wb 10th Sst

WBBSE 10th Class Social Science Solutions Geography Chapter 1 বহির্জাত প্রক্রিয়া ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ

WBBSE 10th Class Social Science Solutions Geography Chapter 1 বহির্জাত প্রক্রিয়া ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ

West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions Geography Chapter 1 বহির্জাত প্রক্রিয়া ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ

West Bengal Board 10th Geography Solutions

TOPIC – A বহির্জাত প্রক্রিয়া ও নদীর কাজের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ

একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি

  1. ভূমিরূপ গঠনকারী দুটি প্রক্রিয়া : প্রধানত দু-রকম প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর ভূমিরূপ অর্থাৎ পাহাড়, পর্বত, মালভূমি, সমভূমি প্রভৃতি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি ভূ-অভ্যন্তরে সৃষ্ট অর্থাৎ অন্তর্জাত প্রক্রিয়া এবং অন্যটি ভূপৃষ্ঠের বাইরে সৃষ্ট বা বহির্জাত প্রক্রিয়া।
  2. বহির্জাত শক্তি : যেসব প্রাকৃতিক শক্তি প্রতিনিয়ত ভূপৃষ্ঠে এবং ভূপৃষ্ঠের সামান্য নীচে অর্থাৎ উপপৃষ্ঠীয় অংশে ক্রিয়াশীল থাকে, তাদের বহির্জাত শক্তি বলে। যেমন—নদী, হিমবাহ, বায়ু, সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি বহির্জাত শক্তি।
  3. বহিজাত প্রক্রিয়া : বহির্জাত শক্তিসমূহ যে পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠ এবং উপপৃষ্ঠকে ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয় কাজের মাধ্যমে নগ্ন বা পরিবর্তিত করে, সেই পদ্ধতিকে বলে বহির্জাত প্রক্রিয়া। যেমন— নদীর কাজ, হিমবাহের কাজ, বায়ুর কাজ, সমুদ্রতরঙ্গের কাজ প্রভৃতি বহির্জাত প্রক্রিয়ার উদাহরণ।
  4. জলচক্রের অংশ হিসেবে নদী: জল কখনও বাষ্প, কখনও মেঘ, কখনও অধঃক্ষেপণরূপে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে অবিরামভাবে আবর্তিত হয়ে যে চক্র সৃষ্টি করে, তাকেই বলে জলচক্র। এর মধ্যে নদী হল এই জলচক্রের অনুভূমিক অংশ এবং বাষ্পীভবন (নীচ থেকে ওপরে ওঠে) ও অধঃক্ষেপণ (ওপর থেকে নীচে নামে) হল জলচক্রের উল্লম্ব অংশ।
  5. ধারণ অববাহিকা: যে অঞ্চলের ছোটো ছোটো জলধারা থেকে নদী সর্বপ্রথম জল সংগ্রহ করে তার প্রবাহকে বাড়ায়, সেই অঞ্চলকে ধারণ অববাহিকা বলে। যেমন—যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের জল দামোদর ও তার বিভিন্ন উপনদীতে এসে পড়ে, সেই সমগ্র অঞ্চলটিই হল দামোদরের ধারণ অববাহিকা।
  6. নদীর অববাহিকা: কোনো নদী ও তার সব উপনদী এবং শাখানদী যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেই সমগ্র অঞ্চলটিকে ওই নদীর অববাহিকা বলে। যেমন—গঙ্গার অববাহিকা।
  7. জলবিভাজিকা : যে উচ্চভূমি দুই বা তারও বেশি নদী অথবা নদী ব্যবস্থাকে পৃথক করে, সেই উচ্চভূমিকে বলা হয় জলবিভাজিকা।
  8. নদীর তিনটি গতি: উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদীর গতিপথকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায় — (1) উচ্চগতি বা পার্বত্যপ্রবাহ, (2) মধ্যগতি বা সমভূমিপ্রবাহ এবং (3) নিম্নগতি বা বদ্বীপপ্রবাহ।
  9. আদর্শ নদী: আদর্শ নদী হল সেই নদী, যার উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন-এই তিনটি গতিপথই সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। ভারতের গঙ্গা একটি
  10. নদীর কাজ : নদী তার প্রবাহপথের বিভিন্ন অংশে ভূমির ঢাল জলের পরিমাণের তারতম্য অনুসারে যে ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ করে, তাকেই এককথায় নদীর কাজ বলে।
  11.  নদীর তিনটি কাজ : উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদী তার চলার পথে তিন ধরনের কাজ করে– (1) ক্ষয়সাধন, (2) বহন এবং (3) সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ। এর মধ্যে উচ্চগতিতে নদী প্রধানত ক্ষয় ও বহন কাজ, মধ্যগতিতে ক্ষয় ও সঞ্চয় কাজ এবং নিম্নগতিতে মূলত সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ করে।
  12. নদীর ক্ষয়কাজ: নদীর জলের আঘাতে যখন নদীখাতের শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় বা নদীখাত থেকে শিলাচূর্ণ, বালি, মাটি ইত্যাদি সরে যায়, তখন সেই স্থানে একে নদীর ক্ষয়কাজ বলে।
  13. নদীর বহন কাজ: নদীর জলের সাহায্যে ক্ষয়জাত পদার্থসমূহ এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় অপসারিত হয়। একে নদীর বহন কাজ বলে।
  14. নদীর সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ কাজ: নদী তার পরিবাহিত পদার্থগুলিকে তলদেশে বা দুইপাশে অবক্ষেপণ করে। একে নদীর সঞ্চয় কাজ বা অবক্ষেপণ বলে।
  15. গা-পদ্মা-মেঘনার বদ্বীপের সক্রিয় অংশের ওপর পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের উন্নতা বৃদ্ধি তথা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে জলের জোগান বেড়ে চলেছে। তার ফলে সমুদ্র জলতলের উচ্চতার বৃদ্ধি ঘটছে। সেজন্য ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপের অর্ধেকটা এবং নিউমুর দ্বীপের পুরোটাই জলের তলায় চলে গেছে। লোহাচড়া দ্বীপটিও একসময় জলমগ্ন হয়েছিল, এখন আংশিকভাবে জেগেছে।

দীর্ঘ উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বর্ণনা করো।
নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপসমূহ
উত্তর – উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদী তার গতিপথে তিনটি কাজ করে—ক্ষয়, বহন এবং সঞ্চয়। এগুলির মধ্যে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে যেসব ভূমিরূপ গঠিত হয়সেগুলি হল—
  1. ‘I’ আকৃতির উপত্যকা বা ক্যানিয়ন: উৎপত্তি: শুষ্ক ও প্রায় শুষ্ক পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে ‘I’-আকৃতির নদী উপত্যকা বা ক্যানিয়নের সৃষ্টি হয়। কারণ, বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্য নদী উপত্যকাগুলির পার্শ্বদেশের বিস্তার কম, কিন্তু ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় নদীগুলির নিম্নক্ষয় বেশি হয়। এজন্য নদী উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়ে ইংরেজি ‘I’ অক্ষরের মতো দেখতে হয়। শুষ্ক ও প্রায় শুষ্ক পার্বত্য অঞ্চলে সংকীর্ণ ও গভীর ‘I’-আকৃতির উপত্যকাকে ক্যানিয়ন বলা হয়। উদাহরণ: কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (গভীরতা প্রায় 1857 মি)।
  2. ‘V’-আকৃতির উপত্যকা বা গিরিখাত: উৎপত্তি: আর্দ্র ও আর্দ্রপ্রায় অঞ্চলে নদীর উচ্চ বা পার্বত্য প্রবাহে ভূমির ঢাল বেশি থাকায় নদীগুলি প্রবলভাবে নিম্নক্ষয় করে। এরূপ নিম্নক্ষয়ের কারণে নদী উপত্যকাগুলি যেমন সংকীর্ণ ও গভীর হয়ে ওঠে তেমনই আবহবিকার, পুঞ্জিতক্ষয় ইত্যাদির প্রভাবে কিছু পরিমাণ পার্শ্বক্ষয়ও চলে। ফলে নদী উপত্যকা আগের থেকে চওড়া হয়ে ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের মতো আকৃতি ধারণ করে। অতিগভীর ‘V’-আকৃতির এই উপত্যকাকে বলা হয় গিরিখাত। উদাহরণ: নেপালের কালী নদীর গিরিখাত।
  3. জলপ্রপাত: উৎপত্তি: নদীর জলপ্রবাহ যখন হঠাৎ কোনো উচ্চ স্থান থেকে নীচের দিকে লাফিয়ে পড়ে, তখন তাকে জলপ্রপাত বলে। নদীর গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর ওপরে নীচে আড়াআড়িভাবে বা অনুভূমিকভাবে অবস্থান করলে, প্রবল স্রোতে ওপরের কঠিন শিলাস্তর ধীরে ধীরে ক্ষয় হওয়ার ফলে নীচের কোমল শিলাস্তর বেরিয়ে পড়ে। কোমল শিলাস্তর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় বলে, সেখানে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় এবং নদীস্রোত খাড়া ঢাল থেকে প্রবল বেগে নীচে আছড়ে পড়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে। উদাহরণ: ভেনেজুয়েলার ক্যারোনি (Caroni) নদীর উপনদী চুরান (Churun) নদীর গতিপথে সৃষ্ট অ্যাঞ্জেল প্রপাতটি পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত।
  4. প্রপাতকূপ বা প্লাঞ্জপুল: উৎপত্তি: জলপ্রপাতের নীচের অংশে জলের গতিবেগ ও শক্তি খুব বেশি থাকে ৷ এজন্য জল যেখানে নীচে পড়ে, নদীখাতের সেই অংশে জলের আঘাতে এবং নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে বেশ বড়ো গর্ত সৃষ্টি হয়। হাঁড়ির মতো দেখতে সেই গর্তকে বলে প্রপাতকূপ বা প্লাঞ্জপুল। উদাহরণ : মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে লিটল ফল জলপ্রপাতের নীচে প্রপাতকূপ আছে।
  5. মন্থকূপ বা পটহোল : উৎপত্তি: উচ্চগতি বা পার্বত্য প্রবাহে নদীর প্রবল স্রোতের সঙ্গে বাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি প্রভৃতি ঘুরতে ঘুরতে নীচের দিকে অগ্রসর হয়। এর ফলে পরিবাহিত নুড়ি ও প্রস্তরখণ্ডের দ্বারা ঘর্ষণজনিত ক্ষয়ের কারণে নদীখাতে কূপের মতো অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়। এগুলিকে বলা হয় মন্থকূপ বা পটহোল। উদাহরণ: তিস্তা নদীর পার্বত্য প্রবাহে অনেক মন্থকূপ দেখা যায়।
    উদাহরণ : পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং হিমালয়ে শৃঙ্খলিত শৈলশিরা দেখা যায়।
  6. শৃঙ্খলিত শৈলশিরা : উৎপত্তি: পার্বত্য অঞ্চলে কঠিন শিলাগঠিত শৈলশিরাসমূহ নদীর গতিপথে অনেকসময় এমন বাধার সৃষ্টি করে যে, সেই বাধা এড়াতে নদী শৈলশিরাগুলির পাদদেশ ক্ষয় করে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। তখন পরপর অবস্থিত ওই শৈলশিরাগুলিকে দূর থেকে শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ দেখায়। ফলে দূর থেকে দেখলে মনে হয় নদী ওই শৈলশিরাগুলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওই শৈলশিরাগুলিকেই শৃঙ্খলিত শৈলশিরা বলে৷
2. নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপসমূহ
উত্তর – নদী পার্বত্য অঞ্চলে প্রধানত ক্ষয়কাজ করে এবং সমভূমি অঞ্চলে সঞ্চয়কাজ করে। নদীর এই সঞ্চয়কাজের ফলে কতকগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, যেমন—
নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা হল—
  1. ত্রিকোণাকার পললভূমি বা পলল ব্যজনী:উৎপত্তি: পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে নদী সমভূমিতে এসে পড়লে, ভূমির ঢাল হঠাৎ কমে যায় বলে নদীর গতিবেগ এবং বহনক্ষমতা—উভয়ই হ্রাস পায়। এর ফলে সমভূমিতে অবতরণের স্থানে অর্থাৎ, পর্বতের পাদদেশে নদীখাতে পলি, বালি, কাঁকর প্রভৃতি জমে ত্রিকোণাকার পললভূমি বা পলল শঙ্কু বা পলল ব্যজনী বা অ্যালুভিয়াল ফ্যানের সৃষ্টি হয় ।

    এরপর নদী ওই পলল ব্যজনীর ওপর দিয়ে বিভিন্ন শাখায় ভাগ হয়ে প্রবাহিত হয়। এর ফলে ওই পলল ব্যজনী প্রায়-গোলাকার ভূমিতে ভাগ হয়ে যায়। যেহেতু এই অর্ধ বা প্রায়-গোলাকার ভূমিরূপ দেখতে হাতপাখার মতো, এজন্য একে পলল ব্যজনী (হাতপাখা) বা পলল পাখা বলে । উদাহরণ : হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গার বিভিন্ন উপনদীর গতিপথে এই ধরনের ভূমিরূপ প্রায়শই দেখা যায়।

  2. নদীচর বা বালুচর: উৎপত্তি: সমভূমিতে নদীর গতিবেগ কম থাকার দরুন পার্বত্য অঞ্চল থেকে বয়ে আনা নুড়ি, পাথর, বালি প্রভৃতি নদীবক্ষে সঞ্চিত হয়ে চরের আকারে জেগে ওঠে। একে নদীচর বা বালুচর বলে। উদাহরণ: অসম সমভূমিতে ব্রহ্মপুত্র নদের মাজুলি দ্বীপটি ভারতের বৃহত্তম নদীচর বা নদীদ্বীপ।
  3. নদীবাঁক: উৎপত্তি: সমভূমিতে ভূমির ঢাল খুব কম বলে নদীর গতিবেগও কমে যায়। এর ফলে সামান্য বাধা পেলেই তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে বাঁকের যে অংশে নদীস্রোত আঘাত করে সেখানে ক্ষয় হয় বলে অবতল বা খাড়া পাড় গঠিত হয়। এর ঠিক বিপরীত অংশে ক্ষয়িত পদার্থসমূহ সঞ্চিত হয়ে উত্তল বা ঢালু পাড় গঠিত হয়। এইভাবে নদীখাতে ক্রমান্বয়ে ক্ষয় ও সঞ্চয়ের জন্য নদীতে অসংখ্য বাঁক সৃষ্টি হয়, যেগুলির মধ্য দিয়ে নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। এই বাঁকগুলিকেই বলে নদীবাঁক বা মিয়েন্ডার। (তুরস্কের মিয়েন্ডারেস নদীর নামানুসারে এই ভূমিরূপের নামকরণ হয় মিয়েন্ডার)। উদাহরণ : পূর্ব বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের কাছে গঙ্গা নদীতে বহু নদীবাঁক দেখা যায়।
  4. প্লাবনভূমি: উৎপত্তি: সমভূমিতে ভূমির ঢাল কম থাকে বলে নদী ধীরগতিতে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে গতিপথের এই অংশে নদীতে হঠাৎ জল বেড়ে গেলে নদীর দু-কূল ছাপিয়ে উপত্যকায় বন্যা বা প্লাবন হয়। প্লাবিত অঞ্চলে নদীর জলের সঙ্গে বাহিত কাদা, পলি, বালি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে যে সমতলভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে বলে প্লাবনভূমি বা প্লাবন সমভূমি। উদাহরণ: বিহারে গঙ্গা নদীর গতিপথের দুই পাশে প্লাবনভূমি দেখা যায়।
  5. স্বাভাবিক বাঁধ: উৎপত্তি: সমভূমিতে নদীর গতিবেগ কম থাকে বলে জলের সঙ্গে যেসব পলি, বালি, কাদা বাহিত হয়ে আসে, নদী সেগুলি আর বহন করতে পারে না। সেগুলি নদীর দুই তীরে ক্রমশ সঞ্চিত হতে হতে কালক্রমে বাঁধের মতো উঁচু হয়ে যায়। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয় বলে এই বাঁধের নাম স্বাভাবিক বাঁধ। উদাহরণ: সমভূমিতে গঙ্গার দুই তীরে বা মিশরে নীল নদের দুই তীরে উঁচু স্বাভাবিক বাঁধ দেখা যায়।
  6. অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ; উৎপত্তি: মধ্যগতির শেষের দিকে এবং নিম্নগতিতে নদীর প্রবাহপথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের (ox-bow lake) সৃষ্টি হয়। এই সময় নদীর গতিবেগ খুব কম থাকে বলে সামান্য কোনো বাধা পেলেই নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথকে বলা হয় মিয়েন্ডার। নদী যখন এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয় তখন প্রবাহপথের অন্তঃবাঁকের (উত্তল পাড়) তুলনায় বহিঃবাঁকে (অবতল পাড়) গতিবেগ বেশি থাকে। তাই বহিঃবাঁকে ক্ষয়কার্য চলে, কিন্তু অন্তঃবাঁকে পলি, কাদা ইত্যাদি সঞ্চিত হয়। নদী যখন খুব বেশি এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়, তখন দুই বাঁক বা জলধারার মধ্যবর্তী ভূমি কালক্রমে সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (বহিঃবাঁকে ক্ষয় প্রক্রিয়ার জন্য)। তার ফলে তখন নদীর ওই দুটি বাঁক বা জলধারার সংযুক্তি ঘটে, অর্থাৎ বাঁকা পথ ছেড়ে নদী তখন সোজা পথে প্রবাহিত হয়। আর পরিত্যক্ত বাঁকটি হ্রদে পরিণত হয়। এই হ্রদ দেখতে ঘোড়ার খুরের মতো হয় বলে এর নাম অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। উদাহরণ: নিম্নগতিতে গঙ্গা এবং তার শাখানদীগুলির গতিপথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।
  7. বদ্বীপ: উৎপত্তি: নদীর জলের সঙ্গে বাহিত পলি, কাদা মোহানার কাছে সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে সহজে জোটবদ্ধ হয়ে মোহানায় বা অগভীর সমুদ্রে জমা হয়। এগুলি ক্রমশ জমে জমে মোহানার কাছে যে নতুন ভূখণ্ডের সৃষ্টি করে, তাকে দ্বীপ বলে। বিভিন্ন নদীতে এইভাবে যেসব দ্বীপ গড়ে ওঠে সেগুলি দেখতে ঠিক মাত্রাহীন বাংলা অক্ষর ‘ব’-এর মতো অথবা গ্রিক অক্ষর ‘ডেল্টা’ (Δ) -র মতো হওয়ায় এদের বদ্বীপ বলে। উদাহরণ : গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহানায় গড়ে ওঠা বদ্বীপ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ।
3. জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণগুলি আলোচনা করো।
জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণ
উত্তর – পৃথিবীতে ছোটো বড়ো অসংখ্য জলপ্রপাত আছে। সেগুলি বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়েছে। কারণগুলি হল—
  1. চ্যুতি: নদীর গতিপথে হঠাৎ কোনো চ্যুতি থাকলে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয়। এর ফলে সেখানে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
  2. শৈলশিরা : অনেক সময় নদীর গতিপথে কঠিন লাভা শৈলশিরার মতো অবস্থান করে। এর ফলে ঢালের তারতম্যজনিত কারণে সেখানে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
  3. ভূ-আন্দোলন: ভূ-আন্দোলনের ফলে কোনো স্থানে হঠাৎ খাড়া ঢালের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এরকম স্থানের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে সেখানে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
  4. ঝুলন্ত উপত্যকা : পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে ঝুলন্ত উপত্যকার সৃষ্টি হয়। এই ঝুলন্ত উপত্যকার অগ্রভাগে খাড়া ঢাল থাকায় এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়।
  5. শিলান্তরের বিন্যাস: ভূপৃষ্ঠের সব অংশ একই ধরনের শিলা দ্বারা গঠিত হয় না। এর মধ্যে কোথাও অনুভূমিকভাবে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর থাকলে তার ওপর দিয়ে যখন নদী প্রবাহিত হয় তখন কোমল শিলায় অধিক ক্ষয় করে খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে এবং জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
4. নদীর মোহানায় বদ্বীপ সৃষ্টির ভৌগোলিক কারণগুলি লেখো।
নদীর মোহানায় বদ্বীপ সৃষ্টির ভৌগোলিক কারণসমূহ
উত্তর – সব নদীর মোহানায় বদ্বীপ গড়ে ওঠে না। কয়েকটি বিশেষ ভৌগোলিক কারণের ওপর নির্ভর করে বদ্বীপ গড়ে ওঠে—
  1. পলিরাশির পরিমাণ : নদী অববাহিকা বৃহৎ, নদীর প্রবাহপথ দীর্ঘ ও নদী অববাহিকা অঞ্চলের শিলা নরম প্রকৃতির হলে এবং অনেক উপনদী এসে মিশলে ওই নদীতে পলির পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে নদীর জল অতিরিক্ত পলিসমৃদ্ধ হয়ে মোহানায় বদ্বীপ সৃষ্টি করে।
  2. সমুদ্রের ঢেউ ও জোয়ারভাটা : নদীমোহানায় জোয়ারভাটার প্রকোপ থাকলে এবং ঢেউয়ের তীব্রতা কম হলে দ্রুত বদ্বীপ গড়ে উঠতে পারে।
  3. বায়ুপ্রবাহ ও উন্ন-আর্দ্র জলবায়ু: যেসব নদীর মোহানায় নদীর স্রোতের বিপরীত দিকে বায়ু প্রবাহিত হয় সেখানে দ্রুত পলির অধঃক্ষেপণ ঘটে। তাই দ্রুত বদ্বীপ গড়ে ওঠে। আবার উয়-আর্দ্র জলবায়ুতে নদনদীর সংখ্যা বেশি থাকে বলে সেখানে বদ্বীপের সংখ্যাও বেশি হয়।
  4. অগভীর উপকূলভাগ : নদীমোহানায় সমুদ্রের উপকূলভাগ অগভীর হলে সেখানে দ্রুত পলি দ্বারা ভরাট হয়ে বদ্বীপ তৈরি হয়। ভারতের পূর্ব উপকূল অগভীর বলে বদ্বীপের সংখ্যাও বেশি।
  5. জলের ঘনত্ব : নদীমোহানায় সমুদ্রজলের ঘনত্ব বেশি হলে সেখানে অতিদ্রুত পলি থিতিয়ে পড়ে। তাই দ্রুত বদ্বীপ গড়ে ওঠে।
  6. সমুদ্রের উন্মুক্ততা: স্থলবেষ্টিত সমুদ্রে নদীমোহানা থাকলে সেখানে বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। কারণ সেখানে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব কম।
  7. সমুদ্রজলের লবণতা : মোহানার কাছে সমুদ্রজলের লবণতা বেশি হলে নদীজলের পলিরাশি জোটবদ্ধ ও ভারী হয়ে দ্রুত অধঃক্ষিপ্ত হয়। এতে বদ্বীপ গঠনের হার বাড়ে।
  8. অন্যান্য: এ ছাড়া মোহানায় যাতে পলি জমতে পারে, তাই নদীর স্রোতের বেগ কম হলে বা মোহানা অঞ্চলটি স্থিতিশীল হলে বা নদীর মুখে চর সৃষ্টি হলে দ্রুত বদ্বীপ গড়ে উঠতে পারে।
5. পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন কীভাবে লোহাচড়া, ঘোড়ামারা ও নিউমুর দ্বীপ-সহ সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে তা এবং এই দ্বীপগুলির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
লোহাচড়া, ঘোড়ামারা ও নিউমুর দ্বীপ-সহ সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
উত্তর – সুন্দরবন অঞ্চলটি হল গঙ্গা বদ্বীপের সক্রিয় অংশ। অসংখ্য দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি। যেহেতু এই অঞ্চলের দক্ষিণ সীমায় আছে বঙ্গোপসাগর, তাই বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়ন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্র জলের উয়তা ও উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এখানকার দ্বীপগুলিতে তার অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে।
  1. জলতল বৃদ্ধি ও দ্বীপসমূহের অবলুপ্তি: জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সুন্দরবনসংলগ্ন সমুদ্র জলতলের উচ্চতা বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে বার্ষিক প্রায় 5 মিলিমিটার হারে বেড়ে চলেছে। এর ফলে একদিকে যেমন জলস্রোতের ক্ষয়ক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেজন্য সামগ্রিকভাবে সুন্দরবন অঞ্চলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে তেমন এখানকার লোহাচড়া, ঘোড়ামারা, নিউমুর-সহ বহু দ্বীপ ধীরে ধীরে জলমগ্ন হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
  2. ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি : জনবসতি সমৃদ্ধ বহু গ্রাম তথা দ্বীপ ধীরে ধীরে জলের নীচে হারিয়ে যাওয়ার কারণে ওইসব দ্বীপের হাজার হাজার অধিবাসী উদ্বাস্তু হয়ে সুন্দরবনের অন্যান্য অংশে বা মূল ভূখণ্ডে সরে গেছে। এইভাবে ক্লাইমেট রিফিউজি মানুষের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
  3. ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি: সমুদ্র জলের উন্নতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে ঝড়ঝঞ্ঝা ও ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
  4. ম্যানগ্রোভ বনভূমির ক্ষতি: বিভিন্ন দ্বীপের অবলুপ্তি, ভূমিক্ষয়, ঝড়ঝঞ্ঝা প্রভৃতি কারণে এখানকার মহামূল্যবান ম্যানগ্রোভ বনভূমির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে চলেছে।
  5. সমুদ্রজলের লবণতা বৃদ্ধি : বিশ্ব উন্নায়নের প্রভাবে সমুদ্রজলের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এখানকার সমগ্র জীবকুলের কাছে বড়ো সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
  6. বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি: জলতলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার জন্য জোয়ারের সময় নদীবাঁধ ভেঙে বন্যার প্রকোপও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে লবণাক্ত জল প্রবেশ করে বহু উর্বর কৃষিজমি চাষের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে এবং জলঘটিত রোগব্যাধির প্রকোপও বেড়েছে।
লোহাচড়া, ঘোড়ামারা ও নিউমুর দ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি
  1. লোহাচড়া দ্বীপ : হুগলি নদীর মোহানায় অবস্থিত এই দ্বীপটি 1980-এর দশকে সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উপগ্রহচিত্রে দেখা যায় দ্বীপটি জলের ওপর সামান্য জেগে উঠেছে (পলি সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়)।
  2. ঘোড়ামারা দ্বীপ: হুগলি নদীর মোহানায় সাগরদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত এই দ্বীপটির খাসিমারা, লক্ষ্মীনারায়ণপুর প্রভৃতি জনবহুল গ্রাম ইতিমধ্যেই জলমগ্ন হয়েছে। হাটখোলা, মন্দিরতলা, চুনপুরী প্রভৃতি গ্রামগুলিও আগামী দিনে জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
  3. নিউমুর দ্বীপ : 1970-এর দশকের প্রথম ভাগে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহানা থেকে 2 কিমি দূরে এই দ্বীপটি সমুদ্র থেকে জেগে উঠলেও 2010 সালের পর থেকে এই দ্বীপটির আর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না, অর্থাৎ এটিও জলমগ্ন হয়েছে।
    বিশ্ব উয়ায়ন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশের অবনতি ঘটায় এবং অন্যদিকে একের পর এক দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হতে থাকায় সমগ্র অঞ্চলটিরই অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে।
6. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর পড়েছে?
অথবা, গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বদ্বীপের সক্রিয় অংশের ওপর পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কতখানি?
সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
উত্তর – পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন সুন্দরবন অঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে—
  1. উন্নতা বৃদ্ধি: বিগত 1980 সাল থেকে 2017 সাল পর্যন্ত সুন্দরবন সংলগ্ন নদী ও সমুদ্রজলের উয়তা প্রতি দশকে 0.5°সে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নতার এই বৃদ্ধি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
  2. ঘূর্ণবাত ও মৌসুমি বৃষ্টিপাত: পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে । আয়লা এমনই একটি ঘূর্ণবাত।
  3. সমুদ্রজলের উচ্চতা বৃদ্ধি: পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সুন্দরবন সংলগ্ন সমুদ্র জলতলের উচ্চতা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এতে বহু দ্বীপ (লোহাচড়া, নিউমুর) সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।
  4. জল এবং মাটির লবণতা বৃদ্ধি: জলতল বেড়ে যাওয়ায় এখানকার জল এবং মাটির লবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে কৃষির প্রয়োজনীয় জল এবং খাদ্য ও পানীয় জলের সমস্যাও বাড়ছে।
  5. বন্যার আশঙ্কা বৃদ্ধি: জলতল বেড়ে যাওয়ার কারণে নদীবাঁধ ভেঙে বন্যার আশঙ্কা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. গঙ্গা নদীর তিনটি প্রবাহ কোথা থেকে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত?
উত্তর – গঙ্গা নদীর প্রবাহপথের বিস্তৃতি: গঙ্গা নদীর তিনটি প্রবাহের বিস্তৃতি হল—
  1. উচ্চপ্রবাহ: উত্তরাখণ্ডের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষারগুহা থেকে উত্তরাখণ্ডেরই হরিদ্বার পর্যন্ত গঙ্গার পার্বত্যপ্রবাহ বা উচ্চপ্রবাহ।
  2. মধ্যপ্রবাহ: উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার থেকে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পর্যন্ত গঙ্গার সমভূমিপ্রবাহ বা মধ্যপ্রবাহ।
  3. নিম্নপ্রবাহ: ঝাড়খণ্ডের রাজমহল থেকে মোহানা (বঙ্গোপসাগর) পর্যন্ত গঙ্গার বদ্বীপপ্রবাহ বা নিম্নপ্রবাহ।
2. নদী কী কী প্রক্রিয়ায় ক্ষয়কার্য করে?
উত্তর – নদীর ক্ষয়কার্যের বিভিন্ন প্রক্রিয়া: নদী তার গতিপথে জলধারার সাহায্যে পাঁচভাবে ক্ষয়কার্য করে, এগুলি হল—
  1. দ্রবণজনিত ক্ষয়: কোনো কোনো পাথর, যেমন— চুনাপাথর, লবণ শিলা প্রভৃতি নদীর জলের সংস্পর্শে গলে গিয়ে বা দ্রবীভূত হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  2. জলপ্রবাহজনিত ক্ষয়: পার্বত্য অঞ্চলে নদীখাতের নরম ও আলগা পাথরগুলি জলস্রোতের আঘাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং কালক্রমে ভেঙে গিয়ে জলস্রোতের দ্বারা বহুদূরে বাহিত হয়।
  3. ঘর্ষণজনিত ক্ষয়: নদীর স্রোতের সঙ্গে বাহিত পাথরগুলি, পরস্পরের সাথে ঘর্ষণে এবং ঠোকাঠুকিতে ক্ষয় হয়ে অবশেষে ক্ষুদ্রাকার কণায় পরিণত হয়।
  4. অবঘর্ষজনিত ক্ষয়: নদীবাহিত পাথরগুলির সঙ্গে নদীখাতের ঘর্ষণ বা অবঘর্ষের ফলে নদীখাত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং নদীখাতে ছোটো ছোটো গর্তের সৃষ্টি হয়। গর্তগুলির জন্য নদীখাত আরও দ্রুত ক্ষয়ে যায়।
  5. বুদ্বুদের কম্পন তরঙ্গজনিত ক্ষয়: নদীর জলের মধ্যে বুদ্বুদের আকারে বাতাস সামান্য সময়ের জন্য অবরুদ্ধ থাকে। সেই বুদ্বুদ হঠাৎ ফেটে গিয়ে নির্গত হলে যে শব্দ হয় সেই শব্দের কম্পন-তরঙ্গের আঘাতেও শিলাখণ্ড চূর্ণবিচূর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
3. নদীর বহনক্ষমতা কীসের ওপর নির্ভর করে?
উত্তর – নদীর বহনক্ষমতা যে-সব বিষয়ের উপর নির্ভরশীল: নদীর বহনক্ষমতা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, এগুলি হল—
  1. নদীতে জলের পরিমাণ: নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে নদীর বহনক্ষমতা বেড়ে যায়।
  2. নদীর গতিবেগ: বহনক্ষমতা সবচেয়ে বেশি বাড়ে নদীর গতিবেগ বাড়লে। নদীর গতিবেগ আবার নির্ভর করে ভূমির ঢালের ওপর। ঢাল বেশি হলে নদীর গতিবেগও বেড়ে যায়। ফলে, নদীর বহন করার ক্ষমতাও বাড়ে।
  3. নদীবাহিত বোঝার পরিমাণ: নদীবাহিত পাথরের আকৃতি ছোটো হলে নদীর বহনক্ষমতা বেড়ে যায়। আবার তা বড়ো হলে নদীর বহনক্ষমতা কমে যায়।
4. নদী কী কী প্রক্রিয়ায় বহন করে?
উত্তর – নদীর বহন কাজের প্রক্রিয়াসমূহ: নদী চারভাবে বহন করে, এগুলি হল—
  1. দ্রবণের মাধ্যমে: চুনাপাথর, লবণ-জাতীয় শিলা প্রভৃতিকে জলে গুলে বা দ্রবণের মাধ্যমে নদী বয়ে নিয়ে চলে।
  2. ভাসমান প্রক্রিয়ায়: কাদা, পলি, বালি প্রভৃতি হালকা পদার্থগুলি নদী ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নদী যে পরিমাণ পদার্থ বহন করে, তার প্রায় 70 শতাংশ বহন করে ভাসমান প্রক্রিয়ায়।
  3. লম্ফনের মাধ্যমে কিছুটা বড়ো বা মাঝারি আকৃতির পাথরগুলি স্রোতের সঙ্গে বাহিত হওয়ার সময় নদীখাতে বার বার ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে অগ্রসর হয়।
  4. টান বা আকর্ষণ প্রক্রিয়ায়: খুব বড়ো বড়ো পাথর নদীর স্রোতের টানে বা আকর্ষণে বাহিত হয়।
5. কী কী অবস্থায় নদী সঞ্চয় করে ?
উত্তর – নদীতে সঞ্চয়ের বিভিন্ন অবস্থা: প্রধানত চারটি অবস্থায় নদী সঞ্চয় করে। এগুলি হল—
  1. জলের পরিমাণ কমে যাওয়া: নদীতে জলের পরিমাণ কমে গেলে নদী সঞ্চয় করে। নদীতে জলের পরিমাণ কমে যায় কয়েকটি বিশেষ অবস্থায়; যেমন—[i] কম বৃষ্টিপাত হয় এমন অঞ্চলে নদী প্রবেশ করলে, [ii] খরার সময়ে, [iii] বৃষ্টিহীন ঋতুতে এবং [iv] চুনাপাথর, বেলেপাথর প্রভৃতি সচ্ছিদ্র প্রস্তরগঠিত অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে।
  2. ভূমির ঢাল কমে যাওয়া: ভূমির ঢাল কম হলে, অর্থাৎ নদীর গতিবেগ কমে গেলে নদী সঞ্চয় করে।
  3. বোঝা বেড়ে যাওয়া: নদীতে বোঝার পরিমাণ বেড়ে গেলে নদী সঞ্চয় করে।
  4. হ্রদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া: কোনো হ্রদের মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে নদী সঞ্চয় করে।

এইভাবে নদী প্রবাহিত হওয়ার সময় পার্বত্য অঞ্চলে বড়ো বড়ো পাথরখণ্ড, আর সমভূমিতে ও মোহানার কাছে বালি, কাদা, পলি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়।

6. নদীর গতিপথে কীভাবে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়?
উত্তর – ধারণা : নদীর জলপ্রবাহ যখন হঠাৎ কোনো উচ্চ স্থান থেকে নীচের দিকে লাফিয়ে পড়ে, তখন তাকে জলপ্রপাত বলে।
সৃষ্টির পদ্ধতি : নদীর গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর ওপর-নীচে আড়া-আড়িভাবে বা অনুভূমিকভাবে অবস্থান করলে, প্রবল স্রোতে ওপরের কঠিন শিলাস্তর ধীরে ধীরে ক্ষয় হওয়ার ফলে নীচের কোমল শিলাস্তর বেরিয়ে পড়ে। কোমল শিলাস্তর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় বলে সেখানে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় এবং তখন নদীস্রোত খাড়া ঢাল থেকে প্রবল বেগে নীচে আছড়ে পড়ে ও জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে। হিমবাহসৃষ্ট ঝুলন্ত উপত্যকার মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও নদীর গতিপথে আড়াআড়িভাবে চ্যুতি থাকলে, মালভূমির প্রান্তভাগ খুব খাড়াভাবে সমভূমিতে মিশলে এবং পুনর্যৌবনপ্রাপ্ত নদীর নিক পয়েন্টে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ : উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স নদীর নায়াগ্রা একটি বিখ্যাত জলপ্রপাত।

7. জলপ্রপাতের শ্রেণিবিভাগ করো।
উত্তর – জলপ্রপাতের শ্রেণিবিভাগ : ভূবিজ্ঞানীরা নদীখাতে জলের পরিমাণ ওভূমির ঢাল অনুসারে জলপ্রপাতকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। এগুলি হল—
(1) র‍্যাপিড, (2) কাসকেড, (3) ক্যাটারাক্ট।
  1. র‍্যাপিড: জলপ্রপাতের ঢাল কম হলে তাকে র‍্যাপিড বলা হয়। এই ধরনের জলপ্রপাতের উচ্চতা মাত্র কয়েক মিটার হয়। উদাহরণ: ছোটোনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলে এরকম জলপ্রপাত প্রায়ই দেখা যায়।
  2. কাসকেড: যখন কোনো জলপ্রপাতের জল অজস্র ধারায় বা সিঁড়ির মতো ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে নীচের দিকে নামে, তখন তার নাম কাসকেড। উদাহরণ: রাঁচির জোনা জলপ্রপাত।
  3. ক্যাটারাক্ট: জলপ্রপাত যখন প্রবলবেগে, ভয়ংকরভাবে ফুলেফেঁপে উত্তাল জলরাশি নিয়ে অতল গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তার নাম ক্যাটারাক্ট। উদাহরণ: আফ্রিকার নীল নদে খাতুম থেকে আসোয়ান পর্যন্ত অংশে মোট 6টি ক্যাটারাক্ট দেখা যায়।
8. পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কার্যই প্রাধান্য লাভ করে কেন?
উত্তর – পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কার্য প্রাধান্য লাভের কারণ : পার্বত্য প্রবাহে নদী প্রধানত ক্ষয় করে, কারণ—
  1. ভূমিঢাল: পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির ঢাল খুব বেশি। এজন্য নদী প্রবল বেগে নীচের দিকে নেমে আসে।
  2. প্রবল জলস্রোত: প্রবল জলস্রোতের মাধ্যমে নদী তার উপত্যকাকে ভীষণভাবে ক্ষয় করে। এখানে পার্শ্বক্ষয়ের তুলনায় নিম্নক্ষয় অনেক বেশি হয়। দ্রুতবেগে প্রবাহিত নদী এই অংশে প্রধানত জলপ্রবাহ ক্ষয়, ঘর্ষণ ও অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় উপত্যকায় ক্ষয়কাজ করে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত পদার্থগুলিকে প্রবল স্রোতের মাধ্যমে নীচের দিকে বহন করে নিয়ে চলে। সুতরাং, পার্বত্যপ্রবাহ বা উচ্চগতিতে নদীর ক্ষয়কার্যই প্রাধান্য লাভ করে।
9. নদীর নিম্নগতিতে কীভাবে বদ্বীপ সৃষ্টি হয়?
অথবা, নদীর মোহানায় বদ্বীপ কেন গড়ে ওঠে ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – নদীর নিম্নগতিতে বদ্বীপ সৃষ্টির পদ্ধতি : নিম্নগতিতে নদী যতই মোহানার কাছে চলে আসে, ভূমির ঢাল ততই কমে যায় বলে নদীর স্রোতের বেগ এবং বহনক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এর ফলে তখন নদীর অবক্ষেপণ খুব বেড়ে যায় । নদীবাহিত কাদা, পলি, বালি মোহানায় ব্যাপকভাবে সঞ্চিত হয়। এ ছাড়া, নদীবাহিত এইসব পদার্থ সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে এসে জোটবদ্ধ ও ভারী হয়ে মোহানায় জমা হতে শুরু করে। এগুলি জমতে জমতে ক্রমশ মোহানায় গ্রিক অক্ষর ডেল্টা (Δ) বা বাংলা অক্ষর—মাত্রা ছাড়া ব-এর মতো নতুন ভূভাগ বা বদ্বীপ সৃষ্টি হয়। তবে বদ্বীপ গঠনের জন্য মোহানায় নদীর সঞ্চয়ের হার সমুদ্রস্রোতের অপসারণ ক্ষমতার তুলনায় বেশি হওয়া দরকার।
উদাহরণ : গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহানায় এইভাবে যে বদ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে সেটি বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ।

10. বদ্বীপের শ্রেণিবিভাগ করো।
উত্তর – বদ্বীপের শ্রেণিবিভাগ: আকৃতি অনুসারে বদ্বীপ প্রধানত চার প্রকারের, যথা—
  1. ধনুকাকৃতি বদ্বীপ: যখন মোহানায় খুব বেশি পরিমাণ নদীবাহিত পলি সঞ্চিত হয় এবং দুর্বল সমুদ্রস্রোত সেগুলি অপসারণ করতে পারে না, তখন নদীবাহিত পদার্থগুলি সেখানে পাখার মতো ছড়িয়ে সঞ্চিত হয়। এভাবে সাগরের দিকে উত্তল প্রান্তবিশিষ্ট অর্থাৎ অর্ধবৃত্ত বা বৃত্তচাপের আকৃতিবিশিষ্ট যে বদ্বীপ গড়ে ওঠে তার নাম ধনুকাকৃতি বদ্বীপ। উদাহরণ: নীল নদের বদ্বীপ।
  2. পাখির পায়ের মতো বা পক্ষীপাদ বদ্বীপ: মোহানার কাছে নদীর জলের ঘনত্ব যদি সমুদ্রজলের ঘনত্বের তুলনায় কম হয় এবং নদীর গতিবেগ একটু বেশি থাকে, তাহলে নদীবাহিত পদার্থসমূহ মূল নদী ও তার শাখানদীসমূহের দুই পাশে সঞ্চিত হতে হতে সমুদ্রের যথেষ্ট দূর পর্যন্ত পৌঁছে অধঃক্ষিপ্ত হয়। এর ফলে যে বদ্বীপটি গড়ে ওঠে, তা দেখতে পাখির পায়ের মতো হয় বলে একে পাখির পায়ের মতো বা পক্ষীপাদ বদ্বীপ বলে। উদাহরণ: মিসিসিপি নদীর বদ্বীপ।
  3. তীক্ষ্ণাগ্র বা কাসপেট বদ্বীপ: যদি নদী মোহানায় প্রবল তরঙ্গের প্রভাব থাকে তখন পলিরাশি নদীর মধ্যভাগে সঞ্চিত না হয়ে দু-ধারে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে যে বদ্বীপ সৃষ্টি হয়, তার সমুদ্রের দিকের অগ্রভাগ বেশ তীক্ষ্ণ অর্থাৎ করাতের দাঁতের মতো দেখতে হয়। এজন্য এর নাম তীক্ষ্ণাগ্র বা কাসপেট বদ্বীপ। উদাহরণ: এব্রো ও টাইবার নদীর বদ্বীপ।
  4. ত্রিকোণাকার বদ্বীপ: মূল নদীর সঙ্গে শাখানদী যেখানে মিলিত হয়, সেখানে ত্রিকোণাকার বদ্বীপ গড়ে ওঠে। উদাহরণ: হুগলি ও জলঙ্গী নদীর মিলনস্থলে ত্রিকোণাকার বদ্বীপ আছে।
11. বদ্বীপ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ উল্লেখ করো।
উত্তর – বদ্বীপ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ: বদ্বীপ সৃষ্টি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুকূল পরিবেশগুলি হল—
  1. অবক্ষেপণের হার বেশি: মোহানায় নদীর অবক্ষেপণের হার সমুদ্রস্রোতের অপসারণ হারের তুলনায় বেশি হওয়া প্রয়োজন।
  2. সুদীর্ঘ নদী ও বেশি উপনদী: নদীর জলের সঙ্গে যাতে বেশি পরিমাণে পলি আসে, সেজন্য নদীকে সুদীর্ঘ হতে হবে। পাশাপাশি নদীর উপনদীর সংখ্যাও বেশি হতে হবে।
  3. নদীর স্রোত কম হওয়া: নদীর মুখে বা মোহানায় যাতে পলি জমতে পারে, সেজন্য নদীর স্রোত কম হওয়া দরকার।
  4. সমুদ্রের ঢাল কম হওয়া: সমুদ্রের যে অংশে নদী এসে মিশবে, সেখানে সমুদ্রের ঢাল কম হতে হবে, না হলে অবক্ষিপ্ত পলি গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাবে।
  5. জোয়ারভাটার প্রকোপ কম থাকা: মোহানায় জোয়ারভাটার প্রকোপ কম থাকলে সহজে বদ্বীপ গড়ে ওঠে।
  6. বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ: মোহানায় নদীস্রোতের বিপরীত দিকে বায়ু প্রবাহিত হলে বদ্বীপ গঠনের কাজ দ্রুত হয়।
  7. আংশিক বেষ্টিত সমুদ্র: উন্মুক্ত সমুদ্রের তুলনায় আংশিক বেষ্টিত সমুদ্রে বেশি বদ্বীপ গড়ে ওঠে।
  8. সমতল ভূমি: নদী মোহানার সংলগ্ন ভূমি সমতল হওয়া প্রয়োজন।
12. নদীর উচ্চগতিতে V-আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি হয় কেন?
উত্তর –  নদীর উচ্চগতিতে V-আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টির কারণ: পার্বত্য অঞ্চলের প্রবাহপথকে নদীর উচ্চগতি বলা হয়। এই অংশে নদীর গতিপথে ‘V’ -আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি হওয়ার কারণ—
  1. ভূমির ঢাল: পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির ঢাল বেশি বলে নদী প্রবল বেগে নীচের দিকে নামে। প্রবল স্রোতের সঙ্গে বাহিত শিলাখণ্ডের সঙ্গে নদীগর্ভের ঘর্ষণ ও সংঘর্ষে নদী উপত্যকায় পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় বেশি হয়। এভাবে নদী উপত্যকা ক্রমশ সংকীর্ণ ও গভীর হতে থাকে।
  2. বৃষ্টিবহুলতা ও আবহবিকার : বৃষ্টিবহুল পার্বত্য অঞ্চলে প্রথমে নদী উপত্যকার দুই পার্শ্বদেশ কিছুটা সংকীর্ণ থাকলেও রাসায়নিক আবহবিকার ও পুঞ্ঝিত ক্ষয়ের প্রভাবে (পার্শ্বক্ষয়ের দ্বারা) নদী উপত্যকার উপরিভাগ ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে ‘V’-আকৃতির উপত্যকা গঠন করে।
  3. ভূমিধস: পার্বত্য নদী উপত্যকার দুই পাশ থেকে নদীতে ধস নামে ও কিছু উপনদীও এসে নদীখাতে মিলিত হয়। এর ফলে নদীখাত কিছুটা প্রশস্ত হয়ে ‘V’-আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি করে।
13. অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ কীভাবে তৈরি হয়?
উত্তর – অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তৈরির পর্যায়সমূহ: মধ্যগতির শেষের দিকে এবং নিম্নগতিতে নদীর প্রবাহপথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের (ox-bowlake) সৃষ্টি হয়। এই হ্রদ সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়গুলি হল— (1) এই সময় নদীর গতিবেগ খুব কম থাকে বলে সামান্য কোনো বাধা পেলেই নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথকে বলা হয় মিয়েন্ডার। (2) নদী যখন এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয় তখন প্রবাহপথের অন্তঃবাঁকের (উত্তল পাড়) তুলনায় বহিঃবাঁকে (অবতল পাড়) গতিবেগ বেশি থাকে। তাই বহিঃবাঁকে ক্ষয়কার্য চলে, কিন্তু অন্তঃবাঁকে পলি, কাদা ইত্যাদি সঞ্চিত হয়। (3) নদী যখন খুব বেশি এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়, দুই বাঁক বা জলধারার মধ্যবর্তী ভূমি কালক্রমে সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (বহিঃবাঁকে ক্ষয় প্রক্রিয়ার জন্য)। (4) ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার ফলে তখন নদীর ওই দুটি বাঁক বা জলধারার সংযুক্তি ঘটে, অর্থাৎ বাঁকা পথ ছেড়ে নদী তখন সোজা পথে প্রবাহিত হয়। আর পরিত্যক্ত বাঁকটি হ্রদে পরিণত হয়। এই হ্রদ দেখতে ঘোড়ার খুরের মতো হয় বলে এর নাম অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ।

উদাহরণ: নিম্নগতিতে গঙ্গা এবং তার শাখানদীগুলির গতিপথে এই ধরনের অনেক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।

14. প্লাবনভূমি কীভাবে সৃষ্টি হয় ?
উত্তর – অবস্থান : নদীর মধ্য ও নিম্ন গতিতে নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে প্লাবনভূমির (flood plain) সৃষ্টি হয়।
সৃষ্টির কারণ : নদীতে হঠাৎ জলপ্রবাহের পরিমাণ বেড়ে গেলে বন্যা বা প্লাবন দেখা দেয়। এ সময় দুই তীর বা কূল ছাপিয়ে সেই জল অনেক দূর পর্যন্ত প্লাবিত করে। নদীর জলের সঙ্গে যেসব পলি, বালি, কাদা থাকে সেগুলিও জলের সঙ্গে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বন্যা শেষে ওই জল যখন নদীতে ফিরে আসে, তখন নদীর গতিবেগ কম থাকে বলে নদীবাহিত পদার্থের সবটা নদীখাতে ফিরে আসে না, অনেকটাই প্লাবিত অঞ্চলে সঞ্চিত হয়। এইভাবে বছরের পর বছর নদীর দুই পাশে বা উপত্যকায় পলি, বালি, কাদা সঞ্চিত হতে হতে নতুন যে ভূমিভাগ গঠিত হয়, তাকে বলা হয় প্লাবনভূমি বা প্লাবন সমভূমি।

উদাহরণ : বিহারে গঙ্গা নদীর গতিপথের দুই পাশে এবং অসম উপত্যকায় ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাশে এই ধরনের প্লাবনভূমি দেখা যায়।

15. স্বাভাবিক বাঁধ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : সমভূমি ও বদ্বীপ প্রবাহে নদী ধীরগতিতে প্রবাহিত হয় বলেজলের সঙ্গে যেসব পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি বাহিত হয়ে আসে নদী আর সেগুলি বহন করতে পারে না। সেগুলি নদীর দুই তীরে সঞ্চিত হতে থাকে। এ ছাড়া বন্যা শেষে দুই তীরে ছড়িয়ে পড়া প্লাবনের জল নদীতে ফিরে এলে নদীবাহিত পলি, কাদা প্রভৃতি নদীর কিনারায় এসে সঞ্চিত হয়। উভয় কারণেই ক্রমাগত নদীর দুই তীরে পলি সঞ্চিত হওয়ার ফলে তা বাঁধ বা স্বল্পোচ্চ শৈলশিরার মতো ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। এই বাঁধ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়বলে একে বলা হয় স্বাভাবিক বাঁধ (natural levee)।

উদাহরণ : মধ্য ও নিম্ন গতিতে গঙ্গা নদীর দুই তীরে এবং মিশরে নীল নদের দুই পাশে উঁচু স্বাভাবিক বাঁধ দেখা যায়।

16. জলপ্রপাত পশ্চাদপসরণ করে কেন?
উত্তর – ধারণা : উচ্চগতিতে নদীর গতিপথে ভূমির ঢাল অসম হলে বা ভূমিঢালের হঠাৎ পরিবর্তন হলে সেখানে জল ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে। একেই জলপ্রপাত বলে ৷ জলপ্রপাতের জল নীচে যেখানে পড়ে, নরম শিলাস্তর গঠিত সেই অঞ্চলে বিশালাকার গর্তের সৃষ্টি হয়। ক্ষয়ের কারণে গর্তের আয়তন বেড়ে গেলে ওপরের কঠিন শিলাস্তর ঝুলতে থাকে এবং একসময় তা ভেঙে পড়ে। শিলাস্তর ভেঙে পড়ার কারণে জলপ্রপাতটি নদীর উৎসের দিকে বা পিছনের দিকে সরে যায়। একেই জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণ বলে।
পদ্ধতি:যেখানে জলপ্রপাত গঠিত হয়, সেখানে কঠিন শিলাস্তরের নীচে কোমল শিলাস্তর থাকলে, কোমল শিলাস্তর বেশি ক্ষয় পেয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। এর ফলে নদীস্রোতের চাপ সহ্য করতে না পেরে ওপরের কঠিন শিলাস্তরের সামনের অংশ ভেঙে পড়ে। এইভাবেও জলপ্রপাত ধীরে ধীরে পশ্চাদপসরণ করে।

উদাহরণ: ভারতের ইন্দ্রাবতী নদীর ওপর চিত্রকূট জলপ্রপাতটির পশ্চাদপসরণ ভালোভাবে বোঝা যায়।

17. কী কী কারণে জলপ্রপাত সৃষ্টি হতে পারে?
উত্তর – জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণ : নানা কারণে জলপ্রপাত সৃষ্টি হতে পারে—
  1. কঠিন ও কোমল শিলা: নদীর চলার পথের কোথাও নরম ও কঠিন শিলাস্তর থাকলে নরম শিলা বেশি ক্ষয়ে গিয়ে নীচু হয়ে যায় এবং কঠিন শিলা উঁচু হয়ে থাকে। এর ফলে সেখানে নদী উঁচু থেকে নীচুতে পড়ে জলপ্রপাত সৃষ্টি করে।
  2. চ্যুতি: নদীর প্রবাহপথে চ্যুতি সৃষ্টি হলে সেখানে জলপ্রপাত সৃষ্টি হতে পারে।
  3. মালভূমির প্রান্তভাগ: মালভূমির প্রান্তভাগে নদী খাড়াভাবে নেমে এলে সেখানে জলপ্রপাত তৈরি হতে পারে।
  4. ঝুলন্ত উপত্যকা: ঝুলন্ত উপত্যকার মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে জলপ্রপাত গঠিত হয়।
  5. লাভাস্রোত: নদীর প্রবাহপথে লাভাস্রোত বেরিয়ে এলে ওই লাভা উঁচু হয়ে শিখর গঠন করে। ওই উঁচু শিখর থেকে জল নীচে লাফিয়ে পড়ে জলপ্রপাত গঠন করে।
18. জলচক্রের অংশ হিসেবে নদীর ভূমিকা কতখানি?
উত্তর – জলচক্রের অংশ হিসেবে নদীর ভূমিকা: পৃথিবীর বারিমণ্ডল বা জলমণ্ডলের সব জল জলচক্রের মাধ্যমে একসূত্রে বাঁধা। সূর্যতাপে বিভিন্ন প্রকার জলাশয় থেকে জল ক্রমাগত বাষ্পীভূত হয়ে ওপরে উঠে মেঘ হিসেবে ভেসে বেড়ায়। মেঘের মধ্যে ভাসমান জলকণাসমূহ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি বা তুষাররূপে পৃথিবীতে নেমে আসে। শেষে ওই বৃষ্টি বা তুষারগলা জলের বেশিরভাগ অংশ নদনদীর মাধ্যমে সমুদ্রে ফিরে যায় এবং সেখান থেকে সূর্যতাপে বাষ্প হয়ে আবার ওপরে উঠে যায়। এইভাবে জল কখনও বাষ্প, কখনও মেঘ, কখনও অধঃক্ষেপণরূপে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে অবিরামভাবে আবর্তিত হয়ে জলচক্র সৃষ্টি করে। নদী হল ভূপৃষ্ঠে এই জলচক্রের অনুভূমিক অংশ এবং বাষ্পীভবন (নীচে থেকে ওপরে ওঠে) ও অধঃক্ষেপণ (ওপর থেকে নীচে নামে) হল উল্লম্ব অংশ। তাই জলচক্রের অনুভূমিক অংশ হিসেবে নদীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে নদী আছে বলেই বৃষ্টির জল বা তুষারগলা জল ভূপৃষ্ঠে আটকে না থেকে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। অর্থাৎ নদী হল একটি সংযোগসূত্র, যার মাধ্যমে জলচক্র পূর্ণতা পায়।
19. বদ্বীপ অঞ্চলে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায় কেন?
উত্তর – বদ্বীপ অঞ্চলে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখতে পাওয়ার কারণ : অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বদ্বীপ অঞ্চলে দেখা যায়, কারণ—
  1. আঁকাবাঁকা নদীপথ: বদ্বীপ অংশে ভূমির ঢাল একেবারেই কমে যায়, তাই নদী তার গতিপথে সামান্য বাধা পেলে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়।
  2. নদীবাঁকে ক্ষয়: নদীর জল বাঁকাপথে কুণ্ডলীর আকারে এগিয়ে যায়। সেজন্য অবতল পাড়ে ক্ষয় এবং উত্তল পাড়ে সঞ্চয় হয়।
  3. নদীবাঁকের বিস্তার: ক্ষয় এবং সঞ্চয়ের জন্য নদীর বাঁক ক্রমশ বাড়তেথাকে ৷
  4. অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ গঠন: নদীর বাঁক আরও বেড়ে গেলে বাঁক দুটি পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসে এবং যুক্ত হয়ে যায়। তখন নদী পুরোনো গতিপথ ছেড়ে নতুন সোজা পথে প্রবাহিত হয়। আর পরিত্যক্ত অর্ধচন্দ্রাকৃতি নদীখাতটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ গঠন করে।
20. গঠনমূলক বদ্বীপ এবং ধ্বংসাত্মক বদ্বীপ কাকে বলে?
উত্তর – গঠনমূলক বদ্বীপ : নদী বিপুল পরিমাণ পলি অগভীর সমুদ্রে জমা করে বদ্বীপ গঠন করে। এই ধরনের বদ্বীপকে গঠনমূলক বদ্বীপ বলে। এই ধরনের বদ্বীপ দুই রকমের হতে পারে– (1) ধনুকাকৃতি বদ্বীপ এবং (2) পাখির পায়ের মতো বদ্বীপ। উদাহরণ: নীল নদের বদ্বীপ ধনুকাকৃতি বা ব্যজনী আকৃতির এবং মিসিসিপি নদীর বদ্বীপ পাখির পায়ের মতো হয়।

ধ্বংসাত্মক বদ্বীপ : জোয়ারভাটা এবং সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে যেসব বদ্বীপের আকার এবং আয়তন সবসময় পরিবর্তিত হয়, সেই ধরনের বদ্বীপকে ধ্বংসাত্মক বদ্বীপ বলে। উদাহরণ: ব্রাজিলের সাও ফ্রান্সিসকো, আফ্রিকার নাইজার নদীর বদ্বীপ এরকম ধ্বংসাত্মক বদ্বীপ।

21. নদীর সমভূমিপ্রবাহ বা মধ্যগতি কাকে বলে? উদাহরণ দাও। 
সমভূমিপ্রবাহ বা মধ্যগতিতে নদীর প্রধান কাজ কী?
উত্তর – নদীর সমভূমিপ্রবাহবা মধ্যগতি: পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে নদী যখন সমভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন নদীর সেই গতিপথকে বলা হয় সমভূমিপ্রবাহ বা মধ্যগতি।

উদাহরণ: উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার থেকে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পর্যন্ত অঞ্চল গঙ্গার সমভূমিপ্রবাহ বা মধ্যগতি।

সমভূমিপ্রবাহে নদীর প্রধান কাজ : ক্ষয়, বহন এবং সঞ্চয়—এই তিনটি কাজের মধ্যে মধ্যগতিতে বা সমভূমিপ্রবাহে নদী প্রধানত বহন কাজ করে। তবে স্থানভেদে এই প্রবাহে নদী ক্ষয় এবং সঞ্চয় কাজও করে থাকে। যদিও এই দুইপ্রকার কাজের পরিমাণ কম। অর্থাৎ মধ্যগতিতে নদী বেশি বহন, অল্প ক্ষয় এবং বেশ কিছুটা সঞ্চয় করে।

22. নদীর নিম্নগতিতে কেন সচরাচর বন্যা দেখা যায়?
উত্তর – নদীর নিম্নগতিতে সচরাচর বন্যা দেখতে পাওয়ার কারণ : নদীরনিম্নগতিতে সচরাচর বন্যা দেখতে পাওয়ার কারণগুলি হল—
  1. নদীস্রোতের অনুপস্থিতি: মোহানার কাছাকাছি বলে এই অংশে নদীতে যথেষ্ট পরিমাণে জল থাকে। কিন্তু ভূমির ঢাল খুব কমে যায় বলে এখানে নদীর স্রোত বিশেষ থাকে না।
  2. অগভীর নদীখাত: নদীর বহন করে আনা পলির সিংহভাগই নিম্নগতিতে নদীর খাতে সঞ্চিত হয়। এর ফলে নদীখাত ক্রমশ অগভীর হয়ে যায়। তাই বর্ষাকালে বা অতিবৃষ্টির সময় নদীতে হঠাৎ জলের জোগান বেড়ে গেলে তা বহন করার ক্ষমতা নদীর থাকে না—দুই কূল ছাপিয়ে নদীসংলগ্ন অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে।
23. বহির্জাত প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগুলি কী?
উত্তর – বহির্জাত প্রক্রিয়ার পদ্ধতি: মূলত তিনটি পদ্ধতির মাধ্যমে বহির্জাত প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়, যথা—
  1. অবরোহণ প্রক্রিয়া: এই প্রক্রিয়ায় আবহবিকার, পুঞ্জিত ক্ষয়, নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি বহির্জাত শক্তিসমূহের প্রভাবে ভূমিভাগের উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে। যেমন—সুউচ্চ পর্বত ক্ষয় হতে হতে ক্ষয়জাত পর্বত, তারপর ক্ষয়জাত মালভূমি এবং শেষে ক্ষয়জাত সমভূমিতে পরিণত হয়।
  2. আরোহণ প্রক্রিয়া: আরোহণ কথার অর্থ ওপরে ওঠা। এই ধরনের প্রক্রিয়ায় ভূমিভাগের উচ্চতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নদী, হিমবাহ, বায়ু দ্বারা বাহিত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে ভূপৃষ্ঠের নিম্নস্থান উঁচু বা ভরাট হয়। একে আরোহণ প্রক্রিয়া বলে। যেমন—বদ্বীপ, প্লাবন সমভূমি, লোয়েস সমভূমি।
  3. জৈবিক প্রক্রিয়া: উদ্ভিদ এবং প্রাণী যখন ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটায়, তখন তাকে জৈবিক প্রক্রিয়া বলে। জলাভূমিতে শ্যাওলা, আগাছা, পাতা, ফুল ইত্যাদি জমে জলাভূমি ভরাট হয়ে যায়। মানুষ পাহাড় কেটে রাস্তা বানায়, সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে সমুদ্রগর্ভ ভরাট করে, নতুন ভূমি তৈরি করে। এভাবে জৈবিক প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে।
24. পর্যায়নের মাধ্যমে কীভাবে ভূমিভাগের সমতলীকরণ ঘটে?
উত্তর – পর্যায়ন : দুই বিজ্ঞানী চেম্বারলিন ও স্যালিসবেরি প্রথম ‘পর্যায়ন’ বা ‘gradation’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ক্ষয়, পরিবহণ ও সঞ্চয় কাজের মাধ্যমে অসমতল এবং বন্ধুর ভূপ্রকৃতি সমতলভাগে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে পর্যায়ন বলে। এককথায় বলা যায়, অবরোহণ এবং আরোহণের সম্মিলিত ফল হল পর্যায়ন। একে ক্রমায়নও বলা হয়।

প্রক্রিয়া : পর্যায়ন দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকরী হয়; একটি অবরোহণ এবং অন্যটি আরোহণ। ভূমিভাগের উঁচু অংশগুলি নদী, হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ, বায়ু প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির ক্ষয়কাজের মাধ্যমে যেমন ধীরে ধীরে নীচু হয়, তেমন পরিবহণ ও সঞ্চয়কার্যের মাধ্যমে ক্ষয়ীভূত পদার্থগুলি ভূপৃষ্ঠের নীচু অংশে জমা হয়ে আরোহণ প্রক্রিয়ায় উঁচু হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না সমগ্র ভূমিভাগ এইভাবে একই সমতলে আসে, ততক্ষণ এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

25. ধনুকাকৃতি, তীক্ষ্ণাগ্র এবং পাখির পায়ের মতো বদ্বীপ কাকে বলে?
উত্তর – ধনুকাকৃতি বদ্বীপ: যখন নদীমোহানায় জমা হওয়া পলিরাশিকে দুর্বল সমুদ্রস্রোত অপসারণ করতে পারে না, তখন নদীবাহিত ওই পলিরাশি সমুদ্রের দিকে পাখার মতো ছড়িয়ে সঞ্চিত হয়। এর ফলে যে বদ্বীপটি গড়ে ওঠে তা সমুদ্রের দিকে ধনুকের মতো বেঁকে যায়। একেই বলে ধনুকাকৃতি বদ্বীপ। এই ধরনের বদ্বীপ অনেকটা জিভের মতো দেখতে হয় বলে একে ‘জিহ্বাগ্র বদ্বীপ’- ও বলে।
উদাহরণ: নীল নদের বদ্বীপ।
তীক্ষ্ণাগ্র বদ্বীপ: মোহানায় তরঙ্গের প্রভাব বেশি থাকলে নদীবাহিত পলিরাশি নদীর সম্মুখে সঞ্চিত না হয়ে দু-পাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে যে বদ্বীপ গড়ে ওঠে তার সমুদ্রের দিকের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ হয়। এজন্য একে তীক্ষ্ণাগ্র বদ্বীপ বলে।
উদাহরণ: ইটালির টাইবার নদীর বদ্বীপ।
পাখির পায়ের মতো বা পক্ষীপাদ বদ্বীপ: মোহানায় নদীর জলের ঘনত্ব কম কিন্তু গতিবেগ বেশি হলে নদীবাহিত পলিরাশি মূল নদী ও তার শাখানদী সমূহের দুই পাশে জমা হতে হতে সমুদ্রে বেশ দূর পর্যন্ত পৌঁছে অধঃক্ষিপ্ত হয়। এর ফলে যে বদ্বীপটি গড়ে ওঠে তা দেখতে পাখির পায়ের মতো হয় বলে একে পক্ষীপাদ বদ্বীপ বলে।
উদাহরণ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি-মিসৌরি নদীর বদ্বীপ।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. নদী বলতে কী বোঝ?
উত্তর – সংজ্ঞা: কোনো পাহাড়, পর্বত, মালভূমি বা উচ্চভূমির হিমবাহ নির্গত জলধারা বা বৃষ্টির জলধারা যখন ভূমির ঢাল অনুসরণ করে নির্দিষ্ট খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র, হ্রদ বা জলাভূমিতে এসে মেশে, তখন তাকে নদী বলে। উদাহরণ: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা প্রভৃতি।
2. উপনদী কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর – সংজ্ঞা: প্রধান নদীর গতিপথের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে অনেক ছোটো ছোটো নদী এসে মূল বা প্রধান নদীতে মিলিত হয়, সেগুলিকে বলা হয় উপনদী।
উদাহরণ: গঙ্গার উপনদী যমুনা।
3. শাখানদী কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর – সংজ্ঞা : মূলনদী থেকে যেসব নদী শাখার আকারে বের হয়, সেগুলিকে বলা হয় শাখানদী।
উদাহরণ: গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথী-হুগলি।
4. আদর্শ নদী কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর – সংজ্ঞা: যে নদীর প্রবাহপথে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন—এই তিনটি গতি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়, তাকে আদর্শ নদী বলে। এ ছাড়া আদর্শ নদীর মধ্য ও নিম্ন অংশ সুবিস্তৃত হয়, নদীর গতিপথ ঘন ঘন পরিবর্তিত হয় না এবং অববাহিকায় বন্যার প্রকোপ কম হয়।
উদাহরণ: আদর্শ নদীর এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হল গঙ্গা নদী।
5. কার্য অনুসারে নদীর প্রবাহকে কী কী ভাগে ভাগ করা যায়?
উত্তর – কার্য অনুসারে নদীর প্রবাহের শ্রেণিবিভাগ: উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদী তার গতিপথে তিনটি কাজ করে—ক্ষয়সাধন, বহন এবং অবক্ষেপণ বা সঞ্জয়। আর, এই তিনপ্রকার কাজের ভিত্তিতে নদীর প্রবাহকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়— (1) ক্ষয়কার্য-প্রধান উচ্চগতি বা পার্বত্যপ্রবাহ, (2) বহনকার্য-প্রধান মধ্যগতি বা সমভূমিপ্রবাহ এবং (3) সঞ্চয়কার্য-প্রধান নিম্নগতি বা বদ্বীপপ্রবাহ।
6. নদীর কাজ কী কী ?
উত্তর – নদীর কাজ: নদীর কাজ তিনটি—ক্ষয়সাধন, বহন এবং সঞ্চয়। (1) ক্ষয়সাধন: পার্বত্যপ্রবাহ বা উচ্চগতিতে নদী প্রধানত ক্ষয়কার্য করে। তা ছাড়া, ওই অংশে নদী ক্ষয়জাত পদার্থ বহনও করে। (2) বহন: সমভূমিপ্রবাহ বা মধ্যগতিতে নদীর প্রধান কাজ বহন। তবে এই অংশে নদী কিছু ক্ষয় (পার্শ্বক্ষয়) এবং অবক্ষেপণও করে। (3) সঞ্চয়: বদ্বীপপ্রবাহ বা নিম্নগতিতে নদীর প্রধান কাজ সঞ্জয়। তবে এই অংশে নদী অল্প পরিমাণে বহনও করে।
7. নদীর ষষ্ঠঘাতের সূত্র কী?
উত্তর – ধারণা : নদীর বহন ক্ষমতা যেসব অবস্থার ওপর নির্ভর করে সেগুলির মধ্যে নদীর গতিবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনোভাবে নদীর গতিবেগ যদি দ্বিগুণ বেড়ে যায়, তখন তার বহনক্ষমতা 2° হারে বা 64 গুণ বাড়ে। এরই নাম নদীর ষষ্ঠঘাতের সূত্র।
8. নদী অববাহিকা ও জলবিভাজিকা বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – নদী অববাহিকা: কোনো নদী ও তার সব উপনদী এবং শাখানদী যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেই সমগ্র অঞ্চলটিকে বলা হয় সেই নদীটির অববাহিকা।
জলবিভাজিকা: কাছাকাছি অবস্থিত দুই বা তার বেশি নদী অথবা নদী ব্যবস্থাকে যে উচ্চভূমি পৃথক করে, সেই উচ্চভূমিকে বলা হয় জলবিভাজিকা। সাধারণত পাহাড় বা পর্বত জলবিভাজিকার কাজ করে।
9. ধারণ অববাহিকা কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : যে অঞ্চলের ছোটো, বড়ো, মাঝারি প্রভৃতি অসংখ্য জলধারা থেকে নদী জল সংগ্রহ করে তার প্রবাহকে বাড়ায়, সেই অঞ্চলকে ধারণ অববাহিকা বলে। উদাহরণ: যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের জল দামোদর ও তার বিভিন্ন উপনদীতে এসে পড়ে, সেই সমগ্র অঞ্চলটিই হল দামোদরের ধারণ অববাহিকা।
10. নদী উপত্যকা কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা : দুই উচ্চভূমির মধ্যবর্তী দীর্ঘ ও সংকীর্ণ নিম্নভূমিকে বলা হয় উপত্যকা। আর সেই সংকীর্ণ নিম্নভূমির মধ্যে দিয়ে যখন নদী প্রবাহিত হয়, তখন তাকে বলা হয় নদী উপত্যকা। অর্থাৎ নদী যে অংশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাকেই নদী উপত্যকা বলে।
11 .গিরিখাত কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর – সংজ্ঞা : বৃষ্টিবহুল পার্বত্য অঞ্চলে নদী পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় বেশি করে। এর ফলে নদীখাত যথেষ্ট গভীর হয়। নদীখাত খুব গভীর ও সংকীর্ণ হতে হতে যখন ইংরেজি অক্ষর V-আকৃতির হয়, তখন তাকে বলা হয় গিরিখাত।
উদাহরণ: দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর এল ক্যানন দ্য কল্কা বিশ্বের গভীরতম (3270 মি) গিরিখাত।
12. কিউসেক ও কিউমেক কী?
উত্তর – কিউসেক: নদীর একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যত ঘনফুট জল প্রবাহিত হয়, তাকেই কিউসেক (cubic feet per second) বলা হয়।
কিউমেক: নদীর একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যত ঘনমিটার জল প্রবাহিত হয়, তাকে কিউমেক (cubic metre per second) বলা হয়।
13. নদীবাঁক বা মিয়েন্ডার কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : সমভূমিতে ভূমির ঢাল খুব কম বলে নদীর গতিবেগও কমে যায়।
এর ফলে সামান্য বাধা পেলেই তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। বাঁকের যে অংশে নদীস্রোত আঘাত করে সেখানে ক্ষয় হয় বলে অবতল বা খাড়া পাড় গঠিত হয়। আর বিপরীত অংশে ক্ষয়িত পদার্থসমূহ সঞ্চিত হওয়ার জন্য উত্তল বা ঢালু পাড় গঠিত হয়। এইভাবে নদীখাতে ক্রমান্বয়ে ক্ষয় ও সঞ্চয়ের জন্য নদীতে অসংখ্য বাঁক সৃষ্টি হয়, যেগুলির মধ্য দিয়ে নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। এই বাঁকগুলিকেই বলে নদীবাঁক বা মিয়েন্ডার। (তুরস্কের মিয়েন্ডারেস নদীর নামানুসারে এই ভূমিরূপের নামকরণ হয় মিয়েন্ডার)।
14. অন্তবর্ম্ম বা শৃঙ্খলিত শৈলশিরা কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: পার্বত্য অঞ্চলে অনেক সময় কঠিন শিলাগঠিত শৈলশিরাসমূহ নদীর গতিপথে এমনভাবে বাধার সৃষ্টি করে যে, সেই বাধা এড়াতে নদী শৈলশিরাগুলির পাদদেশ ক্ষয় করে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হতে হয়। তখন পরপর অবস্থিত ওই শৈলশিরাগুলিকে দূর থেকে আবদ্ধ বা শৃঙ্খলিত দেখায়। এ ছাড়াও নদী ওই শৈলশিরাগুলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ওই শৈলশিরাগুলিকেই অন্তর্বদ্ধ বা শৃঙ্খলিত শৈলশিরা বলা হয়।
15. কাসকেড কী?
উত্তর – ধারণা: পার্বত্য প্রবাহে নদীর গতিপথে যদি নরম ও কঠিন শিলাস্তর এমনভাবে পরস্পর সংলগ্ন থাকে যে তার মাধ্যমে সেখানে সিঁড়ির মতো ধাপ উৎপন্ন হয়, তাহলে তার ওপর নদী অজস্র ধারায় ভাগ হয়ে প্রবাহিত হয়। এর ফলে ছোটো ছোটো জলপ্রপাত সৃষ্টি করে ধাপে ধাপে বা লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নামে। এই ধরনের খুব কাছাকাছি বা সারিবদ্ধভাবে থাকা ছোটো ছোটো জলপ্রপাতকে একসঙ্গে কাসকেড বলে।
16. ক্যানিয়ন কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: কোনো নদী যদি তার গতিপথে বৃষ্টিহীন শুষ্ক অঞ্চলের নরম শিলাস্তরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে সেখানে বৃষ্টিপাতের অভাবে উপত্যকার দু-পাশে ভূমিক্ষয় হয় কম (কারণ দু-পাশ থেকে উপনদী এসে মেশে না এবং দুই পাড়ের ক্ষয়ও হয় কম), কিন্তু নরম শিলাস্তরের জন্য নদী তখন বেশি পরিমাণে নিম্নক্ষয় করে। এর ফলে নদী উপত্যকা ইংরেজি অক্ষর ‘I’-আকৃতির মতো দেখতে হয় এবং অত্যন্ত গভীর ও সংকীর্ণ উপত্যকার সৃষ্টি হয়। ওই অত্যন্ত গভীর ও সংকীর্ণ উপত্যকাকে ক্যানিয়ন বলে।
উদাহরণ: গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।
17. নদীগ্রাস কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: কোনো জলবিভাজিকার দু-পাশে প্রবাহিত দুটি নদীর মধ্যে যদি একটি অন্যটির তুলনায় বেশি শক্তিশালী হয় অর্থাৎ তার গভীরতা ও ক্ষয়কারী ক্ষমতা বেশি হয়, তাহলে কিছুকাল পরে যখন মধ্যবর্তী জলবিভাজিকা বিলুপ্ত হয়, তখন দুর্বল নদীটির জল সবল নদীটিতে এসে পড়ে তার উপনদীতে পরিণত হয়। এই অবস্থায় সবল নদীটি দুর্বল নদীটিকে গ্রাস করেছে বলে ধরা হয়। একেই নদীগ্রাস বলে।
18. নদীর ক্ষয়সীমা বা ক্ষয়ের শেষসীমা বলতে কী বোঝ?
উত্তর – সংজ্ঞা : নদী ভূপৃষ্ঠে যে গভীরতা পর্যন্ত ক্ষয় করতে সক্ষম, সেই গভীরতাকেই নদীর ক্ষয়সীমা বা ক্ষয়ের শেষসীমা বলে।
বৈশিষ্ট্য: (1) সাধারণভাবে নদীর ক্ষয়সীমা হল নিকটতম সমুদ্রপৃষ্ঠ। (2) নদী যখন কোনো হ্রদে এসে মিলিত হয়, তখন সেই হ্রদপৃষ্ঠই হয় নদীর ক্ষয়সীমা। যেমন মরু অঞ্চলে নদীর ক্ষয়সীমা হল প্লায়া হ্রদ।
19. অন্তর্জাত শক্তি কী?
উত্তর – সংজ্ঞা: পৃথিবীর অভ্যন্তরে সৃষ্ট সংকোচন, প্রসারণ, উত্থান, অবনমন, বিচ্ছেদ, বিকৃতি, নির্গমন প্রভৃতি যেসব প্রক্রিয়ার জন্য ভূপৃষ্ঠের ভূমিরূপ প্রভাবিত বা পরিবর্তিত হয়, সেগুলিকে ভূ-অভ্যন্তরীণ বা অন্তর্জাত শক্তি বলে।
বৈশিষ্ট্য: (1) এইসব অন্তর্জাত শক্তির মূল উৎস পৃথিবীর অভ্যন্তরে সৃষ্ট প্রচণ্ড তাপ ও চাপ। (2) অন্তর্জাত শক্তির প্রভাবেই ভূ আলোড়ন, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি অন্তর্জাত প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে, যেগুলির মাধ্যমে মহাদেশ, মালভূমি, চ্যুতি, ফাটল, গ্রস্ত উপত্যকা, উত্থিত বা নিমজ্জিত উপকূল ইত্যাদি তৈরি হয়।
20. বহির্জাত শক্তি কী?
উত্তর – সংজ্ঞা: যেসব প্রাকৃতিক শক্তি প্রতিনিয়ত ভূপৃষ্ঠে এবং ভূপৃষ্ঠের সামান্য নীচে অর্থাৎ উপপৃষ্ঠীয় অংশে ক্রিয়াশীল থাকে তাদের বহির্জাত শক্তি বলে। উদাহরণ: নদী, হিমবাহ, বায়ু, সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি বহির্জাত শক্তি।
21. পর্যায়ন বা ক্রমায়ন কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: চেম্বারলিন ও স্যালিসবেরি দুই বিজ্ঞানী প্রথম ‘পর্যায়ন’ বা ‘gradation’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ক্ষয়, পরিবহণ ও সঞ্জয় কাজের মাধ্যমে অসমতল এবং বন্ধুর ভূপ্রকৃতি সমতলভাগে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে পর্যায়ন বলে। এককথায় বলা যায়, অবরোহণ এবং আরোহণের সম্মিলিত ফল হল পর্যায়ন। একে ক্রমায়নও বলা হয়।
22. অবরোহণ কী?
উত্তর – সংজ্ঞা: যে প্রক্রিয়ায় আবহবিকার, পুঞ্জিত স্খলন, নদী, হিমবাহ প্রভৃতি বহির্জাত শক্তিসমূহের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের উঁচু জায়গাগুলি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গিয়ে ক্রমশ নীচু হয়ে আসে, সেই প্রক্রিয়া বা প্রক্রিয়াসমূহকে এককথায় অবরোহণ বলে। উদাহরণ: অবরোহণের ফলেই সুউচ্চ পর্বত ক্ষয় হতে হতে প্রথমে ক্ষয়জাত পর্বত, তারপর ক্ষয়জাত মালভূমি এবং শেষে ক্ষয়জাত সমভূমিতে পরিণত হয়।
23. আরোহণ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: সঞ্চয়, অবক্ষেপণ এবং অধঃক্ষেপণের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের নীচু অংশগুলি বা নিম্নভূমিসমূহ ভরাট হওয়ার যে প্রক্রিয়া তাকেই আরোহণ বলে। এর আর-এক নাম স্তূপীকরণ।
বৈশিষ্ট্য: (1) এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নিম্নভূমির উচ্চতা বেড়ে যায়। (2) পর্বতের পাদদেশে সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ তৈরি হয়। (3) নদী অববাহিকায় পলল ব্যজনী ও প্লাবনভূমির মতো ভূমিরূপ তৈরি হয়।
24. নগ্নীভবন কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা : আবহবিকারের মাধ্যমে সৃষ্ট চূর্ণবিচূর্ণ শিলাসমূহ অভিকর্ষের টানে পুঞ্জিত স্খলনরূপে (Mass wasting) নীচে নামে এবং শেষে ক্ষয়ীভবনের মাধ্যমে সেখান থেকে দূরে অপসারিত হয়। সুতরাং আবহবিকার, পুঞ্জিত স্খলন এবং ক্ষয়ীভবন—এই তিনটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সম্মিলিত কার্যে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর উন্মুক্ত বা নগ্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ আবহবিকার, পুথ্বিতস্খলন এবং ক্ষয়ীভবনের মিলিত প্রক্রিয়াকে নগ্নীভবন বলে।
25. মানুষ এবং অন্যান্য জীব কীভাবে বহির্জাত শক্তির প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে?
উত্তর – বহিজাত শক্তির প্রক্রিয়া হিসেবে মানুষ এবং অন্যান্য জীব : মানুষ-সহ সমগ্র জীবজগৎ ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় এবং সঞ্চয়কার্যে অংশগ্রহণ করে বহির্জাত শক্তির প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। মানুষ রাস্তাঘাট, বাঁধ-জলাধার ইত্যাদি নির্মাণের কাজে এবং উইপোকা, ইঁদুর, খরগোশ, প্রেইরি কুকুর ইত্যাদি প্রাণী জীবনধারণের প্রয়োজনে শিলাকে ক্ষয় ও চূর্ণবিচূর্ণ করে। এইভাবেই ক্ষয়কার্য ঘটে। অন্যদিকে জলাভূমি, লেগুনে যেসব শ্যাওলা, গাছপালা জন্মায়, তাদের ফুল, পাতা, ফল ইত্যাদি পচে গিয়ে জৈব পদার্থ তৈরি করে। সেসব দিয়েই জলাভূমি ভরাট হয়। মানুষ নিজেও জলাভূমি ভরাট করে, নদী-সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং ভূমিভাগের সঞ্চয় প্রক্রিয়াকে জারি রাখে।
26. সমপ্রায়ভূমি ও মোনাডনক কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: বহু যুগ ধরে কোনো প্রাচীন মালভূমি বা উচ্চভূমি অঞ্চল প্রধানত নদীর কার্যের মাধ্যমে অনবরত ক্ষয় হলে বেশ নীচু হয়ে যায় এবং তার বন্ধুরতাও অনেকটা হ্রাস পায়। এর ফলে যে ভূমিটি সৃষ্টি হয় তা অনেকটা সমভূমিরই মতো। এজন্য ওই ভূমিকে সমপ্রায়ভূমি বলে। সমপ্রায়ভূমির মাঝে মাঝে দু-একটি কঠিন শিলাগঠিত অংশ ক্ষয় প্রতিরোধ করে টিলার আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলির নাম মোনাডনক।
উদাহরণ: ছোটোনাগপুর মালভূমির কোনো কোনো অংশ সমপ্রায়ভূমি এবং এখানকার পরেশনাথ, পাঞ্চেৎ প্রভৃতি পাহাড় মোনাডনক।
27. নদীর মধ্যগতি বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – সংজ্ঞা : নদী যখন পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে সমভূমিতে এসে পড়ে, সেই সমভূমি অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর প্রবাহকে মধ্যগতি বলে। মধ্যগতিতে নদীস্রোত হ্রাস পেলেও নদীতে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই অংশে নদীর প্রধান কাজ বহন এবং সঞ্চয় করা।
উদাহরণ: গঙ্গা নদীর হরিদ্বার থেকে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পর্যন্ত প্রবাহপথটি মধ্যগতির মধ্যে পড়ে।
28. নদীর নিম্নগতি বা বদ্বীপপ্রবাহ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: সমভূমির ওপর দিয়ে মধ্যগতিতে প্রবাহিত হতে হতে নদী যখন মোহানার কাছাকাছি চলে আসে, শুরু হয় নদীর নিম্নগতি। অর্থাৎ মোহানা অঞ্চলের ওপর দিয়ে ধীরগতিতে প্রবাহিত নদীর গতিপথকে বলে নিম্নগতি। যেহেতু নিম্নগতিতে প্রবাহিত নদী মোহানায় বদ্বীপ গড়ে তোলে, তাই এই গতির আর-এক নাম বদ্বীপপ্রবাহ।
উদাহরণ: ঝাড়খণ্ডের রাজমহলের পর থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহানা পর্যন্ত অংশ গঙ্গা নদীর নিম্নগতি বা বদ্বীপপ্রবাহ।
29. প্ৰপাতকূপ কী?
উত্তর – সংজ্ঞা: পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলে নদীর গতিপথের ঢাল হঠাৎ পরিবর্তিত হলে নদীস্রোত সেই খাড়া ঢাল থেকে বিপুল বেগে নীচে পড়ে জলপ্রপাত সৃষ্টি করে। যেহেতু জলপ্রপাতের নীচের অংশের গতিবেগ ও শক্তি খুব বেশি থাকে, তাই জল যেখানে নীচে পড়ে, নদীখাতের সেই অংশে জলের আঘাতে এবং নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে বেশ বড়ো গর্ত সৃষ্টি হয়। হাঁড়ির মতো দেখতে সেই গর্তকেই বলে প্রপাতকূপ বা প্লাঞ্জপুল (Plunge pool) |
30. মিয়েন্ডার ভূমিরূপ নামকরণ কেন হয়েছে?
উত্তর – মিয়েন্ডার ভূমিরূপ নামকরণ হওয়ার কারণ: সমভূমি প্রবাহে নদীর আঁকাবাঁকা ‘গতিপথকে মিয়েন্ডার বলা হয়। তুরস্কের মিয়েন্ডারেস (Menderes) নদীতে অসংখ্য নদীবাঁক আছে। ওই নদীবাঁকের কথা মনে রেখেই পৃথিবীর যাবতীয় নদীবাঁককে মিয়েন্ডার বলা হয়।
31. লোহাচড়া দ্বীপটি ডুবে যাচ্ছে কেন?
উত্তর – লোহাচড়া দ্বীপটি ডুবে যাওয়ার কারণ : হুগলি নদীর মোহানায় লোহাচড়া দ্বীপটি বর্তমানে অনেকটাই ডুবে গেছে। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা কয়েকটি কারণ নির্দেশ করেছেন— (1) সমুদ্রজলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, (2) উপকূলের ক্ষয়, (3) প্রবল ঘূর্ণিঝড়, (4) ম্যানগ্রোভের ধ্বংস প্রভৃতি এই দ্বীপের ক্ষতির অন্যতম কারণ।
32. নিউমুর বা পূর্বাশা বা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – ধারণা : সুন্দরবনের দক্ষিণে হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহানা থেকে 2 কিমি দূরে ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানার খুব কাছে এই দ্বীপের অবস্থান ছিল। ভৌগোলিক অবস্থা অনুযায়ী এটির অবস্থান ছিল 21°37.00´´ উত্তর অক্ষাংশ এবং 89°08′30″ পূর্ব দ্রাঘিমার সংযোগস্থলে। 1970 সালে ভোলা নামে সাইক্লোন আসার পরেই এই দ্বীপ সমুদ্র থেকে জেগে ওঠে। 1974 সালে এর আয়তন ছিল 2500 বর্গমিটার (উপগ্রহচিত্র থেকে)। বর্তমানে এটি একটি সম্পূর্ণ নিমজ্জিত দ্বীপ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় দ্বীপটি তলিয়ে গেছে বা জলমগ্ন হয়েছে।
33. ঘোড়ামারা দ্বীপের বর্তমান অবস্থা কেমন?
উত্তর – ঘোড়ামারা দ্বীপের বর্তমান অবস্থা: কলকাতা থেকে মাত্র 92 কিমি দক্ষিণে হুগলি নদীর মোহানায় সাগরদ্বীপের উত্তরে এবং হলদি নদীর মোহানার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সুন্দরবনের এই সাধারণ দ্বীপটি অবস্থিত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, 1951 সালে ঘোড়ামারা দ্বীপটির আয়তন ছিল 38.23 বর্গকিমি, 2011 সালে এর আয়তন দাঁড়ায় 4.37 বর্গকিমি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই দ্বীপটিও সম্পূর্ণ ডুবে যাবে।
34. নদীর পুনর্যৌবন লাভ বলতে কী বোঝ?
উত্তর – সংজ্ঞা: সমুদ্রপৃষ্ঠের পতন ঘটলে অথবা ভূ-আলোড়নের ফলে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে নদীর ক্ষয়কার্যের ক্ষমতা বেড়ে যায়। একে বলা হয় নদীর পুনর্যৌবন লাভ।
বৈশিষ্ট্য : নদীর পুনর্যৌবন লাভের ফলে নদীতে নিক পয়েন্ট, নদীমঞ্চ, উপত্যকার মধ্যে উপত্যকা, কর্তিত নদীবাঁক প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।
35. নিক পয়েন্ট কী?
উত্তর – সংজ্ঞা: ভূমির পুনর্যৌবন লাভের ফলে নদী উপত্যকার নতুন ঢাল ও পুরোনো ঢালের সংযোগস্থলে যে খাঁজ তৈরি হয়, তাকে নিক পয়েন্ট বলে।
বৈশিষ্ট্য: নিক পয়েন্টে হঠাৎ ভূমিঢালের পরিবর্তন তথা জলতলের পার্থক্য সৃষ্টি হয় বলে সেখানে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
36. অবঘর্ষ প্রক্রিয়া কী?
অথবা, অবঘর্ষ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: ‘অবঘর্ষ’ কথাটির অর্থ ‘ঘর্ষণজনিত ক্ষয়’। সাধারণভাবে বলা যায়, নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা পরিবাহিত শিলাখণ্ডের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠসংলগ্ন শিলাস্তরের ঘর্ষণ তথা সংঘর্ষের ফলে শিলাস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, একে বলে অবঘর্ষ ক্ষয়।
বৈশিষ্ট্য : অবঘর্ষ ক্ষয়ের ফলে শিলার ক্ষয় দ্রুততর হয় এবং শিলা মসৃণ হয়।
37. মন্থকূপ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: উচ্চগতি বা পার্বত্যপ্রবাহে নদীর প্রবল স্রোতের সঙ্গে বাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি প্রভৃতি ঘুরতে ঘুরতে নীচের দিকে অগ্রসর হয়। এর ফলে পরিবাহিত নুড়ি ও প্রস্তরখণ্ডের দ্বারা ঘর্ষণজনিত ক্ষয়ের কারণে নদীখাতে কূপের মতো অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়। এগুলিকে বলা হয় মন্থকূপ বা পটহোল।
উদাহরণ: সুবর্ণরেখা নদীখাতে অনেক মন্থকূপ দেখতে পাওয়া যায়।
38. খরস্রোত কী?
উত্তর – সংজ্ঞা: নদীর গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর একটির পর একটি (পাশাপাশি) খাড়াভাবে বা উল্লম্বভাবে থাকলে কঠিন শিলাস্তরের তুলনায় কোমল শিলাস্তর তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়। এর ফলে নদীর গতিপথে পরপর কয়েকটি ধাপ বা সিঁড়ির সৃষ্টি হয়। এর ফলে নদী তখন একটির পর একটি ধাপ পেরিয়ে দ্রুত নীচে নেমে আসে ও খরস্রোতের সৃষ্টি করে।
উদাহরণ: আফ্রিকার বিখ্যাত নীল নদের গতিপথে খাতুম থেকে আসোয়ান পর্যন্ত 6টি স্থানে এরকম খরস্রোতের সৃষ্টি হয়েছে।
39. পাখির পায়ের মতো বদ্বীপ কীভাবে গঠিত হয়?
উত্তর – পাখির পায়ের মতো বদ্বীপ গঠিত হওয়ার পদ্ধতি : মোহানার কাছে নদীর জলের ঘনত্ব যদি সমুদ্রজলের ঘনত্বের তুলনায় কম হয় এবং নদীর গতিবেগ একটু বেশি থাকে, তাহলে নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীর দুইপাশে সঞ্চিত হতে হতে সমুদ্রের যথেষ্ট দূর পর্যন্ত পৌঁছে অধঃক্ষিপ্ত হয়। একইভাবে শাখানদীসমূহের পাশেও পদার্থসমূহ সঞ্চিত হতে থাকে। এর ফলে মূল নদী ও শাখানদীসমূহের মাধ্যমে সৃষ্ট সমগ্র বদ্বীপটি দেখতে পাখির পায়ের মতো লাগে।
উদাহরণ: মিসিসিপি মিসৌরি নদীর বদ্বীপ পাখির পায়ের মতো দেখতে।
40. ব্রহ্মপুত্র নদে অসংখ্য দ্বীপ বা চরার সৃষ্টি হয়েছে কেন?
উত্তর – ব্রহ্মপুত্র নদে অসংখ্য দ্বীপ বা চরা সৃষ্টির কারণ:ব্রহ্মপুত্র নদে অসংখ্যদ্বীপ বা চরা সৃষ্টির কারণগুলি হল— (1) ভূমির ঢাল কম: অসমের মধ্যে আছে ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যগতি বা সমভূমিপ্রবাহ। এখানে ভূমির ঢাল এত কম যে নদী অত্যন্ত ধীরে প্রবাহিত হয়। এর ফলে সেখানে চরা সৃষ্টি হয়েছে। (2) নদীগর্ভে বিপুল সঞ্চয়: এখানে প্রচুর সংখ্যক উপনদী ব্রহ্মপুত্রে পড়ায় বোঝার পরিমাণও বেশি থাকে। তাই নদীবাহিত বিপুল পরিমাণ পদার্থ নদীগর্ভেই সঞ্চিত হয়। আর সেকারণেই ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে অসংখ্য দ্বীপ ও চরার সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণ:মাজুলি এমনই একটি নদীদ্বীপ।

বহু বিকল্পভিত্তিক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

1. বৃষ্টিযুক্ত আর্দ্র অঞ্চলে যে প্রাকৃতিক শক্তি ভূমিরূপ পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা নেয়, তা হল –
(a) হিমবাহ
(b) বায়ু
(c) নদী
(d) সূর্যতাপ
উত্তর – (c) নদী
2. নদীর নিক পয়েন্টে সৃষ্টি হয় –
(a) অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ
(b) প্লাবনভূমি
(c) জলপ্রপাত
(d) পললশঙ্কু
উত্তর – (c) জলপ্রপাত
3. যে প্রক্রিয়ায় ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে ভূমিরূপের সামঞ্জস্য তৈরি করে, তা হল—
(a) ক্ষয়ীভবন
(b) পর্যায়ন
(c) নগ্নীভবন
(d) আবহবিকার
উত্তর – (b) পর্যায়ন
4. যে প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, তাকে বলে—
(a) আরোহণ প্রক্রিয়া
(b) অবরোহণ প্রক্রিয়া
(c) আবহবিকার প্রক্রিয়া
(d) নগ্নীভবন প্রক্রিয়া
উত্তর – (a) আরোহণ প্রক্রিয়া
5. পললশঙ্কু গঠিত হয় নদীর—
(a) পার্বত্যপ্রবাহে
(b) বদ্বীপপ্রবাহে
(c) উচ্চ ও মধ্য প্রবাহের সংযোগস্থলে
(d) মধ্য ও নিম্ন প্রবাহের সংযোগস্থলে
উত্তর – (c) উচ্চ ও মধ্য প্রবাহের সংযোগস্থলে
6. শুষ্ক অঞ্চলে গিরিখাতকে বলা হয়—
(a) ক্যানিয়ন
(b) ‘V’-আকৃতির উপত্যকা
(c) মন্থকূপ
(d) ধান্দ
উত্তর – (a) ক্যানিয়ন
7. পার্বত্যপ্রবাহে নদীর দুই পাশে যেসব সমান বা অসমান ধাপের মতো অল্প বিস্তৃত ভূভাগের সৃষ্টি হয়, তাকে বলে—
(a) নদীমঞ
(b) স্বাভাবিক বাঁধ
(c) খরস্রোত
(d) কর্তিত স্পার
উত্তর – (a) নদীমঞ
৪. অতিগভীর ‘V’-আকৃতির উপত্যকাকে বলে—
(a) গিরিখাত
(b) ক্যানিয়ন
(c) কর্তিত স্পার
(d) প্লাঞ্জপুল
উত্তর – (a) গিরিখাত
9. মন্থকূপ সৃষ্টি হয় যার ক্ষয়কার্যের ফলে—
(a) নদীর
(b) বায়ুর
(c) হিমবাহের
(d) সমুদ্রতরঙ্গের
উত্তর – (a) নদীর
10. পললশঙ্কু দেখা যায় –
(a) পর্বতের উচ্চভাগে
(b) পর্বতের পাদদেশে
(c) বদ্বীপ অঞ্চলে
(d) নদীর মধ্যপ্রবাহে
উত্তর – (b) পর্বতের পাদদেশে
11. জলপ্রপাতের পাদদেশে তৈরি হয়—
(a) মন্থকূপ
(b) ফিয়র্ড
(c) প্রপাতকূপ
(d) পলল ব্যজনী
উত্তর – (c) প্রপাতকূপ
12. পৃথিবীর বৃহত্তম নদী অববাহিকা হল—
(a) গঙ্গা নদী অববাহিকা
(b) কঙ্গো নদী অববাহিকা
(c) আমাজন নদী অববাহিকা
(d) নীল নদ অববাহিকা
উত্তর – (c) আমাজন নদী অববাহিকা
13. নদীর কোনো নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যত ঘনফুট জল বয়ে যায়, তাকে বলে—
(a) কিউসেক
(b) কিউরেক
(c) কিউমেক
(d) কিউডেক
উত্তর – (a) কিউসেক
14. পৃথিবীর বৃহত্তম গিরিখাত—
(a) ইচাং গিরিখাত
(b) কালিগণ্ডকী গিরিখাত
(c) মার্চিসন গিরিখাত
(d) গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
উত্তর – (d) গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
15. পৃথিবীর বৃহত্তম জলপ্রপাত—
(a) ভিক্টোরিয়া
(b) ইটাইপু
(c) নায়াগ্রা
(d) স্ট্যানলি
উত্তর – (c) নায়াগ্রা
16. লম্ফদান প্রক্রিয়াটি হল নদীর—
(a) ক্ষয়
(b) বহন
(c) উত্থান
(d) অবক্ষেপণ
উত্তর – (b) বহন
17. পৃথিবীর বৃহত্তম নদীগঠিত দ্বীপ হল—
(a) মারিয়ানা
(b) মারাজো
(c) সাগরদ্বীপ
(d) মাজুলি
উত্তর – (b) মারাজো
18. নদীর গতিবেগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলে তার বহনক্ষমতা বাড়ে—
(a) 7 গুণ
(b) 2 গুণ
(c) 6 গুণ
(d) 64 গুণ
উত্তর – (d) 64 গুণ
19. কঠিন শিলাযুক্ত অঞ্চলে কম ঢালযুক্ত ছোটো ছোটো জলপ্রপাতকে বলে—
(a) ক্যাটারাক্ট
(b) কাসকেড
(c) র‍্যাপিড
(d) জলস্রোত
উত্তর – (c) র‍্যাপিড
20. একটি বহির্জাত ভূগাঠনিক প্রক্রিয়া হল—
(a) লাভা উদ্‌গিরণ
(b) ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টি
(c) স্তূপ পর্বত নির্মাণ
(d) নদীর ক্ষয়কার্য
উত্তর – (d) নদীর ক্ষয়কার্য
21. বহির্জাত প্রক্রিয়াতে সামগ্রিকভাবে ঘটে—
(a) পর্যায়ন
(b) ভূমি সঞ্চয়
(c) ভূমির ক্ষয়
(d) ভূমির উত্থান
উত্তর – (a) পর্যায়ন
22. সুন্দরবনের দ্বীপগুলি ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়ার মূল কারণ—
(a) অত্যধিক বৃষ্টিপাত
(b) ঘূর্ণিঝড়
(c) সমুদ্র জলতলের উত্থান
(d) সুন্দরবনের অবনমন
উত্তর – (c) সমুদ্র জলতলের উত্থান
23. নীল নদের বদ্বীপটি হল—
(a) তীক্ষ্ণাগ্র বদ্বীপ
(b) ধনুকাকৃতি বদ্বীপ
(c) অবিন্যস্ত বদ্বীপ
(d) পাখির পায়ের মতো বদ্বীপ
উত্তর – (b) ধনুকাকৃতি বদ্বীপ
24. নদীবাঁকের উত্তল অংশের সঞ্চয়কে বলে –
(a) পুল
(b) বিন্দুবার
(c) প্লাঞ্জপুল
(d) কাসকেড
উত্তর – (b) বিন্দুবার
25. কোন্‌টি সুন্দরবন এলাকার দ্বীপ নয়—
(a) ঘোড়ামারা
(b) পূর্বাশা
(c) মাজুলি
(d) লোহাচড়া
উত্তর – (c) মাজুলি

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. দুই নদী অববাহিকাকে যে ………. পৃথক করে, তাকে বলে জলবিভাজিকা।
উত্তর – উচ্চভূমি
2. নদীপ্রবাহ পরিমাপের একক ………..।
উত্তর – কিউসেক বা কিউমেক
3. নিম্নভূমি সঞ্চয়ের মাধ্যমে উঁচু হওয়াকে বলে ………..।
উত্তর – আরোহণ
4. পার্বত্যপ্রবাহে নদীর গতিপথে ………. সৃষ্টি হয়।
উত্তর – গিরিখাত
5. পার্বত্য অঞ্চলে নদীর প্রবাহকে বলে ………..।
উত্তর – পার্বত্য প্রবাহ বা উচ্চগতি
6. পার্বত্য অংশে নদীর নিম্নক্ষয় প্রধানত ………. প্রক্রিয়ায় ঘটে।
উত্তর – অবঘর্ষ
7. ভারতের ……….. অঞ্চলে গিরিখাত দেখা যায়।
উত্তর – হিমালয়
৪. জলপ্রপাতের ঢাল বেশি হলে, তাকে ……… বলে।
উত্তর – ক্যাটারাক্ট
9. পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী ………..।
উত্তর – নীল
10. লাতিন শব্দ ‘কাসপেট’-এর অর্থ হল ……….।
উত্তর – তীক্ষ্ণ
11. ……… নদী পৃথিবীর সর্বাধিক জল বহন করে।
উত্তর – আমাজন
12. নদীর ……….. প্রবাহে প্লাবনভূমি গড়ে ওঠে।
উত্তর – সমভূমি
13. একটি অন্তর্জাত ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তি হল ………..।
উত্তর – পাতের চলন
14. নদীগর্ভে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট গর্তগুলিকে ………. বলে।
উত্তর – মন্থকূপ
15. নদী, হিমবাহের ক্ষয়কাজ একধরনের ………. প্ৰক্ৰিয়া ৷
উত্তর – বহির্জাত
16. বহির্জাত প্রক্রিয়ার কার্যের মাধ্যমে ক্ষয়ের ফলে ভূমির ঢালের একটি পর্যায় তৈরি হয়। একে ……… বলে।
উত্তর – পর্যায়ন
17. নদীর পার্বত্য প্রবাহের প্রধান কাজ ………..।
উত্তর – ক্ষয়
18. …………. প্রবাহে নদী সবচেয়ে কম ক্ষয় করে।
উত্তর – বদ্বীপ
19. গঙ্গা নদীর পার্বত্যপ্রবাহ গোমুখ থেকে ……….. পর্যন্ত বিস্তৃত।
উত্তর – হরিদ্বার
20. বিভিন্ন ধরনের বহির্জাত শক্তির দ্বারা ভূমিভাগের সমতলীকরণ ঘটলে, তাকে ……… বলে।
উত্তর – পর্যায়ন
21. লিভিংস্টোন জলপ্রপাতটি ………. নদীর ওপর অবস্থিত।
উত্তর – কঙ্গো বা জাইরে

TOPIC – B হিমবাহের বিভিন্ন কাজ দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ

একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি

  1. হিমবাহ: শীতপ্রধান অঞ্চলে যে বিশালাকৃতির বরফের স্তূপ ভূমির ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামে, তাকে বলে হিমবাহ বা বরফের নদী।
  2. বৃহত্তম সুপেয় জলের ভাঙার: হিমবাহের মধ্যে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম সুপেয় জলের সঞ্চয়। পৃথিবীর মোট জলভাণ্ডারের মাত্র 3 শতাংশ সুপেয় জল এবং 97 শতাংশ লবণাক্ত সমুদ্রজল। 3 শতাংশ সুপেয় জলের মধ্যে প্রায় 2 শতাংশ জল আবদ্ধ আছে কঠিন বরফস্তর তথা হিমবাহের মধ্যে।
  3. হিমবাহের শ্রেণিবিভাগ : অবস্থান অনুসারে হিমবাহকে তিনভাগে ভাগ করা যায় – মহাদেশীয় হিমবাহ, 2 পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ এবং 3 পর্বতের পাদদেশীয় হিমবাহ।
  4. হিমরেখা: পর্বতের গায়ে বা ভূপৃষ্ঠে যে উচ্চতার উপরে সারাবছর বরফ জমে থাকে বা যে উচ্চতার নীচে বরফ গলে যায়, উচ্চতার সেই সীমারেখার নাম হিমরেখা।
  5. হিমশৈল : সমুদ্রে ভাসমান বিশালাকৃতি বরফের স্তূপকে হিমশৈল বলে। হিমশৈলের ৪ ভাগের 1 ভাগ জলের ওপর ভেসে থাকে।
  6. ক্রেভাস: নীচের দিকে নামার সময় হিমবাহের পৃষ্ঠদেশে টান পড়ার জন্য যেসব চিড় বা ফাটল সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে বলে ক্রেভাস।
  7. বার্গমুন্ড: হিমবাহের মস্তক এবং মস্তকের দিকের পর্বতগাত্রের মাঝে যে গভীর উল্লম্ব ফাটল থাকে, তাকে বার্গশ্রুন্ড বলে।
  8. র‍্যাডকুফ্ট: হিমবাহের পার্শ্বসীমান্ত ও পর্বতগাত্রের মাঝে যেসব ফাটল সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে বলে র‍্যান্ডফ্লুফ্ট।
  9. নুনাটাকস: নুনাটাকস একটি এস্কিমো শব্দ, যার অর্থ ‘বরফমুক্ত’ স্থান। মহাদেশীয় হিমবাহের মাঝে মাঝে বরফমুক্ত পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলি নুনাটাকস নামে পরিচিত।
  10. সিরাক: হিমবাহের মধ্যে সৃষ্ট হওয়া খাদের পাশে বরফ সজ্জিত হয়ে যে চূড়া গঠিত হয়, তা সিরাক নামে পরিচিত।

দীর্ঘ উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।
হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
উত্তর – হিমবাহের ক্ষয়কার্য শুধু উঁচু পর্বতের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে এবং এই ক্ষয়কার্যের ফলে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, যেমন—
  1. করি বা সার্ক: উৎপত্তি: হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়কার্যের কারণে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে সার্ক বা করি সৃষ্টি হয়। হিমবাহ যখন উঁচু পার্বত্য অঞ্চল থেকে নীচের দিকে নামে তখন একইসঙ্গে হিমবাহের অবঘর্ষ ও উৎপাটন প্রক্রিয়ার দরুন পর্বতের ঢালের পিছনদিকে খাড়া দেয়াল, মধ্যভাগে অর্ধবৃত্তকার গহ্বর এবং সামনে ধাপসমন্বিত হাতলযুক্ত ডেকচেয়ারের মতো ভূমিরূপ গঠিত হয়। এইরকম ভূমিরূপকে স্কটল্যান্ডে করি এবং ফ্রান্সে সার্ক বলা হয়। গঠন:একটি করির তিনটি অংশ দেখা যায়—[i] খাড়া দেয়াল: করির পিছনদিকে একটি খাড়া দেয়াল থাকে [ii] অর্ধবৃত্তাকার গর্ভ: করির মধ্যভাগে একটি অর্ধবৃত্তাকার গর্ত বা খাত থাকে এবং [iii] উটের কুঁজের মতো অংশ: করির নীচের দিকে বা প্রান্তভাগে উটের কুঁজের মতো একটি অংশ বর্তমান। হিমবাহ-গলা জল করিতে জমে হ্রদ সৃষ্টি হলে তাকে বলা হয় করি বা টার্ম হ্রদ, যেমন – হিমালয়, আল্পস প্রভৃতি হিমবাহ অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে এই প্রকার হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণ: অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত ওয়ালকট পৃথিবীর গভীরতম করি বা সার্ক।
  2. এরিটি বা অ্যারেট : উৎপত্তি: হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়ের ফলে একই পর্বতশৃঙ্গের দুই দিকে দুটি করির সৃষ্টি হলে ও তাদের আয়তন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে মধ্যবর্তী সংকীর্ণ খাড়া শিরা বা তীক্ষ্ণ প্রাচীরের মতো অংশকে বলা হয় এরিটি বা অ্যারেট। বৈশিষ্ট্য: [i] এরিটিগুলি প্রায় ছুরির ফলার মতো ধারালো হয়। [ii] কোনো অংশ যদি ভেঙে যায় তাহলে এক সার্ক থেকে অন্য সার্কে যাওয়ার ‘গিরিপথ’ সৃষ্টি হয়। উদাহরণ: হিমালয় এবং কারাকোরাম পর্বতে অনেক এরিটি দেখা যায়।
  3. পিরামিড চূড়া : উৎপত্তি: পার্বত্য উপত্যকায় হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়কার্যের অন্যতম নিদর্শন হল পিরামিড চূড়া। একটি পর্বতের বিভিন্ন দিকে পাশাপাশি তিন-চারটি বিপরীতমুখী ‘করি’-র সৃষ্টি হলে সেগুলি ক্রমাগত মস্তকদেশের দিকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একটি পিরামিডের মতো আকৃতির চূড়া গঠন করে। এজন্য এর নাম পিরামিড চূড়া বা হর্ন। উদাহরণ: আল্পস পর্বতের ম্যাটারহর্ন এরকম একটি বিখ্যাত পিরামিড চূড়া। গঙ্গোত্রীর কাছে নীলকণ্ঠ শৃঙ্গও পিরামিড চূড়ার নিদর্শন।
  4. ঝুলন্ত উপত্যকা : উৎপত্তি: অনেকসময় পার্বত্য অঞ্চলে সৃষ্ট অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী ও গভীর প্রধান হিমবাহ উপত্যকায় দু-পাশ থেকে অনেক কম শক্তিশালী অগভীর ছোটো ছোটো হিমবাহ এসে মেশে। গভীরতার এই পার্থক্যের জন্য উপহিমবাহ যেখানে প্রধান হিমবাহে মেশে, সেই মিলনস্থলে দুই উপত্যকার উচ্চতার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। মনে হয় যেন উপহিমবাহ উপত্যকা প্রধান হিমবাহ উপত্যকার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। এইভাবে ঝুলে থাকা উপহিমবাহ উপত্যকাকে বলা হয় ঝুলন্ত উপত্যকা। উদাহরণ: হিমালয় পর্বতে বদ্রীনাথের কাছে ঋষিগঙ্গা উপত্যকা এরকম একটি ঝুলন্ত উপত্যকা।
  5. U-আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি: উৎপত্তি:হিমবাহ পার্বত্য অঞ্চলে যে উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, তাকে হিমদ্রোণি বলে। ওই উপত্যকায় হিমবাহের পার্শ্বক্ষয় ও নিম্নক্ষয় প্রায় সমানভাবে হয় বলে উপত্যকাটি প্রশস্ত, তলদেশ অনেকটাই মসৃণ এবং পার্শ্বদেশ খাড়া ঢালবিশিষ্ট উপত্যকায় পরিণত হয়। অর্থাৎ, উপত্যকাটির আকৃতি ইংরেজি U অক্ষরের মতো দেখতে হওয়ায় একে U-আকৃতির উপত্যকা বলে।
  6. ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল: উৎপত্তি: হিমবাহের গতিপথে অনেকসময় কোনো কঠিন শিলা উঁচু হয়ে অবস্থান করে, যেমন—কোনো আগ্নেয় উদ্‌বেধ এবং তার পিছনে থাকে কোমল শিলা। এরকম ক্ষেত্রে কঠিন শিলা কোমল শিলাকে হিমবাহের ক্ষয়কার্য থেকে কিছুটা রক্ষা করে। ফলে কোমল শিলা গঠিত অংশ তখন উঁচু ঢিবির আকারে থাকা কঠিন শিলার পিছনে পুচ্ছ (tail) বা ল্যাজের মতো বিস্তৃত থাকে। এর মধ্যে এবড়োখেবড়ো উঁচু ঢিবিটিকে ক্র্যাগ এবং পুচ্ছটিকে টেল বলে। বৈশিষ্ট্য: [i] ক্র্যাগ অ্যান্ড টেলের ক্র্যাগ অমসৃণ আর টেল মসৃণ হয়। [ii] টেল 2 কিমি পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে। উদাহরণ: স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় একটি সুবৃহৎ ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল আছে।
  7.  রসে মতানে: উৎপত্তি: হিমবাহের প্রবাহপথে শিলাখণ্ড ঢিবির আকারে উঁচু হয়ে থাকলে ক্ষয়কার্যের ফলে হিমবাহের প্রবাহের দিকে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় শিলাখণ্ডটি মসৃণ এবং বিপরীত দিকে উৎপাটন প্রক্রিয়ায় এবড়োখেবড়ো বা অসমৃণ হয়। এই ধরনের ঢিবির নাম রসে মতানে। বৈশিষ্ট্য: [i] রসে মতানে একটি মাত্র শিলার ওপর গঠিত হয়। [ii] রসে মতানের মসৃণ ঢালকে স্টস এবং অমসৃণ খাড়া ঢালকে লি বলে। [iii] এর উচ্চতা বেশি। [iv] এর বিস্তৃতি ও দৈর্ঘ্য কম।
    উদাহরণ: কাশ্মীরে ঝিলামের উপনদী লিডার উপত্যকায় রসে মতানে আছে।
  8. ফিয়র্ড: উৎপত্তি: হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সমুদ্রোপকূলসংলগ্ন পার্বত্যভূমিতে বহু খাত তথা হিমবাহ উপত্যকা সৃষ্টি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এগুলির গভীরতা বেশি হলে অঞ্চলটি বরফমুক্ত হওয়ার পর এগুলিতে সমুদ্রের জল প্রবেশ করে। জলপূর্ণ এই খাত বা উপত্যকাগুলিকেই ফিয়র্ড বলে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতি অগভীর ফিয়র্ডকে ফিয়ার্ড বলা হয়। বৈশিষ্ট্য: [i] ফিয়র্ড উপকূলে জলের গভীরতা খুব বেশি হয়। [ii] ফিয়র্ডের মাঝের তুলনায় প্রান্তভাগের জলের গভীরতা কম হয়।
    উদাহরণ: নরওয়ের সোভনে বা সোজনে পৃথিবীর গভীরতম ফিয়র্ড।
  9. কর্তিত স্পার বা শৈলশিরা : উৎপত্তি: পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় হিমবাহ উপত্যকার দু-পাশের পর্বতশৃঙ্গের পাদদেশীয় বা প্রসারিত অংশগুলিকে ক্ষয় করে এগিয়ে যেতে থাকে। এর ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত ও প্রসারিত পার্বত্য অংশগুলি ত্রিভুজাকৃতির যে শৈলশিরার সৃষ্টি করে, সেগুলিকে বলে কর্তিত স্পার বা শৈলশিরা।
2. হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।
হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
উত্তর – হিমবাহের সঞ্চয়কার্যকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা—[1] পর্বতের উপরিভাগে সঞ্চয় এবং [2] পর্বতের পাদদেশে সঞ্চয় বা হিমবাহ ও জলধারার মিলিত সঞ্চয়। এর ফলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ গঠিত হয়। যেমন—
1. পর্বতের উপরিভাগে সঞ্চয়
(1) গ্রাবরেখা: উৎপত্তি: পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষয়জাত পদার্থগুলি ওই হিমবাহের সঙ্গে বাহিত হয়ে উপত্যকার বিভিন্ন অংশে সঞ্চিত হয়। সঞ্চিত এইসব পদার্থ গ্রাবরেখা বা মোরেন নামে পরিচিত। শ্রেণিবিভাগ: অবস্থানের পার্থক্য অনুসারে বিভিন্ন প্রকার গ্রাবরেখা দেখতে পাওয়া যায়, যেমন—[a] পার্শ্ব গ্রাবরেখা: হিমবাহের প্রবাহপথের দু-পাশে হিমবাহের সাথে বাহিত পদার্থসমূহ সঞ্চিত হলে, তাকে বলে পার্শ্ব গ্রাবরেখা। [b] প্রাপ্ত গ্রাবরেখা: হিমবাহের প্রবাহপথের শেষপ্রান্তে ওইসব পদার্থ সঞ্চিত হলে, তাকে বলে প্রান্ত গ্রাবরেখা। [c] মধ্য গ্রাবরেখা: দুটি হিমবাহ পাশাপাশি মিলিত হলে মাঝখানে সৃষ্টি হয় মধ্য গ্রাবরেখা। [d] ভূমি গ্রাবরেখা: হিমবাহের তলদেশে গ্রাবরেখা সঞ্চিত হলে তাকে ভূমি গ্রাবরেখা বলে ।
আকৃতি ও প্রকৃতি অনুসারে গ্রাবরেখা চার ভাগে বিভক্ত, যেমন—[a] অবিন্যস্ত গ্রাবরেখা: হিমবাহের সামনে ইতস্তত বা বিক্ষিপ্তভাবে গ্রাবরেখা গড়ে উঠলে অবিন্যস্ত গ্রাবরেখার সৃষ্টি হয়। [b] বলয়ধর্মী গ্রাবরেখা: গ্রাবরেখা বলয়াকারে সৃষ্টি হলে তাকে বলয়ধর্মী গ্রাবরেখা বলে। [c] রোজেন গ্রাবরেখা: একটির ওপর একটি গ্রাবরেখা থাকলে রোজেন গ্রাবরেখার সৃষ্টি হয়। [d] স্তরায়িত গ্রাবরেখা: হিমবাহ দ্বারা বাহিত পদার্থ সমুদ্র তলদেশে সঞ্চিত হলে স্তরায়িত গ্রাবরেখার সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ: পূর্ব হিমালয়ে জেমু হিমবাহের শেষ প্রান্তে তিস্তা নদীর উচ্চ অববাহিকায় বিভিন্ন গ্রাবরেখা আছে।
(2) আগামুক বা ইরাটিক: উৎপত্তি: হিমবাহের সঙ্গে বহুদূর থেকে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ড বাহিত হয়ে এসে কোনো স্থানে সঞ্চিত হলে যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তা আগামুক বা ইরাটিক নামে পরিচিত। বৈশিষ্ট্য: [a] আগামুক হিমবাহের সঞ্চয় কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ। [b] এর শিলাধর্মের সঙ্গে স্থানীয় শিলাধর্মের কোনো মিল থাকে না। [c] এগুলি কঠিন শিলায় গঠিত হয়। উদাহরণ: কাশ্মীরের পহেলগামের উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে আগামুক দেখতে পাওয়া যায়।
2. পর্বতের পাদদেশে সঞ্চয় বা হিমবাহ ও জলধারার মিলিত কাজের ফলে গঠিত ভূমিরূপ: পর্বতের পাদদেশে হিমবাহের প্রান্তসীমায় (অর্থাৎ হিমরেখার নীচে) হিমবাহ ও হিমবাহগলিত জলধারা মিলিতভাবে কিছু ভূমিরূপ গঠন করে, যেমন—
  1. বহিঃধৌত সমভূমি: উৎপত্তি: প্রান্ত গ্রাবরেখার শেষে বরফগলা জলপ্রবাহের মাধ্যমে হিমবাহবাহিত নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সঞ্চিত হলে যে সমভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে বলে বহিঃধৌত সমভূমি বা আউট-ওয়াশ প্লেন। বৈশিষ্ট্য: [a] বহিঃধৌত সমভূমি হিমবাহ ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ। [b] বহিঃধৌত সমভূমিতে অনেকসময় কোনো গর্তে হিমবাহগলা জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়। উদাহরণ: উত্তর আমেরিকার কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ হ্রদ অঞ্চলে এরূপ সমভূমি দেখা যায়।
  2. ড্রামলিন: উৎপত্তি: বহিঃধৌত সমভূমিতে বা তার কাছে হিমবাহ ও জলধারাবাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি এমনভাবে টিলার মতো সঞ্চিত হয় যে, সেগুলিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন উলটানো নৌকা বা চামচ উলটানো অবস্থায় আছে। এই ধরনের ভূমিরূপগুলি ড্রামলিন নামে পরিচিত। যেসব জায়গায় একসঙ্গে অনেক ড্রামলিন অবস্থান করে সেই জায়গাকে দূর থেকে ডিম ভরতি ঝুড়ির মতো দেখতে লাগে। এজন্য ড্রামলিন অধ্যুষিত অঞ্চলকে ডিমের ঝুড়ি ভূমিরূপ (Basket of Eggs Topography) বলা হয়। উদাহরণ: আয়াল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে এই ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়। বৈশিষ্ট্য: [a] ড্রামলিন হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ। [b] এগুলির উচ্চতা 6 মি থেকে 60 মি হয়। [c] এগুলি হিমবাহপ্রবাহের দিকে অমসৃণ ও খাড়াই এবং বিপরীত দিকে মসৃণ ও ঢালু হয়। উদাহরণ: সুইটজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতে এই ধরনের ভূভাগ দেখা যায়।
  3. কেম: উৎপত্তি: হিমবাহের শেষপ্রান্তে হিমবাহবাহিত শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি, কাদা প্রভৃতি পদার্থকে যখন হিমবাহগলিত জলধারা বহন করে নিয়ে গিয়ে কোনো বড়ো জলাভূমি বা হ্রদে সঞ্চয় করে ত্রিকোণাকার বা বদ্বীপের মতো ভূমিরূপ গড়ে তোলে, তখন তাকে বলা হয় কেম। বৈশিষ্ট্য: [a] কেম হিমবাহ ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে গড়ে ওঠা একটি ভূমিরূপ। [b] হিমবাহ উপত্যকার দু-পাশে কেম সৃষ্টি হলে তাকে কেম মঞ্চ বলে। উদাহরণ: ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের নরফেকের গ্লাভেন উপত্যকায় কেম ও কেম সোপান আছে।
  4. এসকার: উৎপত্তি: অনেক সময় হিমবাহবাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি হিমবাহগলিত জলধারার মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে পর্বতের পাদদেশে আঁকাবাঁকা শৈলশিরার মতো ভূমিরূপ গঠন করে। একে এসকার বলা হয়।
    বৈশিষ্ট্য: [a] এসকারগুলির উচ্চতা প্রায় 3 থেকে 5 মিটার হয়। [b] এগুলি আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ হয় এবং দৈর্ঘ্যে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। উদাহরণ: ফিনল্যান্ডের পুনকাহারয়ু এসকারের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

  5. কেল: উৎপত্তি: কোনো কোনো সময় বহিঃধৌত সমভূমিতে বিরাট বিরাট বরফের চাঁই নানা ধরনের অবক্ষেপের মধ্যে চাপা পড়ে থাকে। পরে যখন ওই বরফ গলে যায়, তখন সেখানে বেশ বড়ো গর্তের সৃষ্টি হয়। এই গর্তগুলিই কেল নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ওইসব গর্তে হিমবাহ গলিত জল জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় তাকে বলে কে হ্রদ। উদাহরণ: স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওকনি দ্বীপে কেল এবং কেট্ল হ্রদ আছে।
  6. নব: উৎপত্তি: হিমবাহবাহিত পাথর, নুড়ি, কাঁকর প্রভৃতি হিমবাহ গলিত জলধারার মাধ্যমে বহিঃধৌত সমভূমির ওপর ছোটো ছোটো টিলার আকারে সঞ্চিত হলে সেই টিলাগুলিকে নব বলে। উদাহরণ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হ্রদ অঞ্চলে বহু নব আছে।

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. হিমবাহ কী কী প্রক্রিয়ায় ক্ষয় করে?
উত্তর – হিমবাহের দ্বারা ক্ষয়ের প্রক্রিয়াসমূহ: হিমবাহ সাধারণত দুইভাবে ক্ষয় করে থাকে—
  1. উৎপাটন : প্রবহমান হিমবাহের চাপে উপত্যকার মেঝে, দেয়াল প্রভৃতি জায়গা থেকে পাথরখণ্ড খুলে এসে হিমবাহের দেহের বরফের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষয়কাজের এই প্রক্রিয়াকে বলে উৎপাটন বা প্লাকিং। এক্ষেত্রে তুষার আবহবিকারের বিশেষ গুরুত্ব আছে। কারণ হিমবাহের তলদেশে বা গায়ে জলের যে পাতলা আস্তরণ থাকে, তারই কিছু অংশ শিলার ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে জমে বরফ হয় এবং আয়তনে বেড়ে ফাটলের চারপাশের শিলাস্তরকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। এই ভাঙা শিলাস্তর চলমান হিমবাহের চাপে সহজেই খুলে আসে।
  2. অবঘর্ষ: চলমান হিমবাহের মধ্যে যেসব উৎপাটিত শিলাখণ্ড আবদ্ধ থাকে, সেগুলির সঙ্গে উপত্যকা গাত্র ও তলদেশের ঘর্ষণের ফলে শিলাস্তরের ক্ষয় হয়। ক্ষয়ের এই প্রক্রিয়ার নাম অবঘর্ষ। এই প্রক্রিয়ার ফলে উপত্যকা ক্ষয়ে প্রচুর পরিমাণে শিলাচূর্ণ সৃষ্টি হয়, কোথাও শিলাস্তরে আঁচড় কাটার মতো দাগ হয়, আবার কোথাও ব্দিশলাস্তর মসৃণ হয়।
2. হিমবাহের শ্রেণিবিভাগ করো। 
উত্তর – হিমবাহের শ্রেণিবিভাগ : অবস্থান অনুযায়ী হিমবাহ তিন রকমের হয়—
  1. মহাদেশীয় হিমবাহ: উচ্চভূমি-নিম্নভূমি নির্বিশেষে মহাদেশের বিস্তীর্ণ স্থান যখন বরফে ঢাকা থাকে, তখন তার নাম মহাদেশীয় হিমবাহ। অবস্থান: অ্যান্টার্কটিকা (প্রায় 85%) এবং গ্রিনল্যান্ডে এই ধরনের হিমবাহ রয়েছে। বর্তমানে দুই মেরু অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বরফক্ষেত্র মহাদেশীয় হিমবাহের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বরফের স্তূপ যেন চাদরের মতো (ice sheet) দুই মেরু অঞ্চলকে ঢেকে রেখেছে। বৈশিষ্ট্য: [a] এগুলি কেন্দ্র থেকে পাতের আকারে চারদিকে প্রসারিত এবং দেখতে অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো। [b] এই হিমবাহের প্রান্তদেশের বরফ খুব পাতলা হয়। [c] মহাদেশীয় হিমবাহ হিমসোপান সৃষ্টি করে। [d] মূলত কোয়াটারনারি ভূতাত্ত্বিক যুগে এই হিমবাহ সঞ্চিত হয়েছিল এমন ধারণা করা হয়। উদাহরণ: অ্যান্টার্কটিকার ল্যামবার্ট এবং গ্রিনল্যান্ড আইস শিট হল মহাদেশীয় হিমবাহের উদাহরণ।
  2. পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ: পর্বতের উঁচু অংশ থেকে হিমবাহ যখন নীচের দিকে ধীরে ধীরে নামতে থাকে, তখন তাকে পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ বলে। বৈশিষ্ট্য: [a] মনে করা হয় প্রাচীন তুষারযুগ থেকে এই বরফ সঞ্চিত হতে থাকে। [b] পার্বত্য হিমবাহ থেকেই মূলত নদীর সৃষ্টি হয়। [c] পার্বত্য হিমবাহ নানা ধরনের ফাটলযুক্ত হয়, অর্থাৎ এই হিমবাহেই বার্গশুন্ড ও ক্রেভাস থাকে। উদাহরণ: আলাস্কার হুবার্ড পৃথিবীর বৃহত্তম পার্বত্য হিমবাহ।
  3. পাদদেশীয় হিমবাহ: হিমবাহ যখন উৎস অঞ্চল থেকে পর্বতের নীচের দিকে নেমে এসে পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়, তখন তাকে পাদদেশীয় হিমবাহ বলে। সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশে তীব্র ঠান্ডার জন্য পর্বতের পাদদেশের উন্নতা হিমাঙ্কের নীচে থাকে। তাই অসংখ্য পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ পর্বতের পাদদেশে এসে মিলিত হয়ে পাদদেশীয় হিমবাহ সৃষ্টি করে। বৈশিষ্ট্য: [a] এগুলির আকার অপেক্ষাকৃত ছোটো হয়। [b] পাদদেশীয় হিমবাহের সামনে গোলাকার অংশকে লোব বা পাখা (fan) বলে। [c] উচ্চ অক্ষাংশে পর্বতের পাদদেশের সমতল অংশে দেখা যায়। [d] একাধিক উপত্যকা হিমবাহ পর্বতের পাদদেশে এসে পরস্পর মিলিত হয়ে গঠিত হয়। উদাহরণ: আলাস্কার মালাসপিনা পৃথিবীর বৃহত্তম পাদদেশীয় হিমবাহের।
3. ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত গঠিত হয় কেন?
উত্তর – ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত গঠিত হওয়ার কারণ: পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে প্রধান বা মূল হিমবাহ উপত্যকা এবং উপহিমবাহ উপত্যকার মধ্যে গভীরতার পার্থক্য হয়। একারণে উভয়ের মিলনস্থলে কম গভীরতাবিশিষ্ট উপহিমবাহ উপত্যকাটি মূল হিমবাহের উপত্যকার ওপর ঝুলন্ত উপত্যকা রূপে অবস্থান করে। পরবর্তীকালে, উপত্যকা দুটিতে হিমবাহ গলে গিয়ে নদী উৎপন্ন হলে, উচ্চতা ও ঢালের পার্থক্যের কারণে কম গভীরতাবিশিষ্ট উপহিমবাহ উপত্যকার নদীটি নীচে অবস্থিত প্রধান উপত্যকার ওপর প্রবলবেগে পতিত হয়। তাই ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। উদাহরণ: বদ্রীনাথের কাছে অবস্থিত বসুধারা জলপ্রপাত।
4. ক্রেভাস ও বার্গমুন্ড কীভাবে সৃষ্টি হয়?
উত্তর – ক্রেভাস সৃষ্টির পদ্ধতি: হিমবাহ যখন বন্ধুর পর্বতের গা বেয়ে বা করির মধ্য দিয়ে নীচের দিকে নামে, তখন ঢালের মুখে এলে হিমবাহের পৃষ্ঠদেশে যথেষ্ট টান পড়ার ফলে ওই অংশে লম্বালম্বিভাবে বা আড়াআড়িভাবে অনেক চিড় বা ফাটল সৃষ্টি হয়। হিমবাহ পৃষ্ঠদেশের ওই চিড় বা ফাটলগুলিই ক্রেভাস নামে পরিচিত। চলমান হিমবাহের সঙ্গে এগুলি কখনও লম্বালম্বিভাবে, আবার কখনও আড়াআড়িভাবে সৃষ্টি হয়।
বার্গমুক্ত সৃষ্টির পদ্ধতি: সাধারণত করির মস্তক দেশের দেয়ালটি খুব খাড়া থাকে। হিমবাহ যখন এই করির খাড়া ঢালের ওপর দিয়ে নীচের দিকে নামে তখন অনেকসময় হিমবাহের মস্তক এবং মস্তকের দিকের ওই খাড়াই পর্বতগাত্রের মাঝে যে গভীর উল্লম্ব ফাঁক বা ফাটল সৃষ্টি হয়, তা বার্গশ্রুন্ড নামে পরিচিত। এগুলির গভীরতা হয় গড়ে প্রায় 100 মিটার।
5. আদর্শ হিমবাহ সৃষ্টির পর্যায়গুলি আলোচনা করো।
উত্তর – আদর্শ হিমবাহ সৃষ্টির পর্যায়সমূহ: সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চল এবং শীতল মেরু অঞ্চলে তুষারপাত থেকে হিমবাহ সৃষ্টি হয় কয়েকটি পর্যায়ে। আদর্শ হিমবাহ সৃষ্টির পর্যায়গুলি হল—
  1. নেভে : সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলে পেঁজাতুলোর আকারে খুব হালকা তুষার বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। ভূমিতে স্তূপাকারে জমে থাকা সেই আলগা তুষারকণাগুলিকে বলা হয় নেভে।
  2. ফার্ন: তুষারপাত আরও বেশি হলে তুষারের চাপে নীচের ভূমিসংলগ্ন তুষারের বা নেভের ঘনত্ব বেড়ে তা ক্রমশ জমাট হতে থাকে, একে বলে ফার্ন।
  3. বরফ: এরপর আরও বেশি তুষার সঞ্চিত হলে ওপরের চাপে নীচের ফার্ন কঠিন বরফে পরিণত হয়।
  4. হিমবাহ: জমাট বাঁধা কঠিন বরফের স্তূপ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ধীরে ধীরে ভূমির ঢাল অনুসারে নিম্নভূমির দিকে নামতে থাকে এবং এইভাবে হিমবাহ তৈরি হয়।
6. আদর্শ হিমবাহ সৃষ্টির পদ্ধতিগুলি লেখো।
উত্তর – আদর্শ হিমবাহ সৃষ্টির পদ্ধতিসমূহ: কয়েকটি জটিল পদ্ধতির মাধ্যমে হিমবাহ গঠিত হয় । আদর্শ হিমবাহ সৃষ্টির পদ্ধতিগুলি হল—
  1. ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation): এই পদ্ধতিতে বরফ সরাসরি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়।
  2. পুনর্কেলাসীভবন (Recrystallization): ছোটো ছোটো কেলাস ভেঙে সম্মিলিত হয়ে বড়ো কেলাসে রূপান্তরিত হয়। এর মাধ্যমে তুষার থেকে বরফে পরিণত হয়।
  3. গলন (Melting): বরফ গলে জল এবং জলে জমে পুনরায় বরফে পরিণত হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই হিমবাহ গঠনের কাজ সম্পূর্ণ হতে থাকে।
  4. পুনঃশিলীভবন (Regelation): চাপের কারণে বরফ গলে জলে পরিণত হয় এবং চাপ হ্রাস পেয়ে আবার বরফ জমাট বাঁধে। এর ফলে বরফের অভ্যন্তরীণ গঠনের পরিবর্তন হয় যা হিমবাহ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
  5. সংবদ্ধতা (Compactness): অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে নীচের স্তর ওপরের স্তরের চাপে আরও সংঘবদ্ধ হয়ে কঠিন ও ঘন বরফের সৃষ্টি করে হিমবাহতে পরিণত হয়।
7. নদী উপত্যকা ‘T’ বা ‘V’ আকৃতির কিন্তু হিমবাহ উপত্যকা ‘U’ আকৃতির হয় কেন? 
উত্তর – নদী উপত্যকা ‘T’ বা ‘V’-আকৃতির কিন্তু হিমবাহ উপত্যকা ‘U’ আকৃতির হওয়ার কারণ: নদী উপত্যকার আকৃতি ‘I’ বা ‘V’-এর মতো হয়। কারণ পার্বত্য অংশে নদীর ঢাল খুব বেশি থাকে বলে নদী প্রবলবেগে নীচের দিকে নামতে থাকে। সেজন্য নদীর নিম্নক্ষয় পার্শ্বক্ষয়ের থেকে বেশি হয় এবং তার ফলে নদী উপত্যকা ‘I’ অক্ষরের মতো হয়। এরপর আবহবিকার, ধস, জলপ্রবাহ প্রভৃতি কারণে নদী উপত্যকায় পার্শ্বক্ষয় বাড়তে থাকে এবং তখন ‘I’ আকৃতির উপত্যকা ‘V’ আকৃতির উপত্যকায় পরিণত হয়। কিন্তু পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে হিমবাহ খুব ধীর গতিতে নামলেও জমাট বরফের স্তূপ হওয়ার জন্য হিমবাহ অত্যন্ত কঠিন ও ভারী । তাই এর ক্ষয়কার্যের ক্ষমতা যেমন বেশি তেমন প্রবাহিত হওয়ার সময় অবঘর্ষ এবং উৎপাটন প্রক্রিয়া দ্বারা উপত্যকায় সমান হারে নিম্নক্ষয় ও পার্শ্বক্ষয় করে। এর ফলে হিমবাহ উপত্যকা ‘U’ আকৃতির হয়ে যায়।
8. পৃথিবীর বৃহত্তম সুপেয় জলের সঞ্জয় হিসেবে হিমবাহের গুরুত্ব কতখানি?
উত্তর – পৃথিবীর বৃহত্তম সুপেয় জলের সঞ্চয় হিসেবে হিমবাহের গুরুত্ব: হিমবাহ কেবল একটি বরফের নদী নয়, সে যেমন ভূমিরূপের পরিবর্তন করে, তেমনই জলবায়ুর পরিবর্তনও করে। এসব বাদ দিয়েও বলা যায় হিমবাহ হল সুপেয় জলের জমাটবদ্ধ রূপ। পৃথিবীর মোট জলের (1) 97.20 শতাংশ লবণাক্ত সমুদ্রজল। এই জল পানের অযোগ্য। (2) বাকি 2.80 শতাংশ জল পানযোগ্য বা সুপেয়। এই জলের মাত্র 0.0001 ভাগ নদনদীতে, 0.9999 ভাগ ভৌমজল হিসেবে এবং বাকি 2.15 শতাংশ হিমবাহের মধ্যে বরফ হিসেবে জমে রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, পৃথিবীতে যত পানীয় জলের সঞ্চয় রয়েছে তার 77 ভাগই হিমবাহ হিসেবে জমাট বেঁধে রয়েছে। আর এই বরফের 90 শতাংশ রয়েছে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্র, সিন্ধু প্রভৃতি সব গুরুত্বপূর্ণ নদীই হিমবাহ থেকেই সৃষ্ট। সুতরাং পানীয় জলের সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই হিমবাহ সংরক্ষণে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
9. হিমরেখা সর্বত্র একই উচ্চতায় থাকে না কেন?
অথবা, হিমরেখার অবস্থান কীসের ওপর নির্ভর করে?
উত্তর – হিমরেখা সর্বত্র একই উচ্চতায় না থাকার কারণ: পর্বতের গায়ে বা ভূপৃষ্ঠে যে উচ্চতার ওপর সারাবছর তুষার জমে থাকে বা যে উচ্চতার নীচে তুষার গলে জল হয়ে যায়, উচ্চতার সেই সীমারেখার নাম হিমরেখা। এই হিমরেখার উচ্চতা নির্ভর করে—
  1. অক্ষাংশ: উচ্চ অক্ষাংশের তুলনায় নিম্ন অক্ষাংশে উন্নতা বেশি। তাই হিমরেখার উচ্চতাও উচ্চ অক্ষাংশে কম এবং নিম্ন অক্ষাংশে বেশি। উদাহরণ: মেরু অঞ্চলে হিমরেখার অবস্থান প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠ (0 মিটার) থেকে শুরু করে নাতিশীতোয় অঞ্চলে 2000-2500 মিটার, ক্রান্তীয় অঞ্চলে 4000-4500 মিটার এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রায় 5500 মিটার উচ্চতায় অবস্থান করে।
  2. ভূমির ঢাল: নিরক্ষরেখার বিপরীত দিকে ঢালু ভূমির তুলনায় সূর্যরশ্মি বেশি পড়ে বলে নিরক্ষরেখার দিকে ঢালু ভূমি বেশি উত্তপ্ত হয় এবং এজন্য হিমরেখার উচ্চতাও বেশি হয়। উদাহরণ: হিমালয়ের উত্তর ঢালের তুলনায় দক্ষিণ ঢালে অর্থাৎ নিরক্ষরেখামুখী ঢালে হিমরেখার উচ্চতা 1000 মিটারেরও বেশি হয়।
  3. ঋতুবৈচিত্র্য: ঋতু অনুসারে হিমরেখার অবস্থানে পার্থক্য হয়। গ্রীষ্মকালে হিমরেখা ওপরে উঠে যায়, আবার শীতকালে নেমে আসে। উদাহরণ: শীতকালে হিমালয়ের কোনো কোনো অংশে হিমরেখা প্রায় 3700 মিটার পর্যন্ত নেমে এলেও গ্রীষ্মকালে তা প্রায় 4800 মিটার পর্যন্ত ওপরে উঠে যায়। এজন্য হিমালয়ের হিমরেখার উচ্চতা 4800 মিটারধরা হয়।
  4. বায়ুপ্রবাহ: যেসব স্থানে উয় বায়ু প্রবাহিত হয় সেখানে হিমরেখার উচ্চতা বেশি হয়। আবার, পর্বতের একদিকে উঘ্ন বায়ু এবং অন্যদিকে শীতল বায়ু প্রবাহিত হলে উভয় দিকের মধ্যে হিমরেখার উচ্চতাতেও পার্থক্য হয়। উদাহরণ: রকি পর্বতের পূর্ব ঢালে উয় চিনুক বায়ুর প্রভাবে হিমরেখার উচ্চতা পশ্চিম ঢালের তুলনায় বেশি।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. হিমবাহ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলে বছরের পর বছর হিমরেখার ঊর্ধ্বে ভূপৃষ্ঠে জমা হতে থাকা তুষার এক সময় বিশাল বরফের চাঁইতে পরিণত হয় এবং মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূমির ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে থাকে। একেই বলা হয় হিমবাহ (glacier) বা বরফের নদী। উদাহরণ: গঙ্গার উৎপত্তি গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে এবং যমুনার উৎপত্তি যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে।
2. হিমরেখা কাকে বলে? 
উত্তর – সংজ্ঞা: যে কাল্পনিক সীমারেখার উপরে সারাবছর তুষার বা বরফ জমে থাকে এবং যে সীমারেখার নীচে তুষার গলে জলে পরিণত হয়, সেই সীমারেখাকে বলা হয় হিমরেখা। শ্রেণিবিভাগ: হিমরেখা দু-ভাগে বিভক্ত, যেমন— (1) স্থায়ী হিমরেখা এবং (2) অস্থায়ী হিমরেখা।
বৈশিষ্ট্য: হিমরেখার বৈশিষ্ট্যগুলি হল— (1) গ্রীষ্মকালে হিমরেখার উচ্চতা বাড়ে এবং শীতকালে কমে যায়। (2) নিরক্ষরেখা থেকে মেরুর দিকে হিমরেখার উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে।
উদাহরণ: হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে হিমরেখার গড় উচ্চতা স্থানবিশেষে প্রায় 4000 থেকে 5000 মিটার। তবে তীব্র ঠান্ডার কারণে মেরু অঞ্চলে হিমরেখা প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় পাওয়া যায়।
3. পার্বত্য হিমবাহ বা উপত্যকা হিমবাহ বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ধারণা : যেসব হিমবাহ সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেইসব হিমবাহ পার্বত্য হিমবাহ বা উপত্যকা হিমবাহ নামে পরিচিত।
উদাহরণ: হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অধিকাংশ এই শ্রেণির হিমবাহ, যেমন— কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ, সিকিম-দার্জিলিং হিমালয়ের জেমু হিমবাহ প্রভৃতি।
4. মহাদেশীয় হিমবাহ বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ধারণা : উচ্চভূমি-নিম্নভূমি নির্বিশেষে মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন বরফ ক্ষেত্র দ্বারা অথবা বরফের চাদর দ্বারা ঢাকা থাকে, তখন তাকে বলা হয় মহাদেশীয় হিমবাহ। উদাহরণ: অ্যান্টার্কটিকার ল্যামবার্ট পৃথিবীর বৃহত্তম মহাদেশীয় হিমবাহ।
5. পর্বতের পাদদেশীয় হিমবাহ বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা: হিমবাহ যখন পর্বতের পাদদেশে অবস্থান করে, তখন তাকে বলা হয় পর্বতের পাদদেশের হিমবাহ বা পাদদেশীয় হিমবাহ।
বৈশিষ্ট্য: (1) পাদদেশীয় হিমবাহ দেখতে বদ্বীপের মতো। (2) এই হিমবাহের অগ্রভাগ লোব নামে পরিচিত। উদাহরণ: আলাস্কার মালাসপিনা হিমবাহ।
6. হিমশৈল কী?
উত্তর – ধারণা: সমুদ্রে ভাসমান বিশালাকৃতি বরফের স্তূপকে হিমশৈল (iceberg) বলা হয়। ‘iceberg’ শব্দটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ বরফের পাহাড় বা শৈল।
বৈশিষ্ট্য: (1) সাধারণত মহাদেশীয় হিমবাহ থেকে বিশাল বরফের স্তূপ আলাদা হয়ে সংলগ্ন সমুদ্রে হিমশৈলরূপে ভেসে বেড়ায়। (2) হিমশৈলের কেবল 1/9 ভাগ জলের ওপর দেখা যায়। (3) হিমশৈলগুলি গলে গেলে তার মধ্যে থাকা নুড়ি, বালি, পাথর প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে মগ্নচড়ার সৃষ্টি হয়।
দৃষ্টান্ত: বিশ্ববিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক তার প্রথম সমুদ্রযাত্রাতেই এরকম একটি হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গভীর সমুদ্রে ডুবে যায়।
7. এসকার কী?
উত্তর – সংজ্ঞা : পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ এবং হিমবাহগলিত জলধারার মাধ্যমে সৃষ্ট আঁকাবাঁকা শৈলশিরার মতো স্বল্প উঁচু, শাখাপ্রশাখাযুক্ত ভূমিকে এসকার বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য: (1) এসকারগুলির উচ্চতা প্রায় 3 থেকে 5 মিটার পর্যন্ত হয়। (2) এগুলি আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ হয় এবং দৈর্ঘ্য কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হতে দেখা যায়। উদাহরণ: ফিনল্যান্ডের পুনকাহারয়ু এসকারের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
৪. হিমসিঁড়ি বা হিমধাপ বা হিমসোপান বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা : পার্বত্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে নামার সময় উপত্যকার বিভিন্ন অংশে শিলার গঠনগত তারতম্য থাকলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যেরও বৈষম্য ঘটে। এই বৈষম্যমূলক ক্ষয়ের ফলে উপত্যকায় অনেক ধাপের সৃষ্টি হয়, এগুলিকে বলে হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান।
বৈশিষ্ট্য: (1) অনেকসময় এরকম গভীর উপত্যকায় জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়। এই হ্রদগুলিকে প্যাটারনস্টার হ্রদ বলে। (2) হিমদ্রোণিতে হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান দেখতে পাওয়া যায়।
উদাহরণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়োসেমিতি উপত্যকা।
9. ক্রেভাস এবং বার্গশ্রুন্ড পর্বতারোহীর কাছে বিপজ্জনক কেন?
উত্তর – ক্রেভাস এবং বার্গমুন্ড পর্বতারোহীর কাছে বিপজ্জনক হওয়ার কারণ: বার্গশ্রুন্ড এবং ক্রেভাস উভয়েই বরফের ওপর সৃষ্ট ফাটল। এর মধ্যে ক্রেভাস অপেক্ষা বার্গশ্রুন্ড অনেক বেশি গভীর ফাটল হওয়ায় তার নীচ পর্যন্ত দেখা যায় না। বছরের অধিকাংশ সময় তুষারপাত হয় বলে এই ক্রেভাস এবং বার্গমুন্ডের মুখগুলি হালকা তুষারে ঢাকা থাকে। তাই বাইরে থেকে বোঝাই যায় না ফাটল বা গহ্বরগুলি কোথায় আছে। এজন্য অনেক পর্বতারোহী ক্রেভাস ও বার্গশূন্ডের অবস্থান বুঝতে না পেরে এদের ওপর দিয়েই এগোতে থাকেন। তার ফলে হিমবাহের গভীর ফাটলের মধ্যে পড়ে তাঁদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।
10. পিরামিড চূড়া বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা: পার্বত্য হিমবাহের উৎসমুখে ক্ষয়কার্যের ফলে পর্বতগাত্রে যেসব করি বা সার্কের সৃষ্টি হয় সেগুলি দেখতে হাতল লাগানো ডেকচেয়ারের মতো হয়। একটি পর্বতের বিভিন্ন দিকে পাশাপাশি তিন-চারটি বিপরীতমুখী ‘করি বা সার্ক’ তৈরি হলে মাঝখানের তীক্ষ্ণ শিরাযুক্ত চূড়াটি খাড়া এবং পিরামিডের মতো দেখতে হয়। তাই এই ধরনের চূড়াকে পিরামিড চূড়া বা হর্ন বলা হয়।
উদাহরণ: আল্পস পর্বতের ম্যাটারহর্ন একটি বিখ্যাত পিরামিড চূড়া।
11. বোল্ডার ক্লে বা হিমকর্দ বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা : পার্বত্য হিমবাহ বা উপত্যকা. হিমবাহ পর্বতের পাদদেশে বা নিম্নভূমিতে সঞ্চয়কার্যের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ গড়ে তোলে এবং সেইসব ভূমিরূপকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন, হিমবাহ গলে যাওয়ার পর হিমবাহবাহিত বালি, কাদা ও পাথর একসঙ্গে সঞ্চিত হলে, তাকে বোল্ডার ক্লে বা হিমকর্দ বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য: (1) বোল্ডার ক্লে পর্বতের পাদদেশে বা নিম্নভূমিতে গঠিত হয়। (2) এটি হিমবাহের সঞ্চয়কাজের ফলে গঠিত ভূমিরূপ।
12. ড্রামলিন কী?
উত্তর – ধারণী: হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে অনেকসময় হিমবাহের শেষ প্রান্তে বরফগলা জলপ্রবাহের মাধ্যমে হিমবাহবাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি বরফগলা জলপ্রবাহের মাধ্যমে হিমবাহবাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি এমনভাবে টিলার মতো সঞ্চিত হয় যে, সেগুলিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন উলটানো নৌকা বা চামচ উলটানো অবস্থায় আছে। এই ধরনের ভূমিরূপগুলি ড্রামলিন নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য: (1) ড্রামলিন সঞ্চয়কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ। (2) এগুলির উচ্চতা 6মি থেকে 60 মি হয়। (3) এগুলি হিমবাহপ্রবাহের দিকে অমসৃণ ও খাড়াই এবং বিপরীত দিকে মসৃণ ও ঢালু হয়।
উদাহরণ: সুইটজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতে এই ধরনের ভূভাগ দেখা যায়।
13. আগামুক বা ইরাটিক কী?
উত্তর – ধারণা : হিমবাহের সঙ্গে বহুদূর থেকে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ড এসে কোনো স্থানে সঞ্চিত হয়ে যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তা আগামুক বা ইরাটিক নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য: (1) এটি হিমবাহের সঞ্চয় কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ। (2) এর শিলাধর্মের সঙ্গে স্থানীয় শিলাধর্মের কোনো মিল থাকে না। (3)এগুলি কঠিন শিলায় গঠিত হয়। উদাহরণ: কাশ্মীরের পহেলগামের উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে আগামুক দেখতে পাওয়া যায়।
14. আইস শেল্ফ বলতে কী বোঝ?
উত্তর – সংজ্ঞা: যে পুরু বরফের চাদর বা আস্তরণের একদিক ভূমিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত এবং বাকি অংশ সমুদ্রে ভাসমান থাকে, সেই বরফের আস্তরণকে আইস শেল্ফ (Ice Shelf) বলে। বৈশিষ্ট্য: আইস শেলফের সমুদ্র দিকের প্রান্ত খুব খাড়াই হয়। উদাহরণ: অ্যান্টার্কটিকার রস ও রনি আইস শেফ।
15. ‘ডিমের ঝুড়ি’ ভূমিরূপ কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা : হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে অনেকসময় হিমবাহের শেষ প্রান্তে বরফগলা জলপ্রবাহের মাধ্যমে হিমবাহবাহিত প্রস্তরখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি এমনভাবে টিলার মতো সঞ্চিত হয় যে সেগুলিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন উলটানো নৌকা বা চামচ উলটানো অবস্থায় আছে। এই ধরনের ভূমিরূপগুলি ড্রামলিন নামে পরিচিত। যেসব জায়গায় একসঙ্গে অনেক ড্রামলিন অবস্থান করে সেই জায়গাকে দূর থেকে ডিম ভরতি ঝুড়ির মতো দেখতে লাগে। এজন্য ড্রামলিন অধ্যুষিত অঞ্চলকে ডিমের ঝুড়ি ভূমিরূপ ( Basket of Eggs Topography) বলা হয়। উদাহরণ: আয়াল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে এই ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়।
16. বরফ-আস্তরণ বা আইস শিট (Ice Sheet) কী ?
উত্তর – পরিচিতি: মহাদেশীয় হিমবাহের আর-এক নাম বরফ-আস্তরণ বা আইস শিট (ice sheet)। কারণ: উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বরফের স্তূপ বা বরফক্ষেত্র আছে। যেহেতু বরফের এই স্তূপ পাত বা চাদর (sheet) -এর মতো দুই মেরু অঞ্চল, বিশেষত উত্তর মেরুসংলগ্ন গ্রিনল্যান্ড এবং দক্ষিণ মেরুসংলগ্ন অ্যান্টার্কটিকাকে আবৃত করে রেখেছে, তাই তাকে বরফ-আস্তরণ বলা হয়ে থাকে।
17. U-আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা: সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ যে উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় সেখানে হিমবাহের পার্শ্বক্ষয় ও নিম্নক্ষয় সমানভাবে হয় বলে ওই উপত্যকাটির আকৃতি ইংরেজি অক্ষর ‘U’-এর মতো দেখতে হয়। তাই একে U-আকৃতির উপত্যকা বলা হয়। এই U আকৃতির উপত্যকাটিই হিমদ্রোণি নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য: (1) অনেকসময় এরকম গভীর উপত্যকায় জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়। এই হ্রদগুলিকে প্যাটারনস্টার হ্রদ বলে। (2) হিমদ্রোণিতে হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান দেখতে পাওয়া যায়।
উদাহরণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়োসেমিতি উপত্যকা।
18. ফিয়র্ড কী?
উত্তর – পরিচিতি: ফিয়র্ড (fiord) হল সমুদ্রোপকূলসংলগ্ন পার্বত্যভূমিতে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট হিমবাহ উপত্যকা। সমুদ্রোপকূলে হিমবাহ তার উপত্যকাকে এমন গভীরভাবে ক্ষয় করে যে সেই উপত্যকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকেও নীচু হয়ে যায়। এরপর হিমবাহ অপসারিত হলে সেই গভীর উপত্যকাগুলি সমুদ্রের জলে ভরে যায়। হিমবাহের ক্ষয়কার্যেরদ্বারা সৃষ্ট কিন্তু বর্তমানে সমুদ্রের জলে পূর্ণ এই ধরনের উপত্যকা ফিয়র্ড নামে পরিচিত।
উদাহরণ: নরওয়ে, সুইডেন এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা উপকূলে অনেক ফিয়র্ড দেখা যায় । এর মধ্যে নরওয়ের সোগনে বা সোজনে বা সোভনে পৃথিবীর গভীরতম ফিয়র্ড।
19. করি বা সার্ক কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়কার্যের কারণে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে সার্ক বা করি সৃষ্টি হয়। হিমবাহ যখন উঁচু পার্বত্য অঞ্চল থেকে নীচের দিকে নামে,
তখন একই সঙ্গে হিমবাহের অবঘর্ষ ও উৎপাটন প্রক্রিয়ার দরুন পর্বতের ঢালের পিছন দিকে খাড়া দেয়াল, মধ্যভাগে অর্ধবৃত্তাকার গহ্বর এবং সামনে স্কটল্যান্ডের স্থানীয় ভাষায় একে করি এবং ফ্রান্সে সার্ক বলা হয়। ধাপসমন্বিত হাতল লাগানো ডেকচেয়ারের মতো ভূভাগের সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ: অ্যান্টার্কটিকায় ওয়ালকট পৃথিবীর গভীরতম করি বা সার্ক।
20. এরিটি বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা : হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়ের ফলে একই পর্বতশৃঙ্গের দুই দিকে দুটি করির সৃষ্টি হলে ও তাদের আয়তন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে মধ্যবর্তী সংকীর্ণ খাড়া শিরা বা তীক্ষ্ণ প্রাচীরের মতো অংশের সৃষ্টি হয়, যা অ্যারেট বা এরিটি নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য: (1) এরিটিগুলি প্রায় ছুরির ফলার মতো ধারালো হয়। (2) এগুলির কোনো অংশ যদি ভেঙে যায় তাহলে এক সার্ক থেকে অন্য সার্কে যাওয়ার ‘গিরিপথ’ সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ: হিমালয় এবং কারাকোরাম পর্বতে অনেক এরিটি দেখা যায়।
21. কেম বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – সংজ্ঞা : হিমবাহের শেষ প্রান্তে যদি কোনো বড়ো জলাভূমি বা হ্রদ থাকে, তাহলে তার মধ্যে হিমবাহবাহিত পাথর, নুড়ি, কাঁকর, কাদা প্রভৃতি স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়ে ত্রিকোণাকার বদ্বীপের মতো ভূমিরূপ গড়ে ওঠে। এই ভূমিরূপকে বলা হয় কেম।
বৈশিষ্ট্য: (1) কম হিমবাহ ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে গড়ে ওঠা একটি ভূমিরূপ। (2) হিমবাহ উপত্যকার দু-পাশে কেম সৃষ্টি হলে তাকে কেমমঞ্চ বলে।
উদাহরণ: ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের নরফেকের গ্লাভেন উপত্যকায় কেম ও কেমম দেখতে পাওয়া যায়।
22. প্যাটারনস্টার হ্রদ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ উপত্যকায় বা হিমদ্রোণিতে অসম ক্ষয়কার্যের ফলে উপত্যকার গায়ে বা নিম্ন অংশে অসংখ্য সিঁড়ি বা ধাপের সৃষ্টি হয়। যখন এই ধাপগুলির ভূমিতলের ঢাল উপত্যকার দিকে না হয়ে বিপরীত দিকে অর্থাৎ পর্বতগাত্রের দিকে হয়, তখন হিমবাহগলা জল ধাপ বেয়ে উপত্যকার মধ্যে না এসে সেই ধাপ বা সিঁড়িতেই জমে গিয়ে হ্রদের সৃষ্টি করে। এই ধরনের পুতির মালার মতো গ্রথিত ছোটো ছোটো হ্রদগুলিকে প্যাটারনস্টার হ্রদ বলা হয়।
23. নব ও কে কী ?
উত্তর – নব: হিমবাহের শেষ প্রান্তে হিমবাহবাহিত নুড়ি, শিলাখণ্ড প্রভৃতি বরফগলা জলপ্রবাহের সঙ্গে বাহিত হয়ে বহিঃধৌত সমভূমির ওপর টিলার আকারে অবস্থান করে। সেই টিলাগুলি নব নামে পরিচিত।
কেট্ল : কোনো কোনো সময় বহিঃধৌত সমভূমিতে বিরাট বিরাট বরফের চাঁই নানা ধরনের অবক্ষেপের মধ্যে চাপা পড়ে থাকে। পরে যখন ওই বরফ গলে যায় তখন সেখানে যেসব বড়ো বড়ো গর্ত বা গহ্বরের সৃষ্টি হয়, সেগুলি কেট্ল নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ওইসব গহ্বরে হিমবাহগলা জল জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয়, সেই হ্রদকে বলা হয় কেটল হ্রদ।
উদাহরণ: উত্তর ইউরোপের অনেক স্থানে নব ও কেটলের অবস্থান লক্ষ করা যায় এবং ওইসব অঞ্চলের ভূমিরূপকে নব ও কেট্ল সমন্বিত ভূমিরূপ বলা হয়।
24. হিমবাহের গতিবেগ কীরূপ?
উত্তর – হিমবাহের গতিবেগ: হিমবাহের গতি অত্যন্ত ধীর। ভূমির ঢাল, বরফের পরিমাণ, ঋতুগত পার্থক্য, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বরফের নমনীয় অবস্থা, এসবের ওপর হিমবাহের গতিবেগ নির্ভর করে। হিমবাহকে বরফের নদী বলা হলেও সে অতি ধীর গতিতে এগোতে থাকে। আল্পসের হিমবাহ প্রতিদিন গড়ে 5.5 সেমি এগিয়ে যায়। হিমালয়ের হিমবাহ প্রতিদিন 2.5-7.5 সেমি করে অগ্রসর হয়। তবে বিশ্বের দ্রুততম হিমবাহ জ্যাকবশাভনের গতিবেগ দিনে প্রায় 45 মিটার।
25. স্নাউট বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা : হিমবাহ যখন প্রবাহিত হয় তখন তার দুই পাশ অপেক্ষা মাঝখানের অংশ এগিয়ে যায়। কারণ, হিমবাহের মাঝখানের অংশ কেবল তলদেশ ঘর্ষণের জন্য বাধা পায়। অন্যদিকে, হিমবাহের দুই পাশ উপত্যকার পার্শ্ববর্তী অংশ এবং তলদেশ উভয়ের দ্বারাই বাধাপ্রাপ্ত হয়। এজন্য হিমবাহের মাঝখানের অংশ একটু এগিয়ে যায়। একে দেখতে অনেকটা জিভের মতো মনে হয়। একে স্নাউট (snout) বলে।
26. নেভে, ফার্ন ও বরফ কী?
উত্তর – তুষার থেকে হিমবাহে রূপান্তরিত হওয়ার তিনটি পর্যায় হল—যথাক্রমে নেভে, ফার্ন ও বরফ। নেভে: উচ্চ পার্বত্য ভূমিতে বা শীতপ্রধান অঞ্চলে ব্যাপক তুষারপাত হয়। সদ্যপতিত তুষার অনেকটা হালকা পেঁজাতুলোর মতো হয়, একে বলে নেভে। এর ঘনত্ব প্রতি ঘনসেমিতে 0.16-0.6 গ্রাম।
ফার্ন: নেভের ওপর আরও তুষারপাত হলে নীচের তুষারের ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে যে পদার্থের সৃষ্টি করে, তাকে বলে ফার্ন। ফার্নের দানাগুলির আকার 0.5-5 মিমি এবং ঘনত্ব প্রতি ঘনসেমিতে 0.4-0.9 গ্রাম হয়।
বরফ: ওপরের চাপে এই ফার্ন আরও জমাটবদ্ধ হলে তার ঘনত্ব বেড়ে প্রতি ঘনসেমিতে 0.9 গ্রামের বেশি হয়, তখন তাকে বরফ বলে। এই বরফই মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূমির ঢাল অনুসারে নীচের দিকে নেমে হিমবাহ সৃষ্টি করে।
27. ক্রেভাস বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ধারণা : হিমবাহ যখন বন্ধুর পর্বতের গা বেয়ে বা করির মধ্যে দিয়ে নীচের দিকে নামে, তখন ঢালের মুখে এলে হিমবাহের পৃষ্ঠদেশে যথেষ্ট টান পড়ার ফলে ওই অংশে লম্বালম্বিভাবে বা আড়াআড়িভাবে অনেক চিড় বা ফাটল সৃষ্টি হয়। হিমবাহ পৃষ্ঠদেশের ওই চিড় বা ফাটলগুলিকে বলে ক্রেভাস।
বৈশিষ্ট্য: (1) এইসব ফাটল অসংখ্য হয়। (2) এদের গভীরতা কম।
28. ভাব কী?
উত্তর – পরিচিতি: বহিঃবিধৌত সমভূমি অংশের সূক্ষ্ম বালি হ্রদের নীচে জমা হয়। ওই সব সূক্ষ্ম বালিরাশি ভার্ব (Varve) নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য: (1) ভার্বের মধ্যে গোলাকার দাগ থাকে। (2) আর ভার্বের মধ্যেকার দাগগুলি এক-একটা বছরকে চিহ্নিত করে।
29. হোয়েলব্যাক বা কুঁজ বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা : পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে কোনো কোনো স্থানে চারিদিকে মসৃণ ও খাড়া ঢালবিশিষ্ট ঢিবি দেখা যায়, একে হোয়েলব্যাক বা কুঁজ বলে।
উদাহরণ: স্কটল্যান্ডের হুয়া সাউন্ড অঞ্চলে কুঁজ দেখা যায়।
30. বার্গমুন্ড কী ?
উত্তর – সংজ্ঞা : করির মস্তক দেশের দেয়ালটি খুব খাড়া থাকে। হিমবাহ যখন এই করির খাড়া ঢালের ওপর দিয়ে নীচের দিকে নামে তখন অনেকসময় হিমবাহের মস্তক এবং মস্তকের দিকের ওই খাড়াই পর্বতগাত্রের মাঝে যে গভীর উল্লম্ব ফাঁক বা ফাটল সৃষ্টি হয়, তাকে বার্ণশুন্ড বলে। উৎপত্তি: সাধারণত করির অবতল অংশের মধ্যে দিয়ে নামার সময় নিম্নমুখী টানে চলমান হিমবাহের অংশ এবং মাথার দিকের খাড়া পর্বতগাত্রসংলগ্ন হিমবাহের স্থিতিশীল অংশের মধ্যে এই ফাঁক বা ফাটল তৈরি হয়।
বৈশিষ্ট্য: (1) এই ফাঁক বা ফাটল হিমবাহের পৃষ্ঠদেশ থেকে একেবারে তলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। (2) এগুলি খুব গভীর (গভীরতা গড়ে 100 মিটার) এবং ৪০ বা তারও বেশি খাড়া হয়।
31. ঝুলন্ত উপত্যকা কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: পার্বত্য অঞ্চলে প্রধান হিমবাহ উপত্যকার ওপর দুই পাশ থেকে এসে পড়া উপহিমবাহের উপত্যকাগুলিকে ঝুলন্ত উপত্যকা বলে।
উদাহরণ: বদ্রীনাথের কাছে ঋষিগঙ্গা উপত্যকা এরকম একটি ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে।
32. ঝুলন্ত উপত্যকা কীভাবে গঠিত হয় ?
উত্তর – ঝুলন্ত উপত্যকা গঠনের পদ্ধতি: ছোটো ছোটো নদী যেমন উপনদী হয়ে প্রধান নদীতে মেশে তেমন পার্বত্যভূমিতে অনেকসময় প্রধান হিমবাহের দু-পাশ থেকে ছোটো ছোটো হিমবাহ বা উপহিমবাহ এসে প্রধান হিমবাহে মিলিত হয়। প্রধান হিমবাহের ক্ষয়কার্য বেশি হয় বলে তার দ্বারা সৃষ্ট উপত্যকা উপহিমবাহসৃষ্ট উপত্যকার তুলনায় বেশি গভীর হয়। ফলে প্রধান হিমবাহের গভীর উপত্যকার সঙ্গে উপহিমবাহসৃষ্ট ওইসব অগভীর উপত্যকার অনেকটাই উল্লম্ব পার্থক্য হয়। এজন্য উপহিমবাহ যেখানে এসে প্রধান হিমবাহে মেশে, সেই মিলনস্থলে উপহিমবাহের উপত্যকা প্রধান হিমবাহ উপত্যকার ওপর আছে বলে মনে হয়। এভাবেই ঝুলন্ত উপত্যকা সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিমবাহ গলে নদী উৎপন্ন হলে ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়।
33. হিমযুগ বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা: হিমযুগ বলতে পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট ভূতাত্ত্বিক সময়কালকে বোঝানো হয়, যখন ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ অংশে গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালের দৈর্ঘ্য ও তীব্রতা অনেক ব্যাপক হয়। আর তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কারণে উন্নতা হিমাঙ্কের নীচে চলে যায় বলে সেসময়ে মহাদেশগুলির অধিকাংশ স্থান কঠিন বরফে ঢাকা পড়ে। প্রায় পৃথিবীজোড়া সেই বরফাবৃত পরিবেশকে হিমযুগ বলে।
উদাহরণ: এখন থেকে প্রায় 20 লক্ষ বছর আগে কোয়াটারনারি যুগের প্রথম ভাগে অর্থাৎ প্লাইস্টোসিন উপযুগে ভূপৃষ্ঠের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কঠিন বরফ তথা হিমবাহের নীচে ঢাকা পড়ে যায়, যাকে যথার্থই হিমযুগ বলা যায়। তারও আগে প্রায় 28 কোটি বছর আগে কার্বোনিফেরাস যুগের শেষের দিকে এরকমই হিমযুগের আবির্ভাব ঘটেছিল।
34. অন্তবর্তী হিমযুগ বা আন্তৰ্হিমযুগ বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ধারণা : পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো হিমযুগই একটানা বিরাজ করেনি। কারণ হিমযুগের মাঝে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার হেরফের হয়, অর্থাৎ তখন তাপমাত্রা বাড়ে। ফলে বরফের আবরণ কিছুটা সংকুচিত হয় এবং তারপর আবার তাপমাত্রা কমে। তখন বরফের আবরণ পুনরায় প্রসারিত হয়। এইভাবে দুটি হিমযুগের মাঝে যে উয় সময়কাল আসে, তাকে অন্তবর্তী হিমযুগ বা আন্তৰ্হিমযুগ বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য: এইসময় বরফের আবরণ সংকুচিত হয়ে মেরুর দিকে সরে যায়।
উদাহরণ: প্লাইস্টোসিন হিমযুগে এরকম চারবার অন্তর্বর্তী হিমযুগের আবির্ভাব ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়। বর্তমানে আমরা এরকমই একটি অন্তর্বর্তী হিমযুগ অতিক্রম করছি।
35. বরফ স্তম্ভ (Ice Pillars) এবং তুষার ধস (Ice Fall) কাকে বলে?
উত্তর – বরফ স্তম্ভ: বন্ধুর পর্বতের গা বেয়ে হিমবাহ যখন নীচের দিকে নামে তখন যদি ভূমির ঢাল খুব বেশি বেড়ে যায়, বিশেষত করি বা সার্কের প্রান্তভাগে, তাহলে সেখানকার তির্যক ও উল্লম্ব ক্রেভাসগুলি বিভিন্ন দিক থেকে পরস্পরকে ছেদ করে। এর ফলে সেখানে চারপাশে ফাটল বেষ্টিত উল্লম্ব বরফের চাঁই গঠিত হয়, যাকে বলা হয় বরফ স্তম্ভ।
তুষার ধস: ভূমির ঢাল হঠাৎ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেলে, অর্থাৎ খাড়াই ঢাল থাকলে সেখানে বরফ স্তম্ভ বা হিমবাহের কিছু অংশ মাধ্যাকর্ষণের টানে সশব্দে নীচে ধসে পড়ে। হিমবাহের এই ধসে পড়াকে বলে তুষার ধস। উদাহরণ: সুউচ্চ পশ্চিম হিমালয়ের হিমবাহ অধ্যুষিত স্থানসমূহে প্রায়শই এরূপ ঘটনা ঘটে।

বহু বিকল্পভিত্তিক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

1. হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে প্রান্ত গ্রাবরেখায় সৃষ্ট ত্রিকোণাকার ভূমিকে বলে—
(a) পলল ব্যজনী
(b) কেম
(c) কেটল
(d) ড্রামলিন
উত্তর – (b) কেম
2. পর্বতের গায়ে যে সীমারেখার নীচে বরফ গলে তা হল—
(a) হিমরেখা
(b) হিমবাহ
(c) হিমশৈল
(d) গ্রাবরেখা
উত্তর – (a) হিমরেখা
3. হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট নিমজ্জিত জলমগ্ন উপত্যকাকে বলে—
(a) রসে মতানে
(b) ঝুলন্ত উপত্যকা
(c) ফিয়র্ড
(d) ড্রামলিন
উত্তর – (c) ফিয়র্ড
4. বিশ্বের দীর্ঘতম মহদেশীয় হিমবাহ হল—
(a) হুবার্ট
(b) মালসপিনা
(c) ল্যামবার্ট
(d) বিয়াফো
উত্তর – (c) ল্যামবার্ট
5. হিমবাহের সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্ট পদার্থগুলিকে বলে—
(a) হিমরেখা
(b) গ্রাবরেখা
(c) গিরিখাত
(d) হিমদ্রোণি
উত্তর – (b) গ্রাবরেখা
6. হিমবাহ উপত্যকার আকৃতি হয় —
(a) I
(b) U
(c) V
(d) Y
উত্তর – (b) U
7. রসে মতানে যে ক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয়, তা হল —
(a) নদী ও বায়ু
(b) বাতাস
(c) নদী
(d) হিমবাহ
উত্তর – (d) হিমবাহ
৪. গ্রাবরেখায় তৈরি আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ উচ্চভূমিকে বলে—
(a) টিল
(b) ড্রামলিন
(c) এসকার
(d) বোল্ডার
উত্তর – (c) এসকার
9. হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে হিমবাহ উপত্যকায় যেসব অসমান ধাপের সৃষ্টি হয়, তাদের বলে —
(a) হিমসিঁড়ি
(b) প্রস্তরখাত
(c) রসে মতানে
(d) নদীমঞ
উত্তর – (a) হিমসিঁড়ি
10. পৃথিবীর বৃহত্তম পাদদেশীয় হিমবাহটি—
(a) আলাস্কা পর্বতে দেখা যায়
(b) গ্রেট ডিভাইডিং পর্বতে দেখা যায়
(c) ইলিয়াস পর্বতে দেখা যায়
(d) ভারখয়ানস্ক পর্বতের পাদদেশে দেখা যায়
উত্তর – (a) আলাস্কা পর্বতে দেখা যায়
11. হিমবাহের ক্ষয়ের ফলে গঠিত একটি ভূমিরূপ হল—
(a) কেটল
(b) রসে মতানে
(c) এসকার
(d) ড্রামলিন
উত্তর – (b) রসে মতানে
12. মহাদেশীয় হিমবাহ দেখা যায় –
(a) হিমালয় পর্বতে
(b) আল্পস পর্বতে
(c) আন্দিজ পর্বতে
(d) অ্যান্টার্কটিকায়
উত্তর – (d) অ্যান্টার্কটিকায়
13. মহাদেশীয় হিমবাহের মধ্যে বরফমুক্ত উচ্চভূমির চূড়াকে বলে—
(a) স্নাউট
(b) লোব
(c) এরিটি
(d) নুনাটাকস
উত্তর – (d) নুনাটাকস
14. ভারতের বৃহত্তম ও দীর্ঘতম হিমবাহ —
(a) গঙ্গোত্রী
(b) সিয়াচেন
(c) হুবার্ড
(d) যমুনোত্রী
উত্তর – (b) সিয়াচেন
15. দুটি সার্কের সংযোগস্থল বরাবর গঠিত হয়—
(a) রসে মতানে
(b) এরিটি
(c) পিরামিড চূড়া
(d) এসকার
উত্তর – (b) এরিটি
16. একটি পিরামিড চূড়া—
(a) আল্পসের মঁ ব্লা
(b) ম্যাটারহর্ন
(c) মাকালু
(d) কাঞ্চনজঙ্ঘা
উত্তর – (b) ম্যাটারহর্ন
17. পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পার্বত্য হিমবাহটি হল—
(a) হুবার্ড
(b) সিয়াচেন
(c) মেসার্ভ
(d) কোয়ারেক
উত্তর – (a) হুবার্ড
18. হিমবাহ দ্বারা আবৃত পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশ হল –
(a) 10%
(b) 20%
(c) 15%
(d) 5%
উত্তর – (a) 10%
19. সমুদ্রে ভাসমান বিশাল হিমবাহকে বলে—
(a) হিমস্তূপ
(b) হিমশৈল
(c) হিমপ্রাচীর
(d) হিমপর্বত
উত্তর – (b) হিমশৈল
20. পার্বত্য হিমবাহের পৃষ্ঠদেশে সৃষ্ট গভীর ফাটলগুলিকে বলে—
(a) নুনাটাকস
(b) ক্রেভাস
(c) অ্যারেট
(d) সার্ক
উত্তর – (b) ক্রেভাস
21. করি নামক ভূমিরূপটিকে ফরাসি ভাষায় বলে—
(a) এরিটি
(b) সার্ক
(c) ফিয়র্ড
(d) গ্রাবরেখা
উত্তর – (b) সার্ক
22. Basket of egg topography গঠন করে —
(a) এসকার
(b) গ্রাবরেখা
(c) ড্রামলিন
(d) বহিঃধৌত সমভূমি
উত্তর – (c) ড্রামলিন
23. হিমবাহ দ্বারা পর্বতের পাদদেশে সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ হল –
(a) ফিয়র্ড
(b) গ্রাবরেখা
(c) রসে মতানে
(d) এসকার
উত্তর – (d) এসকার

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. পর্বতের দুই পাশে দুটি ……….. তৈরি হলে মধ্যবর্তী অংশে সংকীর্ণ, খাড়া ছুরির ফলার মতো এরিটি বা অ্যারেৎ গড়ে ওঠে।
উত্তর – করি বা সার্ক
2. হিমবাহবাহিত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে যে স্বল্প উঁচু আঁকাবাঁকা ……… গঠিত হয়, তাকে বলে এসকার।
উত্তর – শৈলশিরা
3. পৃথিবীর দীর্ঘতম ও বৃহত্তম হিমবাহ অ্যান্টার্কটিকার ……….।
উত্তর – ল্যামবার্ট
4. পৃথিবীর দীর্ঘতম উপত্যকা হিমবাহ ……….।
উত্তর – হুবার্ড
5. পাদদেশীয় হিমবাহের অগ্রভাগটিকে ………. বলে।
উত্তর – লোব
6. বিস্তীর্ণ তুষারক্ষেত্রে তুষারবিহীন শৃঙ্গগুলিকে ………. বলে।
উত্তর – নুনাটাকস
7. হিমবাহ জিভের মতো এগিয়ে গেলে, তাকে ………. বলে।
উত্তর – স্কাউট
৪. হিমবাহ ও জলধারাবাহিত নুড়ি, বালি, কাঁকর ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে দীর্ঘ সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা শৈলশিরার মতো ভূমিরূপকে ………. বলে।
উত্তর – এসকার
9. ‘U’ আকৃতির হিমবাহ উপত্যকাকে ………. বলে।
উত্তর – হিমদ্রোণি
10. রসে মতানের অমসৃণ ঢালটি ……… পদ্ধতিতে সৃষ্টি হয়।
উত্তর – উৎপাটন
11. এরিটি গঠিত হয় ………. প্রক্রিয়ার দ্বারা।
উত্তর – অবঘর্ষ
12. ঝুলন্ত উপত্যকার মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে ………. সৃষ্টি হয়।
উত্তর – জলপ্রপাত
13. ড্রামলিন দেখতে অনেকটা ………. মতো।
উত্তর – ওলটানো নৌকা
14. ফিনল্যান্ডের ‘পুনকাহারয়ু’ একটি বিখ্যাত ………।
উত্তর – এসকার
15. সঞ্চয়কার্যের ফলে হিমবাহের তলায় ………. গ্রাবরেখা তৈরি হয়।
উত্তর – ভূমি
16. এসকার হিমবাহের ………. কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ।
উত্তর – সঞ্চয়
17. হিমবাহ পৃষ্ঠে আড়াআড়ি ও সমান্তরাল ফাটলগুলিকে ……… বলে।
উত্তর – ক্রেভাস
18. সিয়াচেন হিমবাহটি ……….. পর্বতে অবস্থিত।
উত্তর – কারাকোরাম
19. গ্রাবরেখা হিমবাহের ……….. কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ।
উত্তর – সঞ্চয়

TOPIC – বায়ুর বিভিন্ন কাজ দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ

একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি

  1. বায়ুর কাজ: মরু অঞ্চল এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ুর কাজ বেশি লক্ষ করা যায়।
  2. গুরুত্বপূর্ণ মরুভূমিসমূহঃ অবস্থান অনুসারে মরু অঞ্চলকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়– (1) নিম্ন অক্ষাংশের উষু মরু অঞ্চল: ভূপৃষ্ঠে উভয় গোলার্ধে সাধারণত 0°-30° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত মরুভূমিগুলিকে নিম্ন অক্ষাংশের উষু মরু অঞ্চল বলা হয়। যেমন— এশিয়ার আরবীয় মরুভূমি ও ভারত-পাকিস্তানের থর মরুভূমি, আফ্রিকার সাহারা, কালাহারি ও নামিব মরুভূমি, উত্তর আমেরিকার সোনোরান ও মোজাভি মরুভূমি, দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা মরুভূমি, অস্ট্রেলিয়ার বৃহৎ অস্ট্রেলীয় মরুভূমি প্রভৃতি। (2) মধ্য অক্ষাংশের মরুভূমি: ভূপৃষ্ঠে উভয় গোলার্ধে প্রধানত 30°-50° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত মরুভূমিগুলিকে মধ্য অক্ষাংশের মরুভূমি বলা হয়। যেমন—দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়া মরুভূমি, মধ্য এশিয়ার গোবি ও তাকলামাকান মরুভূমি প্রভৃতি।
  3. মরু অঞ্চলে ও উপকূল অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহের অধিক সক্রিয়তার কারণ: বিস্তৃত মরু অঞ্চল বৃষ্টিহীন ও উদ্ভিদহীন বলে বায়ু বাধাহীনভাবে প্রবাহিত হতে পারে। আর উন্মুক্ত সমুদ্র সম্মুখে থাকে বলে উপকূল অঞ্চলে সারাবছরই বায়ু প্রবলবেগে প্রবাহিত হয়।
  4. বালিকণা সৃষ্টি: মরুভূমিতে যান্ত্রিক আবহবিকারের জন্য শিলাসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কালক্রমে বালিতে পরিণত হয়। আর উপকূলে যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকারের জন্য বালিকণা সৃষ্টি হয়।
  5. মরুভূমির প্রসারণ : ইদানীং বিশ্বজুড়ে মরুভূমির আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যাকে মরু সম্প্রসারণ বলা হয়।
  6. মরু প্রসারণ প্রতিরোধের উপায় : (1) মরুভূমির প্রান্তে খরাসহনশীল গাছ লাগানো, (2) পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ, (3) কষ্টসহিয়ু বা খরা-প্রতিরোধী ফসলের চাষ, (4) গাছ ও ঝোপঝাড়ের সাহায্যে বায়ু বাঁধ বা উইন্ড ব্রেকার নির্মাণ, (5) বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, জ্বালানি কাঠের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির মাধ্যমে মরুভূমির প্রসারণ প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়।

দীর্ঘ উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের চিত্র-সহ বর্ণনা দাও।
অথবা, বায়ুর ক্ষয়কার্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপসমূহ
উত্তর – বায়ুর ক্ষয়কার্যের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় শুষ্ক মরু অঞ্চলে। এই অঞ্চলে বায়ু প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে ক্ষয়কার্য করে, এগুলি হল—
1. অবঘর্ষ, 2. অপসারণ ও 3. ঘর্ষণ। এর ফলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, যেমন— (1) গৌর, (2) জিউগেন, (3) ইয়ারদাঙ, (4) ইনসেলবার্জ, (5) অপসারণ গর্ত প্রভৃতি।
  1. অবঘর্ষের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ: অবঘর্ষের ফলে মরু অঞ্চলে যে ভূমিরূপগুলির সৃষ্টি হয়, সেগুলি হল—
    1. গৌর: উৎপত্তি: মরু অঞ্চলে অবঘর্ষের জন্য বৃহদাকৃতির শিলাখণ্ডের নিম্নাংশ যত বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ঊর্ধ্বাংশ ততটা হয় না। এ ছাড়া, কঠিন ও কোমল শিলাস্তরে এই ধরনের বৃহদায়তন শিলাখণ্ড গঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোমল শিলা গঠিত অংশটি যদি নীচের দিকে থাকে, তাহলে বায়ুর অবঘর্ষের ফলে নীচের অংশটি খুব বেশি ক্ষয়ে যায় এবং ওপরের অংশটি কম ক্ষয় পেয়ে সমগ্র শিলাখণ্ডটি ব্যাঙের ছাতার মতো আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে যায়। এই ধরনের শিলাখণ্ডকে গৌর বা গারা বা ব্যাঙের ছাতার মতো শিলাস্তূপ বলা হয় । বৈশিষ্ট্য: [a] এগুলি দেখতে ব্যাঙের ছাতার মতো হয় বলে এগুলিকে Mushroom Rock বলে। [b] মরুভূমির মাঝে অবশিষ্ট টিলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়৷ উদাহরণ: সাহারা মরুভূমিতে গৌর আকৃতির অনেক শিলাস্তূপ দেখা যায়।
    2. জিউগেন: উৎপত্তি: মরুভূমির যেসব স্থানে আড়াআড়িভাবে বা অনুভূমিকভাবে ওপরের স্তরে ফাটলযুক্ত কঠিন শিলা এবং নীচের স্তরে কোমল শিলা থাকে, সেখানে বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে কোমল শিলাস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খাতের আকার ধারণ করে। অন্যদিকে, কঠিন শিলাগঠিত অংশ কম ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় চ্যাপটা ও সমতল শীর্ষদেশবিশিষ্ট পরস্পর সমান্তরাল টিলার আকারে অবস্থান করে। এইভাবে দুটি খাতের মধ্যে চ্যাপটা শীর্ষদেশ বিশিষ্ট টিলার ন্যায় ভূমিরূপকে জিউগেন বলা হয়। বৈশিষ্ট্য: [a] জিউগেন 3-30 মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। [b] এদের উপারিভাগ চ্যাপটা ও সমতল হয়। উদাহরণ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সোনোরান মরু অঞ্চলে এই ভূমিরূপ দেখা যায়।
    3. ইয়ারদাং: উৎপত্তি: কঠিন ও কোমল শিলাস্তর ভূপৃষ্ঠে পাশাপাশি উল্লম্বভাবে অবস্থান করলে বায়ুর অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় কোমল শিলাস্তরগুলি তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়। এর ফলে কঠিন শিলাস্তরগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে বিচিত্র আকৃতির শৈলশিরার মতো খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, এদের বলা হয় ইয়ারদাং। বৈশিষ্ট্য: [a] ইয়ারদাঙের গড় উচ্চতা 6 মিটার। [b] এদের প্রস্থ 8-40 মিটার পর্যন্ত হয়। [c] ইয়ারদাংকে দেখতে মোরগের ঝুঁটির মতো হয় বলে একে Cock’s Comb Ridge বলে। [d] এদের শীর্ষদেশ সুচালো হয়। উদাহরণ: সৌদি আরবের মরু অঞ্চলে এই ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়৷
    4. ইনসেলবার্জ: উৎপত্তি: বায়ুপ্রবাহের ক্ষয়কাজের ফলে সমগ্র মরু, অঞ্চলের সাধারণ উচ্চতা কমে গিয়ে যখন প্রায় সমপ্রায়ভূমিতে পরিণত হয়, তখন তার মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে কঠিন শিলায় গঠিত অংশগুলি কোনোক্রমে ক্ষয়কার্য প্রতিরোধ করে অনুচ্চ ও পরস্পর সমান উচ্চতাবিশিষ্ট টিলার আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ধরনের ক্ষয়জাত পাহাড় বা টিলাকে বলা হয় ইনসেলবার্জ। বৈশিষ্ট্য: [a] ইনসেলবার্জ সাধারণত আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলায় (গ্র্যানাইট, নিস প্রভৃতি) গঠিত হয়। [b] এগুলির উচ্চতা সাধারণত 30-300 মিটার হয়। উদাহরণ: দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরু অঞ্চলে এবং অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে অনেক ইনসেলবার্জ দেখা যায়।
  2. অপসারণের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ : বায়ুর অপসারণের ফলে মরু অঞ্চলে সৃষ্টি হয় অপসারণ গর্ত।
    অপসারণ গর্ত: উৎপত্তি: প্রবল বায়ুপ্রবাহ মরুভূমির বালিকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। এর ফলে কখনো-কখনো বিশাল এলাকাজুড়ে বালি অপসারিত হয়ে অবনত স্থান বা খাদ বা গর্ত সৃষ্টি হয়। এরই নাম অপসারণ গর্ত।
    উদাহরণ: মিশরের কাতারা অবনত ভূমি। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম অপসারণ গর্ত। রাজস্থানের মরু অঞ্চলে এই ধরনের ছোটো বড়ো বিভিন্ন আকৃতির গর্তকে স্থানীয় ভাষায় ধান্দ বলে। এ ছাড়াও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের গর্তকে বাফেলো গর্ভ এবং মঙ্গোলিয়াতে প্যাংকিয়াং গর্ভ বলা হয়।
  3. ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ: প্রবলবেগে প্রবাহিত বায়ুর সঙ্গে যেসব শিলাখণ্ড থাকে, সেগুলি পরস্পর ঠোকাঠুকি ও ঘর্ষণে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ক্রমশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হতে হতে শেষে বালুকণায় পরিণত হয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শিলাচূর্ণ ও বালিকে একত্রে মিলেট সিড স্যান্ড বলে। এভাবে ঘর্ষণের মাধ্যমে মরু অঞ্চলে বালির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বায়ুর ক্ষয়কার্যের শেষ পর্যায় হল এই বালিকণা।
2. শুষ্ক অঞ্চলে বায়ু ও জলধারার মিলিত কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের চিত্র-সহ বিবরণ দাও।
শুষ্ক অঞ্চলে বায়ু ও জলাধারের মিলিত কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
উত্তর – মরুভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়। তবে যখন বৃষ্টিপাত হয়, একেবারে মুশলধারেই তার আবির্ভাব ঘটে। আর বৃষ্টিপাতের সেই জল ভূপৃষ্ঠের ঢাল বরাবর নেমে কিছু অনিত্যবহ জলধারাও সৃষ্টি করে। এজন্য মরু অঞ্চলে বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে কিছু ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়, যেমন—
  1. ওয়াদি: উৎপত্তি: আরবি শব্দ ‘ওয়াদি’-র অর্থ শুষ্ক উপত্যকা। মরু অঞ্চলের বালি ঢাকা ভূমিতে জল নিকাশের জন্য নদীনালা বিশেষ থাকে না বলে এক পশলা মুশলধারে বৃষ্টি হলেই বন্যা হয়ে যায়। বন্যা বা বৃষ্টির জল বেরোনোর জন্য তখন বালুকাভূমির ওপর অস্থায়ী নদী সৃষ্টি হয়। জল নেমে গেলে ওগুলি শুষ্ক খাত হিসেবে পড়ে থাকে। এই শুষ্ক নদীখাত-ই ওয়াদি নামে পরিচিত।
  2. পেডিমেন্ট: উৎপত্তি:বায়ুপ্রবাহ ও জলধারার মিলিত ক্ষয়কার্যে উচ্চভূমি বা ইনসেলবার্জের পাদদেশে যে প্রায় সমতল বা মৃদু ঢালবিশিষ্ট ভূমিভাগের সৃষ্টি হয়, তাকে বলে পেডিমেন্ট। বৈশিষ্ট্য: [i] এর ঢাল গড়ে 1° থেকে 10°-এর মধ্যে থাকে। [ii] পেডিমেন্টের ওপর ছোটো ছোটো শিলাখণ্ড, বালি, পলি ইত্যাদি থাকতে পারে। [iii] পেডিমেন্ট সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হতে পারে। [iv] পেডিমেন্টের নীচে থাকে বাজাদা। উদাহরণ:উত্তর আফ্রিকার অ্যাটলাস পর্বতের পাদদেশের কোনো কোনো অংশে বিস্তৃত পেডিমেন্ট আছে।
  3. বাজাদা: উৎপত্তি: পেডিমেন্টের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলধারার সঙ্গে আসা নুড়ি, কাঁকর, পলি, বালি প্রভৃতি ঢালের নিম্নাংশে অর্থাৎ পেডিমেন্টের পাদদেশে সঞ্চিত হয়ে ত্রিকোণাকার পলল ব্যজনী সৃষ্টি করে। এই ধরনের অনেকগুলি ভূমি পরস্পর যুক্ত হলে যে বড়ো আকারের পললভূমি গঠিত হয় তাকে বলে বাজাদা বা বাহাদা। বৈশিষ্ট্য: [i] পেডিমেন্টের সামনে গড়ে ওঠা বাজাদা সম্পূর্ণরূপে সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ। [ii] পেডিমেন্টের দিকে বাজাদার খাড়া অবতল ঢাল সৃষ্টি হলেও প্লায়ার কাছে ঢাল খুব কম বা একেবারে শূন্যও হতে পারে। উদাহরণ: সাহারা মরুভূমি-সহ প্রায় সব মরুভূমিতেই বাজাদা আছে।
  4. প্লায়া: উৎপত্তি: চারপাশের উচ্চভূমি থেকে আসা অনেকগুলি জলধারা মধ্যভাগের উপত্যকা বা নিম্নভূমিতে মিলিত হলে সেখানে লবণাক্ত জলের অগভীর হ্রদ সৃষ্টি হয়। বাজাদা পৃষ্ঠের ওপর গড়ে ওঠা এই মরুহ্রদের নাম প্লায়া। এগুলি সাধারণত অস্থায়ী প্রকৃতির হয় এবং এদের আয়তন বা ক্ষেত্রমান কয়েক বর্গমিটার থেকে কয়েক বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। মরু অঞ্চলে ক্ষয়কার্যের নিম্নসীমা বা শেষসীমা হল এই প্লায়া।
3. উদাহরণ ও চিত্র-সহ বায়ুর সঞ্চয়জাত ভূমিরূপগুলি বর্ণনা করো।
অথবা, বায়ুর সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।
বায়ুর সঞ্চয়জাত ভূমিরূপসমূহ
উত্তর – বায়ুর সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপগুলি হল—
বালিয়াড়ি
বালিপূর্ণ বায়ুর গতিপথে গাছপালা, বড়ো প্রস্তরখণ্ড, ঝোপঝাড় বা অন্য কোনোরকম বাধা থাকলে বায়ুবাহিত বালির কিছু অংশ সেখানে সঞ্চিত হয়ে ক্রমশ ঢিবির মতো উঁচু হয়ে যায়। স্তূপাকারে সঞ্চিত এই বালির ঢিপিগুলিকে বলা হয় বালিয়াড়ি।
উপবিভাগ: বিখ্যাত বিজ্ঞানী ব্যাগনল্ড বালিয়াড়িকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেন— (1) তির্যক বালিয়াড়ি এবং (2) অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি।
  1. তির্যক বালিয়াড়ি: যেসব বালিয়াড়ি বায়ুর গতির সঙ্গে আড়াআড়িভাবে গড়ে ওঠে, তাদের বলে তির্যক বালিয়াড়ি। এদের আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়—[i] বারখান, [ii] অ্যাকলে বালিয়াড়ি এবং [iii] রোর্ডস বালিয়াড়ি।
    1. বারখান: যেসব বালিয়াড়ি একেবারে অর্ধচন্দ্রের আকারে গড়ে ওঠে, সেই বালিয়াড়িগুলিকে বলে বারখান। উদাহরণ: সাহারা মরুভূমিতে অনেক বারখান দেখা যায়।
    2. অ্যাকলে বালিয়াড়ি: একাধিক বারখান পরপর পাশাপাশি গঠিত হওয়ার ফলে যে আঁকাবাঁকা ও সারিবদ্ধ শৈলশিরার মতো বালিয়াড়িশ্রেণির সৃষ্টি হয়, তাদের একত্রে অ্যাকলে বালিয়াড়ি বলা হয়। এই বালিয়াড়ির বাঁকের সামনের অংশকে লিংগুঅয়েড এবং পিছনের অংশকে বারখানয়েড বলে।
    3. রোর্ডস বালিয়াড়ি: যেসব তির্যক বালিয়াড়ি দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো সেই বালিয়াড়িগুলিকে বলে রোর্ডস বালিয়াড়ি। বিভিন্ন দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হলে বারখানগুলিই রোর্ডস বালিয়াড়িতে পরিণত হয়।
  2. অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি বা সিফ বালিয়াড়ি: যেসব বালিয়াড়ি বায়ুর গতিপথের সঙ্গে সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠে, সেইসব বালিয়াড়িকে বলা হয় অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি। এদের মধ্যে যেগুলি খুব দীর্ঘ কিন্তু সংকীর্ণ, একেবারে তরবারির মতো দেখতে, সেগুলিকে বলে সিফ বালিয়াড়ি। উদাহরণ: থর মরুভূমিতে সিফ দেখা যায়।
  3. অন্যান্য বালিয়াড়ি: উল্লিখিত প্রধান দুই বালিয়াড়ি ছাড়াও উৎপত্তি, আকার ও অবস্থান অনুসারে আরও কয়েক ধরনের বালিয়াড়ি মরুভূমিতে দেখা যায়। তবে এগুলি অপ্রধান বালিয়াড়ি, যেমন—
    1. মস্তক বালিয়াড়ি: ঝোপঝাড়, প্রস্তরখণ্ড প্রভৃতির যে দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়, সেই দিকেই বালিয়াড়ি সৃষ্টি হলে তাকে মস্তক বালিয়াড়ি বলে।
    2. পুচ্ছ বালিয়াড়ি: প্রস্তরখণ্ড, গাছপালা প্রভৃতির যে দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়, ঠিক তার বিপরীত দিকে সরু ল্যাজের মতো গড়ে ওঠা বালিয়াড়িকে বলে পুচ্ছ বালিয়াড়ি।
    3. পার্শ্বস্থ বালিয়াড়ি: প্রস্তরখণ্ড, ঝোপঝাড় প্রভৃতির উভয়দিকে বালিয়াড়ি সৃষ্টি হলে তাকে পার্শ্বস্থ বালিয়াড়ি বলে।
    4. অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি: মস্তক বালিয়াড়ির সামনে ঘূর্ণি বাতাসের প্রভাবে সৃষ্ট বালিয়াড়ি অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি নামে পরিচিত।
    5. নক্ষত্র বালিয়াড়ি: বিভিন্ন দিক থেকে আসা বাতাসের মাধ্যমে  প্রস্তরখণ্ড, গাছপালা প্রভৃতির বিভিন্ন দিকে বালিয়াড়ি সৃষ্টি হলে তাকে নক্ষত্র বা তারা বালিয়াড়ি বলে।
    6. অস্থায়ী বা চলমান বালিয়াড়ি: বেশিরভাগ বালিয়াড়িই বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে সরে যায়। এদের বলে অস্থায়ী বা চলমান বালিয়াড়ি। রাজস্থানের মরু অঞ্চলে এই চলমান বালিয়াড়িকে বলে থ্রিয়ান।
লোয়েস সমভূমি
উৎপত্তি: মরুভূমির বালুকামিশ্রিত হলুদ রঙের শিথিল অতিসূক্ষ্ম পলিকণা বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত উড়ে গিয়ে সঞ্চিত হয়। একে লোয়েস বলে। এভাবে বায়ুবাহিত সূক্ষ্ম বালুকণা ও পলিকণা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সেখানকার বিস্তৃত এলাকায় সঞ্চিত হয়ে যখন সমভূমি সৃষ্টি করে, তখন তাকে লোয়েস সমভূমি বলে। উদাহরণ: উত্তর চিনের হোয়াংহো নদীর উপত্যকায় এই লোয়েস সমভূমি দেখা যায়। মধ্য এশিয়ার গোবি মরুভূমি থেকে বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বালুকারাশি উড়ে এসে চিনের হোয়াংহো নদীর উপত্যকায় সঞ্চিত হয়ে এই সমভূমি গঠন করেছে।
4. মরু অঞ্চলে বায়ু কীভাবে কাজ করে?
মরু অঞ্চলে বায়ুর কাজের প্রক্রিয়া
উত্তর – মরু অঞ্চলে বায়ু তিন ভাবে কাজ করে, যেমন—
  1. ক্ষয়কার্য : বায়ুর ক্ষয়কার্যের প্রক্রিয়াগুলি হল—
    1. অবঘর্ষ: মরু অঞ্চলে প্রবাহিত বায়ুতে বিভিন্ন মাপের শিলাচূর্ণ, বালি ও শক্ত কোয়ার্টজ কণা থাকে। এর ফলে বায়ুবাহিত এইসব পদার্থের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরের ঘর্ষণে শিলাস্তরের গায়ে কোথাও আঁচড় কাটার মতো দাগ, কোথাও বেশ গভীর দাগ, কোথাও অসংখ্য ছোটো ছোটো গর্ত তৈরি হয়। এই ধরনের ক্ষয়কেই বলা হয় অবঘর্ষ। অবঘর্ষের ফলে গৌর, ইনসেলবার্জ, ইয়ারদাং, জিউগেন, ভেন্টিফ্যাক্ট, ড্রেইকান্টার, পেডিমেন্ট প্রভৃতি ভূমিরূপ গড়ে ওঠে।
    2. অপসারণ: প্রবল বায়ুপ্রবাহ মরুভূমির বালুকাকে এক স্থান থেকে আর-এক স্থানে উড়িয়ে নিয়ে যায়। একে বলে অপসারণ। অপসারণের ফলে ধান্দ, মরূদ্যান, অবনত ভূমি প্রভৃতি ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।
    3. ঘর্ষণ: প্রবল বেগে প্রবাহিত বায়ুর সঙ্গে যেসব পাথরখণ্ডথাকে সেগুলি পরস্পরের সঙ্গে ঘর্ষণ ও ঠোকাঠুকিতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অবশেষে বালিকণায় পরিণত হয়; এই পদ্ধতিই ঘর্ষণ বলা হয়।
  2. বহনকার্য : মরু অঞ্চলে প্রবল বেগে প্রবাহিত বায়ু ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাচূর্ণ ও বালিকণাকে নিম্নলিখিত তিনটি প্রক্রিয়ায় বহন করে, যেমন—
    1. ভাসমান প্রক্রিয়া: সূক্ষ্ম বালুকণা হালকা বলে প্রবহমান বায়ুতে ভাসমান অবস্থায় বহুদূরে উড়ে যায়।
    2. লম্ফন প্রক্রিয়া: কিছুটা বড়ো বা মাঝারি আয়তনের পাথর ভারী বলে বার বার ভূমিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে এগিয়ে চলে।
    3. গড়ানো প্রক্রিয়া: বড়ো পাথরগুলি ভূমির ওপর দিয়ে প্রবলবেগে প্রবাহিত বায়ুর সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলে।
  3. সঞ্চয়কার্য: মরু অঞ্চলের বাতাসে প্রচুর পরিমাণে বালুকণা থাকে। কোনো ঝোপঝাড় বা উচ্চভূমি বা বড়ো পাথরখণ্ড বা অন্য কোনো কারণে ওই বাতাস বাধাপ্রাপ্ত হলে অথবা তার গতিবেগ হ্রাস পেলে বাতাসের মধ্যে থাকা বালুকণা সেখানে সঞ্চিত হতে থাকে এবং সঞ্চিত হতে হতে ক্রমশ ঢিবির মতো উঁচু হয়ে ওঠে। একেই বলে বায়ুর সঞ্চয়কাজ। বায়ুর সঞ্চয়কার্যের ফলে তির্যক বালিয়াড়ি (বারখান, অ্যাকলে বালিয়াড়ি, রোর্ডস বালিয়াড়ি), অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি বা সিফ বালিয়াড়ি, মস্তক বালিয়াড়ি, পুচ্ছ বালিয়াড়ি প্রভৃতি নানারকম বালিয়াড়ি এবং লোয়েস সমভূমি গঠিত হয়।
5. মরু অঞ্চলের প্রসারণ কেন ঘটছে? কীভাবে এর প্রতিকার করা সম্ভব ?
মরু অঞ্চলের প্রসারণের কারণ
উত্তর – বর্তমানে ভারতের থর বা আফ্রিকার সাহারা-সহ পৃথিবীর অধিকাংশ মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটে চলেছে, এর কারণগুলি হল—
  1. বালিপূর্ণ প্রবল বায়ুপ্রবাহ: মরুভূমি থেকে আগত বালিপূর্ণ বাতাসের মাধ্যমে সংলগ্ন এলাকাসমূহে বালি জমা হতে হতে ধীরে ধীরে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটে।
  2. অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণ : মরুভূমির প্রান্তভাগে স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকাসমূহে কিছু কিছু তৃণভূমি সৃষ্টি হয় । কৃষিকাজের অভাবে মরুভূমির অধিবাসীরা ওইসব তৃণভূমিতে পশুচারণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু অধিক সংখ্যায় পশুচারণের জন্য ওইসব তৃণভূমি দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে সেখানে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটে।
  3. বন নিধন: মরুভূমিসংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক হারে গাছপালা কাটলে মরুভূমির বিস্তার দ্রুত হয়।
  4. অবৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষিকাজ : মরুভূমির আশেপাশে কোনো কোনো স্থানে চাষাবাদ করার সুযোগ থাকলেও অবৈজ্ঞানিক প্রথায় ফসল উৎপাদনের জন্য জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে ওইসব স্থানে মরুভূমি বিস্তার লাভ করে।
  5. খরার প্রাদুর্ভাব : পরপর কয়েক বছর খরা হলে সেখানে মাটির আর্দ্রতা এতটাই হ্রাস পায় যে গাছপালা শুকিয়ে জায়গাটি ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয়।
  6. বিশ্ব উন্নায়ন : বর্তমানে বিশ্ব উয়ায়ন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অধিকাংশ মরুভূমির আশেপাশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন হ্রাস পেয়েছে তেমনই তাপমাত্রাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং এই অবস্থা মরুভূমির সম্প্রসারণে অনুকূলে প্রভাব ফেলেছে।
এ ছাড়া অবৈজ্ঞানিক প্রথায় জলসেচ, মরু অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্যের কারণে ক্রমশ শিলাচূর্ণ ও বালুকণার পরিমাণ বৃদ্ধি প্রভৃতিও মরু সম্প্রসারণে সহায়তা করে।

মরুভূমির প্রসারণ প্রতিরোধের উপায়

মরুভূমির প্রসারণ কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব। মরুভূমির প্রসারণ রোধ করার উপায়গুলি হল—
  1. বনসৃজন : মরুভূমির প্রান্ত বরাবর নিবিড়ভাবে বনভূমি গড়ে তুলতে হবে। গাছ মরু প্রসারণ রোধ করে। এমন উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে, যা মরু জলবায়ুর উপযুক্ত অর্থাৎ খরা সহনশীল।
  2. পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ: মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধে মাত্রাহীন পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  3. জ্বালানি কাঠের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: মরুভূমির উদ্ভিদসমূহকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আলাদাভাবে জ্বালানি কাঠের চাষ তথা উৎপাদন ছাড়াও বিকল্প জ্বালানির উৎসগুলি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
  4. বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ: মরুভূমিতে আধুনিক জলসেচ পদ্ধতির প্রয়োগ, জলের সঠিক ব্যবহার, খরা সহনশীল শস্যের উৎপাদন প্রভৃতির মাধ্যমে মরুভূমির বিস্তার রোধ করা সম্ভব।
  5. জল সংরক্ষণ : রেন ওয়াটার হারভেস্টিং এবং অধিক সংখ্যায় পুকুর খননের মাধ্যমে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও ভৌমজলকে রিচার্জ করা, জলের অপচয় বন্ধ করা, জলের বহুমুখী ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার বাড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে মরুভূমির প্রসার রোধ করা যায়।
  6. অন্যান্য: মরুভূমির প্রান্তে গাছ ও ঝোপঝাড়ের সাহায্যে বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী উইন্ডব্রেক গড়ে তোলা,
  7. স্যান্ড শিল্ড নির্মাণ,
  8. লবণ সহ্যকারী উদ্ভিদ রোপণ প্রভৃতির মাধ্যমে মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধ করা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাহারা মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধে এর দক্ষিণ সীমায় প্রায় ৪০০০ কিমি দীর্ঘ এবং প্রায় 15 কিমি প্রস্থ সমন্বিত সবুজ উদ্ভিদের একটি প্রাচীর গড়ে তোলা হচ্ছে যার নাম গ্রেট গ্রিন ওয়াল। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে সাহারার দক্ষিণমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ হবে বলে আশা করা যায়।

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. বারখান বালিয়াড়ির বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
উত্তর – বারখান বালিয়াড়ির বৈশিষ্ট্য:বায়ুর গতিপথে আড়াআড়িভাবে গড়ে ওঠা অর্ধচন্দ্রাকৃতি বালিয়াড়িকে বারখান বলা হয়। বারখানের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন—
  1. আকৃতি:বারখানের বায়ুমুখী ঢাল খাড়া হয় না, উত্তল আকৃতির হয়। কিন্তু বিপরীত দিকের ঢাল খুব খাড়া এবং অবতল আকৃতির হয়।
  2. শিঙের অবস্থান:বারখানের দুই পাশে দুটি শিঙের মতো শিরা আধখানা চাঁদের দুই প্রান্তের মতো বিস্তৃত হয়।
  3. উচ্চতা:বারখানের উচ্চতা সাধারণত 15 থেকে 30 মিটার পর্যন্ত হয়।
  4. বিস্তার:এক-একটি বারখান প্রায় 5 থেকে 200 মিটার পর্যন্ত স্থানজুড়ে অবস্থান করে।
  5. চলমান প্রকৃতির: সমতল জায়গায় একসঙ্গে অনেকগুলি বারখান পরপর গড়ে উঠতে পারে, তবে এগুলি সাধারণত অস্থায়ী বা চলমান বালিয়াড়ি হয়।
2. সিফ বালিয়াড়ির বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
উত্তর – সিফ বালিয়াড়ির বৈশিষ্ট্য: প্রবহমান বায়ুর গতিপথের সঙ্গে সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠা খুব দীর্ঘ কিন্তু সংকীর্ণ বালিয়াড়িকে বলা হয় সিফ। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
  1. বিস্তার ও উচ্চতা:সিফ বালিয়াড়ি 100 কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এর উচ্চতা 100 মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
  2. সমান্তরাল অবস্থান: অনেকসময় পরস্পর সমান্তরালভাবে অনেকগুলি সিফ বালিয়াড়ি গড়ে উঠতে দেখা যায়।
  3. শিঙের অবস্থান: কখনো কখনো প্রবল বায়ুপ্রবাহে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বালিয়াড়ি বা বারখানের মাঝের অংশ ক্ষয় হয়ে যায় এবং দুই পাশে শিঙের মতো শিরা দুটি ক্রমশ বড়ো হয়ে অনুদৈর্ঘ্য বা সিফ বালিয়াড়িরূপে সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠে।
  4. করিডোর: দুটি সিফ বালিয়াড়ির মধ্যবর্তী অংশকে করিডোর বলে। এর মধ্য দিয়ে বায়ু প্রবলবেগে সোজাসুজি প্রবাহিত হয়।
  5. আকৃতি:বালিয়াড়ির শীর্ষদেশ তীক্ষ্ণ করাত আকৃতির হয়।
3. মরু অঞ্চলে বায়ুর কার্যের প্রাধান্য লক্ষ করা যায় কেন?
উত্তর – মরু অঞ্চলে বায়ুর কার্যের প্রাধান্যের কারণ: মরু অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশে বায়ুর কার্যের প্রাধান্যলাভের প্রধান কারণগুলি হল—
  1. উয়তার প্রসর: মরু অঞ্চলে দৈনিক ও বার্ষিক উন্নতার প্রসর খুব বেশি হওয়ায় যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শিলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণায় পরিণত হয়। এই বালিকণাই হল বায়ুর কাজের প্রধান হাতিয়ার। বায়ু এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণাগুলি দিয়ে অবঘর্ষ ও ঘর্ষণ প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের শিলা যেমন ক্ষয় করে, তেমনই এগুলি উড়িয়ে নিয়ে অন্যত্র জমা করে ভূমিরূপ গঠন করে।
  2. উদ্ভিদের স্বল্পতা: মরু অঞ্চলে গাছপালা বিশেষ না থাকায় ভূমি সবসময় অনাবৃত থাকে। ফলে বায়ু বাধাহীনভাবে প্রবলবেগে বইতে পারে।
  3. বৃষ্টিপাতের অভাব: মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুব কম হওয়ার জন্য বায়ু এবং ভূমি উভয়ই যথেষ্ট শুষ্ক থাকে। ফলে বায়ুপ্রবাহ সহজেই ভূমি থেকে প্রচুর পরিমাণে বালুকণা তুলে নিতে পারে। প্রবলবেগে প্রবাহিত ওই বালুপূর্ণ বায়ুই ক্ষয়, বহন বা অপসারণ এবং অধঃক্ষেপণ বা সঞ্চয়কাজের মাধ্যমে মরু অঞ্চলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ গঠন করে।
4. লোয়েস ভূমি বা লোয়েস সমভূমি কী?
উত্তর – ধারণা: মরুভূমির খুব সূক্ষ্ম বালি মিশ্রিত পলিকণা বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে বহুদূর পর্যন্ত উড়ে গিয়ে সঞ্চিত হলে তাকে লোয়েস বলে। এগুলি সাধারণত পীত বা হলুদ রঙের হয়। অতি সূক্ষ্ম বালি ও পলিমিশ্রিত বায়ুপ্রবাহ জলাভূমি, উচ্চভূমি, গাছ প্রভৃতি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলে সেখানে অধঃক্ষিপ্ত হয়ে লোয়েস ভূমি গঠন করে। এভাবে বিস্তৃত এলাকায় লোয়েস সঞ্চিত হয়ে যখন সমভূমি গঠন করে তাকে লোয়েস সমভূমি বলে।
উদাহরণ: মধ্য এশিয়ার গোবি মরুভূমি থেকে হাজার হাজার বছর ধরে শীতের সময় মৌসুমি বায়ুর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বালিরাশি উত্তর চিনের হোয়াংহো নদী উপত্যকায় সঞ্চিত হয়ে লোয়েস সমভূমি গঠন করেছে। এর গভীরতা 30 থেকে 200 মিটার। একইভাবে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি থেকে সূক্ষ্ম বালি ও পলিকণা উড়ে এসে ইজরায়েলের দক্ষিণাংশে লোয়েস সমভূমি গঠন করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও কিছু লোয়েস ভূমি দেখা যায়, যেমন—ইউরোপের ফ্রান্সে, আমেরিক যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি-মিসৌরি নদী উপত্যকার কোনো কোনো স্থানে এবং ভারতের উত্তর গুজরাতে।
5. বায়ুর অপসারণের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলি কী কী?
উত্তর – বায়ুর অপসারণের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপসমূহ: প্রবল বায়ুপ্রবাহ মরুভূমির বালিকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে যায়—এর নাম অপসারণ। এর ফলে মরু অঞ্চলে বিভিন্ন ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। যেমন—
  1. ধান্দ: তীব্র বায়ুপ্রবাহে মরু অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ থেকে বালি অপসারিত হওয়ার ফলে ছোটো-বড়ো নানা আয়তনের গর্তের সৃষ্টি হয়। রাজস্থানের মরু অঞ্চলে এই ধরনের ছোটো-বড়ো বিভিন্ন আয়তনের গর্তগুলিকে বলা হয় ধান্দ।
  2. অপসারণসৃষ্ট গর্ত বা ব্লো আউট: অনেকসময় বায়ুর অপসারণ ক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠে সুবিশাল অবনত অঞ্চল বা গর্তের সৃষ্টি হয়। উদাহরণ: মিশরের কাতারা হল একটি অবনত ভূমি।
  3. মরুদ্যান: বিশাল অঞ্চলজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে বালি অপসারিত হতে হতে যদি অবনত অংশটির গভীরতা ভূগর্ভের জলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে সেখানে মরূদ্যান (oasis) গড়ে ওঠে। উদাহরণ: সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধ একটি বিশালাকৃতি মরূদ্যানের ওপর অবস্থিত।
6. ক্ষয়কার্যের প্রভাব কোথায় সর্বাপেক্ষা বেশি?
উত্তর – বায়ুর ক্ষয়কার্যের সর্বাধিক প্রভাব: পৃথিবীর যেসব এলাকায় উন্নতা খুবই বেশি এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 25 সেন্টিমিটারের কম সেইসব উয় মরু অঞ্চল বা মরুপ্রায় অঞ্চলে স্বাভাবিক উদ্ভিদ খুবই কম জন্মায়। ফলে ভূমি প্রায় অনাবৃত এবং চারপাশ উন্মুক্ত থাকে বলে বায়ু তীব্র গতিতে প্রবাহিত হয় ও ক্ষয়কার্য করে। তা ছাড়া, এইসব অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্যের জন্য স্বাভাবিকভাবে প্রচুর শিলাচূর্ণ, বালিকণা প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। এজন্য উয়-মরু অঞ্চল তথা শুষ্ক অঞ্চলেই বায়ুর ক্ষয়কার্যের প্রভাব সর্বাপেক্ষা বেশি হয়।
7. উপকূল অঞ্চলে বায়ুর কাজ বেশি কার্যকরী কেন?
উত্তর – উপকূল অঞ্চলে বায়ুর কাজ বেশি কার্যকরী হওয়ার কারণ: উপকূল অঞ্চলে বায়ুর কাজ বেশি কার্যকরী হওয়ার কারণগুলি হল—
  1. সমুদ্রতরঙ্গের ক্ষয়কাজ: সমুদ্রতরঙ্গের ক্ষয়কাজের ফলে তটভূমির শিলাসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বালিতে পরিণত হয়। এজন্য সৈকতভূমিতে প্রচুর পরিমাণ আলগা বালি থাকে এবং সৈকতভূমি গঠনের অন্যতম উপাদানই হল বালি।
  2. প্রবল বায়ুপ্রবাহ: উন্মুক্ত সমুদ্র সম্মুখে থাকে বলে উপকূল অঞ্চলে প্রায় সারাবছরই বায়ু বাধাহীনভাবে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়, যার মধ্যে থাকে তটভূমি থেকে সংগৃহীত বালি।
  3. বালিপূর্ণ বায়ু: উপকূল অঞ্চলের বালিপূর্ণ বায়ু সহজেই ক্ষয় ও সঞ্চয় বা অধঃক্ষেপণের মাধ্যমে উপকূলে নানা ধরনের ভূমিরূপ গড়ে তোলে। এ ছাড়া উপকূল অঞ্চলে 4 বড়ো গাছের অভাব, 5 জোয়ারভাটার সক্রিয়তা প্রভৃতিও বায়ুর কাজে প্রভাব বিস্তার করে। উদাহরণ—দিঘা ও কাঁথির উপকূল-সহ ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের বহু স্থানে বায়ুর কাজের বহু নিদর্শন আছে।
8. পৃথিবীর কোথায় কোথায় মরুভূমি দেখা যায়?
উত্তর – পৃথিবীতে মরুভূমির অবস্থান: পৃথিবীর মোট স্থলভাগের প্রায় 1/3 ভাগ বা 30 ভাগ মরুভূমির অন্তর্গত। এগুলি রয়েছে নিম্ন অক্ষাংশে বা ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এবং মধ্য অক্ষাংশে বা নাতিশীতোয় অঞ্চলে।
  1. নিম্ন অক্ষাংশের মরুভূমি: পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে প্রধানত 20°-30° অক্ষাংশের মধ্যে মহাদেশের পশ্চিমদিকে সবচেয়ে বেশি মরুভূমি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে—[i] আফ্রিকার সাহারা ও কালাহারি; [ii] এশিয়ার আরব মরুভূমি ও ভারত-পাকিস্তানের থর মরুভূমি; [iii] উত্তর আমেরিকার সোনেরান; [iv] দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা; [v] অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম অস্ট্রেলীয় মরুভূমি উল্লেখযোগ্য।
  2. মধ্য অক্ষাংশের মরুভূমি: [i] এশিয়ার গোবি, তাকলামাকান ও তুর্কিস্তানের মরুভূমি; [ii] উত্তর আমেরিকার মোহাভি ও কলোরাডো মরুভূমি এবং [iii] দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়া মরুভূমি প্রভৃতি মধ্য অক্ষাংশের উল্লেখযোগ্য মরুভূমি।
9. মরুভূমিতে ও উপকূল অঞ্চলে বালুকাকণা কীভাবে সৃষ্টি হয়?
উত্তর – মরুভূমিতে বালুকাকণা সৃষ্টির পদ্ধতি: মরুভূমি বলতে সাধারণভাবে বোঝায় দিগন্তবিস্তৃত বালি ঢাকা ভূমি। মরুভূমিতে এত বিপুল পরিমাণ বালি সৃষ্টির কারণগুলি হল—
  1. বৃষ্টিহীন শুষ্ক পরিবেশ: মরুভূমির প্রায় বৃষ্টিহীন শুষ্ক পরিবেশ, যার ফলে ওখানকার শিলাস্তর তথা ভূমি শুকনো খটখটে অবস্থায় থাকে।
  2. দিন ও রাতের মধ্যে উন্নতার অত্যধিক পার্থক্য: দিন ও রাতের মধ্যে উষ্ণতার পার্থক্য বেশি হওয়ার ফলে ওখানকার শিলাস্তরে ব্যাপকহারে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে। কারণ দিনের বেলা উন্নতা প্রায় 45°-50° সে বা তার বেশি উঠে গেলেও রাতে তা 8°-10° সে-এর কাছাকাছি নেমে আসে। এতে শিলার খনিজগুলি ক্রমাগত ভিন্ন ভিন্ন হারে প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। এর ফলে যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিলাসমূহ ক্রমান্বয়ে খণ্ডবিখণ্ড বা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে শেষে বালুকণায় পরিণত হয়।
  3. অবঘর্ষ ও ঘর্ষণ: চূর্ণবিচূর্ণ শিলাসমূহ বায়ুর মাধ্যমে বাহিত হওয়ার সময় পরস্পর ঠোকাঠুকি ও ঘর্ষণেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণায় পরিণত হয়।
  4. কোয়ার্টজ কণা সমৃদ্ধ শিলার উপস্থিতি: বেলেপাথর, গ্র্যানাইট, নিস প্রভৃতি শিলাখণ্ডগুলি ভেঙে বালুকণার সৃষ্টি হয়। এইসব কণার মধ্যে অতি কঠিন কোয়ার্টজ কণা থাকে, সেগুলিও শিলাকে ক্ষয় করে বালুকণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
উপকূল অঞ্চলে বালুকাকণা সৃষ্টির পদ্ধতি: উপকূল অঞ্চলে যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকার এবং বায়ুপ্রবাহের সহায়তা নিয়ে প্রধানত সমুদ্রতরঙ্গ অবঘর্ষ ক্ষয়, ঘর্ষণ ক্ষয়, দ্রবণ ক্ষয়, জলপ্রবাহ ক্ষয় প্রভৃতি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তটভূমির শিলাসমূহকে ক্রমশ চূর্ণবিচূর্ণ করে অবশেষে বালিতে পরিণত করে। উপকূল অঞ্চলে সংঘটিত রাসায়নিক আবহবিকারের মধ্যে আর্দ্র বিশ্লেষণ, অঙ্গারযোজন ও জারণ উল্লেখযোগ্য। এর ফলে শিলা বিয়োজিত ও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বালুকণা সৃষ্টি করে।
10. মরু সম্প্রসারণের কারণগুলি আলোচনা করো।
উত্তর – মরু সম্প্রসারণের কারণ: মরুভূমির পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে বা মরুসংলগ্ন অঞ্চলে মরুভূমির প্রসার ঘটলে তাকে মরু সম্প্রসারণ বা মরুবিস্তার বলে। কোথাও প্রাকৃতিক কারণে, আবার কোথাও মানুষের ক্রিয়াকলাপে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটে। যেমন—
  1. মরুভূমি সম্প্রসারণের প্রাকৃতিক কারণ: [i] বালিপূর্ণ বাতাসের আগমন: মরুভূমি থেকে আগত বালিপূর্ণ বাতাসের মাধ্যমে মরুসংলগ্ন অঞ্চলে বালি জমা হতে হতে ধীরে ধীরে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটে। [ii] খরার প্রাদুর্ভাব: বার বার খরা হলে মাটি এতটাই শুষ্ক হয়ে যায় যে, সেখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল-সহ সমগ্র বাস্তুতন্ত্রেই চরম বিপর্যয় নেমে আসে। এরকম অবস্থা মরুভূমি-সংলগ্ন অঞ্চলে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটায়। [iii] বিশ্ব উয়ায়ন: বর্তমানে বিশ্ব উস্নায়নের জন্য আবহাওয়া তথা জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে, তা মরুভূমির সম্প্রসারণে অনুকূল প্রভাব ফেলেছে।
  2. মরুভূমি সম্প্রসারণের মনুষ্যসৃষ্ট কারণ: মরুভূমিসংলগ্ন অঞ্চলে— [i] ব্যাপকহারে বৃক্ষচ্ছেদন, [ii] অনিয়ন্ত্রিত বা অতিরিক্ত পশুচারণ, [iii] অবৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষিকাজ, [iv] অবৈজ্ঞানিক প্রথায় জলসেচ (এর ফলে মাটির লবণতা বৃদ্ধি পেয়ে তা চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে, যা মরুকরণে সাহায্য করে) প্রভৃতি মনুষ্যসৃষ্ট কারণে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটে।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. ওয়াদি বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ধারণা: মরু অঞ্চলের ক্ষীণকায়, অনিত্যবহ ও ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির নদীগুলিকে ওয়াদি (Wadi) বলে। বৈশিষ্ট্য: (1) খাত প্রায় থাকে না বললেই চলে। (2) প্রবল বৃষ্টিপাতের সময় ছাড়া অন্য সময় শুষ্ক থাকে। (3) হঠাৎ বৃষ্টি হলে ওয়াদিগুলি কিছুদূর প্রবাহিত হওয়ার পর বালির মধ্যে হারিয়ে যায়। উদাহরণ: সৌদি আরবের আল বাটন (Al-Batin) একটি বিখ্যাত ওয়াদি।
2. পেডিমেন্ট বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ধারণা: মরু অঞ্চলে পর্বতের পাদদেশে সৃষ্ট মরু-সমপ্রায়ভূমির ওপর মূলত ক্ষণস্থায়ী নদী ছড়ানো জলধারার মতো বা পাতের আকারে প্রবাহিত হয়ে ক্ষয় করে। এই জলধারা ও কিছুটা বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে সেখানে যে সামান্য ঢালু (ঢাল 1°-7°) প্রস্তরগঠিত ভূমিভাগের সৃষ্টি হয়, তাকে পেডিমেন্ট (pediment) বা পর্বত পাদদেশের সমভূমি বলে। উদাহরণ: সাহারার উত্তর-পশ্চিমে অ্যাটলাস পর্বতের পাদদেশে পেডিমেন্ট দেখা যায়।
3. বালিয়াড়ি কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: বালিপূর্ণ বায়ুর গতিপথে গাছপালা, প্রস্তরখণ্ড, ঝোপঝাড় বা অন্য কোনো বাধা থাকলে বায়ুবাহিত বালির কিছু অংশ সেখানে সঞ্চিত হয়ে উঁচু ঢিবি বা স্তূপের মতো অবস্থান করে। এই ধরনের বালির স্তূপকে বালিয়াড়ি (sand dune) বলা হয় ।
4. বারখান বলতে কী বোঝ?
উত্তর – ধারণা: প্রবহমান বায়ুর গতিপথের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে একেবারে আধখানা চাঁদের আকারে যেসব বালিয়াড়ি গড়ে ওঠে, সেগুলিকে বারখান (barchan) বলা হয়। বৈশিষ্ট্য: (1) বারখান প্রকৃতপক্ষে তির্যক বালিয়াড়ির একটি রূপ। (2) এগুলি সাধারণত চলমান বা ভ্রাম্যমাণ হয়। (3) উচ্চতা 15 থেকে 30 মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
5. হামাদা কী?
উত্তর – ধারণা: শিলা দ্বারা গঠিত মরুভূমিকে বলা হয় হামাদা। সাধারণত কোনো মরুভূমিতে বায়ুর অপসারণ প্রক্রিয়ায় বালিকণা প্রায় সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হলে সেখানে একটি শিলাগঠিত বন্ধুর ভূমি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং কালক্রমে বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে তা প্রায় সমতল ভূমিতে পরিণত হয়। এই সমতল ভূমিকে সাহারা মরুভূমির অন্তর্গত আলজিরিয়ায় হামাদা নামে অভিহিত করা হয়।
6. কোন্ কোন্ অঞ্চলে বালিয়াড়ি দেখা যায়? 
উত্তর – বালিয়াড়ি অঞ্চল: কোনো স্থানে বালিয়াড়ি গড়ে ওঠার প্রধান দুটি শর্ত হল—বালিপূর্ণ বায়ুপ্রবাহ এবং মাঝে মাঝে কাঁটাগাছ বা ঝোপঝাড়সমৃদ্ধ বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত স্থান। সাধারণত এই ধরনের অনুকূল অবস্থা (1) উয় মরু অঞ্চল, (2) শুষ্ক অঞ্চল এবং (3) সমুদ্রোপকূলে পাওয়া যায় বলে এই তিনটি অঞ্চলে বালিয়াড়ি দেখা যায়।
7. গৌর সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর – ধারণা:মরুভূমিতে বায়ুর ক্ষয়কার্যের জন্য যত ধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয়, তার মধ্যে গৌর অন্যতম। সাধারণত মরু অঞ্চলে বায়ুর অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় ক্ষয়কার্যের জন্য বৃহদাকৃতি শিলাখণ্ডের নিম্নাংশের কোমল শিলা যত বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ঊর্ধ্বাংশের কঠিন শিলা ততটা হয় না। এর ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো আকৃতিবিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। এই ধরনের ভূমিরূপকে গৌর বা গারা বা ব্যাঙের ছাতার মতো শিলা বলা হয়।
8. লোয়েস কী ?
উত্তর – ধারণা: মরুভূমির খুব সূক্ষ্ম বালুকণা ও পলিকণা বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে বহুদূর পর্যন্ত উড়ে গিয়ে সঞ্চিত হলে তাকে লোয়েস বলে। এভাবে বিস্তৃত অবনত এলাকায় লোয়েস সঞ্চিত হয়ে যখন সমভূমি সৃষ্টি করে তাকে লোয়েস সমভূমি বলে। উদাহরণ: উত্তর চিনের গোবি মরুভূমির বালি হোয়াংহো নদীর অববাহিকায় সঞ্চিত হয়ে লোয়েস সমভূমির সৃষ্টি করেছে।
9. মরুদ্যান কী?
উত্তর – ধারণা: অনেকসময় মরু অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে বিরাট এলাকাজুড়ে বালি অপসারিত হতে হতে অবনত অংশটির গভীরতা ভূগর্ভের জলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর ফলে সেখানে তখন সহজেই জলের সন্ধান পাওয়া যায় এবং (আর্দ্র মাটি এবং জলের সুবিধার জন্য) নানাধরনের গাছ জন্মায় ৷ এইভাবে ধু-ধু মরুভূমির মাঝে গাছপালায় ঢাকা যে সবুজ ভূমিটি গড়ে ওঠে, তাকে মরুদ্যান (Oasis) বলা হয়।
10. ভেন্টিফ্যাক্ট ও ড্রেইকান্টার কী?
উত্তর – ভেন্টিফ্যাক্ট : কোনো কোনো সময় মরু অঞ্চলে একদিক থেকে বায়ুপ্রবাহের জন্য বায়ুবাহিত বালিকণা অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় শিলাখণ্ডকে একদিকে ক্ষয় করে। এইভাবে শিলাখণ্ডটির বায়ুপ্রবাহের দিকটি মসৃণ ও তীক্ষ্ণ ধারযুক্ত হয়। আর বাকি দিকগুলি অমসৃণ বা এবড়োখেবড়ো হয়ে ওঠে, এই ধরনের শিলাখন্ডকে ভেন্টিফ্যাক্ট বলে।
ড্রেইকান্টার : মরু অঞ্চলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক থেকে বায়ুপ্রবাহের জন্য বায়ুবাহিত বালিকণা অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় শিলাখণ্ডের বিভিন্ন দিককে মসৃণ করে তোলে। এইভাবে অবঘর্ষ ক্রিয়ার প্রভাবে যখন শিলাখণ্ডের তিনদিক মসৃণ হয়, তখন সেই শিলাখণ্ডকে ড্রেইকান্টার বলে।
11. খ্রিয়ান কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: মরু অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহের দিক বা গতি পরিবর্তনের কারণে বেশিরভাগ বালিয়াড়িই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে সরে যায়। এজন্য এদের নাম অস্থায়ী বা চলমান বালিয়াড়ি। রাজস্থানের মরু অঞ্চলে এই ধরনের অস্থায়ী বালিয়াড়িকে খ্রিয়ান বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য: (1) এগুলি উন্মুক্ত মরুভূমিতে গঠিত হয়। (2) বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলির দিক ও বিস্তার পরিবর্তিত হয়।
12. সিফ বালিয়াড়ি কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা: আরবি ভাষায় ‘সিফ’ শব্দটির অর্থ তলোয়ার। মরু অঞ্চলে যেসব বালিয়াড়ি খুব দীর্ঘ ও সংকীর্ণ শৈলশিরা বা তলোয়ারের মতো, সেগুলিকে বলে সিফ বালিয়াড়ি। এই প্রকার বালিয়াড়ি প্রায় 100 মি উঁচু, 600 মি প্রশস্ত এবং 100 কিমি দীর্ঘ হয়।গঠন প্রক্রিয়া : বিজ্ঞানী বাগনল্ডের মতে প্রবল বায়ুপ্রবাহে যখন বারখানের মাঝের অংশ ক্ষয়ে যায় তখন দু-পাশে শিঙের মতো শিরা দুটি ক্রমশ বড়ো হয়ে দুটি সিফ বালিয়াড়ি রূপে পাশাপাশি গড়ে ওঠে।
13. মরুখাত বা ব্লো আউট কাকে বলে? 
উত্তর – সংজ্ঞা: মরু অঞ্চলে বায়ুর অপসারণ কার্যের ফলে আলগা বালিরাশি সরে গিয়ে গঠিত বিভিন্ন আকার ও আয়তনের ছোটো-বড়ো গর্ত বা অবনত ভূমিকে মরুখাত বা অপসারণ গর্ত বা ব্লো আউট বলে।
বৈশিষ্ট্য: (1) এগুলি সাধারণত বালিয়াড়ি অথবা বালির সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত অঞ্চলে দেখা যায়। (2) বায়ুর অপসারণসৃষ্ট অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার গর্তগুলিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বাফেলো গর্ত এবং বৃহৎ গর্তগুলিকে মঙ্গোলিয়ায় প্যাং কিয়াং গর্ত বলে।
14. প্লায়া কী?
অথবা, বোলসন কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: ‘প্লায়া’ একটি স্প্যানিশ শব্দ, এর অর্থ লবণাক্ত হ্রদ। মরু অঞ্চলের লবণাক্ত জলের হ্রদগুলিকে প্লায়া বলে। সাধারণত মরু অঞ্চলে হঠাৎ মুশলধারে বৃষ্টিপাত হলে চারপাশের উচ্চভূমি থেকে আসা অনেকগুলি জলধারা মধ্যভাগের উপত্যকা বা নিম্নভূমিতে মিলিত হলে সেখানে এই লবণাক্ত জলের অগভীর হ্রদ তথা প্লায়া সৃষ্টি হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমভাগে এবং মেক্সিকোতে এই প্লায়া হ্রদকে ‘বোলসন’ বলা হয়। (স্প্যানিশ ভাষায় বোলসন বা Bolson কথাটির অর্থ বড়ো থলি বা Large purse। এ ছাড়া প্লায়া অস্ট্রেলিয়ায় ‘প্যান’, আফ্রিকায় ‘শটস’ এবং সৌদি আরবে ‘সবখা’ নামে পরিচিত। উদাহরণ: রাজস্থানের সম্বর বা পুষ্কর হ্রদ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ‘লা প্লায়া’ পৃথিবীর বৃহত্তম প্লায়া হ্রদ।
15. বাজাদা কী?
উত্তর – ধারণা: স্প্যানিশ শব্দ BAHADA থেকে ইংরেজিতে BAJADA শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ একাধিক পলল শঙ্কযুক্ত সমতল ভূমি। সাধারণত মরু অঞ্চলে পর্বতের পাদদেশে যে সামান্য ঢালবিশিষ্ট শিলাময় ভূমি বা পেডিমেন্ট থাকে, তার নীচে বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে পলি সজ্জিত এক সমতলক্ষেত্র গঠিত হয়, একেই বলে বাজাদা।
বৈশিষ্ট্য: (1) পর্বতের পাদদেশের একাধিক পলল শঙ্কু যুক্ত হয়ে এই বাজাদা গড়ে ওঠে। (2) এর ঢাল 1° থেকে 10° পর্যন্ত হয়। (3) পলি, কাদা, নুড়ি ইত্যাদি সঞ্জিত হয়ে বাজাদা গঠিত হয়। উদাহরণ: সাহারা মরুভূমির উত্তর-পশ্চিমে আটলাস পর্বতের পাদদেশে বাজাদা আছে।
16. বায়ুর অবঘর্ষ প্রক্রিয়া ভূমির সামান্য ওপরে কার্যকরী হয় কেন?
উত্তর – বায়ুর অবঘর্ষ প্রক্রিয়া ভূমির সামান্য ওপরে কার্যকরী হওয়ার কারণ: মরু অঞ্চলের ভূমিভাগ সামান্য উঁচুনীচু হয় এবং ভূমিতে ঝোপঝাড় থাকায় বায়ুর গতিবেগ কম হয়। এতে বায়ুবাহিত পদার্থগুলি বাধা পায়। আবার ওপরের অংশে বায়ুর গতিবেগ বেশি থাকলেও বায়ুবাহিত পদার্থের পরিমাণ কম হয়। তাই অবঘর্ষ প্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠ থেকে সামান্য উঁচু অংশে বেশি কার্যকরী হয়।
17. পুচ্ছ বালিয়াড়ি কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : মরু অঞ্চলে ঝোপঝাড়ে বা প্রস্তরখণ্ডের যেদিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়, ঠিক তার বিপরীত দিকে সরু ল্যাজের মতো গড়ে ওঠা বালিয়াডিকে পুচ্ছ বালিয়াড়ি বলে।
18. নক্ষত্র বালিয়াড়ি কী?
উত্তর – ধারণা: মরুভূমিতে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। এর ফলে অনেক জায়গায় বালিপূর্ণ বায়ুর গতিপথে পড়ে থাকা প্রস্তরখণ্ড বা ঝোপঝাড়ের বিভিন্ন দিকে ছোটো ছোটো অনেকগুলি বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয়ে নক্ষত্রের আকার ধারণ করে, একেই নক্ষত্র বা তারা বালিয়াড়ি বলে।
19. গাসি কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : মরু অঞ্চলে কোনো কোনো সময় সিফ বালিয়াড়িগুলি একে অপরের সমান্তরালে গড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে দুটি সিফ বালিয়াড়ির মাঝখানের লম্বা ফাটল অংশ বা করিডরগুলি সাধারণত বালিবিহীন থাকে এবং প্রস্তরখণ্ডে পূর্ণ বা শিলাদ্বারা গঠিত হয়। এইসব করিডরকে সাহারায় গাসি বলে। মরুভূমিতে এইসব করিডরগুলি যাতায়াতের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
20. আর্গ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা : পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকারের মরুভূমি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন— প্রস্তরময়, শিলাময়, বালিময় ইত্যাদি। এর মধ্যে বিস্তীর্ণ বালিঢাকা মরুভূমিকে সাহারায় বলে আর্গ। এশিয়ায় এরই নাম কুম। উদাহরণ : সৌদি আরবের রুব-আল-খালি একটি সুবিশাল আর্গ।
21. মধ্য অক্ষাংশের বা নাতিশীতোয় অঞ্চলের কয়েকটি মরুভূমির নাম লেখো।
উত্তর – মধ্য অক্ষাংশের বা নাতিশীতোর অঞ্চলের মরুভূমি: এশিয়ার গোবি, তাকলামাকান, তুর্কিস্তানের মরুভূমি, উত্তর আমেরিকার কলোরাডো মরুভূমি, দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়া মরুভূমি প্রভৃতি মধ্য অক্ষাংশের বা নাতিশীতোয় মরুভূমি।
22. কয়েকটি নিম্ন অক্ষাংশের মরুভূমির নাম করো।
উত্তর – নিম্ন অক্ষাংশের মরুভূমি: উভয় গোলার্ধে সাধারণভাবে 20°-30° অক্ষাংশের মধ্যে যেসব মরুভূমি আছে সেগুলিকে নিম্ন অক্ষাংশের মরুভূমি বলে। এই মরুভূমিগুলি বেশিরভাগই মহাদেশের পশ্চিমভাগে গড়ে উঠেছে। যেমন—উত্তর আমেরিকার সোনেরান, দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা, আফ্রিকার সাহারা ও কালাহারি, এশিয়ার থর ও আরবীয় মরুভূমি এবং অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম অস্ট্রেলীয় মরুভূমি।
23. ডেজার্ট পেভমেন্ট কী?
অথবা, রেগ ও সেরির কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা : মরু অঞ্চলে গোলাকার শিলা, নুড়ি এবং কোণাকার শিলাখণ্ড দিয়ে গঠিত ভূমিকে ডেজার্ট পেভমেন্ট বা ডেজার্ট ফ্লোর বলে। দীর্ঘদিন ধরে বায়ুর অপসারণ প্রক্রিয়ায় ভূমি থেকে বালি সরে গেলে ডেজার্ট পেভমেন্ট গঠিত হয়। এই জাতীয় ভূমিরূপকে পশ্চিম সাহারায় রেগ, পূর্ব সাহারায় সেরির, মধ্য এশিয়ায় সাই এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিবার বলে।
24. অ্যাডোব কী?
উত্তর – পরিচিতি:উত্তর আমেরিকার মিসিসিপি-মিসৌরি নদীর উপত্যকায় গড়ে ওঠা লোয়েস সমভূমিকে স্থানীয় ভাষায় অ্যাডোব বলে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্লিস্টোসিন যুগে হিমবাহ গঠিত গ্রাবরেখা ও বহিঃবিধৌত সমভূমির সূক্ষ্ম পলি উড়ে এসে এই লোয়েস ভূমি গঠিত হয়েছে।
25. মরু অঞ্চলের প্রসারণের যে-কোনো দুটি কারণ লেখো।
উত্তর – মরু অঞ্চলের প্রসারণের কারণ: (1) মরুভূমিসংলগ্ন অঞ্চলে নির্বিচারে গাছ কাটলে এবং (2) অতিরিক্ত পশুচারণ করলে অঞ্চলটি উদ্ভিদশূন্য হয়ে যায় এবং সেখানে মরুভূমির প্রসারণ ঘটে। এ ছাড়া বিশ্ব উস্নায়নের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন, মরুসংলগ্ন এলাকাসমূহে অবৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, প্রবল বায়ুপ্রবাহ ও বালিঝড় প্রভৃতি কারণেও মরুভূমির প্রসারণ ঘটে।
26. ধান্দ বলতে কী বোঝ?
অথবা, অপসারণ গর্ত কীভাবে সৃষ্টি হয় ?
উত্তর – ধারণা: প্রবল বায়ুপ্রবাহ মরু অঞ্চলের আলগা বালুকণা ও শিলাচূর্ণকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার নাম অপসারণ। এই অপসারণের ফলে ক্ষয়প্রবণ স্থানে ভূমির উচ্চতা কমে গিয়ে কড়াইয়ের মতো অবনত স্থান বা খাদ তৈরি হয়, যাকে অপসারণ গর্ত বা ব্লো আউট বলা হয়। রাজস্থানের থর মরু অঞ্চলে এই ধরনের যেসব অপসারণ গর্ত আছে, সেগুলির স্থানীয় নাম ধান্দ।
27. উত্তর গোলার্ধের দুটি উয় মরুভূমির নাম বলো।
উত্তর – উত্তর গোলার্ধের উগ্ন মরুভূমি: উত্তর গোলার্ধের দুটি উয় মরুভূমির নাম হল— (1) আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি এবং (2) দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আরবীয় মরুভূমি (ভারত-পাকিস্তানের থর মরুভূমিও উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত)।
28. মরুকরণ কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা : ধারাবাহিকভাবে মরুভূমির সম্প্রসারণ তথা আয়তন বৃদ্ধিকে বাংলায় মরুকরণ এবং ইংরেজিতে ডেজার্টিফিকেশন বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো স্থানে ভূমির জৈবিক ক্ষমতা হ্রাস পেলে বা ধ্বংস হলে সেখানে ভূমিভাগের যে চূড়ান্ত অবনমন ঘটে অর্থাৎ মরুসদৃশ অবস্থা সৃষ্টি হয়, তাকে মরুকরণ বলে। মরুকরণের কারণ: সাধারণত মরুভূমিসংলগ্ন অঞ্চলে ধুলোবালির ঝড়, তীব্রগতির বায়ুপ্রবাহ, অতিরিক্ত বাষ্পীভবন, কৃষিভূমি ও তৃণভূমিতে বালিয়াড়ি গড়ে ওঠা, খরা, ভূমিক্ষয় প্রভৃতির মাধ্যমে মরুকরণ ঘটে।
29. মরুবিস্তার কাকে বলে?
উত্তর – ধারণা: মরুভূমির পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে বা মরুসংলগ্ন অঞ্চলে মরুভূমির প্রসার ঘটলে তাকে মরুবিস্তার (Expansion of desert) বা মরুসম্প্রসারণ বলে। মরুবিস্তারের কারণ: সাধারণত মরুভূমির আলগা বালুকারাশি প্রবল বায়ুপ্রবাহে বা মরুঝড়ের মাধ্যমে বাহিত হয়ে সংলগ্ন এলাকাসমূহে পতিত হলে ওইসব ভূমি ক্রমশ বালিতে ঢাকা পড়ে যায় এবং তার ফলে উর্বরতা হারিয়ে তা মরভূমিতে পরিণত হয়। এইভাবেই রাজস্থানের থর মরুভূমির পূর্ব দিকে বেশ কিছুটা বিস্তার বা সম্প্রসারণ ঘটেছে।
30. মরূদ্যান কীভাবে সৃষ্টি হয়?
উত্তর – মরূদ্যান সৃষ্টির পদ্ধতি: মরু অঞ্চলে বায়ুর অপসারণ প্রক্রিয়ার ফলে মরুভূমির বালি এক স্থান থেকে আর-এক স্থানে উড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে মরুভূমির কোনো অংশে এই প্রক্রিয়া চললে সেই স্থানের ভূমিভাগ ক্রমশ অবনত হয়। এইভাবে বালি অপসারিত হতে হতে যখন অবনত এলাকাটির গভীরতা ভূগর্ভের জলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন সেখানে মরূদ্যান সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ: সাহারা মরুভূমিতে বাহারিয়া, কুফরা প্রভৃতি নামে কয়েকটি মরূদ্যান আছে।
31. Aeolian ভূমিরূপ কাকে বলে?
উত্তর – সংজ্ঞা: গ্রিক বায়ুদেবতার নাম Aeolus বা এওলিয়াস। তাঁর নামানুসারে সাধারণভাবে বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত বা বায়ুপ্রবাহের দ্বারা সংঘটিত সব ধরনের কাজকে একত্রে Aeolian বা এওলিয়ান বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে, বায়ুপ্রবাহ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহির্জাত প্রাকৃতিক শক্তি। এটি ক্ষয়সাধন, বহন এবং অধঃক্ষেপণ বা সঞ্চয়কাজের মাধ্যমে মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সমুদ্রোপকূলে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে যে নতুন ধরনের ভূমিরূপ গড়ে তোলে, তাকেই Aeolian বা এওলিয়ান ভূমিরূপ বলে।
উদাহরণ: কয়েকটি উল্লেখযোগ্য Aeolian ভূমিরূপ হল—জিউগেন, ইয়ারদাং, ইনসেলবার্জ, লোয়েস সমভূমি, বালিয়াড়ি প্রভৃতি।
32. CAZRI কী ?
উত্তর – পরিচিতি: CAZRI-র পুরো কথাটি হল Central Arid Zone Research Institute (সেন্ট্রাল এরিড জোন রিসার্চ ইন্সটিটিউট)। ভারতে থর মরু অঞ্চলের সম্প্রসারণ প্রতিরোধের জন্য এই সংস্থাটি কাজ করে এবং এর সদর দপ্তর রাজস্থানের যোধপুরে অবস্থিত।
33. গ্রেট গ্রিন ওয়াল কী?
উত্তর – ধারণা: আফ্রিকা মহাদেশের সমগ্র উত্তরভাগ জুড়ে থাকা পৃথিবীর বৃহত্তম উন্ন মরুভূমি সাহারার সম্প্রসারণ প্রতিরোধের জন্য মরুভূমিটির দক্ষিণ সীমা বরাবর যে একটি সবুজ উদ্ভিদের প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে, তারই নাম গ্রেট গ্রিন ওয়াল।
বৈশিষ্ট্য: (1) এই সবুজ উদ্ভিদ প্রাচীরটি পূর্বে জিবুতি থেকে পশ্চিমে সেনেগাল পর্যন্ত 11 টি দেশের ওপর দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। (2) পূর্ব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য প্রায় 7775 কিমি এবং উত্তর-দক্ষিণে এর বিস্তৃতি প্রায় 15 কিমি।
34. দক্ষিণ গোলার্ধের দুটি উম্ন মরুভূমির নাম লেখো।
উত্তর – দক্ষিণ গোলার্ধের উগ্ন মরুভূমি: দক্ষিণ গোলার্ধের দুটি উম্ন মরুভূমি হল— (1) আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমি এবং (2) দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা মরুভূমি।
35. অবঘর্ষ ক্ষয় বলতে কী বোঝ?
অথবা, অবঘর্ষ ক্ষয় কীভাবে হয়?
উত্তর – ধারণা: মরু অঞ্চলে প্রবলবেগে প্রবাহিত বায়ুর মধ্যে ছোটো ছোটো পাথরখণ্ড, নানা আয়তনের বালি এবং শক্ত কোয়ার্টজ কণা থাকে। ফলে এই বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে যখন ভূপৃষ্ঠসংলগ্ন শিলাস্তরের ঘর্ষণ লাগে, তখন শিলাস্তরের গায়ে কোথাও আঁচড় কাটার মতো দাগ, কোথাও বেশ গভীর দাগ, আবার কোথাও মৌচাকের মতো অসংখ্য ছোটো ছোটো গর্ত তৈরি হয়। এই ধরনের ক্ষয়কে বলে অবঘর্ষ ক্ষয়।
বৈশিষ্ট্য: (1) ভূমি থেকে সাধারণত এক মিটারের মধ্যে এই ধরনের ক্ষয় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। (2) অবঘর্ষের জন্য মরু অঞ্চলে টেলিগ্রাফ পোস্টের গোড়ার দিকটা খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয় হয়ে ভেঙে পড়ে বা বৃহদাকৃতির শিলাখণ্ডে ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে ভূমিরূপ গৌর সৃষ্টি হয়।
36. মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধের দুটি উপায় লেখো।
উত্তর – মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধের উপায় : মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধের দুটি উপায় হল— (1) বনসৃজন: মরুভূমির প্রান্ত বরাবর নিবিড়ভাবে বনভূমি গড়ে তুলতে হবে। গাছ মরু প্রসারণ রোধ করে। তাই এমন উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে, যা মরু জলবায়ুর উপযুক্ত অর্থাৎ খরা সহনশীল। (2) পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ : মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধে মাত্রাহীন পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বহু বিকল্পভিত্তিক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

1. চলমান বালিয়াড়িকে বলে-
(a) শটস
(b) ওয়াদি
(c) থ্রিয়ান
(d) প্লায়া
উত্তর – (c) থ্রিয়ান
2. তির্যক বালিয়াড়িকে বলে—
(a) সিফ
(b) বারখান
(c) লোয়েস
(d) ব্লো আউট
উত্তর – (b) বারখান
3. বায়ু ও ক্ষণস্থায়ী নদীর যে কার্যের ফলে পেডিমেন্ট সৃষ্টি হয়—
(a) ক্ষয়কার্য
(b) বহনকার্য
(c) সঞ্চয়কার্য
(d) উভয় কার্য
উত্তর – (a) ক্ষয়কার্য
4. মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের নিম্নভূমিতে অবস্থিত লবণাক্ত জলের হ্রদকে বলে—
(a) ধান্দ
(b) কাতারা
(c) প্লায়া
(d) ওয়াদি
উত্তর – (c) প্লায়া
5. মরুভূমি অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট পাহাড়গুলিকে বলে—
(a) বালিয়াড়ি
(b) হিমশৈল
(c) ইনসেলবার্জ
(d) এসকার
উত্তর – (c) ইনসেলবার্জ
6. প্রবহমান বায়ুর গতিপথের সঙ্গে সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠা বালিয়াড়িকে বলে—
(a) তির্যক বালিয়াড়ি
(b) অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি
(c) ভ্রাম্যমাণ বালিয়াড়ি
(d) তিমিপৃষ্ঠ বালিয়াড়ি
উত্তর – (b) অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি
7. বায়ুর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট সমভূমিকে বলে—
(a) প্লাবনভূমি
(b) লোয়েস সমভূমি
(c) বহিঃবিধৌত সমভূমি
(d) বদ্বীপ সমভূমি
উত্তর – (b) লোয়েস সমভূমি
৪. পেডিমেন্টের ওপর যে ক্ষয়জাত ও অবশিষ্ট পাহাড় সৃষ্টি হয় তাকে বলে—
(a) মোনাডনক
(b) ইনসেলবার্জ
(c) থ্রিয়ান
(d) হামাদা
উত্তর – (b) ইনসেলবার্জ
9. থর মরু অঞ্চলে বায়ুর অপসারণ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নীচু জায়গাকে বলে-
(a) ধান্দ
(b) মরূদ্যান
(c) কাতারা
(d) আর্গ
উত্তর – (a) ধান্দ
10. প্রস্তরময় মরুভূমিকে বলে—
(a) আর্গ
(b) রেগ
(c) হামাদা
(d) ট্যালাস
উত্তর – (c) হামাদা
11. লোয়েস সমভূমিকে উত্তর আমেরিকায় বলা হয়—
(a) সেডান
(b) অ্যাডোব
(c) লিমন
(d) মেসা
উত্তর – (b) অ্যাডোব
12. শিলাময় মরুভূমি আলজিরিয়ায় যে নামে পরিচিত—
(a) আর্গ
(b) কুম
(c) হামাদা
(d) রেগ
উত্তর – (d) রেগ
13. মরু অঞ্চলে ক্ষয়ের নিম্নসীমা হল—
(a) বারখান
(b) প্লায়া
(c) লোয়েস
(d) ইনসেলবার্জ
উত্তর – (b) প্লায়া
14. মেসা আরও ক্ষয়ে গিয়ে তৈরি হয়—
(a) জিউগেন
(b) বিউট
(c) ইনসেলবার্জ
(d) ইয়ারদাং
উত্তর – (b) বিউট
15. ‘মাশরুম রক’ বলা হয়—
(a) গৌরকে
(b) ইয়ারদাংকে
(c) ইনসেলবার্জকে
(d) জিউগেনকে
উত্তর – (a) গৌরকে
16. মরুভূমি অঞ্চলে শুষ্ক নদীখাতকে বলে—
(a) প্লায়া
(b) ওয়াদি
(c) বাজাদা
(d) পেডিমেন্ট
উত্তর – (b) ওয়াদি
17. ফ্রান্সে লোয়েস সমভূমিকে বলে—
(a) লিমন
(b) অ্যাডোব
(c) লস
(d) হোয়াংতু
উত্তর – (a) লিমন
18. ‘লোয়েস’ কথাটির অর্থ হল—
(a) স্থানচ্যুত বস্তু
(b) স্থানযুক্ত বস্তু
(c) বালিয়াড়ি
(d) বিস্তীর্ণ অঞ্চল
উত্তর – (a) স্থানচ্যুত বস্তু
19. মরু অঞ্চলে ইনসেলবার্জের থেকে ছোটো অবশিষ্ট পাহাড়কে বলা হয়—
(a) কোপিস
(b) টরস
(c) মোনাডনক
(d) বর্নহার্ট
উত্তর – (c) মোনাডনক
20. পাথুরে মরুভূমিকে মিশরে বলা হয়—
(a) রেগ
(b) কুম
(c) সেরির
(d) আগ
উত্তর – (c) সেরির
21. বায়ুর যে কার্যের দ্বারা গৌর গঠিত হয় —
(a) উৎপাটন
(b) ঘর্ষণ ক্ষয়
(c) অবঘর্ষ
(d) জলপ্রবাহ ক্ষয়
উত্তর – (c) অবঘর্ষ
22. ভেন্টিফ্যাক্ট গঠিত হয় —
(a) বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে
(b) নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে
(c) হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে
(d) সমুদ্রতরঙ্গের ক্ষয়কার্যের ফলে
উত্তর – (a) বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে
23. মরু অঞ্চলে বায়ুর ক্ষয়কাজের ফলে গঠিত ব্যাঙের ছাতার মতো ভূমিরূপ হল—
(a) আগামুক
(b) রকিনব
(c) ইনসেলবার্জ
(d) গৌর
উত্তর – (d) গৌর
24. বায়ু অপসারণের ফলে সৃষ্ট পৃথিবীর বৃহত্তম গর্তটি হল —
(a) সম্বর
(b) পুষ্কর
(c) কাতারা
(d) বিনহলো
উত্তর – (c) কাতারা
25. মরু অঞ্চলে বায়ু ও জলধারার সম্মিলিত কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ হল –
(a) বারখান
(b) পেডিমেন্ট
(c) লোয়েস
(d) ইয়ারদাং
উত্তর – (b) পেডিমেন্ট
26. কোন্‌টি মরুকরণে সাহায্য করে না?—
(a) অতিরিক্ত পশুচারণ
(b) অতিরিক্ত চাষাবাদ
(c) বনভূমি ধ্বংস
(d) কাঁটা-ঝোপ-জাতীয় বৃক্ষরোপণ
উত্তর – (d) কাঁটা-ঝোপ-জাতীয় বৃক্ষরোপণ

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি

1. দক্ষিণ আফ্রিকায় ………. নামক মরুভূমি দেখা যায়।
উত্তর – নামিব/কালাহারি
2. মরু অঞ্চলে অনুভূমিক শিলাস্তরে ক্ষয়কার্যের ফলে ……… সৃষ্টি হয়।
উত্তর – জিউগেন
3. বায়ুর এবং জলধারার ক্ষয়কার্যের ফলে পর্বতের পাদদেশে প্রস্তরে ঢাকা যে সমতল স্থান গঠিত হয়, তাকে বলে ………।
উত্তর – পেডিমেন্ট
4. ……… বালিয়াড়ির দুই পাশে দুটি শিং-এর মতো শিরা আধখানা চাঁদের মতো বিস্তৃত হয়।
উত্তর – বারখান
5. বারখান বালিয়াড়ি দেখতে ………. হয়।
উত্তর – অর্ধচন্দ্রাকৃতি
6. দুটি সিফ বালিয়াড়ির মাঝের অংশকে ………. বলে।
উত্তর – করিডোর/গাসি
7. ভারতের লবণাক্ত হ্রদগুলিকে ……….. বলে।
উত্তর – ধান্দ
৪. জার্মান শব্দ ‘ইনসেলবার্জ’-এর অর্থ ………।
উত্তর – দ্বীপশৈল
9. ইয়ারদাঙের মাথা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তীক্ষ্ম ও সুচালো আকৃতির হলে তাকে ………. বলে।
উত্তর – নিডিলস
10. উম্ন মরুভূমিতে ……….. কাজ বেশি দেখা যায়।
উত্তর – বায়ুর
11. শিলাময় মরুভূমির নাম ………।
উত্তর – হামাদা
12. মরু উদ্ভিদকে ………. বলে।
উত্তর – জেরোফাইট
13. ……….. কথার অর্থ তলোয়ার।
উত্তর – সিফ
14. বালিয়াড়ি বায়ুর ………. কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ।
উত্তর – সঞ্জয়
15. আফ্রিকার মরু হ্রদগুলিকে ………. নামে ডাকা হয়।
উত্তর – শটস
16. তির্যক বালিয়াড়ির এক বিশেষ রূপ হল ………।
উত্তর – বারখান
17. বায়ু দ্বারা সূক্ষ্ম বালিকণা বহুদূরে বাহিত হয়ে সঞ্চিত হলে, তাকে বলা হয় ………।
উত্তর – লোয়েস
18. ………. বালিয়াড়ির শীর্ষদেশ তীক্ষ্ণ হয়।
উত্তর – সিফ

The Complete Educational Website

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *