wb 10th Sst

WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 2 সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 2 সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 2 সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

West Bengal Board 10th History Solutions

একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি

  1. ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি’ (১৮১৭ খ্রি.), ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ (১৮২৯ খ্রি.), ‘লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন’ (১৮২৪ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলি উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
  2. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন-এর উদ্যোগে কলকাতায় “হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ (১৮৪৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বর্তমান নাম ‘বেথুন স্কুল’। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজ গ্রাম বীরসিংহে ‘ভগবতী বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন।
  3. লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘মেডিকেল কলেজ, বেঙ্গল’ প্রতিষ্ঠা করেন যা সাধারণভাবে ‘কলকাতা মেডিকেল কলেজ’ নামে পরিচিত। এই কলেজের ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত ভারতে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করেন।
  4. লর্ড ক্যানিং-এর শাসনকালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রথম আচার্য ছিলেন লর্ড ক্যানিং, প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল এবং প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এখান থেকে প্রথম স্নাতক হন যদুনাথ বোস ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৫৮ খ্রি.)।
  5. রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্ণসভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ব্রাহ্ণসমাজ।
  6. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ (১৮৩৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (১৮৪৩ খ্রি.) প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত।
  7. রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭নং রেগুলেশন আইনের দ্বারা সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।
  8. হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮২৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ছিল। এই গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্যরা ছিলেন ছিলেন রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, কৃয়মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃয় মল্লিক, প্যারিচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ইয়ং বেঙ্গলদের উদ্যোগে ‘এথেনিয়াম’ ও ‘পার্থেনন’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
  9. হাজি মহম্মদ মহসীনের অর্থানুকূল্যে চুঁচুড়ায় একটি কলেজ (১৮৩৬ খ্রি.) (বর্তমান হুগলি মহসীন কলেজ), হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, ইমামবাড়া হাসপাতাল (১৮৩৬ খ্রি.), হুগলির ইমামবাড়া (১৮৪১ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  10. বিধবাবিবাহের সপক্ষে সর্বপ্রথম তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অবশেষে লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করে বিধবাবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালীমতীর মধ্যে প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়।
  11. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশবচন্দ্রকে ‘ব্রহ্লানন্দ’ উপাধি দেন। কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ণ আন্দোলন সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে।
  12. ব্রাহ্ণসমাজ বিভাজিত হয়ে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আদি ব্রাহ্বসমাজ ও কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (১৮৬৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ (১৮৭৮ খ্রি.) ও নববিধান (১৮৮০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ ব্রাহ্ণসমাজের আচার্য ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।
  13. রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেন, “যত মত, তত পথ।” তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর নব্য বেদান্তবাদের মূল কথা হল ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’।
  14. কুষ্টিয়া জেলার ছেউরিয়া গ্রামে লালন ফকির বসবাস করতেন। তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত গান হল ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের অনুরাগী ছিলেন।
  15. লালনের নিজের ধর্মবিশ্বাস কী ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ তাঁকে হিন্দু আবার কেউ তাঁকে মুসলিম বলে মনে করেন। কিন্তু লালন নিজে এই বিষয়ে কিছু বলেননি।
  16. তুর্কি মুসলিমদের আক্রমণে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটলে সেখানকার শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে ইটালিতে চলে যান। তাঁদের উদ্যোগে পঞ্চদশ শতকে ইটালির বৌদ্ধিক জগতে যে অগ্রগতি ঘটে তা ‘নবজাগরণ’ (Renaissance) নামে পরিচিত।
  17. রামমোহন রায়ের সময়কালকে বাংলার নবজাগরণের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয় । এই নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ।

TOPIC – A সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লেখো।
উত্তর – ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা
ভূমিকা: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা ছিল উনিশ শতকের বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি প্রথমে সাপ্তাহিক ছিল। কিন্তু পরে এটি দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এই পত্রিকায় সমকালীন বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
  1. হরিশচন্দ্রের সম্পাদনা: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। পত্রিকাটির প্রথম প্রবর্তক ও প্রথম স্বত্বাধিকারী মধুসূদন রায়ের চিঠি থেকে জানা যায় যে, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮২৪-১৮৬১ খ্রি.)। হরিশচন্দ্র আড়াই বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে পত্রিকাটি পরিচালনা করেন। পরে তিনি মধুসূদন রায়ের কাছ থেকে পত্রিকাটির প্রেস ও কাগজের স্বত্ব কিনে নেন।
  2. পত্রিকার অগ্রগতি: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাটি চালিয়ে প্রথম চার বছর প্রচুর আর্থিক লোকসানের শিকার হন। তা সত্ত্বেও তিনি এটিকে একটি আধুনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত করেন। তিনি বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বৈদেশিক সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। ফলে স্বদেশের সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এ ছাড়া ব্যাবসাবাণিজ্য, বাজারদর, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়েও পত্রিকাটিতে সংবাদ পরিবেশিত হত। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার প্রবল জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে বাংলায় বিদেশিদের পরিচালিত পত্রিকাগুলিও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে।
  3. নির্ভীক সাংবাদিকতা: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নির্ভীক সাংবাদিকতার ফলে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা প্রথম থেকেই ব্রিটিশ, নীলকর ও জমিদার বিরোধী পত্রিকায় পরিণত হয়। তিনি তাঁর পত্রিকায় প্রথম থেকেই তৎকালীন বাংলার সামাজিক শোষণ, দরিদ্রশ্রেণির ওপর সীমাহীন অত্যাচার, তাদের দুরবস্থা প্রভৃতির চিত্র তুলে ধরতে থাকেন। সাধারণ মানুষের ওপর সরকার ও পুলিশের অত্যাচার, বাংলার নীলচাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার, বাংলার চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি করে মদ আমদানি, পুরুষের বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সরব হয়।
  4. শিক্ষিত শ্রেণির সচেতনতা: বাংলার দরিদ্র শ্রেণির ওপর সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচারের ঘটনাবলির কথা ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা থেকে কলকাতা-সহ বাংলার সমাজের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত মানুষ জানতে পারে। এমনকি ইউরোপীয়রাও এই পত্রিকা থেকে দরিদ্রশ্রেণির ওপর তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের কাহিনি জানতে পারে। হরিশচন্দ্র ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসক লর্ড ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবিস্তারের নীতির তীব্র সমালোচনা করে দুঃসাহসের পরিচয় দেন। বিভিন্ন লোভনীয় সরকারি চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি সরকারের বিরোধিতা চালিয়ে যান।
  5. নারী অধিকার: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ধারাবাহিক প্রচার চালায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রবর্তন করলে হরিশচন্দ্র তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গড়ে তোলেন। নারীশিক্ষাকে সমর্থন করে এই পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। পতিতাদের নানা সমস্যার বিষয়ে এই পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
  6. শিক্ষা: হরিশ্চন্দ্র বাংলা ভাষার প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখান। তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্রের সমালোচনা প্রভৃতি নিয়মিতভাবে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে নিয়মিত প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়। সরকারি শিক্ষানীতির বিষয়েও এই পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
  7. সীমাহীন পরিশ্রম: গ্রামবাংলার অত্যাচারিত নীলচাষিদের মধ্যে উদারহৃদয় হরিশচন্দ্রের কথা ছড়িয়ে পড়লে তারা সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে হরিশচন্দ্রের ভবানীপুরের বাড়িতে এসে হাজির হত। হরিশচন্দ্রও চাষিদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতেন এবং তাদের মঙ্গলের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। চাষিদের সমস্যার বিবরণ শুনে তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে দেওয়া, দরখাস্ত লিখে দেওয়া, প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দেওয়া প্রভৃতি কাজে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করতেন।

উপসংহারঃ সীমাহীন পরিশ্রম, স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যুতে মানসিক অবসাদ প্রভৃতির ফলে অল্প বয়সেই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তা সত্ত্বেও ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর কাজ থেকে তিনি কোনোদিন ছুটি নেননি। অবশেষে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে বাংলার নীলচাষিরা তাদের অভিভাবক হারান। তাই এই সময় বাংলায় এক কবিতা ছড়িয়ে পড়ে—

‘নীলবানরে সোনার বাংলা
করল এবার ছারখার,
অসময়ে হরিশ ম’ল,
লঙের হ’ল কারাগার।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. উনিশ শতকে সাময়িক পত্র, সংবাদপত্র, সাহিত্য প্রভৃতিতে কীভাবে সমকালীন বঙ্গীয় সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে?
উত্তর – সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যে তৎকালীন বঙ্গসমাজ
ভূমিকা: পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণ সংঘটিত হয় বলে অনেকে মনে করেন।
  1. অগ্রগতি: উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রভাবে বাংলায় সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র, সাহিত্য প্রভৃতির যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। এগুলিতে তৎকালীন বাংলার সমাজচিত্র প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
  2. সাময়িকপত্র: উনিশ শতকে বাংলা থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্রগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল হিকি-র ‘বেঙ্গল গেজেট’, মার্শম্যানের ‘দিগদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ এবং গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্গাল গেজেট’। পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সম্বাদ প্রভাকর’, অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’, উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সোমপ্রকাশ’, স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে নানা রচনা প্রকাশিত হতে থাকে।
  3. সংবাদপত্র: উনিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাঙালির সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’, হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’, ব্ৰত্মবান্ধব উপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সন্ধ্যা’, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বেঙ্গলি’ প্রভৃতি। এসব সংবাদপত্রে সমসাময়িক বাংলার সমাজজীবনের নানা চিত্র পাওয়া যায়।
  4. সাহিত্য: উনিশ শতকে বিভিন্ন সাহিত্যেও সমকালীন বঙ্গীয় সমাজের নানা ঘটনার প্রতিফলন ঘটে। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যগ্রন্থ হল কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’, দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানি’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘কৃয়চরিত’, প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরে দুলাল’, নবীনচন্দ্র সেন রচিত ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রভৃতি।

উপসংহার: উনিশ শতকে এইসকল সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যগুলি যথার্থভাবেই তৎকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছিল। সমকালীন বাংলার নেতিবাচক প্রবণতাগুলি দূর করার ক্ষেত্রেও এগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

2. *বামাবোধিনী পত্রিকা’-র প্রকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, টীকা লেখো: বামাবোধিনী পত্রিকা।
উত্তর – ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র প্রকাশ
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িকপত্রগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল ব্রায়নেতা কেশবচন্দ্রের সেনের অনুগামী উমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪০-১৯০৭ খ্রি.) সম্পাদিত ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’।
  1. সামাজিক প্রেক্ষাপট : উনিশ শতকের মধ্যভাগেও বাংলায় স্ত্রীশিক্ষার ‘প্রতি সাধারণ মানুষের বিশেষ সমর্থন ছিল না। তাই এই সময় পর্যন্ত নারীশিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি। এই পরিস্থিতিতে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদের সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে উমেশচন্দ্র দত্ত বিশেষ উদ্যোগ নেন।
  2. বামাবোধিনী সভা : বাঙালি ‘বামা’ অর্থাৎ নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও নারী সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের যোগ্য করে তোলা, নারীদের মনের কথা তুলে ধরা, নারীজাতির স্বার্থে বিভিন্ন বইপত্র প্রকাশ প্রভৃতির উদ্দেশ্যে উমেশচন্দ্র দত্ত কয়েকজন তরুণ ব্রাহ্ণকে নিয়ে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বামাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
  3. পত্রিকার প্রথম প্রকাশ: বামাবোধিনী সভার পক্ষ থেকে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’র প্রকাশ শুরু হয়। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত। এই পত্রিকার প্রকাশে উমেশচন্দ্র দত্তকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন ক্ষেত্রমোহন দত্ত, বসন্তকুমার দত্ত প্রমুখ।
  4. পরিচালনা: কলকাতার সিমুলিয়ার বামাবোধিনী সভার কার্যালয় থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। উদারমনস্ক সংস্কারকদের নিয়ে ‘বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করা হয়। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা-র শেষ সম্পাদক ছিলেন আনন্দকুমার দত্ত। নানা উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৬০ বছর ধরে প্রকাশিত হয়।

উপসংহার: বামাবোধিনী পত্রিকা সমকালীন বাংলার নারী সমাজের অন্তরের কথা তুলে ধরতে সক্ষম হয়। এই পত্রিকায় নামে ও বেনামে বিভিন্ন নারী তাঁদের নিজস্ব লেখালেখি প্রকাশ করার সুযোগ পাওয়ায় সাহিত্য জগতে নতুন লেখিকাদের আবির্ভাব ঘটে।

3. *‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় বাংলার সমকালীন সমাজের কীরূপ প্রতিফলন ঘটেছে?
উত্তর – ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় সমকালীন সমাজের প্রতিফলন
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যেসব সাময়িকপত্রে সমকালীন বঙ্গীয় সমাজের প্রতিফলন ঘটেছে সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নামক মাসিক পত্রিকা। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র প্রকাশ শুরু হয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার সমাজের, বিশেষ করে নারীদের অবস্থা কেমন ছিল তা ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ থেকে জানা যায়।
  1. নারীশিক্ষার প্রতিফলন: উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার নারীদের সামাজিক অবস্থার বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। নারীশিক্ষার বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ সুনজরে দেখত না। ফলে বাংলায় নারীশিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি।
  2. নারীর মর্যাদার প্রতিফলন: এই সময় বাংলার নারীরা সাধারণত বাড়ির অন্দরমহলে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত ছিল। তাদের অধিকার ও মর্যাদা বিশেষ ছিল না।
  3. সামাজিক কুসংস্কারের প্রভাব: ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা উনিশ শতকে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার তুলে ধরে এসবের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। নারীদের বাল্যবিবাহ, পুরুষদের বহুবিবাহ, মদ্যপান প্রভৃতির বিরুদ্ধে এই পত্রিকায় নিয়মিত প্রচার চালানো হয়।

উপসংহার: বাংলার তৎকালীন সামাজিক সমস্যাগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নিয়মিত প্রচার চালায়। পত্রিকাটি নারীশিক্ষার প্রসার, নারীর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বাংলায় নারী আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

4. *নারীসমাজের উন্নতির লক্ষ্যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ কীরূপ উদ্যোগ নিয়েছিল ?
উত্তর – নারীসমাজের উন্নতির লক্ষ্যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র উদ্যোগ
ভূমিকা: ব্রাহ্বনেতা কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী উমেশচন্দ্র দত্ত ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার প্রকাশ শুরু করেন। বাংলার নারীসমাজের উন্নতির লক্ষ্যে এই পত্রিকা বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। যেমন—
  1. সামাজিক সংস্কার: উনিশ শতকে এদেশের হিন্দুসমাজে মেয়েরা বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা প্রভৃতির শিকার ছিল। এসব সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে এবং নারীদের মন থেকে যাবতীয় কুসংস্কার ও সন্দেহ দূর করার উদ্দেশ্যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নিয়মিত প্রচার চালিয়ে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়।
  2. শিক্ষার প্রসার: উনিশ শতকেও সাধারণ মানুষ নারীশিক্ষাকে বিশেষ সমর্থন করত না। এই অবস্থায় ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নারীশিক্ষার সমর্থনে, নারী সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিয়মিত প্রচার চালায়।
  3. নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠা: উনিশ শতকেও নারীরা মূলত বাড়ির অন্দরমহলে আবদ্ধ ছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের কোনো সুযোগ ছিল না। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নারীদের সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের লক্ষ্যে নিয়মিত প্রচার চালায়। নারী-অধিকারের উদার সমর্থকদের নিয়ে এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী গড়ে তোলা হয়।
  4. প্রগতিশীলতার প্রয়াস: নারীরা যাতে নিজস্ব লেখনীর মাধ্যমে নিজেদের মতামত জানাতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা গোষ্ঠী স্বনামে বা বেনামে নারীদের এই পত্রিকায় নিয়মিত লেখার সুযোগ করে দেয়। পত্রিকাগোষ্ঠী নারীজাতির স্বার্থরক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বইপত্র ও পত্রিকা প্রকাশ করে।

উপসংহার: নারীসমাজের উন্নতির লক্ষ্যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে শুধু যে নারীদের উন্নতি হয়েছিল তাই নয়, এর ফলে গোটা সমাজেরই অগ্রগতি হয়েছিল।

5. * উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – উমেশচন্দ্র দত্ত
ভূমিকা: উমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪০-১৯০৭ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন সমাজসচেতন ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। সমকালীন বাংলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রাখেন।
  1. প্রথম জীবন: উমেশচন্দ্র দত্ত ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মজিলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হরমোহন দত্ত। তিনি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরের একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তিনি ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিকেল কলেজে ভরতি হলেও দারিদ্রের জন্য ডাক্তারি পড়া ছাড়তে বাধ্য হন।
  2. ব্রায়্রসমাজে নেতৃত্ব: উমেশচন্দ্রদত্ত ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দেব্রাহ্বসমাজে যোগ দিয়েই শীঘ্রই ব্রাম্মনেতা কেশবচন্দ্রে সেনের অনুগামীতে পরিণত হন। তিনি স্থানীয় মানুষের আপত্তি অগ্রাহ্য করে হরিনাভিতে ব্রাহ্ণসমাজের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্ণসমাজে বিভাজনের পর সাধারণ ব্রাত্মসমাজ (১৮৭৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
  3. বামাবোধিনী সভা: উমেশচন্দ্র দত্ত কয়েকজন তরুণ ব্রাহ্ণকে নিয়ে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বামাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল ‘বামা’ অর্থাৎ নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো, নারী সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীদের অধিকার ও মর্যাদা দান প্রভৃতি বিষয়ে কাজ করা।
  4. বামাবোধিনী পত্রিকা: নারীদের সামাজিক উন্নতি, নারীশিক্ষার প্রসার, নারীদের মনের কথা প্রকাশের সুযোগ দান প্রভৃতি উদ্দেশ্যে উমেশচন্দ্র ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল।
  5. অন্যান্য অবদান: উমেশচন্দ্র দত্ত বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি সিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং সিটি কলেজের অধ্যক্ষও হন। তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মানিকতলায় মূক ও বধিরদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বামারচনাবলী’ ও ‘স্ত্রীলোকদের বিদ্যার আবশ্যকতা’ তাঁর লেখা দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
  6. মৃত্যু: উমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর সহজ ও সরল জীবনযাপনের জন্য সকলের কাছে ‘সাধু’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

উপসংহার: নারীশিক্ষা ও নারী উন্নতির জন্য ব্যক্তি উমেশচন্দ্র বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। নারীদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পত্রিকা প্রকাশ প্রভৃতি অসামান্য অবদানের জন্য তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

6. *‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় বাংলার সমকালীন সমাজের কীরূপ প্রতিফলন ঘটেছে?
উত্তর – ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় বাংলার সমকালীন সমাজের প্রতিফলন
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা থেকে প্রকাশিত যেসব পত্রপত্রিকায় সমকালীন সমাজের প্রতিফলন ঘটেছে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা। সমকালীন বঙ্গসমাজের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র এই পত্রিকায় ফুটে ওঠে। যেমন—
  1. দরিদ্র মানুষের দুর্দশা: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাংলার তৎকালীন সমাজের দরিদ্র কৃষক-মজুরদের দুর্দশা-দুরবস্থায় মর্মাহত ছিলেন। দরিদ্রদের দুরবস্থার নানা ঘটনার চিত্র তিনি তাঁর পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করতেন।
  2. শোষণ অত্যাচার: তৎকালীন বাংলার প্রজারা সর্বদা কীভাবে ব্রিটিশ সরকার, সরকারের পুলিশ, জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়, তা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সাঁওতাল পরগনার আদিবাসীরা কীরূপ অত্যাচারের শিকার হয়, সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় সরকারি সেনা কীরূপ নৃশংসভাবে অগণিত সাঁওতালদের হত্যা করে, বিদেশি নীলকর সাহেবরা কীভাবে বাংলার চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করত, তারা চাষিদের ওপর কীরূপ নির্মম অত্যাচার চালাত, তার বিবরণও ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত।
  3. অর্থনৈতিক দুর্দশা: ব্রিটিশ সরকার বাংলার চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি করে বিনিময়ে মদ আমদানি করত। এর ফলে বাংলার অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার নানা খবর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হত।
  4. নারীর অবস্থা: সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা ধারাবাহিক প্রচার চালায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রবর্তন করলে হরিশচন্দ্র তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গড়ে তোলেন। নারীশিক্ষাকে সমর্থন করে এই পত্রিকায় নারীশিক্ষার সপক্ষে ব্যাপক প্রচার চালায়।
  5. সামাজিক কুসংস্কার: মেয়েদের বাল্যবিবাহ, পুরুষদের বহুবিবাহ, মদ্যপান প্রভৃতি সামাজিক কু-প্রথার বিরুদ্ধে নানা সংবাদ ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হত।

উপসংহার: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাউনিশ শতকের আর্থ-সামাজিক জীবনের মুখপত্র হয়ে ওঠে। অত্যাচারী নীলকর,জমিদার প্রমুখের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই পত্রিকা সরব প্রতিবাদ জানায়।

7. *বাংলায় নীলচাষিদের কল্যাণে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা কী ছিল?
অথবা, নীলকরদের বিরুদ্ধে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার কী ভূমিকা ছিল ?
উত্তর – বাংলায় নীলচাষিদের কল্যাণে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকে নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারে বাংলার নীলচাষিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সাহসী সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দুর্দশাগ্রস্ত নীলচাষিদের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
  1. প্রকৃত তথ্য প্রচার: বিদেশি নীলকর সাহেবরা বাংলার দরিদ্র চাষিদের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করত, চাষিদের নানাভাবে ঠকাত। নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারে চাষিদের জীবনে সীমাহীন দুর্দশা নেমে আসত এবং এসব বিষয়ের খবরাখবর হরিশচন্দ্র তাঁর পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করতেন।
  2. শিক্ষিতশ্রেণির সচেতনতা বৃদ্ধি: গ্রামবাংলার নীলচাষিদের ওপর সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচারের কাহিনি ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকলে কলকাতার শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায় এবিষয়ে বিস্তারে জানতে পারে। ফলে তারা নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
  3. আইনি পরামর্শ দান: হরিশচন্দ্র নীলচাষিদের সমস্যার বিবরণ শুনে তা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য নানাভাবে সহায়তা করতেন। তাদের দরখাস্ত লিখে দেওয়া, প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দেওয়া প্রভৃতি কাজে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করতেন।

উপসংহার: অত্যাচারিত নীলচাষিদের কল্যাণে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁর পত্রিকা ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর নতুন বিভাগ ‘নীল জেলা’ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের নীল বিদ্রোহ কিংবা ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকার কর্তৃক ‘নীল কমিশন’ গঠনের পিছনে এই পত্রিকার প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।

8. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
ভূমিকা: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮২৪-১৮৬১ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকে বাংলার এক নির্ভীক দেশপ্রেমিক, সাংবাদিক এবং সমাজসেবক। ‘হিন্দু  প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নীলচাষিদের দুর্দশার বিবরণ তিনি সকলের সামনে তুলে ধরেন।
  1. প্রথম জীবন: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রামধন মুখোপাধ্যায়। ভবানীপুরের পাঠশালায় পড়ার সময়ই তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। অত্যন্ত দারিদ্র্যের শিকার হয়ে হরিশচন্দ্র স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন।
  2. পত্রিকার সম্পাদনা: মধুসূদন রায়ের কাছ থেকে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা ও প্রেসের মালিকানা স্বত্ব কিনে নেন। তাঁর সম্পাদনায় এই পত্রিকার উৎকর্ষ ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই পত্রিকায় বাংলার নীলচাষিদের ওপর সীমাহীন অত্যাচারের বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ করা হত। ফলে কলকাতার শিক্ষিত সমাজ এ বিষয়ে জানতে পারে এবং প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে।
  3. নীলচাষিদের সহায়তা: বাংলার অত্যাচারিত নীলচাষিদের দুর্দশা মোচনের জন্য হরিশচন্দ্র প্রচুর পরিশ্রম করতেন। চাষিদের আর্থিক সহায়তা, আইনি পরামর্শ প্রভৃতি দানের উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়ির দরজা সর্বদা চাষিদের জন্য খোলা ছিল।
  4. অন্যান্য উদ্যোগ: হরিশচন্দ্র ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, চিনি, তৈলবীজ প্রভৃতি রপ্তানি ও মদ আমদানির বিরোধিতা করেন। তিনি ডালহৌসির (১৮৪৮-৫৬ খ্রি.) নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু অন্যদিকে তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে ব্রিটিশদের সমর্থন করেন।
  5. মৃত্যু: সীমাহীন পরিশ্রমের ফলে হরিশচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। কিছুকাল পর তাঁর যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে। অবশেষে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে (১৪ জুন) মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দেশকল্যাণের কাজে তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাকেই হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর প্রাকমুহূর্তেও জ্বরের ঘোরে তাঁর দায়িত্বপূর্ণ উক্তি ছিল—“ওরে, পেট্রিয়ট মেশিনে ওঠাসনে, প্রুফটা আর একবার আমাকে দিয়ে দেখিয়ে তবে ছাপিস।”

9. ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকার প্রকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকার প্রকাশ
ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় গ্রামীণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ নামের পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  1. পত্রিকার প্রকাশ: ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ নামে পত্রিকাটির প্রকাশ শুরু হয়। পরে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থেকে ‘মথুরানাথ প্রেস’ (এম এন প্রেস) নামক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে পত্রিকা প্রকাশের কাজ চলতে থাকে।
  2. অগ্রগতি: ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকাটি প্রথমে মাসিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হত। পরে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটি পাক্ষিক এবং ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিণত হয়।
  3. সম্পাদক: ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-৯৬ খ্রি.), যিনি কাঙাল হরিনাথ নামেই প্রসিদ্ধ। তিনিই এই পত্রিকার জন্য সংবাদ সংগ্রহ করতেন, সম্পাদনা করতেন এবং পাঠকদের হাতে পৌঁছে দিতেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক এবং বিক্রেতা।
  4. পত্রিকার উদ্দেশ্য: ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ সংবাদগুলি সকলের সামনে তুলে ধরা। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (মে, ১৮৬৩ খ্রি.) সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার লেখেন, “এ পর্যন্ত বাঙ্গালা সংবাদপত্রিকা যতই প্রচারিত হইতেছে তাহা কেবল প্রধান প্রধান নগর ও বিদেশীয় সম্বাদাদিতেই পরিপূর্ণ। গ্রামীয় অর্থাৎ মফস্সলের অবস্থাদি কিছুই প্রকাশিত হয় না।… যাহাতে গ্রামবাসীদের অবস্থা…. প্রকাশিত হয় তাহাই এই পত্রিকার প্রধানোদ্দেশ্য…….।”
  5. আর্থিক সংকট: ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকা কখনও আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পায়নি। বিভিন্ন সহৃদয় ব্যক্তির আর্থিক সহায়তার দ্বারা দীর্ঘ ২৫ বছর পত্রিকাটি চালু ছিল। অবশেষে মাত্র ৭ টাকা ঋণের দায়ে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

উপসংহার: ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকাটি ছিল উনিশ শতকের সময়োপযোগী একটি পত্রিকা। পত্রিকাটি লোকসানে চলা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গ্রামীণ মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে পত্রিকাটি চালু রাখা হয়েছিল।

10. *‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?
উত্তর – ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায় বাংলার সমাজচিত্র
ভূমিকা: উনিশ শতকে কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ ছিল বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। এই পত্রিকায় তৎকালীন বাংলার সমাজজীবনের যথেষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। যেমন—
  1. সরকারের শোষণ: ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও অত্যাচারে বাংলার দরিদ্র প্রজাদের জীবন কীরূপ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তা কাঙাল হরিনাথ তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায় তুলে ধরেন।
  2. জমিদারদের শোষণ: ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী বাংলার জমিদার, জোতদার, মহাজন প্রমুখের শোষণ ও অত্যাচার সাধারণ বাঙালি সমাজে কীরূপ দুর্দশার সৃষ্টি করেছিল তাও এই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় তুলে ধরা হয়, পুলিশের কাছে বিচার চেয়েও এর কোনো প্রতিকার মিলত না। বরং অভিযোগকারীরাই পুলিশের নির্যাতনের শিকার হত।
  3. বিদ্রোহ ও দুর্ভিক্ষের সংবাদ: ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জে প্রজাবিদ্রোহ শুরু হলে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ প্রজাদের পক্ষ নেয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে কাঙাল হরিনাথ তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পক্ষে সোচ্চার হন।
  4. নীলকরদের অত্যাচার: কাঙাল হরিনাথ কিছুদিন নীলকুঠিতে কাজ করার সময় কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের বিষয়টি স্বচক্ষে দেখেন। নীলচাষিদের ওপর এই শোষণ ও অত্যাচারের বিবরণ তিনি নিয়মিত তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন।

উপসংহার: গ্রামবাংলার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ সংবাদপত্রটি ছিল উপযুক্ত একটি মাধ্যম। এই পত্রিকায় বাংলার সাধারণ মানুষের সামগ্রিক শোষণ-অত্যাচারের ছবি নিয়মিত তুলে ধরে বাংলার মানুষকে সচেতন করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

11. হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথ
ভূমিকা: হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকের একজন প্রতিভাবান সাংবাদিক, লেখক, গীতিকার ও মানবতাবাদী। তিনি কাঙাল হরিনাথ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
  1. প্রথম জীবন: কাঙাল হরিনাথ ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত নদিয়া জেলার কুমারখালিতে (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হরচন্দ্র মজুমদার। আর্থিক দুর্দশার কারণে হরিনাথের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
  2. ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ প্রকাশ: কাঙাল হরিনাথ নিজের উদ্যোগে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি প্রথমে মাসিক হিসেবে প্রকাশিত হলেও পরে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাক্ষিক এবং ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিণত হয়। এই পত্রিকায় নিয়মিত সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে নানান প্রবন্ধ প্রকাশিত হত।
  3. শোষণের বিরোধিতা: কাঙাল হরিনাথ বাংলার চাষিদের ওপর সরকার ও জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার, নীলচাষিদের ওপর লাঞ্ছনা, সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার প্রভৃতি খবরাখবর গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। এর ফলে এই শোষণ ও অত্যাচারের ঘটনাবলি শিক্ষিত সমাজের নজরে আসে এবং এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে।
  4. শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা: কাঙাল হরিনাথ তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যান। তিনি কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ওই গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় (১৮৫৬ খ্রি.) কৃয়নাথ মজুমদারকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন।
  5. সাহিত্য ও সংগীত চর্চা: হরিনাথ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘বিজয় বসন্ত’, ‘চারু-চরিত্র’, ‘কবিতা কৌমুদী’ প্রভৃতি। আর্থিক দুরবস্থার কারণে। একসময় ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে গেলে হরিনাথ সাংবাদিকতা ছেড়ে ধর্মসাধনায় মন দেন। তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে একটি বাউল সংগীতের দল গড়ে তোলেন যা ‘কাঙাল ফকিরের চাঁদের দল’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি বেশকিছু বাউল গান রচনা করেন। “হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল”তাঁর লেখা একটি উল্লেখযোগ্য গান।

উপসংহার: হরিনাথ মজুমদারের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব ছিল ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ প্রকাশ। পাশাপাশি শেষজীবনে একজন বাউল সংগীতকার হিসেবে তিনি যেসব গান রচনা করেন সেগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ অনেকের মন জয় করে।

12. *কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ উপন্যাস থেকে তৎকালীন বাংলার কী সমাজচিত্র পাওয়া যায়?
অথবা, ‘হুতোমপ্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায়? 
উত্তর – ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’-য় তৎকালীন বাংলার সমাজচিত্র
ভূমিকা: সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ (১৮৬১ খ্রি.) উনিশ শতকের বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। উনিশ শতকে যেসব বাংলা সাহিত্যগ্রন্থে সেকালের বাংলার সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই গ্রন্থ। যেমন—
  1. মধ্যবিত্তদের মানসিকতা: কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থে ‘হুতোমপ্যাঁচা’ ছদ্মনামে ঊনবিংশ শতকের বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ও ক্রিয়াকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন।
  2. বাবুসমাজের জীবনযাত্রা: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতায় হঠাৎ ফুলেফেঁপে ওঠা অত্যন্ত ধনী বাবুদের মধ্যে যে সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়, তার স্বরূপটি ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাবুসংস্কৃতির তীব্র সমালোচনা করে গ্রন্থটি সমকালীন শিক্ষিত বাঙালিকে সচেতন করে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে।
  3. কলকাতাবাসীর শ্রেণিবিভাগ: কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর গ্রন্থে তৎকালীন কলকাতাবাসীদের তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা— [i] ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী, [ii] ইংরেজি শিক্ষায় নব্যপন্থী, যারা সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী নয় এবং [iii] ইংরেজি না-জানা গোঁড়া হিন্দুসমাজ। কালীপ্রসন্ন সিংহের কথায়, এরা সবাই কমবেশি জাল-জুয়াচুরি বা ফন্দি-ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত।
  4. কলকাতার সামাজিক জীবন: কালীপ্রসন্ন সিংহর ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় তৎকালীন কলকাতার সাধারণ সামাজিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটির প্রথমভাগে আলোচিত হয়েছে চড়ক পাবণ, কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা, ছেলেধরা, কৃশ্চানি হুজুক, সাতপেয়ে গরু, দরিয়াই ঘোড়া, লক্ষ্ণৌয়ের বাসা এবং দ্বিতীয় ভাগে আলোচিত রথ, দুর্গোৎসব, রামলীলা প্রভৃতি তৎকালীন কলকাতার প্রতিচ্ছবি।

উপসংহার: কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ রচনাটি ছিল উনিশ শতকের কলকাতার কথ্য ভাষায় এবং হাস্যরসাত্মক ভঙ্গি রচিত একটি ব্যঙ্গাত্মমূলক সাহিত্য। এর মধ্য দিয়ে তৎকালীন ঔপনিবেশিক সমাজের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

13. কালীপ্রসন্ন সিংহ সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – কালীপ্রসন্ন সিংহ
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তিনি ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এক ধনী জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ২৯ বছরের স্বল্পকালীন জীবনে তিনি সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ও সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন।
  1. বিদ্যোৎসাহিনী সভা: কালীপ্রসন্ন সিংহ মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিদ্যোৎসাহিনী সভা (১৮৫৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে মিলিত হয়ে প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা করতেন। এই সভা বিধবাবিবাহ ও সমাজসংস্কারের পক্ষে নানা মতামত প্রচার করত। এই সভা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণ-সংবর্ধনা (১৮৬১ খ্রি.) দেয়।
  2. লং-এর জরিমানা: দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০ খ্রি.) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করার অভিযোগে জেমস লং-এর একমাস কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা জরিমানা হলে (১৮৬১ খ্রি.) কালীপ্রসন্ন সিংহ জরিমানার টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করে দেন।
  3. সাহিত্যকীর্তি: কালীপ্রসন্ন সিংহের অমর সাহিত্যকীর্তি হল ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ রচনা। এই উপন্যাসে তিনি উনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত, ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত কলকাতাবাসী এবং সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া বাবু সম্প্রদায়ের মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কলকাতার কথ্যভাষায় (Calcutta Cockney) এই উপন্যাস রচনা করে তিনি বাংলা গদ্যরীতির নতুন পথের সন্ধান দেন। এ ছাড়া, তিনি সতেরো খণ্ডে মহাভারতের বাংলা অনুবাদ ও ‘পুরাণসংগ্রহ’ রচনা করেন।
  4. মানবকল্যাণ: কালীপ্রসন্ন সিংহ একজন জমিদার হলেও সেকালে মানবদরদী ব্যক্তি হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত বহু মানুষকে অকাতরে দান করতেন। বিধবাবিবাহ আইন পাস হলে তিনি বিধবা-বিবাহকারীকে ১ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
  5. আর্থিক দুর্দশা: অকাতরে দান ও সমাজকল্যাণে অর্থব্যয় করে কালীপ্রসন্ন গভীরভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। ঋণের দায়ে তিনি উড়িষ্যার জমিদারি এবং কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তিনি বন্ধু এবং আত্মীয়দের দ্বারাও প্রতারিত হন।
  6. মৃত্যু: কালীপ্রসন্ন ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর কৃয়দাস পাল লিখেছেন, “… কালীপ্রসন্ন ছিলেন একটি উজ্জ্বল চরিত্র এবং এমন একটি প্রদীপ্ত প্রতিশ্রুতিবান কর্মজীবনের এভাবে একটি আকস্মিক এবং দুঃখজনক সমাপ্তির জন্য আমরা পর্যাপ্তরূপে আমাদের খেদ প্রকাশ করতে অপারগ।”

উপসংহার: প্রচণ্ড ধীশক্তির অধিকারী কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর স্বল্প জীবনকালের মধ্যে যা কিছু করে গেছেন তা আমাদের বিস্ময় সৃষ্টি করে। দুঃখের বিষয়, এই মহান মানুষটির জীবনের আকস্মিক এবং দুঃখজনক পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

14. * দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকে সমকালীন বাংলার সমাজচিত্র কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল? অথবা, ‘নীলদর্পণ’ নাটক সম্পর্কে কী জান? অথবা, ‘নীলদর্পণ’ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায়?
উত্তর – ‘নীলদর্পণ’ নাটকে সমকালীন বাংলার সমাজচিত্র
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবনের চিত্র যেসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নাটক ‘নীলদর্পণ’।
  1. প্রেক্ষাপট: উনিশ শতকে ইউরোপের বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের চাহিদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে ইংরেজ-সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ব্যবসায়ী বাংলায় এসে এখানকার চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করে। এর ফলে বাংলার চাষিদের জীবনে চরম দুর্দশা নেমে আসে। এই প্রেক্ষাপটে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০ খ্রি.) নাটকটি রচনা করে তা ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন।
  2. চাষিদের দুর্দশা: অত্যাচারী নীলকর সাহেবরা বাংলার দরিদ্র চাষিদের ধানের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করে। ফলে চাষিদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এদিকে নীল উৎপাদন করে চাষি যথার্থ মূল্য থেকেও বঞ্চিত হয়। এর ফলে আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জীবনে নেমে আসা দুর্দশা যা ‘নীলদর্পণ’ নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
  3. অত্যাচার: ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলচাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচারের বিবরণ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়। চাষিদের জমি থেকে উৎখাত, গোরু-বাছুর কেড়ে নেওয়া, ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো, নীলকুঠিতে চাষিকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চালানো প্রভৃতি এই নাটকে তুলে ধরা হয়। নাটকে উল্লিখিত নীলকর উড-এর অত্যাচার মানুষের মনে শিহরণ সৃষ্টি করে।
  4. নীল বিদ্রোহ: তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার দরিত্র নীলচাষিরা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধেআন্দোলন শুরু করে যা ‘নীলবিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ‘নীলদর্পণ’ নাটকে এই বিদ্রোহের সূত্রপাত ও প্রসারের চিত্র প্রতিফলিত হয়।

উপসংহারঃ উনিশ শতকের বাংলার কৃষক সমাজের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও তাদের দুঃখ-দুর্দশার ছবি জ্বলন্ত হয়ে উঠেছিল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকে। এই নাটকে বাংলার কৃষকদের অসহায়তার যে মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরা হয়েছে তা ইংল্যান্ডের বহু সভ্য ইংরেজের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল।

15. *দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের গুরুত্ব কী?
উত্তর – ‘নীলদর্পণ’ নাটকের গুরুত্ব
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলার নীলচাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের শোষণ, অত্যাচার ও নীলবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট নাট্যকার ও সমাজসেবক দীনবন্ধু মিত্র (১৮২৯–১৮৭৩ খ্রি.) ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০খ্রি.) নাটক রচনা করেন। সমকালীন প্রেক্ষাপটে এই নাটকের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। যেমন—.
  1. নীলচাষিদের দুর্দশা: নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে বাংলার চাষিদের বাধ্য হয়ে নীলচাষ করা, চাষিদের ওপর নীলকরদের সীমাহীন নির্যাতন চালানো, তার ফলে নীলবিদ্রোহের সূত্রপাত (১৮৫৮ খ্রি.) প্রভৃতি বিভিন্ন ঘটনার চিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
  2. শিক্ষিত সমাজে আলোড়ন: ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলচাষিদের ওপর যে নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়, তা থেকে শিক্ষিতসমাজ নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের এইসব জুলুম ও অত্যাচার সম্পর্কে জানতে পারে। ফলে বাংলার শিক্ষিতসমাজে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
  3. ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ: ‘নীলদর্পণ’ই হল প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ইংরেজি অনুবাদটি খ্রিস্টান পাদ্রি রেভারেন্ড জেমস লং-এর নামে প্রকাশিত হয়। অনেকে মনে করেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই গ্রন্থটির অনুবাদ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের শাস্তি এড়াতে তা লং সাহেবের নামে প্রকাশ করেন। যাই হোক, সরকার লং সাহেবকে অভিযুক্ত (১৮৬১ খ্রি.) করে। বিচারে তাঁর একমাস কারাদণ্ড এবং ১ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য হয়।
  4. ইউরোপে প্রচার: ইংরেজি-সহ কিছু ইউরোপীয় ভাষায় এই নাটকটি অনূদিত হয়। ‘নীলদর্পণ’ নাটক থেকে ইউরোপের মানুষ বাংলার চাষিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের কাহিনি জেনে শিহরিত হয়।

উপসংহার: দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক শুধুমাত্র নীলচাষিদের দুর্দশাকেই তুলে ধরেনি; এই নাটক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলার মাধ্যমে তাদের মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. বেঙ্গল গেজেট কে কবে প্রকাশ করেন?
উত্তর – জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন।
2. *উনিশ শতকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা সাময়িকপত্রের নাম লেখো।
উত্তর – উনিশ শতকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা সাময়িকপত্র ছিল ‘বামাবোধিনী’, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘ভারতী’ ও ‘প্রবাসী’।
3. * উনিশ শতকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা সংবাদপত্রের নাম লেখো।
উত্তর – উনিশ শতকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা সংবাদপত্র ছিল ‘সমাচার দর্পণ’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সন্ধ্যা’, ‘বেঙ্গলী’ প্রভৃতি।
4. *উনিশ শতকের বাংলার আর্থসামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে এমন কয়েকটি বাংলা সাহিত্যগ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর – উনিশ শতকের বাংলার আর্থসামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে এমন কয়েকটি বাংলা সাহিত্যগ্রন্থ হল—কালীপ্রসন্ন সিংহর ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ ’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘কৃয়চরিত’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, প্যারীচাঁদ মিত্রর ‘আলালের ঘরের দুলাল’, নবীনচন্দ্ৰ সেনের কাব্যগ্রন্থ ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রভৃতি।
5. গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক হিসেবে হরিনাথ মজুমদার কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর – সাংবাদিক হরিনাথ মজুমদার গ্রামীণ মানুষ, বিশেষত কৃষকদের ওপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষের ওপর জমিদার, মহাজন, নীলকরদের শোষণ-অত্যাচারের করুণ চিত্র তিনি পত্রিকার মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরতেন।
6. * বামাবোধিনী সভা-র উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর – বামাবোধিনী সভার উদ্দেশ্য ছিল– [1] সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা করা, [2] নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো, [3] নারীদের অধিকার ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা, [4] নারীজাতির স্বার্থে বিভিন্ন বইপত্র ও পত্রিকা প্রকাশ করা প্রভৃতি।
7. *‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের কীরূপ সামাজিক তথ্য জানা যায় ?
উত্তর – ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার নারীদের অবস্থা, গৃহচিকিৎসা, শিশুপালন, গৃহকার্য, শিল্পকর্ম, পরিবার ও সমাজের যোগসূত্র হিসেবে নারীর ভূমিকা প্রভৃতি সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায় ।
8. *‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় সমকালীন বাংলার কীরূপ সামাজিক চিত্র পাওয়া যায় ?
উত্তর – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় সমকালীন বাংলার সামাজিক শোষণ, সাধারণ মানুষের ওপর সরকার ও পুলিশের অত্যাচার, নীলচাষিদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার, দরিদ্রশ্রেণির ওপর অত্যাচার, দরিদ্রদের দুরবস্থা প্রভৃতির চিত্র পাওয়া যায়।
9. * ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার কয়েকটি সামাজিক উদ্যোগ উল্লেখ করো।
উত্তর – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ নেয়। যেমন – [1] এই পত্রিকা বাংলার নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের শোষণের খবর ছাপিয়ে এবিষয়ে মানুষকে সচেতন করে। [2] বাংলার চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রফতানির বিরোধিতা করে। [3] বাংলায় বিদেশি মদ আমদানির বিরোধিতা করে। [4] বহুবিবাহের বিরোধিতা করে এবং বিধবাবিবাহকে সমর্থন করে। [5] নারীশিক্ষার সমর্থনে প্রচার চালায়। [6] ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধিতা করে প্রভৃতি।
10. *‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার বৈশিষ্ট্য কী ছিল ?
উত্তর – ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল – [1] বাংলায় ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের বিরোধিতা, [2] মদ আমদানির বিরোধিতা, [3] বহুবিবাহের বিরোধিতা, [4] অত্যাচারিত নীলচাষিদের সমর্থন ও পাশে দাঁড়ানো, [5] ব্রিটিশবিরোধী কৃষকদের আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করা, [6] নারীশিক্ষা প্রভৃতির সপক্ষে জনমত তৈরি করা, [7] সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ওপর পত্রিকাটির সর্বাধিক নির্ভরশীলতা প্রভৃতি।
11. * সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতি ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার কী মনোভাব ছিল?
উত্তর – ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হলে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে এবং সাঁওতাল এলাকায় সামরিক শাসন জারির তীব্র বিরোধিতা করে। পত্রিকায় সাঁওতালদের ওপর সীমাহীন শোষণের চিত্র নিয়মিত তুলে ধরা হয়।
12. * নারীসমাজের উন্নতির বিষয়ে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা কীরূপ উদ্যোগ নেয়?
উত্তর – ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা নারীসমাজের উন্নতিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। যেমন– [1] এই পত্রিকা বিধবাবিবাহকে সমর্থন করে। [2] নারীশিক্ষার সমর্থনে ব্যাপক প্রচার চালায়। [3] পতিতা সমস্যা নিয়ে নানা প্রবন্ধ প্রকাশ করে।
13. * হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অত্যাচারী নীলচাষিদের জন্য কীরূপ সহযোগিতা করেন?
উত্তর – হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাংলার দুর্দশাগ্রস্ত নীলচাষিদের নানাভাবে সহায়তা করেন। যেমন— [1] নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ নিয়মিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। [2] অত্যাচারিত নীলচাষিরা হরিশচন্দ্রের ভবানীপুরের বাড়িতে হাজির হয়ে অর্থিক সহায়তা লাভ করতেন। [3] তিনি চাষিদের সমস্যার বিবরণ শুনে তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে দেওয়া, দরখাস্ত লিখে দেওয়া, প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দেওয়া প্রভৃতি কাজ করে দিতেন।
14. ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ কবে প্রথম প্রকাশিত হয়? এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর – ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।
গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার যিনি ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে পরিচিত ছিলেন।
15. * ‘গ্রামবাৰ্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায় কী কী আলোচনা প্রকাশিত হত।
উত্তর – ‘গ্রামবাৰ্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায় নীলকর, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারের বিবরণ, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, বিপ্লবীদের শপথ ও বীরত্বগাথা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা প্রকাশিত হত।
16. *‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায় সমকালীন বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?
উত্তর – ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায় সমকালীন বাংলার বিভিন্ন সামাজিক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন – [1] নীলকরদের সীমাহীন অত্যাচারে দরিদ্র নীলচাষিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। [2] জমিদার, জোতদার, মহাজন প্রমুখের শোষণ ও অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। [3] পুলিশের কাছে বিচার চেয়েও এর কোনো প্রতিকার মিলত না। বরং অভিযোগকারীই পুলিশের নির্যাতনের শিকার হত।
17 ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর – ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল – [1] সমকালীন সময়ে গ্রামের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা, [2] কৃষকদের ওপর জমিদার, মহাজন, নীলকরদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনী জনসমক্ষে তুলে ধরা, [3] গ্রামীণ মানুষদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের সমালোচনা করা, [4] প্রভুর শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ মানুষকে সচেতন করা প্রভৃতি।
18. ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ উপন্যাসের ভাষা কীরূপ?
উত্তর – ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ উপন্যাসটি কলকাতার কথ্য ভাষায় হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে রচিত হয়েছে। ইতিপূর্বে বাংলা গদ্যে নিরঙ্কুশ কথ্যভাষার ব্যবহার দেখা যায় না।
19. * ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থের কোন্ ভাগে কীসের আলোচনা রয়েছে?
উত্তর – ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থের প্রথম ভাগে কলিকাতায় চড়ক পাৰ্ব্বণ, কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা, হুজুক, ছেলেধরা, প্রতাপচাঁদ, মহাপুরুষ, লাল রাজাদের বাড়ী দাঙ্গা, কৃশ্চানি হুজুক, সাতপেয়ে গরু, দরিয়াই ঘোড়া, লক্ষ্ণৌয়ের বাসা এবং দ্বিতীয় ভাগে রথ, দুর্গোৎসব, রামলীলা, রেলওয়ে প্রভৃতির আলোচনা রয়েছে।
20. *‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থে কলকাতার বাবু সম্প্রদায়কে কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে? 
উত্তর – ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ উপন্যাসে কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের অন্যায়, অবক্ষয় ও কুরুচিকর দিকগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এই গ্রন্থে দেখানো হয়েছে— [1] বাবু সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক অবক্ষয় তীব্র আকার ধারণ করেছে। [2] এই বাবু সম্প্রদায় হঠাৎ ফুলেফেঁপে ধনী হয়ে উঠেছে। [3] এরা সবাই কমবেশি জাল-জুয়াচুরি বা ফন্দি-ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। [4] বাবুরা বাঙালিয়ানা ভুলে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত।
21. * ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় তৎকালীন সমাজের মানুষকে কয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ও কী কী ?
উত্তর – ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’য় তৎকালীন সমাজের মানুষকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা—[1] ইংরেজি-শিক্ষিত সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী, [2] ইংরেজি শিক্ষিত নব্যপন্থী যারা সাহেবি চালচলনের অনুকরণকারী নয় এবং [3] ইংরেজি না-জানা গোঁড়া হিন্দুসমাজ।
22. *‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থটির গুরুত্ব কোথায়?
উত্তর – ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থটির গুরুত্ব হল—[1] এই গ্রন্থ থেকে তৎকালীন কলকাতা ও তার প্রতিবেশী অঞ্চলের কথ্যভাষার ধরন সম্পর্কে জানা যায়। [2] হঠাৎ ফুলেফেঁপে ধনী হয়ে ওঠা তৎকালীন বাঙালি সম্প্রদায়ের চরিত্র সম্পর্কে এই গ্রন্থ থেকে ধারণা পাওয়া যায়। [3] এই গ্রন্থে সমাজের বিভিন্ন ত্রুটিগুলি উল্লেখ করে তা সংশোধনের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
23. *দীনবন্ধু মিত্রের লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর – দীনবন্ধু মিত্রের লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল ‘নীলদর্পণ’, ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘সধবার একাদশী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ প্রভৃতি। ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি।
24. * ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রধান আলোচ্য বিষয় কী?
অথবা, ‘নীলদর্পণ’ নাটকে তৎকালীন বঙ্গসমাজের কীরূপ চিত্র ফুটে উঠেছে?
উত্তর – ‘নীলদর্পণ’ নাটকে তৎকালীন বঙ্গসমাজে নীলচাষিদের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে—[1] নীলকর সাহেবরা বাংলার দরিদ্র চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করে। [2] নীলচাষ করে চাষিদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। [3] নীলচাষ না করলে নীলকর সাহেবরা চাষিদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালায়।
25. সমাজসংস্কারে নব্যবঙ্গদের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর – ডিরোজিও-র অনুগামীরা নব্যবঙ্গ নামে পরিচিত। এরা হিন্দু সমাজের পৌত্তলিকতা, জাতিভেদপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতির সপক্ষে আন্দোলন চালায়। এরা সমাজে যুক্তিবাদেরও প্রসার ঘটায়।
26. * কে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং কার নামে এটি প্রকাশিত হয়?
উত্তর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন বলে গবেষকগণ মনে করেন। ব্রিটিশ সরকারের শাস্তি এড়াতে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ খ্রিস্টান পাদরি রেভারেন্ড জেমস লং-এর নামে প্রকাশিত হয়।
27. জেমস লং-এর নামে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়?
উত্তর – জেমস লং-এর নামে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে ইংরেজ সরকার লং সাহেবকে অভিযুক্ত করে। বিচারে তাঁর এক মাসের কারাদণ্ড এবং ১ হাজার টাকা জরিমানা হয়।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

একটি বাক্যে উত্তর দাও

1. ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র শেষ সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর – ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’র শেষ সম্পাদক ছিলেন আনন্দ কুমার দত্ত।
2. ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা কতদিন চলে?
উত্তর – বামাবোধিনী পত্রিকা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে।
3. ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা কোন্ ভাষায় প্রকাশিত হয়?
উত্তর – ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়।
4. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কে ছিলেন?
উত্তর – হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক এবং ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক।
5. ‘অবলাবান্ধৰ’ পত্রিকার সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর – ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
6. কোন পত্রিকাকে ‘গ্রামীণ সংবাদপত্রের জনক’ বলা হয়?
উত্তর – ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’-কে ‘গ্রামীণ সংবাদপত্রের জনক’ বলা হয়।
7. হরিনাথ মজুমদার সাধারণ মানুষের কাছে কী নামে পরিচিত ছিলেন ?
উত্তর – হরিনাথ মজুমদার সাধারণ মানুষের কাছে ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে পরিচিত ছিলেন।
৪. ‘গ্রামবার্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকা কোথা থেকে প্রকাশিত হত?
উত্তর – ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকা অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থেকে প্রকাশিত হত।
9. কলকাতা থেকে প্রথম কোন্ সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়?
উত্তর – কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র হল ‘বেঙ্গল গেজেট।
10. বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বাঙালি পরিচালিত প্রথম পত্রিকা কোনটি?
উত্তর – বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বাঙালি পরিচালিত প্রথম সংবাদপত্র হল ‘বাঙ্গালা গেজেট’।
11. কালীপ্রসন্ন সিংহের অমর সাহিত্যকীর্তি কোনটি?
উত্তর – কালীপ্রসন্ন সিংহের অমর সাহিত্যকীর্তির নাম হল ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা।
12. কে, কবে বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – কালীপ্রসন্ন সিংহ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
13. দীনবন্ধু মিত্র কে ছিলেন?
উত্তর – দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন একজন বাংলা সাহিত্যিক, ‘নীলদর্পণ’ নাটক ছিল যাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি।
14. দীনবন্ধু মিত্র কবে, কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর – দীনবন্ধু মিত্র ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
15. নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে কোন বাংলা নাটকটি রচিত হয়?
উত্তর – নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচিত হয়।
16. নীলদর্পণ কে রচনা করেন?
উত্তর – নীলদর্পণ রচনা করেন দীনবন্ধু মিত্র।
17. কবে, কারা কাদের বিরুদ্ধে নীলবিদ্রোহ করে?
উত্তর – ১৮৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলার অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বাংলার অত্যাচারিত নীলচাষিরা নীলবিদ্রোহ করে।
18. ‘নীলদর্পণ’ নাটকে প্রধান অত্যাচারী নীলকর সাহেবের চরিত্রটির নাম কী?
উত্তর – ‘নীলদর্পণ’ নাটকে প্রধান অত্যাচারী নীলকর সাহেবের চরিত্রটির নাম ছিল উড।
19. কলকাতায় জাতীয় নাট্যশালা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – কলকাতায় জাতীয় নাট্যশালা ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।
20. কোন্ বাংলা নাটক প্রথম ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়?
উত্তর – বাংলা নাটক ‘নীলদর্পণ’ প্রথম ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়।
21. উমেশচন্দ্র দত্তর লেখা দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর – উমেশচন্দ্র দত্তর লেখা দুটি अদ হল ‘বামারচনাবলী’ ও ‘স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যার আবশ্যকতা’।

ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো

1. উনিশ শতকের একটি উল্লেখযোগ্য সাময়িকপত্র ছিল ‘বামাবোধিনী’ নামে মাসিক পত্রিকা।
উত্তর – ঠিক
2. ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ।
উত্তর – ঠিক
3. ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাটি প্রথনে সাপ্তাহিক ছিল, পরে এটি দৈনিকে রূপান্তরিত হয়।
উত্তর – ঠিক
4. উমেশচন্দ্র দত্তর কাছ থেকে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার প্রেস ও কাগজ স্বত্ব কিনে নেন।
উত্তর – ভুল
5. গ্রামবার্তাপ্রকাশিকা পত্রিকা প্রকাশ করেন হরিনাথ মজুমদার।
উত্তর – ঠিক
6. নীলচাষিদের ওপর শোষণের প্রতিকারের চিন্তা করে কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্তাপ্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন।
উত্তর – ঠিক
7. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে একবার জমিদারদের আক্রমণের হাত থেকে লালন ফকির তাঁর দলবল নিয়ে রক্ষা করেন।
উত্তর – ভুল
৪. ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রেক্ষাপটে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নীলবিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
উত্তর – ভুল
9. ‘কাঙাল ফকির চাঁদ’ নামে হরিনাথ মজুমদার বাউলগান লেখেন।
উত্তর – ঠিক
10. হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন একজন গণসংগীত শিল্পী।
উত্তর – ঠিক

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. ………… ছিলেন ‘আধুনিক ভারতের জনক’।
উত্তর – রাজা রামমোহন রায়
2. ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ……….।
উত্তর – ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
3. গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পাদিত সংবাদপত্র ছিল ……….।
উত্তর – বাঙ্গালা গেজেট
4. ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ ………. সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উত্তর – গ্রামীণ
5. ইউরোপীয়রা ………. পত্রিকা থেকে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের খবর জানতে পারে।
উত্তর – হিন্দু প্যাট্রিয়ট
6. নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয় ……….।
উত্তর – হিন্দু প্যাট্রিয়ট
7. ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক সামাজিক রচনার একটি উদাহরণ হল ……….।
উত্তর – হুতোমপ্যাচার নক্সা
8. ………. গ্রন্থে কলকাতার বাবুদের সামাজিক অবক্ষয় তুলে ধরা হয়েছে।
উত্তর – হুতোমপ্যাঁচার নক্সা

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. ভারতের প্রথম বাঙালি সংবাদপত্র প্রকাশক হলেন-
(a) গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
(b) অক্ষয়কুমার দত্ত
(c) বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়
(d) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
উত্তর – (a) গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
2. বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত পত্রিকাটির নাম-
(a) দিগদর্শন
(b) সমাচার দর্পণ
(c) সোমপ্রকাশ
(d) বঙ্গদর্শন
উত্তর – (a) দিগদর্শন
3. বাংলা ভাষায় বাঙালি পরিচালিত প্রথম সংবাদপত্র হল—
(a) বেঙ্গল গেজেট
(b) বাঙ্গাল গেজেটি
(c) বামাবোধিনী
(d) সোমপ্রকাশ
উত্তর – (b) বাঙ্গাল গেজেটি
4. ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়-
(a) ১৮৩৩ খ্রি.
(b) ১৮৫৯ খ্রি.
(c) ১৮৬০ খ্রি.
(d) ১৮৬৩ খ্রি.
উত্তর – (d) ১৮৬৩ খ্রি.
5. ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা ছিল একটি—
(a) দৈনিক পত্রিকা
(b) সাপ্তাহিক পত্রিকা
(c) মাসিক পত্রিকা
(d) ত্রৈমাসিক পত্রিকা
উত্তর – (c) মাসিক পত্রিকা
6. ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন—
(a) দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ
(b) উমেশচন্দ্র দত্ত
(c) কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার
(d) শিশিরকুমার ঘোষ
উত্তর – (b) উমেশচন্দ্র দত্ত
7. বাংলায় প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন—
(a) হরিনাথ মজুমদার
(b) জেমস অগাস্টাস হিকি
(c) হ্যারিয়েট বিচার স্টো
(d) উমেশচন্দ্র দত্ত
উত্তর – (b) জেমস অগাস্টাস হিকি
৪. বামাবোধিনী পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখিকা ছিলেন—
(a) মানকুমারী বসু
(b) চন্দ্রমুখী বসু
(c) কাদম্বিনী গাঙ্গুলি
(d) সরোজিনী নাইডু
উত্তর – (b) চন্দ্রমুখী বসু
9. উনিশ শতকের নারীদের অবস্থা জানার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকপত্র ছিল-
(a) হিন্দু প্যাট্রিয়ট
(b) গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা
(c) সমাচার দর্পণ
(d) বামাবোধিনী
উত্তর – (d) বামাবোধিনী
10. বামাবোধিনীর ‘বামা’ আসলে কারা?
(a) বিধবারা
(b) বালিকারা
(c) নববিবাহিতরা
(d) সমগ্র নারী জাতি
উত্তর – (d) সমগ্র নারী জাতি
11. অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক কে ছিলেন?
(a) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(b) শিশিরকুমার ঘোষ
(c) উমেশচন্দ্র দত্ত
(d) দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়
উত্তর – (b) শিশিরকুমার ঘোষ
12. ‘সোমপ্রকাশ’ ছিল একটি—
(a) দৈনিক পত্রিকা
(b) সাপ্তাহিক পত্রিকা
(c) পাক্ষিক পত্রিকা
(d) মাসিক পত্রিকা
উত্তর – (b) সাপ্তাহিক পত্রিকা
13. হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম প্রবর্তক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন—
(a) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(b) অক্ষয়কুমার দত্ত
(c) মধুসূদন রায়
(d) দীনবন্ধু মিত্র
উত্তর – (c) মধুসূদন রায়
14. হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন—
(a) গিরিশচন্দ্র ঘোষ
(b) হরিশচন্দ্র মুখার্জি
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) অক্ষয়কুমার দত্ত
উত্তর – (a) গিরিশচন্দ্র ঘোষ
15. ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন—
(a) হরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
(b) হরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(c) হরিশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়
(d) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
উত্তর – (d) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
16. দিগদর্শন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন—
(a) হরচন্দ্র রায়
(b) মার্শম্যান
(c) ঈশ্বর গুপ্ত
(d) উইলিয়ম কেরি
উত্তর – (b) মার্শম্যান
17. প্রথম কোন্ পত্রিকায় লালন ফকিরের গান প্রকাশিত হয়?
(a) হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এ
(b) বামাবোধিনী-তে
(c) সম্বাদ প্রভাকর-এ
(d) গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা-তে
উত্তর – (d) গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা-তে
18. যে সাহিত্যিক পাবনার কৃষকবিদ্রোহ সমর্থন করেছিলেন তিনি হলেন—
(a) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) মধুসূদন দত্ত
(d) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
উত্তর – (a) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
19. ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতির সমালোচনা করা হয়—
(a) গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকায়
(b) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়
(c) বামাবোধিনী পত্রিকায়
(d) ভারতী পত্রিকায়
উত্তর – (b) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়
20. ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) উমেশচন্দ্র দত্ত
(b) হরিনাথ মজুমদার
(c) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(d) কালীপ্রসন্ন সিংহ
উত্তর – (d) কালীপ্রসন্ন সিংহ
21. সাঁওতাল এলাকায় সামরিক শাসন জারির তীব্র বিরোধিতা করা হয়—
(a) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়
(b) দিগদর্শন পত্রিকায়
(c) প্রবাসী পত্রিকায়
(d) সঞ্জীবনী পত্রিকায়
উত্তর – (a) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়
22. ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’র লেখক হলেন—
(a) গিরিশচন্দ্র ঘোষ
(b) প্যারিচাঁদ মিত্র
(c) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
(d) কালীপ্রসন্ন সিংহ
উত্তর – (d) কালীপ্রসন্ন সিংহ
23. ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশক ছিলেন—
(a) কালীপ্রসন্ন সিংহ
(b) মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(c) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(d) রেভাঃ জেমস লং
উত্তর – (d) রেভাঃ জেমস লং
24. ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের জন্য জেমস লঙের কারাদণ্ড হয়-
(a) ১ মাস।
(b) ৬ মাস
(c) ১ বছর
(d) ১২ বছর
উত্তর – (a) ১ মাস।
25. নীলদর্পণ নাটককে ‘আংকল টমস কেবিন’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন-
(a) শিশির কুমার ঘোষ
(b) দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়
(c) নবগোপাল মিত্র
(d) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
উত্তর – (d) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

TOPIC – B শিক্ষার সংস্কার

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *বাংলায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – বাংলায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার
ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে সরকার এদেশে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে লিখিত ‘অবজারভেশন’ নামে এক পুস্তিকায় এই মত প্রকাশ করেন যে, ভারতের পশ্চাদপদ সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতার উন্নয়নের জন্য এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার। যদিও কোম্পানি তখন এবিষয়ে গুরুত্ব দেননি। কেন-না, সরকার মনে করত, ভারতের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে চাপিয়ে দিলে ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হতে পারে।
  1. ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: প্রথমদিকে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ না নিলেও এদেশে বিভিন্ন কারণে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে। [i] এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ব্যাবসাবাণিজ্য, প্রশাসন, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতির ধারাবাহিক প্রসার ঘটলে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ইংরেজি-জানা কর্মচারীর বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়। [ii] মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকরা চাকরি লাভের আশায় ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। [iii] এদেশে আগত খ্রিস্টান মিশনারিরাও খ্রিস্টধর্মের প্রচারের জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর প্রয়োজন অনুভব করে।
  2. প্রাথমিক উদ্যোগ: এদেশে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকলে প্রথমদিকে কয়েকজন বিদেশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতায় কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শোরবোর্ন, মার্টিন, বাউল, অরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখ।
  3. মিশনারিদের উদ্যোগ: ইউরোপের বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি গোষ্ঠী বাংলা দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রসারের শ্যে এখানকার বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসে। লন্ডন মিশনারি সোসাইটি, চার্চ মিশনারি সোসাইটি ও শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে এবং কলকাতার বাইরে চুঁচুড়া, বর্ধমান, বহরমপুর, কালনা, মালদহ প্রভৃতি শহরে বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাপটিস্ট মিশনের উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড প্রমুখের উদ্যোগে ১২৬টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে চুঁচুড়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্কটিশ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার ডাফ-এর প্রচেষ্টায় বাংলায় কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ)। কলকাতার প্রথম বিশপ মিডলটন শিবপুরে বিশপ কলেজ (১৮১৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। জেসুইট মিশনারিরা কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.) এবং লরেটো হাউস স্কুল (১৮৪২ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
  4. বিভিন্ন মনীষীর উদ্যোগ: বাংলায় রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, তেজচন্দ্র রায়, জয়নারায়ণ ঘোষাল এবং স্কটল্যান্ডের ঘড়ি প্রস্তুতকারক ডেভিড হেয়ার প্রমুখ মনীষীও বাংলায় ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরে এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। রামমোহন রায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট প্রমুখের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেভিড হেয়ার পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি (১৮১৮খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে হেয়ার স্কুল নামে পরিচিত। বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি (১৮১৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। গৌরমোহন আঢ্য ওরিয়েন্টাল সেমিনারি (১৮২৮ খ্রি.) নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার: বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকরা সরকারি চাকরি লাভের আশায় ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচ বা নির্দেশনামাতেও ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের সপক্ষে অভিমত দেওয়া হয়। সরকারি উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এদেশে ১৫১টি ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

2. শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর – শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এরপর এদেশে শিক্ষাব্যবস্থার নীতি-নির্ধারণের বিষয়টি তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
  1. দ্বন্দ্বের সূত্রপাত: ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে জনশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নিলে এদেশে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো উচিত সে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
  2. রামমোহন রায়ের উদ্যোগ: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সনদ আইনের (১৮১৩ খ্রি.) দ্বারা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা বায়ের সিদ্ধান্ত নিলে রামমোহন রায় সরকারকে এক পত্রের দ্বারা (১৮২৩ খ্রি.) এই টাকা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা অর্থাৎ ইংরেজি ও আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ব্যয়ের অনুরোধ জানান।
  3. প্রাচ্য-পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্ব: বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫খ্রি.) ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিত—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে জনশিক্ষা কমিটির সদস্যরা কার্যত প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট এবং পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এভাবে সরকারি শিক্ষানীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
  4. প্রাচ্যবাদী: প্রাচ্যবাদীরা ভারতে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। প্রাচ্যবাদের সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ।
  5. পাশ্চাত্যবাদী: পাশ্চাত্যবাদীরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা, অর্থাৎ ইংরেজি, আধুনিক বিজ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষার প্রসারের দাবি জানান। পাশ্চাত্যবাদের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ।
  6. মেকলে মিনিট: বেন্টিঙ্কের আমলে জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (২ ফেব্রুয়ারি) বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব (Minutes) দেন যা ‘মেকলের মিনিট’ নামে পরিচিত। অবশেষে পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হন এবং সরকার ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের নীতি নেয়।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হওয়ার ফলে ভারতে সরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের কোনো বাধা রইল না। এরপর একে একে বিভিন্ন পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে এদেশে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশের পথ আরও সুগম হয়।
উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচে আধুনিক উচ্চতর শিক্ষার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে লর্ড ক্যানিং-এর শাসনকালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে (২৪ জানুয়ারি) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এদেশে উচ্চশিক্ষার বিকাশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
  1. পরিধি: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের প্রাচীনতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাশ্চাত্য ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে লাহোর থেকে রেঙ্গুন এবং শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের পরিধি বিস্তৃত ছিল। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।
  2. মানের চরম উৎকর্ষ: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য থাকার সময় (১৯০৬-১৪ খ্রি. এবং ১৯২১-২৩ খ্রি.) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছোয়। তাঁর আমলে কলা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নত গবেষণার কাজ সারা বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর অনুরোধে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ এখানে পড়াতে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক অধ্যাপক ছিলেন।
  3. প্রথম স্নাতক: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে যদুনাথ বোস ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম স্নাতক হন। এশিয়ার প্রথম ডি লিট বেণীমাধব বড়ুয়া এখানকার ছাত্র ছিলেন।
  4. কৃতী ছাত্র: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করে বিভিন্ন ছাত্র পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। এখানকার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কৃতী ছাত্র ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সর্বপল্লী রাধাকৃয়ান, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন · রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ। এঁরা দেশবিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

ভারতে পাশ্চাত্য ধারায় উচ্চশিক্ষার প্রসারে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথমদিকে এই বিশ্ববিদ্যালয় মূলত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রি প্রদান করত। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি দেশের বৃহত্তম গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়।

3. *ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসার
ভূমিকা: উনিশ শতকের শুরুতেও বাংলায় মেয়েদের লেখাপড়া শেখার বিশেষ সুযোগ ছিল না। বাংলা শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে উইলিয়াম অ্যাডাম তাঁর রিপোর্টে (১৮৩৬ খ্রি.) লেখেন, “যখন হিন্দুরা বিশ্বাস করত যে শিক্ষা বালবিধবার পথ প্রশস্ত করবে, তখন হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই নারীদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে অনীহা ছিল, কারণ তারা এর মধ্যে নারীসুলভ ষড়যন্ত্রের’ আশঙ্কা করে।”
  1. সীমিত শিক্ষার সুযোগ : উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাংলার অভিজাত পরিবারের কিছু মেয়ে কিছুটা দেশীয় শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিল। তবে একথা বলাই যায়, সাধারণ মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের তেমন সুযোগ ছিল না। নারীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা প্রভৃতি বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৮/১০ বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। ওই বয়সের মধ্যে কেউ কেউ বাপের বাড়িতে অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত হত মাত্র। তবে নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রচলন ঘটে।
  2. মিশনারিদের ভূমিকা: ইউরোপ থেকে আগত খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টধর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে এদেশে নারীশিক্ষার প্রসারের কিছু কিছু উদ্যোগ নেয়। [i] বাংলার শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড-এর উদ্যোগে ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে ৪০ জন বালিকাকে নিয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। [ii] লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। [iii] ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের স্ত্রীদের উদ্যোগে কলকাতায় ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি (১৮১৯ খ্রি.) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠান বাংলায় বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।
  3. বিশিষ্ট নারীদের ভূমিকা; কয়েকজন বিশিষ্ট বিদেশিনি বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিসেস কুক, মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার, অ্যানেট অ্যাক্রয়েড প্রমুখ।[i] চার্চ মিশনারি সোসাইটি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ৩০টিরও বেশি বালিকা বিদ্যালয়ের দেখাশোনার উদ্দেশ্যে মিস্সে কুক কলকাতায় আসেন (১৮২১ খ্রি.)।[ii] মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার প্রমুখ বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়েদের পড়াশোনা শেখার আবেদন জানান। তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে অনেক বাড়িতে মা-মেয়ে একসঙ্গে পড়তে শুরু করেন। এ ছাড়া বহু বালিকা স্কুলে যেতে শুরু করে। [iii] মেরি কার্পেন্টার বিদেশের নারীসংগঠন থেকে ভারতের নারীশিক্ষার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। নারীশিক্ষার প্রসারে তাঁর উদ্যোগ এদেশের মনীষীদের উৎসাহিত করে। [iv] অ্যানেট অ্যাক্রয়েড পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নারীশিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন।
  4. অন্যান্য উদ্যোগ: কলকাতা স্কুল সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.), লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন (১৮২৪ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্রাহ্ণসমাজ নারীশিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট প্রচার চালায়। এ ছাড়া বিভিন্ন বিদেশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  5. বিদ্যাসাগরের ভূমিকা: বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১ খ্রি.)। বিদ্যাসাগর বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় (১৮৫৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এগুলিতে ১৩ হাজার ছাত্রী পড়াশোনা করত। বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালের আরও কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  6. সাফল্য: বিভিন্ন উদ্যোগে নারীশিক্ষার প্রসারের ফলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮টি। রাসসুন্দরী দেবী নিজে নিজে লেখাপড়া শিখে ‘আমার জীবন’ (১৮৭৫ খ্রি.) নামে নিজের আত্মজীবনী রচনা করেন। এটি হল বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম আত্মজীবনী। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ও চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
উপসংহারঃ ব্রিটিশ আমলে বাংলায় নারীশিক্ষার যে অগ্রগতি ঘটে তা সমাজের পক্ষে অত্যন্ত শুভ হয়েছিল। নারীশিক্ষার প্রসারের ফলেই নারীদের মধ্য থেকে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, বিধবাবিবাহ, দেবদাসী প্রথা প্রভৃতি বিরোধিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. ভারতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করো।
উত্তর – ভারতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিষয়ক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট
ভূমিকা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এরপর কোম্পানি কর্তৃক এদেশে কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা উচিত সে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। এই দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ-
  1. ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জন্য চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইন পাস করে। এই আইনের একটি ধারায় বলা হয় যে, কোম্পানি প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য ব্যয় করবে।
  2. জনশিক্ষা কমিটি: ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে ভারতে জনশিক্ষার নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জনশিক্ষা কমিটি বা কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন গঠিত হয়।
  3. রামমোহনের দাবি: জনশিক্ষা কমিটি কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রামমোহন রায় বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে এক পত্র লেখেন। তিনি এই পত্রে সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ইংরেজি ও আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের দাবি জানান।
  4. দ্বন্দ্বের সূত্রপাত: ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃত ভাষাশিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নিলেও রামমোহন রায়-সহ কেউ কেউ এদেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের দাবি জানান। এভাবে ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন্ ধরনের শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত সেবিষয়ে একটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

উপসংহারঃ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছিল। এই দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হলে কোম্পানি সরকার ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের নীতি গ্রহণ করে।

2. * ‘মেকলে মিনিট’ সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – মেকলের প্রস্তাব বা ‘মিনিট’
ভূমিকা: ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এদেশে একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
  1. প্রেক্ষাপট: ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে প্রাচ্য শিক্ষা না আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেবে সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার পূর্বে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। একদল পণ্ডিত এদেশে প্রাচ্য শিক্ষার প্রবর্তনের কথা বললেও অপর দল এদেশে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের দাবি জানান।
  2. মেকলের প্রস্তাব: বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি ও উগ্র পাশ্চাত্যবাদী টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (২ ফেব্রুয়ারি) বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব দেন যা ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত।
  3. মেকলের মিনিটের বক্তব্য: মেকলে তাঁর ‘মিনিট’ বা প্রস্তাবে বলেন যে— [i] প্রাচ্যের শিক্ষা বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন এবং পাশ্চাত্যের তুলনায় সম্পূর্ণ নিকৃষ্ট। [ii] প্রাচ্যের সভ্যতা দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপবিত্র। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। [iii] এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে ‘ক্রমনিম্ন পরিসূত নীতি’ বা চুঁইয়ে পড়া নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুসারে তা ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। [iv] পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে এদেশে এমন একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা ‘রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ’।

উপসংহার: ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রেক্ষাপটে ‘মেকলে মিনিট’ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। শেষপর্যন্ত মেকলে মিনিটের সুপারিশ মেনেই বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের শিক্ষানীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

3. *ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। অথবা, ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনে ‘মেকলে মিনিট’-এর ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর – ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সূত্রপাত
ভূমিকা: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতের জনশিক্ষার জন্য প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা বলে।
  1. বিতর্ক: সনদ আইনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য ব্যয় করা উচিত সে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে সরকারের ঘনিষ্ঠ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়।
  2. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের বক্তব্য: প্রাচ্যবাদের সমর্থক এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রক, উইলসন প্রমুখ এদেশে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যবাদের সমর্থক মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের দাবি জানান।
  3. মেকলে ‘মিনিট’: বেন্টিঙ্কের আমলে (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) জনশিক্ষা কমিটি-র সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব (Minutes) দেন (২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫ খ্রি.), যা ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবে তিনি বলেন যে— [i] প্রাচ্যের শিক্ষা নিকৃষ্ট এবং বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। [ii] পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে এদেশে এমন একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা “রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।”
  4. সরকারের সিদ্ধান্ত : অবশেষে মেকলের বক্তব্য মেনে নিয়ে বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (৭ মার্চ) ভারতে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারকে সরকারের শিক্ষানীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

উপসংহার: টমাস মেকলে ছিলেন উগ্র পাশ্চাত্যবাদী। ‘জনশিক্ষা কমিটি’র সভাপতি হিসেবে তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সুপারিশ করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক তাঁর সুপারিশকেই কার্যত সিলমোহর দিলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের বাধা দূর হয়।

4. *ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিদেশি উদ্যোগের উল্লেখ করো।
উত্তর – ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিদেশি উদ্যোগ
ভূমিকা: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও প্রথমদিকে তারা এদেশে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেয়নি। এই সময় কিছু বিদেশি এবং কয়েকটি খ্রিস্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে এদেশে বিভিন্ন ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
  1. ব্যক্তিগত উদ্যোগ: শোরবোর্ন, মার্টিন, বাউল, অরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ বিদেশি বাংলায় কয়েকটি ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ড্রামন্ডের ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’ এবং ডেভিড হেয়ারের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়।
  2. মিশনারিদের উদ্যোগ: বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি গোষ্ঠী খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে এসে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা চালায়। [i] ব্যাপটিস্ট মিশনের উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড প্রমুখের উদ্যোগে ১২৬টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মিশনের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। [ii] লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে চুঁচুড়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। [iii] কলকাতার প্রথম বিশপ মিডলটন শিবপুরে বিশপ কলেজ (১৮১৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। [iv] স্কটিশ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার ডাফ-এর প্রচেষ্টায় বাংলায় কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউট (বর্তমান নাম ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’)। [v] জেসুইট মিশনারিরা কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.) এবং লরেটো হাউস স্কুল (১৮৪২ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। [vi] এ ছাড়া মিশনারিদের উদ্যোগে খ্রিস্টান কলেজ (১৮৩৭ খ্রি.) এবং বোম্বাই-এ উইলসন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার: ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং কিছু দেশীয় ও বিদেশি গুণী ব্যক্তি যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের কাজ নিঃসন্দেহে অনেকটা এগিয়ে যায়।

5. *ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে ভারতীয়দের ব্যক্তিগত উদ্যোগের উল্লেখ করো।
উত্তর – ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে ভারতীয়দের ব্যক্তিগত উদ্যোগ
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের কিছু সচেতন ও প্রগতিশীল মানুষ এদেশে প্রচলিত পশ্চাদপদ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বিশেষ উদ্যোগ নেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
  1. পথপ্রদর্শক: ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে যেসব ভারতীয় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, তেজচন্দ্র রায়, জয়নারায়ণ ঘোষাল প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন স্কটল্যান্ডের ঘড়ি প্রস্তুতকারক ডেভিড হেয়ার।
  2. অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল: রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিলে রামমোহন এক পত্রের মাধ্যমে সরকারকে অনুরোধ করেন যে, এই টাকা যেন ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ব্যয় করা হয়।
  3. হিন্দু কলেজ: ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট প্রমুখের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় রামমোহন রায়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। এটি পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ (১৮৫৫ খ্রি.) এবং আরও পরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১০ খ্রি.) নামে পরিচিত হয়।
  4. ওরিয়েন্টাল সেমিনারি: গৌরমোহন আঢ্য (১৮২৮ খ্রি.) কলকাতায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার: ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে যে ব্যক্তিগত উদ্যোগ লক্ষ করা গিয়েছিল তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। সরকারের শিক্ষানীতিতে প্রাচ্য শিক্ষা না পাশ্চাত্য শিক্ষা দেওয়া হবে এই দ্বন্দ্বে যখন ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের গতি রুদ্ধ হয়ে আসে, তখন উপরোক্ত মুক্তমনা গুণী মানুষরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের কাজকে অনেকটা এগিয়ে দেন।

6. কোন্ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে শুরু করে ?
অথবা, ভারতে ব্রিটিশ সরকার কেন ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেয়?
উত্তর – ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের কারণ
ভূমিকা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমদিকে এদেশে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ না নিলেও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সরকার এবিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকার এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করার পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল। যেমন—
  1. ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, প্রশাসন, ব্রিটিশ বাণিজ্য, অফিস-আদালত প্রভৃতির যথেষ্ট প্রসার ঘটে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য ইংরেজি জানা প্রচুর দেশীয় শিক্ষিত যুবকের প্রয়োজন ছিল।
  2. গ্রান্টের বক্তব্য: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে লিখিত ‘অবজারভেশন’ নামে এক পুস্তিকায় এই মত প্রকাশ করেন যে, ভারতের পশ্চাদপদ সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতার উন্নয়নের জন্য এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার। পরবর্তীকালে গ্রান্টের বক্তব্য সরকারকে প্রভাবিত করে।
  3. মেকলের প্রস্তাব: লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫খ্রি.) জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (২ ফেব্রুয়ারি) সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব (Minute) দেন যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত। এই পরিস্থিতিতে বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।
  4. হার্ডিঞ্জের ঘোষণা: পরবর্তীকালে বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
  5. উডের ডেসপ্যাচ: বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা-বিষয়ক একটি নির্দেশনামা প্রকাশ করেন যা উডের ডেসপ্যাচ বা উডের নির্দেশনামা নামে পরিচিত। এতে পাশ্চাত্য ধাঁচে এদেশে শিক্ষার প্রসারের কথা বলা হয়।

উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলনে ভারত উপকৃত হয়েছিল ঠিকই, তবে ভারতীয়দের প্রতি কোনো মহান উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, মূলত নিজেদের সুবিধার্থেই ব্রিটিশরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

7. *ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – সরকারি উদ্যোগে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার
ভূমিকা: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ‘অবজারভেশন’ নামে এক পুস্তিকায় এই মত প্রকাশ করেন যে, ভারতের পশ্চাদপদ সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতার উন্নয়নের জন্য এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার। কোম্পানি তখন এ বিষয়ে গুরুত্ব না দিলেও লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।
  1. প্রাথমিক উদ্যোগ: বেন্টিঙ্কের ঘোষণার পর সরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাশ্চাত্য ধাঁচের ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.), বোম্বাই-এ এলফিনস্টোন ইন্সটিটিউশন (১৮৩৫ খ্রি:), রুরকিতে থমাসোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৮৪৭ খ্রি.) প্রভৃতি।
  2. হার্ডিঞ্জের ঘোষণা: বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা (১৮৪৪ খ্রি.) করলে বাঙালি বেকার যুবকদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার আগ্রহ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
  3. কাউন্সিল অব এডুকেশনের উদ্যোগ: পূর্বতন জনশিক্ষা কমিটি পুনর্গঠিত করে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে কাউন্সিল অব এডুকেশন গঠিত হয়। এর উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এদেশে ১৫১টি ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এগুলিতে ১৩ হাজারেরও বেশি ছাত্র ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়।
  4. উডের ডেসপ্যাচ: বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাবিষয়ক একটি নির্দেশনামায় এদেশে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের কথা ঘোষণা করেন। এর ফলে সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে থাকে।

উপসংহার: ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার শুরু হলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রম ও পঠনরীতির মধ্যে সামঞ্জস্য গড়ে উঠতে থাকে। কিছুকাল পর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য ধারায় উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটে।

8. *উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪ খ্রি.) সম্পর্কে কী জান?
অথবা, উডের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদন ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – উডের ডেসপ্যাচ
ভূমিকা: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রম ও গঠনরীতিতে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। এই পরিস্থিতিতে বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা-বিষয়ক একটি নির্দেশনামা প্রকাশ করেন। এটি উডের ডেসপ্যাচ বা উডের নির্দেশনামা নামে পরিচিত।
  1. সুপারিশ: উডের ডেসপ্যাচ-এ যেসব সুপারিশ করা হয় সেগুলি হল—[i] সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে ৫টি শ্রেণিতে বিভাজন, [ii] দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা, [iii] কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, [iv] একটি পৃথক শিক্ষাদপ্তর গঠন, [v] উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ কর্তা | হিসেবে ‘ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ পদ সৃষ্টি, [vi] শিক্ষক – মাতৃভাষার ব্যবহার, শিক্ষণ ব্যবস্থা চালু, [vii] সাধারণ শিক্ষায় [viii] উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি, [ix] স্ত্রীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতি।
  2. মহাসনদ: উডের নির্দেশনামা বা ডেসপ্যাচের ওপর ভিত্তি করে ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই জন্য এই নির্দেশনামাকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা ‘মহাসনদ’ বলা হয়।

উপসংহার: আধুনিক শিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রে উডের নির্দেশনামা ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পাঠক্রম ও পঠনরীতির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে সক্ষম হয়েছিল।

9. *ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে প্রবর্তিত ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রধান ত্রুটিগুলি কী ছিল ?
উত্তর – ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রধান ত্রুটিবিচ্যুতি
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে উনিশ শতকে বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগে ভারতে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটে। কিন্তু এই শিক্ষার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতিও দেখা যায়। এই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি হল—
  1. ভাষামাধ্যম: আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। ফলে সমাজের উচ্চবর্গের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষালাভের সুযোগ পেলেও ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞ বাংলার বৃহত্তর সমাজের সাধারণ মানুষ এই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়নি।
  2. প্রাথমিক শিক্ষায় অবহেলা কলেজ ও মাধ্যমিক স্তরের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে বাংলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়।
  3. কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা: ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানোর যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
  4. নারীশিক্ষার অবহেলা: সরকার পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও নারীশিক্ষার প্রসারে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। ফলে নারীসমাজের বৃহত্তর অংশই এই শিক্ষার বাইরে থেকে যায়।
  5. মুসলিম সম্প্রদায়ের উদাসীনতা: সমকালীন মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট উদাসীন ছিল। ফলে তাদের বড়ো অংশই এই শিক্ষার বাইরে থেকে যায়।
  6. সীমাবদ্ধতা: পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার প্রধানত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার গ্রামগঞ্জে এই শিক্ষার আলো বিশেষ পৌঁছায়নি।

উপসংহার: বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও একথা বলা যায় যে, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলেই ভারত আধুনিকতার দিকে এগোতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভারতীয়দের মধ্যে যে প্রবল জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে তা বহুলাংশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ফল বলেই মনে করা হয়।

10. *ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফল কী হয়েছিল?
উত্তর – ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলাফল
ভূমিকা: আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা তথা ভারতে পশ্চাৎপদ দেশীয় শিক্ষা প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটে। এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলাফলগুলি ছিল সুদূরপ্রসারী।
  1. দুর্বলতা উপলব্ধি: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা নিজেদের প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতার দুর্বলতা ও ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় এবং এই দুর্বলতা দূর করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
  2. কুসংস্কারের অবসান: ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয় সমাজের পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রবেশ ঘটে। এর ফলে ভারতীয় সমাজের বহু কুসংস্কার দূর হতে থাকে।
  3. আধুনিক ভাবধারার প্রসার: পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, মানবতাবাদ প্রভৃতি ইউরোপের আধুনিক ভাবধারা বা আদর্শগুলি ভারতীয়দের মনে প্রবেশ করে এবং এগুলি ভারতীয়দের মধ্যে শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
  4. জাতীয় ঐক্যের সূচনা: ভারতে ইংরেজি ভাষার প্রসারের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে ভাষাগত ব্যবধান দূর হয়। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান শুরু হয়। এভাবে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে।
  5. সংস্কার আন্দোলনের সূচনা: পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটতে থাকে।
  6. রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা: পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে তারা ক্রমে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং এই অধিকারগুলি আদায়ের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।

উপসংহার: আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতীয় সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। ব্রিটিশ শাসনকালে এই আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের শিক্ষাই ভারতীয়দের মধ্যে পশ্চাৎপদতা দূর করে নবযুগের সূচনা ঘটায়।

11. *নারীশিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর – নারীশিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধের ফলে বাংলায় নারীশিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি। তবে কিছুকাল পর থেকেই এ বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ শুরু হয়। নারীশিক্ষার প্রসারে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১ খ্রি.)।
  1. বিদ্যাসাগরের উপলব্ধি: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপলখি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। এই জন্য তাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো দরকার।
  2. প্রাথমিক উদ্যোগ: মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাসাগরের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল ড্রিংকওয়াটার বিটনের সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমান বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা। বিদ্যাসাগর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  3. চূড়ান্ত উদ্যোগ: গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারেও বিদ্যাসাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়িনী সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলিতে ১৩ হাজার ছাত্রী পড়াশোনা করত। তাঁর ব্যক্তিগত ব্যয়ে বিদ্যালয়গুলি চলত।
  4. বিশেষ উদ্যোগ: বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে, বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মা ভগবতী দেবীর স্মৃতিতে বিদ্যাসাগর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার: নারীশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদের শৃঙ্খলমোচনই হয়ে উঠেছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের ব্রত। তাই দেখা যায় যে, জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও তিনি নারীশিক্ষার প্রয়াস থেকে সরে আসেননি।

12. শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যাসাগরের কী অবদান ছিল ?
উত্তর – শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান
ভূমিকা: শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার জনশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও নারীশিক্ষার প্রসারে এবং বাংলা গদ্যের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
  1. মডেল স্কুল স্থাপন : শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর বাংলার বিভিন্ন জেলায় মডেল স্কুল বা আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় তিনি নিজ ব্যয়ে চালাতেন।
  2. নারী শিক্ষার প্রসার : বিদ্যাসাগর এটা বুঝেছিলেন যে নারী সমাজের মুক্তির জন্য তাদের শিক্ষার অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ নেন। তাঁর উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুনের সহায়তায় কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ যা বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত।
  3. মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন: শিক্ষাবিস্তারের কাজে বিদ্যাসাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল কলকাতায় ‘মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে’র প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে এটি বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত।
  4. পাঠ্যপুস্তক রচনা: শিক্ষাবিস্তারের কাজে একটি অন্যতম আবশ্যিক উপাদান হল পাঠ্যপুস্তক। বিদ্যাসাগর নিজে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘নীতিবোধ’ প্রভৃতি পাঠ্যপুস্তক রচনার মধ্য দিয়ে তিনি এই কাজে অগ্রসর হন।

উপসংহার: শিক্ষাবিস্তারের কাজে বিদ্যাসাগর যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি লর্ড হার্ডিঞ্জের সহায়তায় গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন স্থানে বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সমকালীন সময়ে নারীশিক্ষার প্রসারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ হয়ে রয়েছেন।

13. ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বেসরকারি উদ্যোগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
উত্তর – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বেসরকারি উদ্যোগ
ভূমিকা: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের কাজে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও লক্ষ করা গিয়েছিল। একাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডেভিড হেয়ার, এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন প্রমুখ ব্যক্তি ও বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারী।
  1. রামমোহনের উদ্যোগ: রামমোহন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য জোরালো সওয়াল করেন। সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের দ্বারা ভারতের শিক্ষাখাতে বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের উদ্যোগ নিলে রামমোহন তৎকালীন বড়োলাট লর্ড আর্মহাস্টকে চিঠি লিখে এই টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষাদানে ব্যয় করার দাবি জানান। তিনি ‘অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল’ (১৮১৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার পথ সুগম করেন।
  2. রাধাকান্ত দেবের উদ্যোগ: পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাধাকান্ত দেব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ’এর পরিচালন সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন।
  3. ডেভিড ছেয়ারের উদ্যোগ: পেশায় ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার তাঁর উপার্জন করা প্রচুর অর্থ পাশ্চাত্য শিক্ষার কাজে ব্যয় করেন। তাঁর সক্রিয় উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য তিনি স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন (১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পটলডাঙ্গা একাডেমি’ (বর্তমান হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন।
  4. বেথুনের উদ্যোগ: ব্রিটিশ কর্মচারী জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন। তিনি ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে (৭ মে) নেটিভ ফিমেল স্কুল নামে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় এবং কিছু পরে একটি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটি ‘বেথুন স্কুল’ এবং কলেজটি ‘বেথুন কলেজ’ নামে পরিচিত।
  5. বিদ্যাসাগরের উদ্যোগ: পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বেথুন কর্তৃক ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি ছিলেন প্রধান সহযোগী। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত। এ ছাড়া তিনি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  6. খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। তাঁদের উদ্যোগেই ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ (১৮১৯ খ্রি.), ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ (১৮২৮ খ্রি.) প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে রবার্ট মে, মিস কুক, মিসেস কুক, মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার, অ্যানেট অ্যাক্রোয়েড প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
  7. অন্যান্য উদ্যোগ : এ ছাড়া শেরবোন কর্তৃক জোড়াসাঁকোতে ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন, গৌরমোহন আঢ্যর ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ স্থাপন (১৮২৮ খ্রি.) ছিল ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের কাজে গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগ।

উপসংহার: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের কাজে বেসরকারি উদ্যোগ শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, বিশেষ প্রয়োজনীয়ও ছিল। শিক্ষানুরাগী বিভিন্ন ব্যক্তির এই প্রচেষ্টার ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার গতি ত্বরান্বিত হয়েছিল।

14. *বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকার উল্লেখ করো।
উত্তর – পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ওপর ভিত্তি করেই নতুন ভারত গড়ে উঠবে।
  1. বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  2. সরকারকে পত্র: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিলে রামমোহন ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে দেওয়া পত্রে দাবি জানান যে, এই অর্থ আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য ব্যয় করা হোক।
  3. পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে প্রচার: রামমোহন পাশ্চাত্য গণিত, দর্শন, রসায়ন, অস্থিবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার সপক্ষে প্রচার চালান। তিনি কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
  4. বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা: শিক্ষার্থীদের মন থেকে নানা কুসংস্কার ও মূর্তিপূজা দূর করে পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা

উপসংহার: পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় শুধুমাত্র নিজের প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নিয়েই থেমে থাকেননি; ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ-সহ অন্যদের সহায়তা করতেও এগিয়ে আসেন। ডাফ জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে রামমোহন তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন। হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় রামমোহনের সহায়তার কথা কেউ কেউ স্বীকার করেন।

15. * বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর – পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা
ভূমিকা: রাজা রাধাকান্ত দেবও (১৭৮৪-১৮৬৭ খ্রি.) উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
  1. শিক্ষার প্রসার: রাজা রাধাকান্ত দেব ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য চেষ্টা চালান। তিনি নিজের পরিবারের মহিলাদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ইংরেজ শিক্ষিকা নিযুক্ত করেন।
  2. হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: রাধাকান্ত দেব ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডেভিড হেয়ার, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, স্যার হাইড ইস্ট প্রমুখের সঙ্গে মিলিতভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এই কলেজের পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই কলেজের অধিকর্তা ও কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
  3. সংস্থার সঙ্গে যোগ: রাধাকান্ত দেব পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত স্কুল বুক সোসাইটির (১৮১৭ খ্রি.) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির (১৮১৮ খ্রি.) ভারতীয় সম্পাদক ছিলেন।
  4. নারীশিক্ষা: রাধাকান্ত দেব নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রাধান্য দেন। তিনি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নিতে তিনি ডব্লিউ এইচ পিয়ার্স-কে এক পত্রের (১৮২১ খ্রি.) দ্বারা অনুরোধ জানান।
  5. চিকিৎসাবিদ্যা: আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে শবদেহের ব্যবচ্ছেদ একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। সেই সময় সামাজিকভাবে এই কাজ নিষিদ্ধ হলেও রাধাকান্ত দেব কলকাতা মেডিকেল কলেজের হিন্দু ছাত্রদের শব ব্যবচ্ছেদকে সমর্থন করেন।
  6. গ্রন্থ অনুবাদে উৎসাহদান: রাধাকান্ত দেব বিভিন্ন ইংরেজি সাহিত্য ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদের জন্য হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উৎসাহিত করেন।
উপসংহার: রাধাকান্ত দেব একজন হিন্দু রক্ষণশীল হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নেন। তিনি সতীদাহ প্রথার মতো কু-প্রথাকে সমর্থন করার জন্য তাঁর ভাবমূর্তি কিছুটা মলিন হয়েছে ঠিকই, তবে পাশ্চাত্য শিক্ষা, নারীশিক্ষা ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
16. *ডেভিড হেয়ার সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – ডেডিড হেয়ার
ভূমিকা: মহামতি ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকের একজন ভারতপ্রেমিক মানবতাবাদী।
  1. প্রথম জীবন: ডেভিড হেয়ার ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এসে ঘড়ির ব্যাবসা শুরু করেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। ঔপনিবেশিক শাসনে এদেশের মানুষের দুর্দশা দেখে তিনি ব্যথিত হন।
  2. আধুনিক শিক্ষার প্রসার: ডেভিড হেয়ার উপলব্ধি করেন যে, এদেশের মানুষের সার্বিক অগ্রগতির জন্য আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। এই উদ্দেশ্যে তিনি হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠায় (১৮১৭ খ্রি.) সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্দেশ্যে ওই বছর স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
  3. নারীশিক্ষার অগ্রগতি: ডেভিড হেয়ার এদেশের মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নারীশিক্ষার পক্ষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
  4. শোষণের বিরোধিতা: ডেভিড হেয়ার দরিদ্র ভারতীয়দের ওপর ঔপনিবেশিক শোষণের বিরোধিতা করেন। নিষ্ঠুর শ্রম আইনের দ্বারা দরিদ্র ভারতীয় শ্রমিকদের দাস হিসেবে ইউরোপে রপ্তানি, সংবাদপত্রের ওপর সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি প্রচার চালান।
  5. দেশাত্মবোধ: বাংলাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ডেভিড হেয়ার তাঁর স্বদেশ স্কটল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার চিন্তা ত্যাগ করেন। তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, দেশীয় খাবার খেতেন, দেশীয় পোশাক পরতেন এবং স্থানীয় সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন।

উপসংহার: সমাজহিতৈষী ডেভিড হেয়ার এদেশে শিক্ষার প্রসারে আন্তরিকভাবে কাজ করে যান। মানবকল্যাণে নিজের যাবতীয় অর্থ ব্যয় করে জীবনের শেষদিকে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

17. *বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা উল্লেখ করো।
উত্তর – বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকে ইউরোপের যেসব মানুষ বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সমাজহিতৈষী ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২ খ্রি.)।
  1. বিপুল অর্থব্যয়: ডেভিড হেয়ার প্রথম জীবনে ঘড়ির ব্যাবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এই অর্থ ব্যয় করে তিনি ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
  2. হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: ডেভিড হেয়ার কলকাতায় একটি আধুনিক ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা চিন্তা করেন। অবশেষে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হাইড ইস্ট-এর সমর্থনে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে (২০ জানুয়ারি) কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় ডেভিড হেয়ারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
  3. স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা: এদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ডেভিড হেয়ার বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্দেশ্যে স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
  4. স্কুল প্রতিষ্ঠা: ডেভিড হেয়ার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রথম পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি, পরে আরপুলি পাঠশালা এবং আরও পরে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল নামে পরিচিত ছিল। সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্কুলটির অনুদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং ১৮৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে এর নামকরণ করে হেয়ার স্কুল।
  5. নারীশিক্ষা: ডেভিড হেয়ার বাংলার নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মেয়েদের জন্য কলকাতায় বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে তিনি নারীশিক্ষার পক্ষে এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
  6. মেডিকেল কলেজ সংক্রান্ত উদ্যোগ : সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে স্থানীয় হিন্দু ছাত্ররা কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভরতি হতে চাইত না। ডেভিড হেয়ার অবিরাম প্রচার চালিয়ে এবং স্থানীয় মানুষজনের মনের কুসংস্কার দূর করে ছাত্রদের এই কলেজে ভরতি হতে উৎসাহিত করেন।

উপসংহার: ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী ও স্বাধীন চিন্তার অধিকারী ডেভিড হেয়ারের লক্ষ্য ছিল প্রকৃত মানুষ তৈরি করা। আর এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন।

18. *ড্রিংকওয়াটার বিটন (বেথুন) সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – ড্রিংকওয়াটার বিটন (বেথুন)
ভূমিকা: ড্রিংকওয়াটার বিটন (১৮০১-৫১ খ্রি.) বা বেথুন সাহেব ছিলেন বিশিষ্ট কবি, ভাষাবিদ, আইন-বিশারদ এবং বড়োলাটের আইন পরিষদের সদস্য।
  1. প্রথম জীবন: ড্রিংকওয়াটার বিটন (বেথুন) ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী বেথুন ওয়েস্টমিনিস্টার স্কুল, ট্রিনিটি কলেজ ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি একজন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারী হিসেবে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন।
  2. শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ: ড্রিংকওয়াটার বিটন (বেথুন) কর্মসূত্রে ভারতে এসে এদেশের মানুষের দুর্দশার প্রকৃত চিত্র দেখে ব্যথিত হন। সরকারের প্রশাসনিক কাজ করার পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করেন যে, এদেশের মানুষের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার।
  3. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: এদেশে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে বেথুন সাহেব ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মির্জাপুরে একটি হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ের কার্যকরী সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বেথুন সাহেব একটি কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে স্কুল ও কলেজটি যথাক্রমে বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজ নামে পরিচিত।
  4. অন্যান্য কৃতিত্ব: বেথুন সাহেব কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদের কাজেও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন।

উপসংহারঃ এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন ভারতপ্রেমী। ভারতে নারীশিক্ষার পথিকৃৎ বেথুন মৃত্যুর আগে তাঁর সকল অস্থাবর সম্পত্তি তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’-এর নামে দান করে যান।

19. *বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ড্রিংকওয়াটার বিটনের (বেথুনের) ভূমিকা উল্লেখ করো। অথবা, ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে ড্রিংকওয়াটার বেথুন-এর অবদান আলোচনা করো।
উত্তর – পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ড্রিংকওয়াটার নিটনের ভূমিকা
ভূমিকা: জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব ছিলেন ভারতে একজন ব্রিটিশ কর্মচারী। তিনি উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
  1. মাতৃভাষায় গুরুত্বদান: রাজা রামমোহন রায়ের মতো মনীষীও যখন ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে বক্তব্য রাখেন তখন বেথুন সাহেব গ্রামবাংলার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষায় জনশিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, মাতৃভাষার মাধ্যমেই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব।
  2. নারীশিক্ষায় অবদান: উনিশ শতকে এদেশে নারীশিক্ষার প্রসারে বেথুন ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি বাংলার মেয়েদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পণ্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের লেখা নারীশিক্ষা-বিষয়ক একটি পুস্তিকা বেথুন সাহেব নিজ অর্থব্যয়ে ছেপে বিলি করেন।
  3. স্কুল প্রতিষ্ঠা: নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বেথুন সাহেব কলকাতায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে (৭ মে) হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমান বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এই বিদ্যালয়কে দান করেন। বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন বেথুন বলেন, “আমি বিশ্বাস করি আজকের দিনটি একটি বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছে।”
  4. কলেজ প্রতিষ্ঠা: বাংলার নারীদের মধ্যে আধুনিক উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য বেথুন সাহেব কলকাতায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে বেথুন কলেজ নামে পরিচিত। মাত্র একজন ছাত্রী কাদম্বিনী বসুকে নিয়ে এই কলেজের যাত্রা শুরু হয়। বেথুন কলেজই হল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মহিলা কলেজ।
  5. অন্যান্য কৃতিত্ব: বেথুন সাহেব কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদের কাজেও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন।

উপসংহার: ব্রিটিশ কর্মচারী ড্রিংকওয়াটার বেথুন ছিলেন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের কাজে নিবেদিত প্রাণ। বিশেষত নারীশিক্ষা বিস্তারে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন তাতে ভারতবাসী তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে।

20. উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিংকওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন?
উত্তর – পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ড্রিংকওয়াটার বেথুনের ভূমিকা
ভূমিকা: জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন ছিলেন ভারতে একজন ব্রিটিশ কর্মচারী। তিনি উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
  1. মাতৃভাষার গুরুত্ব: রাজা রামমোহন রায়ের মতো মনীষীও যখন ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে বক্তব্য রাখেন তখন বেথুন সাহেব গ্রামবাংলার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষায় জনশিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, মাতৃভাষার মাধ্যমেই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব।
  2. নারীশিক্ষা: উনিশ শতকে এদেশে নারীশিক্ষার প্রসারে বেথুন ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি বাংলার মেয়েদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পণ্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের লেখা নারীশিক্ষা-বিষয়ক একটি পুস্তিকা বেথুন সাহেব নিজ অর্থব্যয়ে ছেপে বিলি করেন।
  3. স্কুল প্রতিষ্ঠা: নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বেথুন সাহেব কলকাতায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে (৭ মে) হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমান বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এই বিদ্যালয়কে দান করেন। বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন বেথুন বলেন “আমি বিশ্বাস করি আজকের দিনটি একটি বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছে।”
  4. কলেজ প্রতিষ্ঠা: বাংলার নারীদের মধ্যে আধুনিক উচ্চশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বেথুন সাহেব কলকাতায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে বেথুন কলেজ নামে পরিচিত। মাত্র একজন ছাত্রী কাদম্বিনী বসুকে নিয়ে এই কলেজের পঠনপাঠন শুরু হয়। বেথুন কলেজ হল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ ৷
  5. অন্যান্য কৃতিত্ব: বেথুন সাহেব কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদের কাজেও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন।

উপসংহার: ডেভিড হেয়ারের প্রচেষ্টার ফলেই বাংলার বহু নারী আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হন। তিনি একজন বিদেশি হয়েও সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে সমকালীন খুব কম ভারতীয় এইরূপ প্রচেষ্টা করেন।

21. * চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ইতিহাসে কলকাতা মেডিকেল কলেজের অবদান আলোচনা করো।
অথবা, এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ? 
উত্তর – ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রসারে কলকাতা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকের সূচনালগ্নেও ভারতে প্রাচীন দেশীয় চিকিৎসাব্যবস্থার প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে ভারতের বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার পথচলা শুরু হয়।
  1. সরকারি উদ্যোগ: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষাদানের জন্য সরকার অর্থব্যয় বন্ধ করে দেয়। ফলে প্রাচীন দেশীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিবর্তে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা এদেশে দ্রুত প্রসার লাভ করে।
  2. ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা: কলকাতা মেডিকেল কলেজে দেশীয় চিকিৎসাবিদ্যার পরিবর্তে ইউরোপের উন্নত চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষাদান শুরু হয়। পণ্ডিচেরীর পর কলকাতা মেডিকেল কলেজ হল এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় কলেজ যেখানে আধুনিক ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা শেখানো হত।
  3. ছাত্রদের অবদান : কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে প্রথম ব্যাচে পাস করে উমাচরণ শেঠ, রাজকৃয় দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত প্রমুখ ঢাকা, চট্টগ্রাম, মুরশিদাবাদ, পাটনা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসার প্রসার ঘটান। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে রহিম খান প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসেবে এখান থেকে ডাক্তারি পাস করেন। বাংলার উচ্চবর্ণের বহু যুবক এই কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে পরবর্তী জীবনে চিকিৎসাবিদ্যায় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন।
  4. কুসংস্কারবিরোধী ভূমিকা: এখানকার ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটান।
  5. নতুন চিকিৎসকের উদ্ভব: কলকাতা মেডিকেল কলেজ থকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করে প্রতিবছর বহু যুবক দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। পাশাপাশি এখান থেকে পাশ করার পর বিলেত থেকে ডাক্তারি পাঠ নিয়ে অনেকে বিলেত ফেরত ডাক্তারে পরিণত হন।

উপসংহার: আধুনিক উন্নত চিকিৎসাবিদ্যার প্রসারের কাজে কলকাতা মেডিকেল কলেজ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই কলেজের উন্নত চিকিৎসাবিদ্যার ফলে বাংলা তথা ভারতের চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়।

22. *মধুসূদন গুপ্ত সম্পর্কে কী জান? অথবা, টীকা লেখো : মধুসূদন গুপ্ত।
উত্তর – মধুসূদন গুপ্ত
ভূমিকা: ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা প্রসারের সঙ্গে মধুসুদন গুপ্তর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দুরন্ত মধুসূদন ছোটোবেলা থেকেই প্রচলিত নানা প্রথা-বিরোধী কাজকর্মে উৎসাহী ছিলেন।
  1. শিক্ষাজীবন: মধুসূদন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করেন। এখানে তিনি সংস্কৃত, ন্যায়শাস্ত্র, অলংকার শাস্ত্র প্রভৃতিরও শিক্ষালাভ করেন। আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশোনার সময় তিনি শারীরতত্ত্ব বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী হন।
  2. অধ্যাপনা: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে মধুসূদন ওই বছর সেখানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।
  3. শব ব্যবচ্ছেদ নিয়ে কুসংস্কার: সেযুগে শব ব্যবচ্ছেদ করলে সমাজে পতিত ও একঘরে হওয়ার মতো কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। এজন্য ছাত্ররা শব ব্যবচ্ছেদ করতে রাজি হত না।
  4. শবব্যবচ্ছেদ: এইরকম সামাজিক পরিস্থিতিতে কলকাতা মেডিকেল কলেজের বাঙালি ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত (১৮০০-১৮৫৬ খ্রি.) শব ব্যবচ্ছেদ করে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটান। এই বৈপ্লবিক কাজের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়। মধুসূদন গুপ্তর শবব্যবচ্ছেদের কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন সেই কলেজের ছাত্র রাজকৃয় দে, উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত, নবীনচন্দ্র মিত্র প্রমুখ।
  5. শিক্ষকতা: মধুসূদন গুপ্ত ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে সাফল্যের সঙ্গে ডাক্তারি পাস করেন। তিনি পরবর্তীকালে এই কলেজে শিক্ষকতাও করেন। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই কলেজের হিন্দুস্থানি ক্লাসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণির সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে কলেজের বাংলা ক্লাসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন।
  6. গ্রন্থ প্রকাশ: মধুসূদন গুপ্ত ‘অ্যানাটমি অর্থাৎ শারীরবিদ্যা’ নামে বাংলায় একটি বই লেখেন। তিনি বাঙালি ছাত্রদের সুবিধার্থে ‘লন্ডন ফার্মাকোপিয়া’ নামে বইটি বাংলায় এবং রবার্ট হুপারের লেখা ‘Anatomist’s Vade Mecum’ নামে গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেন।

উপসংহার: আধুনিক ভারতের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে মধুসূদন গুপ্ত একটি অবিস্মরণীয় নাম। চিকিৎসা জগতে প্রথম ভারতীয় শব ব্যবচ্ছেদকারী হিসেবে তিনি যে বিপ্লবের সূচনা করেন পরবর্তীকালে তা শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে নব যুগের সূচনা করে।

23. * কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা
ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমভাগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটলে এই শতকের মধ্যভাগে পাশ্চাত্য ধাঁচে উচ্চতর শিক্ষার প্রসারও বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এই প্রয়োজন থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
  1. প্রেক্ষাপট: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর সভাপতি স্যার চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা-বিষয়ক এক নির্দেশনামায় (উডের ডেসপ্যাচ, ১৮৫৪ খ্রি.) এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যেসব সুপারিশ করেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
  2. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও পরিধি: উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড ক্যানিং-এর শাসনকালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাশ্চাত্য ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে লাহোর থেকে রেঙ্গুন এবং শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের পরিধি বিস্তৃত ছিল।
  3. প্রশাসক: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ছিলেন লর্ড ক্যানিং এবং প্রথম উপাচার্য ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল (১৮৫৭-৫৯ খ্রি.)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯০-৯২ খ্রি.)।
  4. মানের চরম উৎকর্ষ: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৯০৬-১৪ খ্রি. এবং ১৯২১-২৩ খ্রি.) উপাচার্য থাকাকালীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছোয়। তাঁর আমলে কলা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নত গবেষণার কাজ সারা বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করে।

উপসংহার: ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন যুগের দিশারী। বস্তুত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বাংলায় প্রকৃত উচ্চশিক্ষার সূচনা ঘটে। সময়ের বিবর্তনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই একসময় ভারতের শ্রেষ্ঠ পীঠস্থানে পরিণত হয়।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
1. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমদিকে কেন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেয়নি?
উত্তর – ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমদিকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেয়নি। কারণ, কোম্পানি মনে করত যে— [1] ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য ব্রিটিশদের অর্থসম্পদ ব্যয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। [2] ভারতীয়দের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করলে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। [3] ভারতীয়রা পাশ্চাত্য শিক্ষা পেলে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে।
2. * প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব কীভাবে শুরু হয়?
অথবা, ভারতে জনশিক্ষার নীতি নির্ধারণে পরস্পর-বিরোধী গোষ্ঠীর পরিচয় দাও।
উত্তর – ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিত এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে জনশিক্ষা কমিটির (১৮২৩ খ্রি.) সদস্যরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। [1] প্রাচ্যবাদের সমর্থক এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ এদেশে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। এঁরা প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট নামে পরিচিত। [2] পাশ্চাত্যবাদের সমর্থক মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ এদেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান। এঁরা পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে পরিচিত।
3. প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্ব কী?
অথবা, প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী শিক্ষা বিতর্ক বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিত—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) জনশিক্ষা কমিটির সদস্যরা দুটি পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল প্রাচ্য পদ্ধতিতে এবং অপর দল পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের পক্ষে মত দেন। দুটি দলের এই দ্বন্দ্ব প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।
4. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী কাদের বলা হয়?
উত্তর – ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিত—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) জনশিক্ষা কমিটির সদস্যরা দুটি পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রক, উইলসন প্রমুখ প্রাচ্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের সমর্থক হওয়ায় তাঁরা প্রাচ্যবাদী এবং মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কোলভিল প্রমুখ পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের সমর্থক হওয়ায় তাঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত হন।
5. * প্রাচ্যচর্চার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি কেন্দ্রের নাম লেখো।
উত্তর – প্রাচ্যচর্চার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হল—[1] কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রি.), [2] এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.), [3] বারাণসী সংস্কৃত কলেজ (১৭৯২ খ্রি.), [4] ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.) প্রভৃতি।
6. কে, কেন এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তর – ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ভারতে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে জোন্স এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
7. *কে, কী উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
অথবা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কে, কবে, কেন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ, প্রশাসনে কর্মরত যুবকদের ভারতীয় ভাষা, আইন, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে অবহিত করা।
8. * ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইনের শিক্ষাবিষয়ক একটি উল্লেখযোগ্য ধারা উল্লেখ করো।
উত্তর – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইনে বলা হয় যে, কোম্পানি প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য ব্যয় করবে।
9. * কবে, কী উদ্দেশ্যে ‘জনশিক্ষা কমিটি’ বা ‘কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন’ গঠিত হয় ?
উত্তর – ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জনশিক্ষা কমিটি বা কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন গঠিত হয়। জনশিক্ষা কমিটি বা কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে জনশিক্ষার নীতি নির্ধারণ করা।
10. শিক্ষাক্ষেত্রে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদের গুরুত্ব কী ছিল?
উত্তর – শিক্ষাক্ষেত্রে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদের গুরুত্ব ছিল যে, এর দ্বারা- [1] কোম্পানি প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। [2] ভারতে জনশিক্ষার নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ‘জনশিক্ষা কমিটি’ বা ‘কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন’ গঠিত হয়।
11. কবে, কী উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ?
উত্তর – ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
12. কবে, কী উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
13. *পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের আগে বাংলার সমাজ কীরূপ ছিল?
উত্তর – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের আগে বাংলার সমাজ ছিল খুবই পশ্চাদপদ। নানান কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি, সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাজলে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
14. * ভারতে শিক্ষাদানের বিষয়ে টমাস মেকলের বক্তব্য কী ছিল ?
অথবা, ‘মেকলে মিনিট’ কী?
উত্তর – জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (২ ফেব্রুয়ারি) বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব (Minutes) দেন যা, ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবে মেকলে বলেন যে, প্রাচ্যের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই পশ্চাদপদ। এজন্য এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত।
15. *‘মেকলে মিনিট’-এ কী বলা হয় ?
উত্তর – ‘মেকলে মিনিট’-এ বলা হয় যে–[1] প্রাচ্যের শিক্ষা পাশ্চাত্যের তুলনায় নিকৃষ্ট। [2] প্রাচ্যের সভ্যতা ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপবিত্র’। [3] তাই এদেশে পাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। [4] এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে ক্রমনিম্ন পরিসুত নীতি বা চুঁইয়ে পড়া নীতি (Downward Filtration Theory) অনুসারে তা ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
16. ‘ক্রমনিম্ন পরিসুত নীতি’ বা ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ কী ?
উত্তর – জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি লর্ড মেকলে তাঁর এক প্রস্তাবে লর্ড বেন্টিঙ্ককে বলেন যে, জল যেভাবে ওপর থেকে নীচের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, ভারতে উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে তা ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। মেকলের এই নীতি ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি বা চুঁইয়ে পড়া নীতি নামে পরিচিত।
17. কোন্ পরিস্থিতিতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে?
উত্তর – অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ভারতে ব্রিটিশ বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত প্রভৃতির যথেষ্ট প্রসার ঘটলে এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষা জানা কর্মচারীর প্রয়োজন দেখা দেয়। এদিকে মধ্যবিত্ত বাঙালি চাকরি লাভের আশায় ইংরেজি শেখার প্রতি আগ্রহ দেখায়। এই পরিস্থিতিতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে।
18. ব্যক্তিগত উদ্যোগে এদেশে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন কয়েকজন বিদেশির নাম লেখো।
উত্তর – ব্যক্তিগত উদ্যোগে এদেশে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন কয়েকজন বিদেশি হলেন—শোরবোর্ন, মার্টিন, বাউল, আরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।
19. * ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হয় এমন কয়েকটি মিশনারি গোষ্ঠীর নাম লেখো।
উত্তর – ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হয় এমন কয়েকটি মিশনারি গোষ্ঠী হল—লন্ডন মিশনারি সোসাইটি (১৭৯৫ খ্রি.), চার্চ মিশনারি সোসাইটি (১৭৯৯ খ্রি.) ও শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০ খ্রি.) প্রভৃতি।
20. *জেসুইট মিশনারিদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – জেসুইট মিশনারিদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.) ও লরেটো হাউস স্কুল (১৮৪২ খ্রি.)।
21. *উডের ডেসপ্যাচ কী? 
অথবা, চার্লস উডের নির্দেশনামায় উল্লিখিত সুপারিশগুলি আলোচনা করো।
উত্তর – বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাবিষয়ক একটি নির্দেশনামা প্রকাশ করেন যা উডের ডেসপ্যাচ বা উডের নির্দেশনামা নামে পরিচিত। উডের ডেসপ্যাচ-এ যেসব সুপারিশ করা হয় সেগুলি হল—[1] একটি পৃথক শিক্ষাদপ্তর গঠন, [2] কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, [3] শিক্ষক-শিক্ষণব্যবস্থা প্রচলন, [4] উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি, [5] স্ত্রীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতি।
22. *উডের ডেসপ্যাচ-কে (১৮৫৪ খ্রি.) মহাসনদ (ম্যাগনা কার্টা) বলা হয় কেন?
উত্তর – উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪ খ্রি.)-এর ওপর ভিত্তি করে ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এজন্য একে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ম্যাগনা কার্টা বা মহাসনদ বলা হয়।
23. * উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুসারে কবে, কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুসারে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
24. * পাশ্চাত্য শিক্ষার দাবিতে রামমোহন রায়ের পত্র (১৮২৩ খ্রি.) সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের দ্বারা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘জনশিক্ষা কমিটি’ ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সময়ে রামমোহন ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে এক পত্র লিখে এই অর্থ ইংরেজি ও আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ব্যয় করার দাবি জানান।
25. * কোন্ কোন্ বাঙালি মনীষী এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন?
উত্তর – রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, তেজচন্দ্র রায়, জয়নারায়ণ ঘোষাল প্রমুখ বাঙালি মনীষী এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
26. * বেন্টিঙ্ক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গড়ে-ওঠা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম করো।
উত্তর – বেন্টিঙ্ক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫ খ্রি), রুরকিতে থমাসোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৮৪৭ খ্রি.), বোম্বাই-এ এলফিনস্টোন ইন্সটিটিউশন (১৮৫৬ খ্রি.) প্রভৃতি।
27. *কবে, কাদের উদ্যোগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়? হিন্দু কলেজ পরবর্তীকালে কী নাম গ্রহণ করে?
উত্তর – ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট প্রমুখের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিন্দু কলেজ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ নামে পরিচিত হয়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নাম গ্রহণ করে।
28. * উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে প্রধান বাধাগুলি কী ছিল ?
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে প্রধান বাধাগুলি ছিল—
[1] রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ মেয়েদের লেখাপড়া শেখাকে সমর্থন না করা।
[2] বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতা।
29. * ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি কী ?
উত্তর – ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি হল শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন যেটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিত।
30. স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে বিদেশিরা কী ভূমিকা নিয়েছিল ?
উত্তর – ভারতে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে বিদেশিরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয় খ্রিস্টান মিশনারিরা। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি ও মার্শম্যানের উদ্যোগে শ্রীরামপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে মিস কুক প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’। মিস কুক, মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার প্রমুখ বিদেশিনী বাংলায় নারীশিক্ষার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
31. কয়েকজন বিদেশিনির নাম লেখো যাঁরা বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন।
উত্তর – বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন বিদেশিনি হলেন মিস কুক, মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার, অ্যানেট অ্যাক্রয়েড প্রমুখ।
32. * বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নিয়েছিল এমন কয়েকটি সংগঠনের নাম লেখো।
উত্তর – বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নিয়েছিল এমন কয়েকটি সংগঠন হল—ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি (১৮১৯ খ্রি.), কলকাতা স্কুল সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.), লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন (১৮২৪ খ্রি.)।
33. * কবে, কাদের উদ্যোগে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়? এর বর্তমান নাম কী?
উত্তর – ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন (বেথুন)-এর উদ্যোগে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর বর্তমান নাম হল বেথুন স্কুল।
34. *কে, কী উদ্দেশ্যে স্ত্রীশিক্ষা বিধায়িনী সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষা বিধায়িনী সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা করেন। স্ত্রীশিক্ষা বিধায়িনী সম্মিলনী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো।
35. * ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয়ের উল্লেখ করো।
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার প্রসারে বেশ কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—[1] ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ড্রিংকওয়াটার বিটনের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়, [2] নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয়।
36. * কে, কোথায় ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর মা ভগবতী দেবীর স্মৃতিতে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
37. * বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারের কয়েকটি প্রভাব উল্লেখ করো।
উত্তর – বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারের ফলে—[1] সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীদাহপ্রথা, পুরুষের বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে নারী সচেতনতা তৈরি হয়। [2] উনিশ শতকে রাসসুন্দরী দেবী, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রমুখী বসু প্রমুখ বেশ কয়েকজন কৃতী নারীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
38. * বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী কোন্‌টি? এটি কে রচনা করেন?
উত্তর – বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম আত্মজীবনী গ্রন্থ হল ‘আমার জীবন’।
‘আমার জীবন’-এর রচয়িতা হলেন রাসসুন্দরী দেবী।
39. * পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রামমোহন রায়ের কয়েকটি উদ্যোগ উল্লেখ করো।
উত্তর – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রামমোহন রায়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হল–[1] তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। [2] হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যোগ ছিল বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেন। [3] রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে একটি পত্র (১৮২৩ খ্রি.) লিখে সরকারি অর্থ আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য ব্যয়ের দাবি জানান। [4] কুসংস্কার ও মূর্তিপূজা দূর করার উদ্দেশ্যে তিনি বেদান্ত কলেজ (১৮২৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
40. *রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল—আত্মীয় সভা (১৮১৫ খ্রি.), বেদান্ত কলেজ (১৮২৬ খ্রি.), ব্রাহ্মসভা (১৮২৮ খ্রি.) প্রভৃতি।
41. * কে, কবে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন? এই কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মন থেকে কুসংস্কার ও মূর্তিপূজা দূর করা।
42. * হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় কাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল?
উত্তর – হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় রাধাকান্ত দেব, ডেভিড হেয়ার, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, স্যার হাইড ইস্ট প্রমুখের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
43. * ডেভিড হেয়ার কে ছিলেন?
উত্তর – ডেভিড হেয়ার ছিলেন স্কটল্যান্ডের একজন ঘড়ি প্রস্তুতকারক। তিনি তাঁর উপার্জিত অর্থ ভারতে এসে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয় করেন। স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) ও পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি (১৮১৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর ভূমিকা ছিল।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

একটি বাক্যে উত্তর দাও

1. ব্রিটিশ কোম্পানি কোন আইনের দ্বারা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেয়?
উত্তর – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইনের দ্বারা ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
2. ‘ক্রমনিম্ন পরিসূত নীতি’ বা ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’-র প্রবক্তা কে?
উত্তর – ‘ক্রমনিম্ন পরিসুত নীতি’ বা ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’-র প্রবক্তা হলেন লর্ড মেকলে।
3. কোন্ প্রস্তাবের সুপারিশ অনুসারে লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সিদ্ধান্ত নেন?
উত্তর – মেকলের প্রস্তাব বা ‘মিনিট’-এর সুপারিশ অনুসারে লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সিদ্ধান্ত নেন।
4. শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সদস্যের নাম লেখো।
উত্তর – শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সদস্যের নাম হল উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড প্রমুখ।
5. কোন্ নির্দেশনামাকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ম্যাগনা কার্টা বা মহাসনদ বলা হয় ?
উত্তর – উডের ডেসপ্যাচকে (১৮৫৪ খ্রি.) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ম্যাগনা কার্টা বা মহাসনদ বলা হয়।
6. স্কুল বুক সোসাইটি কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন ডেভিড হেয়ার।
7. ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ কে স্থাপন করেন?
উত্তর – ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ স্থাপন করেন গৌরমোহন আঢ্য।
৪. ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় কোন্‌টি?
উত্তর – ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় হল ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমান বেথুন স্কুল)।
9. ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ কোন্‌টি?
উত্তর – ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম কলেজ বেথুন কলেজ।
10. বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে প্রথম কারা উদ্যোগ নেয় ?
উত্তর – বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রথম উদ্যোগ নেয়।
11. কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিল্ডিং তৈরির জন্য কে জমি দান করেন?
উত্তর – কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিল্ডিং তৈরির জন্য জমি দান করেন মতিলাল শীল।
12. কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ কে ছিলেন?
উত্তর – কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ব্রামলি।
13. দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পশ্চিমি ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি?
উত্তর – দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পশ্চিমি ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয় হল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ খ্রি.)।
14. কোন্ উপাচার্যের সময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উৎকর্ষ চরম শিখরে পৌঁছোয় ?
উত্তর – স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য থাকার সময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উৎকর্ষ চরম শিখরে পৌঁছোয়।
15. এশিয়ার প্রথম ডি লিট কে ছিলেন?
উত্তর – এশিয়ার প্রথম ডি লিট ছিলেন বেণীমাধব বড়ুয়া।
16. ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে কারা পরিচিত?
উত্তর – শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, ওয়ার্ড ও মার্শম্যান ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে পরিচিত।
17. কে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর – অশোক মিত্র উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
18. কে, কবে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
19. কে, কবে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
20. কে, কবে বারাণসী সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – জোনাথন ডানকান ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

21. কে, কবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?

উত্তর – লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
22. কত খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
23. প্রাচ্যবাদের কয়েকজন সমর্থকের নাম লেখো।
উত্তর – প্রাচ্যবাদের কয়েকজন সমর্থক হলেন এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ।
24. প্রথম কে, কবে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন?
উত্তর – লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. বড়োলাট ………. ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
উত্তর – লর্ড হার্ডিঞ্জ
2. লন্ডন মিশনারি সোসাইটির ………. চুঁচুড়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর – রবার্ট মে
3. ……….. প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
উত্তর – ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি
4. ……….. সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
উত্তর – উডের ডেসপ্যাচের
5. হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের (১৮৪৯ খ্রি.) বর্তমান নাম হল ………….।
উত্তর – বেথুন স্কুল
6. …………. খ্রিস্টাব্দে সরকার নারীশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে সরকারি অনুদান প্রদানের কথা ঘোষণা করে।
উত্তর – ১৮৫৪
7. রামমোহন রায় ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ……….. -কে এক পত্রের দ্বারা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের দাবি জানান।
উত্তর – আমহার্স্ট
৪. লর্ড ……….. আমলে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
উত্তর – বেন্টিঙ্কের
9. ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ………… নামে প্রথম মুসলিম ছাত্র কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে।
উত্তর – রহিম খান
10. কলকাতা মেডিকেল কলেজ ছিল ………… -কলেজ যেখানে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা শেখানো হত।
উত্তর – দ্বিতীয়

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) লর্ড ক্লাইভ
(b) লর্ড কর্নওয়ালিশ
(c) লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস
(d) লর্ড ওয়েলেসলি
উত্তর – (c) লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস
2. এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৭৭৪ খ্রি.
(b) ১৭৮৪ খ্রি.
(c) ১৭৯২ খ্রি.
(d) ১৮৭৪ খ্রি.
উত্তর – (b) ১৭৮৪ খ্রি.
3. ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয় –
(a) ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (a) ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে
4. সাধারণ জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়-
(a) ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (d) ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে
5. মেকলের মিনিট কবে পেশ করা হয়?
(a) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে
6. ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে চুঁইয়ে পড়া নীতি’ প্রবর্তন করেন—
(a) চার্লস উড
(b) মেকলে
(c) লর্ড বেন্টিঙ্ক
(d) লর্ড আর্মহাস্ট
উত্তর – (b) মেকলে
7. বেন্টিঙ্কের আমলে জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি ছিলেন—
(a) কলভিন
(b) টমাস মেকলে
(c) কোলব্রুক
(d) উইলসন
উত্তর – (b) টমাস মেকলে
৪. ভারতে প্রাচ্যরীতিতে শিক্ষাদানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন—
(a) প্রিন্সেপ
(b) মেকলে।
(c) আলেকজান্ডার ডাফ
(d) সন্ডার্স
উত্তর – (a) প্রিন্সেপ
9. কোন্ মিনিটের মাধ্যমে প্রাচ্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে?
(a) অকল্যান্ডের মিনিট
(b) মেকলের মিনিট
(c) জনপোরের মিনিট
(d) বেন্টিঙ্কের মিনিট
উত্তর – (b) মেকলের মিনিট
10. ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন—
(a) মেকলে
(b) প্রিন্সেপ
(c) কোলব্রুক
(d) উইলসন
উত্তর – (a) মেকলে
11. ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বেমানান নামটি হল—
(a) রাজা রামমোহন রায়
(b) কালীপ্রসন্ন সিংহ
(c) ডেভিড হেয়ার
(d) ড্রিংকওয়াটার বিটন (বেথুন)
উত্তর – (b) কালীপ্রসন্ন সিংহ
12. ব্রায়সমাজের মুখপত্র ছিল—
(a) সম্বাদ কৌমুদি
(b) সমাচার দর্পণ
(c) সমাচার চন্দ্রিকা
(d) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা
উত্তর – (d) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা
13. ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন’ প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) মিডলটন
(b) আলেকজান্ডার ডাফ
(c) উইলিয়াম কেরি
(d) মার্শম্যান
উত্তর – (b) আলেকজান্ডার ডাফ
14. বাংলায় নারীশিক্ষা প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন—
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) রাজা রামমোহন রায়
(c) ডেভিড হেয়ার
(d) কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়
উত্তর – (a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
15. হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়-
(a) ১৮৪৭ খ্রি.
(b) ১৮৪৮ খ্রি.
(c) ১৮৪৯ খ্রি.
(d) ১৮৫০ খ্রি..
উত্তর – (c) ১৮৪৯ খ্রি.
16. হেয়ার স্কুল-এর প্রথম নাম ছিল—
(a) ধর্মতলা অ্যাকাডেমি
(b) পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি
(c) অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন
(d) ডিফেন্স অ্যাকাডেমি
উত্তর – (b) পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি
17. জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনের বর্তমান নাম কী?
(a) স্কটিশ চার্চ কলেজ
(b) বিদ্যাসাগর কলেজ
(c) প্রেসিডেন্সি কলেজ
(d) চিত্তরঞ্জন কলেজ
উত্তর – (a) স্কটিশ চার্চ কলেজ
18. ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ হল—
(a) বেথুন কলেজ
(b) স্কটিশ চার্চ কলেজ
(c) বিদ্যাসাগর কলেজ
(d) হিন্দু কলেজ
উত্তর – (a) বেথুন কলেজ
19. হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৮০০ খ্রি.
(b) ১৮৩৫ খ্রি.
(c) ১৮১৭ খ্রি.
(d) ১৮৫৭ খ্রি.
উত্তর – (c) ১৮১৭ খ্রি.
20. হিন্দু কলেজের বর্তমান নাম—
(a) বিদ্যাসাগর কলেজ
(b) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
(c) স্কটিশ চার্চ কলেজ
(d) সংস্কৃত কলেজ
উত্তর – (b) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
21. ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (a) ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে
22. কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন—
(a) ড. এম জে ব্রাম্‌লি
(b) ড. এইচ এইচ গুডিভ
(c) ড. এন ওয়ালিশ
(d) ড. জে গ্রান্ট
উত্তর – (a) ড. এম জে ব্রাম্‌লি
23. প্রথম বাঙালি ছাত্র যিনি শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন তিনি হলেন—
(a) মধুসূদন দত্ত
(b) নীলরতন সরকার
(c) মধুসূদন গুপ্ত
(d) দ্বারকানাথ গুপ্ত
উত্তর – (c) মধুসূদন গুপ্ত
24. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ছিলেন—
(a) লর্ড লিটন
(b) লর্ড ডালহৌসি
(c) উইলিয়াম কোলভিল
(d) লর্ড ক্যানিং
উত্তর – (d) লর্ড ক্যানিং
25. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক অধ্যাপক ছিলেন—
(a) রাসবিহারী ঘোষ
(b) প্রসন্নকুমার ঠাকুর
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) ড. নীলরতন সরকার
উত্তর – (c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

TOPIC – C সমাজসংস্কার এবং ধর্মসংস্কার

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। বিদ্যাসাগর কতটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন?
উত্তর – বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলন
ভূমিকা: উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ স্বীকৃত ছিল না। ফলে, বিধবা হিন্দু নারীরা সমাজে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে থাকতে বাধ্য হত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন সমাজ-সংস্কারক এই সময় বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
  1. জনমত গঠন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গঠন করতে থাকেন। [i] তিনি ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। [ii] জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’তে বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। [iii] সমাজে বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর গণস্বাক্ষর গ্রহণ করেন এবং এই গণস্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন।
  2. আইন পাস: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার প্রভাবিত হন। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করে সরকার বিধবাবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন।
  3. বিধবাবিবাহের প্রচলন: ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বর্ধমানের জনৈক বিধবা কালীমতীকে বিবাহ করলে কলকাতায় প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রকে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন।
  4. বিরোধীদের জবাব: যারা বিধবাবিবাহের বিপক্ষে ছিল কিংবা বিধবা- বিবাহের বিরোধিতা করেছিল তাদের উত্তর দেবার জন্য তিনি ‘অতি অল্প হইল’ ও ‘আবার অতি অল্প হইল’ নামে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহের সাফল্য
বিদ্যাসাগর তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলনে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন—
  1. নারীমুক্তি: বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ফলে বিধবা নারীরা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়। এরপর বিধবাবিবাহ সংঘটিত হতে থাকলে বিধবাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
  2. বিধবাবিবাহের প্রসার: বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বোম্বাইয়ের প্রার্থনাসমাজ, মহারাষ্ট্রে ডি কে কার্ভে, মাদ্রাজে বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু বিধবাবিবাহকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন।
  3. সুদূরপ্রসারী প্রভাব: রক্ষণশীলদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যায়নি। বিদ্যাসাগরের শুরু করা বিধবাবিবাহ পরবর্তীকালে স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজে নিজের স্থান করে নিয়েছে।

উপসংহার: বিধবাবিবাহ আন্দোলন ও তার প্রবর্তন ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে হিন্দু বিধবা নারীরা নতুন দিশার সন্ধান পায়।

2. *উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে সমাজ ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো। অথবা, ঊনবিংশ শতাব্দীতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণে রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর – সমাজ ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়
ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের একজন অনন্য প্রতিভাধর মনীষী। তাঁকে ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়। তিনিই প্রথম তাঁর যুক্তিবাদী মন ও অসীম জ্ঞানের আলোতে সমকালীন ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও দোষত্রুটিগুলি দূর করার চেষ্টা করেন। তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন থেকেই তাঁর সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।
  1. সামাজিক ও ধর্মীয় কুপ্রথা বিরোধী আন্দোলন: রামমোহন হিন্দুসমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি উপলব্ধি করেন, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, বহু দেবতার পূজা, ব্রাহ্মণবাদ, পুরোহিততন্ত্র, সতীদাহ, গঙ্গাজলে সন্তান বিসর্জন, অর্থহীন ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভৃতি হিন্দু ধর্মকে কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে। তিনি এসব কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হন।
  2. একেশ্বরবাদের প্রচার: রামমোহন রায় প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেন, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। একেশ্বরবাদী নিরাকার ব্রহ্মার আরাধনাই হিন্দুধর্মের মূল কথা। তিনি একেশ্বরবাদের সমর্থনে ‘তুহাফৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন’ নামে ফারসি ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেন এবং পাঁচটি প্রধান উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেন।
  3. আত্মীয় সভা ও ব্রাহ্যসভা প্রতিষ্ঠা: রামমোহন কলকাতায় তাঁর বন্ধু ও অনুগামীদের নিয়ে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। একেশ্বরবাদের প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্ণসভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ব্রাহ্মসমাজ।
  4. সতীদাহপ্রথা বিরোধী আন্দোলন: ভারতীয় হিন্দুসমাজে সতীদাহ নামে এক কুপ্রথার প্রচলন ছিল। এই প্রথা অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর তার জীবিত স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারা হত। রামমোহন এই বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেষপর্যন্ত তাঁর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আইনের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।
  5. শিক্ষাসংস্কার: রামমোহন উপলব্ধি করেছিলেন, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ না করলে ভারতীয়দের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। এজন্য তিনি লর্ড আমহার্স্টকে লেখা এক পত্রে (১৮২৩ খ্রি.) ভারতীয়দের ইংরেজি, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন শিক্ষাদানের জন্য সরকারি অর্থব্যয়ের দাবি জানান। তিনি নিজে কলকাতায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কলকাতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (১৮৩০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় তিনি আলেকজান্ডার ডাফকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন।
  6. অন্যান্য সংস্কার: রামমোহন ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন ও ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্রদূত ছিলেন। তিনি বিচারব্যবস্থার দুর্নীতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, প্রশাসনে ভারতীয়দের নিয়োগে বনা প্রভৃতির প্রতিবাদ করেন। কৃষকদের দুর্দশা মোচনেও তিনি চিন্তা করতেন। তিনি বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের জনক। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

উপসংহার: ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের সংস্কারের কাজে রামমোহনের অবদানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে পণ্ডিতগণ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়েছেন। আবার রামমোহনের জীবদ্দশাতে এবং পরবর্তীকালেও অনেকে তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিশোরীচাঁদ মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র, আচার্য ব্রজেন্দ্রলাল শীল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধি—সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভারতপথিক’ বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস আরও একধাপ এগিয়ে তাঁকে ‘বিশ্বপথিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছেন, “তোমার উপাধি রাজা। জড়ময় ভূমিখণ্ড তোমার রাজ্য নয়। তুমি একটি সুবিস্তর মন রাজ্য অধিকার করিয়া রাখিয়াছ।।…. কেবল ভারতবর্ষীয়দের বন্ধু কেন, তুমি জগতের বন্ধু।”

3. ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজসংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো। 
উত্তর – সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান
ভূমিকা: ঊনবিংশ শতকে ভারতে বিরল যেকজন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সমাজসংস্কারের কাজে তাঁর আন্তরিক উদ্যোগ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।
  1. বর্ণবৈষম্য দূর: উনিশ শতকের ভারতীয় সমাজে প্রবল জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণবৈষম্য সমাজকে দুর্বল করেছিল। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হিসেবে বিদ্যাসাগর এই প্রথা দূর করেন। আগে কেবলমাত্র ব্রাক্ষ্মণ ও বৈদ্য সন্তানরাই সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হতে পারত। বিদ্যাসাগর এই প্রথা বাতিল করে সংস্কৃত কলেজের দরজা সকল বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্য খুলে দেন।
  2. বিধবাবিবাহের আন্দোলন: তৎকালীন সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহ স্বীকৃত ছিল না। বিদ্যাসাগর হিন্দু বাল্যবিধবাদের জীবনের করুণ দশা দেখে ব্যথিত হন এবং বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে আন্দোলনে নামেন।
    1. জনমত গঠন: বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গঠন করতে থাকেন। তিনি ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিবিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সমাজে বিধবা বিবাহকে আইনসিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি গণস্বাক্ষর গ্রহণ করে একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই লর্ড ক্যানিং ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করে বিধবাবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন।
    2. বিধবাবিবাহের প্রচলন: ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে কলকাতায় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বর্ধমানের জনৈক বিধবা কালীমতীকে বিবাহ করার মধ্য দিয়ে প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রকে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন।
  3. বহুবিবাহের বিরোধিতা: তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও বিদ্যাসাগর প্রতিবাদ জানান।
    1. সরকারের কাছে আবেদন: বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংবলিত এক আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। স্থির হয় যে, সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
    2. বিদ্যাসাগরের প্রচার: বিদ্যাসাগর ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয়। বিদ্যাসাগরের প্রচার ও আন্তরিক উদ্যোগের ফলে বহুবিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়।
শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান
শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বাংলার জনশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও নারীশিক্ষার প্রসারে এবং বাংলা গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  1. গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন : বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন যে, একমাত্র শিক্ষাই মানুষের মধ্যে জ্ঞানের সঞ্চার ঘটানোর মধ্য দিয়ে মানুষের মন থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে এবং প্রকৃত মনুষত্ব জাগিয়ে তুলতে পারে। তাই শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি লর্ড হার্ডিঞ্জের সহায়তায় গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন স্থানে বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
  2. মডেল স্কুল স্থাপন: শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর বাংলার বিভিন্ন জেলায় মডেল স্কুল বা আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় তিনি নিজ ব্যয়ে চালাতেন।
  3. নারী শিক্ষার প্রসার : বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ নেন। তাঁর উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুনের সহায়তায় কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ যা আজকের বেথুন স্কুল নামে পরিচিত।
  4. মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন: শিক্ষাবিস্তারের কাজে বিদ্যাসাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল কলকাতায় ‘মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন’-এর প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে এটি বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত।
  5. পাঠ্যপুস্তক রচনা: শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনে বিদ্যাসাগর শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘নীতিবোধ’ প্রভৃতি পাঠ্যপুস্তক রচনার মধ্য দিয়ে তিনি এই কাজে অগ্রসর হন।

উপসংহার: ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে ভূমিকা গ্রহণ করেন তা এককথায় অবিস্মরণীয়। তাঁর প্রশংসা করে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁকে ‘ঐতিহ্যবাহী আধুনিকতাবাদী’ বলে অভিহিত করেছেন।

4. *নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল কাদের বলা হয়? উনিশ শতকে বাংলার ইতিহাসে নব্যবঙ্গদের অবদান উল্লেখ করো।
উত্তর – নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল কারা
উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নেতৃত্বে একদল যুবক হিন্দুসমাজ ও ধর্ম সংস্কারের কাজে বিশেষ খ্যাতিলাভ করে। ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী যুবগোষ্ঠী ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত।
নব্যবঙ্গদের অবদান
উনিশ শতকে যেসব আন্দোলন বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল নব্যবঙ্গ আন্দোলন বা ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট।
  1. প্রাণপুরুষ: নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সূচনা ও প্রসারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১ খ্রি.)। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই কবি, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
  2. স্বদেশপ্রীতি: ডিরোজিও একটি ইঙ্গ-ভারতীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ভারতের প্রতি তাঁর দেশাত্মবোধ ছিল গভীর। ‘ক্রীতদাসের মুক্তি’ এবং ‘আমার জন্মভূমি ভারতের প্রতি’ কবিতায় তাঁর গভীর দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এই দেশপ্রেমের সঞ্চার করেন। তাঁর ছাত্রমন্ডলী দেশপ্রেমের নিদর্শনস্বরূপ বিভিন্ন কাজে অংশ নেন।
  3. যুক্তিবাদ: টমাস পেইন, হিউম, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের যুক্তিবাদী দর্শন ডিরোজিওকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে এই যুক্তিবাদের সঞ্চার করেন। তিনি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে বলেন এবং কোনো কিছুই বিনা বিচারে মেনে নিতে নিষেধ করেন।
  4. সংগঠন: ডিরোজিও হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পার্থেনন’ নামে পত্রিকার মাধ্যমে নব্যবঙ্গরা তাঁদের মতামত সকলের কাছে পৌঁছে দিতেন।
  5. কুপ্রথার বিরোধিতা: ডিরোজিও-র পরামর্শে ছাত্ররা বুঝতে পারে যে, প্রাচীন রক্ষণশীলতা, বর্বর কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলি হিন্দুধর্ম ও সমাজের প্রাণশক্তি নষ্ট করে দিয়েছে। তাই এই পুরোনো ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা দরকার। ডিরোজিও-র অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী হিন্দুধর্মের কুপ্রথা ও রক্ষণশীলতাকে সরাসরি আক্রমণ করতে থাকেন। তাঁরা জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতার নিন্দা করার উদ্দেশ্যে পইতা ছিঁড়ে ফেলেন ও নিষিদ্ধ মাংস খান।
  6. প্রতিক্রিয়া: নব্যবঙ্গদের এরূপ উগ্র আন্দোলন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা তাদের সন্তানদের হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত রক্ষণশীল হিন্দুদের চাপে ডিরোজিওকে পদচ্যুত করা হয়। এর কিছুদিন পর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
  7. অনুগামীদের আন্দোলন: ডিরোজিও-র মৃত্যুর পরও তাঁর অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী নব্যবঙ্গ আন্দোলন চালিয়ে যান। এই সময়ের ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’র সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃয়মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ। এঁরা সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে প্রগতিশীল মতবাদ প্রচার করেন। সাধারণ জ্ঞান অর্জন সমিতি’ (১৮৩৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে তারা মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেন।

উপসংহার: নব্যবঙ্গ আন্দোলনকে আপাতদৃষ্টিতে ভাঙনমূলক বা নৈরাজ্যবাদী বলে মনে হলেও বাংলার সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে এই আন্দোলনের অবদানকে কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না। ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’র যুবকরা পরবর্তীকালে পরিণত সংস্কারক ও সমাজসেবীতে পরিণত হন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নারীশিক্ষার প্রসার, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের উদ্যোগে  প্রকাশিত ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এনকোয়েরার’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা দেশবাসীর মনে কুসংস্কারবিরোধী মনোভাব ও যুক্তিবাদের প্রসারে সহায়তা করে। নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর যুবকদের প্রশংসা করে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “এরাই বাংলায় আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক, এরাই আমাদের জাতির পিতা, এদের গুণাবলি চিরস্মরণীয়। এদের দুর্বলতা বা দোষত্রুটি সম্বন্ধে মুখর হয়ে ওঠা উচিত হবে না।”

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারের প্রধান উদ্যোগ কারা নিয়েছিল?
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার
ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমদিকেও বাংলার সমাজজীবনে বিভিন্ন কুপ্রথার প্রচলন ছিল। সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসীপ্রথা, জাতিভেদপ্রথা, অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাজলে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি নানান কুপ্রথা ও অন্ধবিশ্বাস বাংলার সমাজজীবনের অগ্রগতি রুদ্ধ করেছিল। উনিশ শতকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলায় সমাজসংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
  1. রামমোহন রায়: বাংলার সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন রামমোহন রায়। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ (১৮২৯ খ্রি.) করেন। রামমোহন বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা, নারীশিক্ষা প্রভৃতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
  2. রামমোহন-পরবর্তী ব্রাহ্যসমাজ: রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ বাংলায় বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতির বিরোধিতা করে এবং অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা প্রভৃতির সমর্থনে আন্দোলন গড়ে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশ করে সমাজসংস্কারের পক্ষে প্রচার চালানো হয়।
  3. ইয়ং বেঙ্গল দল: ডিরোজিও-র নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গল বা ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’-র রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ যুবক বাংলার হিন্দুসমাজের সতীদাহপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, মূর্তিপূজা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।
  4. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার সমাজসংস্কারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় লর্ড ক্যানিং বিধবাবিবাহ আইন (১৮৫৬ খ্রি.) পাস করেন। বিদ্যাসাগর বাংলায় বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরোধিতা করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ও নারীশিক্ষার প্রসারে আজীবন কাজ করে যান।

উপসংহার: উনিশ শতকের এই সকল ব্যক্তিদের সংস্কার প্রচেষ্টার ফলে। বাংলার সমাজ নতুন আলোর সন্ধান পায়। এরফলে বাংলায় যুক্তিবাদ, উদারতাবাদ ও মানবতাবাদের আবির্ভাব ঘটে |

2. *সতীদাহপ্রথা সম্পর্কে কী জান? অথবা, সহমরণ কী?
উত্তর – সতীদাহ প্রথা/সহমরণ
ভূমিকা: উনিশ শতকের সূচনালগ্নেও বাংলা তথা ভারতীয় হিন্দুসমাজের নারীরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকার হতেন। এসব নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম ছিল সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ।
  1. সতীদাহপ্রথা কী?: উনিশ শতকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর জ্বলন্ত চিতায় তার বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার রীতি প্রচলিত ছিল। এই রীতি সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ নামে পরিচিত।
  2. হিন্দুসমাজের দৃষ্টিভঙ্গি: তৎকালীন হিন্দুসমাজ স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীকে সতীদাহ বা সহমরণের হাত থেকে রক্ষা করত না বরং এই প্রথাকে সমর্থন করত।
  3. সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি: ব্রিটিশ সরকার সতীদাহপ্রথার বিরোধী ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার প্রথমদিকে এই প্রথা নিষিদ্ধ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে ক্ষিপ্ত বা অসন্তুষ্ট করতে চায়নি।
  4. আন্দোলন: সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে জনমত তুলতে থাকেন। তিনি বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি-সহ অসংখ্য মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন।

উপসংহার: ভারতের বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) সতীদাহপ্রথার কুফল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। শেষপর্যন্ত রাজা রামমোহন রায়ের সক্রিয় সহযোগিতায় বেন্টিঙ্ক আইন প্রণয়ন করে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

3. *উনিশ শতকে বাংলায় সতীদাহ-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সতীদাহ-বিরোধী আন্দোলনের পরিচয় দাও।
উত্তর – সতীদাহ-বিরোধী আন্দোলন
ভূমিকা: উনিশ শতকের সূচনালগ্নেও বাংলা তথা ভারতীয় হিন্দুসমাজে সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ নামে একটি মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুর বর্বর প্রথা প্রচলিত ছিল এই প্রথা অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর জ্বলন্ত চিতায় তার বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হত। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে এই বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়।
  1. প্রেক্ষাপট: উনিশ শতকের শুরুতেও হিন্দুসমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের বিধবা স্ত্রীরা সীমাহীন উপেক্ষার শিকার হত। সতীদাহ বা সহমরণের হাত থেকে তাদের রক্ষা না করে সমাজ বরং এই প্রথাকে সমর্থন করত। ব্রিটিশ সরকার এই কুপ্রথার বিরোধী হলেও তারা প্রথমদিকে এই প্রথা নিষিদ্ধ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে ক্ষিপ্ত করতে চায়নি।
  2. আন্দোলন সংগঠন: সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজা রামমোহন রায় শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি লোকশিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে হিন্দুসমাজ থেকে এই কুপ্রথার অবসান ঘটানোর চেষ্টা চালান।
  3. ধর্মীয় নির্দেশের সন্ধান: রক্ষণশীল হিন্দুরা সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন রায়ের আন্দোলনে ক্ষুব্ধ হলে রামমোহন ‘মনুসংহিতা’-সহ বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহপ্রথা হিন্দুধর্ম ও শাস্ত্রবিরোধী। তিনি ‘সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
  4. সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ: বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে রামমোহন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তিনি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি বাংলা পুস্তিকা প্রকাশ করে শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি এবিষয়ে পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
  5. ফলাফল: রামমোহন সতীদাহপ্রথা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে বাংলার বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদনপত্র তৎকালীন ভারতের বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮ ১৮৩৫ খ্রি.)-এর কাছে জমা দেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে (৪ ডিসেম্বর) ১৭নং রেগুলেশন আইন পাস করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।

উপসংহার: বেন্টিঙ্ক কর্তৃক সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধকরণ আইনকে রামমোহন রায় অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। এরপর দীর্ঘকালব্যাপী এই বর্বর প্রথার অবসান ঘটে।

4. *উনিশ শতকে বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগগুলি কী ছিল?
উত্তর – বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগ
ভূমিকা: পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলায় ব্যাপক সমাজ ও ধর্মসংস্কার শুরু হয়। বাংলায় এক্ষেত্রে অগ্রভাগে ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের নেতৃবৃন্দ।
  1. ব্রাহ্মসমাজের গঠন: রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ব্রাহ্মসমাজ। রামমোহনের মৃত্যুর (১৮৩৩ খ্রি.) পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব দেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ।
  2. রামমোহনের সময়: রামমোহন রায়ের সময় ব্রাহ্মসমাজ একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা, পৌত্তলিকতার অবসান ঘটানো, সর্বধর্ম-সমন্বয়সাধন, মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রচার চালায়। এভাবেই তারা বাংলায় সামাজিক আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়।
  3. দেবেন্দ্রনাথের উদ্যোগ: রামমোহন রায়ের মৃত্যুর (১৮৩৩ খ্রি.) পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.) নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯ খ্রি.) সংস্কারমুক্ত ধর্ম আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সভা বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, শ্রমিককল্যাণ প্রভৃতির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলে।
  4. কেশবচন্দ্রের উদ্যোগ: কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ণসমাজ সমাজসংস্কারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নারীশিক্ষা, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, পতিতা মেয়েদের উদ্ধার প্রভৃতির পক্ষে ব্রাহ্ণসমাজ প্রচার চালায়। কেশবচন্দ্র বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মদ্যপান, পর্দাপ্রথা প্রভৃতিরও বিরোধিতা করেন। শ্রমিকদের কল্যাণেও কেশবচন্দ্র নজর দেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকেই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন।

উপসংহার: বলাবাহুল্য, ব্রাহ্ণসমাজ শুধুমাত্র সমাজ সংস্কারের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না; শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যেও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে ‘সমাজোন্নয়ন বিধায়নী সুহৃদ সমিতি’ (১৮৫৪ খ্রি.), ‘ব্রায়বন্ধুসভা (১৮৬০ খ্রি.), সঙ্গতসভা (১৮৬০ খ্রি.), ‘ক্যালকাটা কলেজ’ (১৮৬২ খ্রি.) প্রভৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল।

5. উনিশ শতকের বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাত্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ? 
উত্তর – উনিশ শতকের বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ব্রাহ্মসমাজ বোঝাতে আদি ব্রাহ্মসমাজ, ভারতবর্ষের ব্রাহ্মসমাজ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, নববিধান ব্রাহ্মসমাজ প্রভৃতিকে বোঝায়। রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ব্রাহ্মসমাজ। রামমোহনের মৃত্যুর পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব দেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ।
  1. কুসংস্কারের বিরোধিতা ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসার: ব্রাহ্বসমাজ ভারতীয় সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের যেমন বিরোধিতা করেছিল, তেমনই মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
  2. জাতিভেদপ্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা: ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুসমাজের জাতিভেদপ্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করে। হিন্দুধর্মের নামে নানা প্রচলিত কুপ্রথার প্রতিরোধে ব্রাহ্ণসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
  3. নারীকল্যাণের ভূমিকা: ব্রাহ্মসমাজ নারীকল্যাণের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। যেমন—পর্দাপ্রথার বিলুপ্তিসাধন, বিধবাবিবাহের আইনসিদ্ধকরণ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, নারীসমাজে শিক্ষার প্রচলন প্রভৃতি।
  4. জাতীয় সংহতির চেতনা: ব্রাহ্মসমাজ ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয় সংহতির চেতনা প্রসারের ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। উদারপন্থী ধর্মীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে ব্রাহ্ণসমাজ জাতীয় সংহতি চেতনার জাগরণ ঘটায়।
  5. সমাজসেবা: ব্রাহ্বসমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা, যেমন— দুর্ভিক্ষের সময় কেশবচন্দ্র সেন একদল বাঙালি তরুণকে নিয়ে ত্রাণের এক দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন।

উপসংহার: ব্রাহ্ণসমাজ বাংলার সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত রেখেছিল। এই প্রতিষ্ঠান সমাজসংস্কারের মাধ্যমে এক জাতীয় জাগরণ ঘটাতে চেয়েছিল। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশন ব্রাহ্ণসমাজের কিছু আদর্শ গ্রহণ করে।

6. * দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের কার্যাবলি ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রসারের পরিচয় দাও।
উত্তর – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলন
ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর (১৮৩৩ খ্রি.) ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের গতি কিছুদিনের জন্য কমে গেলেও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.) ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে সমাজসংস্কার আন্দোলন আবার গতিশীল হয়ে ওঠে।
  1. তত্ত্ববোধিনী সভা: সংস্কারমুক্ত ধর্ম আলোচনার উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভা দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের প্রগতিশীল মানুষের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই সভার সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখের যোগাযোগ ছিল।
  2. তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা: তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (১৮৪৩ খ্রি.) ব্রাহ্ণসমাজের আদর্শ ও চিন্তাধারা দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেয়। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
  3. তত্ত্ববোধিনী সভার শাখা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ব্রাহ্মসমাজের ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা, কুমিল্লা, রংপুর, বাঁশবেড়িয়া-সহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে ব্রাহ্মসমাজের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
  4. সংস্কার আন্দোলন: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাত্মসমাজ হিন্দুসমাজে প্রচলিত নানা ধরনের কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদপ্রথা প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে এবং ‘অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতি সমাজকল্যাণমূলক প্রথার সপক্ষে ব্রাহ্ণসমাজ আন্দোলন গড়ে তোলে। একেশ্বরবাদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা ব্রাম্মদের মূল আদর্শ হিসেবে ঘোষিত হয়।
  5. শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ: শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ সমাজোন্নয়ন বিধায়নী সুহৃদ সমিতি (১৮৫৪ খ্রি.), ব্রাত্মবন্ধুসভা (১৮৬০ খ্রি.), সঙ্গতসভা (১৮৬০ খ্রি.), ক্যালকাটা কলেজ (১৮৬২ খ্রি.) প্রভৃতি সংগঠন গড়ে তোলে।

উপসংহার: ব্রাহ্ণসমাজ পরিচালনায় রামমোহন রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ, রামমোহনের মৃত্যুর পর দ্বারকানাথ ঠাকুর-সহ কয়েকজন ধীরগতিতে ব্রায়সমাজের আন্দোলন সচল রাখলেও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলেই তা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।

7. *মুসলিম সমাজের উন্নয়নে হাজি মহম্মদ মহসীনের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – মুসলিম সমাজের উন্নয়নে হাজি মহম্মদ মহসীনের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজের উন্নয়নে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবক ও দানবীর হাজি মহম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২ খ্রি.)।
  1. আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে অবদান: হাজি মহম্মদ মহসীন উপলব্ধি করেন, সমাজের উন্নতির জন্য ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি।
  2. দানকার্য : মহসীন নিজেকে নিঃস্ব করে নিজের বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ মুসলিম সমাজের উন্নয়নে দান করেন। এই দানের অর্থ মাদ্রাসা চালানো, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তাদান, চিকিৎসাব্যবস্থায় উন্নতি, রাস্তাঘাট তৈরি, পুকুর খনন প্রভৃতি কাজে ব্যয় করা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১৭৭০ খ্রি.) সময় তাঁর দানে লক্ষ লক্ষ নিরন্ন মানুষ প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
  3. ফান্ড গঠন: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ গভর্নর চার্লস মেটকাফের উদ্যোগে মহসীনের দান করা অর্থে মহসীন শিক্ষা তহবিল নামে একটি ফান্ড গড়ে ওঠে। এই ফান্ডের অর্থে বিভিন্ন সামাজিক কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
  4. কলেজ প্রতিষ্ঠা: মহসীনের আর্থিক দানে এবং শিক্ষানুরাগী মেটকাফের উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় একটি কলেজ স্থাপিত হয়। এটি বর্তমানে হুগলি মহসীন কলেজ নামে পরিচিত।
  5. অন্যান্য কাজ : মহসীন ফান্ডের অর্থে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা-সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইমামবাড়া হাসপাতাল (১৮৩৬ খ্রি.), হুগলির ইমামবাড়া (১৮৪১ খ্রি.) প্রভৃতি স্থাপিত হয়েছে। তাঁর দান করা জমিতে স্থাপিত হয়েছে জুবিলি ব্রিজ, চুঁচুড়া থানা, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংক-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

উপসংহার: মহসীনের দানের অর্থে দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী, অনাথ ও অসহায় বঙ্গবাসী উপকৃত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। হুগলি মহসীন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখনও মহসীন তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকে। তাঁর মহৎ অবদানের জন্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়দের অন্যতম’ বলে অভিহিত করেছেন।

8. * উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুধর্মের সংস্কারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর – উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুধর্মের সংস্কার
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকেও বাংলায় হিন্দুধর্মে নানা কুসংস্কারের অস্তিত্ব ছিল। পৌত্তলিকতা, বহু দেবতার আরাধনা প্রভৃতি হিন্দুধর্মে জাঁকিয়ে বসেছিল। এসবের বিরুদ্ধে উনিশ শতকে বিভিন্ন মনীষীর উদ্যোগে সংস্কারকার্য শুরু হয়।
  1. ব্রাক্ষ্মসমাজের ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাত্মসমাজই প্রথম হিন্দুধর্মের, সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। রামমোহনের নেতৃত্বে ব্রায়সমাজ একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা, পৌত্তলিকতার অবসান, সর্বধর্মসমন্বয়সাধন, মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে। রামমোহনের মৃত্যুর পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাত্নসমাজের ধর্মীয় আন্দোলন চলতে থাকে। এই সময় একেশ্বরবাদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা ব্রাহ্লদের মূল আদর্শ বলে ঘোষিত হয়।
  2. নব্যবঙ্গের ভূমিকা: ডিরোজিও-র নেতৃত্বে ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’ হিন্দুধর্মের সংস্কারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ডিরোজিও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৭ খ্রি.)-এ হিন্দুধর্মের অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদপ্রথা, সতীদাহপ্রথা, মূর্তিপূজা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিয়মিত আলোচনা হত। এই সংগঠনের সদস্যরা নিষিদ্ধ মাংস খেয়ে, উপবীত ছিঁড়ে হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতার প্রতিবাদ জানান।
  3. শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকা: শ্রীরামকৃয় সহজসরল ভাষায় তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করে আপামর বাঙালিসমাজকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেন। তিনি বলতেন, সকল ধর্মই সত্য। “সব ধর্মের লোকেরা একই ঈশ্বরকে ডাকছে। কেউ বলছে ঈশ্বর, কেউ রাম, কেউ হরি, কেউ আল্লা, কেউ ব্রয়। নাম আলাদা, কিন্তু একই বস্তু।” তিনি ‘যত মত, তত পথ’- এর আদর্শ প্রচার করে বলেন যে, সাধনার সব পথই সত্য ও সঠিক। বৈয়ব, শাক্ত, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি সব ধর্মের সাধনার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরকে লাভ করা সম্ভব।
  4. স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দ প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা নব্য বেদান্তবাদ নামে পরিচিত। এই ব্যাখ্যায় তিনি বলেন যে, সর্বত্রই ব্রষ্মের উপস্থিতি রয়েছে। সাধারণ মানুষের সেবা করাই হল ব্রষ্মের সেবা করা। তিনি আত্মার মুক্তির জন্য সমাধি বা বাহ্যজ্ঞানযুক্ত গভীর জ্ঞানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।

উপসংহার: এইভাবে বিভিন্ন মনীষীর সংস্কার প্রচেষ্টার ফলে হিন্দু ধর্ম কুসংস্কারমুক্ত হয় এবং মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে।

9. * উনিশ শতকে ব্রাত্মসমাজের বিভাজন সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – উনিশ শতকে ব্রাহ্মসমাজের বিভাজন
ভূমিকা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ব্রাহ্মসমাজের প্রধান নেতা তখন যুবক কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪ খ্রি.) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্ণসমাজে যোগ দেন।
  1. কেশবচন্দ্রের উত্থান: কেশবচন্দ্র সেন তাঁর প্রতিভা ও দক্ষতার গুণে শীঘ্রই দেবেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ব্ৰষ্মানন্দ’ উপাধি দেন (১৮৬২ খ্রি.) এবং ব্রাহ্ণসমাজের আচার্য পদে নিয়োগ করেন।
  2. মতভেদের সূত্রপাত: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্রের উত্থান ঘটলেও বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, ব্রাহ্ম আচার্যদের উপবীত ধারণ, সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
  3. প্রথম ভাঙন: দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রের মতভেদের ফলে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্ণসমাজে ভাঙন দেখা দেয়। কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ভারতবর্ষীয় ব্রাত্মসমাজ (১৮৬৬ খ্রি.) নামে একটি পৃথক সংগঠন গড়ে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন মূল সংগঠনটি আদি ব্রাত্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।
  4. দ্বিতীয় ভাঙন: কেশবচন্দ্রের ইংরেজ-প্রীতি, অবতারবাদে বিশ্বাস, নারীস্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিধা— এই নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। এর ওপর ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম ভেঙে কেশবচন্দ্র নিজের ১৪ বছরের নাবালিকা কন্যাকে কুচবিহারের মহারাজের সঙ্গে বিবাহ দেন। এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট হয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ তরুণ কেশবচন্দ্রকে ত্যাগ করে সাধারণ ব্রাত্মসমাজ (১৮৭৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন সংগঠনটি নববিধান ব্রাত্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।

উপসংহার: ব্রাহ্বসমাজ হিন্দু সমাজ ও ধর্মসংস্কারে যে সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল তা ব্রাহ্মসমাজের বিভাজনের মধ্য দিয়ে ব্যাহত হয়।

10. *ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাত্মসমাজের সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল?
উত্তর – ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রায়সমাজের সীমাবদ্ধতা
ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের সীমাবদ্ধতাগুলিও অস্বীকার করা যায় না। যেমন—
  1. সীমাবদ্ধ প্রসার: ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্ণসমাজের আন্দোলন সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসারিত হয়নি। কেশবচন্দ্রের মৃত্যুকালে (১৮৮৪ খ্রি.) ব্রাহ্ণসমাজের তিনটি শাখা মিলিয়ে মোট সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৬,৪০০ জন।
  2. শহুরে আন্দোলন: ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন মূলত শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাইরে বৃহত্তর গ্রামবাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রসার ঘটানোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
  3. শিক্ষিত মানুষের আন্দোলন: ব্রায়সমাজের আন্দোলন মূলত শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের অগণিত অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের এই আন্দোলনে শামিল করার বিশেষ চেষ্টা করা হয়নি।
  4. অনৈক্য: ব্রাত্নসমাজের নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মতভেদ এই আন্দোলনের যথেষ্ট ক্ষতি করে। প্রথমে দেবেন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্র বিরোধ এবং পরে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর অনুগামীদের বিরোধ, ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন শাখার মধ্যে মতভেদ প্রভৃতি ঘটনা ব্রাত্নসমাজের আন্দোলনের গতিকে দুর্বল করে দেয়।

উপসংহারঃ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্রাহ্ণসমাজের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। উনিশ শতকে বাঙালি হিন্দুধর্ম ও সমাজ যখন মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ডুবেছিল, তখন ব্রাহ্ণসমাজের আন্দোলন তাকে আলোর পথে টেনে এনেছিল।

11. *বাংলার ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আন্দোলনে ব্রাত্মসমাজের কী অবদান ছিল ?
উত্তর – বাংলার ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের অবদান
ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় ধর্ম ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে। বাংলার সমাজজীবনে ব্রায়সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। যেমন—
  1. কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার: বাংলার রক্ষণশীল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকাঠামোয় সর্বপ্রথম জোরালো আঘাত হানে ব্রাহ্ণসমাজ। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা, পর্দাপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজে ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
  2. আধুনিকতার উন্মেষে ভূমিকা: পশ্চাদপদ হিন্দুসমাজের অগ্রগতির জন্য ব্রাহ্বসমাজ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিক্ষার প্রসার, নারীস্বাধীনতার প্রসার, নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা, মদ্যপান নিবারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্রাহ্ণসমাজের আন্দোলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
  3. তিন আইন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে সরকার ‘তিন আইন’ নামে একটি আইন পাস করে। এই আইনের দ্বারা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।
  4. দুর্দশা লাঘবে ভূমিকা: ব্রাহ্ণসমাজ সাধারণ দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। কেশবচন্দ্র সেন সঙ্গত সভা (১৮৬০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে নিপীড়িত মানুষের জন্য জনসেবার আদর্শ গ্রহণ করেন।
  5. সুমহান আদর্শ: ব্রাহ্মসমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য প্রভৃতি সুমহান আদর্শ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে জাতীয় জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। ড. এ আর দেশাই বলেছেন, “ব্রাহ্ণসমাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ।”

উপসংহার: হিন্দুধর্ম বিরোধী একটি পৃথক ধর্ম-আন্দোলন হিসেবে ব্রায়সমাজ বাংলার ধর্ম ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছে তা অস্বীকার করা যায় না। এই আন্দোলন হিন্দু সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পেরেছিল।

12. ঊনবিংশ শতকের ধর্ম ও সমাজজীবনে রামকৃয় পরমহংসদেবের ভূমিকা লেখো।
অথবা, শ্রীরামকৃয় সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – ঊনবিংশ শতকের ধর্ম ও সমাজজীবনে রামকৃ পরমহংসদেবের ভূমিকা
ভূমিকা: উনিশ শতকে যখন বাংলায় হিন্দুধর্ম নানা কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বেড়াজালে আবদ্ধ তখন আধ্যাত্মিক পুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃয় পরমহংসদেব (১৮৩৬-৮৬ খ্রি.) সর্বধর্মসমন্বয় অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের সম্প্রীতির আদর্শ প্রচার করে হিন্দু সম্প্রদায়কে নতুন আশার আলো দেখান।
  1. যত মত, তত পথ : শ্রীরামকৃষ্মের ধর্মীয় আদর্শের মূল কথা ছিল ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’। তিনি সকল ধর্মের সুসম্পর্কের বা সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করে বলেন যে, সাধনার সব পথই সত্য ও সঠিক, অর্থাৎ “যত মত, তত পথ”। তিনি বলতেন যে বৈয়ব, শাক্ত, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি সব ধর্মের সাধনার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরলাভ করা যায়।
  2. নিষ্কাম কর্মের আদর্শ: শ্রীরামকৃয় সাধনার জন্য সংসার ত্যাগের বদলে সংসারের আসক্তিকে জয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। কর্মত্যাগের বদলে তিনি বলেছেন নিষ্কাম কর্মের কথা।
  3. আন্তরিকতার আদর্শ: শ্রীরামকৃয় বলেছেন যে, ঈশ্বরলাভের জন্য শাস্ত্রীয় বিধি, জপতপ, মন্ত্রতন্ত্র, যাগযজ্ঞ কিংবা কৃচ্ছসাধনা— কোনোটারই প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র আন্তরিকতাকে সম্বল করেই যে- কোনো মানুষ স্বাধীনভাবে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে।
  4. শিবজ্ঞানে জীবসেবা: শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন যে, জীবের কল্যাণসাধনই হল যথার্থ ধর্ম। তাই জীবে দয়া নয়, তিনি ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’-র কথা বলেছেন।
  5. চৈতন্যের পথে যাত্রা: মানুষের মহত্বে বিশ্বাসী শ্রীরামকৃয় মনে করতেন যে, প্রত্যেক মানুষই হল অনন্ত শক্তির আধার এবং ‘চৈতন্যে’র পথে অগ্রসর হওয়াই হল মানুষের ধর্ম।
  6. নারীমুক্তি : শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নারী হল সাক্ষাৎ জগন্মাতার প্রতিমূর্তি। ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নারীমুক্তির আদর্শকে তিনি পূর্ণতার পথে এগিয়ে দেন। নারী জাতির দুর্দশামোচন ও সেকাজে নারীরই নেতৃত্বকে স্বীকৃতি জানিয়ে নারীর মহিমাকে তিনি আরও উঁচুতে তুলে ধরেন।

উপসংহার: শ্রীরামকৃয়ের ধর্মীয় আদর্শের মূল কথা ছিল ‘সর্বধর্মসমন্বয়’। তাই সকল ধর্মের সুসম্পর্কের বা সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করে তিনি বলতেন যে, “সব মতকে এক-একটি পথ বলে জানবে। আমার ঠিক পথ, আর সকলের মিথ্যা—এরূপ বোধ না হয়। বিদ্বেষভাব না হয়।”

13. * স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’ সম্পর্কে কী জান? অথবা, স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের আদর্শ ব্যখ্যা করো।
উত্তর – বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’
ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকে ভারতের খাঁটি আধ্যাত্মবাদ, নিখাদ দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি যে আদর্শ প্রচার করেন তা ‘নব্য বেদান্ত’ নামে পরিচিত।
  1. লক্ষ্য: ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্র্য, দুঃখ, শ্রীরামকৃয়ের উপদেশ, ভারত পরিক্রমার সময় নিজের চোখে ভারতবাসীর দুর্দশা দর্শন প্রভৃতি বিবেকানন্দের ধর্মচিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এজন্য মানুষকে অনুষ্ঠান-সর্বস্ব ধর্মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে সেবার আদর্শ তুলে ধরাই বিবেকানন্দ তাঁর ধর্মচিন্তার মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন।
  2. নতুন ধর্মাদর্শ: ভারতের প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যাকর্তা ছিলেন আদি জগৎগুরু শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রি.)। স্বামী বিবেকানন্দ অদ্বৈত দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা দেন যা ‘নব্য বেদান্তবাদ’ নামে পরিচিত। এই ব্যাখ্যায় তিনি বলেন যে, সর্বত্রই ব্রষ্মের উপস্থিতি রয়েছে। সাধারণ মানুষের সেবা করাই হল ব্রষ্মের সেবা করা।
  3. শিকাগো সম্মেলন: স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে (১১-২৭ সেপ্টেম্বর) আমেরিকার শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে (পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়স) যোগ দেন। সেখানে তিনি তাঁর বক্তৃতায় ভারতের সনাতন হিন্দুধর্মের অদ্বৈত বেদান্তের বিশ্বজনীন আদর্শ ও বিশ্বজনীন মানবপ্রেমের আদর্শ ব্যাখ্যা করেন।
  4. সমাধি: প্রাচীন অদ্বৈত দর্শনে সমাধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিবেকানন্দ তাঁর নব্য বেদান্তবাদে মানুষের মুক্তি অর্জনের জন্য সমাধির অর্থাৎ বাহ্যজ্ঞান বিবর্জিত ধ্যানমগ্ন অবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এভাবে স্বামীজি তাঁর ‘নব্য বেদান্তবাদের মাধ্যমে মানুষকে মুক্তির নতুন পথ দেখান।

উপসংহার: স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’ ছিল সমকালীন সময়ের একটি প্রয়োজনীয় ধর্মাদর্শ। কুসংস্কার আর নানান নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে যখন হিন্দুধর্মের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, তখন মানবপ্রেমের সনাতনী আদর্শের সমন্বয়ে গড়ে তোলা বিবেকানন্দের নব্য বেদান্তবাদই মুক্তির স্বাদ জুগিয়েছিল।

14. *লালন ফকির সম্পর্কে কী জান ?
উত্তর – লালন ফকির
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় সর্বধর্মসমন্বয়ের ক্ষেত্রে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আধ্যাত্মিক বাউলসাধক লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০ খ্রি.) বা লালন সাঁই।
  1. প্রথম জীবন: লালনের প্রথম জীবনের বেশকিছু বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত তিনি ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে যশোহর জেলায় ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে বা কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানার ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তরুণ বয়সে তীর্থভ্রমণে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে মলম শাহ ও তাঁর স্ত্রী মতিজানের সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
  2. ধর্মবিশ্বাস: লালন হিন্দু না মুসলিম ছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ তাঁকে হিন্দু, আবার কেউ বা মুসলিম বলে মনে করতেন। কিন্তু লালন নিজে এবিষয়ে কিছু না বলে বরং গান বেঁধেছেন—
           “সব লোকে কয় লালন কি জাতি সংসারে।
           লালন বলে জাতের কি রূপ
           দেখলাম না এই নজরে।”
    অন্য একটি গানে লালন লিখেছেন—
          “এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
           যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
            জাতি গোত্র নাহি রবে।”
  3. বাউল গান: কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা না থাকলেও লালন নিজ সাধনাবলে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন এবং মানবজীবনের আধ্যাত্মিক রহস্য নিয়ে প্রায় দু-হাজার বাউল গান রচনা করেন।
  4. ‘মনের মানুষ’-এর ধারণা: লালন বিশ্বাস করতেন, সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। সেই মনের মানুষের কোনো জাতি- ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদ নেই। তাই সেই মানুষকে নিয়ে লালন গান বাঁধেন— “মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরই সনে।”
  5. ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যোগ: ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে লালনের যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন—আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

উপসংহার: লালন সকল ধর্মের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতেন। তিনি হিন্দু ও ইসলাম—উভয় ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ১১৬ বছর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলিম কোনো ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হয়নি।

15. *বিজয়কৃয় গোস্বামী সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – বিজয়কৃয় গোস্বামী
ভূমিকা: বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৪১-৯৯ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন সাধক ও ধর্মসংস্কারক।
  1. প্রথম জীবন: বিজয়কৃয় গোস্বামী নদিয়া জেলার দহকুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শান্তিপুরে গোবিন্দ গোস্বামীর টোলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে ভর্তি (১৮৫৯ খ্রি.) হন।
  2. ব্রাষ্মসমাজে যোগদান: সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনার সময় বিজয়কৃয় গোস্বামী ব্রাত্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ব্রাহ্বসমাজে যোগ দেন (১৮৬৩ খ্রি.)। এরপর ব্রাহ্ণধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। তিনি শান্তিপুর, ময়মনসিংহ, গয়া প্রভৃতি স্থানে ব্রাহ্ণমন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
  3. কেশবচন্দ্রের সঙ্গে বিরোধ: বিজয়কৃয় ব্রাহ্মসমাজের আচার্য হয়ে পূর্ববঙ্গে আসেন (১৮৬৩ খ্রি.) এবং কিছুদিন ঢাকায় কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে কাজ করেন। পরবর্তীকালে কেশবচন্দ্রের কিছু অনুগামী তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে সাধারণ ব্রাত্মসমাজ (১৮৭৮ খ্রি.) নামে একটি পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এইসময় বিজয়কৃয় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
  4. ব্রাসমাজ ত্যাগ: কিছুদিন পর সাধারণ ব্রাহ্ণসমাজের সঙ্গে তাঁর মতভেদ দেখা দিলে তিনি ব্রাহ্বসমাজের আচার্যের পদ থেকে বিতাড়িত (১৮৮৬ খ্রি.) হন।
  5. নব্যবৈঘ্নর আন্দোলন: কিছুদিন পর বিজয়কৃয় ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ (১৮৮৮ খ্রি.) করে বৈয়বধর্মে ফিরে আসেন এবং ঢাকার গেণ্ডারিয়ার আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ধর্মসাধনায় মন দেন। এভাবে তিনি বাংলায় নব্যবৈয়ব আন্দোলনের সূচনা করেন। অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
  6. সংস্কার: বিজয়কৃয় স্ত্রীশিক্ষা ও নারীজাতির উন্নতির জন্য চেষ্টা চালান। তিনি পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীরামকৃয় ও ত্রৈলঙ্গস্বামীর সর্বধর্মসমন্বয় এবং সাকার ব্রষ্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মূর্তিপূজাকে সমর্থন করেন।
  7. সন্ন্যাসগ্রহণ: সন্ন্যাসগ্রহণের পর বিজয়কৃয় গোস্বামীর নতুন নাম হয় অচ্যুতানন্দ সরস্বতী। তিনি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পুরীতে দেহত্যাগ করেন।

উপসংহার: সাধক বিজয়কৃয় গোস্বামী সারাজীবন সত্যের অনুসন্ধানেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর নববৈয়ব আন্দোলন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আন্দোলনের মতোই মানবমনে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।

16. * হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
ভূমিকা: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.) ছিলেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক এবং উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের একজন অগ্রপথিক।
  1. প্রথম জীবন: ডিরোজিও ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এক অ্যাংলো- ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকালে ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমি-তে পড়াশোনা করেন। একটি ফিরিঙ্গি বা ইঙ্গ- পোর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ ভারতীয় বলেই মনে করতেন।
  2. অধ্যাপনা: ডিরোজিও হিন্দু কলেজে সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত (১৮২৬ খ্রি.) হন এবং ছাত্রদের মধ্যে শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রভাবে ছাত্ররা লক, হিউম, টম পেইন, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের মতবাদ ও ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি তাঁর ছাত্রদের বিনা বিচারে কিছু মেনে না নিতে পরামর্শ দেন।
  3. নব্যবঙ্গ আন্দোলন: ডিরোজিও-র নেতৃত্বে তাঁর অনুগামী একদল যুবক সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে এক উগ্রপন্থী আন্দোলনের সূচনা করেন। ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’ এবং তাঁদের উদ্যোগে পরিচালিত আন্দোলন ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন’ নামে ইতিহাসে পরিচিত।
  4. কার্যাবলি: ডিরোজিও ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে হিন্দুধর্মের অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহপ্রথা, মূর্তিপূজা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আলোচনা চলত। এর মুখপত্র ছিল ‘এথেনিয়াম’।
  5. হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়ন: ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’ হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে উগ্র প্রতিবাদ শুরু করলে আতঙ্কিত অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে থাকেন। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করে।

উপসংহার: স্বদেশপ্রেমী ডিরোজিও তাঁর নব্যবঙ্গ দলকে নিয়ে শুধু হিন্দুধর্মের সংস্কার নয়, গোটা ভারতেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সীমাহীন পরিশ্রমে ডিরোজিও-র শরীর ভেঙে পড়তে থাকে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সে এই মহান যুবকের মৃত্যু হয়।

17. *নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সমাজসংস্কার আন্দোলন ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – সমাজসংস্কারের বিষয়ে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর উদ্যোগ
ভূমিকা: উনিশ শতকে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক ডিরোজিও-র (১৮০৯-৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে তাঁর অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী যে সক্রিয় সমাজসংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলে তা ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন’ বা ‘ইয়ঃ বেঙ্গল মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত।
  1. অনুগামী ছাত্রদল: হিন্দু কলেজের ছাত্রদরদী জনপ্রিয় অধ্যাপক ডিরোজিও-র প্রভাবে তাঁর অনুগামী ছাত্ররা লক, হিউম, টম পেইন, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের মতবাদ এবং ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন। ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ডিরোজিও অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
  2. আন্দোলন: ডিরোজিও-র নেতৃত্বে তাঁর অনুগামী ছাত্রদল হিন্দুধর্মের অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদপ্রথা, সতীদাহপ্রথা, মূর্তিপূজা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়। তাঁরা নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতির পক্ষে প্রচার চালান।
  3. উগ্রতা: ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’র আন্দোলন শীঘ্রই উগ্র হয়ে ওঠে। তাঁরা নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করে, উপবীত ছিঁড়ে, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের দেখে ‘আমরা গোরুর মাংস খাই’ বলে চেঁচিয়ে, কালীঘাটের মন্দিরে মাকালীর উদ্দেশ্যে ‘গুড মর্নিং, ম্যাডাম’ বলে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
  4. পরিণাম: ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’র উগ্রতায় আতঙ্কিত অভিভাবকরা হিন্দু কলেজ থেকে তাঁদের সন্তানদের ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলে কলেজ কর্তৃপক্ষ এর জন্য ডিরোজিও-কে দায়ী করেন এবং তাঁকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করেন। এর কিছুদিন পরেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ডিরোজিও মারা যান।
  5. অনুগামীদের উদ্যোগ: ডিরোজিও-র মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামী ছাত্রদল সংস্কার আন্দোলনের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃয় মল্লিক, প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

উপসংহার: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই আন্দোলন দেশের সমাজ-সংস্কৃতির উপরেও স্থায়ী প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, তারা প্রগতিশীলতার নামে কেবল উগ্রতা ব্যক্ত করেছিল।

18. *বাংলার সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ডিরোজিও-র নেতৃত্বাধীন ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’ বা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর কার্যাবলির মূল্যায়ন করো।
উত্তর – ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’র কার্যাবলির মূল্যায়ন
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ডিরোজিও-র নেতৃত্বাধীন ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’র ভূমিকা সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। তাঁদের কার্যাবলির পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন পণ্ডিত নানা যুক্তি দেখিয়ে থাকেন। যেমন-
  1. বিপক্ষে: বিভিন্ন পণ্ডিত নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেছেন। যেমন – [i] এই আন্দোলন উগ্র ও নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজকে আক্রমণ করে। [ii] দেশের দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের নিয়ে নব্যবঙ্গরা বিশেষ কিছু ভাবেনি। [iii] শহরকেন্দ্রিক এই আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি। [iv] ডিরোজিও-র মৃত্যুর পর এই আন্দোলনে দ্রুত ভাটা পড়ে। এসব ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য কেউ কেউ তাঁদের উচ্ছৃঙ্খল, কালাপাহাড়, ‘ভ্রান্ত পুঁথিপড়া বুদ্ধিজীবী’ প্রভৃতি বলে সমালোচনা করেছেন।
  2. পক্ষে: নব্যবঙ্গ আন্দোলনের পক্ষে বলা হয় যে – [1] তৎকালীন বঙ্গীয় হিন্দুসমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য নব্যবঙ্গদের উগ্রতার প্রয়োজন ছিল। [ii] সমাজসংস্কারে নব্যবঙ্গদের নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক উদ্যোগ সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। [iii] ডিরোজিও- র অনুগামীরা পরবর্তীকালে নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে গিয়ে সংস্কারের ধারাকে সচল রেখেছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, নব্যবঙ্গরা ছিলেন ‘বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক, তাঁরা আমাদের জাতির পিতা, তাঁদের গুণাবলি চিরস্মরণীয়’।

উপসংহার: ডিরোজিও-র নেতৃত্বাধীন নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাই বলে তাদের ইতিবাচক দিকগুলোকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। একথা সত্য যে, তাদের মধ্যে আন্তরিকতা ও দেশাত্মবোধের কোনো অভাব ছিল না।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. * কে, কী উদ্দেশ্যে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন? এই সভার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সদস্যের নাম লেখো।
উত্তর – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কারমুক্ত ধর্ম আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
তত্ত্ববোধিনী সভার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ।
2. * সতীদাহপ্রথা কী ?
উত্তর – উনিশ শতকের গোড়াতেও ভারতীয় হিন্দুসমাজে প্রচলিত এক প্রথা অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর জ্বলন্ত চিতায় তাঁর বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হত। এই মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুর বর্বর প্রথা সতীদাহপ্রথা বা সহমরণ নামে পরিচিত।
3 *রামমোহন কী উপায়ে সতীদাহপ্রথার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন?
উত্তর – রামমোহন রায় লোকশিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তুলে সতীদাহপ্রথার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে একটি বাংলা পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
4. রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে কীরূপ প্রচার চালান?
উত্তর – রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উপায়ে প্রচার চালান। যেমন—[1] তিনি ‘মনুসংহিতা’সহ বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহপ্রথা হিন্দুধর্ম ও শাস্ত্রবিরোধী। [2] তিনি সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। [3] তিনি লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে বাংলার বিভিন্ন বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে সতীদাহপ্রথার বন্ধের অনুরোধ করেন।
5. * কে, কবে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন?
উত্তর – ভারতের বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক রামমোহন রায়ের সহায়তায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে (৪ ডিসেম্বর) ১৭নং রেগুলেশন আইন পাস করেন। এই আইনের দ্বারা সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ হয়।
6. * বিধবাবিবাহের সপক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কয়েকটিউদ্যোগ উল্লেখ করো।
উত্তর – বিধবাবিবাহের সপক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—[1] কয়েকটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। [2] এ সম্পর্কে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। [3] বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত করার উদ্দেশ্যে তিনি গণস্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন।
7. * কে, কবে বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন?
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সক্রিয় সহযোগিতায় ভারতের বড়োলাট লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (১৬ জুলাই) ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করে বিধবাবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন।
8. *কবে, কার উদ্যোগে প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়?
উত্তর – ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বর্ধমানের কালীমতী নামে জনৈক বিধবাকে বিবাহ করলে কলকাতায় প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়।
9. হাজি মহম্মদ মহসীন বিখ্যাত কেন?
উত্তর – হাজি মহম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২ খ্রি.) ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবক ও দানবীর। উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজে শিক্ষার প্রসার, জনকল্যাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের কারণে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।
10. হাজি মহম্মদ মহসীনের দানের অর্থে কী কী কাজ হয়?
উত্তর – হাজি মহম্মদ মহসীনের দানের অর্থে মাদ্রাসা-সহ নানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দান, চিকিৎসার উন্নতি ঘটানো, রাস্তাঘাট তৈরি, পুকুর খনন প্রভৃতি কাজ হয়।
11. * হুগলি মহসীন কলেজ কোথায় অবস্থিত? এটি কবে কার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – হুগলি মহসীন কলেজ হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় অবস্থিত।
হাজি মহম্মদ মহসীনের দান করা অর্থে এবং শিক্ষানুরাগী মেটকাফের উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে হুগলি মহসীন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
12. * হাজি মহম্মদ মহসীনের দানের অর্থে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – হাজি মহম্মদ মহসীনের দানের অর্থে হুগলি মহসীন কলেজ (১৮৩৬ খ্রি.), ইমামবাড়া হাসপাতাল (১৮৩৬ খ্রি.), হুগলির ইমামবাড়া (১৮৪১ খ্রি.), হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা-সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়।
13. *কবে, কার উদ্যোগে মহসীন শিক্ষা তহবিল গড়ে ওঠে?
উত্তর – ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ গভর্নর চার্লস মেটকাফের উদ্যোগে মহসীনের দান করা অর্থে মহসীন শিক্ষা তহবিল নামক একটি ফান্ড তৈরি হয়। এই ফান্ডের অর্থ দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
14. রাজা রামমোহন রায় কেন আত্মীয় সভা স্থাপন করেন?
উত্তর – রামমোহন রায় নিজের ধর্মভাবনা সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্যে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে কলকাতায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। নানা ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে এই সভায় আলোচনা হত।
15. *ব্রাহ্মসমাজের প্রধান কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর – ব্রাহ্ণসমাজের প্রধান কয়েকজন নেতা ছিলেন রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয়কৃয় গোস্বামী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ ।
16 *ব্রাহ্ণসমাজের যে-কোনো দুটি সমাজ সংস্কারমূলক কাজের উল্লেখ করো।
উত্তর – ব্রাহ্মসমাজের উল্লেখযোগ্য দুটি সমাজ সংস্কারমূলক কাজ হল—[1] বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার জন্য ‘তিন আইন’ প্রণয়নে সরকারকে বাধ্য করা, [2] শিক্ষার প্রসার, নারী স্বাধীনতা প্রভৃতির পক্ষে জনম গড়ে তোলা।
17. * কে, কবে ব্রাত্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্নসভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩0, খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভার নাম হয় ‘ব্রাহ্মসমাজ’।
18. *রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ কোন্ কোন্ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা পৌত্তলিকতার অবসান, সর্বধর্মসমন্বয়সাধন, মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা প্রভৃষ্টি বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে।
19. * দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাত্মসমাজ কীরূপ আন্দোলন গড়ে তোলে?
উত্তর – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাষ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষ নারীস্বাধীনতা, শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতির সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলে। একেশ্বরবাদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা ব্রাম্মদের মূল আদর্শ বলে ঘোষিত হয়।
20. * কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্রাত্মসমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংগঠনের নাম লেখো।
উত্তর – কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংগঠন হল সমাজোন্নয়ন বিধায়নী সুহৃদ সমিতি (১৮৫৪ খ্রি.), ব্রাহ্মবন্ধুসভা (১৮৬০ খ্রি.), সঙ্গতসভা (১৮৬০ খ্রি.), ক্যালকাটা কলেজ (১৮৬২ খ্রি.) প্রভৃতি।
21.*কেশবচন্দ্র সেন কে ছিলেন? অথবা, ব্রাত্ম আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর – কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাত্ম আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ব্রহ্মানন্দ উপাধি দেন (১৮৬২ খ্রি.) এবং ব্রাহ্মসমাজের আচার্য পদে নিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে তাঁর নেতৃত্বে তাঁর অনুগামীরা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (১৮৬৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
22. * কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল ব্রাত্মবন্ধুসভা (১৮৬০ খ্রি.), সঙ্গতসভা (১৮৬০ খ্রি.), ক্যালকাটা কলেজ (১৮৬২ খ্রি.) প্রভৃতি।
23. * কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ণসমাজের কয়েকটি আন্দোলন উল্লেখ করো।
উত্তর – কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে সামাজিক অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদপ্রথা, পর্দাপ্রথা, মদ্যপান প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা প্রভৃতির সপক্ষে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

একটি বাক্যে উত্তর দাও

1. ব্রাহ্মসমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রামমোহন রায়।
2. আদি ব্রাহ্মসমাজে কে নেতৃত্ব দেন?
উত্তর – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আদি ব্রাহ্বসমাজে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
3. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবে ব্রাত্মধর্মে দীক্ষিত হন?
উত্তর – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন।
4. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কাকে ‘ব্রষ্মানন্দ’ উপাধি দেন?
উত্তর – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশবচন্দ্র সেনকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দিয়েছিলেন (১৮৬২ খ্রি.)।
5. নববিধান ব্রাহ্মসমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
উত্তর – কেশবচন্দ্র সেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
6. তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার নাম কী ছিল ?
উত্তর – তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার নাম ছিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা।
7. অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্রের নাম কী ছিল?
উত্তর – অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্রের নাম ছিল এথেনিয়াম।
৪. বিধবাবিবাহের সপক্ষে সর্বপ্রথম কে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন?
উত্তর – বিধবাবিবাহের সপক্ষে সর্বপ্রথম জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
9. বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পর প্রথম কোন বিধবার বিবাহ হয়?
উত্তর – বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পর প্রথম বিধবা হিসেবে বিবাহ হয় কালীমতীর।
10. উনিশ শতকে বাংলায় কারা সমাজসংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন?
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, ব্রাহ্মসমাজ, ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজসংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
11. কে, কবে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – ব্রায়নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
12. রক্ষণশীল হিন্দুরা কোন্ পুস্তিকার মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা সম্পর্কে রামমোহনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন ?
উত্তর – রক্ষণশীল হিন্দুরা ‘বিধায়ক’ নামে একটি পুস্তিকার প্রকাশ করে সতীদাহপ্রথা সম্পর্কে রামমোহনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন।
13. নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর উদ্যোগে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার নাম লেখো।
উত্তর – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর উদ্যোগে প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার নাম হল—‘এথেনিয়াম’, ‘পার্থেনন’, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ প্রভৃতি।
14. বিধবাবিবাহের সমর্থনে বিদ্যাসাগরের লেখা একটি পুস্তিকার নাম লেখো।
উত্তর – বিধবাবিবাহের সমর্থনে বিদ্যাসাগরের লেখা একটি পুস্তিকা হল— ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’।
15. কার উদ্যোগে, কবে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ?
উত্তর – ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
16. কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রপত্রিকার নাম লেখো।
উত্তর – কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকাগুলি হল—‘সুলভ সমাচার’ (১৮৭০ খ্রি.), ‘ভারত শ্রমজীবী’ (১৮৭৮ খ্রি.), ‘মদ না গরল’ প্রভৃতি।
17. ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ কবে গঠিত হয়?
উত্তর – ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয়।
18. বিজয়কৃয় গোস্বামী ব্রাত্মসমাজের কোন শাখা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন?
উত্তর – বিজয়কৃয় গোস্বামী ব্রাত্নসমাজের একটি শাখা, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ (১৮৭৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
19. বাংলায় নব্যবৈষুব আন্দোলনের সূচনা করেন কে?
উত্তর – বিজয়কৃয় গোস্বামী বাংলায় নব্যবৈয়ব আন্দোলনের সূচনা করেন।
20. বিজয়কৃয় গোস্বামী কোথায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে নব্যবৈয়ব ধর্মসাধনা শুরু করেন ?
উত্তর – বিজয়কৃয় গোস্বামী ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে নব্যবৈয়ব ধর্মসাধনা শুরু করেন।

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. ……… নামে একটি পুস্তিকার দ্বারা সতীদাহপ্রথার পক্ষে প্রচার চালানো হয়।
উত্তর – বিধায়ক
2. ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ ও চিন্তাধারা প্রচারিত হত ……… পত্রিকার মাধ্যমে।
উত্তর – তত্ত্ববোধিনী
3. অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন ………।
উত্তর – ডিরোজিও
4. হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষ ………. -কে কলেজ থেকে বিতাড়িত করেন।
উত্তর – ডিরোজিও
5. বিধবাবিবাহ আইনে স্বাক্ষর করেন ………..।
উত্তর – লর্ড ক্যানিং
6. বিদ্যাসাগর ‘অতি অল্প হইল’ এবং ‘আবার অতি অল্প হইল’ নামে দুটি পুস্তিকা ……… সমর্থনে প্রকাশ করেন।
উত্তর – বিধবাবিবাহের
7. ……….. নিজেকে নিঃস্ব করে যাবতীয় সম্পত্তি মূলত মুসলিমদের সেবায় দান (১৮০৬ খ্রি.) করেন।
উত্তর – হাজি মহম্মদ মহসীন
8. ………. শান্তিপুর, ময়মনসিংহ, গয়া প্রভৃতি স্থানে ব্রাহ্ণমন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
উত্তর – বিজয়কৃষ গোস্বামী
9. বিজয়কৃয় গোস্বামী ………. -এর উৎসাহে ব্রাহ্ণসমাজে যোগ দেন।
উত্তর – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
10. ………. বলতেন, “সকল ধর্মই সত্য। সব ধর্মের লোকেরা একই ঈশ্বরকে ডাকছে। কেউ বলছে ঈশ্বর, কেউ রাম, কেউ হরি, কেউ আল্লা, কেউ ব্রয়।”
উত্তর – শ্রীরামকৃয়

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. দেবেন্দ্রনাথের ব্রায় আদর্শের মূলভিত্তি ছিল—
(a) পুরাণ
(b) বেদ
(c) রামায়ণ
(d) মহাভারত
উত্তর – (b) বেদ
2. সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে প্রথম জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন—
(a) রাধাকান্ত দেব
(b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) রামমোহন রায়
(d) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
উত্তর – (c) রামমোহন রায়
3. সতীদাহপ্রথা রদ হয়—
(a) ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে
4. যে আইনের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা রদ করা হয় সেটি হল—
(a) তিন আইন
(b) পঞ্চদশ আইন
(c) সপ্তদশ আইন
(d) অষ্টাদশ আইন
উত্তর – (c) সপ্তদশ আইন
5. ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করেন—
(a) লর্ড ক্যানিং
(b) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(c) লর্ড ডালহৌসি
(d) রাজা রামমোহন রায়
উত্তর – (c) লর্ড ডালহৌসি
6. বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়—
(a) ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে
7. প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়—
(a) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর
(b) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর
(c) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর
(d) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর
উত্তর – (b) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর
৪. অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রতিষ্ঠা হয়—
(a) ১৮২৫ খ্রি.
(b) ১৮২৬ খ্রি.
(c) ১৮২৭ খ্রি.
(d) ১৮২৮ খ্রি.
উত্তর – (d) ১৮২৮ খ্রি.
9. মহসীন শিক্ষা তহবিল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন—
(a) হাজি মহম্মদ মহসীন
(b) লর্ড বেন্টিঙ্ক
(c) লর্ড ক্যানিং
(d) চার্লস মেটকাফ
উত্তর – (d) চার্লস মেটকাফ
10. কার দানের অর্থে হুগলির ইমামবাড়া হাসপাতাল নির্মিত হয়?
(a) রামমোহন রায়ের
(b) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের
(c) হাজি মহম্মদ মহসীনের
(d) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
উত্তর – (c) হাজি মহম্মদ মহসীনের
11. ভারতবর্ষীয় ব্রায়সমাজ গঠন করেন—
(a) রাজা রামমোহন রায়
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) শিবনাথ শাস্ত্রী
উত্তর – (b) কেশবচন্দ্র সেন
12. ‘নববিধান’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—
(a) দয়ানন্দ সরস্বতী
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) স্বামী বিবেকানন্দ
(d) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (b) কেশবচন্দ্র সেন
13. ব্রহ্মানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন—
(a) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) রাধাকান্ত দেব
(c) কেশবচন্দ্র সেন
(d) শিবনাথ শাস্ত্রী
উত্তর – (c) কেশবচন্দ্র সেন
14. কেশবচন্দ্র সেনকে ‘ব্ৰহ্বানন্দ’ উপাধি দেন—
(a) রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ
(b) শিবনাথ শাস্ত্রী
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রামমোহন রায়
উত্তর – (c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
15. সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হলেন—
(a) রাজা রামমোহন রায়।
(b) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) শিবনাথ শাস্ত্রী
(d) কেশবচন্দ্র সেন
উত্তর – (c) শিবনাথ শাস্ত্রী
16. ‘ব্রাষ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ নামক গ্রন্থটি লেখেন—
(a) রামতনু লাহিড়ি
(b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) রামমোহন রায়
(d) কেশবচন্দ্র সেন
উত্তর – (b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
17. কে সন্ন্যাস গ্রহণের পর অচ্যুতানন্দ সরস্বতী নাম গ্রহণ করেন?
(a) শ্রীরামকৃয়
(b) স্বামী বিবেকানন্দ
(c) কেশবচন্দ্র সেন
(d) বিজয়কৃয় গোস্বামী
উত্তর – (d) বিজয়কৃয় গোস্বামী
18. বিজয়কৃয় গোস্বামী দেহত্যাগ করেন—
(a) ঢাকায়
(b) শান্তিপুরে
(c) পুরীতে
(d) গয়ায়
উত্তর – (c) পুরীতে
19. সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করেন-
(a) শিবনাথ শাস্ত্রী
(b) স্বামী বিবেকানন্দ
(c) শ্রীরামকৃষ্ণ
(d) রাজা রামমোহন রায়
উত্তর – (c) শ্রীরামকৃষ্ণ
20. ‘যত মত, তত পথ’-এর আদর্শ প্রচার করেন-
(a) স্বামী বিবেকানন্দ
(b) শ্রীরামকৃষ
(c) বিজয়কৃয় গোস্বামী
(d) লালন ফকির
উত্তর – (b) শ্রীরামকৃষ
21. “সব মতকে এক-একটি পথ বলে জানবে। আমার ঠিক পথ, আর সকলের মিথ্যা–এরূপ বোধ না হয়। বিদ্বেষভাব না হয়।”—এটি কার উক্তি?
(a) শ্রীরামকৃষ্ণের
(b) স্বামী বিবেকানন্দের
(c) লালন ফকিরের
(d) বিজয়কৃয় গোস্বামীর
উত্তর – (a) শ্রীরামকৃষ্ণের
22. ‘নব্য বেদান্তবাদ’ প্রচার করেন-
(a) বিজয়কৃয় গোস্বামী
(b) ত্রৈলঙ্গস্বামী
(c) শ্রীরামকৃষ্ণ
(d) স্বামী বিবেকানন্দ
উত্তর – (d) স্বামী বিবেকানন্দ
23. ‘জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা’-র কথা বলেছেন-
(a) বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
(b) লালন ফকির
(c) শ্রীরামকৃষ
(d) স্বামী বিবেকানন্দ
উত্তর – (c) শ্রীরামকৃষ
24. রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মুখপত্র ছিল—
(a) বেঙ্গলি পত্রিকা
(b) সঞ্জীবনী পত্রিকা
(c) উদ্বোধন পত্রিকা
(d) অমৃতবাজার পত্রিকা
উত্তর – (c) উদ্বোধন পত্রিকা
25. ‘স্ত্রী শিক্ষা বিধায়ক’ গ্রন্থটি রচনা করেন—
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) রামমোহন রায়
(d) গৌরমোহন বিদ্যালংকার
উত্তর – (d) গৌরমোহন বিদ্যালংকার

TOPIC – D বাংলার নবজাগরণ

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *উনিশ শতকে ‘বাংলার নবজাগরণ’ বলতে কী বোঝ ? এই নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – উনিশ শতকে ‘বাংলার নবজাগরণ’
ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা দেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটলে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ে। এর প্রভাবে বাঙালির ভাবজগতে এক বৌদ্ধিক আন্দোলন শুরু হয়।
  1. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ধনী ব্যবসায়ী, নব্য জমিদারশ্রেণি প্রমুখ পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এলে তাঁরা পাশ্চাত্যের আধুনিক সাহিত্য, দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উদারবাদ প্রভৃতির দ্বারা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন।
  2. নবজাগরণের উন্মেষ: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা, ধর্মীয় উদারতা, সমাজসংস্কার, আধুনিক সাহিত্যের বিকাশ প্রভৃতি শুরু হয়। ফলে ঊনবিংশ শতকে বাংলার সমাজ- সংস্কৃতিতেও ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। এই অগ্রগতিকে কেউ কেউ উনিশ শতকে বাংলার ‘নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
  3. নবজাগরণের প্রসার: উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতি বা নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতা থেকে এই অগ্রগতির ধারা পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। রাজা রামমোহন রায়ের সময়কে এই জাগরণের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি
পঞ্চদশ শতকে সংঘটিত ইউরোপের নবজাগরণের সঙ্গে অনেকে উনিশ শতকে সংঘটিত বাংলার নবজাগরণের তুলনা করেছেন। এর ফলে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন—
  1. সীমিত পরিসর: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ব্যাপ্তি বা পরিসর ছিল খুবই সীমিত। তা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক। কলকাতার বাইরে গ্রামবাংলায় এই নবজাগরণের প্রসার ঘটেনি এবং গ্রামবাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই নবজাগরণের কোনো সুফল পায়নি।
  2. মধ্যবিত্ত সমাজে সীমাবদ্ধ: বাংলার জাগরণ শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই সমাজের লোকেদের ‘মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক’ বলে অভিহিত করেছেন। এজন্য অধ্যাপক অনিল শীল এই জাগরণকে এলিটিস্ট আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। বাংলার এই জাগরণের সঙ্গে গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার দরিদ্র মেহনতি মানুষের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও মনে করেন যে, ঔপনিবেশিক শাসনের জ্ঞানদীপ্তি শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওপরই প্রতিফলিত হয়েছিল। সাধারণ জনগণের মধ্যে এর বিশেষ প্রভাব পড়েনি।
  3. ব্রিটিশ নির্ভরতা: বাংলার এই জাগরণ অতিমাত্রায় ব্রিটিশ-নির্ভর হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনের দ্বারাই ভারতীয় সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন, ‘ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড়ো উপহার হল আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ। তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠাকে এজন্য ‘গৌরবময় ভোর’ বলে অভিহিত করেছেন।
  4. হিন্দু জাগরণবাদ: বাংলার নবজাগরণ প্রকৃতপক্ষে ‘হিন্দু জাগরণবাদে পর্যবসিত হয়। রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের কার্যকলাপে হিন্দু জাগরণবাদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। আবার, রামমোহন ও বিদ্যাসাগরও হিন্দুশাস্ত্রকে ভিত্তি করেই সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন। তাই অনেকে মনে করেন, উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *উনিশ শতকে বাংলায় ‘নবজাগরণ’ ধারণার ব্যবহার-বিষয়ক বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – বাংলায় ‘নবজাগরণ’ ধারণার ব্যবহার -বিষয়ক বিতর্ক
ভূমিকা: পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি লক্ষ করা যায় তাকে কেউ কেউ ‘নবজাগরণ” বলে অভিহিত করেছেন। তবে এই অগ্রগতিকে প্রকৃত অর্থে ‘নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করা যায় কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
  1. ‘নবজাগরণ’ অভিধার পক্ষে: ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার প্রমুখ উনিশ শতকের অগ্রগতিকে ‘নবজাগরণ’ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। [i] স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে দ্বিধাহীনভাবে ‘নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, “ইংরেজদের দেওয়া সব থেকে বড়ো উপহার আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ। এটি যথার্থই একটি নবজাগৃতি। কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা দেয়, উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার চেয়ে অধিক ব্যাপক ও বৈপ্লবিক।” [ii] অধ্যাপক সুশোভন সরকার মনে করেন যে, পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের নবজাগরণে ইটালির যেরূপ ভূমিকা ছিল ঊনবিংশ শতকে ভারতের নবজাগরণে বাংলার অনুরূপ ভূমিকা ছিল।
  2. ‘নবজাগরণ’ অভিধার বিপক্ষে: অশোক মিত্র, বিনয় ঘোষ, সুপ্রকাশ রায়, ড. বরুণ দে, ড. সুমিত সরকার প্রমুখ উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে ‘নবজাগরণ’ বলে স্বীকার করেন না। [i] সেন্সাস কমিশনার অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের সেন্সাস রিপোর্টে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা, এই জাগরণ ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং এটি সীমাবদ্ধ ছিল পরজীবী ভূস্বামীশ্রেণির মধ্যে। [ii] বিনয় ঘোষ মনে করেন যে, উনিশ শতকে বাংলার জাগরণ ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক প্রবঞ্চনা’। [iii] সুপ্রকাশ রায় মনে করেন যে, “বাংলার জাগরণ আন্দোলন ইউরোপীয় নবজাগরণ আন্দোলনের বিপরীতধর্মী।”

উপসংহার: ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার মনে করেন যে, উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ মধ্যযুগের ‘অন্ধকারের’ অবসান ঘটিয়ে ইংরেজ শাসিত ভারতীয় সমাজ এক ‘আলোর রাজ্যে’ যাত্রা শুরু করেছিল।

2. * উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের প্রধান ধারাগুলি কী ছিল ?
বাংলার নবজাগরণের প্রধান ধারাসমূহ
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। এর প্রভাবে এই শতকে বাংলায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এই অগ্রগতি সাধারণভাবে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ’ নামে পরিচিত। এই নবজাগরণের প্রধান ধারাগুলি হল নিম্নরূপ-
  1. প্রাচ্য-পুনরুজ্জীবনবাদী ধারা: উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের একটি অন্যতম ধারা হল বাংলার সুপ্রাচীন ও গৌরবময় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার। এই প্রাচ্য-পুনরুজ্জীবনবাদী ধারার জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সনাতনপন্থী প্রগতিশীল মানসিকতার ব্যক্তিরা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, হরিশচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল প্রাচ্যের সুপ্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্যের যথার্থ পুনরুজ্জীবন ঘটানো।
  2. পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ধারা: কেউ কেউ প্রাচ্যের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির উন্নতি ঘটানোর পরিকল্পনা করেন। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ধারার মুখপাত্র ছিল ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’। তাঁদের লক্ষ্য ছিল প্রাচ্যের পশ্চাদপদ সভ্যতা- সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করা।
  3. সমন্বয়বাদী ধারা: উক্ত দুটি ধারার মধ্যবর্তী স্তরে একটি সমন্বয়বাদী ধারারও উদ্ভব ঘটেছিল। তৃতীয় এই ধারার নেতৃত্বে ছিলেন রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর প্রমুখ। তাঁরা প্রাচ্যের মহৎ বিষয়গুলির সঙ্গে পাশ্চাত্যের মহৎ বিষয়গুলির সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে চেয়েছিলেন।

উপসংহার: উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগরণের স্রোত যে ধারাতেই প্রবাহিত হোক না কেন, তাতে যে অতিমাত্রায় ব্রিটিশ-নির্ভরতা ছিল সেকথা বলাই বাহুল্য।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের সঙ্গে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের দুটি পার্থক্য উল্লেখ করো।
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের প্রধান ধারাগুলি ছিল –[1] প্ৰাচ্য- পুনরুজ্জীবনবাদী ধারা, [2] পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ধারা, [3] সমন্বয় ধারা।
2. *উনিশ শতকে বাংলার ‘নবজাগরণ’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর – উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা দেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটলে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। এর প্রভাবে বাঙালির ভাবজগতে এক ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে বা বৌদ্ধিক আন্দোলন শুরু হয়। এই অগ্রগতি উনিশ শতকে বাংলার ‘নবজাগরণ’ নামে পরিচিত।
3. * উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অবদানগুলি কী ছিল ?
উত্তর –  উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অবদানগুলি হল সতীদাহপ্রথার অবসান, বিধবাবিবাহের প্রচলন, ধর্মীয় উদারতা, পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি, বিভিন্ন সভাসমিতি প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশ প্রভৃতি।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

একটি বাক্যে উত্তর দাও

1. পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের নবজাগরণ প্রথম কোথায় শুরু হয়েছিল ?
উত্তর – পঞ্চদশ শতকে ইটালির ফ্লোরেন্স শহরে প্রথম নবজাগরণ শুরু হয়।
2. বাংলার কোন্ শতককে নবজাগরণের শতক বলা হয় ?
উত্তর – উনিশ শতককে বাংলার নবজাগরণের শতক বলা হয়।
3. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে কাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল?
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
4. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের প্রাচ্য পুনরুজ্জীবনবাদী ধারায় কারা নেতৃত্বে ছিলেন?
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের প্রাচ্য পুনরুজ্জীবনবাদী ধারায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
5. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের সমন্বয়বাদী ধারায় নেতৃত্বে ছিলেন কারা?
উত্তর – উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের সমন্বয়বাদী ধারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ।
6. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে কারা ‘নবজাগরণ’ বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ?
উত্তর – স্যার যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার প্রমুখ উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ‘নবজাগরণ’ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
7. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে কারা ‘নবজাগরণ’ বলে স্বীকার করেননি?
উত্তর – অশোক মিত্র, বিনয় ঘোষ, সুপ্রকাশ রায়, ড. বরুণ দে, ড. সুমিত সরকার প্রমুখ উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ‘নবজাগরণ’ বলে স্বীকার করেননি।

ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো

1. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ঘটার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা।
উত্তর – ঠিক
2. অশোক মিত্র উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩ খ্রি.) ফল বলে উল্লেখ করেছেন।
উত্তর – ভুল

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. ………… মনে করেন যে, উনিশ শতকে বাংলার জাগরণ ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক প্রবঞ্চনা।
উত্তর – বিনয় ঘোষ
2. ………. তাঁর ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার বৌদ্ধিক আন্দোলনকে নবজাগরণ বলেছেন।
উত্তর – যদুনাথ সরকার
3. ‘Notes on Bengal Renaissance’ গ্রন্থটি রচনা করেন ………..।
উত্তর – সুশোভন সরকার

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন—
(a) বিপিনচন্দ্ৰ
(b) অনিতা শীল
(c) জওহরলাল নেহরু
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (b) অনিতা শীল
2. উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাংলার প্রগতিশীল সমাজকে বলা হত-
(a) উচ্চবিত্ত বাঙালি
(b) মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক
(c) নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক
(d) নিম্নবিত্ত ভদ্রলোক
উত্তর – (b) মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক
3. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ প্রথম শুরু হয়েছিল—
(a) ঢাকায়
(b) ফরিদপুরে
(c) কলকাতায়
(d) মুরশিদাবাদে
উত্তর – (c) কলকাতায়
4. কে বলেছেন যে, “বাংলার জাগরণ আন্দোলন ইউরোপীয় নবজাগরণ আন্দোলনের বিপরীতধর্মী?”
(a) যদুনাথ সরকার
(b) সুপ্রকাশ রায়
(c) অমলেশ ত্রিপাঠী
(d) বিনয় ঘোষ
উত্তর – (b) সুপ্রকাশ রায়
5. উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল—
(a) ফরিদপুর
(b) কলকাতা
(c) মুরশিদাবাদ
(d) ঢাকা
উত্তর – (b) কলকাতা
6. উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতির প্রাণকেন্দ্র ছিল-
(a) কলকাতা
(b) হুগলি
(c) শ্রীরামপুর
(d) চন্দননগর
উত্তর – (a) কলকাতা

TOPIC – E বিবিধ

অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর

1. ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমদিকে বাংলা তথা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় কী পদক্ষেপ নিয়েছিল ?
উত্তর – ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা তথা ভারতে মধ্যযুগীয় ধাঁচের দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ভারতের মধ্যে বাংলায় প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে।
  1. পশ্চাদপদ শিক্ষাব্যবস্থা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা তথা ভারতে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা ছিল খুবই পশ্চাদপদ। হিন্দুদের টোল ও পাঠশালা এবং মুসলিমদের মক্তব ও মাদ্রাসা ছিল প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। এগুলিতে মূলত ধর্মীয় কাহিনি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষা ও সাধারণ কিছু বিষয়ের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হত।
    ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় কোম্পানির প্রাথমিক পদক্ষেপ
  2. কোম্পানির উদাসীনতা: কোম্পানি ভারতের শাসনক্ষমতা পেয়ে প্রথমদিকে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কারণ— [i] কোম্পানি মনে করত ভারতীয়দের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ব্রিটিশদের অর্থব্যয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। [ii] ভারতীয়দের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করলে তারা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারে। [iii] ভারতীয়রা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা পেলে ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জেগে উঠবে।
  3. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: পরবর্তীকালে ভারতে প্রচলিত মুসলিম আইন, সংস্কৃত-আরবি-ফারসি ভাষা প্রভৃতি চর্চার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বড়োলাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রি.), স্যার উইলিয়াম জোন্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.), জোনাথান ডানকান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বারাণসী সংস্কৃত কলেজ (১৭৯২ খ্রি.), লর্ড ওয়েলেসলি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.) প্রভৃতি।
2. রাজা রাধাকান্ত দেব সম্পর্কে কী জান ?
উত্তর – রাজা রাধাকান্ত দেব
ভূমিকা: রাজা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭ খ্রি.) ছিলেন বাংলার নবজাগরণের যুগের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। কারণ, তিনি একদিকে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন, অন্যদিকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন।
  1. প্রথম জীবন: রাজা রাধাকান্ত দেব অল্প বয়সেই সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি প্রথম জীবনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশি ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস ও ওয়েলেসলির অধীনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে তিনি ‘মহারাজ’ উপাধি লাভ করেন।
  2. শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা: বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রাধাকান্ত দেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় (১৮১৭ খ্রি.) তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি নারীশিক্ষার প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
  3. রক্ষণশীল সমাজের নেতৃত্ব: রাধাকান্ত দেব ছিলেন উনিশ শতকে কলকাতায় রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের অন্যতম নেতা। তিনি ‘গৌড়ীয় সমাজ’ (১৮২৩ খ্রি.)-এর কর্মসমিতির সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন।
  4. সংস্কারের বিরোধিতা: রামমোহন রায়ের ধর্মসংস্কার শুরু হলে রাধাকান্ত দেব তার বিরুদ্ধে প্রচার চালান। তিনি সতীদাহপ্রথা সম্পর্কে রামমোহন রায়ের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। তিনি ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর চিন্তাধারা এবং বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ বিষয়ক আন্দোলনেরও বিরোধিতা করেন।
  5. লেখকসত্তা : রাধাকান্ত দেব ‘সম্বাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা তাঁর ‘শব্দকল্পদ্রুম’ (১৮১৫ খ্রি.) একটি উল্লেখযোগ্য অভিধান গ্রন্থ। এ ছাড়া তিনি ‘বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২১ খ্রি.) ও ‘সংক্ষিপ্ত বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২৭ খ্রি.) নামে আরও দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
  6. সম্মান প্রাপ্তি: রাধাকান্ত দেব রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি-সহ কয়েকটি ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানিত হন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি দেন।

উপসংহার: দীর্ঘদিন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতির পদে সম্মানিত হওয়ার পর তিনি ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

The Complete Educational Website

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *