wb 10th Bengali

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 4 আফ্রিকা

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 4 আফ্রিকা

West Bengal Board 10th Class Bengali Solutions Chapter 4 আফ্রিকা

West Bengal Board 10th Bengali Solutions

কবি পরিচিতি

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অভিনেতা, গীতিকার, চিত্রশিল্পী ও প্রাবন্ধিক। তাঁর সৃষ্টি শুধু ভারতীয় সাহিত্যকেই নয়, বিশ্বসাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে।
জন্ম: ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। ঠাকুর পরিবারের শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতচর্চার আবহাওয়ার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বড়ো হয়ে উঠেছিলেন।
ছাত্রজীবন: ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’-তে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে বালক রবীন্দ্রনাথের মন বসত না। সেজন্য বারবার বিদ্যালয় পরিবর্তন করেও বিদ্যালয়ের পড়া তিনি শেষ করে উঠতে পারেননি। বাড়িতে যোগ্য গৃহশিক্ষকদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর আঠারো বছর বয়সে তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে যশোরের মেয়ে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিতার নির্দেশে জমিদারি দেখাশোনার জন্য পদ্মার তীরে সাজাদপুর, শিলাইদহে তিনি কিছুকাল বসবাস করেন। সেকারণে রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের সাহিত্যসৃষ্টিতে এ অঞ্চলের গভীর প্রভাব রয়েছে।
কর্মজীবন: সাহিত্যকর্ম ছাড়াও তিনি নানারকম কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্ণচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ। রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্য বা শিল্পের চর্চাই করেননি, প্রয়োজনে দেশ ও জাতির স্বার্থে, মানবতাবিরোধী যে-কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদও করেছেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।
সাহিত্যজীবন: অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করেন। ছেলেবেলায় তাঁকে এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতাটি প্রথম রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত কবিতা, যা ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে অমৃতবাজার পত্রিকায় বের হয়। প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থ কবিকাহিনী, এরপর প্রভাতসংগীত ও সন্ধ্যাসংগীত। তাঁর লেখা প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলি হল মানসী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতালি, বলাকা, মহুয়া, পুনশ্চ, নবজাতক, জন্মদিনে শেষ লেখা ইত্যাদি। তাঁর লেখা উপন্যাস বাংলা উপন্যাসের দিকবদল ঘটায়। চোখের বালি, গোরা, চতুরঙ্গ, যোগাযোগ তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলা ছোটোগল্প রচনার পথিকৃৎও তিনি। তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত ছোটোগল্প হল ‘পোস্টমাল্টার’, ‘নষ্টনীড়’, ‘দেনাপাওনা’, ‘অতিথি’, ‘ছুটি’, ‘নিশীথে’ ইত্যাদি। চিন্তাশীল প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ অনন্য। চরিত্রপূজা, সাহিত্য, সাহিত্যের পথে, স্বদেশ, সমাজ, কালান্তর তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ।
পুরস্কার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে।
জীবনাবসান: ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।

উৎস

‘আফ্রিকা’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকার, ১৩৪৩-এর চৈত্র সংখ্যায়। পরে এটি পত্রপুট এর দ্বিতীয় সংস্করণে ১৬ সংখ্যক কবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং পরে সঞ্চয়িতায় স্থান পায়।

সারসংক্ষেপ

রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা আদিম আফ্রিকার ছায়াঘন সুন্দর রূপ বর্ণনার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত চিত্রই এঁকেছেন কবি। সৃষ্টির শুরুতেই ভয়ংকর প্রকৃতি আফ্রিকা মহাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে তার আত্মপ্রকাশকে সম্ভব করে তুলেছিল। তৈরি হয়েছিল আদিম অরণ্যে ঢাকা এক নতুন মহাদেশ, যেখানে ভয়ংকরতা আর রহস্যময়তাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাকি পৃথিবীর কাছে যেন দুর্বোধ্য ছিল সেই নতুন ভূমিখণ্ড। ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে নিজের অস্তিত্বকে যেন টিকিয়ে রাখতে চাইছিল সে। অন্যদিকে সভ্য পৃথিবীও উপেক্ষার চোখে দেখেছিল রহস্যময় সেই মহাদেশকে, গুরুত্ব পায়নি তার জীবনধারা, সংস্কৃতি। পরবর্তীকালে আফ্রিকাকে দেখা হল ক্রীতদাস সংগ্রহের বাণিজ্যিক জায়গা হিসেবে। আফ্রিকার গভীর অরণ্যের অন্ধকারের থেকেও সভ্যতার অহংকারে অনেক বেশি অন্ধ মানুষদের আগমন ঘটল আফ্রিকায়। ক্রমশ সভ্য দুনিয়ার মানুষ আফ্রিকার সম্পদের কথা জানতে পারল। উপনিবেশ তৈরি হল সেখানে। আফ্রিকা হয়ে উঠল ইউরোপের উন্নত দেশগুলির চারণভূমি। তাদের বর্বর অমানবিক লুণ্ঠন, শোষণ, অত্যাচারে আফ্রিকার মাটি ভিজে গেল রক্তে আর চোখের জলে। সভ্য পৃথিবীর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের বিপরীতে এই রক্তাক্ততা আসলে সভ্যতার অমানবিক কুৎসিত রূপকেই ফুটিয়ে তুলল। এই নির্লজ্জ হিংস্রতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন কবি। তাঁর মনে হয়েছে শোষিত, অপমানিত আফ্রিকার কাছে যুগান্তের কবির ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ, মানবসভ্যতার শেষ কথাই হল ক্ষমা। আর ক্ষমাই সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী, যা যুগান্তের কবি’র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। কবিই হলেন সুন্দরের উপাসক। তাই কবির ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়েই শুভবুদ্ধির প্রকাশ ঘটবে; প্রতিষ্ঠা হবে মানবতার।

নামকরণ

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের নামকরণের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। নামের মধ্য দিয়ে বিষয়ের ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়। ‘আফ্রিকা’ তাঁর পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের স্মরণীয় এক কবিতা। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইটালির সাম্রাজ্যবাদী শাসক মুসোলিনি ইথিওপিয়া আক্রমণ করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রচিত হয়। কবিতার প্রথম অংশে আফ্রিকার উৎপত্তির ইতিহাসটি বর্ণিত হয়েছে। প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশে প্রকৃতির ভয়ংকর রূপকে আপন করে আফ্রিকা নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সমস্ত বাধাকে জয় করে আফ্রিকা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল। সভ্য মানুষের কাছে চিরকাল তার মানবরূপ অপরিচিত ছিল। তারপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের থাবা পড়ল স্বাধীন আফ্রিকার ওপর। ক্রীতদাসে পরিণত হল হাজার হাজার আফ্রিকাবাসী। লোহার হাতকড়ি পরিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হল অন্যদেশে ঔপনিবেশিক প্রভুদের দাস হিসেবে। সভ্যতার ‘নির্লজ্জ অমানুষতা’ প্রকাশিত হল নিষ্ঠুরভাবে। মানবতার এই চরম অপমানে শেষপর্যন্ত কবি অপমানিত আফ্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে যুগান্তের কবিকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। সমগ্র কবিতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির পটভূমিতে আফ্রিকার লাঞ্ছিত, রক্তাক্ত রূপটিই ফুটে উঠেছে। এই বিচারে কবিতাটির নামকরণ বিষয়কেন্দ্রিক হয়েও ব্যঞ্জনাধর্মী।

আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর

বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১. ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি যে কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে-
(ক) মানসী
(খ) পত্রপুট
(গ) প্রান্তিক
(ঘ) শিশু
২. আফ্রিকা’ কবিতাটি- 
(ক) প্রকৃতি বিষয়ক
(খ) সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী
(গ) ঈশ্বরচেতনা বিষয়ক
(ঘ) সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক
৩. রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কবিতা হল—
(ক) অপমানিত
(খ) ১৪০০ সাল
(গ) শতবর্ষ পরে
(ঘ) ওরা কাজ করে
৪. ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ‘আদিম যুগ’ ছিল-
(ক) অন্ধকার
(খ) উদ্ভ্রান্ত
(গ) সহজ
(ঘ) আন্তরিক
৫. আদিম যুগে স্রষ্টার কার প্রতি অসন্তোষ ছিল?
(ক) দয়াময় দেবতার প্রতি
(খ) কবির সংগীতের প্রতি
(গ) নিজের প্রতি
(ঘ) ধরিত্রীর প্রতি
৬. নিজের প্রতি অসন্তোষে স্রষ্টা কী করছিলেন?
(ক) অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন
(খ) মন্ত্র জাগাচ্ছিলেন চেতনাতীত মনে
(গ) বিদ্রূপ করছিলেন ভীষণকে
(ঘ) নতুন সৃষ্টিকে বারবার বিধ্বস্ত করছিলেন

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের প্রথম চরণের প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
উত্তর – বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রকাশকাল ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ।
২. পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি ছিল কি? 
উত্তর – পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে (প্রকাশ ২৫ বৈশাখ, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি ছিল না।
৩. পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
উত্তর – পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ শ্রাবণ প্রকাশিত হয়।
৪. পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে কটি কবিতা সংযোজিত হয়?
উত্তর – পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে দুটি কবিতা সংযোজিত হয়, যার একটি হল ‘আফ্রিকা’।
৫. পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি কত সংখ্যক কবিতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়?
উত্তর – পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি ষোলো সংখ্যক কবিতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
৬. ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি প্রথম কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়, চৈত্র, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে।
৭. রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটির ভিন্নতর পাঠ কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটির ভিন্নতর একটি পাঠ প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা পত্রিকায়, আশ্বিন, ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে।
৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর ‘আফ্রিকা’ কবিতার আর-একটি পাঠ কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর ‘আফ্রিকা’ কবিতার আর-একটি পাঠ বিশ্বভারতী পত্রিকা-র শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৫১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কার অনুরোধে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি লেখেন?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি লেখেন।
১০. ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি কোন্ সময়ের রচনা?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আফ্রিকা’ শীর্ষক কবিতাটি ২৮ মাঘ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ) এর রচনা।
১১. উনিশ শতকের শেষভাগে কোন্ কোন্ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এশিয়া ও আফ্রিকার বুকে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলতে ও সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল?
উত্তর – উনিশ শতকের শেষভাগে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বুকে নিজেদের সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
১২. সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কোন্ অজুহাতে এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের অনুপ্রবেশ ঘটায় ?
উত্তর – অসভ্য জাতিকে সভ্য করার অজুহাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের অনুপ্রবেশ ঘটায়। যার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন ও উপনিবেশ বিস্তার।
১৩. “উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে…”—‘আদিম যুগ’ বলতে কোন্ সময়পর্বের কথা বোঝানো হয়েছে?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ‘আদিম যুগ’ বলতে বিশ্বসৃষ্টির সূচনাপর্বের কথা বোঝানো হয়েছে।
১৪. “তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে…”—কে, কেন অধৈর্যে ঘনঘন মাথা নাড়িয়েছেন?
উত্তর – বিশ্বস্রষ্টা ঈশ্বর সৃষ্টিপর্বের শুরুর দিকে নিজের প্রতি অসন্তোষে তাঁর নতুন সৃষ্টিকে বারবার ধ্বংস করেছিলেন আর অধৈর্যে ঘনঘন মাথা নাড়িয়েছিলেন।
১৫. “ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা—” —কে আফ্রিকাকে কোথা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?
উত্তর – আলোচ্য অংশে বলা হয়েছে উত্তাল সমুদ্রের বাহু যেন ‘প্রাচী ধরিত্রী’ অর্থাৎ পৃথিবীর পূর্বদিকের দেশগুলির থেকে আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
১৬. আফ্রিকা মহাদেশ কোন্ কোন্ সাগর দিয়ে ঘেরা?
উত্তর – ‘আফ্রিকা মহাদেশ প্রধানত আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর এবং তাদের বিভিন্ন উপসাগর দিয়ে ঘেরা।
১৭. “কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।”—আলো ‘কৃপণ’ কেন?
উত্তর – আফ্রিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে রয়েছে চিরহরিৎ বৃক্ষের ঘন অরণ্যভূমি। সূর্যের আলো এই অরণ্যভূমিতে প্রায় ঢুকতেই পারে না। তাই সেখানে আলোকে ‘কৃপণ’ বলা হয়েছে।
১৮. “সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি /সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য”‘সেখানে’ বলতে কোন্ জায়গার কথা বোঝানো হয়েছে?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতার আলোচ্য অংশে ‘সেখানে’ বলতে আফ্রিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলের ঘন অরণ্যভূমির কথা বোঝানো হয়েছে।
১৯. “চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত” — কে চিনছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে নেওয়া আলোচ্য অংশে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ্য সংকেতকে চিনে নিচ্ছিল আফ্রিকা।
২০. জলস্থল-আকাশের সংকেতকে ‘দুর্বোধ’ বলা হয়েছে কেন?
উত্তর – সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষ প্রকৃতির কাছে নিতান্ত অসহায়। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল বোঝার শক্তি তার নেই বলে তা মানুষের কাছে ‘দুর্বোধ’।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর 

১. “নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত…”—কে নতুন সৃষ্টিকে বারবার বিধ্বস্ত করছিলেন? তাঁর এমন আচরণের কারণ কী? হলেন? 
উত্তর – ধ্বংসকারী: এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, অর্থাৎ ঈশ্বর নতুন সৃষ্টিকে বারবার ধ্বংস করছিলেন।
ধ্বংস করার কারণ: স্রষ্টা মনের মতো না হলে নিজেই নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করেন এবং আবার তা গড়ে তোলেন। ভাঙাগড়ার খেলার মধ্য দিয়ে তাঁর এই সৃষ্টিলীলা চলতে থাকে। ‘উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’ আফ্রিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও স্রষ্টা যেন সেই খেলায় মেতে উঠেছিলেন। যদিও মহীসঞ্চরণ (continental drift) তত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভূগাঠনিক প্লেটসমূহের কম্পনে মূল মহাদেশ থেকে আফ্রিকা-সহ বিভিন্ন মহাদেশের আলাদা হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত এখানে আছে।
২. “তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে”—‘তাঁর’ বলতে কার কথা বোঝানো হয়েছে? এই ‘ঘন-ঘন মাথা নাড়া’ কথাটির দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর – ‘তাঁর’ পরিচয়: উল্লিখিত অংশে ‘তাঁর’ বলতে ঈশ্বরের কথা বোঝানো হয়েছে।
তাৎপর্য: রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য বিশ্বসৃষ্টির ভৌগোলিক সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। আলফ্রেড ওয়েগনারের তত্ত্ব অনুযায়ী বহুকাল আগে সবকটি মহাদেশ একত্রে একটিই মহাদেশ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূগাঠনিক পাতগুলি নড়াচড়ার ফলে আলাদা হয়ে যায়। এই তত্ত্বের নাম মহীসঞ্চরণ (continental drift) তত্ত্ব। এভাবেই আফ্রিকান পাতেরও সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ কাব্যিক ভঙ্গিতে এই ভৌগোলিক সত্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
৩. “ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে,”—তোমাকে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? তাকে কে, কোথা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে? 
উত্তর – তুমি-র পরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতার উল্লিখিত অংশে ‘তোমাকে’ বলতে আফ্রিকা মহাদেশের কথা বোঝানো হয়েছে।
যে যেখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে: সভ্যতা সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে নতুন সৃষ্টিকে বারবার বিধ্বস্ত করছিলেন, সেই সময়ে রুদ্র সমুদ্রের বাহু প্রাচী ধরিত্রীর বুক অর্থাৎ পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ড থেকে আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
৪. “বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়”—কার কথা বলা হয়েছে? ‘বনস্পতির নিবিড় পাহারা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? 
উত্তর – যার কথা: প্রশ্নোধৃত অংশে আফ্রিকার কথা বলা হয়েছে।
তাৎপর্য: আফ্রিকা মহাদেশের এক বিস্তীর্ণ অংশ নিরক্ষীয় অঞ্চল হওয়ার জন্য সেখানে ঘন অরণ্য রয়েছে। সেই ঘন অরণ্য ভেদ করে সূর্যের আলোও সেখানে ঢুকতে পারে না। প্রকৃতি যেন নিবিড়, নিশ্ছিদ্র পাহারায় সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আফ্রিকাকে। এই ভৌগোলিক সত্যকেই রবীন্দ্রনাথ কাব্যিকভাবে তুলে ধরেছেন।
৫. “কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।”—কৃপণ আলো’ বলার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর – উৎস: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত। প্রসঙ্গ: আফ্রিকা ভূখণ্ডের উৎপত্তির ইতিহাসটি বর্ণনা করা হয়েছে। ভয়ংকর সমুদ্রের বাহু প্রাচীন পৃথিবীর বুক থেকে আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে আলাদা মহাদেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিল। তাৎপর্য: এমন এক ভৌগোলিক অবস্থানে আফ্রিকার জন্ম, যেখানে বেশিরভাগ জায়গাই অরণ্যে ঘেরা। সূর্যের আলো সেই ঘন অরণ্য ভেদ করে সেখানে পৌঁছোতে পারে না। এই কারণেই আফ্রিকাকে কবি ‘কৃপণ আলোর অন্তঃপুর’ বলেছেন।
৬. ‘ প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু/মন্ত্র জাগাচ্ছিল, তোমার চেতনাতীত মনে।”—‘তুমি’ কে? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – ‘তুমি’র পরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতার অন্তর্গত আলোচ্য অংশটিতে ‘তুমি’ বলতে আফ্রিকাকে বোঝানো হয়েছে।
ব্যাখ্যা: সৃষ্টির সূচনাপর্বে প্রকৃতির কোলে লালিত ছিল আফ্রিকা। বাইরের পৃথিবীর চোখের আড়ালে প্রকৃতি নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিল তাকে। একদিকে ঘন অরণ্য, অন্যদিকে সাহারা, কালাহারির মতো ভূমি যেন আফ্রিকাকে লালন করেছে। ভয়ংকর বন্যজন্তু আর দুর্গম প্রকৃতিই যেন প্রথমদিকে আফ্রিকাকে গড়ে তুলেছিল। নতুনভাবে গড়ে ওঠা এই মহাদেশ কবির ভাষায়, তখনও ছিল ‘চেতনাতীত’, অর্থাৎ তার নিজস্ব সংস্কৃতি বা জীবনধারা তখনও গড়ে ওঠেনি।
৭. “বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে।”—এখানে কার কথা বলা হয়েছে। কেন সে ভীষণকে বিদ্রূপ করছিল?
উত্তর – যার কথা: আলোচ্য উদ্ধৃতাংশে আদিম আফ্রিকার কথা বলা হয়েছে।
ভীষণকে বিদ্রূপ করার কারণ: এক দুর্গম রহস্যময় স্থানে আফ্রিকার জন্ম হয়েছিল। অরণ্যে ঘেরা এই আফ্রিকার চারপাশের প্রকৃতি ছিল আরও দুর্বোধ্য এবং সংকেতপূর্ণ। প্রকৃতির এই দুর্বোধ্য মায়াবী রহস্য আফ্রিকার চেতনাতীত মনে তার জীবনধারা গড়ে তোলার মন্ত্র জুগিয়ে ছিল। আর আফ্রিকা প্রতিকূলতার ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রকৃতির সেই ভয়ংকর রূপকে বিদ্রুপ করছিল। নিজের শঙ্কাকে হার মানাতেই ভীষণের বিরুদ্ধে সেও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল।
৮. “আপনাকে উগ্র ক’রে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়”—প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – উৎস: উদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে গৃহীত। প্রসঙ্গ: সৃষ্টির প্রথমপর্বে আফ্রিকা বাইরের পৃথিবীর কাছে নিজেকে পরিচিত করেছিল তার ভয়ংকর রূপের মধ্য দিয়ে। আফ্রিকার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাই একসময় তাকে বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিল। তার ঘন অরণ্য ভেদ করে ভেতরে ঢোকার অধিকার সূর্যরশ্মিরও ছিল না। প্রতিকূলতার ছদ্মবেশে আফ্রিকা যেন প্রকৃতির ভয়ংকর রূপকেই বিদ্রুপ করেছিল। নিজের ভয়কে সে জয় করেছিল বিভীষিকাকে আশ্রয় করে।

বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

১. ‘উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’ কৰি আফ্রিকাকে যেভাবে দেখেছিলেন লেখো। এই আফ্রিকার প্রতি উন্নত পৃথিবীর আফ্রিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? 
উত্তর – কবির চোখে ‘উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’র আফ্রিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটিতে কবি আফ্রিকার আদিম সময় থেকে তার নানান রূপের ছবি তুলে ধরেছেন। বিশ্বসৃষ্টির প্রথম পর্বে স্রষ্টা যখন ‘নিজের প্রতি অসন্তোষে’ তাঁর নতুন সৃষ্টিকে বারবার ধ্বংস করছিলেন সেই সময়—“রুদ্র সমুদ্রের বাহু/প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে” আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আলফ্রেড ওয়েগনার তাঁর পাতসংস্থান তত্ত্বের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের একটি ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তা-ই যেন রবীন্দ্রনাথের লেখায় রূপ পেয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকে আফ্রিকা ছিল আদিম অরণ্যে ঘেরা। ‘দুর্গমের রহস্য’ আর ‘দুর্বোধ সংকেত’ ছিল সেই আফ্রিকার গড়ে ওঠার বিশেষত্ব। সেই সময় প্রকৃতি তাকে দিয়েছিল জাদুমন্ত্র। কবির কথায়, বিভীষিকাই যেন হয়ে উঠেছিল এই আফ্রিকার মহিমা, যা দিয়ে সে আসলে নিজের যাবতীয় ভয়কে পরাজিত করতে চাইছিল।
আফ্রিকার প্রতি উন্নত পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি: সৃষ্টির সেই প্রথম যুগে আফ্রিকা ছিল বাকি পৃথিবীর কাছে উপেক্ষার পাত্র — “কালো ঘোমটার নীচে/অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ”। আফ্রিকার নিজস্ব যে সংস্কৃতি, সমাজভাবনা—এসবকে না বুঝে উন্নত বিশ্ব আফ্রিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ হিসেবে। উপেক্ষা আর অপমানই ছিল সমগ্র জগতের থেকে আফ্রিকার একমাত্র পাওনা।
২. “মন্ত্র জাগাচ্ছিল, তোমার চেতনাতীত মনে।” -কে, কার মনে ‘মন্ত্র’ জাগাচ্ছিল? এই ‘মন্ত্র’-র তাৎপর্য কী?
উত্তর – পরিচিতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় সৃষ্টির শুরুতে প্রকৃতি তার ‘দৃষ্টি-অতীত জাদু’ দিয়ে আফ্রিকার মনে ‘মন্ত্র’ জাগাচ্ছিল।
তাৎপর্য: সভ্যসমাজের জ্ঞানসীমার বাইরে প্রকৃতির যে নিজস্ব বিস্তার, প্রকৃতিই সেখানে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার পথ দেখায়। একেই কবি প্রকৃতির ‘দৃষ্টি-অতীত জাদু’ বলেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নৃতাত্ত্বিকদের একাংশের মতে আদিম যুগ থেকে বিবর্তনের পথে মানবজাতির যে গড়ে ওঠা, তা ঘটেছিল আফ্রিকাতেই। সেখান থেকেই মানুষ বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই অর্থে বললে, আফ্রিকা সভ্যতার জন্মভূমিও। প্রকৃতিই সেখানে বেঁচে থাকার মন্ত্র উচ্চারণ করেছে দুর্গম অরণ্যে কিংবা দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমিতে। সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতি যেন আফ্রিকার মানুষদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে নিজস্ব জীবনছন্দ, জনজাতির সংস্কৃতি। আফ্রিকার কাছে দুর্গমের রহস্যই তার সম্পদ। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আফ্রিকা যেন উচ্চারণ করেছে প্রতিরোধের মন্ত্র। ভয়ংকর আফ্রিকা চেয়েছিল নিজের ভয়কে জয় করতে, অস্তিত্ব রক্ষা করতে। আর এই কাজে প্রকৃতিই হয়েছে তার সহায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত দুর্গমতার কারণেই ইউরোপীয় দেশগুলি আফ্রিকায় উপনিবেশ তৈরি করতে পারেনি। প্রকৃতির সাহায্যেই দুর্গমকে আশ্রয় করে আফ্রিকা যেন নিজেকে রক্ষা করেছিল।

বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১. “হায় ছায়াবৃতা”—এখানে কাকে ‘ছায়াবৃতা’ বলা হয়েছে?
(ক) আফ্রিকাকে
(খ) এশিয়াকে
(গ) অরণ্যকে
(ঘ) সূর্যকে
২. “কালো ঘোমটার নীচে”—‘কালো ঘোমটা’ হল-
(ক) ছায়ানিবিড়তা
(খ) অন্ধকার
(গ) দুর্গমতা
(ঘ) রহস্যময়তা
৩. কালো ঘোমটার নীচে কী অপরিচিত ছিল?
(ক) আদিম রূপ
(খ) মানবরূপ
(গ) হিংস্ররূপ
(ঘ) অমানবিক রূপ
৪. উপেক্ষার দৃষ্টি কেমন হয়েছিল?
(ক) উৎসুক
(খ) আনমনা
(গ) আবিল
(ঘ) কৌতূহলী
৫. “উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।” —কার প্রতি উপেক্ষা?
(ক) প্রকৃতির
(খ) সমুদ্রের
(গ) জলস্থলের
(ঘ) আফ্রিকার
৬. “এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে”—ওরা হল-
(ক) ভারতীয়রা
(খ) আমেরিকানরা
(গ) জংলি উপজাতিরা
(ঘ) ইউরোপিয়ানরা
৭. ওরা কী নিয়ে এল?
(ক) রথ
(খ) বন্দুক
(গ) বারুদ
(ঘ) লোহার হাতকড়ি
৮. কাদের নখ তীক্ষ্ণ?
(ক) মানুষ-ধরার দলের
(খ) হিংস্র প্রকৃতির
(গ) কাঁটাওয়ালা চাবুকের
(ঘ) পশুর
৯. “নখ যাদের তীক্ষ্ণ…”—কার চেয়ে নখ তীক্ষ্ণ?
(ক) নেকড়ের
(খ) হায়নার
(গ) সিংহের
(ঘ) বাঘের
১০. “এল মানুষ ধরার দল।”—মানুষ ধরার দল’ বলা হয়েছে-
(ক) ছেলেধরাদের
(খ) ঔপনিবেশিক প্রভুদের
(গ) দস্যুদের
(ঘ) ধনী লোকদের
১১. “গর্বে যারা অন্ধ…”—কার চেয়ে বেশি অন্ধ?
(ক) অন্ধকারের
(খ) সূর্যহারা অরণ্যের
(গ) কুয়াশার
(ঘ) গুহার
১২. সভ্যের লোভ কেমন?
(ক) লকলকে
(খ) বর্বর
(গ) হিংস্র
(ঘ) নোংরা
১৩. কাদার পিণ্ডকে বীভৎস বলা হয়েছে, কারণ-
(ক) আফ্রিকার মাটি এঁটেল মাটি
(খ) আফ্রিকার মাটি মানুষের রক্ত আর অশ্রুতে ভেজা
(গ) আফ্রিকার মাটি লবণাক্ত জলে সিক্ত
(ঘ) কাদার গভীরতা বেশি
১৪. “নগ্ন করল…” নগ্নভাবে কী প্রকাশিত হল?
(ক) প্রলয়
(খ) ধ্বংস
(গ) নির্লজ্জ অমানুষতা
(ঘ) যুদ্ধ
১৫. আফ্রিকার ক্রন্দন কেমন?
(ক) ভাবহীন
(খ) রূপহীন
(গ) ভাষাহীন
(ঘ) বীভৎস
১৬. অরণ্যপথ ‘ভাষাহীন ক্রন্দনে’ কী হয়ে উঠল?
(ক) মুখর
(খ) ভয়ানক
(গ) বর্বর
(ঘ) বাষ্পাকুল
১৭. ধূলি কীভাবে পঙ্কিল হল?
(ক) ঘামে রক্তে মিশে
(খ) ঘামে অশ্রুতে মিশে
(গ) ঘামে বৃষ্টিতে মিশে
(ঘ) রক্তে অশ্রুতে মিশে
১৮. দস্যু-পায়ের জুতো কেমন?
(ক) পেরেক মারা
(খ) ছুঁচ-বেঁধানো
(গ) পিষে-দেওয়া
(ঘ) কাঁটা-মারা

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “কালো ঘোমটার নীচে/অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ…” এখানে ‘কালো ঘোমটা’ কী?
উত্তর – কালো ঘোমটা’ বলতে এখানে আদিম অরণ্যে ঘেরা আফ্রিকার যে ছায়া ও অন্ধকারের বিস্তার তার কথা বলা হয়েছে।
২. “অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ”—তার মানবরূপ কীভাবে অপরিচিত ছিল?
উত্তর – কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতায় মানবরূপ অপরিচিত ছিল  উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
৩. “…অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ/উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।”কার মানবরূপ, কাদের কাছে উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে অপরিচিত ছিল?
উত্তর – আলোচ্য অংশে আফ্রিকা মহাদেশের মানবরূপ যেন তার অরণ্যে ঢাকা ‘কালো ঘোমটার নীচে’ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে উপেক্ষার কলুষিত দৃষ্টিতে অপরিচিত ছিল।
৪. “এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে”—কাদের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতার আলোচ্য অংশে উন্নত ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তিগুলি, যারা আফ্রিকাকে আক্রমণ করেছিল, তাদের কথা বলা হয়েছে।
৫. “এল মানুষ-ধরার দল।”—এখানে ‘মানুষ ধরার দল’ বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর – উন্নত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো, যারা আফ্রিকাকে ক্রীতদাস সরবরাহের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল, এখানে তাদের কথা বলা হয়েছে।
৬. “এল মানুষ-ধরার দল”—এই ‘মানুষধরার দল’-এর বিশেষত্ব কী ছিল?
উত্তর – হিংস্রতায় এদের নখ ছিল আফ্রিকার অরণ্যচারী নেকড়ের থেকেও ধারালো।
৭. “হায় ছায়াবৃতা”—কাকে, কেন ‘ছায়াবৃতা’ বলা হয়েছে?
উত্তর – আদিম, ঘন অরণ্যে ঢাকা আফ্রিকায় সূর্যরশ্মি ঢুকতে না পারায় তাকে ‘ছায়াবৃতা’ বলা হয়েছে।
৮. ‘ছায়াবৃতা’ আফ্রিকার মুখ কোথায় লুকানো ছিল? 
উত্তর – ‘ছায়াবৃতা’ আফ্রিকার মুখ লুকানো ছিল কালো ঘোমটার নীচে অর্থাৎ আদিম অরণ্যের অন্ধকারে।
৯. “গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।”—তারা কী করল?
উত্তর – উন্নত সভ্যতার গর্বে অন্ধ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি লোহার হাতকড়ি দিয়ে আফ্রিকার মানুষদের কৌশলে বন্দি করল এবং ক্রীতদাস বানাল।
১০. “নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।”—কীভাবে নির্লজ্জ অমানুষতা প্রকাশ পেল?
উত্তর – সাম্রাজ্যবিস্তারের লক্ষ্যে মানুষ মানুষকে দীর্ঘকাল ধরে শিকল পরিয়েছে। তথাকথিত সভ্য মানুষের ক্ষমতার প্রতি এই বর্বর লোভের মধ্য দিয়েই তাদের নির্লজ্জ অমানুষতা প্রকাশ পেয়েছে।
১১. “পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে…”—কীভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল?
উত্তর – পৃথিবীর নানা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের উপনিবেশ গড়ার জন্যে স্বাধীন আফ্রিকার মানুষকে শৃঙ্খলিত করল এবং তাদের ওপর বর্বর, অমানুষিক অত্যাচার চালাল। এভাবেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হল।
১২, “চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।”—কারা চিরচিহ্ন দিয়ে গেল?
উত্তর – তথাকথিত ‘সভ্য’ এবং সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তিগুলি চিরচিহ্ন দিয়ে গেল।
১৩. “চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।”—ইতিহাস অপমানিত কেন? ·
উত্তর – পরাধীনতার গ্লানিতে, মানুষের অপমানে আফ্রিকার ইতিহাস অপমানিত। সেই অপমানের চিহ্নকে চিরস্থায়ী করে দিয়ে গেছে লোভী, হিংস্র বর্বর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “হায় ছায়াবৃতা”–কাকে ছায়াবৃতা বলা হয়েছে? কেন বলা হয়েছে?
উত্তর – ‘ছায়াবৃতা’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতার অন্তর্গত আলোচ্য অংশটিতে আফ্রিকাকে ‘ছায়াবৃতা’ বলা হয়েছে।
ছায়াবৃতা বলার কারণ: আফ্রিকা মহাদেশের এক বিস্তীর্ণ অংশ ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যে ঘেরা। সেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। প্রকৃতি যেন নিজের মতো করে তাকে অন্ধকার মহাদেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না বলেই আফ্রিকাকে ‘ছায়াবৃতা’ বলা হয়েছে। তার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে আফ্রিকার নিজস্ব জীবন ও সংস্কৃতি।
২. “অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ/উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে”—কার কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তর – যার কথা আলোচ্য অংশে আফ্রিকার কথা বলা হয়েছে।
তাৎপর্য: আদিম অরণ্য আর মরুভূমি পূর্ণ আফ্রিকা এক দীর্ঘ সময় পৃথিবীর সভ্য দেশগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। উন্নত পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে থেকেছে আফ্রিকার থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন ‘ছায়াবৃতা’, আর হেনরি স্ট্যানলির কাছে আফ্রিকা ছিল ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ (dark continent)। ইতিহাস প্রমাণ করে উনিশ শতকের আগে কোনো ইউরোপীয় শক্তি আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের কথা ভাবেনি। আফ্রিকার সম্পদ এবং সংস্কৃতি এভাবেই উপেক্ষিত হয়েছিল সভ্যসমাজের দ্বারা।
৩. “এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,/নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে…”—কাদের আসার কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটির দ্বারা কী বোঝাতে চাওয়া হয়েছে? 
উত্তর – যাদের কথা: উল্লিখিত অংশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের আফ্রিকায় আসার কথা বলা হয়েছে।
তাৎপর্য: সাধারণভাবে মনে হয়, আফ্রিকায় যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘটেছিল তার অত্যাচারী স্বরূপ তুলে ধরাই ছিল কবির লক্ষ্য। তবে এর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় ইতিহাসের ধারাকেও তুলে ধরেছেন। কবি এখানে পঞ্চম শতক থেকে প্রচলিত দাসব্যবস্থার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। ‘এল মানুষ-ধরার দল’—এতে দাসব্যবস্থা ও দাস-মালিকদের অত্যাচারী স্বরূপের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
8. “নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে”—যাদের’ বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের নখ নেকড়ের চেয়ে তীক্ষ্ণ বলার কারণ কী? 
উত্তর – যাদের কথা: উল্লিখিত অংশে আফ্রিকা আক্রমণকারী ইউরোপীয় শক্তিগুলির কথা বলা হয়েছে।
নখ নেকড়ের চেয়ে তীক্ষ্ম বলার কারণ: সৃষ্টির সূচনা পর্বে আফ্রিকা ছিল আদিম অরণ্যে ঢাকা এক মহাদেশ। উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি আফ্রিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আফ্রিকার মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের নজর পড়ল। আফ্রিকা হয়ে উঠল ক্রীতদাস জোগানের কেন্দ্র। অত্যাচার আর হিংস্রতায় রক্তাক্ত হল আফ্রিকা। সেই হিংস্রতার তীব্রতাই উল্লিখিত অংশে প্রকাশিত হয়েছে।
৫. ‘এল মানুষ ধরার দল”—কবি কাদের সম্পর্কে বলেছেন? তাদের ‘মানুষ ধরার দল’ বলা হয়েছে কেন?
উত্তর – যাদের সম্পর্কে; আফ্রিকা আক্রমণকারী ইউরোপীয় দেশগুলির সম্পর্কে উল্লিখিত মন্তব্যটি করা হয়েছে।
‘মানুষ ধরার দল’ বলার কারণ: আফ্রিকা সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি অরণ্যের আদিম অন্ধকারে ঢাকা আফ্রিকা সম্পর্কে উদাসীন ছিল। তারা উপেক্ষা করত এই নবগঠিত মহাদেশকে। কিন্তু ক্রমশই আফ্রিকার প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদে তাদের নজর পড়ল। প্রথমেই তারা আফ্রিকাকে চিহ্নিত করল ক্রীতদাস সংগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে। ‘লোহার হাতকড়ি’ নিয়ে তারা এসেছিল আফ্রিকাবাসীদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই তাদের ‘মানুষ ধরার দল’ বলা হয়েছে।
৬. “গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।”—কারা গর্বে অন্ধ? অরণ্য সূর্যহারা কেন? 
উত্তর – গর্বান্ধ শক্তি: সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিদের কথাই এখানে বলা হয়েছে। তারা সভ্যতার গর্বে এবং ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ।
অরণ্য সূর্যহারা হওয়ার কারণ: আদিম আফ্রিকার ভৌগোলিক অবস্থান ছিল দুর্গম, রহস্যময়। চারিদিকে ঘন বনস্পতি যেন আফ্রিকাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এতই ঘন অরণ্যভরা স্থানে আফ্রিকার অবস্থান ছিল যে, সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছোতে পারত না। চিরছায়ায় ঢাকা আফ্রিকা যেন কালো ঘোমটার নীচে তার মানবরূপকে ঢেকে রেখেছিল। এইজন্যই অরণ্যকে সূর্যহারা বলা হয়েছে।
৭. “সভ্যের বর্বর লোভ/নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা। এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। 
উত্তর – যাদের কথা: উল্লিখিত অংশে সভ্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তিগুলোর কথা বলা হয়েছে।
মন্তব্যটির বিশ্লেষণ: অরণ্য আর আদিমতার অন্ধকারে থাকা আফ্রিকায় উনিশ শতক থেকে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপন শুরু হয়। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, জার্মানি, ইটালি—ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশই আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। উনিশ শতকের শেষে প্রায় গোটা আফ্রিকা ইউরোপের উপনিবেশে পরিণত হয়। আফ্রিকাকে লুণ্ঠন করে সেখানকার আদিম জনজাতিদের শোষণের যে ইতিহাস রচিত হয়, এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
৮. “পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে।”—সম্প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখো।
উত্তর – উৎস: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতিটি গৃহীত। প্রসঙ্গ: আফ্রিকার জনগণের ওপর ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে কবি আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন। ব্যাখ্যা: সৃষ্টির শুরু থেকেই আফ্রিকা ছিল উপেক্ষিত। কিন্তু ধীরে ধীরে দুর্গম প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে অবস্থিত আফ্রিকার মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে উদ্যোগী হয় ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়। শোষণ, অত্যাচার আর অবহেলা হয়ে ওঠে আফ্রিকাবাসীদের ভাগ্যলিপি। কবি মনে করেছেন, অত্যাচারিত আফ্রিকাবাসীর রক্ত আর চোখের জলেই সেখানকার মাটি পঙ্কিল হয়ে উঠেছে।
৯. “চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।”—কার ইতিহাসকে অপমানিত বলা হয়েছে? কোন্ ঘটনাকে কবি ‘চিরচিহ্ন’ বলেছেন’? 
উত্তর – উদ্দিষ্ট: আদিম আফ্রিকার ইতিহাসকে অপমানিত বলা হয়েছে।
‘চিরচিহ্ন’-এর ঘটনা: সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিরা আফ্রিকার মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। ক্ষমতালোভী সেই সাম্রাজ্যবাদীর দল নির্মম অত্যাচার চালাত আফ্রিকার আদিম মানুষদের ওপর। সেইসব তথাকথিত সভ্য মানুষদের বর্বরতা আর অমানুষিক অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হল আফ্রিকার মানুষ। তাদের রক্ত আর চোখের জলে কর্দমাক্ত হল আফ্রিকার মাটি। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের কাঁটা-মারা জুতোর নীচে সেই বীভৎস কাদার পিণ্ড চিরচিহ্নরূপে কালোছাপ ফেলে রাখল আফ্রিকার | অপমানিত ইতিহাসে।

বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

১. “হায় ছায়াবৃতা”— ‘ছায়াবৃতা’ বলার কারণ কী? তার সম্পর্কে কবি কী বলেছেন সংক্ষেপে লেখো। 
উত্তর – ‘ছায়াবৃতা’ বলার কারণ: নিবিড় অরণ্যঘেরা পরিবেশে আফ্রিকার অবস্থান, সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছোতে পারে না। তাই আফ্রিকাকে ‘ছায়াবৃতা’ বলা হয়েছে।
কবির বক্তব্য: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশটিতে কবি যেন আফ্রিকার জন্মলগ্নের ইতিহাসটি তুলে ধরেছেন। ঘন অরণ্যঘেরা ভূখণ্ডে আফ্রিকার জন্ম। তাই কবি বলেছেন ‘বনস্পতির নিবিড় পাহারা’ কথাটি। অরণ্য এত ঘন যে, সূর্যের আলোও সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। তাই ‘কৃপণ আলোর অন্তঃপুর’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
আফ্রিকার জন্মলগ্নে ভৌগোলিক পরিবেশ ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নিজের খেয়ালে ভাঙাগড়ার কাজ করেন। তাঁর সন্তোষের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টির স্থায়িত্ব। না হলে তিনি অধৈর্য হয়ে নতুন সৃষ্টিকে ধ্বংস করে আবার গড়তে থাকেন। বিধাতার এই ঘনঘন মাথা নাড়ার দিনে ভয়ংকর সমুদ্রের বাহু প্রাচী পৃথিবীর বুক থেকে আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এভাবেই নতুন ভূখণ্ড হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশের জন্ম হয়। ভৌগোলিক দিক থেকে আফ্রিকার অবস্থান নিরক্ষীয় অঞ্চলে। এই কারণে অঞ্চলটি ঘন অরণ্যে ঘেরা। সূর্যের আলো এখানে পৌঁছোতে পারে না। প্রকৃতি যেন বাধার প্রাচীর গড়ে তুলে আফ্রিকাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে। এই প্রসঙ্গেই কবি আলোচ্য উদ্ধৃতিটি করেছেন।
২. ‘এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে”—ওরা কারা? ওদের নগ্নরূপের পরিচয় দাও।
অথবা, ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে”—’ওরা’ বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে? ওরা এসে কোন পরিস্থিতিতে কীরূপ আচরণ করে কবিতা অনুসরণে লেখো। 
উত্তর – ওদের পরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আফ্রিকা’ কবিতার প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে আফ্রিকার বুকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আসার কথা বলা হয়েছে।
নগ্নরূপের পরিচয়: সভ্যতার শুরুতে আফ্রিকা ছিল আদিম অরণ্যে ঘেরা দুর্গম এক ভূখণ্ড। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘকাল জুড়ে আফ্রিকার প্রতি উদাসীন ছিল সভ্য দুনিয়া। তাই কবি বলেছেন—“কালো ঘোমটার নীচে/অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ/উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।” কিন্তু যখন এই আফ্রিকার দিকে উন্নত বিশ্বের চোখ পড়ল তখন এই মহাদেশ তাদের অত্যাচারের শিকার হল। নেকড়ের থেকেও ধারালো তাদের নখ। এই ইউরোপীয় শক্তিরা আফ্রিকাকে ব্যবহার করল ক্রীতদাস সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে। ‘লোহার হাতকড়ি’ নিয়ে তাদের আগমন ঘটল, আফ্রিকার মানুষদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তথাকথিত সভ্য জাতির বর্বর লোভ এভাবে নিজেদের অমানবিক রূপটিকেই প্রকাশ করল। অসহায় আফ্রিকার ধূলি কান্নায়, রক্তে এবং চোখের জলে মিশে কাদায় পরিণত হল। দস্যুবৃত্তির নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত রেখে গেল সভ্য দুনিয়া। তাদের অত্যাচার যেন ‘চিরচিহ্ন’ দিয়ে গেল অপমানিত আফ্রিকার ইতিহাসে। শুধু মানবসম্পদ নয়, প্রাকৃতিক সম্পদও সভ্য ইউরোপীয় শক্তিগুলির লোভের লক্ষ্য হল। উদ্ধত এইসব দেশের অত্যাচার আর অমানবিকতায় এভাবেই বারেবারে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে আফ্রিকাকে।
৩. “গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।”—গর্বে কারা অন্ধ? উদ্ধৃত অংশটির মধ্য দিয়ে কবির অভিপ্রেত অর্থটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর – গর্বান্ধ শক্তি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় যে তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয় দেশগুলি আফ্রিকাকে লুঠের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছিল তারাই গর্বে অন্ধ।
কবির অভিপ্রেত অর্থ: আদিম অরণ্যে ঢাকা আফ্রিকা একদা শুধু দুর্গমই ছিল না, সে নিজের চারপাশে তৈরি করে নিয়েছিল এক রহস্যময়তা। অন্যদিকে উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি দীর্ঘসময় ধরে আফ্রিকাকে উপেক্ষা করে গিয়েছিল—“কালো ঘোমটার নীচে / অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ / উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।” কিন্তু ধীরে ধীরে আফ্রিকার প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদে আকৃষ্ট হল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো। ফলে আক্রান্ত হল আফ্রিকা। প্রথমে তাদের আগমন ঘটল ক্রীতদাস সংগ্রহের জন্য। ‘লোহার হাতকড়ি’ নিয়ে আসা সেই ইউরোপীয় শক্তিগুলি হিংস্রতার দিক থেকে নেকড়েকেও হার মানিয়ে দেয়—“নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে।” এই তথাকথিত সভ্যজাতিগুলির আচরণে যে ‘বর্বর লোভ’-এর প্রকাশ ঘটল তা নির্লজ্জ অমানবিকতাকেই স্পষ্ট করল। রক্ত আর চোখের জলে ভিজে যাওয়া আফ্রিকার মাটি হয়ে উঠল মানবতা আর ইতিহাসের অপমানের অবাধ ক্ষেত্র। আফ্রিকার অরণ্য তার গভীরতায় এবং দুর্গম চরিত্রের জন্য বাকি পৃথিবীর সমীহ আদায় করেছে চিরকাল। কিন্তু সেই গর্বকে অনায়াসে হারিয়ে দিয়েছে তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয় দেশগুলির ঔদ্ধত্য আর অহংকার। উল্লিখিত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এই অত্যাচারী এবং অহংকারী স্বভাববৈশিষ্ট্যকে কবি স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।
8. “সভ্যের বর্বর লোভ/নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।” -‘সভ্যের বর্বর লোভ’ বলতে কীসের কথা বলা হয়েছে? কীভাবে তা ‘নির্লজ্জ অমানুষতা’-কে প্রকাশ করেছিল? 
উত্তর – সভ্যের বর্বর লোভ’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আফ্রিকা’ কবিতায় আফ্রিকার ওপরে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার কাহিনিকে তুলে ধরেছেন। প্রাকৃতিকভাবে দুর্গম আফ্রিকা দীর্ঘসময়জুড়ে ইউরোপীয় শক্তিগুলির নজরের বাইরে ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের শেষে প্রায় পুরো আফ্রিকা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশে পরিণত হয়। প্রথম পর্যায়ে আফ্রিকাকে ব্যবহার করা হয় ক্রীতদাস সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে। তারপরে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদে নজর পড়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির। মনে রাখতে হবে, গোটা পৃথিবীর খনিজ পদার্থের ৩০ শতাংশই আফ্রিকায় উৎপাদিত হয়। সোনা ও প্ল্যাটিনামে আফ্রিকা সমৃদ্ধ হয়ে আছে। তাই প্রায় প্রতিটি শক্তিশালী ইউরোপীয় দেশই সেখানে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। আফ্রিকাকে নির্লজ্জভাবে শোষণ করাই শুধু নয়, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার কাহিনিও রচিত হয়।
‘নির্লজ্জ অমানুষতা’-র প্রকাশ: ইউরোপীয় শক্তিগুলি শুধু আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করেই থেমে থাকেনি, মানবিকতার লাঞ্ছনাও ঘটিয়েছিল। ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রচনার অনুরোধ যিনি কবিকে করেছিলেন, সেই কবি অমিয় চক্রবর্তী লিখেছেন—“বিষম অত্যাচার করেছে বর্বর সাম্রাজ্যলোভী, অর্থলুত্থ য়ুরোপীয় দল…. অধিকাংশ আফ্রিকানদের হাড় য়ুরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়ানো, প্রায় কেউই বাড়ি ফেরেনি।” মুসোলিনির ইটালি আফ্রিকার আবিসিনিয়া আক্রমণ করে দেশকে নিঃস্ব আর রক্তাক্ত করে দেয়। আফ্রিকা হয়ে ওঠে উন্নত সভ্যতার ‘নির্লজ্জ অমানুষতা’র লীলাক্ষেত্র।
৫. “চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।”—কাকে এ কথা বলা হয়েছে? কীভাবে তার অপমানিত ইতিহাসে চিরচিহ্ন মুদ্রিত হল?
উত্তর – যার উদ্দেশ্যে এ কথা বলা: ‘আফ্রিকা’ কবিতায় সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিগুলি আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে ‘চিরচিহ্ন’ দিয়ে গিয়েছিল।
অপমানিত ইতিহাসে চিরচিহ্ন মুদ্রণ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আফ্রিকা কবিতায় আফ্রিকার ওপর সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার কাহিনিকে বর্ণনা করেছেন। প্রাকৃতিকভাবে দুর্গম আফ্রিকা দীর্ঘসময় ইউরোপীয় শক্তিগুলির নজরের বাইরে ছিল। কিন্তু উনিশ শতকে ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। এই শতকের শেষে প্রায় পুরো আফ্রিকা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশে পরিণত হয়। এইসব তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রশক্তি আফ্রিকার মানুষদের ওপরে নির্মম অত্যাচার চালাত। সেখানকার মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। তৈরি হয় মানবিকতার লাঞ্ছনার কাহিনি। আফ্রিকার মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে সরবরাহ করা হতে থাকে। আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদও হয়ে ওঠে আকর্ষণের কেন্দ্র। তাদের নির্লজ্জ লোভ যেন বর্বরতার রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল আফ্রিকার মানুষ। তাদের রক্ত আর চোখের জলে কর্দমাক্ত হয়েছিল আফ্রিকার মাটি। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনায়কদের কাঁটা-মারা জুতোর নীচে বীভৎস কাদার পিণ্ড যেন চিরকালের মতো অত্যাচারের চিহ্ন রেখে গিয়েছিল আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে।

বহুৰিকল্পীষ্ম প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১. সমুদ্রপারে কোথায় ঘণ্টা বাজছিল?
(ক) মন্দিরে
(খ) বাড়িতে
(গ) রাজসভায়
(ঘ) উদ্যানে
২. “তাদের পাড়ায় পাড়ায়”- ‘তাদের’ বলতে বোঝানো হয়েছে-
(ক) আফ্রিকাবাসীদের
(খ) ঔপনিবেশিক প্রভুদের
(গ) নিবিড় অরণ্যের
(ঘ) পূজারিদের
৩. কার নামে পুজো চলছিল?
(ক) ক্ষমতাময় রাজার
(খ) পরমাত্মার
(গ) অন্ধকার আফ্রিকার
(ঘ) দয়াময় দেবতার
৪. শিশুরা কোথায় খেলছিল?
(ক) বনে
(খ) মাঠে
(গ) ময়দানে
(ঘ) মায়ের কোলে
৫. কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল-
(ক) বিপ্লবের সুর
(খ) সুন্দরের আরাধনা
(গ) দেবতার স্তবগান
(ঘ) পুজোর মজ্রধ্বনি
৬. কবি কীসের মাধ্যমে আরাধনা করছিলেন?
(ক) কবিতার
(খ) লেখনীর
(গ) সংগীতের
(ঘ) গ্রন্থের
৭. আজ কোথায় ঝড় ঘনিয়ে উঠছে?
(ক) পূর্ব দিগন্তে
(খ) পশ্চিম দিগন্তে
(গ) উত্তর দিগন্তে
(ঘ) দক্ষিণ দিগন্তে
৮. কখন ঝড় ঘনিয়ে উঠল?
(ক) দ্বিপ্রহরে
(খ) প্রদোষকালে
(গ) মধ্যরাত্রে
(ঘ) শেষরাত্রে
৯. “প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস”—‘প্রদোষ’ শব্দের অর্থ-
(ক) সন্ধ্যা
(খ) ভোর
(গ) রাত্রি
(ঘ) দুপুর
১০. কোথা থেকে পশুরা বেরিয়ে এল?
(ক) গুপ্ত গহ্বর থেকে
(খ) আদিম বনভূমি থেকে
(গ) প্রকাশ্য গহ্বর থেকে
(ঘ) গভীর অরণ্য থেকে
১১. পশুরা কী ঘোষণা করল?
(ক) দিনের অন্তিমকাল
(খ) রাত্রির অন্তিমকাল
(গ) সকালের অন্তিমকাল
(ঘ) সন্ধ্যার অন্তিমকাল
১২. পশুরা কীভাবে অন্তিম ঘোষণা করল?
(ক) অশুভ ধ্বনিতে
(খ) হিংস্র চিৎকারে
(গ) মুখর কলরবে
(ঘ) অশুভ ইঙ্গিতে
১৩. কবি কাকে আহ্বান জানিয়েছেন?
(ক) আফ্রিকাকে
(খ) যুগান্তের কবিকে
(গ) অপমানকারী পশুদের
(ঘ) সারা বিশ্বকে

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই…”—সমুদ্রপারে তখন কী ঘটছিল?
উত্তর – আফ্রিকা যখন অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত তখন সমুদ্রপারে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির পাড়ায় পাড়ায় মন্দিরে পুজোর ঘণ্টা বাজছিল। শিশুরা মায়ের কোলে খেলা করছিল, কবিরা সুন্দরের আরাধনা করছিলেন।
২. “মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা”— কেন এই পুজোর ঘণ্টা বাজছিল ?
উত্তর – সকাল এবং সন্ধ্যায় দয়াময় দেবতার নাম স্মরণ করে ঔপনিবেশিক প্রভুদের মন্দিরে পুজোর ঘণ্টা বাজছিল।
৩. “কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল…”—কবির সংগীতে কী বেজে উঠেছিল? 
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতার আলোচ্য অংশে কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল সুন্দরের আরাধনা।
৪, “প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,”—’প্রদোষকাল’ বলতে কোন্ সময়কে বোঝানো হয়েছে? 
উত্তর – ‘প্রদোষকাল’ বলতে সান্ধ্যকাল বা দিনের অন্তিম সময়কে বোঝানো হয়েছে।
৫. “আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে/প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,/ যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল। -/অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,”—উদ্ধৃতাংশে কোন রাজনৈতিক ঘটনার স্পর্শ রয়েছে।  
উত্তর – উদ্ধৃতাংশে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ মানুষদের এবং তথাকথিত সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রগুলির অত্যাচার ও উৎপীড়নের মতো রাজনৈতিক ঘটনার ছোঁয়া রয়েছে।
৬. গুপ্ত গহবর থেকে পশুরা বেরিয়ে এসে কী ঘোষণা করেছিল?
উত্তর – গুপ্ত গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসে পশুরা দিনের অন্তিমকাল ঘোষণা করেছিল।
৭. “এসো যুগান্তের কবি…”—কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘যুগান্তের কবি’র কাছে কোন্‌ ডাক দিয়েছেন?
অথবা, “এসো যুগান্তরের কবি”—’কবি’র ভূমিকাটি কী হবে?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুগান্তের কবিকে আসন্ন সন্ধ্যার শেষে অপমানিত আফ্রিকার পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন।
৮. “আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে”—সন্ধ্যাকাল আসন্ন কেন?
উত্তর – অশুভ ধ্বনিতে দিনের অন্তিমকাল ঘোষণা করেছে গুপ্ত গহ্বরের পশুরা, দিনের শেষে পশ্চিম দিগন্তও ঝঞ্ঝাবাতাসে শ্বাসরুদ্ধ। সভ্যতার যেন সংকটকাল উপস্থিত। তাই রূপকার্থে বলা হয়েছে সন্ধ্যাকাল আসন্ন।
৯. ‘ক্ষমা করো’—এই ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে কবির কোন্ মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে?
উত্তর – এই ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে কবির অনুশোচনা এবং বিবেকবোধের প্রকাশ ঘটেছে।
১০. “সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।”—সভ্যতার শেষ ‘পুণ্যবাণী’টি কী হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে কবি মনে করেন?
উত্তর – ‘আফ্রিকা’ কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন যুগান্তের কবির কণ্ঠে সভ্যতার শেষ ‘পুণ্যবাণী’-টি হওয়া উচিত ‘ক্ষমা করো”।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই…”—–সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তে কী ঘটেছিল লেখো।
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে। কবির বর্ণনা অনুসারে আফ্রিকায় যখন ঔপনিবেশিক শোষণ চলছিল, তখন সমুদ্রপারে ইউরোপীয়দের নিজেদের পাড়ায় পাড়ায় দয়াময় দেবতার নামে মন্দিরে পুজোর ঘণ্টা বাজছিল। শিশুরা মায়ের কোলে খেলছিল। আর সেখানে কবিরা বীণায় সংগীতের সুর তুলে সুন্দরের আরাধনা করছিলেন। সমুদ্রপারের এই দৃশ্যে সভ্যতার বিপরীত দিকই ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথের চোখে।
২. “কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল/সুন্দরের আরাধনা।।” বেজে ওঠার তাৎপর্য কী?
উত্তর – উৎস: রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত। তাৎপর্য: আধুনিক সভ্যতার বিপরীত দিককে রবীন্দ্রনাথ এখানে তুলে ধরেছেন। তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয় শক্তিরা আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে তীব্র শোষণ চালাত। আফ্রিকানদের পাঠানো হত যুদ্ধক্ষেত্রে, পশুর মতো তাদের নিয়ে কেনাবেচা চলত। একদিকে যখন মনুষ্যত্বের এরকম লাঞ্ছনা, সেই একই সময়ে সভ্য দুনিয়ায় ঈশ্বরের প্রার্থনা চলত। আবার শিশুরা মায়ের কোলে খেলত, কবির সংগীতে বেজে উঠত সুন্দরের আরাধনা। অর্থাৎ জীবন সেখানে থাকত শান্ত ও সুন্দর।
৩. “এসো যুগান্তের কবি”—যুণাত্তের কবিকে কোথায় আসতে বলা হয়েছে? সেখানে এসে তিনি কী করবেন? 
উত্তর – যুগান্তের কবির আগমনস্থল: ‘আফ্রিকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যুগান্তের কবিকে আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে অপমানিত আফ্রিকার দ্বারে এসে দাঁড়াতে বলেছেন।
যুগান্তের কবির করণীয়: আফ্রিকার জনগণের ওপর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের অত্যাচার মানবতার অপমান। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উচিত এই বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। যুগান্তের কবি তাঁদেরই প্রতিনিধি। মানহারা আফ্রিকার দ্বারে দাঁড়িয়ে সত্য ও সুন্দরের পূজারি কবিকেও বলতে হবে ‘ক্ষমা করো’। আর সেটাই হবে সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।’
8.“সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”—মন্তব্যটির প্রসঙ্গ নির্দেশ করো।
উত্তর – উৎস: উদ্ধৃতাংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে গৃহীত। প্রসঙ্গ: ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার চাহিদা — এই দুই-এ মিলে আফ্রিকায় এক পালাবদলের সম্ভাবনা কবির কাছে স্পষ্ট হয়েছিল। তাই কবি এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে যুগান্তের নবীন কবিকে আহ্বান করেছেন অপমানিত আফ্রিকার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য। আফ্রিকার এই অপমানের ইতিহাসকে মনে রেখে যুগান্তের কবিকে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। হিংস্র প্রলাপের মধ্যে এই ক্ষমাপ্রার্থনার তাৎপর্য বোঝাতেই কবি মন্তব্যটি করেছেন।

বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

১. “কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল/সুন্দরের আরাধনা” — উদ্ধৃতাংশটির মধ্য দিয়ে কবির যে বক্তব্য ফুটে উঠেছে তা বিবৃত করো।
উত্তর – নিপীড়ন ও অত্যাচার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় আফ্রিকার বুকে তার প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদের লোভে ইউরোপীয় দেশগুলি নিদারুণ অত্যাচার চালাচ্ছিল। চোখের জল আর রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আফ্রিকার মাটি। লাঞ্ছনার চিরস্থায়ী চিহ্ন আঁকা হয়ে যাচ্ছিল আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে। আনন্দের ঝরনাধারা: এই পরিস্থিতিতেই সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যাচ্ছিল আক্রমণকারী ইউরোপীয় দেশগুলিতে। তাদের পাড়ায় পাড়ায় দয়াময় দেবতার নামে মন্দিরে পুজোর ঘণ্টা বাজছিল। শিশুরা নিশ্চিন্তে খেলছিল মায়ের কোলে। অর্থাৎ আফ্রিকায় যে মৃত্যু এবং রক্তাক্ততার ঘটনা ক্রমাগত ঘটে চলেছিল তা কোনোভাবেই ইউরোপের জনজীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর সেই শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেই ইউরোপীয় কবির সংগীতেও বেজে উঠছিল সুন্দরের আরাধনা। অর্থাৎ সেখানে মানবতার লাঞ্ছনার কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যাচ্ছিল না। কবির কর্তব্যবোধ: কবিরা সত্যদ্রষ্টা। তাঁরা সুন্দরের পূজারি। কিন্তু সেই সুন্দর তখনই সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যদি তার সঙ্গে মানবতার সংযোগ থাকে। যখন কবিরা এই মানবতার অপমানের সময়ে মুখ ফিরিয়ে থাকেন তা কবিতার জন্য উচিত কাজ হয় না, এমনকি সভ্যতার জন্যও নয়। ইউরোপে এভাবেই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কবিতার চর্চা লক্ষ করেছিলেন কবি, যা সভ্যতার গ্লানিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
২. “এসো যুগান্তের কবি”—কোন্ পরিস্থিতিতে যুগান্তের কবিকে আহ্বান জানানো হয়েছে? তার কাছে কবির কী প্রত্যাশা? 
উত্তর – পরিস্থিতি: ‘আফ্রিকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলির দ্বারা আফ্রিকার শোষণ ও লাঞ্ছনার এক করুণ ছবি তুলে ধরেছেন। ‘সভ্যের বর্বর লোভ’ কীভাবে নিজেদের ‘নির্লজ্জ অমানুষতা’-কে প্রকাশ করে তার দৃষ্টান্ত কবি তুলে ধরেছেন। আফ্রিকাকে এই লাঞ্ছনার হাত থেকে মুক্তি দিতে কবি ‘যুগান্তের কবি’-কে আহ্বান করেছেন।
৩. “দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে,/ বলো ‘ক্ষমা করো” ‘মানহারা মানবী’ কথাটি ব্যাখ্যা করো। কাকে, কেন তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হয়েছে? 
উত্তর – ‘মানহারা মানবী’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় কবি আফ্রিকাকেই ‘মানহারা মানবী’ বলেছেন। কারণ উন্নত ইউরোপীয় সভ্যতা আফ্রিকাকে শোষণ করলেও আফ্রিকার জীবনধারা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেয়নি। উপেক্ষা আর অপমানের অন্ধকারে কলঙ্কিত আফ্রিকাকে ডুবে থাকতে হয়েছে। দাসব্যবস্থা থেকে ঔপনিবেশিকতা—বঞ্চনার ইতিহাস আফ্রিকাকে ঘিরে আছে। ‘মানহারা মানবী’ কথাটির দ্বারা এই বঞ্চনার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ক্ষমা চাওয়ার কারণ: যুগান্তের কবিকে এখানে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ সৃষ্টিশীল কবিমাত্রই সত্য এবং সুন্দরের কথা বলেন। তাই যে শোষণ-লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে আফ্রিকাকে—একজন কবিই তাঁর সংবেদনশীলতা দিয়ে তা উপলব্ধি করতে পারেন। ‘আফ্রিকা’ কবিতা রচনার সময়কালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শাসনক্ষমতার পরিবর্তন হতে থাকে। আফ্রিকা এবং তার অধিবাসীদের ওপরে যে অত্যাচার হয়েছে তার ‘ক্ষমা ভিক্ষা’ প্রার্থনা করাটাই সভ্যতার সবথেকে বড়ো কর্তব্য হওয়া উচিত বলে কবি মনে করেছেন। চারপাশে হিংস্র প্রলাপের মধ্যে একেই কবি ‘সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী’ বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ কবি চেয়েছেন, যে নতুন আফ্রিকা তৈরি হবে, মানবিক প্রশান্তিই যেন তার পথ চলার সাথি হয়।

সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

১. ‘আফ্রিকা’ কবিতা অবলম্বনে আফ্রিকার মানুষদের ওপরে ঔপনিবেশিক প্রভুদের অত্যাচারের বর্ণনা দাও। সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবির প্রতিবাদ কীভাবে উচ্চারিত হয়েছে লেখো। 
উত্তর – ঔপনিবেশিক প্রভুদের অত্যাচার: রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি আফ্রিকার ওপরে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির অত্যাচারের এক মানবিক দলিল। আদিমতার অন্ধকারে ঢাকা আফ্রিকা একসময় ছিল সভ্যসমাজের কাছে ভয়ংকর। কিন্তু কালক্রমে আফ্রিকার প্রতি অবহেলা দূর হয়ে গিয়ে তার মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিকটি চোখ পড়ে সভ্য দুনিয়ার। আর তখনই নখদাঁত বিস্তার করা হিংস্রতার শিকার হতে হয় আফ্রিকাকে। প্রথমপর্বে গর্বিত ইউরোপীয় দেশগুলি আফ্রিকাকে বেছে নিয়েছিল ক্রীতদাস সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে–“এল মানুষ-ধরার দল/ গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।” তারপরে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ আকৃষ্ট করল তাদের—“সভ্যের বর্বর লোভ/নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।” আর এভাবেই লাঞ্ছিত হল মানবতা। আফ্রিকার মাটি পঙ্কিল হল মানুষের রক্ত আর চোখের জলে। অত্যাচার চিরস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন তৈরি করে দিল আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে।
অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবির প্রতিবাদ: কবি রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকার ওপরে অত্যাচারের কাহিনিকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে অপমানিত আফ্রিকার প্রতি নিজের সহানুভূতি জানিয়েছেন। ‘মানহারা মানবী’ আফ্রিকার ওপর অবিচারকে স্পষ্টতর করে তুলতেই কবি বিপরীতে তুলে ধরেছেন সমুদ্রপারের দেশগুলির নিশ্চিন্ত শান্ত দিন কাটানোর কথা। এখানেই না-থেমে কবি ‘দিনের অন্তিমকাল’ ঘোষণার মুহূর্তে সভ্যতার সংকটের মুখোমুখি হয়ে যুগান্তের কবিকে বলেছেন ক্ষমাপ্রার্থনা করার জন্য। হিংস্র প্রলাপের মধ্যে এই ক্ষমাপ্রার্থনাকেই রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী’ বলেছেন।
২. ‘আফ্রিকা’ কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর – উত্তর রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি উপেক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা এক মহাদেশের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সৃষ্টির শুরু থেকেই আফ্রিকা ঘন অরণ্যে ভরা এমন এক দেশ, যেখানে সূর্যের আলোও ঠিকমতো প্রবেশ করে না। কিন্তু সেই ভয়ংকরতাই হয়েছে আফ্রিকার রক্ষাকবচ। ‘বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়’ আফ্রিকা নিজেকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে নিয়েছে। অন্যদিকে, দুর্গম এবং দুর্বোধ্য আফ্রিকাকে উপেক্ষা করেছে উন্নত বিশ্ব। তার পরিচয় থেকে গিয়েছে অন্ধকার মহাদেশ হিসেবেই। ধীরে ধীরে আফ্রিকার সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। এসেছে ‘মানুষ-ধরার দল’। তৈরি হয়েছে দাসব্যবস্থা, যা কিনা অরণ্যের আদিমতার থেকেও আদিম এক অধ্যায়। তারপরে ইউরোপের উন্নত দেশগুলি উপনিবেশ স্থাপন করেছে আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে। ‘সভ্যের বর্বর লোভ’ আফ্রিকায় তৈরি করেছে নির্লজ্জ অমানবিকতার আর-এক ইতিহাস। রক্ত আর চোখের জলে ভিজে গেছে আফ্রিকার মাটি। অথচ অন্য প্রান্তে উন্নত দেশগুলিতে তখনও একইভাবে অব্যাহত ঈশ্বরের আরাধনা কিংবা কবির সংগীত ।
দিনের অন্তিমকাল ঘোষণার সময় যখন উপস্থিত, তখন কবি ‘যুগান্তের কবি’ কে উদ্দেশ্য করে ‘মানহারা মানবী’ আফ্রিকার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বলেছেন। মানুষের যাবতীয় শুভবোধকে এই ক্ষমার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন কবি। সাম্রাজ্যবাদের ‘হিংস্র প্রলাপ’-এর মধ্যে এই হবে ‘সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী’। এভাবেই বিশ্বমানব-মৈত্রীর মধ্য দিয়ে আফ্রিকার এক নব উত্থানকে কল্পনা করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ।
৩. ‘আফ্রিকা’ কবিতা অবলম্বনে উপেক্ষিত ও অত্যাচারিত আফ্রিকার বর্ণনা দাও। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে মানহারা আফ্রিকার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন লেখো। 
উত্তর – উপেক্ষিত ও অত্যাচারিত আফ্রিকা: ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের বর্বরতা এবং পাশবিক লোভলালসাকে কবি তুলে ধরেছেন।
প্রাকৃতিক বাধাকে উপেক্ষা করেও আদিম আফ্রিকা ছিল নিজের মহিমায় উজ্জ্বল, কিন্তু একসময় সে দেশে এল ক্ষমতালোভী ঔপনিবেশিক শক্তি। কবির ভাষায়—
“এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে।”
এই হিংস্র দানবশক্তির কাছে হেরে গেল আফ্রিকার কালোমানুষ। নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে পড়ল তারা। বর্ণের অহংকারে, সভ্যের মুখোশ পরে ঔপনিবেশিক প্রভুরা সমগ্র আফ্রিকাবাসীকে পরিণত করল ক্রীতদাসে। মাটিতে ঝরে পড়ল তাদের রক্ত ও অশ্রু। সেই রক্ত আর চোখের জল মিশে আফ্রিকার ধুলো হল পঙ্কিল। দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায় সেই বীভৎস কাদার পিণ্ড চিরচিহ্ন দিয়ে গেল মানহারা আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে।
মানহারা আফ্রিকার পাশে রবীন্দ্রনাথ: উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত আফ্রিকার পাশে দাঁড়াতে কবির জাগ্রত বিবেক গর্জে উঠেছে কবিতার শেষ স্তবকে। যুগান্তের কবিকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন—“দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;/বলো ‘ক্ষমা করো’—” আসলে ক্ষমাপ্রার্থী কবির বিবেক। বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হয়ে সংবেদনশীল কবি নতজানু হয়েছেন মানহারা আফ্রিকার কাছে। ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণীকে প্রতিষ্ঠা দিতে চান তিনি।
৪. ‘আফ্রিকা’ কবিতাটির পটভূমি আলোচনা করো। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের পরিচয় দাও। 
উত্তর – পটভূমি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনোভাবের অন্যতম সৃষ্টি ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কবিতাটি রচনা করেন। বিশ্ব ইতিহাসে এই সালটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনির ইথিওপিয়া আক্রমণকে রবীন্দ্রনাথ ভালো চোখে দেখেননি। আফ্রিকার কালোমানুষদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকদের দানবীয় অত্যাচার রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি। নিরপরাধ, নিরীহ আফ্রিকার আদিম মানুষদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের বর্বর অত্যাচার কবিচিত্তে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তারই প্রকাশ ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি।
কবিমানসের পরিচয়: ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। ভৌগোলিক বাধাকে জয় করে আফ্রিকা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্বাধীন এক ভূখণ্ড ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এই অরণ্যঘেরা ভূখণ্ডের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠল। সাম্রাজ্যবাদীরা আফ্রিকার কালোমানুষদের পরিণত করল ক্রীতদাসে। তাদের ‘নির্লজ্জ ‘অমানুষতা’ আর ‘বর্বর লোভ’আফ্রিকাকে ক্ষতবিক্ষত করল। কবির চেতনায় আফ্রিকার মানুষের সেই আর্তনাদ ‘ভাষাহীন ক্রন্দন’ রূপে কবিতায় ফুটে ওঠে। উপেক্ষার কলুষিত চাহনিতে লাঞ্ছিত আফ্রিকাকে কবি দেখলেন ‘মানহারা মানবী’ রূপে। যুগান্তের কবিকে জানালেন আহ্বান, ক্ষমা চাইতে বললেন আফ্রিকার কাছে। আফ্রিকার প্রতি কবির দরদ ও ভালোবাসা তাঁর বিশ্বমানবতাবাদের কাব্যিক প্রকাশ।

The Complete Educational Website

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *