যিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। এই অভিযানের অন্যতম প্রয়াস হল লিঙ্গবৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা। অভিযানটি মেয়েদের, তপশিলি জাতি, উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত শিশুদের ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার চাহিদাপুরণে বিশেষ খেয়াল রাখে।
লক্ষ্য: [ক] ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আমাদের দেশের সমস্ত শিশুকে বিদ্যালয়ে ভরতি করা, পরিবর্ত বিদ্যালয়, বিদ্যালয় প্রত্যাবর্তন ক্যাম্প প্রভৃতি স্থাপন করা। [খ] ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এদেশের সমস্ত শিশু যাতে পাঁচ বছরব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে তা সুনিশ্চিত করা। [গ] ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশের সমস্ত শিশু যাতে আট বছরব্যাপী ন্যূনতম আবশ্যিক শিক্ষা পায় তার ব্যবস্থা করা। [ঘ] ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ভরতি হওয়া সমস্ত ছাত্রের একজনও যাতে বিদ্যালয় ছেড়ে না যায় তা সুনিশ্চিত করা।
উপসংহার: সর্বশিক্ষা অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি এখনও অর্জন করা যায়নি। তবে সরকার ও জনগণের মিলিত প্রয়াসে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হবে এই আশা নিয়ে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *