WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 5 হারিয়ে যাওয়া কালি কলম
WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 5 হারিয়ে যাওয়া কালি কলম
West Bengal Board 10th Class Bengali Solutions Chapter 5 হারিয়ে যাওয়া কালি কলম
West Bengal Board 10th Bengali Solutions
প্রবন্ধকার পরিচিতি
ভূমিকা: “জগতের এত বিষয়ে এত জ্ঞান খুব বেশি মানুষের আমি দেখিনি।”—পণ্ডিত, সাহিত্যিক, বিদগ্ধ ব্যক্তি নিখিল সরকার সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন কবি-সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন। কলকাতার সংস্কৃতি, প্রাচীন জীবনধারা সম্পর্কে দীর্ঘদিন গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন নিখিল সরকার। বাংলা সাহিত্য জগতে ‘শ্রীপান্থ’ ছদ্মনামেই তিনি অধিক পরিচিত। জন্ম ও শৈশব: ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর গ্রামে নিখিল সরকারের জন্ম হয়। শৈশবজীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।
শিক্ষাজীবন: ময়মনসিংহতেই নিখিল সরকারের শিক্ষাজীবনের সূচনা। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক হন।
কর্মজীবন: তরুণ বয়সে সাংবাদিকতা দিয়ে নিখিল সরকারের কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিনি প্রথমে যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারপর আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি করেন। ‘পুস্তক পর্যালোচনা’ এবং প্রতি সোমবার ‘কলকাতার কড়চা’—এই দুটি বিষয় তাঁর কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি।
সাহিত্যজীবন: সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়ই নিখিল সরকারের সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটে। আদি কলকাতার সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে তিনি দীর্ঘ লেখালেখি ও গবেষণা করেন। প্রবন্ধ আকারে তাঁর লেখাগুলি বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে থাকে। লেখালেখির প্রতি গভীর আগ্রহ এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে শ্রীপান্থ বহু কবি-সাহিত্যিকের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি বাংলায় প্রথম ধাতব হরফে ছাপা হ্যালহেডের আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ গ্রন্থটির সম্পাদিত সংস্করণের দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল—আজব নগরী (প্রথম গ্রন্থ), শ্রীপান্থের কলকাতা, যখন ছাপাখানা এলো, মোহন্ত এলোকেশী সম্বাদ, কেয়াবাৎ মেয়ে, মেটিয়াবুরুজের নবাব, দেবদাসী, ঠগী, হারেম, বটতলা।
পুরস্কার: নিখিল সরকার ১৯৭৮-এ আনন্দ পুরস্কার পান ।
জীবনাবসান; ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যানসারে এই পণ্ডিত মানুষটির জীবনাবসান ঘটে।
উৎস
‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধটি কালি আছে কাগজ নেই, কলম আছে মন নেই রচনা থেকে গৃহীত।
বিষয়সংক্ষেপ
‘কালি-কলম-মন, লেখে তিন জন’— প্রবাদটি প্রচলিত হলেও কলম ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছে। লেখক লেখালেখির অফিসে কাজ করেন। লেখক ছাড়া সেখানে সবাই কম্পিউটার ব্যবহার করেন। এমনকি কখনও ভালোবেসে তারা লেখকের লেখাটাও কম্পিউটারে লিখে দেন। কলম লেখকের নিত্যসঙ্গী। কখনও সেই কলম নিয়ে যেতে ভুলে গেলেই বিপদ। অফিসে কারও সঙ্গে কলম থাকে না। আবার কলম পেলেও তার মুখ ভোঁতা, ফলে লিখে তিনি শান্তি পান না। লেখালেখির অফিস হওয়া সত্ত্বেও কারও কাছে কলম থাকে না। তবুও কালগুণে তারা সবাই মুনশি।
লেখক গ্রামের ছেলে। শৈশবে বাঁশের কলম তৈরি করে তাঁর লেখাপড়ার শুরু। বড়োদের পরামর্শে কলমের মুখটা চিরে নিতেন, কারণ তাহলে কালি ধীর প্রবাহে পড়ত। কাগজের মতো করে কলাপাতা কেটে তাতেই তিনি লিখতেন। বাড়ির কাজ মাস্টারমশাইকে দেখানোর পর বাড়ি ফেরার পথে তা পুকুরে ফেলে দিতেন, কারণ সেই যুগে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, বাড়ির বাইরে ফেললে গোরুতে খেলে অমঙ্গল বা পাপ হয়।
শৈশবে লেখক ও তাঁর সহপাঠীরা মা, পিসি, দিদিদের সাহায্যে বাড়িতেই কলমের মতো কালিও তৈরি করতেন। অতি সহজ পদ্ধতিতে বাড়িতে যে কাঠের উনুনে রান্না হত, সেই কড়াইয়ের তলার কালি লাউপাতা দিয়ে ঘষে, পাথরের বাটিতে গুলে লেখক ও তাঁর সহপাঠীরা কালি তৈরি করতেন। কখনও হরীতকী, আতপ চাল ভাজা পুড়িয়ে বেটে মিশিয়ে নিতেন। তারপর একটা খুন্তির গোড়ার দিক আগুনে পুড়িয়ে লাল টকটকে করে সেই জলে ছ্যাঁকা দিতেন ৷ জল কম থাকায় তা টগবগ করে ফুটত। সবশেষে ন্যাকড়া দিয়ে ছেঁকে দোয়াতে ভরে কালি প্রস্তুত করতেন। তবে প্রাচীনদের মত ছিল ভালো কালি তৈরির জন্য প্রয়োজন তিল, ত্রিফলা, শিমুল গাছের ছাল, ছাগলের দুধ ও লোহা। এভাবেই বাঁশের কলম, মাটির দোয়াত, ঘরে তৈরি কালি, কলাপাতা দিয়েই লেখক ও তাঁর সহপাঠীদের প্রথম লেখালেখির কাজ শুরু হয়েছিল। সেই কলম হাতছাড়া হওয়ার উপক্রমে লেখক ব্যথিত হয়েছেন।
লেখক ভেবেছেন, তিনি যদি জিশু খ্রিস্টের আগে জন্মাতেন বা মিশরে জন্মাতেন বা যদি সুমেরিয়ান, ফিনিসিয়ান হতেন, তাহলে নীল নদের তীর থেকে নলখাগড়া ভেঙে নিয়ে কলম বানাতেন। ফিনিসীয় হলে বনপ্রান্ত থেকে হাড় সংগ্রহ করে কলম বানাতেন। রোমের সম্রাট জুলিয়াস সিজার হলে ব্রোঞ্জের শলাকা বা স্টাইলাস হাতে তুলে নিতেন। চিনারা শুধু তুলিতে লিখেছেন, বাকি সকলেই বাঁশের, নলখাগড়ার, পাখির পালকের বা ব্রোঞ্জের শলাকা কলম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
যুগের পরিবর্তনে নানান রকমের কলম এসেছে। বাঁশের কলম আর খুঁজেই দেখা যায় না। খাগের কলম শুধু সরস্বতী পুজোর সময় ব্যবহৃত হয়। এমনকি পালকের কলম দেখতে গেলেও তৈলচিত্রেই শুধু তা দেখা যায়। যেমন, উইলিয়ম জোন্স বা মুনশি কেরি সাহেবের ছবিতে দেখা যায়। পালকের কলম বানানোর জন্য সাহেবরা পেনসিল শার্পনারের মতো একটা যন্ত্রও বানিয়েছিলেন।
পালকের কলম, দোয়াতকলম সবই এখন উধাও। অনেক অফিসে ডটপেনই দোয়াতকলম হিসেবে সাজানো থাকে। একসময় ফেরিওয়ালারাও কলম বিক্রি করত। ছোটোবেলায় লেখক দেখেছেন, এক দারোগাবাবু পায়ের মোজায় কলম গুঁজে রাখতেন। আধুনিক ছেলেরা বুকপকেটের বদলে কাঁধের ছোটো পকেটে কলম সাজিয়ে রাখে। শিক্ষিত মানুষ ছাড়াও কলম যেকোনো মানুষেরই সঙ্গী হয়ে ওঠে। সর্বভোগ্য ও সর্বজনীন হওয়ার ফলে পকেটমারদের কাছেও কলম গুরুত্ব হারায়।
লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান নামক ব্যবসায়ী ফাউন্টেন পেন আবিষ্কার করে পেনের জগতে বিপ্লব আনেন। লেখক কলেজ স্ট্রিটের এক দোকানে ফাউন্টেন পেন কিনতে গিয়ে পার্কার, শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, সোয়ান, পাইলট প্রভৃতি হরেক পেনের হরেকরকম দাম ও কারুকার্য দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সেখান থেকে সস্তায় একটা জাপানি পাইলট পেন কিনে আনেন। দোকানদার অনেক কসরত করে পেনটার নিব কতটা শক্ত তা দেখান। ফাউন্টেন পেন সংগ্রহও একসময় নেশার মতো ছিল। সাহিত্যিক শৈলজানন্দ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের নেশা ছিল।
লেখক ছিলেন কালিকলমের ভক্ত। হাই স্কুলে ভরতির পর তিনি বাঁশের কলম ব্যবহার বন্ধ করে দেন। কালি বানানোও তখন বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় বাজারে কাজল, সুলেখা প্রভৃতি কালি কিনতে পাওয়া যেত। এরপর ফাউন্টেন পেন তার রকমারি বাহারি চেহারা নিয়ে ক্রমশ দোয়াত এবং কলমকে হটিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে কঞ্চির কলম, খাগের কলম, , কালির আধার, ব্লটিং পেপার সব কিছু হারিয়ে যায়। দোয়াতকলম,
এরপর একসময় বাজারে আসে কম্পিউটার। কম্পিউটারের কারণে কলমের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে। একসময় বিশ্বের দরবারে লিপিকুশলীদের সম্মান ছিল, বই লেখার মূল্য কম হলেও তা অমূল্য ছিল। লেখক বা লিপিকররা তাঁদের বই নিয়ে গর্ব করতেন। কলমকে বলা হত তলোয়ারের চেয়েও শক্তিধর।
ইতিহাসে পালকের কলমধারীদের সত্যিই কখনো কখনো তলোয়ার হাতে লড়াই করতে হয়েছে। তাই অনেক পরিবর্তনের মাঝেও কাউকে কলম আঁকড়ে থাকতে দেখলে লেখকের ভালো লেগেছে। তাঁর সময়কালের অন্নদাশঙ্কর রায় বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় টাইপরাইটারে লিখলেও বাকিরা কলমেই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সত্যজিৎ রায় কলমের সাহায্যেই তাঁদের শিল্পবোধকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। এঁদের দুজনেরই কলমের লেখা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল।
লেখক স্বীকার করেছেন, তিনি কলমের ভক্ত হলেও আধুনিক বল-পেনের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে কলম যে সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, সেই করুণ কাহিনিও লেখক জানাতে ভোলেননি।
নামকরণ
সাহিত্যের নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রচয়িতার অভিপ্রায় রচনাটির নামের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। নামকরণ সাধারণত চরিত্রধর্মী, বিষয়ভিত্তিক বা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে থাকে। আমাদের পাঠ্য ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধটির নামকরণ কতদূর সার্থক, তা আলোচনাযোগ্য।
কালি-কলম-মন, লেখে তিন জন — অর্থাৎ, প্রাচীন কাল থেকেই মনের সঙ্গে কালি এবং কলমের সম্পর্ক। সময় এগিয়ে চলেছে নদীর স্রোতের মতো। বহমানতার যুগে মানুষ ক্রমশ যন্ত্রকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এর ফলেই মানুষ মনের সঙ্গে যুক্ত থাকা ছোটো ছোটো সামগ্রী হারাতে বসেছে। লেখক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই বলেছেন যে, তাঁর অফিসে সবাই কম্পিউটার ব্যবহারে পারদর্শী। একমাত্র তিনিই কলম ব্যবহার ছাড়তে পারেননি। এর ফলে “একদিন যদি কোনও কারণে কলম নিয়ে যেতে ভুলে যাই তবেই বিপদ। —কলম! কারও সঙ্গে কলম নেই।” এই বিলাপ থেকেই স্পষ্ট যে কলম হারিয়ে যেতে বসেছে। শৈশবে লেখকরা যেভাবে বাঁশের কলম তৈরি করে ব্যবহার করেছেন এবং কড়াইয়ের নীচের কালি লাউ পাতা দিয়ে ঘষে তুলে জলে গুলে যেভাবে কালি তৈরি করেছেন তা এখন স্মৃতির বিষয়। ফাউন্টেন পেন আসার পর কলম হয়ে ওঠে সস্তা এবং সবার প্রিয়। ক্রমশ ফাউন্টেন পেনের আধিপত্যকে হটিয়ে দিয়ে বাজার দখল করে বল-পেন। ইতিহাসের পাতায় চলে যায় বাঁশের পেন, খাগের পেন, পালকের পেন প্রভৃতি। হাতে তৈরি কালি, সুলেখা কালি, কালি শুকানোর ব্লটিং পেপার সব উধাও হয়ে যেতে থাকে। আক্ষেপের সুরে তাই লেখক বলেছেন, “আশ্চর্য, সবই আজ অবলুপ্তির পথে। কম্পিউটার তাদের জাদুঘরে পাঠাবে বলে যেন প্রতিজ্ঞা করেছে।” তাঁর আক্ষেপ বিষাদে পরিণত হয়েছে, কারণ তিনিও জানেন যে আধুনিকতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। তবুও শৈশবের সেই কালিকলম হারিয়ে যাওয়াকে তিনি মানতে পারেননি। তাই বিষয়ের সঙ্গে নামটি সাযুজ্যপূর্ণ এবং সংগতি লাভ করেছে। বিষয়ধর্মী নামকরণ হিসেবে রচনাংশটির নামটি তাই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও সার্থক হয়েছে।
আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর
বহুবিল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর
ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনাটি যে গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে, সেটি হল—
(ক) যখন ছাপাখানা এলো
(খ) কালি আছে কাগজ নেই, কলম আছে মন নেই
(গ) আজব নগরী
(ঘ) বটতলা
২. শ্রীপান্থের আসল নাম-
(ক) অন্নদাশঙ্কর রায়
(খ) নিখিলনাথ রায়
(গ) নিখিল সরকার
(ঘ) সুবোধ ঘোষ
৩. নিখিল সরকার ওরফে ‘শ্রীপান্থ’র জন্ম হয়-
(ক) ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে
(খ) ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে
(ঘ) ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে
৪. নিখিল সরকার রচিত একটি গ্রন্থ হল-
(ক) মেটিয়াবুরুজের নবাব
(খ) কঙ্কাবতী
(গ) আমরা বাঙালি
(ঘ) রামায়ণ
৫. কথায় আছে, কালি কলম মন, লেখে —- জন।
(ক) এক
(খ) দুই
(গ) তিন
(ঘ) চার
৬. “কালি কলম মন, লেখে তিন জন।”—এটি হল-
(ক) ধাঁধা
(খ) প্রবাদ
(গ) রূপকথা
(ঘ) উপকথা
৭. লেখক যেখানে কাজ করেন, সেটা হল-
(ক) ছাপাখানা
(খ) পুথি লেখার কারখানা
(গ) লেখালেখির অফিস
(ঘ) গল্প লেখার আসর
৮. লেখক যেখানে কাজ করেন সেখানে সবাই-
(ক) লেখক
(খ) পুলিশ
(গ) আড্ডাবাজ
(ঘ) চাকর
৯. লেখক তাঁর অফিসে কোন্ জিনিসের কথা বলেছেন যা শুধু তাঁরই আছে?
(ক) একটি অভিধান
(খ) একটি কম্পিউটার
(গ) কলম
(ঘ) বই
১০. লেখকের হাতে কলম এবং বাকিদের সামনে কী?
(ক) টাইপরাইটার
(খ) কম্পিউটার
(গ) প্রচুর বই
(ঘ) দোয়াত ও পেন
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. শ্রীপান্থ কোন্ সাহিত্যিকের ছদ্মনাম?
উত্তর – শ্রীপান্থ হল নিখিল সরকারের ছদ্মনাম।
২. পাঠ্য ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনাটি কোন্ গ্রন্থের অন্তর্গত?
উত্তর – পাঠ্য ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনাটি নিখিল সরকার রচিত কালি আছে কাগজ নেই, কলম আছে মন নেই গ্রন্থের অন্তর্গত।
৩. কালি আছে কাগজ নেই, কলম আছে মন নেই গ্রন্থটি ছাড়া নিখিল সরকার রচিত অপর দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর – কালি আছে কাগজ নেই, কলম আছে মন নেই গ্রন্থটি ছাড়া নিখিল সরকার রচিত অপর দুটি গ্রন্থ হল যখন ছাপাখানা এলো, মেটিয়াবুরুজের নবাব|
৪. “লেখে তিন জন।”— এই ‘তিন জন’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে?
উত্তর – শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতাংশে তিন জন বলতে কালি, কলম এবং মনকে বোঝানো হয়েছে।
৫. লেখক যেখানে কাজ করেন সেটা কীসের অফিস এবং সবাই সেখানে কী?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখক শ্রীপান্থ যেখানে কাজ করেন সেটা লেখালেখির অফিস এবং সেখানে সবাই লেখক।
৬. লেখকের অফিসে লেখক ছাড়া সকলের সামনে কী থাকে?
উত্তর – লেখকের অফিসে লেখক ছাড়া সকলের সামনে চৌকো আয়নার মতো একটা কাচের স্ক্রিন বা পরদা অর্থাৎ কম্পিউটার থাকে।
৭. “লেখকরা অনবরত তা দিয়ে লিখে চলেছেন”- ‘তা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর – শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় আলোচ্য উদ্ধৃতাংশে ‘তা’ বলতে ছাপা হরফ-সহ কম্পিউটারের কি-বোর্ডকে বোঝানো হয়েছে।
৮. লেখক একদিন অফিসে কলম নিয়ে যেতে ভুলে গেলে ‘তবেই বিপদ’ কেন বলেছেন?
উত্তর – এক্ষেত্রে বিপদ হল লেখক ছাড়া তাঁর অফিসে কেউ লেখার কাজে কলম ব্যবহার করেন না। এমনকি কারও কাছে কলম পাওয়া গেলেও সেই ভোঁতা মুখের কলমে লিখে লেখক সুখ পান না।
৯. “দায়সারা ভাবে কোনও মতে সেদিনকার মতো কাজ সারতে হয়।” ‘দায়সারা’ কথাটি ব্যবহার করেছেন কেন?
উত্তর – অফিসে লেখকই একমাত্র কলম ব্যবহার করতেন। তাই কোনোদিন অফিসে কলম নিয়ে যেতে ভুলে গেলে কারও ভোঁতা মুখের কলমেই অগত্যা কাজ চালাতে হত তাঁকে।
১০, “বাংলায় একটা কথা চালু ছিল।”—কোন্ কথা চালু ছিল?
উত্তর – বাংলায় চালু কথাটি ছিল—“কালি নেই, কলম নেই, বলে আমি মুনশি।”
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
১. “কথায় বলে – কালি কলম মন, লেখে তিন জন।”—উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর – উৎস: শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে স্বয়ং লেখক অতিপ্ৰচলিত উদ্ধৃত প্রবাদটি উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গ: হারিয়ে যাওয়া কালি কলম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়েই লেখকের এরুপ মনে হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে এই মন্তব্যটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। তাৎপর্য: মানুষের মনের ভাব ও ভাবনা কলমের সাহায্যে কালির রেখায় সাদা কাগজের ওপর জীবন্তরূপ লাভ করে। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ তার মনের কথাকে ভবিষ্যতের মানুষের জন্য রেখে যাওয়ার উদ্দেশ্যে লেখার সামগ্রী ব্যবহার করে আসছে। এই পথ ধরেই কালি আর কলম এসেছে আমাদের সভ্য জগতে। কলম মানুষের আবেগকে প্রকাশ করে। তাকে হাতে নিয়ে মানুষ মনের নানা ভাবনাকে প্রকাশ্য করে তোলে। কলম হল তুলি, কালি হল রং আর মন হল শিল্পী। এই তিনের মিলনে মনের গোপনে জন্ম নেওয়া ভাবনা মূর্ত হয়ে ওঠে। এমনিভাবেই লেখা হয়েছে অজস্র গ্রন্থ। অর্থাৎ সাহিত্যের যে সর্বজনীন হয়ে ওঠা, তা কালি, কলম আর মন—এই তিনের মিলনের দ্বারা সম্ভব। কলমের সাহায্যে লেখার মাহাত্ম্যকে তুলে ধরতেই লেখকের এই মন্তব্যটির অবতারণা।
২. “সবাই এখানে লেখক। কিন্তু আমি ছাড়া করও হাতে কলম নেই।”—‘এখানে’ বলতে কোথাকার কথা বলা হয়েছে? লেখক হওয়া সত্ত্বেও কারও হাতে কলম নেই কেন?
উত্তর – উদ্দিষ্ট স্থান: শ্রীপান্থের লেখা ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনার উল্লিখিত অংশে ‘এখানে’ বলতে যে সংবাদপত্রের অফিসে লেখক কাজ করতেন সেখানকার কথা বলা হয়েছে।
কলম না থাকার কারণ: সংবাদপত্রে অফিস আসলে ‘লেখালেখির’ অফিস। সবাই সেখানে লেখার কাজই করে থাকেন। কিন্তু ‘কালি কলম মন, লেখে তিন জন’—এ কথা বলা হলেও নিজের কর্মক্ষেত্রে কলমের উপস্থিতি লেখক দেখতে পাচ্ছিলেন না। একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউই কলমের ব্যবহার করতেন না। কম্পিউটারই ছিল সকলের অবলম্বন। সকলের সামনে ছিল চৌকো আয়নার মতো একটা কাচের পর্দা, তার নীচে একটা কি-বোর্ড। এই বোর্ডের প্রত্যেকটি বোতামে ছাপা আছে একটি হরফ। আর লেখকের সহকর্মীরা অনবরত তার সাহায্যে লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে লেখা থামিয়ে সেই পর্দার দিকে তাকাচ্ছেন। যা লেখা হয়ে গিয়েছে তা সেই পর্দায় দেখা যাচ্ছে। এ এক নতুন লেখালেখির পদ্ধতি। কলম সেখানে প্রয়োজনহীন। কম্পিউটারের এই ব্যবহার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, কোনোদিন কলম না নিয়ে গেলে একটা কলম জোগাড় করাই সমস্যার হয়ে যেত। নতুন যুগের এই লেখার পদ্ধতিকে সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সকলে গ্রহণ করে নেওয়াতেই কলম অপ্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে পড়েছিল।
৩. “আমরা কালিও তৈরি করতাম নিজেরাই।”—লেখকরা কীভাবে কালি তৈরি করতেন তা প্রবন্ধ অনুসরণে লেখো।
উত্তর – নিখিল সরকার ওরফে ‘শ্রীপান্থ’ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে উদ্ধৃতাংশটি ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রচলিত ছড়া: আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক তাঁর ছেলেবেলায় কালি তৈরি নিয়ে প্রচলিত ছড়ার কথা বলেছেন। ছড়াটি হল—“তিল ত্রিফলা সিমুল ছালা/ ছাগ দুগ্ধে করি মেলা/লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি/ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসি।” উপকরণ: ছড়াটিতে তিল, ত্রিফলা, শিমুল গাছের ছাল, ছাগলের দুধ ইত্যাদি উপকরণের কথা আছে। এতগুলি উপকরণ জোগাড় করে কালি তৈরি করা খুব সহজ কাজ ছিল না। তাই লেখক অন্য সহজ পথ ধরেন। বিকল্প পদ্ধতি: লেখকের বাড়িতে কাঠের আগুনে রান্না হত। তাতে কড়াইয়ের তলায় প্রচুর কালি জমত। লাউ পাতা দিয়ে তা ঘষে তুলে, পাথরের বাটিতে জলে গুলে রাখা হত। যারা কালি তৈরিতে ওস্তাদ তারা এই কালো জলে হরীতকী ঘষত। কখনো কখনো আতপ চাল ভেজে পুড়িয়ে এবং তা বেটে সেই জলে মেশানো হত। এইসব ভালো করে মিশিয়ে একটা খুন্তির গোড়ার দিক পুড়িয়ে লাল করে সেই জলে স্পর্শ করালে তা টগবগ করে ফুটত। তারপর ন্যাকড়ায় হেঁকে মাটির দোয়াতে ভরে নিলেই তৈরি হয়ে যেত কালি।
8. “বলতে গেলে তাই নিয়ে আমাদের প্রথম লেখালেখি।”—শৈশবের কোন্ বর্ণনা লেখক দিয়েছেন?
উত্তর – কথামুখ: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখক তাঁর শৈশবজীবনের লেখালেখির সূচনার এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রামজীবনের সঙ্গে যাঁদের শৈশব যুক্ত, লেখকের সমবয়সি সেইসব মানুষ তাঁর এই বর্ণনার সঙ্গে একমত এবং একাত্ম হতে পারবেন—এই আশা প্রকাশ করে লেখক তাঁর বর্ণনাটি করেছেন। লেখার কলম: শৈশবে লেখক সরু বাঁশের কঞ্চি কেটে কলম তৈরি করতেন। বড়োদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি কলমের মাথাটা একটু চিরে দিতেন, ফলে কালি আস্তে আস্তে গড়িয়ে পড়ত। লেখার পাতা: লেখা হত কলাপাতায়। কাগজের আকৃতিতে কলাপাতা কেটে তাতে হোমটাস্ক করে মাস্টারমশাইকে দেখিয়ে তা পুকুরে ফেলে দেওয়া হত। কালি তৈরির পদ্ধতি: কলম তৈরির পাশাপাশি কালিও লেখকরা নিজেরাই তৈরি করতেন। এক্ষেত্রেও তাঁরা বড়োদের সাহায্য নিতেন। কোনোরকম আয়োজন ছাড়াই এক সহজ পদ্ধতিতে তাঁরা কালি তৈরি করতেন। কাঠের উনুনে কড়াই বসিয়ে তার তলায় জমে যাওয়া কালি তাঁরা লাউ পাতা দিয়ে ঘষে তুলে জলে গুলে নিতেন। কখনো কখনো তার সঙ্গে হরীতকীও মেশাতেন। আবার কখনও আতপ চাল ভেজে পুড়িয়ে তা বেটে ওই জলের সঙ্গে মেশানো হত। তারপর ওই জলে একটা খুন্তির গোড়ার দিক পুড়িয়ে লাল টকটকে করে ছ্যাঁকা দেওয়া হত। সবশেষে ন্যাকড়ায় হেঁকে মাটির দোয়াতে কালি ভরা হত। এইভাবেই লেখকের শৈশবজীবনে ‘লেখালেখি’-র সূচনা হয়।
৫. “ভাবি, আচ্ছা, আমি যদি জিশু খ্রিস্টের আগে জন্মাতাম।”কোন্ প্রসঙ্গে লেখকের এই ভাবনা? জিশু খ্রিস্টের আগে জন্মালে তিনি কী করতেন?
উত্তর – প্রসঙ্গ: লেখক শ্রীপান্থ ছেলেবেলায় বাঁশের কলম, মাটির দোয়াত, ঘরে তৈরি কালি আর কলাপাতা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। ফেলে আসা দিনের কথা মনে করতে গিয়ে তিনি আলোচ্য প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন। কম্পিউটারের ব্যবহার অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলমের ব্যবহার কমতে থাকে। কলমের এই দুরবস্থায় লেখকের মন ব্যথিত হয়েছে। শৈশবের লেখালেখির দিনগুলোর কথা তাঁর মনে পড়েছে। সেই সঙ্গে ইতিহাসের পথ ধরে তিনি পরিক্রমা করেছেন। এই প্রসঙ্গেই তাঁর মনে উল্লিখিত ভাবনাটি এসেছে।
লেখকের ইতিহাস ভাবনা: প্রাচীন মিশরের প্রসঙ্গ: লেখক ভেবেছেন, তাঁর যদি প্রাচীন মিশরে জন্ম হত, তাহলে তিনি নীল নদের তীর থেকে নলখাগড়া ভেঙে নিয়ে এসে সেটিকে ভোঁতা করে তুলি বানিয়ে লিখতেন। প্রাচীন সুমেরীয় বা ফিনিসীয়দের প্রসঙ্গ: আবার বাঙালি না হয়ে তিনি যদি হতেন প্রাচীন সুমেরীয় বা ফিনিসীয় তাহলে তাঁকে অন্যভাবে কলম বানাতে হত। ফিনিসীয় হলে হয়তো বন থেকে একটা হাড় কুড়িয়ে এনে তা-ই দিয়েই একটা কলম বানিয়ে নিতেন। প্রাচীন রোমের প্রসঙ্গ: লেখক ভেবেছেন, রোম সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলে তিনি জুলিয়াস সিজারের মতো ব্রোঞ্জের শলাকা বা স্টাইলাস ব্যবহার করতেন। সিজার যে কলমটি দিয়ে কাসকাকে আঘাত করেছিলেন, সেটি আসলে ছিল ব্রোঞ্জের ধারালো শলাকা। প্রাচীন চিনের প্রসঙ্গ: চিনাদের কলম অবশ্য তুলি। এইভাবে লেখক কলম আবিষ্কারের প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যেতে চেয়েছেন।
৬. “কাল গুণে বুঝি বা আজ আমরাও তাই।”—এখানে কোন্ বিশেষ অবস্থার কথা বলা হয়েছে? এহেন অবস্থার কারণ কী?
উত্তর – বিশেষ অবস্থা: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে লেখক শ্রীপান্থ বলেছেন—“কালি নেই, কলম নেই, বলে আমি মুনশি!” আধুনিক যুগেও কম্পিউটার নির্ভরতার কারণে কলম তার গুরুত্ব হারিয়েছে। কলমের সঙ্গে সংযোগহীন এই অবস্থার কথাই লেখক এখানে বলেছেন।
উক্ত অবস্থার কারণ: ‘কালি কলম মন, লেখে তিন জন’—লেখক কথাকে মন থেকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বাস্তবে কলমের অভাব তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। সংবাদপত্র অফিসে তাঁর কাজ। কিন্তু একমাত্র প্রবন্ধকার ছাড়া আর কারও কাছেই কলম নেই। সকলের সামনেই রয়েছে কম্পিউটারের মনিটর, আর হাতের কাছে কি-বোর্ড। সেখানে বোতামে ছাপা রয়েছে একটি করে হরফ, যাতে লেখকের সহকর্মীরা হাত লাগিয়ে টাইপ করে চলেছেন আর পর্দার দিকে তাকাচ্ছেন। এরকম অবস্থায় প্রবন্ধকার যদি কোনোদিন কোনো কারণে কলম নিয়ে যেতে ভুলে যান তাহলে বিপদ, কারণ কারও কাছেই কলম চেয়ে পাওয়া যায় না। যদিও বা পাওয়া যায়, তা ব্যবহার অযোগ্য কোনোভাবে কাজ সারতে হয়। অথচ তাঁদের অফিস ‘লেখালেখির অফিস’ হিসেবেই পরিচিত। অন্যভাবে এ হল ‘লেখকের কারখানা’। এই পরিবেশে লেখক নিজেকে ‘কলন ছাড়া মুনশি’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজকাল মানুষের যন্ত্রনির্ভরতা তাকে তার পুরোনো অভ্যাস ও গৌরব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তাই যথেষ্ট চিন্তিত এবং হতাশ হয়েই প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন।
বহুবিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর
ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. গ্রামাঞ্চলেও আজ আর কীসের কলম খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে লেখক ভেবেছেন?
(ক) বাঁশের কঞ্চির কলম
(খ) খাগের কলম
(গ)পার্কার পেন
(ঘ) কাউন্টেন পেন
২. কোন্ কলম একমাত্র সরস্বতী পুজোর সময় দেখা যায়?
(ক) বাঁশের কঞ্চির কলম
(খ) খাগের কলম
(গ) ফাউন্টেন পেন
(ঘ) বল-পেন
৩. সরস্বতী পুজোতে কাচের দোয়াতে কালির বদলে কী দেওয়া হয়?
(ক) জল
(খ) মধু
(গ) দুধ
(ঘ) চিনির জল
৪. পালকের কলমের ইংরেজি নাম-
(ক) ফাদার পেন
(খ) জাপানি পাইলট
(গ) কুইল
(ঘ) ডট-পেন
৫. বাঙালি সাংবাদিকদের কে ‘বাবু কুইল ড্রাইভারস’ বলতেন?
(ক) লর্ড ক্যানিং
(খ) লর্ড কার্জন
(গ) লর্ড ওয়েলেসলি
(ঘ) লর্ড বেন্টিঙ্ক
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. খাগের কলমের ব্যবহার এখন কোন্ সময়ে দেখা যায়?
উত্তর – খাগের কলমের ব্যবহার এখন সরস্বতী পুজোর সময় দেখা যায়।
২. পালকের কলমের ইংরেজি নাম কী?
উত্তর – পালকের কলমের ইংরেজি নাম হল কুইল।
৩. বাঙালি সাংবাদিকদের ইংরেজি দেখে কে, কী বলতেন?
উত্তর – বাঙালি সাংবাদিকদের ইংরেজি দেখে লর্ড কার্জন ‘বাবু কুইল ড্রাইভারস বলতেন।
৪. পালকের কলম বর্তমানে দেখার জন্য কীসের ওপর নির্ভর করতে হয়? অথবা, ‘কুইল’ এখন কোথায় দেখতে পাওয়া যায়?
উত্তর – পালকের কলম বা ‘কুইল’ বর্তমানে দেখার জন্য পুরোনো দিনের তৈলচিত্র বা ফোটোগ্রাফের ওপর নির্ভর করতে হয়।
৫. এমন দুটি চিত্রের উল্লেখ করো যাতে পালকের কলম দেখা যায়।
উত্তর – উইলিয়াম জোন্সের ও সমুনশি কেরি সাহেবের চিত্র দুটিতে পালকের কলম দেখা যায়।
৬. পালক কেটে কলম তৈরি করার জন্য সাহেবরা কী করেছিলেন?
উত্তর – পালক কেটে কলম তৈরি করার জন্য সাহেবরা পেনসিল শার্পনারের মতো এক ধরনের যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। কলম বানানোর জন্য তাতে ব্লেড ছিল।
৭. “কিন্তু সে সব ফাঁকি মাত্র।”—এই উক্তির তাৎপর্য কী?
উত্তর – পালক কলম এবং দোয়াত কলমের পরিবর্তে অফিসে ছদ্মবেশী বল-পেন সাজানো থাকে, যাকে লেখক বলেছেন “ফাঁকি মাত্র।
৮. “কিছুকাল আগে একজন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছিলেন…” — কী লিখেছিলেন?
উত্তর – কিছুকাল আগে একজন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছিলেন যে, কলকাতার চৌরঙ্গিতে তিন জন ফেরিওয়ালার মধ্যে এক জন কলমবিক্রেতা।
৯. “দার্শনিক তাঁকেই বলে”— দার্শনিক কাকে বলা হয়?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখকের মতে যিনি কানে কলম গুঁজে দুনিয়া খোঁজেন তাকেই দার্শনিক বলা হয়।
১০. “কেউ কেউ অবশ্য চুলেও কলম ধারণ করেন।”— এই প্রসঙ্গে শ্রীপান্থ কী উদাহরণ দিয়েছেন?
উত্তর – আলোচ্য প্রসঙ্গে শ্রীপান্থ উদাহরণ দিয়েছেন, ভিড় ট্রাম বা বাস থেকে নামার সময় দেখা যায়, কোনো কোনো মহিলা যাত্রীর খোঁপায় কলম গোঁজা রয়েছে।
১১. “কলম এখন সর্বজনীন।” — তাৎপর্য কী?
উত্তর – সস্তা এবং সর্বভোগ্য হওয়ার ফলে হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় কলম সম্পর্কে লেখক এমন মন্তব্য করেছেন।
১২. “কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য।”— অস্পৃশ্য কেন?
উত্তর – কলম অতি সস্তা এবং সর্বভোগ্য হওয়ার ফলে পকেটমারও এখন কলম চুরি করে না। তাই বলা হয়েছে তাদের কাছে কলম অস্পৃশ্য ।
১৩, “কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য।”— কাদের কাছে?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখক বলেছেন, কলম সস্তা হয়ে যাওয়ার ফলে হাত সাফাইয়ের কাজে নিযুক্ত পকেটমারদের কাছে কলম অস্পৃশ্য হয়ে যায়।
১৪. কলমের দুনিয়ায় সত্যিকারের বিপ্লব কীভাবে ঘটেছে?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখক বলেছেন কলমের দুনিয়ায় সত্যিকারের বিপ্লব ঘটেছে ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কারের ফলে।
১৫. “নামটা রবীন্দ্রনাথের দেওয়াও হতে পারে।”— কোন্ নামের কথা বলা হয়েছে।
উত্তর – ফাউন্টেন পেনের যে বাংলা নাম ঝরনা কলম একদা প্রচলিত ছিল, এখানে সেই নামের কথা বলা হয়েছে।
১৬. ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কারক কে?
উত্তর – ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কারক হলেন লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
১. “পালকের কলম তো দূরস্থান, দোয়াতকলমই বা আজ কোথায়।”—পালকের কলম সম্পর্কে লেখক কী জানিয়েছেন? দোয়াতকলম প্রসঙ্গে লেখক কী বলেছেন?
উত্তর – পালকের কলম সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য: আজকাল কলম এবং দোয়াতের ব্যবহার কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক শ্রীপান্থ আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
পালকের কলমকে ইংরেজিতে বলা হয় কুইল। বাঁশের কলম, খাগের কলম চলে যাওয়ার পর একসময় পালকের কলমের আধিপত্য ছিল। পাখির পালক দিয়ে তৈরি হত এই কলম। লেখক আক্ষেপ করেছেন, “পালকের কলম দেখতে হলে পুরানো দিনের তৈলচিত্র কিংবা ফটোগ্রাফ ছাড়া গতি নেই।” ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধেও পালকের কলমের প্রচলন ছিল। উইলিয়াম জোন্স বা স-মুনশি কেরি সাহেবের ছবিতে দেখা যায় পালকের কলম। মিশনারিরা এবং ইংরেজ সাহেবরা পালক কেটে কলম তৈরির জন্য পেনসিল শার্পনারের মতো এক প্রকারের যন্ত্রও বানিয়েছিলেন।
দোয়াতকলম প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য: লেখক দোয়াত-কলমের নানা বৈচিত্র্যের উল্লেখ করেছেন। কাচের, কাট-গ্লাসের, পোর্সেলিনের, শ্বেতপাথরের, জেডের, পিতলের, এমনকি গোরুর শিং বা সোনার দোয়াতও আগে পাওয়া যেত। লেখক নিজে সুভো ঠাকুরের দোয়াতের সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। এমনকি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বয়স্করা আশীর্বাদ দিতেন—“তোমার সোনার দোয়াতকলম হোক।” সেই দোয়াতকলম আজ উধাও। কোনো কোনো অফিসে গিয়ে লেখক ছদ্মবেশী দোয়াত এবং কলম টেবিলে সাজানো দেখেছেন, আসলে এই পেন হল বল-পেন।
২. ‘ফাউন্টেন পেন’ বাংলায় কী নামে পরিচিত? নামটি কার দেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে? ফাউন্টেন পেনের জন্ম-ইতিহাস লেখো।
উত্তর – ফাউন্টেন পেনের বাংলা নাম: ফাউন্টেন পেনের বাংলা নাম ঝরনা কলম।
বাংলা নামকরণ: শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় নামটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জন্ম-ইতিহাস: পণ্ডিতদের মতে, কলমের দুনিয়ায় সত্যিকারের বিপ্লব ঘটিয়েছে ফাউন্টেন পেন। কিন্তু এর জন্ম-ইতিহাসটি বেশ চমকপ্রদ।
আবিষ্কারক: এর আবিষ্কারক লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান। তিনি এই নতুন ধরনের কলম তৈরি করে অফুরন্ত কালির ফোয়ারা খুলে দিয়েছিলেন। চুক্তিপত্র সই: সেকালের আরও অনেক ব্যবসায়ীর মতো তিনিও দোয়াতকলম নিয়ে কাজে বের হতেন। একবার তিনি গিয়েছেন আর-একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করতে। দলিল কিছুটা লেখা হয়েছে এমন সময় দোয়াত হঠাৎ উপুড় হয়ে কাগজে পড়ে গেল। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি ছুটলেন কালির সন্ধানে। ফিরে এসে শোনেন, ইতিমধ্যে অন্য একজন তৎপর ব্যবসায়ী সইসাবুদ শেষ করে চুক্তিপত্র পাকা করে গেছেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া: এই ঘটনায় বিমর্ষ ওয়াটারম্যান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, এর একটা বিহিত করতেই হবে। অর্থাৎ এমন একটা পদ্ধতির খোঁজ করতে হবে যেখানে কলমের সঙ্গে কালির দোয়াত নিয়ে ঘুরতে হবে না। তারপরই আবিষ্কার করলেন ফাউন্টেন পেন। নবযুগের প্রতিষ্ঠা: দোয়াতের যুগের অবসান ঘটিয়ে কালক্রমে এই ফাউন্টেন পেন লেখালেখির নবযুগের প্রতিষ্ঠা ঘটাল।
৩. “কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য।”—কলম কাদের কাছে অস্পৃশ্য? কলম সম্পর্কে লেখক কেন এরকম বলেছেন?
উত্তর – কলম যাদের কাছে অস্পৃশ্য: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় সময়ের অগ্রগতিতে কলমের পরিণতি দেখে লেখক নিখিল সরকার এই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন।
আধুনিকতার পথে কলমও ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে মানুষের হাত থেকে। সময়ের ধারায় বাঁশের পেন, পালকের পেন ক্রমশ হারিয়ে গিয়ে সেই জায়গায় এল ফাউন্টেন পেন। তারপর সস্তার বল-পেন বাজার দখল করে নেয়। এর ফলে পকেটমারও কলম চুরি করে না— “কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য”। এরকম মন্তব্যের কারণ: একসময়ে মানুষের লেখার একমাত্র অবলম্বন ছিল বাঁশের কলম। শৈশবে লেখকরা এরূপ কলম নিজেরাই বানাতেন। সময়ের অগ্রগতিতে বাঁশের কলম উধাও হয়ে এল পালকের কলম। তারপর ফাউন্টেন পেন এবং বল-পেন বাজার দখল করল। ধীরে ধীরে ফেরিওয়ালারাও কলম বিক্রিকে পেশা করল। লেখক অতি-আধুনিক ছেলেদের বুকপকেটের পরিবর্তে কাঁধের ছোটো পকেটে কলম সাজিয়ে রাখতে দেখেছেন। এমনকি ভিড় ট্রামেবাসে মহিলাদের মাথার খোঁপাতেও কলম গোঁজা রয়েছে—এমনও দেখা গিয়েছে। লেখকের ভাষায়—“বিস্ফোরণ। কলম বিস্ফোরণ।” সস্তার কলম বাজারে আসার পরে কলম সুলভ ও সর্বভোগ্য হয়ে উঠল। এভাবেই কলম একসময় তার কদর হারিয়ে ফেলল। ফলে যে পকেটমার একসময় কলম হাতসাফাই করত তার কাছেও কলম অস্পৃশ্য হয়ে গেল।
৪. “পণ্ডিতরা বলেন কলমের দুনিয়ায় যা সত্যিকারের বিপ্লব ঘটায় তা ফাউন্টেন পেন।”—ফাউন্টেন পেন কলমের দুনিয়ায় কীভাবে বিপ্লব ঘটিয়েছিল তা লেখো।
উত্তর – কথামুখ: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে শ্রীপান্থ লেখার দুনিয়ায় ফাউন্টেন পেনের কার্যকারিতা বোঝাতে গিয়ে মন্তব্যটি করেছেন। চুক্তিপত্র সই: লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান ব্যক্তিগত জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে চেয়েছিলেন দোয়াতে কলম ডুবিয়ে লেখালেখির একটা বিকল্প খুঁজে নিতে। ফাউন্টেন পেন আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে দোয়াত-কালি সঙ্গে নিয়ে ঘোরার দিনের অবসান ঘটে। এরপর থেকে সস্তা—ফাউন্টেন পেনের অজস্র সংস্করণ বের হয়। বিশেষত্ব: ফাউন্টেন পেনের বিশেষত্বই হল তা ব্যবহারকারীকে ক্রমশ নেশাগ্রস্ত করে তোলে। লেখক শৈলজানন্দের ছিল এরকম ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের নেশা। আবার তা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। লুপ্তপ্রায়: প্রথম দিকে ফাউন্টেন পেন সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। রকমারি চেহারার সস্তা এবং দামি ফাউন্টেন পেন বাজারে আসার পরে দোয়াতকলম ক্রমশ বাজার থেকে হটে যায়। সেগুলি হয়ে ওঠে ঘর সাজানোর উপকরণ। বাঁশের বা কঞ্চির কিংবা খাগের কলম, কালির আধার, ব্লটিং পেপার—এসব জিনিসই ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যায়। সহজসাধ্য: সব পড়ুয়ার পকেটেই দেখা যায় ফাউন্টেন পেন। এভাবে একদিকে লেখা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে, অন্যদিকে লেখার উপকরণের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়াও সম্ভব হয়। এভাবেই কলমের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল ফাউন্টেন পেন।
৫. ওয়াটারম্যান কীভাবে কালির ফোয়ারা খুলে দিয়েছিলেন?
উত্তর – কথামুখ: লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো তিনিও দোয়াতকলম নিয়ে কাজে বের হতেন। চুক্তিপত্র সই: একবার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করতে গিয়ে দোয়াত থেকে কালি ফেলে দিলেন সেই দলিলে। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি শূন্য দোয়াতে কালি ভরতে ছুটলেন। কিন্তু ফিরে এসে শোনেন, ইতিমধ্যে আরএকজন ব্যবসায়ী এসে সেই চুক্তিপত্রে সই করে চুক্তি পাকা করে ফেলেছেন। বিকল্প পদ্ধতির খোঁজ: হতাশ ও বিমর্ষ ওয়াটারম্যান তখনই ঠিক করলেন, তিনি এমন একটা পদ্ধতির খোঁজ করবেন যেখানে কলমের সঙ্গে কালির দোয়াত নিয়ে ঘুরতে হবে না। এইভাবেই জন্ম নিল ফাউন্টেন পেন। রিজার্ভার পেন: ফাউন্টেন পেনের আগের নাম রিজার্ভার পেন। ওয়াটারম্যান তাকেই উন্নত করে তৈরি করেছিলেন ফাউন্টেন পেন। কলম হিসেবে ফাউন্টেন পেনের বিরাট প্রসার ঘটে। হরেক রকম নিব ও কোম্পানি: একটি বিজ্ঞাপনে লেখক দেখেছিলেন তাঁদের তহবিলে নাকি রয়েছে সাতশোরকম নিব। দোকানে গিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির নাম লেখক শুনেছিলেন—পার্কার, শেফার্ড, সোয়ান ইত্যাদি। লেখক উল্লেখ করেছেন, তিনি যখন কলেজে পড়তেন, তখন তাঁর সব বন্ধুর পকেটেই ছিল ফাউন্টেন পেন। শেষকথা: সুতরাং, ওয়াটারম্যান তাঁর আবিষ্কারের পর সত্যিই যেন কালির ফোয়ারা খুলে দিয়েছিলেন।
৬. “বিমর্ষ ওয়াটারম্যান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন —আর নয়, এর একটা বিহিত তাঁকে করতেই হবে।”—ওয়াটারম্যান কে? তিনি বিমর্ষ কেন? তাঁর প্রতিজ্ঞার ফল কী হয়েছিল?
উত্তর – ওয়াটারম্যানের পরিচয়: লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান ছিলেন ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কারক।
বিমর্ষতার কারণ: ওয়াটারম্যান সেকালের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মতোই দোয়াতকলম নিয়ে কাজে বের হতেন। একবার তিনি গিয়েছিলেন অন্য একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটা চুক্তিপত্র সই করতে। যখন দলিল কিছুটা লেখা হয়েছে ঠিক সেই সময়ে হঠাৎই দোয়াত কাগজে উপুড় হয়ে পড়ে যায়, ফলে তাঁকে বাধ্য হয়েই কালির সন্ধানে যেতে হয়। কালি সংগ্রহ করে ফিরে এসে দেখেন যে, অন্য একজন তৎপর ব্যবসায়ী সইসাবুদ করে চুক্তিপত্র পাকা করে চলে গেছেন। এই ঘটনাতেই ওয়াটারম্যান বিমর্ষ হয়ে যান।
প্রতিজ্ঞার ফল: বিমর্ষ ওয়াটারম্যানের প্রতিজ্ঞা জন্ম দিয়েছিল ফাউন্টেন পেনের। কলমের দুনিয়ায় এই পেন বিপ্লব ঘটিয়েছিল। বাঁশের কঞ্চির কলম, খাগের কলম, পালকের কলম ইত্যাদির যুগের অবসান হল। পাশাপাশি দোয়াতে কলম ডুবিয়ে লেখার দিনও শেষ হল। ধীরে ধীরে সস্তা এবং দামি নানারকম ফাউন্টেন পেনে বাজার দখল করে নিল। সকলের কাছে এই কলম গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। দোয়াতকলমের যুগের অবসানে আমাদের লেখালেখি আধুনিক যুগে প্রবেশ করল। এই পরিবর্তনের মূলে ছিল ওয়াটারম্যানের প্রতিজ্ঞা।
৭. “আমার মনে পড়ে প্রথম ফাউন্টেন কেনার কথা।”—লেখক কোথায় ফাউন্টেন কিনতে গিয়েছিলেন? তাঁর কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
উত্তর – স্থান: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখক জানিয়েছেন কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের একটি নামি দোকানে তিনি ফাউন্টেন পেন কিনতে গিয়েছিলেন।
অভিজ্ঞতা: ফাউন্টেন পেন আবিষ্কার পেনের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে এক অফুরন্ত কালির ফোয়ারা খুলে দিয়েছিল। ফাউন্টেন পেন কিনতে যাওয়া: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকবছর পরে কোনো-একদিন লেখক কলেজ স্ট্রিটের একটি নামি দোকানে ফাউন্টেন পেন কিনতে গিয়েছিলেন। দোকানদার তাঁকে পার্কার, শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, সোয়ান, পাইলট হরেক রকম পেনের নাম ও তাদের দামের কথাও বলেন। জাপানি পাইলট পেন কেনা: লেখকের মুখের অবস্থা দেখে আর তাঁর পকেটের অবস্থা বুঝতে পেরে দোকানদার তাঁকে একটা সস্তা জাপানি পাইলট কলম কিনতে বলেন। দোকানদার পেনটির ঢাকনা খুলে একটি কাঠের বোর্ডের ওপর ছুঁড়ে দেন। সার্কাসে যেমন জীবন্ত মানুষের দিকে ছুরি ছুঁড়ে দেওয়ার পরও সে অক্ষত থাকে, বোর্ড থেকে খুলে দোকানদারও দেখান, পেনটার নিব অক্ষত আছে। তারপর তিনি দু-এক ছত্র লিখেও দেখান। আনুমানিক পনেরো-ষোলো বছরের কিশোর লেখকের কাছে পেনটি জাদুপেন বলেই মনে হয়। তবুও: লেখক পরবর্তীকালে অনেক ফাউন্টেন পেন কিনলেও বহুদিন ওই জাপানি পাইলটটি তিনি যত্ন করে রেখেছিলেন।
বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর
ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. আদিতে ফাউন্টেন পেনের নাম ছিল-
(ক) রিজার্ভার পেন
(খ) বল-পেন
(গ) ঝরনা কলম
(ঘ) ব্যারেল পেন
২. লেখক কাচের দোয়াতে কালি ভরেছেন যা দিয়ে, তা হল-
(ক) কালি ট্যাবলেট
(খ) জল কালি
(গ) আলতা
(ঘ) নীল রং
৩. “তাদের বাহারি সব নাম”— কী নাম?
(ক) সুলেখা কালি
(খ) বাবা কালি
(গ) আলতা কালি
(ঘ) স্থায়ী কালি
৪. পালকের কলম তাড়াতাড়ি ভোঁতা হয়ে যেত, তাই টেকসই করার জন্য কীসের নিব তৈরি হয়েছিল?
(ক) গোরুর শিঙের
(খ) কচ্ছপের খোলের
(গ) ক ও খ উভয়ই
(ঘ) কোনোটিই নয়
৫. ফাউন্টেন পেন বাজার দখল করে সরিয়ে দিয়েছিল-
(ক) দোয়াত আর কলমকে
(খ) বল-পেনকে
(গ) পালকের পেনকে
(ঘ) বাঁশের কলমকে
৬. “দোয়াত যে কত রকমের হতে পারে”—যেমন-
(ক) কাচের
(খ) জেডের
পিতলের
(ঘ) সবগুলির
৭. লেখক কার কাছে সোনার দোয়াতকলম দেখেছিলেন?
(ক) সুভো ঠাকুরের কাছে
শৈলজানন্দের কাছে
(গ) শরৎচন্দ্রের কাছে
(ঘ) অন্নদাশঙ্করের কাছে
৮. দোয়াতের কালি দিয়ে লিখে অমর হয়েছেন এমন সাহিত্যিকের উদাহরণ হিসেবে লেখক কার কথা বলেছেন?
(ক) মতি নন্দী
(খ) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
(গ) কাশীরাম দাস
(ঘ) মধুসূদন দত্ত
৯. ফাউন্টেন পেনের পর যে পেন বাজার দখল করেছে, তা হল-
(ক) নিব-পেন
(খ) বল-পেন
(গ) পালকের কলম
(ঘ) খাগের কলম
১০. সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একের পর এক যেসব পেন এসেছে তার ক্রমতালিকাটি হল-
(ক) বাঁশের পেন—পালকের পেন—ফাউন্টেন পেন—বল-পেন
(খ) বল-পেন—পালকের পেন—ফাউন্টেন পেন—বাঁশের পেন
(গ) বাঁশের পেন— বল-পেন—ফাউন্টেন পেন—পালকের পেন
(ঘ) পালকের পেন—ফাউন্টেন পেন—বল-পেন—বাঁশের পেন
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. প্রথমে ফাউন্টেন পেনের নাম কী ছিল?
উত্তর – শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় জানা যায় প্রথমে ফাউন্টেন পেনের নাম ছিল রিজার্ভার পেন।
২. “আমি ছিলাম কালি কলমের ভক্ত।” —এখানে কী বলতে চেয়েছেন লেখক?
উত্তর – লেখক পুরোনো দিনের দোয়াত-ভরা কালি আর নিবের ভক্ত ছিলেন। আলোচ্য অংশে লেখক সেই কথাটিই বলতে চেয়েছেন।
৩. ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে দোয়াতে এবং বোতলে তৈরি করে রাখা কালির কী কী নাম পেয়েছ?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে দোয়াতে এবং বোতলে তৈরি করে রাখা কালির কাজল কালি, সুলেখা ইত্যাদি নাম পেয়েছি।
৪. বিদেশে উন্নত ধরনের নিব টেকসই করার জন্য কী দিয়ে বানানো হত?
উত্তর – বিদেশে উন্নত ধরনের নিব টেকসই করার জন্য গোরুর শিং অথবা কচ্ছপের খোল কেটে বানানো হত।
৫. “ক্রমে হঠিয়ে দেওয়া হলো দোয়াত আর কলমকে।”— কীভাবে হঠিয়ে দেওয়া হল?
উত্তর – ফাউন্টেন পেনের সস্তা, দামি, উন্নত নানা ধরনের সম্ভার বাজারে আসার ফলে দোয়াত এবং কলম ক্রমশ বাজার থেকে হটে গেল।
৬. একসময় লেখা শুকোনো হত কী দিয়ে?
উত্তর – শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনা থেকে জানা যায়, প্রথমে বালি এবং পরে ব্লটিং পেপারে একসময় লেখা শুকোনো হত।
৭. “না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।” —কী প্রসঙ্গে লেখক এরূপ বলেছেন?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় দোয়াতের বৈচিত্র্য প্রসঙ্গে লেখক এ কথা বলেছেন।
৮. গ্রামে কেউ দু-একটা পাস করতে পারলে বুড়োবুড়িরা কী বলে আশীর্বাদ করতেন?
উত্তর – গ্রামে কেউ দু-একটা পাস করতে পারলে বুড়োবুড়িরা তাকে ‘সোনার দোয়াতকলম হোক’ বলে আশীর্বাদ করতেন।
৯. “সোনার দোয়াত কলম যে সত্যিই হতো” তা লেখক কীভাবে জেনেছিলেন?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনা থেকে জানা যায়, সোনার দোয়াতকলম যে সত্যিই হত তা লেখক জেনেছিলেন সুভো ঠাকুরের দোয়াতের সংগ্রহ দেখে।
১০. সুভো ঠাকুরের দোয়াতের সংগ্রহ দেখে অবাক হয়ে মনে মনে লেখক কী ভেবেছিলেন?
উত্তর – লেখক অবাক হয়ে মনে মনে ভেবেছিলেন, এই ধরনের দোয়াতের কালি ও কলম দিয়েই শেকসপিয়র, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, কাশীরাম, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ সাহিত্যিক তাঁদের অমর রচনা লিখে গিয়েছেন।
১১. “ক্রমে তা-ও বুঝিবা যায় যায়।” – কেন লেখক এরূপ বলেছেন?
উত্তর – যন্ত্রযুগের উন্নতির কারণে ফাউন্টেন পেনও তার আধিপত্য এবং বাজারজোড়া সর্বজনীন রূপ হারিয়ে বল-পেনের জয় দেখতে চলেছে। সেই প্রসঙ্গেই লেখক এরূপ বলেছেন।
১২. ফাউন্টেন পেন বিক্রি করে এমন একটি কোম্পানি গর্ব প্রকাশ করে কী বিজ্ঞাপন দিয়েছিল?
উত্তর – ফাউন্টেন পেন বিক্রি করে, এমন একটি কোম্পানি গর্ব করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল যে, তাদের তহবিলে সাতশো রকমের নিব থাকে।
১৩. “যন্ত্রযুগ সকলের দাবি মেটাতেই তৈরি।”—উক্তিটির প্রসঙ্গ লেখো।
উত্তর – গায়ক, শিল্পী, শ্রুতিলেখক, বাম হাতে লেখা লোক, এমনকি ধনী ব্যক্তিসকলের আলাদা আলাদা নিবের চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে এরূপ বলা হয়েছে।
১৪. “আশ্চর্য, সবই আজ অবলুপ্তির পথে।”—কী আজ অবলুপ্তির পথে?
উত্তর – ফাউন্টেন পেন থেকে বল পয়েন্ট পেন—সবই আজ অবলুপ্তির পথে। কম্পিউটার যুগে কলমের ব্যবহার কমতে থাকায় লেখক এই কথা বলেছেন।
১৫. “আমার মতো আরো কেউ কেউ নিশ্চয় বিপন্ন বোধ করছেন।” —কী বিষয়ে বিপন্ন বোধের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর – লেখকের মতো যারা কলম ব্যবহার করেন তাদের বিপন্ন অবস্থা, কারণ কম্পিউটারের দৌলতে কলম আজ ক্রমশ অবলুপ্তির পথে।
১৬. “কিন্তু ইতিহাসে ঠাঁই কিন্তু তার পাকা।” –লেখক কী প্রসঙ্গে এরূপ বলেছেন?
উত্তর – ইতিহাসে কলমের স্থান পোক্ত। কারণ প্রাচীন কাল থেকে কলম শিক্ষাশিল্প-সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
১৭. ক্যালিগ্রাফিস্ট বা লিপিকুশলী কাদের বলা হয়?
উত্তর – পারদর্শী লিপিকর বা ক্যালিগ্রাফিস্টদের বলা হয় লিপিকুশলী।
১৮. “মুঘল দরবারে একদিন তাঁদের কত না খাতির”—কাদের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর – শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনার অন্তর্গত প্রশ্নোধৃত অংশে লিপিকুশলী বা ‘ক্যালিগ্রাফিস্ট’-দের কথা বলা হয়েছে।
১৯. “সমানি সম শীর্ষাণি ঘনানি বিরলানি চ।”— বাংলা অর্থ কী?
উত্তর – শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনার অন্তর্গত থেকে প্রশ্নোদৃত উক্তিটির বাংলা অর্থ হল—“সব অক্ষর সমান, প্রতিটি ছত্র সুশৃঙ্খল, পরিচ্ছন্ন।”
২০. “অথচ কত সামান্যই না রোজগার করতেন ওঁরা।” এরকম বক্তব্যের কোন্ উদাহরণ লেখক দিয়েছেন?
উত্তর – উদ্ধৃত বক্তব্যের সপক্ষে উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন, অষ্টাদশ শতকে চার খণ্ড রামায়ণ লিখে একজন লেখক পেয়েছিলেন নগদ সাত টাকা, কিছু কাপড় আর মিঠাই।
২১. “লিখে কম রোজগার হত’ -এ-প্রসঙ্গে সাহেব কী লিখে গেছেন?
উত্তর – ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, এক সাহেব লিখে গেছেন, উনিশ শতকে বারো আনায় বত্রিশ হাজার অক্ষর লেখানো হত।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
১. “দোয়াত যে কত রকমের হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।”—কত রকমের দোয়াতের কথা বলেছেন বক্তা? এই প্রসঙ্গে তিনি আর কী তথ্য দিয়েছেন পাঠ্যরচনা অবলম্বনে লেখো।
উত্তর – দোয়াতের রকমভেদ: শ্রীপান্থ তাঁর ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় দোয়াতের নানারকম বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন— কাচের, কাঠ-গ্লাসের, পোর্সেলিনের, শ্বেতপাথরের, জেডের, পিতলের, ব্রোঞ্জের, ভেড়ার শিং-এর এমনকি সোনারও।
প্রসঙ্গক্রমে লেখকের দেওয়া তথ্য: সুভো ঠাকুরের প্রসঙ্গ: লেখক শ্রীপান্থ উল্লেখ করেছেন যে, সোনার দোয়াতকলম যে সত্যিই হতে পারে তা তিনি জেনেছিলেন সুভো ঠাকুরের বিখ্যাত দোয়াত সংগ্রহ দেখতে গিয়ে। আবার তিনি এ কথাও জেনেছেন যে, গ্রামে কেউ দু-একটা পাস করলে বুড়োবুড়িরা আশীর্বাদ করে বলতেন, “বেঁচে থাকো বাছা, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।” ইতিহাসের প্রসঙ্গ: এ ছাড়াও শ্রীপান্থ কোনো কোনো দোয়াতের সঙ্গে সাহিত্য এবং ইতিহাসের নানা চরিত্রের যোগের কথাও মনে করেছেন। অবিস্মরণীয় সাহিত্যসৃষ্টি: অবাক হয়ে লেখক ভেবেছেন যে শেকসপিয়র, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভবভূতি, কাশীরাম দাস, কালি দিয়ে তাঁদের অবিস্মরণীয় রচনাগুলি লিখে গিয়েছেন। দোয়াতের যুগের কৃত্তিবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র সকলেই এইসব দোয়াতের অবসান: কিন্তু ফাউন্টেন পেন আসার সঙ্গে সঙ্গে এইসব দোয়াতের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন সেগুলি নিতান্তই ঘর সাজানোর উপকরণ। প্রথমে বাঁশের বা কঞ্চির কলম। পরে নিবের কলম—লেখকের লেখালেখির ক্ষেত্রে দোয়াতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ‘কালি কলমের ভক্ত’ লেখক ফাউন্টেন পেনের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গেই এই দোয়াতের যুগের অবসানকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
২. “আশ্চর্য, সবই আজ অবলুপ্তির পথে।”—কোন্ জিনিস আজ অবলুপ্তির পথে ? এই অবলুপ্তির কারণ কী? এ বিষয়ে লেখকের মতামত কী?
উত্তর – অবলুপ্তির পথে যা: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লেখক শ্রীপান্থর মতে কলম আজ অবলুপ্তির পথে।
অবলুপ্তির কারণ: কম্পিউটারের আধিপত্য এবং তার প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা কলমের এই অবলুপ্তির কারণ।
লেখকের অভিমত: শৈশব থেকেই লেখকের শিক্ষাজীবনের সঙ্গী ছিল বাঁশের কলম, খাগের কলম, পালকের কলম ইত্যাদি। পরে বাজারে আসে ফাউন্টেন পেন। কলমের বাজারে এই পেন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এরপর ফাউন্টেন পেনকেও ম্লান করে বাজারে এসে যায় বল-পেন। কলম হয়ে ওঠে সস্তা এবং সর্বভোগ্য। সর্বজনীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলম তার নিজস্ব কদর হারাতে থাকে। একদিন যে দোয়াতকলম দিয়ে লিখে দেশবিদেশের সাহিত্যিকরা অমর সৃষ্টি রেখে গিয়েছেন, সেই দোয়াতকলম ইতিহাসের পাতায় চলে যায়। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সৃষ্টি হিসেবে কলমের জায়গা দখল করে নেয় কম্পিউটার। সাংবাদিক হিসেবে লেখার কাজেই ব্যস্ত লেখকের এক অদ্ভুত কলমপ্রীতি ছিল। বাঁশের কলম, খাগের কলম ছেড়ে বল-পেনের কাছে আত্মসমর্পণ করেও লেখক বিপন্ন বোধ করেছেন। “যদি হাতের লেখা মুছে যায় চিরকালের জন্য”—এই কথা ভেবে তিনি বিচলিত হয়ে উঠেছেন। কম্পিউটারের প্রভাবে সর্বপ্রকার কলমের অবলুপ্তির আশঙ্কাতে লেখক একইসঙ্গে আতঙ্কিত ও আশ্চর্য হয়েছেন।
৩. “কম্পিউটার তাদের জাদুঘরে পাঠাবে বলে যেন প্রতিজ্ঞা করেছে।”—‘তাদের’ বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের ঐতিহ্যের প্রতি লেখক শ্রদ্ধাশীল কেন?
উত্তর – ‘তাদের’ পরিচয়: আলোচ্য অংশটি শ্রীপান্থর লেখা ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ নামক প্রবন্ধটি থেকে গৃহীত। তাদের বলতে পুরোনো দিনের নানা ধরনের কলম, কালি ও দোয়াত-সহ ফাউন্টেন পেন এবং বলপেনের কথা বলা হয়েছে।
ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল: লেখক শ্রীপান্থ কালিকলমের ভক্ত ছিলেন। ছোটোবেলায় নানা ধরনের কলম তিনি ব্যবহার করতেন। আগে কালি তৈরির পদ্ধতিও ছিল বিচিত্র। তারপর বাজারে এল নানা ধরনের ফাউন্টেন পেন। অতীতের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা এই কালিকলম দিয়েই তাঁদের অমর রচনাগুলি লিখে গেছেন। কিন্তু পুরোনো দিনের সেই কালিকলম এবং দোয়াত এখন অবলুপ্তির পথে। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে কম্পিউটার। বোতামের ওপর চাপ দিয়ে এখন অক্ষর বিন্যাস করা যায়। লেখকের মতে, এই পদ্ধতি তো যান্ত্রিক। এতে মনের সংযোগ খুবই কম। হাতের লেখার একটি আলাদা মূল্য আছে, যার মাহাত্ম্য কম্পিউটার কখনও ক্ষুণ্ন করতে পারে না। লেখক মনে করেছেন, এই জন্যই ইতিহাসে কলমের স্থান চিরকাল গৌরবের। উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে কালি ও কলমের প্রতি তাঁর অটুট ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কথাই প্রকাশিত হয়েছে।
8. “যাঁরা ওস্তাদ কলমবাজ তাঁদের বলা হলো ‘ক্যালিগ্রাফিস্ট’ বা লিপি-কুশলী।”—লিপিকুশলীদের কাজ কী ছিল? এই প্রবন্ধে ‘লিপিকুশলী’ সম্বন্ধে যা জানা যায় তা লেখো। ১+৪ [চাকদহ রামলাল একাডেমি]
উত্তর – লিপিকুশলীদের কাজ: প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ তাঁর ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় লিপিকুশলীদের উল্লেখ করেছেন। এই লিপিকুশলীদের কাজ ছিল লিপি নকল করা।
লিপিকুশলীদের বিষয়ে জ্ঞাত তথ্য: লিপিকুশলীরা ছিলেন ওস্তাদ কলমবাজ। মর্যাদার অধিকারী: মোগল দরবার-সহ সারা পৃথিবীজুড়েই এই লিপিকুশলীদের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। বাংলা দেশে রাজা জমিদাররা লিপিকুশলীদের গুণী বলে সম্মান করতেন এবং তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। অসামান্য অক্ষরসজ্জা: সাধারণ গৃহস্থরাও লিপিকরদের ডেকে পুথি নকল করাতেন। সেসব পুথির অক্ষরসজ্জা ছিল অসামান্য ৷ প্রত্যেকটি ছত্র ছিল সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন। হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। আর্থিক অসচ্ছলতা: তবে আর্থিকভাবে লিপিকুশলীরা সচ্ছল ছিলেন না। তাঁদের রোজগার ছিল অতিসামান্য। চার খণ্ড রামায়ণ নকল করে একজন লেখক অষ্টাদশ শতকে মাত্র সাত টাকা, কিছু কাপড় আর মিঠাই পেয়েছিলেন। এমনও জানা যায় যে, উনিশ শতকে বারো আনায় বত্রিশ হাজার অক্ষর লেখানো যেত। গর্বের বিষয়; আবার পুথিকে ঘিরেই লিপিকরদের অনেক গর্ব ছিল। পুথি যাতে কেউ চুরি না করে, সেদিকে ছিল তাঁদের সতর্ক দৃষ্টি। ইতিহাসের চরিত্র: এই লিপিকররা আজ ইতিহাসের চরিত্র। তাঁদের পুথিগুলো ইতিহাসের সামগ্রী। কিন্তু একটা সময়ে কেবল একটা কলমকে সঙ্গী করেই তাঁরা নিজেরা ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে গেছেন।
৫. “মুঘল দরবারে একদিন তাঁদের কত না খাতির, কত না সম্মান?”—তাঁদের বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে? তাঁদের খাতির ও সম্মানের পরিচয় দাও।
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি ও কলম’ রচনার উল্লিখিত অংশে ‘তাঁদের’ বলতে লিপি কুশলী বা ক্যালিগ্রাফিস্টদের কথা বলা হয়েছে।
খাতির ও সম্মানের পরিচয়: লিপিকুশলীরা ছিলেন লেখকের কথায় ‘ওস্তাদ কলমবাজ’। আর্থিক অসচ্ছলতা: তাঁদের আর্থিক অবস্থা যে সবসময় ভালো হত তা নয়। আঠেরো শতকে চারখণ্ড রামায়ণ কপি করে একজন লিপিকার পেয়েছিলেন নগদ সাত টাকা, কিছু কাপড় আর মিঠাই। এক সাহেবের লেখা থেকে জানা যায় যে উনিশ শতকে বারো আনায় বত্রিশ হাজার অক্ষর লেখানো যেত। সামাজিক সম্মান; তাঁদের সামাজিক সম্মান ছিল যথেষ্টই। মুঘল দরবারে তো বটেই, সর্বত্র, এমনকি বাংলা দেশেও রাজাজমিদাররা তাঁদের গুণীর সম্মান দিতেন, ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতেন। অসামান্য অঞ্চরসজ্জা: সাধারণ গৃহস্থরাও এইসব লিপিকারদের ডেকে পুঁথির নকল করাতেন। সেসব পুঁথি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যেত। প্রতিটি ছত্র সুশৃঙ্খল এবং পরিচ্ছন্ন। মুক্তোর মতো ছিল লেখা অক্ষরগুলি। গর্ব ও আত্মিমর্যাদাবোধ: সামান্য উপার্জন করলেও সম্মান ও সমাদর তাই তাঁদের যথেষ্টই ছিল। আর সেজন্য একধরনের শিল্পীসুলভ অহংকার তাঁদের মধ্যে দেখা যেত। পুঁথি যাতে কেউ চুরি না করতে পারে তাই নিয়ে ছিল সতর্ক দৃষ্টি। খাতির, সম্মান আর আত্মমর্যাদাবোধ মিলে লিপিকাররা প্রায় লেখকের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
৬. “কলমকে বলা হয় তলোয়ারের চেয়েও শক্তিধর।”—বিভিন্ন প্রকার কলমের পরিচয় দিয়ে লেখকের এই মন্তব্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – বিভিন্ন প্রকার কলমের পরিচয়: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনায় শ্রীপান্থ কলম এবং লেখালেখির বিবর্তনের কাহিনি উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গেই তিনি বিভিন্ন রকম কলমের কথা বলেছেন। আদিপর্বের কলম: একসময় কলম তৈরি হত বাঁশের সরু কঞ্চি দিয়ে। তারপরে খাগের কলম, পশুর হাড়ের কলম, পাখির পালকের কলম, ব্রোঞ্জের কলম, তুলির কলম ইত্যাদির প্রচলন হয়। ফাউন্টেন পেন: তারপরে এল ফাউন্টেন পেন। ওয়াটারম্যানের এই আবিষ্কার কলমের দুনিয়ায় বিপ্লব এনে দিল। কালিতে ডুবিয়ে লেখা কলমগুলির যুগ শেষ হল। সস্তা, দামি নানারকম ফাউন্টেন পেন বাজার দখল করে নিল। পাইলট, পার্কার, শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, সোয়ান এরকম নানা ফাউন্টেন পেন বাজারে এল। সেইসব পেনের রকমারি ও আকর্ষণীয় নিব ও হ্যান্ডেল ছিল। প্ল্যাটিনাম, সোনা ইত্যাদি দিয়েও অভিজাতদের জন্য ফাউন্টেন পেন তৈরি হত। তারপর ফাউন্টেন পেনের পরিবর্তে বাজারে এল বল-পেন। কলম তখন আরও সস্তা ও সহজলভ্য হয়ে উঠল। লেখকের মন্তব্য: “কলম তরোয়ালের চেয়েও শক্তিধর”— লোকসমাজে প্রচলিত এই কথাটিকে প্রথমে সাহিত্যে ব্যবহার করেছিলেন ইংরেজ নাট্যকার এডওয়ার্ড বুলওয়ার-লিটন তাঁর Richelieu; or the Conspiracy নাটকে। এই মন্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, যুদ্ধবাজ এবং অস্ত্রনির্ভর মানুষদের চেয়ে কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষমতা অনেক বেশি। কলমের এই ক্ষমতার অনুষঙ্গ হিসেবেই সম্ভবত ফাউন্টেন পেনে ‘ব্যারেল’ ‘কার্টিজ’ ইত্যাদি শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। একজন শাসক যুদ্ধের দ্বারা ভূখণ্ড জিতে নিলেও, মানুষের মন জিততে পারেন না। অন্যদিকে লেখক জিতে নেন মানুষের মন। প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন, ইতিহাসে অনেক পালকের কলমধারীকে অস্ত্র হাতেও লড়াই করতে হয়েছে। তবে প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল– তলোয়ার যে কাজ করতে পারে না, কলম তা পারে। আর সেই কাজ হল মানবজীবনকে সুন্দরতর করে তোলা।
৭. “কিন্তু সে ছবি কতখানি যন্ত্রের, আর কতখানি শিল্পীর?”——‘সে ছবি’ বলতে লেখক কোন্ ছবির কথা বলেছেন? যন্ত্রের ছবি আর শিল্পীর ছবির মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর – ছবির কথা: ‘সে ছবি’ বলতে লেখক কম্পিউটারে আঁকা ছবির কথাই বলেছেন।
যন্ত্রের ছবি বনাম শিল্পীর ছবি: কম্পিউটার একটি যন্ত্র। প্রযুক্তির সহায়তায় সেখানে ছবি আঁকা হয়। সেই ছবির সঙ্গে মনের কোনো সংযোগ নেই। ছবি আঁকাও সৃজনশীল শিল্পকর্ম। শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। কম্পিউটারের মন বলে কিছু নেই। তার রেখা নিছকই যন্ত্রের আঁকিঝুঁকি। আর শিল্পী ছবি আঁকেন তার নিজের অনুভূতির রঙে। সেখানে মনের মাধুরীর সাথে মিশে থাকে শিল্পীর আবেগ। রবীন্দ্রনাথও অক্ষর কাটাকাটি করতে গিয়ে আনমনে এঁকে ফেলতেন সাদাকালো ছবি। এই ছবির মধ্যে আছে খেয়ালি মনের প্রকাশ। কিন্তু কম্পিউটারে সেই আবেগ-অনুভূতির কোনো জায়গা নেই। লেখক বলতে চেয়েছেন, মনের জিনিসকে যন্ত্রের সাহায্যে রূপ দিতে গেলে তা কৃত্রিম হয়ে পড়ে। আবেগ ছাড়া শিল্প কখনও জীবন্ত হয় না। ভাব ঘনীভূত হলে শিল্পী তাকে রং তুলির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন। তাই কম্পিউটারে আঁকা ছবির থেকে শিল্পীর আঁকা ছবি অনেক বেশি জীবন্ত মনে হয়।
৮. “মনে মনে সেই ফরাসি কবির মতো বলেছি”—লেখক ফরাসি কবির মতো কী বলেছেন? তাঁর সে কথা বলার কারণ কী?
উত্তর – লেখকের বক্তব্য: লেখক ফরাসি কবির মতো মনে মনে বলেছেন, “তুমি সবল, আমি দুর্বল। তুমি সাহসী, আমি ভীরু। তবু যদি আমাকে হত্যা করতে চাও, আচ্ছা, তবে তা-ই হোক। ধরে নাও আমি মৃত।”
সে-কথা বলার কারণ: সময়ের পরিবর্তনে কালিকলম হারিয়ে গেছে স্মৃতির আড়ালে। লেখক শ্রীপান্থ মনের মধ্যে পোষণ করেন সেই হারিয়ে যাওয়া কালিকলমের মাহাত্ম্য। অনেক লেখক যুগের দাবিকে মেনে নিয়ে পুরোনো কালিকলম ছেড়ে ফাউন্টেন ও বল-পেনকে বরণ করে নিয়েছেন। কেউ কেউ কম্পিউটারকে ব্যবহার করেন লেখার কাজে। পুরোনো কালিকলমকে স্মৃতির পাতায় রেখে দিয়ে লেখকও শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন বল-পেনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। স্বেচ্ছায় তিনি পুরোনো কলম ছেড়ে বল-পেন হাতে তুলে নেননি। যুগের দাবিই তাঁকে বাধ্য করেছে নতুন লেখার সামগ্রীকে বরণ করে নিতে। তাঁর মনে হয়েছে, শক্তিশালী বল-পেন সত্যিই যদি তাঁর ইচ্ছাকে হত্যা করে, তাতে তাঁর কিছু করার নেই। যুগের প্রভাবকে তিনি কোনোভাবে এড়াতে পারবেন না। যুগের দাবির কাছে তাই তিনি মৃত সৈনিক। উদ্দিষ্ট ফরাসি কবির মতোই তাঁর অসহায়তা প্রকাশ পেয়েছে এখানে।
সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর
১. আধুনিক যন্ত্রযুগকে মেনে নিয়েও লেখকের মনের আবেগ ও শিল্পীসত্তা কীভাবে ফুটে উঠেছে?
উত্তর – কথামুখ: কালি আছে কাগজ নেই, কলম আছে মন নেই গ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে আমরা প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থর মনের আবেগ ও শিল্পীসত্তার এক অপূর্ব পরিচয় পেয়েছি। কালের ধারায় কলমের বিবর্তন: শৈশবে বাঁশের কলম, লেখার জন্য কলাপাতা, বাড়িতে সহজ পদ্ধতিতে তৈরি কালি ছিল লেখকের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তিনি বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশের কলম, খাগের কলম, পালকের কলম, ফাউন্টেন পেন, বল-পেন—এভাবে কালের ধারায় পেনকে আধুনিক এবং উন্নত হতে দেখেছেন। কম্পিউটারের আধিপত্য: তারপরে কম্পিউটার কলমের স্থান দখল করে নেওয়ায় কলম ক্রমশ অবলুপ্তির পথে চলে যেতে থাকে। লেখক এখানেই বিপন্ন বোধ করেছেন, কারণ লেখালেখির কাজের সুবাদে কলমের প্রতি তাঁর অদ্ভুত এক ভালোবাসা ছিল। অফিসে তাঁর সহকর্মীরা কম্পিউটার ব্যবহার করলেও তিনি পেনকেই আঁকড়ে ছিলেন। অত্যন্ত দরদ দিয়ে কলমের পরিবর্তন এবং ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে শ্রীপান্থ মনের আবেগকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি। আধুনিকতার পথে: পুরোনো দিনের কালিকলমের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও একজন শিল্পী হিসেবে আধুনিকতার পথে পা রেখেই লেখার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। শেষের কথা: তাই বল-পেনের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও শিল্পীসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই লেখক এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করেছেন।
২. কালিকলমের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে কীভাবে ফুটে উঠেছে?
উত্তর – কথামুখ: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে কলম, দোয়াত, দোয়াতের কালি—এগুলি ঘিরে লেখকের স্মৃতিমেদুর ভালোবাসা এবং সভ্যতার কালপ্রবাহে এগুলির হারিয়ে যাওয়ার বেদনা ফুটে উঠেছে। লেখাপড়ার সঙ্গী: শৈশবে লেখকের লেখাপড়ার সঙ্গী ছিল বাঁশের কলম এবং কাগজাকৃতি কলাপাতা। বাড়ির কাঠের উনুনে কড়াইয়ের নীচে জমে যাওয়া কালি লাউ পাতা দিয়ে ঘষে একটা পাথরের বাটিতে জলে গুলে নেওয়া হত। ক্রমশ বাঁশের কলম হারিয়ে খাগের কলম, পালকের কলম প্রচলিত হতে থাকে। ফাউন্টেন পেনের আগমন: এরপর কলমের জগতে বিপ্লব নিয়ে আসে ফাউন্টেন পেন। পেন হয়ে ওঠে সস্তা আর সর্বভোগ্য। ফাউন্টেন পেনকে কেন্দ্র করে বিলাসিতাও বাড়ে। বাজারে কাজল কালি, সুলেখা কালি দোয়াত ও বোতলে বিক্রি হতে থাকে। এরপর বাজারে আসে বল-পেন। কম্পিউটারের আধিপত্য: বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার এসে কলমের স্থান দখল করে। বাজার থেকে সব ধরনের পেন, কালি হারিয়ে যেতে থাকলে লেখকের মতো ‘কালি কলমের ভক্ত’ মানুষের মন কেঁদে ওঠে। শেষের কথা: কম্পিউটারের আধিপত্যকে মেনে নিলেও কলমের সঙ্গে লেখকের শৈশবজীবনের স্মৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে, যা তাঁর মনকে ভারাক্রান্ত করেছে।
৩. প্ৰবন্ধ কী? বস্তুনিষ্ঠ বা Formal Essay হিসেবে হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধটি সার্থক?
উত্তর – প্রবন্ধ: প্রবন্ধ শব্দটির ইংরেজি অর্থ হল ‘Essay’। সংস্কৃতে বলা হয় ‘প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন’। প্রবন্ধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “Any brief composition in prose that undertakes to discuss a matter, express a point of view, or persuade us to accept a thesis on any subject whatever”. প্রবন্ধ দুইপ্রকার হয় –[১] বস্তুনিষ্ঠ বা Formal Essay, [২] ব্যক্তিনিষ্ঠ বা Informal Essay |
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ হিসেবে সার্থকতা: শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ রচনাটিতে বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তিনিষ্ঠার সঙ্গে ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের ব্যক্তিগত আবেগ ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণ ঘটেছে।
আলোচ্য প্রবন্ধটির শুরুতেই রয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছোঁয়া। লেখকের অফিসে কলমের ব্যবহার আর কেউ করেন না— এই অভিজ্ঞতা থেকেই লেখক ফিরে যান তাঁর শৈশবে। বাঁশের কঞ্চির কলম, লেখার পাতা হিসেবে কলাপাতা, কালি তৈরির কৌশল—এসব দিয়ে শুরু হয় কলমের ইতিহাসপরিক্রমা। কথাপ্রসঙ্গে আসে মিশর বা রোমের কলমের প্রসঙ্গ। ক্রমে আসে লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান আর তাঁর ফাউন্টেন পেন আবিষ্কারের কথা। এই ফাউন্টেন পেন থেকে কম্পিউটার, লেখার ইতিহাসের এই বিবর্তনই তাঁর রচনার কেন্দ্রে থাকলেও তাঁর ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাসও শোনা যায় কলমের অবলুপ্তির কারণে। সমগ্র প্রবন্ধের মধ্যে তথ্যের জোগান যথেষ্ট কিন্তু প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভব এই প্রবন্ধটিকে যে অত্যন্ত সরস ও মনোগ্রাহী করে তুলেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
৪. প্রাবন্ধিক যেভাবে কলমের বিবর্তনের কথা বলেছেন, তা প্রবন্ধ অনুসরণে লেখো।
অথবা, ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে লেখক কলমের যে অতীত ও বর্তমান রূপের কথা বলেছেন তার সম্পর্কে লেখো।
উত্তর – শুরুর কথা: ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ দেশে ও বিদেশে কলমের বিবর্তনের একটি হদিশ পাঠকের সামনে রেখেছেন। বিদেশে কলমের ইতিহাস: জিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে প্রাচীন মিশরে নলখাগড়া ভেঙে নিয়ে, সেটিকে ভোঁতা করে তুলি বানিয়ে লেখার কথা তিনি বলেছেন। ফিনিসীয় দেশে হাড় দিয়ে কলম তৈরি হত। ব্রোঞ্জের শলাকা দিয়ে কলম বানাত প্রাচীন রোমের লোকেরা। এর পোশাকি নাম স্টাইলাস। চিনের লোকেরা লিখত তুলিতে। বাঁশের কঞ্জি, খাগ বা পালকের কলম: আমাদের এখানে বাঁশের কঞ্চির কলম, খাগের কলম, পাখির পালকের কলমের চল ছিল। রোগা বাঁশের কঞ্চি কেটে মুখটি চিরে বাঁশের কঞ্চির কলম বানাতে হত। এখন কোথাও এই ধরনের কলমের চল নেই। আজকাল খাগের কলম দেখা যায় শুধু সরস্বতী পুজোর সময়। ব্রিটিশ আমলে পাখির পালকের কলমের চল ছিল, যাকে ‘কুইল’ বলা হত। ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার: এর পরবর্তী ইতিহাস ফাউন্টেন পেনের। লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যানের আবিষ্কৃত ফাউন্টেন পেন সব রকমের কলমকে সরিয়ে জায়গা করে নেয়। নানা ধরনের ফাউন্টেন পেন বাজারে চলে আসে, যেমন পার্কার, শেফার্ড, সোয়ান ইত্যাদি। ফাউন্টেন পেনও একদিন জায়গা ছেড়ে দিল বলপেন বা ডট-পেনকে। শেষের কথা: সেই বল-পেন বা ডট-পেনও আজ কম্পিউটারের আগমনে অবলুপ্তির পথে।
৫. ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে লেখক বেশ কয়েকটি প্রবাদের ব্যবহার করেছেন প্রবাদের এই ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা কোথায় ?
উত্তর – কথামুখ: প্রবাদ হল সামাজিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। এই সামাজিক অভিজ্ঞতার মধ্যে লুকিয়ে আছে সামাজিক ইতিহাসের ধারাও। প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ কালিকলমের ইতিহাস বলতে গিয়ে কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রবাদকে তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছেন।
‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে পাঁচটি প্রবাদের ব্যবহার চোখে পড়ে। কালি-কলম মন, লেখে তিনজন: শুরুতেই রয়েছে “কালি কলম মন, লেখে তিন জন”। কিন্তু এর মধ্যে ‘কালি’, ‘কলম’লুপ্তপ্রায়। কালি নেই কলম নেই বলে তুমি মুনশি: উক্ত সূত্র ধরে এসেছে পরের প্রবাদটি “কালি নেই, কলম নেই, বলে আমি মুনশি।” যার অর্থ হল লেখালেখির কাজ কলম ছাড়া টাইপরাইটার অথবা কম্পিউটারের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। তিল ত্রিফলা সিমুল ছালা না ছাড়ে মসি: কালি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যে প্রবাদটি ব্যবহার করেছেন, লোক-অভিজ্ঞতা ও লোকশিক্ষার ছাপ তাতে স্পষ্ট—“তিল ত্রিফলা সিমুল ছালা/ ছাপ দুগ্ধে করি মেলা/লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি/ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসি।” কলমে কায়স্থ চিনি, গোঁফেতে রাজপুত: সেকালে বিশেষ বিশেষ মানুষের অধিকার ছিল কলমের ওপর—“কলমে কায়স্থ চিনি, গোঁফেতে রাজপুত।”কালির অক্ষর … কালীঘাটে: মাহাত্ম্য ছিল কালিরও, “কালির অক্ষর নাইকো পেটে, চণ্ডী পড়েন কালীঘাটে।” শেষের কথা: এভাবেই প্রবাদ হয়ে উঠেছে কখনও ইতিহাসের উপাদান, অভিজ্ঞতার ফসল, কখনও বা সমাজের দর্পণ।
৬. “সব মিলিয়ে লেখালেখি রীতিমতো ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান।”—লেখালেখি ব্যাপারটিকে ছোটোখাটো অনুষ্ঠান বলা হয়েছে কেন বুঝিয়ে দাও।
উত্তর – বাঁশের কঞ্চির কলম: একসময়ে রোগা বাঁশের কঞি কেটে কলম তৈরি করা হত। কালি যাতে গড়িয়ে না পড়ে তাই মুখটা চিরে দেওয়া হত। লেখা হত কলার পাতায়।
কালি তৈরি: কালিও নিজেদেরই তৈরি করতে হত। কাঠের উনুনে রান্না করা কড়াই-এর তলার কালি লাউ পাতা দিয়ে ঘষে তুলে তা পাথরের বাটিতে রেখে জলে গোলা হত। কখনো কখনো হরীতকী, আতপ চাল ভাজা পুড়িয়ে বেটে মিশিয়ে দেওয়া হত তাতে তারপর খুন্তি পুড়িয়ে জলে ছ্যাঁকা দিয়ে ফোটানো হত। প্রথম লেখালেখি: বাঁশের কলম, মাটির দোয়াত, ঘরে তৈরি কালি আর কলাপাতাতে লেখকের প্রথম লেখালেখি। শহরের হাই স্কুলে ভরতি হওয়ার পরে বাঁশের বা কঞ্চির কলমকে ছুটি দেওয়া হয়। কালি বানানোও বন্ধ হয়ে যায়। কাচের দোয়াতে কালি তৈরি: কাচের দোয়াতে এই কালি বানানো হত কালি ট্যাবলেট বা বড়িগুলি দিয়ে। তৈরি কালি পাওয়া যেত দোয়াতে। ফাউন্টেন পেনের জন্ম: ফাউন্টেন পেনের জন্য ছিল বিদেশি কালি। রকমারি নিব ও হ্যান্ডেল ছিল। ফাউন্টেন পেনকে প্ল্যাটিনাম, সোনা ইত্যাদি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত। দোয়াত কলমের অবসান: এই পর্যায়ে দোয়াতকলম হয়ে গেল ঘর সাজানোর আসবাব। একসময় লেখা শুকানো হত বালিতে, পরে ব্লটিং পেপারে। প্রথম যুগে তার চেহারা ছিল একরকম, পরবর্তীকালে সেই রূপের বদল ঘটে গেল। শেষের কথা: তারপর সবই অতীত হয়ে গেল। লেখালেখি এভাবে এক অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল।