WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 1 ইতিহাসের ধারণা
WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 1 ইতিহাসের ধারণা
West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 1 ইতিহাসের ধারণা
West Bengal Board 10th History Solutions
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি
- বর্তমানকালে ইতিহাসবিদগণ বহু নতুন বিষয়কে ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—নতুন সামাজিক ইতিহাস, খেলার ইতিহাস, খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস, পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস, শিল্পচর্চার (সংগীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র) ইতিহাস, স্থাপত্যের ইতিহাস, দৃশ্যশিল্পের (ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি) ইতিহাস, যানবাহন যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস, স্থানীয় ইতিহাস, শহরের ইতিহাস, সামরিক ইতিহাস, পরিবেশের ইতিহাস, নারী ইতিহাস প্রভৃতি।
- সাম্প্রতিককালে সমাজের বৃহত্তর নিম্নবর্গের দরিদ্র, প্রান্তিক, পিছিয়ে-পড়া মানুষ সামাজিক ইতিহাসের আলোচনায় গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে আলোচনা করা এই ইতিহাস ‘নতুন সামাজিক ইতিহাস’ নামে পরিচিত। সাম্প্রতিককালে ‘নতুন সামাজিক ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। এ বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল মার্কস-এর ‘দাস ক্যাপিটাল’, এঙ্গেলস-এর ‘দ্য কনডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’, জা জরেস-এর ‘আ সোশ্যাল হিস্ট্রি অব দ্য ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন’ প্রভৃতি। এইসব গ্রন্থের মাধ্যমে মার্কসবাদী ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। ভারতে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ প্রকাশের মাধ্যমে রজনীপাম দত্ত মার্কসবাদী ইতিহাসচর্চা শুরু করেন।
- রণজিৎ গুহ ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘অন সাম অ্যাসপেক্টস অব দ্য হিস্টোরিওগ্রাফি অব কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটি রচনার মধ্য দিয়ে এদেশে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা শুরু করেন। পরে এই ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান পার্থ চ্যাটার্জি, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, শাহিদ আমিন, সুমিত সরকার, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, সুদীপ্ত কবিরাজ প্রমুখ।
- বিংশ শতক থেকে খেলাধুলো সর্বস্তরের মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন গবেষক এসব বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিককালে ইতিহাসচর্চা করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রিচার্ড হোল্ট-এর ‘স্পোর্টস অ্যান্ড দ্য ব্রিটিশ: আ মডার্ন হিস্ট্রি’, রামচন্দ্র গুহ-র ‘আ করনার অব আ ফরেন ফিল্ড: দ্য ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অব আ ব্রিটিশ স্পোর্টস’, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খেলা যখন ইতিহাস’, বোরিয়া মজুমদারের ‘ক্রিকেট ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি।
- বর্তমানকালে বিভিন্ন গবেষক খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছেন। এবিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল হরিপদ ভৌমিকের ‘রসগোল্লা: বাংলার জগত্খাতানো আবিষ্কার’, কে টি আচয়-এর ইন্ডিয়ান ফুড: আ হিস্টোরিক্যাল কমপ্যানিয়ন’, রিয়াই টান্নাহিল-এর ‘ফুড ইন হিস্ট্রি’, প্যাট চ্যাপম্যানের ইন্ডিয়া ফুড অ্যান্ড কুকিং’ প্রভৃতি।
- পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস নিয়ে আজকাল বিভিন্ন গবেষক চর্চা করছেন। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল মলয় রায়-এর ‘বাঙালির বেশবাস: বিবর্তনের রূপরেখা’, কার্ল কোহলার-এর ‘পোশাকের ইতিহাস’, মাইকেল ডেভিস-এর ‘আর্ট অব ড্রেস ডিজাইনিং’, এম্মা টারলো-র ‘ক্লোথিং ম্যাটার্স: ড্রেস আ আইডেনটিটি ইন ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি।
- বর্তমানে সংগীত, নৃত্য, নাটক চলচ্চিত্র প্রভৃতি শিল্পকলার ইতিহাসেরও যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। এ বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল— [i] সংগীতে উমেশ জোশীর ‘ভারতীয় সংগীত কা ইতিহাস’, সুকুমার রায়ের ‘বাংলা সংগীতের রূপ’, করুণাময় গোস্বামীর ‘বাংলা গানের বিবর্তন’, সুধীর চক্রবর্তীর ‘বাংলা গানের সন্ধানে’, মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর ‘বাংলা গানের ধারা’ প্রভৃতি। [ii] নৃত্যে ক্যারল ওয়েলস-এর ‘ডান্স-আ ভেরি সোশ্যাল হিস্ট্রি’, রাগিনী দেবীর ‘ডান্স ডায়ালেক্ট অব ‘ইন্ডিয়া’, শোভনা গুপ্তার ‘ডান্স অব ইন্ডিয়া’, গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতের নৃত্যকলা’ প্রভৃতি। [iii] নাটকে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস, সত্যজীবন মুখোপাধ্যায়ের ‘দৃশ্যকাব্য পরিচয়’, আশুতোষ ভট্টাচার্যর ‘বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস’ প্রভৃতি। [iv] চলচ্চিত্রে ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরও কিছু’, সত্যজিৎ রায়ের ‘একেই বলে শুটিং’ ও ‘বিষয় চলচ্চিত্র’, তপন সিংহর ‘চলচ্চিত্র আজীবন’, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ‘দেখার রকমফের: ঋত্বিক ও সত্যজিৎ’ প্রভৃতি।
- স্থাপত্যের ইতিহাস নিয়েও আধুনিককালে যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল জে ফার্গুসন-এর ‘হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইস্টার্ন আর্কিটেকচার’, জর্জ মিশেল-এর ‘ব্রিক টেম্পল অব বেঙ্গল’, পার্সি ব্রাউন-এর ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার’, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পশ্চিমবঙ্গের পুরাসম্পদ’ (সম্পা.), তারাপদ সাঁতরার ‘কলকাতার মন্দির-মসজিদ স্থাপত্য’, হিতেশরঞ্জন সান্যালের ‘বাংলার মন্দির’ প্রভৃতি।
- দৃশ্যশিল্পের ইতিহাস নিয়েও আজকাল যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘বাগেশ্বরী প্রবন্ধমালা’, অশোক মিত্র রচিত ‘ভারতের চিত্রকলা’, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় রচিত ‘চিত্রকথা’, গীতা কাপুর রচিত ‘কনটেমপোরারি ইন্ডিয়ান আর্টিস্টস’, জন ওয়েড রচিত ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অব দ্য ক্যামেরা’ প্রভৃতি।
- যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে আজকাল চর্চা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল জন আর্মস্ট্রং-এর ‘ট্রান্সপোর্ট হিস্ট্রি’, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইউরোপ অ্যান্ড দ্য হুগলি’, আর আর ভান্ডারির ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ: গ্লোরিয়াস ১৫০ ইয়ার্স’ প্রভৃতি।
- আধুনিককালে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন স্থানের স্থানীয় ইতিহাসের চর্চা শুরু করেছেন। এর ফলে জাতীয় ইতিহাসের চর্চা আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল কালীকমল সার্বভৌম রচিত ‘সে ইতিহাস বগুড়ার বৃত্তান্ত’, কুমুদনাথ মল্লিক রচিত ‘নদিয়া কাহিনি’, নিখিলনাথ রায় রচিত মুরশিদাবাদ কাহিনি’, সতীশচন্দ্র মিত্র রচিত ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’, রাধারমণ সাহা রচিত ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’, কালীনাথ চৌধুরী রচিত ‘রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, ভগবতীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘কোচবিহারের ইতিহাস’, সুধীরকুমার মিত্র-র ‘হুগলি জেলার ইতিহাস’ প্রভৃতি।
- বিভিন্ন শহরের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে আজকাল বিভিন্ন গবেষক গবেষণার কাজ করছেন। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল পুর্ণেন্দু পত্রীর ‘কলকাতা সংক্রান্ত’, নিখিল সরকারের (শ্রীপান্থ) ‘কলকাতা’, রাধারমণ মিত্রর ‘কলিকাতা দর্পণ’, সৌমিত্র শ্রীমানীর ‘কলিকাতা কলকাতা’ (সম্পা.), বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শহর বহরমপুর’, মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’, নারায়ণী গুপ্তর ‘দ্য দিল্লি অমনিবাস’ প্রভৃতি।
- সামরিক ইতিহাস বর্তমানকালে চর্চার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল—বার্নেট-এর ‘ব্রিটেন অ্যান্ড হার আর্মি’, রজার স্পিলার-এর ‘আমেরিকান মিলিটারি লিডার্স’, জন হোয়াইট ক্লে-র ‘আমেরিকান মিলিটারি হিস্ট্রি’, যদুনাথ সরকারের ‘মিলিটারি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’, সুরেন্দ্রনাথ সেনের ‘মিলিটারি সিস্টেম অব দ্য মারাঠাস’, সুবোধ ঘোষের ‘ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস’, জি এস সাঁধুর ‘মিলিটারি হিস্ট্রি অব মেডিয়াভাল ইন্ডিয়া’, কৌশিক রায়ের ‘দ্য আর্মি ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি।
- পরিবেশের পরিবর্তন, ইতিহাসে পরিবেশের প্রভাব প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আজকাল যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল র্যাচেল কারসন-এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’, আলফ্রেড ক্রসবি-র ‘ইকোলজিকাল ইম্পিরিয়ালিজম’, রিচার্ড গ্রোভ-এর ‘গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজম’, ইরফান হাবিবের ‘মানুষ ও পরিবেশ’, মাধব গ্যাডগিল ও রামচন্দ্র গুহর ‘ইকোলজি আ ইকুইটি’ প্রভৃতি।
- সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ব্যক্তি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিবর্তন নিয়ে ইতিহাসচর্চা করছেন। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল টমাস কুহন-এর ‘দ্য স্ট্রাকচার অব সায়েন্টিফিক রেভোলিউশনস’, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘আ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’, জে ডি বার্নাল-এর ‘হিস্ট্রি অব সায়েন্স’, দীপক কুমারের ‘সায়েন্স অ্যান্ড দ্য রাজ’ প্রভৃতি।
- সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ব্যক্তি চিকিৎসাবিদ্যার বিবর্তন নিয়ে ইতিহাসচর্চা করছেন। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিজ্ঞান’, পার্থসারথি চক্রবর্তীর ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের আজব কথা’, তপন চক্রবর্তীর ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস’ প্রভৃতি।
- ইতিহাসের অগ্রগতিতে নারীদেরও অসামান্য অবদান রয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিককালে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছে। এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল জোয়ান স্কট-এর ‘জেন্ডার অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অব হিস্ট্রি’, নীরা দেশাইয়ের ‘উইমেন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’, জেরান্ডিন ফোর্বস-এর ‘উইমেন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’, এম এন শ্রীনিবাসের ‘দ্য চেঞ্জিং পজিশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন’, কমলা ভাসিনের ‘হোয়াট ইজ প্যাট্রিয়ার্কি’ প্রভৃতি।
- আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার উল্লেখযোগ্য উপাদানগুলি হল— [i] সরকারি নথিপত্র, [ii] আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা, [iii] চিঠিপত্র, [iv] সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র প্রভৃতি।
- ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল [i] সরকারি কমিটি ও কমিশনের প্রতিবেদন, [ii] পুলিশ-গোয়েন্দা-সরকারি আধিকারিকদের রিপোর্ট, [iii] পদস্থ সরকারি আধিকারিক বা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিবরণ, [iv] সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন চিঠিপত্র প্রভৃতি।
- আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক উপাদান হল বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’, সরলাদেবী চৌধুরানির ‘জীবনের ঝরাপাতা’ প্রভৃতি ছাড়াও মহাত্মা গান্ধি, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, মুজাফফর আহমেদ, মণিকুন্তলা সেন প্রমুখের আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা।
- আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে চিঠিপত্রের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল কন্যা ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা পিতা জওহরলাল নেহরুর চিঠিগুলি। এ ছাড়াও টিপু সুলতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রমথ চৌধুরি প্রমুখের লেখা চিঠিপত্র প্রভৃতিও খুব মূল্যবান।
- আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে উল্লেখযোগ্য সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ এবং দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সোমপ্রকাশ’। এ ছাড়া রয়েছে ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সন্ধ্যা’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘বন্দেমাতরম’ প্রভৃতি।
- আজকাল ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইনটারনেটের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে এই তথ্য সংগ্রহের সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই রয়েছে।
TOPIC – A আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্য
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- রাজাদের কার্যকলাপ : বিগত শতাব্দীর মতো বর্তমানকালেও যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয়, শান্তিপ্রতিষ্ঠা, সন্ধি, রাজবংশের উত্থান-পতন প্রভৃতি বিষয়ের ইতিহাসচর্চা অব্যাহত আছে।
- উচ্চবর্গের আলোচনা: বিগত শতকের মতো সাম্প্রতিককালেও অভিজাত, ভূস্বামী, জমিদার, সামন্তপ্রভু প্রভৃতি সমাজের উচ্চবর্গের আলোচনা ইতিহাসচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
- সাধারণ মানুষের আলোচনা: বিগত শতক পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিল্প-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়ের ইতিহাসচর্চা অনেকটা উপেক্ষিত থাকলেও সাম্প্রতিককালে এসব বিষয়ের চর্চা ও গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
- স্থানীয় ইতিহাস : সাম্প্রতিককালে আঞ্চলিক ও স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে চর্চাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মহাদেশ থেকে দেশ, দেশ থেকে স্থানীয় অঞ্চলের শহর ও গ্রাম, শহর ও গ্রাম থেকে ব্যক্তি, মানুষ প্রভৃতি সবকিছুই ইতিহাসের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে।
- বিজ্ঞানের ইতিহাস: প্রাচীনকাল থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার যে ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটেছে সে বিষয়ের ইতিহাসচর্চাও সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে।
- নারী ইতিহাস: একদা ইতিহাসচর্চায় নারীরা যথেষ্ট উপেক্ষিত থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ নারী ইতিহাসচর্চায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন।
উপসংহার: সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে ইতিহাসচর্চার ধারারও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সংযোজিত হচ্ছে নতুন নতুন বিষয়। ফলে আধুনিক কালের ইতিহাসচর্চা আরও বেশি বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
- নীচ থেকে ওপর দিকে দৃষ্টিপাত: নতুন সামাজিক ইতিহাসের আলোচনায় ওপর থেকে নীচের দিকে দেখার পরিবর্তে নীচে থেকে ওপরের দিকে দেখার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ সমাজের মুষ্টিমেয় উচ্চবর্গের মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাধারণ ও নিম্নবর্গের মানুষের ভূমিকার ভিত্তিতে সমাজকে দেখার চেষ্টা করা হয়।
- বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য: নতুন সামাজিক ইতিহাসে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্গকে নয়, বৃহত্তর সাধারণ, নিম্নবর্গের ও প্রান্তিক মানুষকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবদান নতুন সামাজিক ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।
উপসংহার: আধুনিক কালে নতুন সামাজিক ইতিহাসের ধারণা এক অভিনব ইতিহাসচর্চার জন্ম দিয়েছে। এর দ্বারা উপরতলার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের ভূমিকার ভিত্তিতে ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে, যা ইতিহাসচর্চার নতুন উৎসমুখ খুলে দিয়েছে।
- অ্যানাল গোষ্ঠীর ভূমিকা: ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মার্ক ব্লখ ও লুসিয়েন ফেবর ‘অ্যানাল্স অব ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি’ নামে পত্রিকার
প্রকাশ করেন। ফ্রান্সের এই অ্যানাল পত্রিকাগোষ্ঠী নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই গোষ্ঠীর ফার্নান্দ ব্রদেল, লাদুরি প্রমুখ সাধারণ মানুষের পরিসংখ্যান, পরিবার, মনস্তত্ত্ব, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন।
- মার্কিন ঐতিহাসিকদের ভূমিকা: ইউজিন জেনোভিস, হারবার্ট গুটম্যান প্রমুখ মার্কিন ঐতিহাসিক সমাজের সাধারণ শ্রমিকদের জীবনযাত্রা, ক্রীতদাসপ্রথা, দাস সমাজ প্রভৃতি নিয়ে ইতিহাসচর্চা করেছেন। ‘পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ পত্রিকায়ও এই ধারার ইতিহাসচর্চার নানা প্রমাণ পাওয়া যায়।
- ভারতের ঐতিহাসিকদের ভূমিকা: ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ১৯৮০-র দশক থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা (সাবলটার্ন স্টাডিজ) ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, শাহিদ আমিন, সুমিত সরকার, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিক জাতিধর্মনির্বিশেষে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের ইতিহাসচর্চা করে নিম্নবর্গের ইতিহাসকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
উপসংহার: নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় ইতিহাসের বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। মার্ক ব্লখ, লুসিয়েন ফেবর প্রমুখ এই কাজে যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা আজকের দিনে আরও যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
- আলোচনার ব্যাপকতা : নতুন সামাজিক ইতিহাসে আলোচনার পরিধি যথেষ্ট ব্যাপক এবং বহুমুখী। পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা, শিল্পচর্চা, পরিবেশ, জাতীয়তাবাদ, নারীবাদ-সহ বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ই এই ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত।
- সমাজের সর্বস্তরের আলোচনা : নতুন, সামাজিক ইতিহাস শুধু রাজা-মহারাজা বা অভিজাতবর্গের আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়। এই চর্চার সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় সমাজ, এমনকি প্রান্তিক অন্ত্যজদের জীবনযাত্রার আলোচনাও সমানভাবে গুরুত্ব পায়।
- আলোচনায় নিম্নবর্গীয়দের প্রাধান্য : গত শতাব্দীর ৯-এর দশক থেকে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার সাবলটার্ন বা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে এই ইতিহাসচর্চা এগিয়ে চলেছে।
- আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা : নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় বৃহত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাসের বাইরেও স্থানীয় ও আঞ্চলিক ইতিহাসকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
- উপাদানের নতুনত্ব : নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঐতিহাসিক উপাদানের নতুনত্ব। এই চর্চায় শুধু সরকারি ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক নথিপত্রই শুধু নয়, বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কাগজপত্রও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্ব পায়।
উপসংহার: বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্থে যে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার সূচনা হয় তা ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এক নব দিগন্তের সূচনা করে। এর ফলে ইতিহাসচর্চার নতুন নতুন উৎসমুখ খুলে যায়, যা প্রকৃত ইতিহাসচর্চাকে সার্থক করে তোলে।
- স্থানীয় ইতিহাসের গুরুত্ব: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন স্থান, অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের ইতিহাস একত্রিত হয়ে কোনো দেশের জাতীয় ইতিহাস গড়ে ওঠে। তাই বিংশ শতকে স্থানীয় ইতিহাস ও ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- স্থানীয় ইতিহাসের বিষয়: বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্থানীয় ইতিহাসের চর্চা হয়ে থাকে। স্থানীয় অঞ্চলের আর্থসামাজিক বিবর্তন, শিল্প-স্থাপত্য, লোকসংস্কৃতি, স্থানীয় শাসকের ইতিবৃত্ত প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় স্থানীয় ইতিহাসের আলোচনায় উঠে আসে।
- যাচাইকরণ: স্থানীয় ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অন্যতম হল মৌখিক উপাদান। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৌখিক উপাদানে বহু কল্পনা ও অতিকথার প্রবেশ ঘটে। তাই যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে মৌখিক উপাদানগুলি যাচাই করে তারপর সেগুলি ইতিহাসের তথ্য হিসেবে ব্যবহার করা দরকার।
- জেলাস্তরের ইতিহাসচর্চা: স্থানীয় ইতিহাসচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হল জেলাস্তরের ইতিহাসচর্চা। বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গবেষক এই বিষয়ে চর্চা করছেন। এই বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম কালীকমল সার্বভৌম রচিত ‘সে ইতিহাস বগুড়ার বৃত্তান্ত’, কুমুদনাথ মল্লিক রচিত ‘নদীয়া কাহিনি’, নিখিলনাথ রায় রচিত ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনি’, সতীশচন্দ্র মিত্র রচিত ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’, এ কে এম গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ রচিত ‘নোয়াখালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য’, কালীনাথ চৌধুরী রচিত ‘রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, শ্রীকেদারনাথ মজুমদার রচিত ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ’ প্রভৃতি।
- ক্ষুদ্র অঞ্চলের ইতিহাসচর্চা: জেলাস্তর থেকে ক্ষুদ্রস্তর নিয়েও আজকাল ইতিহাসচর্চা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরূপ ইতিহাসচর্চার কয়েকটি দৃষ্টান্ত হল ড. রতনলাল চক্রবর্তী রচিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রন্থিত ইতিহাস’, ড. খগেন্দ্রনাথ বসু রচিত ‘দৌলতপুরের বিবরণ’, বিপুলরঞ্জন সরকার রচিত ‘চাকদহ রামলাল একাডেমি: পট ও পটভূমিকা’ প্রভৃতি।
উপসংহারঃ বিভিন্ন স্থানের স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে কোনো দেশের জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়। তাই স্থানীয় ইতিহাসচর্চা ছাড়া জাতীয় ইতিহাসের চর্চা করা খুবই কঠিন।
- খেলাধুলার জনপ্রিয়তা : বিগত শতক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলাধুলা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক হবসবম উল্লেখ করেছেন যে, বিংশ শতকে ইউরোপীয় জীবনধারার অন্যতম প্রধান সামাজিক অভ্যাস হল খেলাধুলা।
- খেলাধুলার গুরুত্ব : কোনো সমাজের খেলাধুলা সেই সমাজের স্বরূপ প্রকাশ করে থাকে। কোনো সমাজের মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ সেই সমাজের নারী স্বাধীনতার প্রমাণ দেয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের হারিয়ে বাংলার মোহনবাগান দল আই এফ এ শিল্ড জিতে যে আনন্দে মেতে ওঠে, তা ছিল প্রকৃতপক্ষে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের বাংলা ভাগের জবাব।
- জাতীয় আবেগের প্রকাশ: খেলাধুলা বর্তমানে জাতীয় আবেগে পরিণত হয়েছে। খেলাধুলা জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সমাজবিবর্তন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রভৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে চলেছে।
- পাশ্চাত্যে খেলার ইতিহাসের চর্চা : সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যে খেলাধুলার ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে। জে এ ম্যাসান, রিচার্ড হোল্ড প্রমুখ গবেষক এই বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে গড়ে উঠেছে ‘ব্রিটিশ সোসাইটি অব স্পোর্টস হিস্ট্রি’।
- ভারতে খেলার ইতিহাসচর্চা : সাম্প্রতিককালে বাংলা তথা ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসচর্চায় যাঁরা বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বোরিয়া মজুমদার, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপক সাহা, গৌতম ভট্টাচার্য প্রমুখ।
উপসংহার: খেলাধুলা শারীরিক সক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি বিনোদনেরও একটি বড়ো উৎস। তাই বর্তমান মানুষের কাছে খেলাধুলার গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার প্রসার ঘটেছে।
- সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা: কোনো মানবসমাজ ও সভ্যতার খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন সেই সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তনের পরিচায়ক। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন থেকে সেই সমাজ সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।
- প্রাচীন বাংলার দৃষ্টান্ত: প্রাচীনকালে বিভিন্ন সময়ে বাংলায় আমিষ আহার বিশেষ জনপ্রিয় হলেও পালযুগে বৌদ্ধধর্ম এবং সেনযুগে ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রভাবে বাংলায় ভাত ও নিরামিষ খাবারের প্রচলন বাড়ে। খাদ্যাভ্যাসের এই পরিবর্তন থেকে সেযুগে ধর্মীয় প্রাধান্যের আভাস পাওয়া যায়।
- সুলতানি আমলে বাংলার দৃষ্টান্ত: সুলতানি আমলে বাংলায় ইসলামি সংস্কৃতির প্রসার এখানকার খাদ্যাভাসে প্রভাব ফেলে। অধ্যাপক শরিফউদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন যে, একসময় ঢাকা প্রাদেশিক মুসলিম শাসকদের রাজধানী হলে এখানকার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে। তখন থেকে ঢাকার রন্ধনপ্রণালীতে পারসিক খাদ্যরীতির প্রবেশ ঘটে এবং ‘ঢাকাই খাবার’-এর উদ্ভব হয়।
- ঔপনিবেশিক আমল: ঔপনিবেশিক শাসনও এদেশের খাদ্যাভ্যাসে বিশেষ প্রভাব ফেলে। পোর্তুগিজদের প্রভাবে হুগলি জেলায় মিষ্টি তৈরিতে ছানার ব্যবহার শুরু হয়। এভাবে খাদ্যাভ্যাস কোনো জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে।
- উল্লেখযোগ্য গবেষকগণ : সম্প্রতি খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষকরা হলেন ড. কে টি আচয়, হারভে লেভেনস্টেইন, জোনাথন রাইট, রিয়াই টান্নাহিল, বিজয়া চৌধুরী, হরিপদ ভৌমিক প্রমুখ।
উপসংহার: খাদ্যাভ্যাসের মধ্য দিয়ে মানুষের সংস্কৃতি, রুচি, এমনকি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিচয় মেলে। তাই সাম্প্রতিককালে খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার প্রসারের মধ্য দিয়ে মানবসংস্কৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলি জানা সম্ভব হচ্ছে।
- পোশাক-পরিচ্ছদের বিবর্তন: সুপ্রাচীনকাল থেকে মানবজাতির পোশাক-পরিচ্ছদের ধারাবাহিক পরিবর্তন ও বিবর্তন লক্ষ করা যায়।
- পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা: বর্তমানে পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষক চর্চা করে ইতিহাসের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করছেন।
- চর্চার সূচনা: বিংশ শতকের সূচনালগ্নে বিভিন্ন পণ্ডিত পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা শুরু করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ইতিহাসচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
- ইউরোপে চর্চা: সাম্প্রতিককালে ইউরোপে বিভিন্ন গবেষক পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক চর্চা করেছেন। এসব গবেষণা কাজের মধ্যে কার্ল কোহলার, জে ফর্বস ওয়াটসন, ও মাইকেল ডেভিস-এর অবদান উল্লেখযোগ্য।
- ভারতে চর্চা: সাম্প্রতিককালে ভারতেও পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস নিয়ে চর্চা চলছে। এই বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ত্রৈলোক্যনাথ বসুর ‘তাঁত ও রঙ’, মলয় রায়ের বাঙালির বেশবাস : বিবর্তনের রূপরেখা’, নিরুপমা পুণ্ডির ‘ফ্যাশন টেকনোলজি : টুডে অ্যান্ড টুমরো’ প্রভৃতি।
উপসংহার: বর্তমানে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মানবসংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতির মানসিকতা, নারীস্বাধীনতা প্রভৃতি সম্পর্কে জানা সম্ভব হচ্ছে।
- উচ্চবর্গের সংগীতচর্চা: প্রাচীনকালে রাজদরবার বা মন্দিরে যে সংগীতের চর্চা হত তা মূলত সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর বিশেষ সংযোগ ছিল না। ‘প্রাচীন সমাজে শ্রেণি বা বর্ণ বৈষম্যের বিষয়ে স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় সেই সমাজের সংগীতচর্চা থেকে।
- প্রভাব: কোনো জাতি বা সমাজের সংগীত অন্য কোনো জাতি বা সমাজের সংগীতের দ্বারা প্রভাবিত কি না বা কতটা প্রভাবিত, তা সংগীতের ইতিহাসচর্চা থেকে জানা সম্ভব। কোনো জাতি বা সমাজের সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ তার আভাস পাওয়া যায় অন্য জাতি বা সমাজের ওপর পূর্বোক্ত জাতির সংগীতের প্রভাব বিচার করে।
- বিবর্তন: ভারতীয় সমাজে একসময় ধর্মীয় সংগীতের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক বিবর্তনের ফলে বিংশ শতকে ভারতীয় সংগীতের ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। বাংলা সংগীতের বিবর্তনের ধারায় বিংশ শতকে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, রজনীকান্তের গান প্রভৃতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
- বৈচিত্র্য: ধারাবাহিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সংগীতের ভাণ্ডারে বিভিন্ন ধরনের সংগীত জায়গা করে নেয়। বর্তমানকালে যেমন ধর্মীয় সংগীতের পাশাপাশি পল্লিগীতি, লোকগীতি, বাউল গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান, চলচ্চিত্রের গান, ব্যান্ডের গান প্রভৃতির সমন্বয়ে বাংলা সংগীতের ভাণ্ডার বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- গবেষকগণ : সাম্প্রতিককালে দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষক ও পণ্ডিত সংগীতের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করছেন। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসচর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন উমেশ জোশী, রাজ কুমার, করুণাময় গোস্বামী, সুধীর চক্রবর্তী, মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী এবং জয়শ্রী ব্যানার্জী প্রমুখ।
উপসংহার: সংগীতের মধ্য দিয়ে মানুষের নানান উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই শিল্পচর্চার ইতিহাসে মানুষের রুচি, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রভাব জানার পাশাপাশি মানবসভ্যতার অগ্রগতি বোঝার ক্ষেত্রেও সংগীতের ইতিহাসচর্চা ক্রমশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
- ধর্মীয় ক্ষেত্রে নৃত্যকলা: প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় ক্ষেত্রে নৃত্যকলার প্রচলন থাকলেও এই নৃত্যকলার সঙ্গে একমাত্র সমাজের উচ্চবর্গের যোগ ছিল, সাধারণ মানুষের কোনো যোগ ছিল না। বিভিন্ন মন্দিরে দেবদাসীদের নৃত্য ব্রাক্ষ্মণ ও উচ্চবর্গীয় মানুষের উপভোগের বিষয় ছিল। প্রচার করা হত, এই রীতি ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপেরই অঙ্গ। নৃত্যকলা থেকে সে যুগের সামাজিক বৈষম্যের পরিচয়ও পাওয়া যায়।
- বিবর্তন: যুগে যুগে নৃত্যকলার বিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীনকালের ধর্মীয় বন্ধন থেকে নৃত্যকলা মুক্তিলাভ করে পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পদ হয়ে উঠেছে। উচ্চবর্গের নৃত্যের পাশাপাশি আদিবাসী-সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের নৃত্যও সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
- বৈচিত্র্য: আধুনিককালে প্রতিটি সমাজের নৃত্যকলাতেই নানা বৈচিত্র্য এসেছে। কত্থক, ভরতনাট্যম, ছৌ, কুচিপুরী, কথাকলি, গৌড়ীয় নৃত্য প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের নৃত্যের সমন্বয়ে ভারতের নৃত্যকলার ভাণ্ডার বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উদয়শঙ্কর, অমলাশঙ্কর, রুক্মিনী দেবী, মল্লিকা সারাভাই, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, অনিতা রত্নম-সহ বিভিন্ন নৃত্যশিল্পী এই বৈচিত্র্য বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন।
- গবেষক ও গবেষণা গ্রন্থ : বিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নৃত্যকলার ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই বিষয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল জে অ্যাডশিড ল্যান্সডেল সম্পাদিত ‘ড্যান্স হিস্ট্রি : অ্যান ইনট্রোডাকশন’, ওয়াং কেফেনের ‘দ্য হিস্ট্রি অব চাইনিজ ড্যান্স’, রাগিনী দেবীর ‘ড্যান্স ডায়ালেক্ট অব ইন্ডিয়া’, আকৃতি সিনহার ‘লেট’স নো ড্যান্সেস অব ইন্ডিয়া’, শোভনা গুপ্তার ‘ড্যান্স অব ইন্ডিয়া’, গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতের নৃত্যকলা’ প্রভৃতি।
উপসংহার: মানব-ইতিহাসে সংস্কৃতির বিবর্তন ও বৈচিত্র্যকে তুলে ধরার কাজে নৃত্যশিল্পের ইতিহাসচর্চা আজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর দ্বারা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি জানা সম্ভব হচ্ছে।
- ইউরোপে নাট্যচর্চা: প্রাচীনকালে ইউরোপে নাট্যচর্চার প্রচলন থাকলেও ইউরোপে আধুনিক নাট্যচর্চা শুরু হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এবং বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে। ইউরোপে শেকসপিয়ার, ক্রিস্টোফার মার্লো, বেন জনসন, জন গলসোর্দি, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখের লেখা বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হলে সেগুলি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
- বাংলায় নাট্যচর্চা: অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে ভারতে বিশেষ করে বাংলায় আধুনিক নাট্যচর্চার প্রসার ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে বাংলা নাট্যচর্চার সূচনা হয় এবং ঊনবিংশ শতকে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত প্রমুখ বাংলা নাটকে অসামান্য অবদান রাখেন।
- মানুষের প্রতিচ্ছবি: বিভিন্ন দেশ বা সমাজে প্রচলিত নাটকগুলিতে সেখানকার সমকালীন ঘটনাবলি, শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি কাহিনি উঠে আসে। ফলে নাটক সেই সমাজের যথাযথ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারে। আবার অনেক সময়ই নাটক লোকশিক্ষা ও জনমত গঠনে সহায়ক হয়ে ওঠে।
- গবেষক ও গবেষণা গ্রন্থ : সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গবেষক যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নাটকের ইতিহাসচর্চা করছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস’, সত্যজীবন মুখোপাধ্যায়ের ‘দৃশ্যকাব্য পরিচয়’, আশুতোষ ভট্টাচার্যের ‘বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস’, সেলিম আল দীনের লেখা ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’, সাইমন জাকারিয়ার লেখা ‘বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক-বৈচিত্র্য’, বালদুন ধিংরার ‘ন্যাশনাল থিয়েটার ফর ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাসচর্চা বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
উপসংহার: সাম্প্রতিককালে নাটকের ইতিহাসচর্চা নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলি তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে।
- চলচ্চিত্র নির্মাণের কেন্দ্র: বিংশ শতকের প্রথমার্ধে আমেরিকার হলিউড এবং ভারতের বোম্বাই, চলচ্চিত্র নির্মাণের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। দাদাসাহেব ফালকের পরিচালনায় ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নির্বাক ছবি ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ মুক্তি পায়। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা (টালিগঞ্জ)।
- কাহিনির বৈচিত্র্য: চলচ্চিত্রের কাহিনির বিষয়বস্তু বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক ঘটনা, সমকালীন সমাজের ঘটনাবলি ও পরিস্থিতি, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ঔপনিবেশিক শাসন, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ফলে চলচ্চিত্র থেকে সমকালীন সমাজের ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়। উদাহরণ হিসেবে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’ প্রভৃতি সিনেমার কথা বলা যায়। যেগুলিতে দেশভাগের বলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জীবন-যন্ত্রণা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
- ইউরোপের চলচ্চিত্রের ইতিহাসচর্চা: চলচ্চিত্রের দীর্ঘ যাত্রাপথের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে আজকাল যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। এই বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ইংরেজি গ্রন্থ হল পাম কুক-এর ‘দি সিনেমা বুক’, ফ্রান্সেসকো ক্যাসেটি-র ‘থিওরিস অব সিনেমা’, জিওফ্রে নাওয়েল স্মিথ-এর ‘দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ প্রভৃতি।
- বাংলায় চলচ্চিত্রের ইতিহাসচর্চা: চলচ্চিত্রের ইতিহাসচর্চায় বাংলাও পিছিয়ে নেই। এই বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা গ্রন্থ হল— ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরও কিছু’, সত্যজিৎ রায়ের ‘একেই বলে শুটিং’ ও ‘বিষয় চলচ্চিত্র’, তপন সিংহের ‘চলচ্চিত্র আজীবন’, অপূর্ব কুমার কুন্ডুর ‘ইউরোপের চলচ্চিত্র’, ‘ভিনদেশী চলচ্চিত্র’, নির্মাল্য আচার্যর ‘শতবর্ষে চলচ্চিত্র’, জাকির হোসেন রাজুর ‘চলচ্চিত্রের চালচিত্র’, ফারহানা মিলির ‘সিনেমা এলো কেমন করে’, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ‘দেখার রকমফের : ঋত্বিক ও সত্যজিৎ’ প্রভৃতি।
উপসংহার: চলচ্চিত্র সবযুগেই সমাজের আয়না হিসেবে কাজ করে চলেছেন। সাম্প্রতিককালে চলচ্চিত্রের ইতিহাসচর্চা সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- স্থাপত্য নির্মাণ : অতীতে একসময় মূলত রাজা-মহারাজা ও ধনী ব্যক্তিরাই স্থাপত্য নির্মাণে আগ্রহ দেখাতেন। বর্তমান যুগে শাসকগোষ্ঠী ছাড়া অন্যান্য মানুষজনও স্থাপত্য নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত।
- স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসচর্চা: স্থাপত্য নির্মাণের প্রেক্ষাপট, শিল্পরীতি, পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি বিষয়গুলি আধুনিক ইতিহাসচর্চায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউরোপ, ভারত তথা বাংলার বিভিন্ন যুগের স্থাপত্যগুলি সাম্প্রতিককালে ইতিহাসচর্চায় স্থান পেয়েছে।
- ভারতে চর্চার সূচনা: ভারতে ঊনবিংশ-বিংশ শতকে স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত ঘটে। এক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন আলেকজান্ডার কানিংহাম, পার্সি ব্রাউন, জে ফার্গুসন, ক্যাথরিন অ্যাশার প্রমুখ।
- বাংলার স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চা: বাংলার বিভিন্ন যুগের স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন গবেষক চর্চা করেছেন এবং করে চলেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জর্জ মিশেল, বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শামসুন্নাহার লাভলী, ড. নাজিমুদ্দিন আহমেদ, রবিউল হুসাইন প্রমুখ।
উপসংহার: সামগ্রিক ইতিহাসের অংশরূপে স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চা আজ শুধু সংস্কৃতির ইতিহাসকেই তুলে ধরে না, অর্থনৈতিক ইতিহাসের নানা দিকও উদ্ঘাটিত করে। পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিকল্পনারও আভাস মেলে স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চায়।
- তথ্য প্রদান: ক্যামেরায় তোলা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। যেমন—জন মুরে, ফেলিক্স বিয়াতো, লাল দীনদয়াল প্রমুখ ফোটোগ্রাফারের তোলা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের বিভিন্ন ছবিগুলি মহাবিদ্রোহের ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের নানা অধিবেশনের ছবিগুলি সেকালের রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিলরূপে বিবেচিত হয়।
- তথ্যকে সমর্থন: ফোটোগ্রাফ বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যকে আরও জোরালো করে তোলে। যেমন—১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া যায় তাকে আরও জোরালো করে তোলে সেই দাঙ্গার বিভিন্ন ছবিগুলি।
- তথ্যের যথার্থতা নির্ণয়: কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে লোকমুখে বহু গুজব বা ভ্রান্ত তথ্য ঘুরে বেড়ালেও সেই ঘটনার বিষয়ে ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে। যেমন—দেশভাগ (১৯৪৭ খ্রি.) এবং তারপরে উদ্বাস্তুদের জীবন-যন্ত্রণার ভয়াবহতা কোনো কোনো রাজনীতিক খাটো করে দেখাতে চাইলেও সমকালীন ফোটোগ্রাফগুলি সেই ভয়াবহতার প্রমাণ দেয়।
- সাবধানতা অবলম্বন : ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফ ব্যবহারের সময় যথেষ্ট সচেতন থাকা উচিত। কেননা, ফোটোগ্রাফার অনেকসময় নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ রাখার উদ্দেশ্যে বা প্রকৃত ঘটনা থেকে পৃথক ছবি তুলে নতুন কিছু দেখানোর উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ কিছু ছবি তুলতে পারেন। সেই ছবিতে ইতিহাসের প্রকৃত তথ্য না-ও দিতে পারে। যেমন—১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে তোলা ছবিতে জিন্না ও গান্ধিজির আন্তরিক সুসম্পর্ক ধরা পড়ে। কিন্তু এই ‘সুসম্পর্ক’ কতটা বাস্তব ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
উপসংহার: আধুনিক কালের ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ফোটোগ্রাফি। . ফোটোগ্রাফির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। তবে সাবধানে ফোটোগ্রাফিকে ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করলে তা ইতিহাসের যথার্থ উপাদান হয়ে উঠতে পারে।
- ছবি আঁকা: মানবসমাজে প্রাগৈতিহাসিক যুগেই ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। চিত্রকররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমকালীন কোনো বিষয়ের ছবি এঁকে থাকেন। তবে সেই ছবিতে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পড়লেও ছবির বিষয়বস্তু যে তথ্যনিষ্ঠ হয়ে থাকে, তা পণ্ডিতরা স্বীকার করেন। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত এরূপ অসংখ্য ছবি সমকালীন ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- চিত্রকলার ইতিহাসচর্চা: বর্তমানে বিভিন্ন পণ্ডিত চিত্রকলার ইতিহাসচর্চা করে চলেছেন। এই চর্চার ক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাকার্য হল অশোক মিত্র রচিত ‘ভারতের চিত্রকলা’, ড. নীলিমা আফরিন রচিত ‘বাংলাদেশের শিল্পকলার উৎস সন্ধান’, সৈয়দ লুৎফল হক রচিত ‘চিত্রকলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ প্রভৃতি।
- গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস হিসেবে ফোটোগ্রাফি: ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ওয়ালকট ক্যামেরা আবিষ্কারের পর থেকে ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তোলা অর্থাৎ ফোটোগ্রাফি চর্চার বিষয়টি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাধারণ ক্যামেরায় সাদা-কালো ও রঙিন ছবির যুগ পেরিয়ে বর্তমানে ডিজিট্যাল ক্যামেরায় উন্নতমানের ছবি তোলা সম্ভব হচ্ছে। ফোটোগ্রাফাররা ক্যামেরার সাহায্যে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের যথার্থ ছবি তোলেন, যা পরবর্তীকালে ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজে লাগে।
- গবেষণ: বর্তমানকালে বিভিন্ন গবেষক ফোটোগ্রাফি নিয়ে ইতিহাসচর্চা করছেন। এই বিষয়ে এ কে এম মহসীন, মহম্মদ হুমায়ূন কবীর, জন ওয়েড, আর ডগলাস নিকেল প্রমুখ গবেষণা করেছেন।
উপসংহার: ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আঁকা ছবি ও ফোটোগ্রাফ—দুটিই ইতিহাসচর্চার কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফ অনেকটাই জীবন্ত, এবং আধুনিক ইতিহাসচর্চায় এর প্রাসঙ্গিকতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- ইউরোপে প্রভাব: আধুনিক যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইউরোপের ইতিহাসকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। জাতীয় ঐক্য বৃদ্ধি, শিল্পবিপ্লব প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
- ভারতে প্রভাব : আধুনিক যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে ভারতের রেল, সড়ক, ডাক প্রভৃতি ব্যবস্থা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও ঐক্য বৃদ্ধি করে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছে। এর দ্বারাই ব্রিটিশ শক্তি নির্বিচারে ভারতীয় অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করেছে। আবার রেলপথ ব্যবহার করে ভারতে বিপ্লবী কার্যকলাপ, বিপ্লবীদের পলায়ন ইত্যাদিও সম্ভব হয়েছে।
- অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা: সাম্প্রতিককালে ইনটারনেট ব্যবস্থা সমগ্র বিশ্বে নিমেষে যোগাযোগ স্থাপন করার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে আজ সমগ্র বিশ্ব যেন ঘরের দোরগোড়ায় চলে এসেছে। এখন যে কোনো তথ্য বা খবর নিমেষে বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ায় এর দ্বারা বিশ্ব ইতিহাস যথেষ্ট প্রভাবিত হচ্ছে।
- যানবাহন যোগাযোগ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক গবেষণা: বিংশ শতকে যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই বিষয়ে জন আর্মস্ট্রং, ইয়ান কের, সুনীল কুমার মুন্সি, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, আর আর ভাণ্ডারী প্রমুখ গবেষণা করেছেন।
- ইনটারনেট সংক্রান্ত ঐতিহাসিক গবেষণা : সম্প্রতি ইনটারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে নানা গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন প্রকাশ চক্রবর্তী, ফ্রেডরিখ কিটলার, নারায়ণ চন্দ্র বসাক, প্রশান্ত রায় প্রমুখ।
উপসংহার: সামগ্রিক বিচারে দেখা যায়, যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইতিহাসের গতিকে প্রভাবিত করেছে। যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ইতিহাসের অনেক দিককে তুলে ধরেছে।
- শহরের ইতিহাসের গুরুত্ব: স্থানীয় ইতিহাসচর্চার মতো শহরের ইতিহাসচর্চাও অনেকটাই ক্ষুদ্র অঞ্চল নিয়ে হয়ে থাকে। কিন্তু শহরগুলি কোনো বৃহৎ ভূখণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হয় ওঠায় দেশ বা জাতির ইতিহাসে শহরের ইতিহাসচর্চার বিশেষ গুরুত্ব থাকে। যেমন বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসচর্চায় কলকাতা শহরের উদ্ভব ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
- শহরের ইতিহাসের বিষয়: শহরের ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল শহরের আর্থসামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক চর্চা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের উন্নতি, শিল্প-সংস্কৃতির ধারা, ধর্মের প্রভাব, নগরায়ণ প্রক্রিয়া প্রভৃতি।
- ইউরোপে শহরের ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত: বিংশ শতকের প্রথমার্ধে শহরের ইতিহাসচর্চার প্রচলন থাকলেও এই বিষয়ে ইতিহাসচর্চায় গতি আসে ১৯৭০-এর দশকে। এই সময়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন থার্নস্টর্মের নেতৃত্বে শহরের ইতিহাসচর্চার ধারাটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এডুইন বরোজ, মাইক ওয়ালেস, এস জি বেকল্যান্ড, রোনাল্ড টেলর প্রমুখ এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেন।
- ভারতে শহরের ইতিহাসচর্চা : ভারতীয় গবেষকদের মধ্যে নারায়ণী গুপ্তা দিল্লি নিয়ে, রীনা ওল্ডেনবার্গ লখনউ দিয়ে, ক্রিস্টিন ডবিন মুম্বই নিয়ে, যতীন্দ্রমোহন রায় ঢাকা নিয়ে, রাধারমণ মিত্র কলকাতা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন। শহরের ইতিহাসচর্চা নিয়ে বাংলায় যাঁরা গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে রাধারমণ মিত্র, ড. সৌমিত্র শ্রীমানী, বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনতাসীর মামুন, যতীন্দ্রমোহন রায় ও শামসুদ্দোহা চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার: শহরের ইতিহাসচর্চা আজ সামগ্রিক ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলত শহরের প্রকৃতি আলোচনাই এই ইতিহাসচর্চার মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- ধারাবাহিক পরিবর্তন প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিটি দেশ, জাতি ও সভ্যতায় সামরিক কাঠামো, যুদ্ধাস্ত্র প্রভৃতির ধারাবাহিক পরিবর্তন ঘটেছে। সামরিকবাহিনীতে পদাতিক, রথ বা হস্তিবাহিনীর পরিবর্তে বর্তমানে ট্যাংক বা সাঁজোয়াবাহিনী, বিমানবাহিনী প্রভৃতি এবং তিরধনুক, তরবারি প্রভৃতির পরিবর্তে কামান, বন্দুক, বোমা, বিষাক্ত গ্যাস প্রভৃতির প্রচলন ঘটেছে।
- সামরিক ইতিহাসচর্চার প্রসার: ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত যুদ্ধ-সংক্রান্ত আলোচনা যুদ্ধের কারণ ও ফলাফলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানকালে এই ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক সজ্জা, রণকৌশল, সামরিক পোশাক প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ও ইতিহাসচর্চার মধ্যে প্রবেশ করেছে।
- ইউরোপে সামরিক ইতিহাসচর্চা: বিংশ শতকে ইউরোপে সামরিক ইতিহাসচর্চার প্রসার ঘটে। বার্নেট, কোরেলি, শেলফোর্ড বিডওয়েল, জন টেরাইন প্রমুখ প্রাচীন ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার তুলনামূলক গবেষণা করেছেন। রজার স্পিলার, জন হোয়াইট ক্লে প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত নানা কিংবদন্তিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন।
- ভারতে সামরিক ইতিহাসচর্চা: ভারতে বিগত শতকে সামরিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন। এ ছাড়া রবার্ট আর্ম, সুবোধ ঘোষ, দীপ্তনীল রায়, নিখিলেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ এবিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালের সামরিক ইতিহাসচর্চায় কৌশিক রায় একটি অগ্রগণ্য নাম।
উপসংহার: রাষ্ট্র তার সামরিক শক্তির দ্বারা যুদ্ধবিগ্রহ, সাম্রাজ্যবিস্তার প্রভৃতির মাধ্যমে ইতিহাসের ঘটনাবলিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় সামরিক ইতিহাসচর্চা আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
- পরিবেশের ধ্বংসসাধন: আধুনিককালে যুদ্ধে বিভিন্ন ভয়ানক মারণাস্ত্রের ব্যবহার, কৃষি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার, গাছপালা কেটে আধুনিক নগর ও শিল্পসভ্যতার প্রসার প্রভৃতির ফলে আমাদের চারিদিকের পরিবেশ ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
- দূষণ: জল, বায়ু, খাদ্য, শব্দ প্রভৃতি দূষণ বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, দূষণের মাত্রা এই রকম হারে বাড়তে থাকলে অদুর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ তথা জীবকূলের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ লুপ্ত হতে পারে।
- আন্দোলন: পরিবেশের ধ্বংসসাধন ও দূষণের সম্পর্কে মানুষ ক্রমাগত সচেতন হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে পরিবেশবাদী নানা আন্দোলন। ভারতে চিপকো আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, তেহরি-গাড়োয়াল আন্দোলন প্রভৃতি পরিবেশবাদী আন্দোলন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
- ইউরোপে পরিবেশের ইতিহাসচর্চা: সাম্প্রতিককালে ইউরোপে পরিবেশের ইতিহাসচর্চার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। এই বিষয়ে ইউরোপের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম হল র্যাচেল কারসন রচিত ‘সাইলেন্ট স্প্রিং, আলফ্রেড ক্রসবি রচিত ইকোলজিক্যাল ইম্পিরিয়ালিজম’, রিচার্ড গ্রোভ রচিত “গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজম প্রভৃতি।
- ভারতে ও বাংলায় পরিবেশের ইতিহাসচর্চা: পরিবেশের ইতিহাস নিয়ে সাম্প্রতিককালে ভারতে এবং বাংলায়ও যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। ইরফান হাবিব, ড. মণীষ প্রধান, সুধাংশু পাত্র, অশোক কুমার বসু, তরুণ সরকার, অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শমিত কর, সাহিদা বেগ এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
উপসংহার: মানবসভ্যতার সমস্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিবেশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই পরিবেশ ইতিহাসচর্চার বিকাশ ও অগ্রগতি বর্তমানে বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
- প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি : প্রাচীনকালে মিশর, ব্যাবিলন, গ্রিস, ভারত প্রভৃতি দেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি খুব ধীরগতিতে হয়েছিল। তবে মধ্যযুগে এসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে কৃষি, যুদ্ধাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে।
- আধুনিক যুগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি: আধুনিককালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা, কৃষি, শিল্প, যুদ্ধসহ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ করা যায়।
- ভৌগোলিক আবিষ্কার ও শিল্পবিপ্লব: পঞ্চদশ শতকে স্পেন, পোর্তুগাল, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পে অগ্রগতিও পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে সংঘটিত শিল্পবিপ্লব আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি সারা বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
- গবেষণা গ্রন্থ : বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম হল জে ডি বার্নাল রচিত ইতিহাসে বিজ্ঞান’, টমাস কুহ রচিত ‘দ্য স্ট্রাকচার অব সায়েন্টিফিক রেভোলিউশনস্’, ডেভিড আরনল্ড রচিত ‘সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড মেডিসিন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রচিত ‘এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও সমাজ’ এবং ‘প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’, দীপক কুমার রচিত ‘সায়েন্স অ্যান্ড দ্য রাজ’, তপন চক্রবর্তী রচিত ‘শতবর্ষে বাঙালির বিজ্ঞানসাধনা’ প্রভৃতি।
উপসংহার: সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির হাত ধরেই মানবসভ্যতা ক্রমশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। তাই মানবসভ্যতার ইতিহাস রচনায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ইতিহাসচর্চা অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- বিবর্তন : প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে চিকিৎসাবিদ্যার নানা পরিবর্তন, উন্নতি ও বিবর্তন ঘটেছে। ফলে আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, আকুপাংচার প্রভৃতি চিকিৎসাবিদ্যার নানা শাখার উদ্ভব ঘটেছে।
- ভারতে অগ্রগতি: ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল বলে জানা যায়। কুষাণ যুগ, গুপ্ত যুগ এবং তার পরবর্তীকালে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ভারতীয় চিকিৎসকদের নাম জানা যায়। তবে মধ্যযুগে এসে ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি থমকে যায়।
- প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে চিকিৎসাবিদ্যা: আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি প্রথম ইউরোপে শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তির মাধ্যমে তা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে মধ্যযুগীয় পিছিয়ে-পড়া চিকিৎসাবিদ্যা ঔপনিবেশিক আমলে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার প্রচলন ঘটে।
- গবেষক ও গবেষণা গ্রন্থ : সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশে চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিজ্ঞান’, পার্থসারথি চক্রবর্তী রচিত ‘চিকিৎসা-বিজ্ঞানের আজব কথা’, তপন চক্রবর্তী রচিত ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস’ প্রভৃতি।
উপসংহার: প্রাচীনকাল থেকে ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চিকিৎসাবিদ্যা আজ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। চিকিৎসাবিদ্যার এই বিবর্তনের কথা চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়েই জানা যায়।
- ইতিহাসে নারীর ভূমিকা : যুগে যুগে ইতিহাসে নারীর আসামান্য অবদান রয়েছে। নেফারতিতি, ক্লিওপেট্রা, রাজিয়া, নূরজাহান, দুর্গাবতী প্রমুখ নারী নিজের যোগ্যতার দ্বারা প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজনৈতিক ক্ষমতার অসীম আধারে পরিণত হয়েছিলেন। বিংশ-একবিংশ শতকেও বিভিন্ন দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির ওপর বিশ্বের বিভিন্ন নারী প্রাধান্য বিস্তার করেছেন।
- ইতিহাসে নারীর বঞ্চনা: ইতিহাসের আলোচনায় পুরুষের আন্দোলন, যুদ্ধ, রাজনীতি, কূটনীতি প্রভৃতি গুরুত্ব পেলেও নারীদের নেতৃত্ব, অধিকার, দাবিদাওয়া, আন্দোলন, মর্যাদা, শিক্ষাসংস্কৃতি প্রভৃতির যথেষ্ট আলোচনা ইতিহাসে করা হত না।
- নারী ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত: ইতিহাসে নারীদের ভূমিকা নিয়ে আধুনিককালে গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে এবং পুরুষের সঙ্গে নারী ইতিহাসের চর্চাও গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে নারী ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত ঘটেছে।
- পাশ্চাত্যে নারী ইতিহাসচর্চা : সম্প্রতি পাশ্চাত্যে নারীবাদী ইতিহাসচর্চাবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি লিখেছেন জোয়ান কেলি, গের্ডা লার্নার, বেটি ফ্রিডান, কেটলিন মোরান, জেসিকা ভ্যালেন্টি, জুডিথ বাটলার প্রমুখ গবেষক।
- ভারতে নারী ইতিহাসচর্চা: ভারতে নারী ইতিহাসচর্চা করেছেন নীরা দেশাই, জেরান্ডিন ফোর্বস, বি আর নন্দ, কমলা ভাসিন প্রমুখ ইতিহাসবিদ এবং বাংলায় দীনেশচন্দ্র সেন, রামেন্দ্র চৌধুরী, শ্রীমন্মথনাথ সরকার, রাজশ্রী বসু, চিত্রা দেব, মালেকা বেগম, মাহমুদ শামসুল হক প্রমুখ এই ব্যাপারে চর্চা করেছেন।
উপসংহার: নারীদের ভূমিকাকে বাদ দিয়ে ইতিহাসচর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই বর্তমান যুগের ইতিহাসচর্চায় নারী ইতিহাসচর্চা অবশ্যই অপরিহার্য।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – B আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান ব্যবহারের পদ্ধতি
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- সরকারি নথিপত্র: ব্রিটিশ শাসনকালে সরকারি নথিপত্রগুলি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হত। এসব নথিপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—[i] বিভিন্ন সরকারি চিঠিপত্র, [ii] পুলিশ, গোয়েন্দা ও সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন, [iii] সরকারি ব্যক্তিদের বিবরণ প্রভৃতি। এসব নথিপত্র ঘেঁটে কোনো ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায় এবং ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা: বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা প্রভৃতিতে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। এরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’, মহাত্মা গান্ধির ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ দ্য ট্রুথ’, সুভাষচন্দ্র বসুর অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ (অসমাপ্ত), জওহরলাল নেহরুর অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রভৃতি।
- চিঠিপত্র: বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা চিঠিপত্র আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার গুরত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য চিঠিপত্র হল টিপু সুলতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের লেখা চিঠিপত্র।
- সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র : সমকালীন বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র আধুনিক ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত হয়। ‘বেঙ্গল গেজেট’, ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’, ‘সংবাদ কৌমুদি’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এনকোয়ারার’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’, ‘কেশরী, ‘মারাঠী’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা আধুনিক ভারতের ইতিহাসের নানা তথ্য সরবরাহ করে থাকে।
উপসংহার: আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানের প্রায় সবগুলিই লিখিত উপাদান। সংখ্যায় এবং বৈচিত্র্যে এগুলির অধিক সংখ্যায় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কাজকে অনেক সহজ করে তুলেছে।
- বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড : ব্রিটিশ সরকার যে বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রতি গোপনে নজরদারি চালাত, সে বিষয়ে সমকালীন পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র থেকে বর্তমানে সম্ভব হয়েছে।
- কমিশনের রিপোর্ট: সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বিভিন্ন কমিশনের রিপোর্ট থেকে সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যাদি পাওয়া যায়। যেমন—নীল কমিশনের (১৮৬০ খ্রি.) রিপোর্ট থেকে বাংলা চাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার, হান্টার কমিশনের (১৮৮২ খ্রি.) রিপোর্ট থেকে সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানা যায়।
- আন্দোলন দমনের নীতি: ব্রিটিশ সরকার কীভাবে ভারতীয়দের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি দুর্বল বা দমন করার চেষ্টা চালাত সে বিষয়ে বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র, বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন আধিকারিকদের চিঠিপত্র থেকে জানা যায়। যেমন—সরকার গোপনে কংগ্রেসকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়েছিল, বাঙালির রাজনৈতিক ঐক্য ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কার্জন বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন প্রভৃতি তথ্যাদি সরকারি চিঠিপত্র থেকে জানা যায়।
-
ভারতীয়দের সংস্কার : সমকালীন ভারতীয়দের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যাবলির প্রতি সরকারের মনোভাব মোটেই ভালো ছিল না—তা জানার জন্য সরকারি নথিপত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ পাশ্চাত্যকে মুগ্ধ করলেও তৎকালীন ব্রিটিশ- ভারতের সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, বিবেকানন্দের রামকৃয় মঠ ও মিশনকে সরকার সুনজরে দেখেনি।
- একমাত্র নির্ভরযোগ্যতা: কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি নথিপত্র ভারত-ইতিহাসের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেমন—বর্তমান তথ্যাদির সহায়তায় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা করা সম্ভব না হওয়ায় অনেকে একমাত্র সরকারি নথিপত্র প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
উপসংহার: সরকারি নথিপত্র হল এমন একটি উপাদান, যা ইতিহাসের অনেক লুকোনো দিক খুঁজে বের করে এনে দিতে পারে। শাসকের কার্যকলাপ জানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হল এই সরকারি নথিপত্র।
- প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ : বিভিন্ন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনাবলি প্রসঙ্গক্রমে তাঁদের লেখা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক রচনায় উল্লেখ করে থাকেন। সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ নেই এমন বহু ঘটনার উল্লেখ এসব রচনায় পাওয়া যায়। এসব তথ্য আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনা করতে বিশেষ সহায়তা করে।
- রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের লেখা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় ব্রিটিশ শাসনকালের নানা ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা হল বিপিনচন্দ্রের পালের ‘সত্তর বৎসর’, মহাত্মা গান্ধির ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’, সুভাষচন্দ্র বসুর ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ (অসমাপ্ত), জওহরলাল নেহরুর ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের ‘আত্মকথা’, মুজাফ্ফর আহমেদের ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (১৯২০-২৯ খ্রি.)’, মণিকুন্তলা সেনের ‘সেদিনের কথা’, জ্যোতি বসুর ‘যতদূর মনে পড়ে’ প্রভৃতি।
- অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রচনা: বিভিন্ন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের লেখা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায়ও আধুনিক ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান পাওয়া যায়। এরূপ রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’, সরলা দেবী চৌধুরানির ‘জীবনের ঝরাপাতা’, নিরোদ সি চৌধুরীর ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়া’, দক্ষিণারঞ্জন বসুর ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ প্রভৃতি।
উপসংহার: উত্তম পুরুষে লেখা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাগুলি ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী। বিশেষ বিশেষ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানার ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- ইতিহাসের উপাদান: বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’ আধুনিক বাংলার নানা ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ। গ্রন্থটি সম্পর্কে বিপিনচন্দ্র নিজেই লিখেছেন, “….আমার সত্তর বৎসরের জীবনকথা বাস্তবিক এই বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসের কথা।”
- প্রথম জীবনের তথ্য: ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থের শুরুতে বিপিনচন্দ্রের প্রথম জীবনের বিভিন্ন তথ্য, যেমন—শ্রীহট্ট জেলার পৈল গ্রামে তাঁর জন্ম, তাঁর বংশ ও গ্রামের পরিচয়, শৈশবে শ্রীহট্ট জেলার নানা ঘটনা, স্কুলের পড়াশোনার পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করতে আসা প্রভৃতি বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
- রাজনৈতিক জীবনের সূচনা: ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থে বিপিনচন্দ্ৰ পালের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বের বিভিন্ন তথ্যেরও উল্লেখ আছে। কলকাতায় এসে জাতীয় নেতা আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, ব্রাহ্বসমাজে যোগদান, শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ, স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রভৃতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিপিনচন্দ্র তাঁর এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
- পরিণত জীবনের তথ্য: বিপিনচন্দ্র পাল পরিণত বয়সে যখন কংগ্রেসের নেতৃত্বে উঠে আসেন সেসময়ের বিভিন্ন তথ্যাদি তাঁর আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে। পুরোনো কলকাতার কথা, ব্রাহ্বসমাজের ইতিহাস, ধর্মভীরু বাঙালির জাতীয়তাবাদী মানসিকতা, স্বদেশি, বয়কট ও পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে আন্দোলন প্রভৃতির নানা দিকের আলোচনা তাঁর গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
উপসংহার: বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর ‘সত্তর বৎসর’ নামক আত্মজীবনীতে যে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে এক ব্যক্তিনিরপেক্ষ সমাজদর্শন। সমকালীন সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে তাঁর এই গ্রন্থটিতে।
- বাঙালির স্বাদেশিকতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে ঔপনিবেশিক বাংলার, বিশেষ করে কলকাতার ধনী পরিবারগুলির জীবনযাত্রার আভাস দিয়েছেন। এ যুগে অভিজাত বাঙালি পরিবারের বিভিন্ন বিদেশি প্রথার প্রচলন শুর হলেও স্বদেশের প্রতি অনুরাগও জাগ্রত ছিল। তাঁরা সন্তানদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা এবং পাশ্চাত্যশিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলেও বাংলা ভাষা ও শিক্ষার প্রতি অনুরাগও লক্ষ করা যায়।
- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল: ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে বৃহৎ পরিবার, শিশুদের বাল্যকাল, নারীদের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিভিন্ন ঘটনার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এগুলি থেকে সমকালীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের নানা তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “আমাদের বাড়িতে দাদারা চিরকাল মাতৃভাষায় চর্চা করিয়া আসিয়াছিলেন। আমার পিতাকে তাঁহার কোনো নূতন আত্মীয় ইংরেজিতে পত্র লিখিয়াছিলেন, সে পত্র লেখকের নিকটে তখনই ফিরিয়া আসিয়াছিল।”
- রাজনৈতিক ঘটনাবলি: ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্বাদেশিকতার সভা, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে ধুতি ও পায়জামার সমন্বয়ে ভারতের একটি সর্বজনীন পরিচ্ছদ প্রচলনের চেষ্টা, স্বদেশি দেশলাই কারখানা বা কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠায় যুবকদের উদ্যোগ প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন।
- হিন্দুমেলা : ‘জীবনস্মৃতি’-তে নবগোপাল মিত্রের ‘হিন্দুমেলা’ সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়। ‘হিন্দুমেলা’র স্বদেশপ্রেম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে, “ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়। মেজদাদা (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর) সেই সময়ে বিখ্যাত জাতীয় সংগীত ‘মিলে সবে ভারতসন্তান’ রচনা করেছিলেন।”
উপসংহার: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ মূলত তাঁর নিজের আত্মজীবনী হলেও এই গ্রন্থে তাঁর সমকালীন বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য আলোচিত হয়েছে যেগুলি আধুনিক ভারতের ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান।
- বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড : সরলা দেবী চৌধুরানি ভারতের ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। তিনি সহিংস বিপ্লবের দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনেরও স্বপ্ন দেখতেন। জীবনের ঝরাপাতা’র ছত্রে ছত্রে ভারতের সশস্ত্র বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নানা তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তিনি নিজেও যে এই ধরনের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে জানা যায়।
- অর্থনৈতিক শোষণ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে অর্থনৈতিক শোষণের নানা ছবি ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। নীলচাষি, চা বাগানের কুলি ও শ্রমিক, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কীভাবে ব্রিটিশ এবং তাদের সহযোগীদের অত্যাচার ও শোষণের শিকার হয়েছিল তা সরলা দেবী চৌধুরানি তাঁর গ্রন্থে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।
- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল: ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের বিভিন্ন ঘটনা। যেমন— ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক চর্চা, ঈশ্বরভাবনা, বিভিন্ন সামাজিক বিধান পালন, শিশুদের একসঙ্গে বাড়তে থাকা প্রভৃতি নানা ঘটনার খণ্ডচিত্র ‘জীবনের ঝরাপাতা’-য় উঠে এসেছে। এগুলি আধুনিক বাংলার সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
- স্বদেশি আন্দোলন : ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় পাওয়া যায়। স্বদেশি আন্দোলনের যুগে স্বদেশি পণ্যের উৎপাদন ও প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।
- রবীন্দ্রনাথ ও স্বামী বিবেকানন্দ : সরলা দেবী চৌধুরানি সে যুগের দুই মনীষী রবীন্দ্রনাথ ও স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে যোগসূত্র ছিলেন। এই দুই মনীষীর প্রতি সরলা দেবীর কেমন দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন ছিল তা বই থেকে জানা যায়।
উপসংহার: সরলা দেবী চৌধুরানির আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ আধুনিক ভারত ইতিহাসের এক সংগ্রামী অধ্যায়কে তুলে ধরে। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে নানান আলোড়ন জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর এই গ্রন্থে।
- গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র: ব্রিটিশ শাসনকালে লেখা আধুনিক ভারতের ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ এরূপ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র হল টিপু সুলতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের লেখা চিঠিপত্র। এ ছাড়া রয়েছে সাধারণ মানুষের লেখা বিপুল সংখ্যক চিঠিপত্র।
- রাজনৈতিক তথ্য: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের লেখা চিঠিপত্রগুলি থেকে সমকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে যথার্থ তথ্য পাওয়া যায়। যেমন—ব্রিটিশ সরকারকে লেখা গান্ধিজির বিভিন্ন চিঠিপত্র থেকে ভারতের সমকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা এবং সেগুলির প্রতি ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব সম্পর্কে জানা যায়।
- সামাজিক তথ্য: বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের চিঠিপত্রে সমকালীন সমাজ- সংস্কৃতি নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এসব চিঠিপত্র থেকে সমকালীন ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যাদি জানা যায়।
- শিক্ষা : ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলিতে অনেক সময় শিক্ষামূলক ঐতিহাসিক তথ্যও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। যেমন—ছোট্ট ইন্দিরা গান্ধিকে তাঁর পিতা জওহরলাল নেহরুর লেখা চিঠিপত্রগুলিতে বিশ্ব-ইতিহাসের নানা ঘটনা স্থান পেয়েছে।
- সাধারণ মানুষের মতামত: যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা বড়ো কোনো রাজনৈতিক ঘটনার মানুষ যে প্রচুর চিঠিপত্র লিখে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে তা থেকে সেই বিষয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায় । যেমন—দেশভাগের প্রেক্ষাপটে ভারতের সাধারণ মানুষ এই বিষয়টিকে কী চোখে দেখেছে তা সমকালীন বিভিন্ন সাধারণ মানুষের লেখা চিঠিপত্র থেকে জানা যায়।
উপসংহার: বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা চিঠিপত্রগুলি আধুনিক ভারতের ইতিহাসের নানান তথ্য তুলে ধরেছে। তাই চিঠিপত্র হয়ে উঠেছে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান।
- পিতার উপদেশ : পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ জেল থেকে মহীশূরে তাঁর ১০ বছর বয়সি কন্যা ইন্দিরা গান্ধিকে অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন। এরূপ ৩০টি চিঠির একটি সংকলন পরবর্তীকালে ‘Letters from a Father to His Daughter’ শিরোনামে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই চিঠির সংকলন হল কন্যার প্রতি একজন স্নেহময় পিতার অমূল্য তত্ত্বাবধান ও উপদেশ।
- উদ্দেশ্য : জওহরলাল নেহরু তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে আমাদের বিশ্বের বিভিন্ন বিস্ময়, প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং সভ্যতার গল্প শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এসব চিঠি লিখেছিলেন।
- সভ্যতার প্রতিষ্ঠা: বুদ্ধি কীভাবে মানুষকে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে চতুর ও শক্তিশালী করে তুলল, কীভাবে ধর্মবিশ্বাসের প্রচলন হল, অর্থবহ শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে কীভাবে ভাষার উদ্ভব হল, প্রাচীনকালে কীভাবে সমাজ, সভ্যতা, রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হল প্রভৃতি বিষয়ে সহজ ভাষায় সুন্দর গল্প লিখে জওহরলাল তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে পাঠাতেন।
- সভ্যতার অগ্রগতি: প্রাচীন ভারতে সভ্যতার অগ্রগতি, আর্যদের আগমন, রামায়ণ ও মহাভারতের আদর্শ, শক্তিশালী রাজবংশ, দরিদ্রশ্রেণির দুরবস্থা প্রভৃতির আলোচনাও জওহরলাল নেহরুর চিঠিপত্রে স্থান পেয়েছে।
উপসংহার: পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর কন্যা ছোট্ট ইন্দিরাকে বিভিন্ন চিঠির মাধ্যমে সমাজ, দেশ ও বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে যে সকল বিষয়ের অবতারণা করেছেন তাতে ভারতের ইতিহাসের বহু দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। চিঠির মধ্যে সুন্দর গল্পগুলো হয়ে উঠেছে ভারতের ইতিহাসের এক অনন্য উপাদান।
- বিভিন্ন সংবাদপত্র: যেসব সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র রূপে স্বীকৃত ঐতিহাসিক উপাদান যেমন ‘বেঙ্গল গেজেট’, ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’, ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সম্বাদ প্রভাকর’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘সন্ধ্যা’, ‘কেশরী’, ‘মারাঠী’ প্রভৃতি।
- রাজনীতি: ব্রিটিশ শাসনকালে প্রকাশিত সাময়িকপত্র সংবাদপত্রগুলিতে সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাবলি, যেমন— ব্রিটিশদের শাসননীতি, ভারতীয়দের মনোভাব প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব তথ্য আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার সময় যথেষ্ট সহায়তা করতে পারে।
- সমাজ: সমকালীন ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিতে উচ্চবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ক বিভিন্ন ঘটনার খবরাখবর নিয়মিত ছাপা হত। এসব তথ্যাদি থেকে ব্রিটিশ-ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে নানা ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।
- শোষণ : আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশ শোষণ ও অত্যাচারের নানা ঘটনাবলি সমসাময়িক সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত ছাপা হত। এসব তথ্যাদি শোষণ ও অত্যাচারের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- অসন্তোষ : ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা বিভিন্ন বিদ্রোহ-আন্দোলন শুরু করে। এসব খবর নিয়মিত সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত হত। এসব খবরের তথ্যাদি আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় খুবই সাহায্য করে।
- জনমতের প্রতিফলন: বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা সমকালীন সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত হয়। ফলে সংবাদপত্রগুলিতে সমকালীন সাধারণ মানুষের মতামতেরও প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়।
উপসংহার: সার্বিক ও সাম্প্রতিক তথ্যে সমৃদ্ধ সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলি সমকালীন সময়ের প্রতিদিনকার তথ্য সরবরাহ করে থাকে। তাই আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- আত্মপ্রকাশের কাল: সাময়িকপত্রের আবির্ভাব অষ্টাদশ শতকে। কিন্তু রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময় থেকেই, অর্থাৎ জিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্বেই সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে বলে মনে করা হয়।
- আকৃতি: আকৃতি এবং দৃশ্যমানতার ক্ষেত্রেও সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ে। সাময়িকপত্রগুলির পৃষ্ঠা আকারে ছোটো হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বইয়ের মতো বাঁধাই করা থাকে। আর সংবাদপত্রগুলির পৃষ্ঠা আকারে বড়ো হয় এবং তার পৃষ্ঠাগুলি খোলা থাকে।
- প্রকাশের সময়কাল: সাময়িকপত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়। সেই ব্যবধান এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ বা এক মাসও হতে পারে। কিন্তু সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় প্রতিদিন, এমনকি দিনে দুইবারও কোনো কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
- প্রকাশনার পার্থক্য: সাময়িকপত্রে সমকালীন খবরাখবরগুলি ছাড়াও কোনো মৌলিক রচনা বা গবেষণাকর্ম যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সংবাদপত্রে গবেষণামূলক প্রবন্ধের পরিবর্তে সাম্প্রতিক খবর পরিবেশনই বেশি গুরুত্ব পায়।
- প্রকাশনার বিষয়: সাময়িকপত্র কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিকও হতে পারে। যেমন—শুধু ইতিহাসচর্চার ওপর ভিত্তি করে এবং ইতিহাসের খবরাখবর ও গবেষণা নিয়ে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে কোনো সাময়িকপত্র প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু সংবাদপত্রগুলির অধিকাংশই হয় সার্বিক। অর্থাৎ সাম্প্রতিক সমস্ত বিষয়ের খবরাখবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়।
উপসংহার: সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সমকালীন ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের কাজে উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার কাজে এই দুটি উপাদান আজ ভীষণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
- পত্রিকার প্রকাশ : ‘বঙ্গদর্শন’ ছিল ব্রিটিশ শাসনকালে প্রকাশিত একটি বিখ্যাত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি প্রকাশের প্রথম থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এর সম্পাদক, লেখক ও প্রধান পরিচালক।
- শিক্ষিত সমাজের মুখপত্র: ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশের পর থেকেই তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি সমাজের প্রধান মুখপত্র হয়ে ওঠে। এই পত্রিকাতেই বাঙালি জাতির আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটত। বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও গঙ্গাচরণ, রামদাস সেন, অক্ষয় সরকার, চন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ প্রতিভাবান লেখক এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।
- সমকালীন তথ্য: ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় সমাজ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ ও বিভিন্ন উপন্যাস প্রকাশিত হত। এসব রচনা থেকে সেসময় বাংলায় ইংরেজ সরকার ও জমিদারের শোষণ ও অত্যাচার, সামাজিক পরিস্থিতি, সাধারণ মানুষের অবস্থা, সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়।
- প্রভাব : [i] ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার দ্বারা সমকালীন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। [ii] বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি প্রথম ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। ‘বন্দেমাতরম’ পরবর্তীকালে ভারতীয় বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল মন্ত্রে পরিণত হয়। [iii] ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত ‘সাম্য’সহ বিভিন্ন প্রবন্ধ বাঙালি সমাজে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসারে যথেষ্ট সহায়তা করে।
উপসংহার: বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটি সমকালের ঘটনাবলিকে যেভাবে তুলে ধরত তা আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার আবার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ভারতের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার উদ্দ্গাতা এই পত্রিকা সমাজে স্বদেশপ্রেমের মন্ত্র প্রচার করেছিল।
- পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ও অস্তিত্বকাল: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় কলকাতা সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (১৮১৯-১৮৮৬ খ্রি.) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ করেন। তিনিই ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের প্রায় ৩০ বছরের বিভিন্ন সংবাদ, তৎকালীন বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।
- দরিদ্র চাষিদের সমর্থন: ‘সোমপ্রকাশ’ দরিদ্র চাষিদের সমর্থনে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করে। এই পত্রিকা কৃষকদের দিয়ে জোর করে নীল ও চা-চাষের প্রতিবাদ করে। এর ফলে শিক্ষিত বাঙালি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
- রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা: বাংলায় ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকাতেই প্রথম রাজনৈতিক খবরাখবর পরিবেশন শুরু হয়। পত্রিকায় নিয়মিত ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার, সামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা প্রভৃতি ঘটনাগুলি তুলে ধরে পাঠকদের সচেতন করে তোলা হয়।
- সামাজিক সচেতনতাবৃদ্ধিতে ভূমিকা : বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, মদ্যপান প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং ইলবার্ট বিল, নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ প্রভৃতির পক্ষে নিয়মিত রচনা প্রকাশ করে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা এসব বিষয়ে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সংবাদপত্র আইনের প্রতিবাদ: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড লিটন ‘দেশীয় সংবাদপত্র আইন’ পাস করে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির ওপর হস্তক্ষেপ করলে ‘সোমপ্রকাশ” এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। আইনের দ্বারা পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হলেও কিছুদিন পর তা আবার চালু হয়।
উপসংহার: ব্রিটিশ কুশাসনের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা। এই পত্রিকাটি সমকালীন ভারতীয় আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির বর্ণনা প্রদান করে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে।
- তথ্যের সহজলভ্যতা : ইনটারনেটের সহায়তায় অতি সহজে এবং ঘরে বসে ইতিহাস-সহ দুনিয়ার যাবতীয় তথ্য জেনে নেওয়া যায়। অন্য কোনো মাধ্যম থেকে এরূপ সহজে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
- স্বল্প অর্থব্যয়: বিভিন্ন বইপত্র কিনে, গ্রন্থাগার বা গবেষণাগারে নিয়মিত যাতায়াত করে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করতে হয়, তা ইনটারনেটের ক্ষেত্রে করতে হয় না। খুব সামান্য অর্থব্যয় করে ইনটারনেটের মাধ্যমে সেসব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
- সময় সাশ্রয় : বইপত্র বা অন্য কোনো সূত্র থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু ইনটারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হয় না। এমনকি, ইনটারনেট থেকে প্রাপ্ত কোনো সুবিশাল বইয়ের কোথায় প্রয়োজনীয় তথ্য বা শব্দগুলি আছে তাও সার্চ করে নিমেষেই বের করা যায়।
- দুর্লভ তথ্যপ্রাপ্তি : ইনটারনেটের মাধ্যমে নানা ধরনের অনলাইন লাইব্রেরি থেকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বইয়ের কপি, অনলাইন আর্কাইভ থেকে আসল রিপোর্টের কপি প্রভৃতি পাওয়া সম্ভব।
- সহজে প্রশ্নের উত্তর লাভ : তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মনে কোনো প্রশ্ন জাগলে অনেকসময় ইনটারনেটে সেই প্রশ্ন লিখেও সরাসরি উত্তর পাওয়া যায়।
উপসংহার: ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে ইনটারনেটের নানান সুবিধা থাকা সত্ত্বেও একে অতিমাত্রায় নির্ভরযোগ্য ভাবা ভুল হবে। তাই ইনটারনেটে ইতিহাসের কোনো তথ্যসংগ্রহের জন্য একটু সতর্ক থাকতেই হবে।
- নির্ভরযোগ্যতার অভাব: ইনটারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলি কতটা যথার্থ বা নির্ভরযোগ্য তা যাচাই করা খুব কঠিন। একই বিষয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পৃথক পৃথক তথ্য থাকায় পাঠক বা গবেষকরা বিভ্রান্ত হন।
- মনগড়া তথ্য: ইনটারনেটে আজকাল যে-কেউ নিজের মনগড়া ভুল তথ্য আপলোড করছে। ফলে তা গবেষণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি করছে।
- গবেষণার মান হ্রাস: ইনটারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন অসত্য বা অর্ধসত্য তথ্য ব্যবহার করতে গিয়ে পাঠক ও গবেষকগণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং গবেষণার গুণগত মান কমে যাচ্ছে।
- তথ্যের অসম্পূর্ণতা : বহু ক্ষেত্রে ইনটারনেটে বই বা গবেষণার অংশবিশেষ পাওয়া যায়। এর পূর্ণাঙ্গ কাজটি পাওয়া না যাওয়ায় পাঠক ও গবেষকগণ নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।
উপসংহার: উক্ত অসুবিধাগুলি সত্ত্বেও আজকের এই ‘তথ্য বিস্ফোরণের যুগে’ ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে ইনটারনেটকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে সময়ের অপচয় রোধ, অফুরন্ত তথ্যের জোগান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইনটারনেটের জুড়ি মেলা ভার।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো