wb 10th Bengali

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 15 নদীর বিদ্রোহ

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 15 নদীর বিদ্রোহ

West Bengal Board 10th Class Bengali Solutions Chapter 15 নদীর বিদ্রোহ

West Bengal Board 10th Bengali Solutions

লেখক পরিচিতি

জন্ম ও শৈশব: ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃকবাড়ি ছিল ঢাকা বিক্রমপুরের অন্তর্গত মালবদিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ছিল হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়ের নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তাই চাকুরিসূত্রে তাঁর বাবাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব কেটেছে বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে। তাঁর আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাকনাম মানিক। এই ডাকনামেই পরবর্তীকালে সাহিত্যিক হিসেবে তিনি খ্যাত হয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন: কলকাতা থেকে মানিকের বাবা টাঙ্গাইলে বদলি হওয়ায় মিত্র স্কুলের ছাত্র মানিক টাঙ্গাইল জেলা স্কুলে ভরতি হন। প্রতিবারই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত মাঝিদের নৌকায় বা গাড়োয়ানদের গাড়িতে অথবা আস্তাবলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। মেদিনীপুরে থাকাকালীন মানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে পাস করেন। বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইএসসি পাস করেন। ওই বছরই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি গণিতে অনার্স নিয়ে বিএসসি-তে ভরতি হন। কলেজজীবনে গান গাওয়া, বাঁশি বাজানো এসবের প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক লক্ষ করা যায়। সাহিত্যচর্চার নেশা তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, তিনি একসময় প্রথাগত পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন: সাহিত্যের জগতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল কিছুটা হঠাৎ করেই। তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, তখন একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় নামি পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপানোর প্রসঙ্গ ওঠে। কথাপ্রসঙ্গে মানিকের এক বন্ধু বলেছিলেন যে, নামকরা লেখক না হলে বিখ্যাত পত্রিকাগুলো লেখা ছাপায় না। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, ভালো লেখা হলে অনামি লেখকের রচনাও নিশ্চয়ই ছাপা হবে। বন্ধুদের সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক বাধলে মানিক তাঁদের বলেন যে, তিন মাসের মধ্যেই তিনি তাঁর কথা প্রমাণ করবেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই ‘অতসী মামী’ নামে একটি গল্প লিখে তখনকার নামি পত্রিকা বিচিত্রা-র অফিসে জমা দেন। লেখক হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটিই তিনি সেখানে ব্যবহার করেন। যথাসময়ে সেই গল্পটি ছাপা হয় এবং তা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এইভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকজীবনের শুরু। ‘অতসী মামী’ গল্পটি প্রকাশের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে মানিকের কাছে লেখার জন্য ডাক আসতে থাকে। তিনিও মনপ্রাণ দিয়ে লিখতে থাকেন। সাহিত্যচর্চাতেই তিনি বেশি করে মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহসম্পাদক নিযুক্ত হন। কিন্তু পত্রিকার মালিকের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই সেই চাকরি থেকে তিনি ইস্তফা দেন। এরপর মানিক তাঁর ছোটো ভাই সুবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস’ নামে এক প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস এবং ছোটোগল্প দুই-ই রচনা করেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর সমান দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা ছোটোগল্পের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দিবারাত্রির কাব্য বইটি তিনি একুশ বছর বয়সে লিখেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল— জননী (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), দর্পণ (১৯৪৫), শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১), সোনার চেয়ে দামি (১৯৫১), ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২), হলুদ নদী সবুজ বন (১৯৫৬) ইত্যাদি। তাঁর লেখা ছোটোগল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), ভেজাল (১৯৪৪), আজ, কাল, পরশুর গল্প (১৯৪৬), লাজুকলতা (১৯৫০) ইত্যাদি।
বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নাম। স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বাস্তবজীবন ও দর্শনকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলায় তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর রচনার মধ্যে মার্কসীয় দর্শন ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রভাব রয়েছে।
শেষজীবন: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যজীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে। সংক্ষিপ্ত জীবনকালে বারবার নানাপ্রকার অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

বিষয়সংক্ষেপ

‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের মুখ্য চরিত্র নদেরচাঁদ একজন স্টেশনমাস্টার। নদীর সঙ্গে তার আত্মার যোগ যেন জন্ম থেকেই, কারণ নদীর ধারেই তার জন্ম; নদীর ধারেই সে মানুষ হয়েছে। চিরদিন সে নদীকে ভালোবেসেছে। তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গেই তাই নদী জড়িয়ে গেছে। স্টেশনমাস্টারি করতে এসেও এই ভালোবাসা একইরকম থেকে গেছে। বর্ষার জন্য পাঁচ দিন নদীকে দেখতে না পেয়ে ছেলেমানুষের মতো তার মন ছটফট করেছে পরম আত্মীয় নদীটিকে দেখার জন্য। তার মনে হয়েছে, নদীকে দেখতে না পেলে সে হয়তো আর বাঁচবে না। তাই বৃষ্টি থামলেই সে ছুটে যায় নদীর কাছে। কিন্তু ব্রিজের কাছাকাছি এসে নদীকে দেখে সে হতবাক হয়ে যায়। এটা ঠিক যে, পাঁচ দিন আগেও বর্ষার জলে ওই নদী পরিপুষ্ট ছিল। চঞ্চল নদীতে সে দেখেছিল পরিপূর্ণতার আনন্দের প্রকাশ। কিন্তু এখন সেই নদীকে এমন রূপে দেখে তার যেন কেমন অচেনা লাগল। নদীর সেই রূপ ভীষণই ভয়ংকর। নদীর জল ব্রিজে বাধা পেয়ে আবর্ত সৃষ্টি করেছে। তার জলপ্রবাহ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নদীর এই রূপ দেখে নদেরচাঁদ এক মজায় মেতে ওঠে। সে নদীর সঙ্গে খেলা শুরু করে। খেলার আনন্দে সে স্ত্রীকে লেখা চিঠিটিও ছুঁড়ে দেয়। তখন নদী যেন তার কাছে এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে ধরা দেয়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলেও সে বসে ভিজতে থাকে। নদেরচাঁদের মনে হয়, রোষে, ক্ষোভে উন্মত্ত নদী যেন বিদ্রোহ করছে। বাঁধের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যেন নদী এভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ব্রিজ ভেঙে, মানুষের তৈরি বাঁধ চুরমার করে দিয়ে নদী যেন নিজের স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে চাইছে। একইসঙ্গে নদেরচাঁদ এটাও অনুভব করে, নদী যদি সমস্ত বাধা চূর্ণ করে মুক্তি পায় তাহলেও তার নিস্তার নেই। মানুষ আবার নদীকে বন্দি করবে, আবার নদীতে বাঁধ গড়ে তুলবে। তারপর হয়তো গভীর প্রশস্ত জলপূর্ণ নদীও নদেরচাঁদের দেশের নদীটির মতোই ক্ষীণস্রোতা হয়ে পড়বে। তাই যে রং করা নতুন ব্রিজের জন্য একসময় নদেরচাঁদের গর্ব হত, আজ সেই ব্রিজকেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয় তার। নদেরচাঁদ মনে মনে নদীর মুক্তি কামনা করতে থাকে। যখন সে এ কথা ভাবতে ভাবতে লাইন ধরে স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই এক প্যাসেঞ্জার ট্রেন এসে তাকে পিষে চলে যায়। গল্পশেষে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়—নদেরচাঁদ নদীর পক্ষ নিয়ে যন্ত্রসভ্যতার প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্ন করেছিল, যন্ত্রসভ্যতা তার সেই স্পর্ধা মেনে নেয়নি।

নামকরণ

যে-কোনো সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামকরণের মাধ্যমেই কোনো সাহিত্যের বিষয়বস্তু বা ভাবটি পাঠকের কাছে ফুটে ওঠে। সাধারণত সাহিত্যের নামকরণ হয় তার বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক, চরিত্রধর্মী বা ভাব অনুযায়ী। আবার কখনও তা হয় ব্যওনাধর্মী।
‘নদীর বিদ্রোহ’ নামকরণটি ব্যঞ্জনাধর্মী। এখানে মানুষ এবং নদীর মধ্যেকার এক অদ্ভুত সখ্যের বর্ণনা পাই আমরা। গল্পে দুটি নদীর কথা জানা যায়। এদের একটি হল নদেরচাঁদের দেশের ক্ষীণস্রোতা নদী আর অন্যটি হল সেই নদী যার সঙ্গে স্টেশনমাস্টারি করতে এসে নদেরচাঁদের আলাপ হয়। ওই নদীটি ছিল বন্দি। বাঁধ দিয়ে মানুষ তাকে বন্দি করেছিল। ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদী এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে ধরা দিয়েছে। বর্ষার জলে এই নদীর পঙ্কিল জলস্রোতে দেখা দিয়েছে উন্মাদনা, চল হয়ে উঠেছে তার স্রোত।
মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য বাঁধ দিয়ে এই নদীকে বন্দি করেছে, তৈরি করেছে ব্রিজ। সব কিছুই মানুষ করেছে যন্ত্রসভ্যতার সাহায্যে, নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে। নিজেদের প্রয়োজনে তারা নদীর স্বাভাবিক গতিকে আটকে রেখেছে। আর সেই কারণেই এই গল্পে নদী যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। সে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে। যারা তাকে বন্দি করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে সে এই ব্রিজ আর বাঁধ ভেঙে ফেলে সে যেন তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে চেয়েছে। আর তাই সে তার উন্মত্ত জলস্রোতের মধ্য দিয়ে সেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তখন বাঁধ ভেঙে দাও’ মন্ত্রে যে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে নদীটি। তাই গল্পের প্রেক্ষিতে বিচার করলে ‘নদীর বিদ্রোহ’ নামকরণটি যথার্থ ও সার্থক হয়েছে বলা যায়।

আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর

বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম ছোটোগল্প-
(ক) প্রাগৈতিহাসিক
(খ) পাশফেল
(গ) শিল্পী
(ঘ) অতসী মামী
২. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম—
(ক) প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
(খ) প্রবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
(গ) প্রবোধকুমার মুখোপাধ্যায়
(ঘ) শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩. নদেরচাদের বয়স—
(ক) পঁচিশ বছর
(খ) পঞ্চাশ বছর
(গ) ত্রিশ বছর
(ঘ) চল্লিশ বছর
৪. নদেরচাঁদ পেশায় ছিলেন একজন-
(ক) স্কুলমাস্টার
(খ) স্টেশনমাস্টার
(গ) পোস্টমাস্টার
(ঘ) উকিল
৫. “কিন্তু শৈশবে, কৈশোরে আর প্রথম যৌবনে বড়োছোটোর হিসাব কে করে?”—উক্তিটি কার সম্বন্ধে করা হয়েছে?—
(ক) নদেরচাঁদ সম্বন্ধে
(খ) নদেরচাদের সহকারীর সম্বন্ধে
(গ) নদেরচাঁদ যেখানে কাজ করত সেখানকার নদীটির সম্বন্ধে
(ঘ) নদেরচাদের দেশের নদীটির সম্বন্ধে
৬. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি-
(ক) তিনটে পঁয়তাল্লিশের
(খ) চারটে পঁয়তাল্লিশের
(গ) পাঁচটা পয়তাল্লিশের
(ঘ) ছটা পঁয়তাল্লিশের
৭. স্টেশন থেকে নদীর দূরত্ব ছিল-
(ক) আধ মাইল
(খ) এক মাইল
(গ) দু-মাইল
(ঘ) তিন মাইল
৮. অবিরত বর্ষণের ফলে নদীকে নদেরচাঁদ কতদিন দেখতে পায়নি?
(ক) পাঁচ দিন
(খ) তিন দিন
(গ) সাত দিন
(ঘ) চার দিন
৯. বৃষ্টি কতদিন ধরে হয়েছিল?
(ক) তিন দিন
(খ) পাঁচ দিন
(গ) আট দিন
(ঘ) চার দিন
১০. পাঁচ দিন অবিরত বৃষ্টির পর বর্ষণ থেমেছে –
(ক) সকালের দিকে
(খ) বিকালের দিকে
(গ) সন্ধ্যার দিকে
(ঘ) রাত্রির দিকে
১১. নদীকে ভালোবাসার যে কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে, তা হল –
(ক) নদীকে সে জীবন্ত ভাবে
(খ) নদীর তীরে তার জন্ম
(গ) নদীর জল তার তৃষ্ণা নিবারণ করে
(ঘ) নদী সভ্যতার রূপকার

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গদ্যাংশটি কার লেখা? 
উত্তর – ‘নদীর বিদ্রোহ’ গদ্যাংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা।
২. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদ পেশায় কী ছিল?
উত্তর – ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদ পেশায় ছিল একজন স্টেশনমাস্টার।
৩. নদেরচাদ স্টেশনমাস্টারি করতে এসে কতদিন তার পরিচিত নদীটিকে দেখতে পায়নি?
উত্তর – নদেরচাঁদ স্টেশনমাস্টারি করতে এসে পাঁচ দিন তার পরিচিত নদীটিকে দেখতে পায়নি।
৪. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম কী? 
উত্তর – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
৫. নদেরচাদের দেশের নদীটি কীরকম ছিল?
উত্তর – নদেরচাঁদের দেশের নদীটি ছিল ক্ষীণস্রোতা ও নির্জীব।
৬. “নদেরচাদ ছেলেমানুষের মতো ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল।” —কেন তার এমন বোধ হয়েছিল?
উত্তর – নদীকে না দেখতে পেয়ে নদেরচাঁদের অবস্থা ছেলেমানুষের মতো হয়ে গিয়েছিল। সে ছোটোছেলের মতো উতলা হয়ে উঠেছিল নদীকে দেখার জন্য।
৭. “নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটা কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে।” –নদেরচাদের নদীকে ভালোবাসার কৈফিয়ত কী ছিল?
উত্তর – নদেরচাদ নদীর ধারে জন্মেছে, নদীর ধারেই মানুষ হয়েছে, নদী যেন তার চিরপরিচিত আপনজন। এই বিষয়টিকেই নদেরচাঁদ নদীর প্রতি তার ভালোবাসার সহজ কৈফিয়ত হিসেবে তুলে ধরতে পারে।
৮. নদেরচাঁদের ওপর কীসের দায়িত্ব ছিল?
উত্তর – নদেরচাঁদ স্টেশনমাস্টার ছিল। তাই সারা দিনরাতে যেসব মেল, প্যাসেঞ্জার ও মালগাড়িগুলি তীব্রগতিতে ছুটে চলে, তাদের গতি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব ছিল নদেরচাঁদের ওপর।
৯. স্টেশনমাস্টারি করতে এসে নদেরচাদের সাথে পরিচয় হওয়া নদী আর তার দেশের নদীর মধ্যে পার্থক্য কী ছিল?
উত্তর – স্টেশনমাস্টারি করতে এসে নদেরটাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়া নদীটি ছিল গভীর, প্রশস্ত ও জলপূর্ণ আর তার দেশের নদীটি ছিল স্কীপস্রোতা ও নির্জর
১০, নদেরচাদের দেশের ক্ষীণস্রোতা নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তার অবস্থা কীরকম হয়েছিল?
উত্তর – নদেরচাদের দেশের ক্ষীণস্রোতা নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার উপরুন হলে সে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরমাত্মীর মারা যাওয়ার উপরুন হলে মানুষ যেভাবে কাঁদে সে-ও সেভাবেই কেঁদেছিল।
১১, “দেখিয়া সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল”—সে কী দেখে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল?
উত্তর – নদেরচাঁদের দেশের ক্ষীণস্রোতা নদীটি অনাবৃষ্টির বছরে প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে সে কেঁদে ফেলেছিল।
১২. “নদেরচাঁদ সব বোঝে,”—নদেরচাঁদ কী বোঝে?
উত্তর – তিরিশ বছর বয়সে নিজের পেশারত দায়িত্ব কীভাবে পালন করতে হয় এবং আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নদেরচাদ বোঝে।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “…নদেরচাঁদের এত বেশি মায়া একটু অস্বাভাবিক।”—কার প্রতি এত বেশি মায়া এবং কেন তা অস্বাভাবিক?
উত্তর – উদ্দিষ্টের পরিচয়: প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে নদেরচাঁদের নদীর প্রতি মায়ার কথা বলা হয়েছে।
অস্বাভাবিক হওয়ার কারণ: বেশিদিন নদীকে দেখতে না পেলে, নদীকে দেখার জন্য নদেরচাঁদ ছেলেমানুষের মতো ছটফট করত। নদেরচাঁদ ছিল একজন স্টেশন মাস্টার। এই পেশার মানুষদের অনেক বেশি বাস্তববাদী ও কাজের প্রতি মনোযোগী হতে হয়। তাই পেশায় গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে নদীর প্রতি এতটা ভালোবাসা নদেরচাদের পক্ষে বেশ বেমানানই ছিল। তাই নদেরচাঁদের নদীর প্রতি এত মায়া তার নিজের কাছেই যেন অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে।
২. “ নদীর জন্য এমনভাবে পাগলা হওয়া কি তার সাজে?”—কে, কেন এরকম প্রশ্ন করেছে?
উত্তর – প্রশ্নকর্তা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে আলোচ্য প্রশ্নটি করেছে নদেরচাঁদ।
প্রশ্নের কারণ: নদেরচাঁদ নদীর জন্য পাগল হত। প্রবল বৃষ্টির কারণে পাঁচ দিন নদীকে না দেখে নদেরচাঁদ আকুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পেশায় সে ছিল স্টেশন মাস্টার। স্টেশন মাস্টারের কাজ যথেষ্ট দায়িত্বপূর্ণ। দিনরাত মেল, প্যাসেঞ্জার আর মালগাড়িগুলির ছোটাছুটি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব যাদের, নদেরচাঁদও তাদের মধ্যে একজন। ঝুঁকিপূর্ণ সেই কাজ ভুলে সবসময় নদীর জন্য পাগল হওয়া তার সাজে না। তাই নদেরচাঁদ নিজেকেই এই প্রশ্ন করেছে।
৩. “নদেরচাঁদ সব বোঝে, নিজেকে কেবল বুঝাইতে পারে না।” —নদেরচাঁদ কী বোঝে? সে নিজেকে বোঝাতে পারে না কেন?
উত্তর – নদেরচাদের বোধগম্য বিষয়: নদীর প্রতি নদেরচাঁদের এত বেশি মায়া যে একটু অস্বাভাবিক—এই কথাটি সে নিজেই বোঝে।
নিজেকে বোঝাতে না পারার কারণ: নদেরচাঁদ জানে নদীর প্রতি তার এরুপ ভালোবাসা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভ । নয়। তা ছাড়া সে যে কাজে নিযুক্ত তাতে নদী সম্পর্কে এত চিন্তা করাও নিতান্ত অস্বাভাবিক। কেননা, সে একজন স্টেশনমাস্টার। তবুও নদেরচাঁদ তার মনকে বোঝাতে পারে না এই দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতাকে। তাই এক দুর্বোধ্য আকর্ষণে তার চঞ্চল মন বারে বারে নদীর কাছে ছুটে যায়।
8. …… নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটা কৈফিয়ত নদেরচাদ দিতে পারে।”—কোন্ প্রসঙ্গে এই কথা বলা হয়েছে? কী কৈফিরত নদেরচাঁদ দিতে পারে? 
উত্তর – উৎস: আলোচ্য অংশটি মানিক বন্দ্যোপাধারের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্প থেকে গৃহীত হয়েছে। প্রসঙ্গ: নদেরচাঁদ পেশায় ছিল একজন স্টেশনমাস্টার। কিন্তু স্টেশনমাস্টারের গুরুদায়িত্ব সামলে নদীর প্রতি এরকম টান, নদীর জন্য এমনভাবে পাগল হওয়া ছিল অস্বাভাবিক। তবুও নদেরচাদের নদীকে এভাবে ভালোবাসার একটা কৈফিয়ত দেওয়ার কথা লেখক বলেন।
নদেরচাঁদের কৈফিয়ত: নদেরচাঁদের নদীকে ভালোবাসার কৈফিয়তটি ছিল এই যে, তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নদী। যেহেতু নদীর ধারেই তার জীবনের বেশিরভাগটা কেটেছে তাই চিরদিন সে নদীকে ভালোবেসেছে।
৫. “এই নদীর মতো এত বড় ছিল না।” -কোন্ নদীর কথা বলা হয়েছে? সেই নদী কেমন ছিল? –
উত্তর – নদীটির পরিচয়: প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে নদেরচাঁদের দেশের নদীর কথা বলা হয়েছে।
নদীটির বর্ণনা: স্টেশনমাস্টারের চাকরি করতে এসে নদেরচাঁদ যে নদীটিকে দেখেছিল তার দেশের নদীটি ওইটির মতো এত বড়ো ছিল না। কিন্তু নদেরচাঁদের দেশের সেই ক্ষীণস্রোতা নির্জীব নদীটি অসুস্থ দুর্বল আত্মীয়ার মতোই তার মমতা পেয়েছিল। অনাবৃষ্টিতে ওই নদীটি শুকিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যেত। তখন সেই নদীর জন্য নদেরচাদের চোখে জল চলে আসত। দুরারোগ্য অসুখে পরমাত্মীয় কেউ মারা যাওয়ার সময় মানুষ যেমন কাঁদে নদেরচাঁদের কান্নাও ছিল সেরকমই।
৬. “…… সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল;”—কে, কী কারণে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল?
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি প্রশ্নে উল্লিখিত অংশে নদেরচাদের কথা বলা হয়েছে। ● কেঁদে ফেলার কারণ: নদেরচাঁদের কাছে নদী ছিল জীবন্ত মানুষের প্রতিমূর্তি। জলপূর্ণ নদী তার কাছে প্রাণময় মানুষ হিসেবেই ধরা দিত। এক অনাবৃষ্টির বছরে সে তার দেশের নদীটিকে শুকিয়ে যেতে দেখেছিল। জল না পেয়ে নদেরচাঁদের দেশের নদীটির ক্ষীণ স্রোতধারা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল। নদীর শুকিয়ে যাওয়া নদেরচাঁদের কাছে মানুষের মৃত্যুর সমান ছিল। তাই সে ছোটোবেলার পরিচিত সেই নদীটির এই অবস্থা দেখে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল।
৭. “দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগিতে ভুগিতে পরমাত্মীয়া মরিয়া যাওয়ার উপক্রম করিলে মানুষ যেমন কাঁদে।”—মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – মন্তব্যের ব্যাখ্যা: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের মুখ্য চরিত্র স্টেশনমাস্টার নদেরচাঁদের নদীর ধারেই জন্ম, নদীর ধারেই সে মানুষ হয়েছে। তাই নদীর প্রতি তার এক অদ্ভুত টান ছিল। দেশের ক্ষীণস্রোতা ও নির্জীব নদীটি অসুস্থ, দুর্বল আত্মীয়ার মতোই তার মমতা পেয়েছিল। একবার অনাবৃষ্টিতে ওই ক্ষীণস্রোতা নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে নদেরচাঁদের ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। সে এমনভাবে কেঁদেছিল যেন কোনো কঠিন রোগে তার কাছের আত্মীয় মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ এই নদীকে সে পরমাত্মীয়ের মতোই ভালোবাসত।
৮. “নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে।”— কার কথা বলা হয়েছে? তার পাগলামিটি কী?
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি : মানিক বন্দ্যোপাদ্যায় ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের উল্লিখিত অংশে নদেরচাঁদের কথা বলা হয়েছে।
পাগলামির পরিচয়: নদীর সঙ্গে নদেরচাঁদের শৈশব থেকেই সখ্য। কর্মক্ষেত্রে এসেও তার নদীর প্রতি আকর্ষণ একটুও কমেনি। তাই প্রবল বৃষ্টির কারণে পাঁচ দিন নদীকে দেখতে না পেয়ে সে ‘ছেলেমানুষের মতো’ আকুল হয়ে ওঠে। বৃষ্টি একটু থামলেই নদীর দিকে যেতে শুরু করে। নদীর প্রতি এই আকুলতাই ছিল তার ‘পাগলামি’, যার অর্থ সে নিজেকে বুঝতে পারে না।

বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

১. “ত্রিশ বছর বয়সে নদীর জন্য নদেরচাঁদের এত বেশি মায়া একটু অস্বাভাবিক।”—নদেরচাঁদের নদীর প্রতি এত ভালোবাসার কারণ কী? সেই ভালোবাসার পরিচয় দাও। 
উত্তর – নদীর প্রতি ভালোবাসার কারণ: মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের নদীর প্রতি ছিল অস্বাভাবিক মায়া। তাই স্টেশনমাস্টারের গুরুদায়িত্ব সামলেও নদীকে দেখার জন্য সে আকুল হয়ে ওঠে। প্রবল বর্ষণে পাঁচদিন নদীকে না দেখতে পাওয়ায় বৃষ্টি থামলেই সে নদীকে দেখার জন্য ছুটে যায়। নদীর জন্য এমনভাবে পাগল হওয়া তার মানায় না বুঝেও সে নিজেকে বোঝাতে পারে না। বরং নিজের এই পাগলামিতে আনন্দই উপভোগ করে সে। এর একটা কারণও সে খুঁজে নেয়। নদীর ধারেই তার জন্ম এবং বড়ো হয়ে ওঠা—তাই চিরদিনই নদীর প্রতি তার এত ভালোবাসা।
ভালোবাসার পরিচয়: নদীর জন্য কান্না: প্রথম জীবনে দেশের ক্ষীণস্রোতা নদীটি অনাবৃষ্টির কারণে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে নদেরচাদ কেঁদে ফেলেছিল। নদীর প্রতি আকুলতা: একইভাবে কর্মক্ষেত্রে এসেও পাঁচ দিন প্রবল বৃষ্টির কারণে নদীকে দেখতে না পাওয়ায় আকুল হয়ে ওঠে সে। বৃষ্টি একটু থামতেই তার মনে হয়— “ব্রিজের একপাশে আজ চুপচাপ বসিয়া কিছুক্ষণ নদীকে না দেখিলে সে বাঁচিবে না।” বর্ষায় উন্মত্ত নদীর সঙ্গে সে খেলা করে। স্ত্রীকে লেখা চিঠিও সে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। নদীকে সমর্থন: আবার ব্রিজ দিয়ে নদীকে বেঁধে রাখার চেষ্টাও মানতে পারে না সে। নদীর বিদ্রোহী চরিত্রকে সে মনে মনে সমর্থন করে। এভাবেই নদীর প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে।
২. “নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে।”কার, কোন্ পাগলামির কথা এখানে বলা হয়েছে? কীভাবে সে পাগলামিতে আনন্দ উপভোগ করে লেখো।
অথবা, “নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে।”—কার ‘পাগলামি’-র কথা বলা হয়েছে? গল্প অনুসরণে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির পাগলামির পরিচয় দাও।
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ও তার পাগলামি: কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে তিরিশ বছর বয়সেও নদীর জন্য নদেরচাঁদের অতিরিক্ত মায়াকে একটু অস্বাভাবিক বলেই মনে হত। নদেরচাঁদের নদীর প্রতি এই ভালোবাসাকেই ‘পাগলামি’ বলা হয়েছে।
পাগলামিতে আনন্দ উপভোগ: আপন হয়ে ওঠা: নদীর ধারেই নদেরচাঁদের দেশ। নদীই তার আবাল্য বন্ধু। স্টেশনমাস্টারের কাজে এসে আরএক নদীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এই নদীটিও তার আপন হয়ে ওঠে। চিন্তায় মশগুল থাকা: কাজের ব্যস্ততার মাঝেও সে এই নদীর চিন্তায় মশগুল হয়ে থাকত। এই নদীটি বর্ষার জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলে সে বিস্মিত হয়ে নদীর জলস্রোতের চঞ্চলতা দেখত। নদেরচাঁদের মনে হত নদীর এই চঞ্চলতা যেন তার আনন্দেরই প্রকাশ। একাত্ম হয়ে ওঠা: দিবারাত্রি প্যাসেঞ্জার ও মালগাড়ির তীব্রবেগে ছোটাছুটি নিয়ন্ত্রণ করা যার কাজ, তার নদীর জন্য এমন পাগল হওয়া সাজে কি না সে প্রশ্ন নদেরচাঁদের মধ্যে প্রায়ই জাগত। নদেরচাঁদ নিজেও এ কথা বোঝে, কিন্তু মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না। আসলে মানসিকভাবে সে নদীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকা: নদীর সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে পেরে সে নিজেকে ধন্য মনে করত। শেষের কথা: নদীপ্রীতির এই পাগলামিতে নদেরচাঁদ উপভোগ করত এক অদ্ভুত আনন্দ, যা ছিল একান্তই তার নিজস্ব।
৩. “নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটি কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে।”—কী কৈফিয়ত দিতে পারে? এই ভালোবাসার কীরূপ পরিণতি হয় লেখো।
উত্তর – কৈফিয়তের বিষয়: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদীকে ভালোবাসার একটা কৈফিয়ত নদেরচাঁদ ভেবেছিল। নদীর ধারে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তাই নদীর প্রতি তার এই ভালোবাসা চিরদিনের। অনাবৃষ্টির কারণে দেশের ক্ষীণস্রোতা নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে নদেরচাঁদ কেঁদেছিল। আবার কর্মক্ষেত্রেও নদীর সঙ্গে তার সখ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
ভালোবাসার পরিণতি: নদীর প্রতি এই ভালোবাসার চূড়ান্ত মূল্য নদেরচাঁদকে দিতে হয়েছিল। বর্ষায় নদীর যে উন্মত্ত রূপ তার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল, তাকেই নদীর বিদ্রোহ বলে মনে হয়েছে নদেরচাঁদের। মানুষ ব্রিজ তৈরি করে নদীকে বাঁধতে চেয়েছে। কিন্তু নিজের স্বাভাবিক গতির এই রোধ নদী মানতে পারেনি। ব্রিজ ভেঙে ভাসিয়ে দিয়ে সে নিজের চলার পথ করে নিতে চেয়েছে। নদেরচাঁদ জানে যে ব্রিজ ভাঙলেও মানুষ আবার তা গড়ে নেবে। তার মনে হয়, এই ব্রিজের কোনো প্রয়োজন ছিল না। নদেরচাঁদ যখন এসব চিন্তায় ডুবেছিল ঠিক তখনই একটি চলন্ত ট্রেন তাকে পিষে দিয়ে চলে যায়। যন্ত্রসভ্যতার প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল সে। প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসার চূড়ান্ত মূল্য এভাবেই জীবন দিয়ে মিটিয়ে দিতে হয় নদেরচাঁদকে।

বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১. নদেরচাঁদ কোথায় বসে নদীকে দেখত?—
(ক) নদীর ধারে
(খ) গাছতলায়
(গ) ধারকস্তম্ভের শেষপ্রান্তে
(ঘ) নদীর ঘাটে
২. “তাহাকে বিশ্বাস নাই।”—‘তাহাকে’ বলতে বোঝানো হয়েছে-
(ক) মানুষকে
(খ) রেলগাড়িকে
(গ) নদীকে
(ঘ) নদীর ব্রিজকে
৩. নদীর চাঞ্চল্য যেন-
(ক) পরিপূর্ণতার প্রকাশ
(খ) বিদ্রোহের প্রকাশ
(গ) জীবনের প্রকাশ
(ঘ) প্রাণের উচ্ছ্বলতা
৪. নদেরচাঁদের চিঠিটি ছিল-
(ক) আনন্দের
(খ) অভিজ্ঞতার
(গ) কৌতুকের
(ঘ) বিরহবেদনার
৫. যে পুরাতন চিঠিটা নদীর স্রোতের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছিল নদেরচাঁদ, সেই চিঠিটি সে লিখেছিল-
(ক) তার মায়ের উদ্দেশ্যে
(খ) তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে
(গ) তার বাবার উদ্দেশ্যে
(ঘ) তার বোনের উদ্দেশ্যে
৬. নদেরচাদের স্ত্রীকে লেখা চিঠির পৃষ্ঠা সংখ্যা কত ছিল?-
(ক) পাঁচ
(খ) তিন
(গ) দুই
(ঘ) ছয়
৭. “এই ভীষণ মধুর শব্দ শুনিতে শুনিতে সর্বাঙ্গ অবশ”—শব্দটি হল-
(ক) নদীর
(খ) বৃষ্টির
(গ) ট্রেনের
(ঘ) নদীর ও বৃষ্টির
৮. কতক্ষণ বিরতির পর আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছিল?
(ক) দু-ঘণ্টা
(খ) ছ-ঘণ্টা
(গ) তিন ঘণ্টা
(ঘ) তিরিশ মিনিট
৯. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের”—ভয়ের কারণ-
(ক) নদী যদি আবার বন্দি হয়ে পড়ে
(খ) যদি ব্রিজ ভেঙে যায়
(গ) যদি নদী তাকে ভুলে যায়
(ঘ) আবার যদি নদী শুকিয়ে যায়
১০, উন্মত্ততার জন্য নদেরচাঁদের কাকে জীবন্ত মনে হয়েছিল?
(ক) প্রবল বাতাসকে
(খ) সামুদ্রিক ঝড়কে
(গ) বৃষ্টিকে
(ঘ) জলপ্রবাহকে 

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হইয়া গেল।”—নদেরচাঁদের স্তম্ভিত হওয়ার কারণ কী?
উত্তর – ব্রিজের কাছে এসে নদীর দিকে প্রথমবার তাকিয়ে নদীর উন্মত্ত চেহারা দেখেই নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হয়ে গেল।
২. “…ফেনিল আবর্ত রচনা করিতেছে।”—কীভাবে নদীতে আবর্ত রচনা হয়েছিল?
উত্তর – নদীর জল বর্ষায় অনেকটা বেড়ে গেছিল। তাই নদীর স্রোত ব্রিজের ধারকস্তম্ভে বাধা পেয়ে আবর্ত রচনা করছিল।
৩. “জলপ্রবাহকে আজ তাহার জীবন্ত মনে হইতেছিল।”—কেন নদেরচাদের নদীর জলপ্রবাহকে জীবন্ত মনে হল?
উত্তর – বৃষ্টির জল পেয়ে নদীর জলপ্রবাহ উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। আর এই উন্মত্ততার জন্যই নদেরচাঁদের নদীর জলপ্রবাহকে জীবন্ত বলে মনে হল।
৪. “চিঠি পকেটেই ছিল।”—কোন্ চিঠির কথা বলা হয়েছে?
উত্তর – নদেরচাঁদ তার স্ত্রীকে পাঁচ পৃষ্ঠার যে বিরহ-বেদনাপূর্ণ চিঠিটি লিখেছিল এখানে সেই চিঠির কথা বলা হয়েছে।
৫. কীসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নদেরচাঁদ স্ত্রীকে চিঠি লিখেছিল?
উত্তর – অবিরাম হয়ে চলা বৃষ্টিধারার সঙ্গে সুর মিলিয়ে নদেরচাঁদ তার স্ত্রীকে চিঠি লিখেছিল।
৬. পুরোনো চিঠিটি নদীর জলস্রোতে ফেলার পর নদেরচাদের কী মনে হল?
উত্তর – স্ত্রীকে লেখা পুরোনো চিঠিটি নদীর জলস্রোতে ফেলার পর নদেরচাদের মনে হল নদীর জীবন্ত জলপ্রবাহ চিঠিটাকে যেন তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলেছে।
৭. নদেরচাঁদের কখন মনে হল তার সর্বাঙ্গ অবশ, অবসন্ন হয়ে আসছে?
উত্তর – নদী থেকে উঠে আসা অশ্রুতপূর্ব একটা শব্দের সঙ্গে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মিশে যেন একটা সংগত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ওই শব্দ শুনে নদেরচাঁদের মনে হল তার সর্বাঙ্গ যেন অবশ ও অবসন্ন হয়ে আসছে।
৮. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদের চাঁদের”—নদেরচাঁদ কেন ভয় পেয়েছিল?
উত্তর – নদীর অবস্থা ভয়ংকর ছিল, নদী যেন রোষে, ক্ষোভে উন্মত্ত ছিল। নদেরচাঁদ নদী থেকে এক হাত উঁচুতেই বসেছিল। তাই বর্ষার জলে ফুলেফেঁপে ওঠা নদী যে-কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটাতে পারে—এই ভেবে নদেরচাঁদ ভয় পেয়েছিল।
৯. ‘তাহাকে বিশ্বাস নাই।”—কাকে, কেন বিশ্বাস নেই? 
উত্তর – নদেরচাঁদ নদীকে বিশ্বাস করতে পারেনি তার উন্মত্ত চেহারার জন্য।
১০. নদী কী চায় বলে নদেরচাঁদের মনে হল?
উত্তর – ব্রিজ ও মানুষের হাতে গড়া বাঁধ ভেঙে নদী নিজের স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে চায় বলে নদেরচাঁদের মনে হল।
১১. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।”—নদীর বিদ্রোহের কারণ নদেরচাঁদ বুঝতে পারল কীভাবে?
উত্তর – শুকনো নদী পাঁচ দিনের বৃষ্টির জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। উন্মত্ত নদীর তীব্র স্রোতযুক্ত জলধারা দেখে নদেরচাঁদ নদীর বিদ্রোহের কারণ বুঝতে পারল।
১২. ব্রিজ ও বাঁধ ভেঙে ফেললেও নদী কেন রেহাই পাবে না বলে নদেরচাঁদের মনে হল?
উত্তর – ব্রিজ ও বাঁধ ভেঙে ফেললেও নদী রেহাই পাবে না বলে নদেরচাঁদের মনে হল। কারণ, মানুষ আবারও নতুন করে ব্রিজ ও বাঁধ গড়ে তুলে নদীকে বন্দি করবে।
১৩. “নদেরচাঁদ গর্ব অনুভব করিয়াছে”—নদেরচাঁদ কীসের জন্য গর্ব অনুভব করেছে?
উত্তর – স্টেশনের কাছে নতুন রং করা ব্রিজটির জন্য নদেরচাঁদ গর্ব অনুভব করেছিল।
১৪. কীভাবে নদেরচাদের মৃত্যু হয়েছিল?
উত্তর – অন্ধকারে অন্যমনস্কভাবে লাইন ধরে স্টেশনের দিকে যাওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় নদেরচাদের মৃত্যু হয়েছিল।
১৫. পাঁচ দিন পর নদীকে দেখে নদেরচাঁদ কেন স্তম্ভিত হয়েছিল?
উত্তর – পাঁচ দিন ধরে বৃষ্টির জল পেয়ে নদী যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল, বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। নদীর এই উন্মত্ত রূপ দেখেই নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
১৬. “আজও সে সেইখানে গিয়ে বসল।”—কোথায় গিয়ে বসল?
উত্তর – নদেরচাঁদ ব্রিজের মাঝামাঝি ইট, সুরকি আর সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা ধারকস্তম্ভের শেষপ্রান্তে গিয়ে বসল।
১৭. “এক একখানি পাতা ছিঁড়িয়া দুমড়াইয়া মোচড়াইয়া জলে ফেলিয়া দিতে লাগিল।”—উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কীসের পাতা জলে ফেলতে লাগল?
উত্তর – নদেরচাঁদ তার স্ত্রীকে লেখা পত্রখানি নদীর জলে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল।
১৮. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে”—নদীর বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
উত্তর – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে আমরা দেখি,নদেরচাঁদ অনুভব করে নদীর ওপরে ব্রিজ তৈরি করা ও বাঁধ দেওয়ার কারণেই নদী যেন বিদ্রোহ করেছে।
১৯. “ট্রেনটি নদেরচাঁদকে পিষিয়া দিয়া চলিয়া গেল”—কোন্ ট্রেনটি?
উত্তর – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্প থেকে নেওয়া আলোচ্য অংশে ৭ নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কথা বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. নদেরচাঁদের দেশের নদী আর স্টেশনমাস্টারি করতে এসে পরিচিত নদী— এই দুই নদীকে ভালোবাসার প্রকৃতি বা স্বরূপ ই দুই নদীকে ভালোবাসার প্রকৃতি কীরকম ছিল?
উত্তর – ভালোবাসার স্বরূপ: নদেরচাঁদের দেশের ক্ষীণস্রোতা নদী যেন অসুস্থ, দুর্বল আত্মীয়ের মতোই তার মমতা পেয়েছিল। তাই নদীর জল শুকিয়ে এলে নদেরচাঁদ পরমাত্মীয় মারা গেলে মানুষ যেভাবে কাঁদে ঠিক সেভাবেই কেঁদেছিল।
অন্যদিকে স্টেশনমাস্টারি করতে এসে পরিচয় হওয়া গভীর, প্রশস্ত নদীটি ছিল নদেরচাঁদের পরমবন্ধু। একদিনও সে ওই নদীকে না দেখে থাকতে পারত না। নদীর স্রোতে নিজের স্ত্রীকে লেখা চিঠি ফেলে এক অদ্ভুত খেলায় নদেরচাঁদ মেতে উঠত।
২. “আজ যেন সেই নদী খেপিয়া গিয়াছে।”—কোন্ নদীর কথা বলা হয়েছে? নদীর এই খেপে যাওয়ার মধ্যে নদেরচাঁদ কোন্ সত্য উপলব্ধি করেছে?
উত্তর – নদীটির পরিচয়: এখানে নদেরচাদের কর্মক্ষেত্রের কাছের নদীটির কথা বলা হয়েছে।
নদেরচাদের উপলব্ধি: বর্ষায় নদীটি টইটুম্বুর হয়ে উঠেছিল। প্রবল তার জলস্রোত। পরিপূর্ণতার আনন্দে সে যেন মাতোয়ারা। কোনো বাধা সে মানতে চায় না। উত্তাল জলের ঘূর্ণিতে পঙ্কিল আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে। চার বছরের চেনা নদীকে সেদিন নদেরচাঁদের আরও বেশি ভয়ংকর এবং অপরিচিত বলে মনে হয়েছিল।
৩. “চার বছরের চেনা এই নদীর মূর্তিকে তাই যেন আরও বেশি ভয়ংকর, আরও বেশি অপরিচিত মনে হইল।”—কেন নদেরচাঁদের কাছে নদীর মূর্তি অপরিচিত বলে মনে হল আলোচনা করো।
উত্তর – অপরিচিত নদী: প্রশ্নে উদ্ধৃতাংশে নদেরচাদের স্টেশনমাস্টারি করতে এসে পরিচয় হওয়া বাঁধে বন্দি নদীটির কথা বলা হয়েছে। এই নদী ছিল গভীর, প্রশস্ত ও জলপূর্ণ। কিন্তু প্রবল বর্ষায় পাঁচ দিন সে নদীকে দেখতে যেতে পারেনি। পাঁচ দিন পরে গিয়ে নদেরচাঁদ দেখল, নদী যেন তার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিদ্রোহ করছে। নদীর গাঢ় পঙ্কিল জল ফুলেফেঁপে উঠেছে। নদীর এই ভয়ংকর রূপ নদেরচাঁদ আগে কখনও দেখেনি। তাই নদীকে তার অপরিচিত বলে মনে হয়েছিল।
৪. “নদেরচাঁদের ভারী আমোদ বোধ হইতে লাগিল।” কী কারণে নদেরচাঁদের এমন অবস্থা হয়েছিল লেখো।
উত্তর – আনন্দের কারণ: নদেরচাঁদ নদীকে বড়ো বেশি ভালোবাসত। বর্ষায় নদী জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সে মুগ্ধ চোখে নদীর সেই রূপ দেখছিল। নদীর উন্মত্ত জলস্রোত পাগলের মতো ছুটে চলেছিল। জলস্তর এত উঁচুতে উঠে এসেছিল যে, নদেরচাঁদ হাত বাড়িয়ে তা ছুঁতে পারত। নদী যেন তখন পূর্ণযৌবনা। কোনো কিছু দিয়েই তার সেই গতি রোধ করা অসম্ভব। নদীর এই পরিপূর্ণ রূপ দেখে নদেরচাঁদের ভারি আমোদ বোধ হয়েছিল।
৫. নদেরচাঁদ নদীর সঙ্গে যে খেলায় মেতে উঠেছিল, সেই খেলাটি কীরকম ছিল?
উত্তর – নদীর সঙ্গে খেলা: এক বর্ষার দিনে নদীর কাছে গিয়ে নদেরচাঁদ দেখল নদীর জল ব্রিজের ধারকস্তম্ভে বাধা পেয়ে এক ফেনিল আবর্ত তৈরি করেছে। সে পকেট থেকে অনেকদিন আগের একটা চিঠি বার করে নদীর স্রোতে ছুঁড়ে ফেলল। চোখের পলকে তা অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপরে স্ত্রীকে লেখা চিঠির এক একটি পাতা ছিঁড়ে দুমড়ে-মুচড়ে সে নদীর মধ্যে ফেলতে লাগল আর নদীও যেন সেগুলি নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে লাগল। এইভাবে নদেরচাঁদ নদীর সঙ্গে এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছিল।
৬. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের”—কী কারণে নদেরচাঁদের ভয় করতে লাগল? 
উত্তর – ভয়ের কারণ: নদেরচাঁদ মুশলধারে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই নদীর পরিপূর্ণ রূপ দেখছিল। এরমধ্যেই চারিদিকে নেমে এল ঘন অন্ধকার। বৃষ্টি একটু থেমে আবার প্রবল বেগে শুরু হল। নদীর কলতান আর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মিলে সংগীতের ঐকতান সৃষ্টি করল। নদেরচাঁদের মন থেকে ছেলেমানুষি আমোদ মিলিয়ে গেল। এরকম পরিবেশে তার সর্বাঙ্গ যেন অবশ, অবসন্ন হয়ে এল। নদীর রহস্যময়তা দেখে নদেরচাঁদের ভয় করতে লাগল।
৭. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।”—কার কথা বলা হয়েছে? নদীর বিদ্রোহের কারণ কী?
উত্তর – উদ্দিষ্টের পরিচয়: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশে নদেরচাদের কথা বলা হয়েছে। ● নদীর বিদ্রোহের কারণ: পাঁচ দিন টানা বৃষ্টির পর নদীর কাছে গিয়ে নদেরচাঁদ দেখল নদীর পঙ্কিল জলস্রোত যেন রোষে ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। নদীর জলস্রোত প্রায় ব্রিজের কাছাকাছি উঠে এসে ব্রিজ ও বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে যেতে চাইছে। তা দেখে নদেরচাঁদ নদীর বিদ্রোহের কারণ বুঝতে পারল। তার মনে হল, নদী যেন তার এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে, ফিরে পেতে চাইছে তার স্বাভাবিক গতি, আর তাই সে এভাবে বিদ্রোহ জানাচ্ছে।
৮. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।”—কে বুঝতে পেরেছে? নদীর বিদ্রোহ বলতে সে কী বোঝাতে চেয়েছে?
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: উদ্ধৃত অংশে নদেরচাঁদের বুঝতে পারার কথা বলা হয়ছে।
নদেরচাঁদের মতামত: প্রবল বৃষ্টির কারণে পাঁচ দিন অদর্শনের পরে নদীর উন্মত্ত রূপ দেখে নদেরচাঁদ চমকে ওঠে। তার মনে হয় নদী যেন খেপে গেছে। নদেরচাঁদ উপলব্ধি করে, নদীর ওপর তৈরি রং করা নতুন ব্রিজ, নদীর বাঁধ যেন নদীর প্রবাহের পথে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী সেসব ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। নদী যেন উদ্দামতার মধ্য দিয়ে তার বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটাচ্ছে।
৯. “পারিলেও মানুষ কি তাকে রেহাই দিবে?”—কার, কী পারার কথা বলা হয়েছে? মানুষ কীভাবে তাকে রেহাই দেবে না?
উত্তর – যার যা পাবার কথা বলা হয়েছে: নদেরচাঁদ মনে করেছে যে, নদী ইচ্ছা করলে তার তীব্র জলস্রোতে মানুষের গড়া বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে।
মানুষের কার্যকলাপ: একইসঙ্গে নদেরচাঁদের মনে হয়েছে, মানুষ নদীকেও রেহাই দেবে না। তারা আবার নতুন করে বাঁধ তৈরি করবে, প্রবহমান জীবন্ত নদীকে বন্দি করবে নিজেদের স্বার্থে। আবার নদীকে মেনে নিতে হবে এই বন্দিদশা। গভীর প্রশস্ত জলপূর্ণ নদী পরিণত হবে ক্ষীণস্রোতা নদীতে।
১০. নদেরচাঁদ গর্ব অনুভব করিয়াছে।” —কীসের জন্য নদেরচাদের গর্ব অনুভব হয়েছে এবং কেন?
উত্তর – পর্ব অনুভবের বিষয়: স্টেশনের কাছে নতুন রং করা ব্রিজটির জন্য নদেরচাঁদ দীর্ঘকাল গর্ব অনুভব করেছে।
গর্ব অনুভবের কারণ: কর্মক্ষেত্রের নদীটির সঙ্গে নদেরচাদের যে মনের যোগাযোগ সেখানে ব্রিজটিরও একটা ভূমিকা ছিল। ব্রিজের মাঝামাঝি ইট, সুরকি আর সিমেন্টে গাঁথা ধারকস্তম্ভের একেবারে শেষপ্রান্তে বসেই সে প্রতিদিন নদীকে দেখত। নদীর ওপরে নির্মিত উন্নত যন্ত্রসভ্যতার চিহ্ন ব্রিজটিকে নিয়ে নদেরচাঁদের গর্ব হয়েছিল।
১১. “কী প্রয়োজন ছিল ব্রিজের?”—কোন্ ব্রিজের কথা বলা হয়েছে? উদ্দিষ্ট ব্যক্তির তা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে কেন?
উত্তর – ব্রিজটির পরিচয়: নদেরচাদের কর্মক্ষেত্রের কাছে অবস্থিত নদীটির ওপর যে কংক্রিটের ব্রিজ ছিল, এখানে সেই ব্রিজটির কথাই বলা হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ার কারণ: আগে নদেরচাঁদ নদীর ওপর তৈরি নতুন রং করা ব্রিজটিকে নিয়ে গর্ব অনুভব করত। কিন্তু পরে বর্ষায় নদী জলে পরিপূর্ণ হলে নদেরচাদের মনে হল ব্রিজটি যেন নদীর পায়ের শেকল। ব্রিজের থামগুলো যেন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিচ্ছে। যন্ত্রসভ্যতার ফসল কংক্রিটের ব্রিজটি নদীর স্বাধীন গতিকে রুদ্ধ করছে। তাই নদেরচাঁদের নতুন করে উপলব্ধি হয়েছিল যে, ওই ব্রিজটির কোনো প্রয়োজন ছিল না।
১২. “বন্দি নদীকে ভালোবাসিয়াছে,”—এখানে কার ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে? কেন নদীকে বন্দি বলা হয়েছে?
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: উদ্ধৃত অংশে নদেরচাঁদের নদীর প্রতি ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।
নদীকে বন্দি বলার কারণ: নদেরচাঁদের স্টেশনমাস্টারি করতে এসে পরিচিত হওয়া নদীটি ছিল গভীর, প্রশস্ত ও জলপূর্ণ। তার প্রবল গতিবেগ রুদ্ধ করা হয়েছিল বাঁধ দিয়ে, আর নদীর ওপরে ছিল একটি ব্রিজ। এই বাঁধ আর ব্রিজ যেন নদীর প্রবল জলস্রোতকে আটকে নদীকে বন্দি করে রেখেছিল।
১৩. “বোধহয়, এই প্রশ্নের জবাব দিবার জন্যই…..”—কোন্ প্রশ্ন? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য কী হয়েছিল?
উত্তর – প্রশ্ন: নদীর কাছ থেকে ফেরার সময় নদেরচাঁদের মনে হয়েছিল— “কী প্রয়োজন ছিল ব্রিজের?”—এখানে এই প্রশ্নের কথাই বলা হয়ছে।
পরিণতি: এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যই যেন যন্ত্র সভ্যতার প্রতীক ৭ নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে চলে যায় স্টেশনের দিকে। বন্দি নদীটি তথা প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার খেসারত এভাবেই দিতে হয় নদেরচাঁদকে।

বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

১. “মানুষ কি তাকে রেহাই দিবে?”- দেরচাঁদের এ কথা মনে হওয়ার কারণ বর্ণনা করো।
উত্তর – নদীর প্রতি ভালোবাসা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটিতে একজন সাধারণ স্টেশনমাস্টার নদেরচাঁদ নদীকে ভালোবেসেছিল পরমাত্মীয়, বন্ধুর মতো। নদীর প্রতি সে এক অসম্ভব টান অনুভব করত। তার জীবনের যেন অর্ধেকটা জুড়েই ছিল নদী। যেখানেই সে থেকেছে, সেখানকার নদীকেই সে ভালোবেসেছে। নদীর বিদ্রোহের উপলব্ধি স্টেশনমাস্টারের কাজ নিয়ে এসে সে পরিচিত হয় প্রশস্ত জলপূর্ণ অথচ বন্দি এক নদীর সঙ্গে। ব্রিজ, বাঁধ দিয়ে ওই নদীকে বন্দি করে রেখেছে মানুষ। একবার প্রবল বৃষ্টির পর নদীর উচ্ছ্বসিত ফেনিল জলরাশি দেখে নদেরচাঁদের মনে হয়েছিল নদী যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।নদীর প্রতিবাদী সভার অনুভব : ব্রিজ আর বাঁধকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে নদী যেন ফিরে পেতে চাইছে তার স্বাভাবিক গতি। নদী যেন যন্ত্রসভ্যতার বিরোধিতা করার মাধ্যমে পরোক্ষে প্রকৃতির লাঞ্ছনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মানুষের স্বার্থপরতা: এইরকম পরিস্থিতিতে নদেরচাঁদের মনে হয়েছে, আজ যদি নদী ব্রিজ, বাঁধ ভেঙে নিজের বন্দিদশা কাটিয়েও ওঠে, তবুও মানুষ তাকে রেহাই দেবে না। নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে আবারও নদীকে বন্দি করবে তারা। আবার মানুষ গড়ে তুলবে ব্রিজ, গড়ে তুলবে বাঁধ। প্রশস্ত নদীকে পরিণত করবে এক ক্ষীণস্রোতা নদীতে।
২. “জলপ্রবাহকে আজ তাহার জীবন্ত মনে হইতেছিল।”—কার জলপ্রবাহকে জীবন্ত মনে হল? জীবন্ত মনে হওয়ার কারণ কী ছিল তা বর্ণনা করো। 
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নদীর বিদ্রোহ’ ছোটোগল্পে নদেরচাদের নদীকে জীবন্ত বলে মনে হয়েছিল।
জীবন্ত মনে হওয়ার কারণ: নদীর প্রতি টান অনুভব: ইতিপূর্বে তার দেশের নদীটির সঙ্গে নদেরচাঁদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও সেই নদীটি ছিল ক্ষীণ, রুগ্ণ। স্টেশনমাস্টারি করতে এসে নদেরচাঁদ এক নতুন নদীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। সে নদী ছিল প্রশস্ত, বর্ষায় তার জলপ্রবাহ হয়ে উঠত উদ্দাম, উন্মত্ত। আর এক অদ্ভুত ভালোবাসার টানে নদেরচাঁদ প্রতিদিন ওই নদীকে দেখতে ছুটে যেত। ব্রিজের ধারে বসে সে নদীকে দেখত। নদীর উন্মত্ততা: এইরকমই এক বর্ষার দিনে নদীর উদ্দাম জলস্রোত ব্রিজের ধারকস্তম্ভে বাধা পেয়ে ফেনিল আবর্ত রচনা করছিল। নদীর সেই আবর্তে নদেরচাদ খেলার ছলে তার স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি ছুঁড়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল চিঠিটা পেয়েই নদী যেন সেটা তার নিজের স্রোতের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। নদেরচাঁদের মনে হল নদীও যেন তার সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছে। উন্মত্ত হয়ে উঠেছে নদীর জলপ্রবাহ। নদীর এই খেলায় যোগ দেওয়া এবং জলপ্রবাহের এমন উন্মত্ততা—এই সব কিছু দেখেই নদেরচাঁদের নদীকে জীবন্ত বলে মনে হয়েছিল।
৩. “আজ তার মনে হইল কী প্রয়োজন ছিল ব্রিজের?”নদেরচাদের কেন ব্রিজটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল ?
উত্তর – নদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব: নদেরচাঁদ ছেলেবেলা থেকেই নদীকে | ভালোবাসত। নদী তার জীবনের সঙ্গে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল। কর্মসূত্রে যে নদীটির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল সেই নদীটি ছিল প্রশস্ত, তার জলস্রোত ছিল উদ্দাম। এই নদীর সঙ্গে এক অদ্ভুত বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নদেরচাঁদের। প্রতিদিন নদেরচাঁদ এক অদ্ভুত টানে ছুটে যেত এই নদীর কাছে। নদীর ভয়ংকর রূপ: একবার বর্ষায় নদীকে পাঁচ দিন দেখতে না পেয়ে তার মন ছটফট করেছিল। ছেলেমানুষের মতো আবার নদীকে দেখার জন্য সে উতলা হয়ে উঠেছিল। পাঁচ দিন প্রবল বর্ষণের পর সে আবার নদীকে দেখার সুযোগ পেল নদীর কাছে গিয়ে সে দেখল নদী এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। নদীর উন্মত্ততা: নদেরচাঁদের মনে হল রোষে, ক্ষোভে নদী যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সে যেন ব্রিজটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলে দেবে। কারণ এই ব্রিজের জন্যই তার ওই স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ রয়েছে। বন্দিদশা থেকে মুক্তি: নদীটিকে দেখে তার মনে হল সে যেন বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে চাইছে। তাই নতুন রং করা যে ব্রিজের জন্য একসময় নদেরচাঁদ গর্ব ছিল সেই ব্রিজটাকেই এ সময়ে তার অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হল।
৪. “তারপর সে অতিকষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইল।”—সে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? তার মানসিক অবস্থাটি পাঠ্যাংশ অবলম্বনে আলোচনা করো। 
উত্তর – ‘সে’র পরিচয়: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের উল্লিখিত অংশে ‘সে’ বলতে নদেরচাঁদের কথা বলা হয়েছে।
মানসিক অবস্থার বর্ণনা: খেলাসুলভ আচরণ: পাঁচ দিন নদীকে না দেখতে পাওয়ার পরে নদেরচাঁদ যেদিন নদীর কাছে এল, নদীর উন্মত্ত চেহারা দেখে প্রথমে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিন্তু তারপরে নদীর উচ্ছ্বসিত জলস্রোতের সঙ্গে সে খেলায় মেতে ওঠে। এরই মধ্যে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি শুরু হলেও সে নদীর ধার থেকে ওঠে না। আচ্ছন্নতা: নদীর ভিতর থেকে আসা একটা অপরিচিত শব্দ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিলে তাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। সেই ‘ভীষণ মধুর’ শব্দ তার সর্বাঙ্গকে অবশ ও অবসন্ন করে দেয়। ক্রমে দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। বৃষ্টি কিছুক্ষণ থেমে আবার প্রবলবেগে শুরু হয়। দিশেহারা হয়ে ওঠা: ব্রিজের উপর দিয়ে চলে যাওয়া একটা ট্রেনের শব্দ নদেরচাঁদকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনে। হঠাৎ কোনো আঘাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো একটা মানসিক বেদনা কিছুক্ষণের জন্য নদেরচাঁদকে দিশেহারা করে তোলে। ভীত ও অবিশ্বাসী: অতিকষ্টে নদেরচাঁদ উঠে দাঁড়ায় এবং তার মনে ভয়ের জন্ম হয়। তার মনে হয় যে, ক্ষোভে উন্মত্ত এই জলরাশির এত কাছে তার এমনভাবে বসে থাকা উচিত হয়নি। যে নদী এমনভাবে খেপে যেতে পারে নদেরচাঁদ তাকে যেন আর বিশ্বাস করতে পারে না।
৫. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।”—নদী কখন বিদ্রোহ করেছিল? এই বিদ্রোহের কোন্ কারণ নদেরচাঁদের বোধগম্য হয়েছিল লেখো। 
উত্তর – নদীর বিদ্রোহের সময়: উন্মত্ত রূপ: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে পাঁচ দিনের অবিরাম বৃষ্টির পরে নদীকে দেখার উৎসাহে নদেরচাঁদ নদীর কাছে যায়। ব্রিজের কাছাকাছি এসে যে নদীকে সে দেখে, তাতে সে পরিপূর্ণতার বদলে উন্মত্ততা দেখতে পায়। চেনা নদীর এই মূর্তি তার ভয়ংকর লাগে। মুশলধারায় বৃষ্টি: ব্রিজের মাঝামাঝি ধারকস্তম্ভের শেষভাগে বসে অন্যদিনের মতোই নদেরচাঁদ নদীকে দেখে, তার সঙ্গে খেলা করতে থাকে। এইসময়ই মুশলধারে বৃষ্টি নামে। মনে হয়,তিন ঘণ্টার বিশ্রামে মেঘে যেন নতুন শক্তির সঞ্চার হয়েছে। নদেরচাঁদের মনের ছেলেবেলার আমোদ ক্রমশ মিলিয়ে গিয়ে তার সর্বাঙ্গ অবশ, অবসন্ন হয়ে ওঠে। চেহারার পরিবর্তন; ক্রমে দিনের আলো মিলিয়ে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। বৃষ্টি কিছুক্ষণ থেমে আবার প্রবলভাবে শুরু হয়। নদীর সেই ক্ষোভে উন্মত্ত চেহারা দেখে নদেরচাঁদ ভয় পেয়ে যায়। এই সময়ে নদীর ওই ভয়ংকর রূপকেই নদেরচাঁদের ‘বিদ্রোহ’ বলে মনে হয়।
নদীর বিদ্রোহের কারণ: মানুষের বাধা সৃষ্টি: নদেরচাঁদ নদীর এই বিদ্রোহের কারণ বোঝার চেষ্টা করে। তার মনে হয় মানুষ নদীকে বাঁধার যে চেষ্টা করেছে তার তৈরি করা ব্রিজের সাহায্যে। নদী সেটাকে ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। দু-পাশে মানুষের হাতে গড়া বাঁধকে চুরমার করে সে স্বাভাবিক গতিতে বয়ে যেতে চায়। স্বাভাবিক মুক্তগতি: নিজের স্বাভাবিক মুক্ত গতি ফিরে পাওয়ার জন্যই যেন নদীর এই বিদ্রোহ।

সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

১. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্প অবলম্বনে নদীর প্রতি নদেরচাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার পরিচয় দাও।
অথবা, ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের নদীর প্রতি যে ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব চিত্রিত হয়েছে তা আলোচনা করো।
উত্তর – জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে স্টেশনমাস্টার নদেরচাঁদের জন্ম থেকেই যেন নদী তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। তাই বর্ষায় পাঁচ দিন নদীকে দেখতে না পেলে তার মন ছটফট করত, ছেলেমানুষের মতো উৎসুক হয়ে উঠত সে নদীর দেখা পাওয়ার জন্য।
জীবনের অতিবাহক ও পরমাত্মীয়: নদীর ধারেই তার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন কেটেছে। স্টেশনমাস্টারের কাজ নিয়ে এসে তার পরিচয় হয় এক প্রশস্ত ও জলপূর্ণ এক নদীর সঙ্গে। নদীটিকে সে যেমন ভালোবেসেছিল তেমনই সে তার দেশের ক্ষীণস্রোতা নির্জীব নদীটিকেও নিজের পরমাত্মীয়ারূপে ভালো বেসেছিল। অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া নদীর জন্য ছেলেবেলায় সে এমনভাবে কেঁদেছিল যেন কঠিন রোগে তার কোনো পরমাত্মীয়া মৃত্যুমুখে পড়েছে।
খেলায় মেতে ওঠা: বর্ষার জলে তার কর্মস্থলের কাছে অবস্থিত পরিপুষ্ট নদীটির উচ্ছল আনন্দের ছোঁয়া নদেরচাঁদের মনেও লেগেছিল। সেই নদীর পঙ্কিল জলস্রোতের আবর্তে সে তার স্ত্রীকে লেখা চিঠি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছিল, তার মনে হয়েছিল নদী যেন সেই চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্রোতের গভীরে তা লুকিয়ে ফেলছে।
বন্দিদশা থেকে মুক্তি কামনা: বাঁধ আর ব্রিজের মধ্যে বন্দি থাকা নদীর মুক্তিলাভের কামনা করেছিল নদেরচাদ। নদীর বন্দিদশা নদেরচাঁদকেও নিদারুণ কষ্ট দিয়েছিল।
উপসংহার: এইভাবে নদী কখনও নদেরচাঁদের পরমাত্মীয়, কখনও বা বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নদীর কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় অজান্তেই চলন্ত ট্রেন পিষে দিয়েছিল নদেরচাঁদকে। নদেরচাঁদ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নদীর প্রতি তার ভালোবাসার দাম চুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
২. নদেরচাঁদ নদীকে ভালোবাসার প্রতিদান কীভাবে পেয়েছিল গল্পের প্রেক্ষিতে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তর – প্রাক্কথন: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নদীর বিদ্রোহ’ ছোটোগল্পের প্রধান চরিত্র নদেরচাদের জীবনে ছেলেবেলা থেকেই জড়িয়ে আছে নদী। নদীর প্রতি টান অনুভব: স্টেশনমাস্টার হিসেবে কর্মসূত্রে সে যেখানে এসেছে সেখানেও ব্রিজ, বাঁধ দিয়ে ঘেরা এক নদীর জন্য সে একইরকম টান অনুভব করেছে। ব্রিজের মাঝামাঝি ইট, সুরকি, সিমেন্টে গাঁথা ধারকস্তম্ভের শেষপ্রান্তে বসে প্রতিদিন সে নদীকে দেখেছে। নদীর বিদ্রোহ অনুভব: বর্ষার কারণে ওই নদীকে পাঁচ দিন দেখতে না পেয়ে সে ছেলেমানুষের মতো ছটফট করেছে। নদীর মুক্তি কামনা: বাঁধে ঘেরা নদীর জলোচ্ছ্বাস দেখে তার মনে হয়েছে নদী যেন বিদ্রোহ করছে। নদীর যন্ত্রণা সে-ও যেন মন থেকে অনুভব করেছে। তাই সে নদীর মুক্তি কামনা করেছে। যে রং করা ব্রিজের জন্য সে একদিন গর্ব অনুভব করেছে পরে নদীর বন্দিদশার কারণে সেই ব্রিজকেই তার অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। নদীকে ভালোবাসার প্রতিদান: এসব ভাবতে ভাবতে নদেরচাঁদ যখন রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেছে, তখনই একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন তাকে পিষে দিয়ে চলে গেছে। যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে গিয়ে নদীরই পক্ষ নিয়েছিল নদেরচাঁদ। তাই গল্পের শেষে নদীকে ভালোবাসার ফলস্বরূপ তার জীবনে নেমে এসেছে করুণ পরিণতি। নদীকে ভালোবাসার প্রতিদান সে এইভাবেই পেয়েছে।
৩. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লেখক পাঠকের উদ্দেশে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর – নদীপ্রীতি: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে জন্মভূমির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিকে দিয়েই নদেরচাঁদের নদীপ্রীতির সূচনা। আর যেমন গাছের কথা ভাবতে ভাবতে নিজেই মনেপ্রাণে একটা গাছ হয়ে উঠেছিল, এই গল্পে নদেরচাঁদও নদীর কথা ভাবতে ভাবতে যেন নিজে নদী হয়ে গেছিল। নদী নিয়ে ভাবনা: নদীর শুষ্কতা, জলোচ্ছ্বাস যেন নদেরচাদেরই জীবনের জোয়ারভাটা। তার কাছে নদীকে বাঁধ দেওয়ার অর্থ জীবনের গতি রুদ্ধ করা। নদীর ওপর নির্মিত সেতু দেখতে সুন্দর; কিন্তু তাতে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। নদেরচাদের কাছে নদীর ব্রিজ বা সেতু আগ্রাসী মানুষের ঔদ্ধত্যের প্রতীক। বর্ষায় নদীর জলোচ্ছ্বাস যেন সেই যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধেই নদীর বিদ্রোহের প্রকাশ। নদেরচাঁদ সেটাই অনুভব করে। ফলস্বরূপ নদীর ওপরের ব্রিজটির তখন নদেরচাঁদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। যন্ত্রসভ্যতার প্রতিশোধ: গল্পের উপসংহারে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই নদেরচাঁদ রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যায়। নদেরচাঁদের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে যন্ত্রসভ্যতা যেন প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসা এবং পক্ষপাতের মধুর প্রতিশোধ নেয়।
৪. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদীর সঙ্গে নদেরচাঁদের যে সম্পর্ক প্রকাশিত হয়েছে, তার রূপটি বর্ণনা করো।
উত্তর – কথামুখ: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদীর সঙ্গে নদেরচাদের সম্পর্কের রূপটি গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। সমর্পিত ভালোবাসা: নদেরচাঁদ তার স্ত্রীকে একটি বেদনাপূর্ণ চিঠি লিখেছিল, এ কথা যেমন সত্যি, তেমনভাবেই আরও বড়ো সত্যি হল, শুধু নদীর সঙ্গে খেলার তুচ্ছ ছেলেমানুষি নেশায় পড়ে সে সেই চিঠিটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়েও দিয়েছিল। এভাবে স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসাকে সে যেন নদীর ভালোবাসার মধ্যে সমর্পণ করেছিল। হৃদয়-যন্ত্রণার প্রকাশ: প্রিয় নদীটিকে একবার চোখের দেখা না দেখলে সে শান্তি পেত না। নদীর কুলুকুলু শব্দ আর বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ সংগীতের ঐকতান হয়ে নদেরচাঁদের দেহমনকে অবসন্ন করে, বিভোর করে তুলত। নদীর ওপরে ব্রিজ তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে রাখার প্রতিবাদে নদেরচাদের হৃদয়ও যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে চায়। ভালোবাসার প্রতিশোধ: কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, তাকেও মরতে হয় যন্ত্রসভ্যতার কাছেই। চলন্ত রেলগাড়ি যন্ত্রদানবের মতোই মুহূর্তে নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে চলে যায়—প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসার চরম প্রতিশোধ যেন নেয় যন্ত্রসভ্যতা।
৫. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের নদেরচাঁদ চরিত্রটি আলোচনা করো।
উত্তর – কথামুখ: নদীর বিদ্রোহ গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নদেরচাঁদ। তাকে অবলম্বন করেই কাহিনির বিকাশ। সেখান থেকে নদেরচাঁদের বৈশিষ্ট্য ও নিজস্বতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পরিচয়: নদেরচাঁদের বয়স তিরিশ বছর এবং সে স্টেশন মাস্টারের পদে চাকরি করে। দিনরাত মেল, প্যাসেঞ্জার আর মালগাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তার।
প্রকৃতি প্রেমিক: পেশাগত দায়িত্বের বাইরে নদেরচাঁদ আদ্যন্ত নদীপ্রেমিক। নদীর প্রতি তার এই ভালোবাসার সূচনা শৈশব-কৈশোরে দেশের ক্ষীণস্রোতা নদীটিকে কেন্দ্র করে। আর পরবর্তীতে তার বিকাশ কার্যক্ষেত্রের বড়ো নদীটিকে নিয়ে।
রোমান্টিকতা: নদীর প্রতি নদেরচাদের ভালোবাসা প্রায় অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, এবং তার প্রকাশ দেখা যায় নদেরচাঁদের ছোটোবেলা থেকেই। দেশের নদী শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে নদেরচাঁদ প্রায় কেঁদে ফেলেছিল “দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভূগিতে ভুগিতে পরমাত্মীয়া মরিয়া যাওয়ার উপক্রম করিলে মানুষ যেমন কাঁদে।” পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে থাকাকালীন প্রবল বৃষ্টির কারণে পাঁচদিন নদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে সে পাগলের মতো হয়ে যায়। বৃষ্টি থামলেই সে নদীর কাছে যায়। এমনকি স্ত্রী-কে লেখা চিঠির পৃষ্ঠা জলে ভাসিয়ে সে নদীর সঙ্গে খেলা করে।
নিজস্বতা: নদীকে নিয়ে নদেরচাদের ভাবনা একেবারেই তার নিজস্ব। বর্ষায় উন্মত্ত নদীকে দেখে তার মনে হয় মানুষের তৈরি বাঁধকে চূর্ণ করে সে নিজের বয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে চায়। মানুষের সঙ্গে সভ্যতার এই লড়াই-এ নদীর জয়লাভ নিয়ে চিন্তিত হয় নদেরটাদ। ব্রিজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জাগে।
ভাবুক: নদীর কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেনের চাকায় পিষে যায় নদেরচাঁদ। প্রকৃতির পক্ষ নেওয়ায় যন্ত্রসভ্যতা যেন তার প্রতিশোধ নেয়। যেন বুঝিয়ে দেয় যে, নদেরচাঁদের মত মানুষরা এই সভ্যতায় টিকে থাকতে পারে না।
৬. ছোটোগল্প হিসেবে ‘নদীর বিদ্রোহ’ কতদূর সার্থক বিচার করো।
উত্তর – ছোটোগল্পের মূলকথা: ছোটোগল্পে লুকিয়ে থাকে বৃহত্তর জীবনের ব্যঞ্জনা।‘ছোটো প্ৰাণ, ছোটো ব্যথা/ছোটো ছোটো দুঃখকথা’ হলেও ছোটোগল্প ছোটো পরিসরে সমগ্র জীবনের ঘটনাকে তুলে ধরে। এর গতি হয় সোজা ও একমুখী। গল্পের শেষে মনে হয়—“শেষ হয়েও হইল না শেষ।” এই সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্যের আলোয় ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটি বিচার করা যেতে পারে। ছোটোগল্প হিসেবে ‘নদীর বিদ্রোহ’-এর সার্থকতা: নদেরচাদের নদীপ্রীতিই গল্পের মূল বিষয়। আর গল্পের ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে নদীর বিদ্রোহ। নদীকে মানুষ বাঁধ দিয়ে বন্দি করে। নদীর ওপর তৈরি করে কংক্রিটের ব্রিজ। যন্ত্রসভ্যতার তার প্রবল পেষণে পিষ্ট করে, রুদ্ধ করে, নদীর স্বাভাবিক গতিকে। নদেরচাদ মনে করেছে, এটাই নদীর শিকল। বর্ষায় নদী প্রাণ ফিরে পায়। তাই নদীর প্রবল স্রোতই তার বিদ্রোহের প্রকাশ। তার জলের ঘূর্ণিপাকই তার বন্দিদশার যন্ত্রণার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। নদেরচাদের মনে হয়েছে, পরিপূর্ণ নদী প্রাণশক্তির প্রতীক। মনে করলে নদী এই সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে, ভেঙে ফেলতে পারে কংক্রিটের ব্রিজ। নদীর দুরন্ত প্রবাহের মধ্যে নদেরচাদ নদীর বন্দিদশা থেকে মুক্তির চেষ্টা দেখতে পেয়েছে। একটিই মাত্র চরিত্রের ভাব ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে পুরো গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। গল্পের শেষে নদেরচাঁদ চরিত্রটির করুণ পরিণতি পাঠককে অতৃপ্তির বেদনায় অভিভূত করে। এভাবেই ছোটোগল্প হিসেবে ‘নদীর বিদ্রোহ’ স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *