WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 6 বহুরূপী
WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 6 বহুরূপী
West Bengal Board 10th Class Bengali Solutions Chapter 6 বহুরূপী
West Bengal Board 10th Bengali Solutions
লেখক পরিচিতি
ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ এক স্মরণীয় নাম। সাহিত্য জগতে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বেশ কিছুটা দেরিতে। তিনি তাঁর মেধাশক্তি, চিন্তাচেতনা এবং অভিজ্ঞতার দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে বিভিন্ন কালজয়ী রচনার মধ্য দিয়ে ভরিয়ে তুলেছেন।
জন্ম ও শৈশব : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ১৪ সেপ্টেম্বর বিহারের হাজারিবাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে।
শিক্ষাজীবন: সুবোধ ঘোষ হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিশিষ্ট দার্শনিক ও গবেষক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরিতে তিনি পড়াশোনা করতেন। প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, এমনকি সামরিকবিদ্যায় তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন: সুবোধ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিহারের আদিবাসী অঞ্চলে বাসের কনডাক্টর হিসেবে। এরপর সার্কাসের ক্লাউন, মুম্বাই পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণির কাজ, চায়ের ব্যাবসা, বেকারির ব্যাবসা, মালগুদামের স্টোরকিপার প্রভৃতি কাজে তিনি তাঁর জীবনের বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করেন। বহু পথ ঘুরে তিরিশের দশকের শেষে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে সহকারী হিসেবে যোগ দেন। তাঁর লেখালেখির সময়কাল ১৯৪০ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গান্ধিজির সহচর হিসেবে তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। দাঙ্গা এবং দাঙ্গা-পরবর্তী সময়ের সাম্প্রদায়িকতা, হিংস্রতা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। সুবোধ ঘোষের প্রথম গল্প ‘অযান্ত্রিক’। তাঁর আর-একটি বিখ্যাত গল্প ‘থির বিজুরি’। শুধু গল্পকার হিসেবে নয়, ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা একটি অন্যতম উপন্যাস হল তিলাঞ্জলি (১৯৪৪)। কংগ্রেস সাহিত্যসংঘের মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে।
বিচিত্র জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁর কর্মজীবন। আনন্দবাজার পত্রিকার সহকারী হিসেবে তিনি যোগ দেন। ক্রমে সেখানকার সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর এবং তারপর অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হল—’ভারত প্রেমকথা’ (মহাভারতের গল্প অবলম্বনে রচিত), ‘গঙ্গোত্রী’ (১৯৪৭), ‘ত্রিযামা’ (১৯৫০), ‘ভালবাসার গল্প’, ‘শতকিয়া’ (১৯৫৮) প্রভৃতি। এ ছাড়াও তাঁর কয়েকটি গল্পসংকলন হল— ‘ফসিল’, ‘পরশুরামের কুঠার’, ‘জতুগৃহ’।
পুরষ্কার: সুবোধ ঘোষ তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য আনন্দ পুরস্কার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক পান।
জীবনাবসান; ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ১০ মার্চ এই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারা যান।
উৎস
সুবোধ ঘোষের গল্পসমগ্র, তৃতীয় খণ্ড থেকে ‘বহুরূপী’ গল্পটি নেওয়া হয়েছে।
বিষয়সংক্ষেপ
গল্পটি মূলত এক বহুরূপীর জীবন নিয়ে লেখা। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা শহরের সবচেয়ে ছোটো গলির মধ্যেই বাস করেন। সেখানে আড্ডাও বসে নিয়মিত। রোজকার চাকরি করতে যাওয়া হরিদার কোনোদিনই পোষাত না। তিনি ছিলেন বহুরূপী। তিনি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রূপ ধারণ করতেন—কখনও পাগল সাজতেন, কখনও বাউল, কোনোদিন কাপালিক, কখনও বোঁচকা কাঁধে বুড়ো কাবুলিওয়ালা, কখনও বা পুলিশ। তাঁর এইসব রূপ দেখে অনেকেই কিছু পয়সা দিত। এটা তাঁর একরকম রোজগার ছিল। পুলিশ সেজে তিনি ঘুষও নিয়েছেন। তাঁর এইসব বহুরূপীর বেশ দেখে লোকজন বিরক্ত হত, আবার কেউ কেউ খুব আনন্দিত হত, কেউ-বা বিস্মিত হত। বহুরূপী সেজে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন। জাগদীশবাবুর বাড়ীতে হিমালয়ের গুহানিবাসী এক সন্ন্যাসীর আগমন এবং অভ্যর্থনার কথা শুনে মোটা রকমের উপার্জনের আশায় তিনি সন্ন্যাসী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সৌম্য, শান্ত, জ্ঞানী মানুষ জগদীশবাবু। সাদা উত্তরীয়, ছোটো বহরের থান পরে এক বিরাগী মানুষের বেশ ধরে বহুরূপী হরিদা হাজির হয়েছিলেন জগদীশবাবুর বাড়িতে। তাঁর সাজপোশাক, উদাত্ত, শান্ত, উজ্জ্বল দৃষ্টি দেখে কেউ বুঝতেও পারেনি তিনি আসলে হরিদা। যখনই যে রূপ হরিদা ধারণ করতেন, তখনই তিনি সেই রূপ বা সেই চরিত্রটির সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে যেতেন যে, তাঁকে বহুরূপী বলে কেউ বুঝতেও পারত না। তিনি সত্যিই যেন মূল চরিত্রটিই হয়ে উঠতেন। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। হরিদা সত্যিই যেন বিরাগী হয়ে উঠেছিলেন। তখন তিনি ধন, যৌবন, সংসার—সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাই জগদীশবাবু তাঁকে তীর্থভ্রমণের জন্য টাকা দিতে চাইলেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। আসলে এইভাবে বহুরূপী পেশাটাকেই তিনি যোগ্য সম্মান দিয়েছিলেন। কারণ এই পেশা ছিল তাঁর ভালোবাসা।
নামকরণ
যে-কোনো সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আর এই নামকরণ সাধারণত বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক, ভাবকেন্দ্রিক বা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে থাকে। যে-কোনো সাহিত্যের অন্তর্নিহিত ভাবও এই নামকরণের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয়।
শহরের সবচেয়ে সরু গলিটার ভিতরের ছোট্ট ঘরটাই হরিদার জীবনের একমাত্র আশ্রয়। কোনো ছকে বাঁধা কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে না। তবে তাঁর জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্য হল এই যে, তিনি মাঝে মাঝে বহুরুপী সাজেন। এতে সামান্য কিছু রোজগারও হয় বটে। বহুরূপী সেজে তিনি কখনও বাসস্ট্যান্ডে, কখনও বাজারে, কখনও আবার অন্য উপায় তাঁর সাজ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করেন। বহুরূপী সাজাটাই তাঁর পেশা। এই পেশাগত বিচারে গল্পের নামকরণ যথাযথ। কিন্তু সুবোধ ঘোষ গল্প কাহিনিতে একটু বাঁক ফেরালেন জগদীশবাবুর বাড়িতে হরিদাকে এনে। হরিদা চেয়েছিলেন কৃপণ, ধনী জগদীশবাবুর কাছ থেকে বেশি করে ঢাকা আদায় করবেন। সেইমতো তিনি বিরাগীর বেশে সেজেওছিলেন ভালো। জগদীশবাবু হরিদাকে বিরাগীর বেশে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। জগদীশবাবু বুঝতেই পারেন না যে, তাঁর বাড়িতে বিরাগী বেশে আসা লোকটা আসলে একজন বহুরূপী। উপরন্তু তিনি বিরাগী হরিদাকে একশো এক টাকার একটি থলি দিতে গেলে হরিদা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এখানেই হরিদার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। ত্যাগই তাঁর জীবনের ধর্ম। অর্থাৎ বহুরূপী বহুরূপী পেশা পাঠকদের কাছে গৌরবের হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায় গল্পের নামকরণ কিছুটা বিষয়কেন্দ্রিক হলেও ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে গল্পের নামকরণ ‘বহুরূপী’ সার্থক হয়েছে।
আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর
বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর
ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. জগদীশবাবুর বাড়িতে সন্ন্যাসী কত দিন ধরে ছিলেন?
(ক) আট দিন
(খ) সাত দিন
(গ) চার দিন
(ঘ) দশ দিন
২. সন্ন্যাসী কোথায় থাকতেন?
(ক) হিমালয়ের গুহাতে
(খ) জঙ্গলে
(গ) মানস সরোবরের কাছে
(ঘ) কোনোটিই নয়
৩. জগদীশবাবুর বাড়িতে আগত সন্ন্যাসীর বয়স আনুমানিক-
(ক) একশো বছর
(খ) পাঁচশো বছর
(গ) হাজার বছরের বেশি
(ঘ) দু-হাজার বছর
৪. জগদীশবাবুর বাড়িতে আগত সন্ন্যাসী সারা বছর কী খেতেন?
(ক) একটি আমলকী
(খ) একটি হরীতকী
(গ) একশো বছর
(ঘ) দুধ ও সাবু
৫. “সে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস”—দুর্লভ জিনিসটি হল-
(ক) সন্ন্যাসীর আশীর্বাদ
(খ) সন্ন্যাসীর সান্নিধ্য
(গ) সন্ন্যাসীর পদধূলি
(ঘ) সন্ন্যাসীর উপদেশ
৬. কীসের জন্য হরিদার আক্ষেপ ছিল?
(ক) সন্ন্যাসীর সঙ্গে না থাকতে পারার
(খ) সন্ন্যাসীকে নিজের বাড়ি এনে রাখতে না পারার
(গ) সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নিতে না পারার
(ঘ) কোনোটাই নয়
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. লেখক ও তাঁর বন্ধুরা হরিদার কাছে কোন্ ঘটনা শোনাতে এসেছিলেন?
উত্তর – সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরুপী’ গল্পে জগদীশবাবুর বাড়িতে খুব উঁচুদরের এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন এবং তিনি সাত দিন ধরে তাঁর বাড়িতে ছিলেন। এই খবরটাই লেখক ও তাঁর বন্ধুরা হরিদাকে শোনাতে এসেছিলেন।
২. “হরিদার কাছে আমরাই গল্প করে বললাম।”—কীসের গল্প ?
উত্তর – বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের লেখা ‘বহুরূপী’ গল্পে জগদীশবাবুর বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন। হরিদার কাছে সেই সন্ন্যাসীর গল্পই করা হয়েছিল।
৩. “সে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস”—দুর্লভ জিনিসটি কী?
উত্তর – সুবোধ ঘোষের লেখা ‘বহুরূপী’ গল্পের আলোচ্য অংশে দুর্লভ জিনিসটি হল জগদীশবাবুর বাড়িতে উপস্থিত সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো।
৪. হরিদা সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে কী বলা হয়েছিল?
উত্তর – ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে বলা হয়েছিল, সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো দুর্লভ জিনিস। একমাত্র জগদীশবাবু ছাড়া কেউই তাই সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো পাননি।
৫. কীভাবে জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো পেয়েছিলেন?
উত্তর – জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর জন্য একজোড়া কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে খড়মজোড়া সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরতেই সন্ন্যাসী বাধ্য হয়ে নিজের পা এগিয়ে দেন। সেই সুযোগে জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নিয়ে নেন।
৬. সন্ন্যাসী চলে যাওয়ার আগে জগদীশবাবু কী করেছিলেন?
উত্তর – সন্ন্যাসী চলে যাওয়ার আগে জগদীশবাবু কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে তাঁকে দিয়েছিলেন আর সন্ন্যাসীর ঝোলায় জোর করে একশো টাকার একটা নোট ফেলে দিয়েছিলেন।
৭. “সন্ন্যাসী হাসলেন আর চলে গেলেন”—সন্ন্যাসী কী দেখে হাসলেন?
উত্তর – ‘বহুরূপী’ গল্পে সন্ন্যাসীকে বিদায় দেবার সময় জগদীশবাবু একশো টাকার একটা নোট তাঁর ঝোলায় জোর করে ফেলে দিলেন— তা দেখে সন্ন্যাসী হাসলেন।
৮. হরিদার ঘরটা কীরকম ছিল এবং সেখানে কী হত?
উত্তর – শহরের সবচেয়ে সরু এক গলির মধ্যে হরিদার ছোটো একটা ঘর ছিল। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা লেখকদের আড্ডা বসত। চা, চিনি, দুধ তাঁরাই আনতেন। হরিদা শুধু আগুনের আঁচে জল ফুটিয়ে দিতেন।
ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. “… এক সন্ন্যাসী এসে জগদীশবাবুর বাড়িতে ছিলেন।” জগদীশবাবুর বাড়িতে যে সন্ন্যাসী এসেছিলেন তাঁর বর্ণনা দাও।
উত্তর – গল্পকার সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পে জগদীশবাবুর বাড়িতে সাত দিন ধরে এক সন্ন্যাসী ছিলেন। খুবই উঁচুদরের এই সন্ন্যাসী হিমালয়ের গুহাতে থাকতেন। তিনি সারাবছরে শুধু একটি হরীতকী খেতেন। এ ছাড়া তিনি আর কিছুই খেতেন না। অনেকেই মনে করত, সন্ন্যাসীর বয়স ছিল হাজার বছরেরও বেশি। তাঁর পায়ের ধুলো ছিল অত্যন্ত দুর্লভ জিনিস; সবাই সন্ন্যাসীর এই পায়ের ধুলো পেত না। একমাত্র জগদীশবাবুই সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো পেয়েছিলেন।
২. “সে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস।”—দুর্লভ জিনিসটা কী? কে, কীভাবে তা লাভ করেছিল?
উত্তর – দুর্লভ জিনিস: সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পের আলোচ্য অংশে দুর্লভ জিনিসটি হল সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো।
দুর্লভ বস্তু লাভ: জগদীশবাবুর বাড়িতে একবার এক সন্ন্যাসী এসে সাত দিন ছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো ছিল অত্যন্ত দুর্লভ। জগদীশবাবু যেকোনো মূল্যে সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নিতে চেয়েছিলেন। তাই জগদীশবাবু একজোড়া কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরেছিলেন। তখন বাধ্য হয়ে সন্ন্যাসী তাঁর পা এগিয়ে দিয়েছিলেন আর সেই ফাঁকে জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন।
৩. “গল্প শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন হরিদা।”—হরিদা কে ছিলেন? কোন্ গল্প শুনে হরিদা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল ?
উত্তর – হরিদার পরিচয়: ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা ছিলেন পেশায় বহুরূপী।
হরিদার গম্ভীর হয়ে যাওয়া: লেখক ও তাঁর বন্ধুরা হরিদাকে জানিয়েছিলেন যে, জগদীশবাবুর বাড়িতে এক সন্ন্যাসী সাত দিন ধরে ছিলেন। তিনি সারাবছরে একটি হরীতকী খান। তাঁর বয়স হাজার বছরেরও বেশি। সন্ন্যাসী কাউকেই তাঁর পায়ের ধুলো দেন না। জগদীশবাবু কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে তাঁর পায়ের কাছে ধরতেই সন্ন্যাসী সেই খড়ম পড়তে গেলে জগদীশবাবু তাঁর পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন। সন্ন্যাসীর এই গল্প শুনে হরিদা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন।
8. “খুবই গরিব মানুষ হরিদা”—হরিদার দারিদ্র্যের পরিচয় দাও।
উত্তর – সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে শহরের সবচেয়ে সরু একটা গলির ভিতরে হরিদার ঘর। সময় ধরে কোনো অফিসে বা দোকানে কাজ করা তাঁর পছন্দ নয়। তাই তাঁর সংসার রোজগারহীন। তাঁর উনুনে অনেক সময় শুধু জলই ফোটে, ভাত ফোটে না। এই অভাব তিনি সহ্য করতে পারেন, কিন্তু একঘেয়ে কাজ করতে তাঁর ভয়ানক আপত্তি। বহুরূপী সেজে যেটুকু রোজগার হয় তাতেই কোনোদিন একবেলা-আধবেলা খেয়ে হরিদার দিন চলে যায়।
৫. “…একটা চাকরির কাজ করে যাওয়া হরিদার পক্ষে সম্ভব নয়।”—কেন হরিদা কোনোদিন চাকরি করেননি?
উত্তর – ইচ্ছে করলেই হরিদা যে-কোনো অফিসের কাজ অথবা কোনো দোকানের বিক্রিওয়ালার কাজ পেয়ে যেতেন। কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় সময় ধরে নিয়ম করে রোজই এক চাকরি করতে যাওয়া হরিদার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কোনোদিন তাঁর হাঁড়িতে ভাত চড়ত, কোনোদিন চড়ত না। এই অভাবটা সহ্য করতেও হরিদা রাজি ছিলেন, কিন্তু একঘেয়ে কাজ করতে তাঁর ভীষণ আপত্তি ছিল। তাই হরিদা কোনোদিন চাকরি করেননি।
৬. “হরিদার জীবনে সত্যিই একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে।”হরিদার জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্যটি কী ছিল?
উত্তর – সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদার অভাবী জীবনে একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য ছিল। হরিদা মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে রোজগার করতেন। বিচিত্র সব ছদ্মবেশে তিনি রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। যারা চিনতে পারত তারা এক-আনা কিংবা দু-আনা বকশিশ দিত। আর যারা চিনতে পারত না তাদের মধ্যে কেউ কিছুই দিত না অথবা কেউ বিরক্ত হয়ে দু-একটা পয়সা বাড়িয়ে দিত। নানারকম বেশে রাস্তায় বেরোনোটাই ছিল হরিদার জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্য।
৭. “ঠিক দুপুরবেলাতে একটা আতঙ্কের হল্লা বেজে উঠেছিল।”—কোথায় আতঙ্কের হল্লাটি বেজে উঠেছিল? নিজের ভাষায় তার বর্ণনা দাও।
উত্তর – যেখানে হল্লা বেজে উঠেছিল: একদিন দুপুরবেলা চকের বাসস্ট্যান্ডের কাছে আতঙ্কের হল্লাটি বেজে উঠেছিল।
আতঙ্কের ঘটনার বর্ণনা: চকের বাসস্ট্যান্ডের কাছে একদিন এক পাগলকে দেখা গিয়েছিল। কটকটে লাল চোখের সেই পাগলের মুখ থেকে লালা ঝরছিল। তার কোমড়ে ছিল একটা ছেঁড়া কম্বল আর গলায় ছিল টিনের কৌটোর একটা মালা। সেই পাগলটা একটা থান ইট নিয়ে বাসে বসা যাত্রীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে যাত্রীরা চেঁচিয়ে উঠছিল। কেউ কেউ দু-এক পয়সা তার সামনে ফেলে দিচ্ছিল। এভাবেই বাসস্ট্যান্ডে আতঙ্কের হল্লা শুরু হয়েছিল। বাস ড্রাইভার কাশীনাথ অবশ্য বুঝতে পেরেছিল লোকটা আসলে বহুরুপী হরিদা।
৮. “কিন্তু দোকানদার হেসে ফেলে—হরির কাণ্ড” কাণ্ডের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর – বহুরূপী হরিদা বিভিন্ন বেশ ধারণ করতেন। একদিন সন্ধেবেলায় যখন আলো সবেমাত্র জ্বলে উঠেছে ঠিক সেইসময় হঠাৎই সবাই ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পায়। সবাই দেখে এক রূপসি বাইজি নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। এক-একটা দোকানের সামনে গিয়ে তিনি দাঁড়ান আর মুচকি হেসে চোখ টিপে একটা ফুলসাজি এগিয়ে দেন। দোকানিরাও হেসে ফেলে একটা সিকি সেই ফুলসাজিতে দিয়ে দেয়। হরিদা-ই বাইজি সেজে এই কাণ্ড ঘটান আর বাইজিটি যে আসলে এক বহুরূপী, সেটা জানতে পেরে দর্শকদের মোহভঙ্গ হয়।
৯. দয়ালবাবুর লিচু বাগানে কী ঘটনা ঘটেছিল?
উত্তর – দয়ালবাবুর লিচু বাগানে স্কুলের চারটি ছেলে এসেছিল লিচু নেওয়ার আশায়। সেখানে হরিদা পুলিশ সেজে দাঁড়িয়েছিলেন আর সেই চার জন ছেলেকে তিনি ধরেছিলেন। সব ছেলে তাঁকে সত্যিকারের পুলিশ বলেই মনে করেছিল এবং ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর সেই ছেলেদের স্কুলের মাস্টারমশাই সেখানে এসে ছেলেদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নকল পুলিশের কাছে ক্ষমা চান এবং তাকে আট আনা ঘুষও দেন। সেই আট আনা ঘুষ পাওয়ার পর নকল পুলিশ হরিদা সেই চার জন ছেলেকে ছেড়েছিলেন।
১০. হরিদা পুলিশ সেজে কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন? তিনি কীভাবে মাস্টারমশাইকে বোকা বানিয়েছিলেন?
উত্তর – স্থান: হরিদা পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর লিচু বাগানে দাঁড়িয়েছিলেন। → মাস্টারমশাইকে বোকা বানানো: দয়ালবাবুর লিচু বাগানে হরিদা পুলিশ সেজে স্কুলের চারটি ছেলেকে ধরেছিলেন। ছেলেরা তাঁকে সত্যিকারের পুলিশ বলেই মনে করেছিল এবং ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর সেই ছেলেগুলির স্কুলের মাস্টারমশাই সেখানে এসে নকল পুলিশের কাছে ক্ষমা , তাকে আট আনা ঘুষ দিয়েছিলেন। ঘুষ পাওয়ার পর তবেই নকল পুলিশ চেয়ে, হরিদা সেই চার জন ছেলেকে ছেড়েছিলেন। হরিদা এভাবেই মাস্টারমশাইকে বোকা বানিয়েছিলেন।
১১. “ঠিকই, আমাদের সন্দেহ মিথ্যে নয়।”—কারা, কী সন্দেহ করেছিল? সেই সন্দেহ যে ঠিক, তা কীভাবে বোঝা গেল?
উত্তর – সন্দেহকারী ও সন্দেহ: গল্পের কথক ও তাঁর বন্ধুরা ভেবেছিলেন হরিদা সন্ন্যাসীর কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছেন। হয়তো মনে মনে কোনো মতলব ফাঁদছেন।
সন্দেহের যথার্থতা: হরিদা একদিন কথক ও তাঁর বন্ধুদের বলেন যে, তিনি তাঁদের একটা জবর খেলা দেখাবেন। আর তিনি ওই খেলা দেখাবে জগদীশবাবুর বাড়িতে। জগদীশবাবু ধনী লোক। সন্ন্যাসীর গল্প শুনে হরিদা তাই সন্ন্যাসীর চরিত্রটিকেই বেছে নিয়েছেন। হরিদার কথা শুনেই কথক ও তাঁর বন্ধুদের সন্দেহ ঠিক বলে প্রমাণিত হল।
১২. “আমি বলছি তোমরা সেখানে থেকো।”—এখানে বক্তা কাদের থাকতে বলেছেন? তাদের থাকতে বলার কারণ কী?
উত্তর – উদ্দিষ্ট জন: উল্লিখিত অংশে হরিদা গল্পকথক এবং তাঁর বন্ধুদের থাকতে বলেছেন।
থাকতে বলার কারণ: কথকেরা হরিদাকে জগদীশবাবুর বাড়িতে আসা হিমালয়ের গুহানিবাসী সন্ন্যাসীর কথা শুনিয়েছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো ছিল দুর্লভ। কিন্তু জগদীশবাবু কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে তা সন্ন্যাসীকে পরতে দিয়ে সুকৌশলে তাঁর পায়ের ধুলো নেন। এ গল্প শুনেই হরিদা গম্ভীর হয়ে যান এবং বলেন যে, তিনি একটা ‘জবর খেলা’ দেখাবেন। এই খেলা দেখতেই হরিদা কথকদের আমন্ত্রণ জানান।
১৩. “এবার মারি তো হাতি, লুঠি তো ভাণ্ডার।”—বক্তা কে? তিনি কোন্ উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন?
উত্তর – বক্তা: প্রখ্যাত গল্পকার সুবোধ ঘোষ ‘বহুরূপী’ গল্প থেকে নেওয়া আলোচ্য অংশটির বক্তা বহুরূপী হরিদা।
এ কথা বলার উদ্দেশ্য: বহুরূপী সেজে হরিদার উপার্জন ছিল অতি সামান্য। তাই জগদীশবাবুর বাড়িতে সন্ন্যাসীর খাতির-যত্ন ও অর্থলাভের কাহিনি শুনে হরিদা সিদ্ধান্ত নেন সেখানে যাওয়ার। মোটা কিছু আদায় করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কাঙালের মতো হাত পেতে বকশিশ নয়, একবারে এমন উপার্জন করবে, যাতে তাঁর সমস্ত বছর চলে যাবে—এই উদ্দেশ্য নিয়েই আলোচ্য কথাটি হরিদা বলেছেন।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
১. “বাঃ, এ তো বেশ মজার ব্যাপার!”—মজার ব্যাপারটি কী? তা বক্তার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল?
উত্তর – মজার ব্যাপার: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে জগদীশবাবুর বাড়িতে থাকার জন্য এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন। খুব উঁচুদরের এই সন্ন্যাসী হিমালয়ের গুহাতে থাকতেন। সারাবছর একটা হরীতকী ছাড়া তিনি নাকি আর কিছুই খেতেন না। অনেকের মতে, তাঁর বয়স ছিল হাজার বছরেরও বেশি। জগদীশবাবু ছাড়া আর কাউকে তিনি পায়ের ধুলো নিতে দেননি। জগদীশবাবু একজোড়া কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সন্ন্যাসীকে বিদায় দেওয়ার সময় জগদীশবাবু একশো টাকার একটা নোট জোর করে সন্ন্যাসীর ঝোলার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল মজার গল্প।
বক্তার উপরে প্রভাব: সন্ন্যাসীর গল্প শুনে হরিদা প্রথমে গম্ভীর হয়ে যান। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। গরিব হরিদা নির্দিষ্ট কোনো পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন না। তাই মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে তিনি পয়সা রোজগার করতেন। কিন্তু তাতে তাঁর দিন চলত না। জগদীশবাবুর বাড়িতে আসা সন্ন্যাসীর কথা শুনে হরিদা চিন্তা করেন সাধুভক্ত জগদীশবাবু সন্ন্যাসীকে উদারহস্তে অনেক কিছু দান করেছেন। তাই তিনিও যদি কোনো সাধুসন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে জগদীশবাবুর বাড়ি যান, তবে নিশ্চয় তাঁর দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না। এই অভিপ্রায়ে হরিদা একদিন সত্যি সত্যি বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
২. “গল্প শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন হরিদা”— গল্পটি কী ছিল। হরিদার গম্ভীর হয়ে যওয়ার কারণ কী ছিল?
উত্তর – গল্পের বর্ণনা: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরুপী’ গল্পে অবস্থাপন্ন জগদীশবাবুর বাড়িতে এসে এক সন্ন্যাসী সাত দিন ধরে ছিলেন। তিনি হিমালয়ের গুহায় থাকতেন। অনেকে মনে করেন তাঁর বয়স হাজার বছরেরও বেশি। তিনি সারাবছরে একটি হরীতকী ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। জগদীশবাবু ছাড়া আর কাউকে তিনি পায়ের ধুলো দেননি। জগদীশবাবুও তা পেয়েছিলেন কৌশল করে। একজোড়া কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরেন আর সন্ন্যাসী বাধ্য হয়ে তাতে পা গলাতে গেলে সেই সুযোগে জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নিয়ে নেন। জগদীশবাবু সন্ন্যাসীর ঝোলার ভিতরে একশো টাকার একটি নোট জোর করে ফেলে দেন। সন্ন্যাসী হেসে সেখান থেকে চলে যান। এই গল্পই হরিদাকে শোনানো হয়েছিল।
হরিদার গম্ভীর হওয়ার কারণ: সন্ন্যাসী এবং জগদীশবাবুর এই গল্প শুনে হরিদা গম্ভীর হয়ে যান। কথক ও তাঁর বন্ধুরা হরিদার এই গাম্ভীর্যের কারণ বুঝতে পারেন না। এই সময়েই হরিদা তাঁদের জগদীশবাবুর বাড়িতে খেলা দেখাতে যাওয়ার কথা বলেন। জগদীশবাবুর কাছ থেকে সারা বছরের প্রয়োজনীয় অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। জগদীশবাবুর ধর্মের প্রতি দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই হরিদা নিজের উদ্দেশ্য সফল করতে চেয়েছিলেন। .
৩. “হরিদার জীবনে সত্যিই একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে।” হরিদার জীবনে নাটকীয় বৈচিত্র্যের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর – বৈচিত্র্যময় জীবন: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা ছিলেন অত্যন্ত গরিব মানুষ। কিন্তু ধরাবাঁধা ছকে জীবন কাটানো হরিদার পছন্দ ছিল না। তাই অভাবের মধ্যেই তিনি জীবনের বৈচিত্র্য খুঁজতেন। বহুরূপীর বৈচিত্র্যময় পেশাকে সঙ্গী করেই তিনি অন্নসংস্থানের চেষ্টা চালাতেন। নানান ছদ্মবেশ: হঠাৎ হঠাৎ বিচিত্র ছদ্মবেশে পথে বের হতেন হরিদা। কখনও বাসস্ট্যান্ডের কাছে উন্মাদের বেশে তাঁকে দেখা যেত, আবার কখনও শহরের রাজপথ ধরে বাইজির বেশে ঘুঙুর বাজিয়ে চলে যেতেন। শহরে নতুন আসা মানুষ যারা হরিদাকে চিনত না, তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত আর পরিচিতরা তার কাণ্ড দেখে হেসে ফেলত। কখনও বোঁচকা কাঁধে বুড়ো কাবুলিওয়ালা, কখনও হ্যাট, কোট, প্যান্টালুন পরা ফিরিঙ্গি সাহেব—এরকম অজস্র রূপেই হরিদাকে দেখতে পাওয়া যেত। এমনকি পুলিশ সেজে স্কুলের মাস্টারমশাইকেও তিনি বোকা বানিয়েছিলেন। পেশার প্রতিষ্ঠা: তাঁর বিচিত্র সব সাজ আর চরিত্রের সঙ্গে মানানসই আচরণে মানুষ কখনও হাসত, কখনও তারিফ করত, কখনও বা বিরক্ত হত। আর হরিদার যা সামান্য বকশিশ জুটত তাতেই তিনি “তাঁর ভাতের হাঁড়ির দাবি মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করেন”। কিন্তু এই দারিদ্র্যের মধ্যেও হরিদা যেন মুক্ত প্রাণের আনন্দ খুঁজে নিতেন।
৪. “এই শহরের জীবনে মাঝে মাঝে বেশ চমৎকার ঘটনা সৃষ্টি করেন বহুরূপী হরিদা।” যে চমৎকার ঘটনাগুলি হরিদা ঘটিয়েছিলেন তার উল্লেখ করো।
উত্তর – কথামুখ: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা বহুরূপীর বেশে শহরের জীবনে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ঘটনা ঘটাতেন। যেমন—
পাগলের ছদ্মবেশ: একদিন হরিদা উন্মাদ পাগল সেজে বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তার মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ছিল। তার চোখ দুটি ছিল কটকটে লাল। কোমরে তার ছেঁড়া কম্বল জড়ানো, গলায় টিনের কৌটোর মালা ঝুলছে। বাসযাত্রীদের দিকে সে মাঝে মাঝে তেড়ে যাচ্ছিল থান ইট নিয়ে।
পুলিশের ছদ্মবেশ; এইরকমই একদিন পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর লিচু বাগানে হরিদা দাঁড়িয়েছিলেন। সেখান থেকে চার জন স্কুলছাত্রকে তিনি ধরেন। তারপর স্কুলমাস্টার এসে নকল পুলিশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং আট আনা ঘুষ দিয়ে স্কুলমাস্টার তাঁর ছাত্রদের ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাইজির ছদ্মবেশ: আর-একদিন সন্ধ্যায় দোকানের লোকজনের ব্যস্ততা আর মুখরতা যখন জমে উঠেছে তখন হঠাৎ করেই সকলে ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পায়। তারা দেখে এক রূপসি বাইজি প্রায় নাচতে নাচতে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। শহরে যারা নতুন এসেছিল তারা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে থাকে। রূপসি বাইজি মুচকি হেসে, চোখ টিপে তার ফুলসাব্জি দোকানদারদের দিকে এগিয়ে দেয় আর দোকানদাররাও হাসিমুখে তাতে এক সিকি ফেলে দেয়। কেবল দোকানদার তাকে চিনতে পারে যে এই বাইজি আসলে বহুরূপী হরিদা।
উপসংহার: বহুরূপী সেজে হরিদা এই চমৎকার ঘটনাগুলি ঘটিয়েছিলেন।
৫. “আজ তোমাদের একটা জবর খেলা দেখাব।”—কে, কাদের উদ্দেশে এ কথা বলেছেন? তিনি কোন্ জবর খেলা দেখিয়েছিলেন?
উত্তর – বক্তা এবং উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা কথক ও তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
জবর খেলার পরিচয়: বহুরূপী সেজে টাকা রোজগার করাই ছিল ‘হরিদার নেশা এবং পেশা। তাই ধর্মভীরু জগদীশবাবুকে বোকা বানিয়ে নিজের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে হরিদা সাদা থান পরে, সাদা উত্তরীয় গায়ে দিয়ে হাজির হন জগদীশবাবুর বাড়িতে। জগদীশবাবু হরিদার নিখুঁত ছদ্মবেশের কারণে তাঁকে চিনতে না পেরে বিনয় ও ভক্তিতে গদগদ হয়ে যান। নিজেকে ‘সৃষ্টির মধ্যে এককণা ধূলি’ বলে উল্লেখ করে জগদীশবাবুকে নীচে নেমে আসতে বাধ্য করেন তিনি। কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য, মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ছবি ফুটিয়ে তুলে হরিদা নিজের সাজকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। বিরাগীবেশী হরিদা জানান যে তাঁর কোনো রাগ নেই, তিনি বিষয়ীর ঘরে থাকতে চান না। তীর্থযাত্রার জন্য জগদীশবাবু হরিদাকে একশো এক টাকার থলি দিতে চাইলে তিনি তা ছুঁয়েও দেখেন না এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। হরিদার এরকম ছদ্মবেশ ধারণ করে জগদীশবাবুকে ধোঁকা দেওয়াকেই ‘জবর খেলা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৬. ‘এবার মারি তো হাতি, লুঠি তো ভাণ্ডার”— কে, কোন্ প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করেছেন? তাঁর এই উদ্দেশ্য কী শেষ অবধি সফল হয়েছিল—গল্প অবলম্বনে আলোচনা করো।
উত্তর – বক্তা ও প্রসঙ্গ: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে মন্তব্যটি করেছেন বহুরূপী হরিদা। কথকদের কাছ থেকে হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে আসা হিমালয়ের সাধুর কথা জানতে পারেন। জগদীশবাবু তাঁর পায়ের অতি দুর্লভ ধুলো পাওয়ার জন্য কীভাবে তাঁর খাতির-যত্ন করেছেন— তা-ও শোনেন। এইসব শুনতে শুনতেই হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে এক ‘জবর খেলা’ দেখানোর পরিকল্পনা করেন। উদ্দেশ্য ‘মোটা মতন কিছু’ আদায় করে নেওয়া। তাই কাঙালের মতো হাত পেতে বকশিশ নেওয়ার বদলে হরিদা চান জগদীশবাবুর ধর্মবিশ্বাস আর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সারাবছরের রোজগার একদিনে করে নিতে। এই প্রসঙ্গেই তিনি মন্তব্যটি করেছেন।
উদ্দেশ্যের সফলতা: এক ফুরফুরে সন্ধ্যায় বিরাগীর বেশে হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে হাজির হন। আদুড় গা, ধবধবে সাদা উত্তরীয়, সাদা থান পরা হরিদার আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক কথাবার্তায় জগদীশবাবু মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি বিরাগীকে তীর্থভ্রমণের জন্য একশো এক টাকা প্রণামি দিতে চান। কিন্তু হরিদাকে এখানে পাওয়া যায় সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ভূমিকায়। সব কিছু প্রত্যাখ্যান করে তিনি চলে যান। পরে কথকদের তিনি বলেন যে বিরাগী সন্ন্যাসী হয়ে টাকা স্পর্শ করলে তার বহুরুপীর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যেত। নিজের পেশার প্রতি সততা থেকেই হরিদা অর্থ উপার্জনের অসাধু ইচ্ছাকে ত্যাগ করেন।
৭. “তোমরা যদি দেখতে চাও, তবে আজ ঠিক সন্ধ্যাতে জগদীশবাবুর বাড়িতে থেকো।” –বক্তা কে? সেই সন্ধ্যায় কোন্ দৃশ্য দেখা গিয়েছিল? সেই ঘটনার মধ্য দিয়ে বক্তার কোন্ পরিচয় পাও?
উত্তর – বক্তা: ‘বহুরূপী’ গল্পে উদ্দিষ্ট মন্তব্যটি করেছিলেন বহুরূপী হরিদা। । সন্ধ্যার দৃশ্য: সেই সন্ধ্যায় বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন হরিদা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল জগতের সীমার ওপার থেকে যেন হেঁটে হেঁটে চলে এসেছেন। জগদীশবাবু নীচে নেমে তাঁকে অভ্যর্থনা না করায় তিনি একে তাঁর সম্পত্তির অহংকার বলে উল্লেখ করেন। ‘পরম সুখ’ বলতে তিনি বোঝান “সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া”। জগদীশবাবু তাঁকে কয়েকদিন থাকতে বললে তিনি জানিয়ে দেন যে, খোলা আকাশ আর ধরিত্রীর মাটি থাকতে বিষয়ীর দালান বাড়িতে তিনি থাকবেন না। জগদীশবাবু প্রণামি হিসেবে একশো এক টাকা দিতে গেলে বিরাগী হরিদা তা নেন না, বরং বলে যান—“আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।”
উল্লিখিত ঘটনায় বক্তার পরিচয়: হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন সারাবছরের রোজগার করে আনার জন্য। কিন্তু চরিত্রটার সঙ্গে তিনি এতটাই একাত্ম হয়ে যান যে তাঁর আর উপার্জনের লক্ষ্য থাকে না। বহুরূপীর বেশে নিজের সৃষ্টিতে তিনি মগ্ন হয়ে যান। তাই খাঁটি সন্ন্যাসীর মতো সব কিছুকে তুচ্ছ করে হরিদা চলে যান। নইলে তাঁর ‘ঢং নষ্ট’ হয়ে যাওয়ার ছিল
বহুবিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর
ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. হরিদা জগদীশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন-
(ক) সন্ধ্যাবেলা
(খ) দুপুরবেলা
(গ) বিকেলবেলা
(ঘ) ভোরবেলা
২. যখন হরিদা বহুরূপী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি গেলেন তখন তাঁর গায়ে ছিল-
(ক) পাঞ্জাবি
(খ) সুতির জামা
(গ) সাদা চাদর
(ঘ) সাদা উত্তরীয়
৩. সাদা মাথা, সাদা দাড়ি, সৌম শান্ত ও জ্ঞানী মানুষটি হলেন—
(ক) বিরাগীরূপী হরিদা
(খ) আগত সন্ন্যাসী
(গ) জগদীশবাবু
(ঘ) এঁদের কেউ নন
৪. বিরাগীর ঝোলার ভিতর ছিল-
(ক) গল্পের বই
(খ) জামাকাপড়
(গ) গীতা
(ঘ) কোরান
৫. হরিদার শীর্ণ শরীরটা দেখে মনে হয়েছিল-
(ক) অশরীরী
(খ) মহাপুরুষ
(গ) অতিমানব
(ঘ) কোনোটাই নয়
৬. “আপনি কি ভগবানের চেয়েও বড়ো?” -এ কথা বলেছেন-
(ক) জগদীশবাবু
(খ) হরিদা
(গ) সন্ন্যাসী
(ঘ) ভবতোষ
৭. “পরম সুখ কাকে বলে জানেন?”—‘পরম সুখ তে বক্তা জানিয়েছেন—
(ক) সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া
(খ) টাকাপয়সার মোহ ত্যাগ করা।
(গ) সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া
(ঘ) সন্ন্যাসী হয়ে বনে চলে যাওয়া
৮. হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন যা বলে—
(ক) মহাপুরুষ
(খ) সন্ন্যাসী
(গ) বিরাগী
(ঘ) কোনোটাই নয়
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. কোন্ সময় এবং কী বেশে হরিদা জগদীশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন?
উত্তর – ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা সন্ধ্যার সময় আদুড় গায়ে একটি ধবধবে সাদা উত্তরীয় আর ছোটো থান পরে বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন।
২, “চমকে উঠলেন জগদীশবাবু।”—জগদীশবাবুর চমকে ওঠার কী?
উত্তর – গল্পকার সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পে আদুড় গা, তার উপরে সাদা উত্তরীয়; পরনে ছোটো বহরের সাদা থান পরা বিরাগীবেশী হরিদাকে দেখে জগদীশবাবু চমকে গিয়েছিলেন।
৩. “জগদীশবাবুর দুই বিস্মিত চোখ অপলক হয়ে গেল”- কী জগদীশবাবুর এমন অবস্থা হয়েছিল?
উত্তর – জগদীশবাবু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে যখন দেখেছিলেন আদুড় গায়ে সাদা উত্তরীয় পরা এক বিরাগী সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন।
৪. “আমার অপরাধ হয়েছে” ”—বক্তার অপরাধ কী ছিল?
উত্তর – বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পের আলোচ্য অংশে বিরাগী সাজে হরিদাকে দেখে জগদীশবাবু ওপর থেকে নীচে নেমে আসেননি। এটাই ছিল তাঁর অপরাধ।
৫. হরিদার বিরাগী মূর্তি সম্পর্কে লেখক কী মন্তব্য করেছেন?
উত্তর – বিরাগীকে দেখে লেখক মন্তব্য করেছেন সীমার ওপার থেকে তিনি যেন হেঁটে এসেছেন। তাঁর শীর্ণ শরীর যেন অশরীরী সত্তা। উদাত্ত, শান্ত ও উজ্জ্বল দৃষ্টি তাঁর চোখ থেকে ঝরে পড়ছে।
৮. বিরাগী মতে ‘পরম সুখ’ আসলে কী?
উত্তর – হরিদা বিরাগী সাজলে কথক ও তাঁর বন্ধুরা তাঁকে চিনতেই পারেননি। তাঁদের মধ্যে ভবতোষ ভেবেছিল এই বিরাগী কখনোই হরিদা হতে পারেন না।
৯. বিরাগীর কাছে জগদীশবাবুর প্রাণের অনুরোধটি কী ছিল এবং তা শুনে বিরাগী কী বলেছিলেন?
উত্তর – জগদীশবাবু বিরাণীকে তাঁর বাড়িতে কিছুদিন থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। এই কথা শুনে বিরাণী বলেছিলেন ধরিত্রীই তাঁর আসল থাকার জায়গা। দালান বাড়িতে তিনি থাকতে পারবেন না।
১০. বিরাগী চলে যাওয়ার আগে জগদীশবাবু কী করেছিলেন?
উত্তর – বিরাগী চলে যাওয়ার আগে জগদীশবাবু নোটের তাড়া ভরতি একটি থলে প্রণামিস্বরূপ বিরাগীর পায়ের কাছে রাখেন। এই টাকা তিনি বিরাগীকে তীর্থভ্রমণ উপলক্ষ্যে দিতে চেয়েছিলেন।
১১. “ভ্রমণ করে দেখবার তো কোনো দরকার হয় না।” -কেন ভ্রমণ করে দেখবার দরকার হয় না?
উত্তর – গল্পকার সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পে বিরাগী হরিদার মতে, তার বুকের ভিতরেই রয়েছে সব তীর্থ, তাই ভ্রমণ করে দেখবার প্রয়োজন হয় না।
১২. বিরাগী জগদীশবাবুর দেওয়া তীর্থভ্রমণের টাকা নিলেন না কেন?
উত্তর – বিরাগীকে জগদীশবাবু তীর্থভ্রমণের টাকা দেওয়ায় তিনি বলেন তাঁর বুকের ভেতরই রয়েছে সব তীর্থ। তাই তাঁর ভ্রমণ করে তীর্থ দেখার কোনো প্রয়োজন হয় না।
১৩. “আমার অনুরোধ বিরাগীজি..।”—বক্তা বিরাগীজিকে কী অনুরোধ করেছিলেন?
উত্তর – গল্পকার সুবোধ ঘোষের ‘বহুরুপী’ গল্পের আলোচ্য অংশের বক্তা জগদীশবাবু বিরাগীজিকে তীর্থভ্রমণের জন্য কিছু টাকা নিতে অনুরোধ করেছিলেন।
১৪. জগদীশবাবু তীর্থভ্রমণের জন্য কত টাকা দিতে চেয়েছিলেন?
উত্তর – সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে জগদীশবাবু তীর্থভ্রমণের জন্য বিরাগীকে একশো এক টাকা দিতে চেয়েছিলেন।
১৫. “বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নেমে গেলেন বিরাগী”—কী বলতে বলতে নেমেছিলেন?
উত্তর – “আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।”—এ কথা বলতে বলতেই বিরাগী সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।
ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. “বড়ো চমৎকার আজকে এই সন্ধ্যার চেহারা”- সন্ধ্যার যে সৌন্দর্যের বর্ণনা এখানে আছে তা লেখো।
উত্তর – ‘বহুরূপী’ গল্পে উল্লিখিত সন্ধেবেলায় দেখা যায় অনেকদিন পর চাঁদের আলো শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল আলোর সৌন্দর্যে ভরে গেছে চারিদিক। ঠান্ডা ফুরফুরে বাতাস বইছে। গাছের পাতাও হাওয়ায় দুলছে আর তারা যেন ঝিরঝির শব্দ দিয়ে কিছু বলতে চাইছে। চারিদিক শান্ত, স্নিগ্ধ। জগদীশবাবুর বাড়ির বারান্দাতে মস্ত বড়ো একটা আলো জ্বলছে। আর সেই আলোর কাছে একটা চেয়ারের ওপর জগদীশবাবু বসে আছেন।
২. “ও চেহারা কি সত্যিই কোনো বহুরূপীর হতে পারে।”—কার কথা বলা হয়েছে? সেই চেহারার বর্ণনা দাও।
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: উল্লিখিত অংশে বিরাগীর বেশ ধারণকারী হরিদার কথা বলা হয়েছে।
চেহারার বর্ণনা: বিরাগীর খালি গায়ে ছিল ধবধবে সাদা উত্তরীয়, পরনে ছিল একটি ছোটো থান, মাথায় শুকনো সাদা চুল, হাতে ছিল একটা ঝোলা আর পা ছিল ধুলোমাখা। তাঁর ঝোলায় ছিল একটা গীতা। দেখে মনে হচ্ছিল যেন জগতের সীমার ওপার থেকে তিনি হেঁটে হেঁটেই চলে এসেছেন। শীর্ণ শরীরটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন অশরীরী চেহারা আর তাঁর চোখ থেকে একটা অদ্ভুত উদাত্ত, শান্ত ও উজ্জ্বল দৃষ্টি যেন ঝরে পড়ছিল।
৩. “আপনি কি ভগবানের চেয়েও বড়ো?”—কাকে এ কথা বলা হয়েছে? এ কথা বলার কারণ কী?
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি : বিরাগীবেশী হরিদা জগদীশবাবুকে এ কথা বলেছেন। • এ কথা বলার কারণ: বিরাগীর বেশে হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে এলে জগদীশবাবু তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। সাধুসঙ্গে আগ্রহী জগদীশবাবু তাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানান। তিনি তখন বারান্দায় একটা চেয়ারে বসেছিলেন। বারান্দা থেকে জগদীশবাবুর নেমে না আসাটা বিরাগীর ক্ষোভের কারণ হয়। তিনি রুষ্টভাবে বলেন যে এগারো লক্ষ টাকার সম্পত্তির অহংকারে জগদীশবাবু নিজেকে ভগবানের থেকেও বড়ো বলে মনে করছেন।
৪. “আমি এই সৃষ্টির মধ্যে এককণা ধূলি।”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লেখো।
উত্তর – প্রসঙ্গ: জগদীশবাবু বিরাগীরূপী হরিদাকে ‘মহারাজ’ বলে সম্বোধন করেন। তাঁর কথার উত্তর দিতেই বিরাগী হরিদা এ কথা বলেছেন।
ব্যাখ্যা: বিরাগী হরিদার মতে, আসল মহারাজ হলেন ঈশ্বর। মানুষ কখনও মহারাজ হতে পারে না। পৃথিবীর সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর। মানুষ সেই সৃষ্টির একটি অংশ মাত্র। সামান্য ধূলিকণার সঙ্গে মানুষকে তুলনা করে বিরাগী হরিদা তাঁর সংসারবৈরাগ্যের পরিচয় দিয়েছেন। আসলে এটি ছিল হরিদার সন্ন্যাসীসুলভ দার্শনিক উক্তি ৷
৫. “ওসব হলো সুন্দর সুন্দর এক-একটি বঞ্চনা।”—‘ওসব’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? সেগুলোকে ‘বঞ্চনা’ বলা হয়েছে কেন?
উত্তর – ‘ওসব’ বলতে বোঝানো হয়েছে: ‘ওসব’ বলতে ধন, জন ও যৌবনকেই বোঝানো হয়েছে।
‘বঞ্চনা’ বলার কারণ: হরিদা বিরাগী সেজেছেন। বিরাগীরা হলেন সংসারত্যাগী মানুষ, পৃথিবীর সব মোহ থেকে তাঁরা মুক্ত। তাঁরা সিদ্ধপুরুষ। তাঁদের কাছে এই জগতের সুখ-সমৃদ্ধির কোনো মূল্য নেই। ধন, জন, যৌবন— এগুলিই মানুষের মনকে চঞ্চল করে। আর এসব পাওয়ার নেশায় মানুষ অসহিষু হয়ে ওঠে। প্রাপ্তির পরও তাদের লোভের শেষ থাকে না। আরও পাবার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। তাই ওগুলোকে বিরাগী হরিদা ‘বঞ্চনা’ বলেছেন।
৬. “তবে কিছু উপদেশ শুনিয়ে যান”—বক্তা কে? তিনি কী উপদেশ শুনেছিলেন?
উত্তর – বক্তা: গল্পকার সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরুপী’ গল্পের উল্লিখিত অংশটির বক্তা হলেন জগদীশবাবু।
উপদেশ: বিরাগী তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন— এই ধন, জন, যৌবন সব কিছুই অস্থায়ী, কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এই সমস্ত কিছুই এক-একটি বঞ্চনা। মনপ্রাণের সব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুধু একজনের আপন হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যাঁকে এই সৃষ্টির সব ঐশ্বর্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৭. “আপনি একটি মিনিট থাকুন বিরাগীজি।”—বক্তা কে? এ কথা বলে তিনি কী করেছিলেন? “
উত্তর – বক্তা: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে উল্লিখিত অংশটির বক্তা হলেন জগদীশবাবু।
বক্তার কাজ: বিরাগীর থেকে উপদেশ শোনার পর জগদীশবাবু বিরাগীকে এক মিনিট দাঁড়াতে বলে ভিতর থেকে একটি থলি নিয়ে আসেন। সেই থলির ভেতর ছিল নোটের তাড়া। থলিটা বিরাগীর পায়ের কাছে রেখে, জগদীশবাবু ব্যাকুল স্বরে প্রার্থনা করেন তাঁর দান গ্রহণ করার জন্য। জগদীশবাবু বিরাগীর তীর্থভ্রমণ উপলক্ষ্যে সেই অর্থ দান করতে চেয়েছিলেন।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
১. “চমকে উঠলেন জগদীশবাবু”—জগদীশবাবুর তাঁর চমকে ওঠার কারণ বর্ণনা করো।
উত্তর – জগদীশবাবুর পরিচয়: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরুপী’ গল্পে জগদীশবাবু এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি অবস্থাপন্ন ও জ্ঞানী মানুষ। শান্ত সৌম্যকান্তি: সাদা মাথা ও সাদা দাড়িতে তাঁকে যথেষ্টই সৌম্য এবং শান্ত দেখায়। সাধু সন্ন্যাসীতেও তাঁর প্রবল ভক্তি। আশীর্বাদ লাভের চেষ্টা: তবে অর্থের সাহায্যে সহজে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের চেষ্টাও তিনি করেছেন। হিমালয়ের গুহায় বাস করা সন্ন্যাসীর কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে যেভাবে তিনি তাঁর ‘দুর্লভ’ পায়ের ধুলো সংগ্রহ করেছেন সেখানে তাঁর সহজ ভক্তি ছিল না। বিরাগীর সেবা: বিরাগীবেশী হরিদাকে দেখেও বিচলিত হয়েছেন জগদীশবাবু। তাঁকে বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করেছেন, তাঁর সেবা ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ভক্তিভাবনা জীবনযাত্রা: শেষপর্যন্ত কোনো কিছুতেই সফল না হয়ে তিনি তাঁর তীর্থ পরিক্রমার জন্য একশো এক টাকা প্রণামি হিসেবে দিতে চেয়েছেন। জগদীশবাবুর ভক্তিভাবনার সঙ্গে তাঁর সচ্ছল জীবনযাত্রার বিষয়টি এভাবেই সচ্ছল বারেবারে যুক্ত হয়ে গেছে। তবুও: তাঁর বিনয়, সাধুসঙ্গলাভের ইচ্ছা, শান্তির সন্ধান ইত্যাদি বিষয়গুলি চরিত্রটিকে আলাদা করে তুলেছে।
জগদীশবাবুর চমকে ওঠার কারণ: এক মনোরম সন্ধ্যায় জগদীশবাবু বাড়ির বারান্দায় একটা চেয়ারের উপরে বসেছিলেন। সেই সময়ে সেখানে বিরাগীবেশী হরিদার আগমন ঘটে। ধবধবে সাদা উত্তরীয় গায়ে, ছোটো বহরের সাদা থান পরা হরিদাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন জগতের সীমার ওপার থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছেন। তাঁকে দেখেই জগদীশবাবু চমকে যান।
২. জগদীশবাবুর বাড়ি হরিদার বিরাগী সেজে যাওয়ার পর যে ঘটনা ঘটেছিল তা বর্ণনা করো।
উত্তর – বিরাগীর পোশাক: জগদীশবাবুর বাড়িতে বিরাগী হরিদার খালি গায়ে ছিল সাদা উত্তরীয় আর পরনে ছিল সাদা ছোটো থান। তার পা ছিল ধুলোমাখা আর সঙ্গে ছিল একটা ঝোলা। সেই ঝোলার মধ্যে একটি গীতা রাখা ছিল। বিরাগী হরিদাকে দেখে জগদীশবাবু চমকে ওঠেন। বিরাগীর বক্তব্য: জগদীশবাবুকে বিরাগী বলেন যে তিনি নিজের সম্পত্তি আর অর্থের অহংকারে নিজেকে ভগবানের থেকেও বড়ো বলে মনে করেন। জগদীশবাবু বিরাগীকে রাগ করতে বারণ করায় বিরাণী জবাব দেন যে তিনি বিরাগী, রাণ নামে তাঁর কোনো রিপুই নেই। বিরাগীকে জগদীশবাবু তাঁর বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু বিরাগী তাঁকে বলেন ধরিত্রীর মাটিতেই তাঁর স্থান, তাই তিনি এই দালান বাড়িতে থাকবেন না। খাবার গ্রহণ না করা: খাওয়ার কথা বলা হলে তিনি কোনো কিছু স্পর্শ না করে শুধু এক গ্লাস ঠান্ডা জল খান। মোহমুক্তির বাণী: বিরাগী জগদীশবাবুকে মোহমুক্ত হওয়ার কথা বলে জানান ধন, যৌবন সব কিছুই বঞ্চনাস্বরূপ। যাকে পেলে সৃষ্টির সব ঐশ্বর্য পাওয়া যাবে তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার উপদেশ দিয়ে বিরাগী চলে যান। নির্লোভ মানসিকতা: তীর্থভ্রমণের জন্য জগদীশবাবু বিরাগীকে একশো এক টাকা দিতে চাইলে বিরাগী সেই টাকা নেননি। সন্ন্যাসীর মতে, তিনি যেমন ধুলো মাড়িয়ে যেতে পারেন তেমনই অনায়াসে সোনা, টাকা এইসব মাড়িয়েও চলে যেতে পারেন। এই বলে সন্ন্যাসী সেখান থেকে চলে যান।
৩. “পরমসুখ কাকে বলে জানেন? সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া।”—হরিদার জীবনে এ সত্য কীভাবে সার্থক হয়েছে আলোচনা করো।
উত্তর – বক্তা ও প্রসঙ্গ: ‘বহুরুপী’ গল্পে জগদীশবাবুর বাড়িতে বিরাগীবেশী হরিদা জগদীশবাবুকে উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছিলেন। আপাতভাবে বহুরুপী | হরিদা নিজের ছদ্মবেশ নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু নিজের আচরণ দিয়ে এই বক্তব্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জগদীশবাবুর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের জন্য তাঁর অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বন্ধন মুক্তি: খোলা আকাশ আর মাটি ছেড়ে ‘বিষয়ীর দালান বাড়ি’-তে থাকতে তিনি নিজের আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন— “ধন জন যৌবন কিছুই নয় জগদীশবাবু। ওসব হলো সুন্দর এক একটি বনা।” ঈশ্বরকে পাওয়াই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত। বিরাগীবেশে হরিদার এই মন্তব্য যে কথার কথা ছিল না তা বোঝা যায় যখন জগদীশবাবুর দেওয়া প্রণামির একশো এক টাকা তিনি ফেলে রেখে যান। নির্লোভ মানসিকতা: যাওয়ার সময়ে বলে যান—“আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।” অথচ হরিদা বড়োরকম উপার্জনের জন্যই জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। পেশার প্রতি নিষ্ঠা: নিজের এই আচরণের ব্যাখ্যায় হরিদা পরে জানিয়েছিলেন যে, টাকা স্পর্শ করলে তাঁর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ এভাবে বিরাগী চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন হরিদা।
৪. “আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।”—ছদ্মবেশ ধারণ করেও হরিদা কীভাবে এই কথার সত্যতা প্রমাণ করেছেন লেখো।
উত্তর – নাটকীয় বৈচিত্র্যে ভরা জীবন: বড়ো চমকপ্রদ এবং নাটকীয় বৈচিত্র্যে ভরা হরিদার জীবন। বাঁধাধরা আর পাঁচটা পেশায় তিনি নিযুক্ত হতে চাননি। কারণ একঘেয়ে কাজ করতে তাঁর ভয়ানক আপত্তি ছিল। আর্থিক অসচ্ছলতা: বহুরূপী সেজে তিনি যা উপ । করতেন তাতে ঠিকমতো তাঁর দিন চলত না। সন্ন্যাসীর কথা: এই সময় তিনি শোনেন জগদীশবাবুর বাড়িতে এক সন্ন্যাসীর আসার কথা। ধনী জগদীশবাবু সেই সন্ন্যাসীকে অর্থ-সহ নানা কিছু দান করেছিলেন।
বিরাগীর ছদ্মবেশ: সন্ন্যাসীর গল্প হরিদাকে উজ্জীবিত করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি থেকে বেশ কিছু আদায় করবেন, যা দিয়ে তাঁর সারাবছর চলে যাবে। নির্লোভ: হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি উপস্থিত হন। জগদীশবাবু তাঁকে দেখে অভিভূত এবং ভক্তিতে গদগদ হয়ে প্রথমে তাঁর বাড়িতে থাকার কথা বলেন। তারপর টাকার থলি এনে হরিদার পায়ের কাছে রাখেন। কিন্তু হরিদা প্রকৃত বিরাগীর মতো সব কিছু প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর লোভ ত্যাগে পরিণত হয়। পেশাদারিত্বের পরাজয়: বিরাগীর চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম বহুরূপী হরিদা ঘোষণা করেন যে, তাঁর কাছে ধুলোর মতো সোনাও তুচ্ছ। চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা তাঁর চরিত্রকে মহনীয় করে তোলে, যার কাছে পেশাদারিত্বও পরাজিত হয়।
৫. “সেদিকে ভুলেও একবার তাকালেন না বিরাগী।”—বিরাগী কোন্ দিকে তাকালেন না? তাঁর না তাকানোর কারণ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর – উপেক্ষার উপলক্ষ্য: কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের লেখা ‘বহুরূপী’ ছোটোগল্পে বিরাগী হরিদা তাঁর পায়ের কাছে রাখা জগদীশবাবুর একশো টাকা ভরতি থলির দিকে তাকাননি।
না তাকানোর কারণ: হতদরিদ্র হরিদা বহুরূপী সেজে অধিক উপার্জনের জন্য জগদীশবাবুর বাড়িতে বিরাগী সেজে গিয়েছিল। তাৎপর্যবাহী: অথচ জগদীশবাবুর দেওয়া প্রণামি হিসেবে একশো এক টাকার একটা থলি পেয়েও তিনি সেদিকে তাকাননি। গল্পের এই ঘটনা গভীর তাৎপর্য বহন করে। বহুরূপী পেশা: হরিদা বহুরুপী। এটাই তাঁর পেশা। পুলিশ, পাগল, বাইজি প্রভৃতি সেজে তিনি পয়সা রোজগার করেছেন। উক্ত পেশাগুলির সঙ্গে পয়সা নেওয়ার ব্যাপারটা খুব একটা অসংগতিপূর্ণ নয়। বিরাগীর ছদ্মবেশ: কিন্তু বিরাগী তো এক লোভহীন জীবানাদর্শকে মেনে চলেন। সংসারত্যাগী বিরাগীর কাছে টাকাপয়সা, ধনদৌলত অতি তুচ্ছ বিষয়। তা গ্রহণ করলে বিরাগীর আদর্শ বা ঢং নষ্ট হয়। চরিত্রের গাম্ভীর্য: আসলে বহুরূপী হরিদা বাদবাকি যেসব চরিত্রের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন সেসমস্ত ক্ষেত্রেও তিনি সেরূপ আচরণ করেছিলেন। সেখানে চরিত্রগুলির গুরুত্ব বা গাম্ভীর্য কিংবা তাৎপর্য—ে —কোনো কিছুই বিরাগীর চরিত্রের সমান নয়। বিরাগী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন যে, ‘পরম সুখ’ হল “সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া।” এই বোধ থেকেই হরিদা টাকার থলির দিকে তাকাননি।
বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর
ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. “সে-কথা কি ভুলেই গেলেন।”—ভুলেই গিয়েছিলেন—
(ক) জগদীশবাবুর বাড়িতে যাওয়ার কথা
(খ) প্রণামি গ্রহণ করার কথা
(গ) সন্ন্যাসীকে প্রণাম করার কথা
(ঘ) হরিদার জবর খেলা দেখানোর কথা
২. “হরিদা চুপ করে বসে আছেন।”—হরিদা কীভাবে বসেছিলেন?
(ক) ধ্যানস্থ হয়ে
(খ) আকাশের দিকে তাকিয়ে
(গ) বিড়ি ধরিয়ে
(ঘ) গালে হাত দিয়ে
৩. “আপনিই বিরাগী?”—কথাটি বলেছিলেন-
(ক) কথক
(খ) ভবতোষ
(গ) জগদীশবাবু
(ঘ) কাশীনাথ
৪. “ওই তো সেই সাদা উত্তরীয়টা পড়ে রয়েছে…”
(ক) দড়ির উপরে
(খ) মেঝেতে
(গ) মাটিতে
(ঘ) মাদুরের উপরে
৫. হরিদা সব তুচ্ছ করে সরে পড়েছিলেন-
(ক) খাঁটি সন্ন্যাসীর মতো
(খ) আদর্শ মানুষের মতো
(গ) প্রতারকের মতো
(ঘ) কোনো উদাসীর মতো
৬. বিরাগী সেজে হরিদা টাকার থলি স্পর্শ করেননি, কারণ-
(ক) থলিতে কম টাকা ছিল
(খ) কৃপণ লোকের টাকা তিনি স্পর্শ করবেন না
(গ) তাঁর টাকার প্রয়োজন নেই
(ঘ) টাকা নিলে ঢং নষ্ট হয়ে যাবে
৭. হরিদা জগদীশবাবুর বাড়ি আবার যেতে চাইলেন-
(ক) টাকার থলি নেওয়ার জন্য
(খ) বকশিশ নেওয়ার জন্য
(গ) জগদীশবাবুর বাড়িতে থাকার জন্য
(ঘ) কোনোটাই নয়
৮. “চেঁচিয়ে ওঠে ভবতোষ।” —ভবতোষ চেঁচিয়ে ওঠে-
(ক) বকশিশের কথা শুনে
(খ) হরিদার টাকা ত্যাগ করার কথা শুনে
(গ) হরিদার বাঘসাজ দেখে
(ঘ) জগদীশবাবুর টাকার পরিমাণ শুনে
৯. “হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবেন না।”—যিনি ক্ষমা করবেন না—
(ক) অদৃষ্ট
(খ) ভগবান
(গ) জগদীশবাবু
(ঘ) দর্শকরা
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. হরিদার ঘরে গিয়ে গল্পের কথক কী দেখেছিলেন?
উত্তর – হরিদার ঘরে গিয়ে কথক দেখেন, উনানের গনগনে আগুনে হাঁড়িতে চাল ফুটছে আর হরিদা একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে চুপ করে বসে আছেন।
২. “এটা কী কাণ্ড করলেন” – কে, কী কাণ্ড করেছিলেন?
উত্তর – হরিদা বিরাগী সেজেছিলেন। জগদীশবাবু তাঁকে তীর্থভ্রমণের টাকা দিতে গেলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই কাণ্ডের কথাই এখানে বলা হয়েছে।
৩. “তাতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়ে যায়।”—কীসে ঢং নষ্ট হয়ে যেতে পারতো?
উত্তর – গল্পকার সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পে জগদীশবাবুর বাড়িতে টাকা স্পর্শ করলে হরিদার ঢং নষ্ট হয়ে যেতে পারতো।
৪. “অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না।”—হরিদার কোন্ ভুলের কথা এখানে বলা হয়েছে?
উত্তর – হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর কাছ থেকে অনেকগুলো টাকা পেয়েও গ্রহণ করেননি। এখানে তাঁর টাকা না নেওয়াকেই ভুল বলা হয়েছে।
৫. হরিদা কী কারণে আবার জগদীশবাবুর বাড়ি যেতে চেয়েছিল?
উত্তর – সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা বহুরূপী সেজে নিজের পাওনা বকশিশটুকু নেওয়ার জন্য জগদীশবাবুর বাড়ি আবার যেতে চেয়েছিলেন।
৬. “কী অদ্ভুদ কথা বললেন হরিদা!”—হরিদার ‘অদ্ভুদ’ কথাটি কী ছিল?
উত্তর – হরিদার ‘অদ্ভুদ’ কথাটি ছিল একজন বিরাগী সন্ন্যাসী সেজে টাকা স্পর্শ করা যায় না, তাতে তাঁর বহুরূপীর ঢং নষ্ট হয়ে যায়।
৭. হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে কত বকশিশ পেতে পারতেন?
উত্তর – হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে খুব বেশি হলে আট আনা কিংবা দশ আনা বকশিশ পেতে পারতেন।
৮. কেন হরিদা বকশিশ হিসেবে আট আনা বা দশ আনাকেই তাঁর প্রাপ্য মনে করেছিলেন?
উত্তর – ‘বহুরূপী’ গল্পে বহুরূপীর জীবনে আট আনা বা দশ আনার বেশি আশা করা উচিত নয় বলেই সেটুকুকেই হরিদা তাঁর প্রাপ্য মনে করেছিলেন।
ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
১. “হরিদার উনানের আগুন তখন বেশ গনগনে হয়ে জ্বলছে।”হরিদা কে? উক্তিটির মধ্য দিয়ে লেখক পরোক্ষে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর – হরিদার পরিচয়: হরিদা ছিলেন একজন অভাবী মানুষ। তাঁর পেশা ছিল বহুরূপী।
পরোক্ষে লেখকের বক্তব্য: হরিদার ছোট্ট ঘরে উনানে যে আগুন জ্বলে তাতে অনেক সময় শুধু জল ফোটে, ভাত ফোটে না। বহুরূপী সেজে সামান্য রোজগারে প্রতিদিন তাঁর খাবারের সংস্থান হয় না। আবার তাঁর সততা এই অবস্থা থেকে তাঁকে বেরোতে দেয় না। জগদীশবাবুর বাড়িতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধু সন্ন্যাসীর ‘ঢং’ নষ্ট হবে বলে তিনি প্রণামির টাকা গ্রহণ করেননি। খিদের আগুন তাই উনানের আগুনের প্রতীকে জ্বলতেই থাকে হরিদার ঘরে।
২. “আমাদের দেখতে পেয়েই লজ্জিতভাবে হাসলেন”—কে, কাদের দেখতে পেয়ে হেসেছিলেন? লজ্জিতভাবে হাসির কারণ কী?
উত্তর – উদ্দিষ্ট জন: গল্পের কথক এবং তাঁর বন্ধুদের দেখে হরিদা হেসেছিলেন।
লজ্জিতভাবে হাসার কারণ: হরিদা জগদীশবাবুর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করবেন বলে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। কথক ও তাঁর বন্ধুদের কাছে সে-কথা হরিদা আগেই জানিয়েছিলেন। হরিদার বিরাগীমূর্তি দেখে জগদীশবাবু মোহিত হয়ে যান। তিনি হরিদাকে একশো এক টাকা ভরে একটি থলিও দেন। কিন্তু হরিদা সেই টাকার থলি ছুঁয়েও দেখেন না। পূর্বপ্রতিশ্রুতি রাখতে না পারায় তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন।
৩. ‘বহুরূপী’ গল্পে কীভাবে বোঝা গেল যে বিরাগী আসলে হরিদাই ?
উত্তর – লেখক তাঁর বন্ধুদের নিয়ে হরিদার বাড়ি এসে দেখলেন ঘরের উনুনে হাঁড়িতে চাল ফুটছে আর হরিদা বিড়ি ধরিয়ে চুপ করে বসে আছেন। সবাই অবাক হয়ে গেলেন। কেউ-ই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বিরাগী আর হরিদা দুজনে আসলে একই লোক। কারণ হরিদার বিরাগী সাজের সঙ্গে তাঁরা আসল হরিদার কোনো মিল খুঁজে পাননি। কিন্তু বিরাগীর ব্যবহৃত সাদা উত্তরীয়, সেই ঝোলা এবং সেই গীতা হরিদার ঘরের মাদুরের ওপর রাখা আছে দেখে তাঁর বুঝতে পারলেন বিরাগী আসলে হরিদাই।
৪. “খাঁটি সন্ন্যাসীর মতো সব তুচ্ছ করে সরে পড়লেন?”—বক্তা কে? এই প্রশ্নের উত্তরে হরিদা কী বলেছিলেন?
উত্তর – বক্তার পরিচয়: উল্লিখিত অংশের বক্তা অনাদি।
হরিদার বক্তব্য: হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি গেলেও তীর্থভ্রমণ উপলক্ষ্যে জগদীশবাবুর দেওয়া একশো এক টাকা কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। কথক ও তাঁর বন্ধুরা হরিদার এই টাকা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন টাকাটা নিলে তাঁর ঢং নষ্ট হয়ে যেত। যেহেতু তিনি বিরাগী সেজেছিলেন তাই বিরাগীর ধর্ম পালন করেছেন। বিরাগী সন্ন্যাসীরা কোনোদিন টাকা স্পর্শ করেন না, তাই অভাব থাকা সত্ত্বেও হরিদা সেই টাকা নিতে চাননি।
৫. “টাকা-ফাকা কী করে স্পর্শ করি বল?”—কে বলেছিলেন? কেন তিনি এমন কথা বলেছিলেন?
উত্তর – উদ্দিষ্ট জন: বহুরূপী হরিদা উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছিলেন।
এমন কথা বলার কারণ: উপার্জনের আশায় জগদীশবাবুর বাড়িতে হরিদা সন্ন্যাসী সেজে গিয়েছিলেন। কিন্তু হরিদা শেষপর্যন্ত বিরাগী চরিত্রের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রণামির একশো এক টাকাও তিনি গ্রহণ করেননি। এই ঘটনা হরিদার প্রতিদিনের সঙ্গী কথক ও তাঁর বন্ধুদের বিস্মিত করে। তাতেই হরিদা বলেন যে টাকা নিলে সন্ন্যাসীর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যাবে বলেই তিনি তা গ্রহণ করেননি।
৬. “একজন বিরাগী সন্ন্যাসী হয়ে টাকা ফাকা কী করে স্পর্শ করি বল?”—হতদরিদ্র হরিদার এই আচরণের নেপথ্যে কোন্ সত্য লুকিয়ে আছে?
উত্তর – হরিদা পাগল, বাইজি, বাউল ইত্যাদি সেজে পয়সা নিয়েছেন। কিন্তু বিরাগী সেজে পয়সা নিতে পারেননি। বিরাগী হলেন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। জগতের সব মোহ থেকে তাঁরা মুক্ত। হরিদা যখন বিরাগী সেজেছিলেন, তখন তিনি ওই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন। একবারও ভাবেননি, তিনি বহুরূপী। আবার এটাও তিনি ভেবেছিলেন, বিরাগী সেজে পয়সা নিলে সন্ন্যাসীর আদর্শের অপমান করা হবে। বিরাগী চরিত্রের মহিমা তাতে ক্ষুণ্ন হবে। তাই হতদরিদ্র হরিদা জগদীশবাবুর যাবতীয় প্রলোভন ত্যাগ করতে পেরেছিলেন।
৭. “তাতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়ে যায়।”—ঢং’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কীসে ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যায়?
উত্তর – ‘ঢং’ অর্থ: ‘ঢং’ বলতে এখানে অভিনয়কে বোঝানো হয়েছে। → ‘ঢং’ নষ্টের কারণ: হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন বিরাগীর বেশ ধরে অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি সেই সন্ন্যাসীর চরিত্রে নিজেকে মিশিয়ে দেন। ফলে চাহিদা ও লোভহীন জীবনদর্শনের কথাই তিনি শুধু বলেন না, প্রণামির টাকা উদাসীনভাবে ফেলে খে তিনি আচরণেও তার প্রমাণ রাখেন। হরিদা বলেন যে, বিরাগী সন্ন্যাসী হয়ে টাকা স্পর্শ করলে তাঁর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যাবে।
৮. “অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না।”—হরিদা কী ভুল করেছিলেন? কেন সেই ভুল অদৃষ্ট ক্ষমা করবে না বলা হয়েছে?
উত্তর – হরিদার ভুল: হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর কাছ থেকে একশো এক টাকা পেয়েও গ্রহণ করেননি। এটাকেই ‘ভুল’ বলা হয়েছে।
অদৃষ্টের ক্ষমা না করা: হরিদা ছিলেন খুব গরিব। তাঁর পেশা ছিল বহুরুপী সাজা। বহুরূপী সেজে তাঁর উপার্জন ছিল অতি সামান্য। কিন্তু বিরাগী সেজে হরিদা একশো এক টাকা পেয়েছিলেন। এতগুলো টাকা হয়তো তাঁকে অদৃষ্টই দিতে চেয়েছিল। তা না নিয়ে হরিদা অদৃষ্টের বিরাগভাজন হয়েছেন। এই কারণেই বলা হয়েছে অদৃষ্ট তাঁর এই ভুল ক্ষমা করবে না।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
১. “তাতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়ে যায়।”— এই উক্তির মাধ্যমে হরিদা কোন্ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর – বিরাগীর সাজ: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা জগদীশবাবুর বাড়ি বিরাগী সেজে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে কেউ বোঝেনি তিনি হরিদা। জগদীশবাবুর উদ্দেশ্য: জগদীশবাবু হরিদাকে বিরাগী ভেবে ভুল করেছিলেন এবং পুণ্যার্জনের জন্য বিরাগীর তীর্থভ্রমণ উপলক্ষ্যে তিনি তাঁকে টাকা দিতে চেয়েছিলেন। বিরাগী সেই টাকা স্পর্শমাত্র না করে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর্থিক চেষ্টা: হরিদা যথেষ্ট অভাবের মধ্যে দিন কাটাতেন; চাইলেই তিনি টাকাটা নিতে পারতেন এবং তাঁর জগদীশবাবুর বাড়িতে যাওয়ার লক্ষ্যও ছিল সেটাই। কিন্তু তিনি শেষপর্যন্ত তা করেননি। চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া: এখানে বিরাগী চরিত্রটির সঙ্গে হরিদা একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। একজন বিরাগী, যিনি সংসারধর্ম ত্যাগ করেছেন তিনি কোনোদিনই বিষয়ী হন না বা টাকা, সোনা কিছুই স্পর্শ করেন না। এখানে হরিদাও তাই করেছেন। পেশাদারিত্বের পরাজয়: হরিদা পেশায় বহুরূপী হলেও সমস্ত রূপের সঙ্গেই তিনি যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। তাই বিরাগী হয়ে টাকা কেন নেননি জানতে চাওয়া হলে তাঁর জবাব ছিল যে, তাঁর ঢং নষ্ট হয়ে যেত টাকা নিলে। কারণ হরিদা বিরাগীর বেশে সত্যিই সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছিলেন। তাই জগদীশবাবুর থেকে তীর্থভ্রমণের অর্থ নিলে তা তাঁর ধর্মবিরোধী হত।
২. “কী অদ্ভূত কথা বললেন হরিদা।” কোন প্রসঙ্গে হরিদা ‘অদ্ভূত কথা’ বলেছিলেন। কথাটি অদ্ভুত কেন?
উত্তর – প্রসঙ্গ: বিরাণী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে পাওয়া হরিদা প্রণামির টাকা অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করে চলে আসেন। এই ঘটনা তাঁর বাড়িতে চায়ের আড্ডায় উপস্থিত কথক এবং তাঁর বন্ধুদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। তখন হরিদা তাঁদের বলেন যে একজন বিরাণী সন্ন্যাসী হয়ে টাকা স্পর্শ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, তাতে তাঁর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যাবে। এ কথাকেই কথকদের ‘অদ্ভুত কথা’ বলে মনে হয়।
কথাটি ‘অদ্ভুত’ মনে হওয়ার কারণ: কথাটিকে ‘অদ্ভুত’ বলে মনে হওয়ার কারণ, প্রথমত হরিদা ছিলেন একজন পেশাদার বহুরূপী। তাঁর পক্ষে সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে সন্ন্যাসীর মতো নির্লোভ হয়ে যাওয়াটা ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। দ্বিতীয়ত, বহুরুপী হরিদার ছিল অভাবের জীবন। জগদীশবাবুর বাড়ি যাওয়ার আগেই হরিদা বলেছিলেন—“এবার মারি তো হাতি, লুঠি তো ভাণ্ডার।” তাঁর সারাবছরের প্রয়োজনীয় অর্থ জগদীশবাবুর বাড়িতে সন্ন্যাসী সেজে হাতিয়ে নেওয়াই ছিল হরিদার লক্ষ্য। অথচ অনেক টাকা প্রণামি পেয়েও তিনি উদাসীনতার সঙ্গে তা ফেলে রেখে চলে আসেন। যে মানুষটার দু-বেলা ভাত জোটে না সেই যখন সন্ন্যাসীর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলেন তা ‘অদ্ভুত’ বলেই মনে হয়। কারণ এর ফলে সারাজীবন হরিদাকে মাঝে মাঝেই ভাতের হাঁড়িতে জল ফুটিয়েই জীবন কাটাতে হবে।
৩. “খাঁটি মানুষ তো নয়, এই বহুরুপীর জীবন এর বেশি কী আশা করতে পারে?”—বক্তা কে ? খাঁটি মানুষ নয় বলার তাৎপর্য কী?
উত্তর – বক্তার পরিচয়: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরুপী’ গল্পের উল্লিখিত অংশটির বক্তা হলেন হরিদা।
তাৎপর্য: পেশায় বহুরূপী হরিদাই বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি থেকে অনেক উপার্জনের আশা করেছিলেন। তাঁর বেশভূষা, কথাবার্তা চমকে দিয়েছিল জগদীশবাবুকে। তিনি হরিদার ছদ্মবেশ বুঝতে পারেননি। ফলে প্রণামি হিসেবে অনেক টাকাই তিনি হরিদাকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হরিদা তখন সন্ন্যাসীর চরিত্রেই নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিলেন। ফলে উদাসীনভাবে সেই অর্থ ফেলে আসেন। কথক ও তাঁর সঙ্গীরা হরিদার এই আচরণকে সমর্থন করতে পারেননি। তখন হরিদা জানান অর্থ নিলে তাঁর ‘ঢং’ নষ্ট হয়ে যেত। একইসঙ্গে জানান যে, বকশিশের জন্য তিনি অবশ্য জগদীশবাবুর কাছে যাবেন। বহুরুপী হিসেবে মাত্র আট-দশ আনাকেই তিনি নিজের প্রাপ্য বলে মনে করেন। ‘খাঁটি মানুষ’ অর্থাৎ যে নিজের জীবনাচরণ ও জীবনদর্শনকে সৎভাবে অনুসরণ করে তার হয়তো অনেক পাওনা হতে পারে, কিন্তু হরিদা নিজেকে বহুরূপী ভাবেন। নকল করাই তাঁর পেশা। পেশার আড়ালে তাঁর ভিতরের মানুষটা যে সমাজের কাছে হারিয়ে গিয়েছে সেই বিষণ্ণতাই প্রকাশ পেয়েছে বহুরুপী হরিদার উচ্চারণে। ‘খাঁটি মানুষ নয়’—এটাই একজন আদ্যন্ত খাঁটি মানুষের বিলাপ হয়ে থাকে।
৪. “হরিদার জীবনের ভাতের হাঁড়ি মাঝে মাঝে শুধু জল ফুটিয়েই সারা হবে”—এ কথার মধ্য দিয়ে লেখক যে ব্যঞ্ঝনা ফুটিয়ে দিয়ে লেখক যে ব্যানা য তুলেছেন তা লেখো।
উত্তর – বিরাণীর সাজে: ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন অর্থ উপার্জনের আশায়। তাঁর বেশভূষা, কথা বলা জগদীশবাবুকে তো বটেই কথকদেরও চমৎকৃত করে দিয়েছিল। জগদীশবাবু এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি বিরাগীকে আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানান বিরাগীর বিদায়ের সময়ে তীর্থভ্রমণের জন্য প্রণামি হিসেবে টাকাও জগদীশবাবু দিতে চান। লোভহীন বিরাণী: বিরাগীবেশী হরিদা অনায়াসে সেই টাকা প্রত্যাখ্যান করে চলে যান। তিনি যাওয়ার সময় বলে যান—“আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।”—তাঁর এই আচরণ কথকদের বিস্মিত করে। তার কারণ, বিপুল টাকা অগ্রাহ্য করার মধ্যে দারিদ্র্যকে মেনে নেওয়ার ইঙ্গিতই ছিল। চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা: সন্ন্যাসীর চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ফলে সেই চরিত্রের ‘ঢং নষ্ট হবে’ বলে হরিদা টাকা নেননি। আর এই ঘটনা নিশ্চিত করে দেয় যে অভাব কখনও হরিদাকে ছেড়ে যাবে না। ভাতের হাঁড়িতে মাঝেমধ্যে শুধু জলই ফুটবে, তাতে চালের জোগান থাকবে না। কথকের মনে হয় অদৃষ্ট হরিদার এই ভুল কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
৫. “অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না।”—হরিদা কী ভুল করেছিলেন? অদৃষ্ট ক্ষমা না করার পরিণাম কী?
উত্তর – হরিদার ভুল: ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন অর্থ উপার্জনের জন্য। হরিদার বেশভূষা, কথাবার্তায় | জগদীশবাবু এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি ‘বিরাগী’কে আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানান। এমনকি বিদায়ের সময়ে একশো টাকা প্রণামীও দিতে চান। কিন্তু উদাসীনভাবে হরিদা সে টাকা প্রত্যাখ্যান করে চলে যান। যাওয়ার সময়ে বলে যান—“আমি যেমন অনায়াসে ধুলো মাড়িয়ে চলে যেতে পারি, তেমনই অনায়াসে সোনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।” সন্ন্যাসী চরিত্রের সঙ্গে তিনি এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন যে, চরিত্রের ‘ঢং নষ্ট হবে’ বলে হরিদা টাকা নেননি। বিস্মিত গল্পকথক এটাকেই হরিদার ‘ভুল’ বলেছেন।
পরিণতি: অভাবী হরিদার ভাগ্য হরিদাকে সঙ্গ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত সততা ও আদর্শবোধের কারণে হরিদা ভাগ্যের সহায়তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যা নিশ্চিত করে দিয়েছে যে অভাব কখনও হরিদাকে ছেড়ে যাবে না। তার ভাতের হাঁড়িতে মাঝে মধ্যে শুধু জলই ফুটবে, তাতে চালের জোগান থাকবে না। কথকের মনে হয়েছে অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুলকে ক্ষমা করবে না।
সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর
১. ‘বহুরূপী’ গল্প অবলম্বনে হরিদার জীবনযাত্রার পরিচয় দাও।
উত্তর – দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই: হরিদা ছিলেন গরিব মানুষ। শহরের সবচেয়ে ছোট্ট একটা গলির মধ্যে তাঁর ছোটো ঘরটি ছিল। এই ঘরে বসত কথকদের চায়ের আড্ডা। যদিও চা, চিনি, দুধ কথকরা নিজেরাই আনতেন। হরিদা শুধু তাঁর উনুনের আগুনের আঁচে জল ফুটিয়ে দিতেন। ঘড়ির কাঁটা ধরে কোনো ধরাবাঁধা কাজ করার ক্ষেত্রে হরিদার প্রাণের মধ্যেই যেন বাধা আছে। অভাব সহ্য করতে আপত্তি না থাকলেও একঘেয়ে কাজ করতে তাঁর ভীষণ আপত্তি ছিল।
নাটকীয় বৈচিত্র্য: হরিদার জীবনের একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য ছিল। হরিদা মাঝে মাঝেই বহুরূপী সেজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। কখনও পাগল, কখনও পুলিশ, কাবুলিওয়ালা, ফিরিঙ্গি সাহেব, আবার কখনও বাইজি সেজে তাঁকে দেখা যেত বিভিন্ন জায়গায়। যারা তাঁকে চিনতে পারত তারা এক-দু আনা বকশিশ দিত। আর যারা চিনতে পারত না তারা হয় কিছুই দিত না কিংবা বিরক্ত | হয়ে দুটো-একটা পয়সা দিত। কোনোদিন বা তাঁর বেশিই রোজগার হত। এই বহুরূপী সাজই একরকম তাঁর জীবনের পেশা হয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে : এইভাবে শহরের জীবনে মাঝে মাঝেই চমৎকার সব ঘটনা ঘটিয়ে, বহুরুপী বেশে কিছু রোজগার করে হরিদার জীবন চলত।
২. ‘বহুরূপী’ গল্প অবলম্বনে জগদীশবাবুর চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
উত্তর – কথামুখ: ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা হলেও গল্পের মূল ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা দিতে জগদীশবাবুর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তি জগদীশবাবু: ব্যক্তি জগদীশবাবু ধনী, ঐশ্বর্যশালী। কৃপণ হলেও তিনি সৌম্য, শান্ত এবং জ্ঞানী।
ভক্তির আতিশয্য: জগদীশবাবু ঈশ্বরবিশ্বাসী, তাই তিনি সাধুসন্ন্যাসীর সেবা করা পছন্দ করতেন। বাড়িতে আগত হিমালয়বাসী সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নেওয়ার জন্য তিনি কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে দিয়েছেন। বিরাগী হরিদার কাছেও দুই হাত জোড় করে তাঁকে তাঁর বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন। এমনকি তীর্থভ্রমণের জন্য একশো এক টাকার একটি থলি বিরাগীর পায়ের কাছে নিবেদন করেছেন। আন্তরিক বিনয়ের সঙ্গে জগদীশবাবু বিরাগীর কাছে উপদেশও প্রার্থনা করেছেন। এই সমস্ত দিক থেকে জগদীশবাবু চরিত্রের মধ্যে ভক্তির আতিশয্যও বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।
কাহিনির গতি নিয়ন্ত্রক: বহুরূপী হরিদা বিরাগী সেজে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বিষয়-আসক্তিকে ত্যাগ করার মধ্যেই প্রকৃত ঈশ্বরসন্ধান সম্ভব। জগদীশবাবুর বিত্ত-নির্ভর ভক্তিভাবনা হরিদার মতাদর্শকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। জগদীশবাবুর প্রলোভন বিরাগীর চরিত্রাদর্শকে কষ্টিপাথরে যাচাই করে সত্যে পরিণত করেছে। জগদীশবাবু এখানে উপলক্ষ্যের ভূমিকা পালন করেছেন। এককথায় বলা যায় জগদীশবাবু ‘বহুরূপী’ গল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র, যাঁর দ্বারা কাহিনির গতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
৩. ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদার চরিত্রটি আলোচনা করো।
উত্তর – কথামুখ: সুবোধ ঘোষের ‘বহুরুপী’ গল্পটির কাহিনিই বিকাশ লাভ করেছে হরিদার চরিত্রকে কেন্দ্র করে। তাঁর চরিত্রের মধ্যে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, তা হল-
বৈচিত্র্যসন্ধানী: জীবনে কোনো ধরাবাঁধা কাজ হরিদার পছন্দ ছিল না। কাজের মধ্যে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার আনন্দ খুঁজে নিতে চান হরিদা। আর একারণেই অন্য নিশ্চিত পেশায় না গিয়ে বহুরূপীর পেশা গ্রহণ করেছিলেন হরিদা।
সামাজিকতা: হরিদার চরিত্রের মধ্যে সামাজিকতার দিকটি লক্ষণীয়। শহরের সবথেকে সরু গলিটার ভিতরে তার ছোট্ট ঘরটিই কথকদের চার বন্ধুর সকালসন্ধ্যার আড্ডার ঘর। চা, চিনি, দুধ কথকরা নিয়ে আসেন আর হরিদা উনানের আঁচে জল ফুটিয়ে দেন।
পেশাগত দক্ষতা: কখনও বাসস্ট্যান্ডের পাগল, কখনও রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাইজি, বাউল, কাপালিক, বুড়ো কাবুলিওয়ালা, ফিরিঙ্গি সাহেব— এরকম অজস্র রূপে হরিদাকে দেখা গেছে। শুধু সাজ নয়, চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ছিল তাঁর আচরণ।
সততা: হরিদার চরিত্রটি পরিণতির শীর্ষ ছুঁয়েছে কাহিনির শেষে। বিরাগীর বেশে জগদীশবাবুকে মুগ্ধ করে দিলেও তাঁর আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ কিংবা প্রণামি হরিদা প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবেই পেশাগত সততায় অর্থলোভকে তিনি ত্যাগ করেন। বকশিশ ছাড়া বহুরূপীর জীবন আর কিছু আশা করতে পারে না—হরিদার এ কথা দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালেও তা আসলে তাকে সততার আলোয় আলোকিত করে।
৪. ছোটোগল্প হিসেবে ‘বহুরূপী’ কতদূর সার্থক বিচার করো।
উত্তর – ছোটোগল্প হল একটি একমুখী নিটোল গদ্যকাহিনি, যার বক্তব্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। সূচনায় থাকে আকস্মিকতা এবং উপসংহারে থাকে কৌতূহলবোধ। এই বৈশিষ্ট্যের আলোকে সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পটি বিচার্য।
‘বহুরূপী’ আসলে হরিদা নামে এক হতদরিদ্র মানুষের বাস্তব জীবনযাপনের কাহিনি। ঘড়ির কাঁটার সামনে সময় বেঁধে দিয়ে আর নিয়ম করে একই ধরনের কাজ করা হরিদার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে যেটুকু রোজগার করেন, তাতেই তাঁর কোনোরকমে দিন চলে যায়। পেশা হিসেবে বহুরূপী সাজাকে বেছে নেওয়ার জন্য গল্পের নাম ‘বহুরূপী’। কিন্তু তার মধ্যে জীবনের ব্যঞ্জনাসূচক বিশেষ ভাবসত্যও পাওয়া যায়। হরিদা যখন বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর যাবতীয় প্রলোভন এবং অর্থ তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন, তখনই কাহিনিটি ছোটোগল্পের মর্যাদা পেয়ে যায়। বিভিন্ন চরিত্রের বেশ ধারণ করে পয়সা উপার্জন করাই হরিদার পেশা। তবু তিনি জগদীশবাবুর টাকার থলি স্পর্শ করেননি। করলে ছোটোগল্পের ব্যঞ্জনা নষ্ট হত। করেননি বলেই পাঠকমন গল্পের উপসংহারে এসে অতৃপ্তি আর কৌতূহলে ঘুরপাক খেতে থাকে। এই ধরনের পরিণতিই আধুনিক ছোটোগল্পের বিশেষত্ব। তাই বলা যায়, ছোটোগল্পের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে ‘বহুরূপী’ সার্থক।