WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 3 প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 3 প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 3 প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
West Bengal Board 10th History Solutions
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি
- ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে এদেশের অরণ্য-সম্পদের ওপর নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন’ এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অরণ্য আইন পাস করে।
- বহু আদিবাসী সম্প্রদায় অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত। ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে অরণ্যের ওপর তাদের চিরাচরিত অধিকার কেড়ে নিলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
- বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব—এই তিনটি শব্দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। [i] প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে জনসমষ্টির আন্দোলন হল বিদ্রোহ। [ii] প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসমষ্টির একাংশের সংগ্রাম হল অভ্যুত্থান। [iii] প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন হল বিপ্লব।
- ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর জেলার কাজিরহাট, কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা বিদ্রোহ করে। এটি রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত। বিদ্রোহীরা নুরুলউদ্দিনকে নেতা ও দয়ারাম শীলকে সহকারী নেতা নির্বাচিত করে ‘স্থানীয় স্বাধীন সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাপতি ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়।
- মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী চুয়াড় সম্প্রদায় ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চুয়াড় বিদ্রোহ এবং ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ করে। প্রথম বিদ্রোহের ঘোষণা করেন ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ এবং দ্বিতীয় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিংহ ও মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি।
- ব্রিটিশ কোম্পানি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার হাতে নেয়। এরপর থেকে সেখানকার কোল উপজাতির ওপর ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সহযোগী জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের চরম শোষণ ও অত্যাচার শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে কোলরা ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন বুন্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সিংরাই, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা প্রমুখ।
- সাঁওতালদের বসতি অঞ্চল ‘দামিন-ই-কোহ’ শব্দের অর্থ হল ‘পাহাড়ের প্রান্তবর্তী দেশ’। ইংরেজ শাসক ও তাদের সহযোগী জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতালরা ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে। এটি ‘সাঁওতাল হুল’ বা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। সিধু ও কানু নামে দুই ভাই এই বিদ্রোহে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন। এই বিদ্রোহের অন্যান্য নেতারা ছিলেন চাঁদ, ভৈরব, বীরসিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ ৷
- ছোটোনাগপুরের আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় ইংরেজ ও তাদের সহযোগী জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহ শুরু করে যা ‘উলঘুলান’ নামে পরিচিত। ‘উলঘুলান’ শব্দের অর্থ হল ‘ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা’ বা ‘প্রবল বিক্ষোভ’। মুন্ডা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন বিরসা মুন্ডা।
- বর্তমান গুজরাট, মহারাষ্ট্রের খান্দেশ-সহ পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ভিল উপজাতির কৃষকরা উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশদের নতুন ভূমিব্যবস্থার ফলে চরম শোষণ, অত্যাচার ও দুর্দশার শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে ভিলরা বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন সেওয়ারাম।
- ফরিদপুর জেলার হাজি শরিয়ত উল্লাহ ‘ফরাজি’ নামে এক ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম ধর্মের সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এই আন্দোলন ক্রমে রাজনৈতিক দিকে মোড় নেয়। তিনি দরিদ্র জনগণকে নিয়ে অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। শরিয়ত উল্লাহ-র মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা এবং দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
- ময়মনসিংহ জেলার ফকির করিম শাহ এক নতুন ধর্ম প্রচার করে ‘পাগলপন্থী’ নামে অনুগামী গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ বা টিপু পাগলের নেতৃত্বে পাগলপন্থী গারো জনগণ জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে শামিল হয়। টিপু নিজেকে ‘স্বাধীন সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ প্রথম পর্বে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।
- আরবের ধর্মসংস্কারক আবদুল ওয়াহাবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২৪ পরগনা জেলার তিতুমির বাংলার দরিদ্র ও নির্যাতিত মুসলিমদের নিয়ে অত্যাচারী জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে ‘ওয়াহাবি এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিতুমিরের ধর্মীয় সংস্কার- প্রচেষ্টা ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ নামে পরিচিত। ২৪ পরগনা, নদীয়া,যশোহর, মালদহ, রাজশাহী, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে তিতুমির নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। কিন্তু ব্রিটিশ কামান এই কেল্লা গুঁড়িয়ে দেয়। তিতুমির যুদ্ধে প্রাণ দেন।
- নীলকর সাহেবদের চরম শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন জেলার চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে। নদীয়া, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, মুরশিদাবাদ, রাজশাহী, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় এই বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন দিগম্বর বিশ্বাস, বিচরণ বিশ্বাস, মেঘাই সর্দার, মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাদের মোল্লা, রফিক মণ্ডল, বৈদ্যনাথ সর্দার, বিশ্বনাথ সর্দার প্রমুখ।
- নীল বিদ্রোহের পরবর্তীকালে পাবনা জেলার কৃষকরা জমিদারদের দ্বারা নানাভাবে অত্যাচারিত হতে শুরু করে। ফলে তারা বিদ্রোহ শুরু করে। কৃষকরা ‘দ্য পাবনা রায়ত লিগ’ গঠন করে জমিদারকে বেআইনি খাজনা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সমগ্র পাবনা জেলায় এবং এর বাইরে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহী প্রভৃতি জেলাতেও বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ঈশানচন্দ্র রায়, শম্ভুনাথ পাল প্রমুখ।
TOPIC – A আদিবাসী বিদ্রোহ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- বিদ্রোহ
- বিদ্রোহ কী?: বিদ্রোহ বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনসমষ্টির আন্দোলন। বিদ্রোহ স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন সম্ভব।
- উদাহরণ : ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে রংপুর বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহ এবং সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি হল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বিদ্রোহের গতি অনেক সময় থেমে যায়। যেমন, রংপুর বিদ্রোহের মতো ঘটনায় আগে প্রচলিত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আবার নীল বিদ্রোহের পর সরকার নীল কমিশন নিয়োগ করে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার লাঘবের ব্যবস্থা করে।
- অভ্যুত্থান
- অভ্যুত্থান কী?: অভ্যুত্থান বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম। অভ্যুত্থান দীর্ঘমেয়াদী হয় না। অভ্যুত্থান সাধারণত খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। অভ্যুত্থানে বিরোধী গোষ্ঠীর ভূমিকা থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। তবে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি ‘অভ্যুত্থান’-এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- উদাহরণ : [a] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একাংশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ সংঘটিত করে। [b] ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নৌসেনাদের নৌবিদ্রোহ সম্পন্ন হয়। [c] স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপতি মহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। এগুলি অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে এগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
- বিৰ
- ‘বিপ্লব’ কী?: ‘বিপ্লব’ বলতে বোঝায় প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন। “বিপ্লব’ হল ‘বিদ্রোহ’ এবং ‘অভ্যুত্থান’এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক।
- উদাহরণ : [a] অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের দ্বারা ইউরোপের শিল্পব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। [b] ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সের পূর্বতন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন ঘটে। বিদ্রোহকে আবার বিপ্লবের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়।
উপসংহার: ‘বিদ্রোহ’, ‘অভ্যুত্থান’ ও ‘বিপ্লব’—এই তিনটি বিষয়কে অনেক সময়ই সুস্পষ্টভাবে পৃথক করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, একই গণবিক্ষোভ বা আন্দোলনকে কেউ কেউ ‘অভ্যুত্থান’ আবার কেউ কেউ ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে– [1] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে কেউ কেউ ‘বিদ্রোহ’, ‘আবার কেউ কেউ ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। [2] ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেউ কেউ ‘গণবিদ্রোহ’ আবার কেউ কেউ ‘গণ অভ্যুত্থান’ বলে বর্ণনা করে থাকেন।
- দুটি পর্ব : চুয়াড় বিদ্রোেহ অন্তত তিন দশক ধরে চলে। এই বিদ্রোহ দুটি পর্বে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
- প্রথম পর্ব : প্রথম পর্বের বিদ্রোহ ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দেশুরু হয়।
- দ্বিতীয় পর্ব : দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে!
- প্রথম পর্বের বিদ্রোহের কারণ : প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল—
- জীবিকা সমস্যা : ব্রিটিশ কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ জমিজমা কেড়ে নিলে তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে।
- রাজস্ব বৃদ্ধি : কোম্পানি চুয়াড়দের কৃষিজমির ওপর রাজস্বের হার যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়।
- অত্যাচার : রাজস্ব আদায়কারী ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা চুয়াড়দের ওপর চরম অত্যাচার চালাতে শুরু করে।
- প্রথম পর্বের বিদ্রোহ : ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়। শেষপর্যন্ত চুয়াড়রা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে তারা ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে আবার বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু এই বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়।
- দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের কারণ : দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) বিভিন্ন কারণ ছিল—
- নির্যাতন: ব্রিটিশ সরকার ও তাদের কর্মচারীরা আদিবাসী চুয়াড় এবং স্থানীয় জমিদারদের ওপর নির্যাতন শুরু করে।
- জমি থেকে উৎখাত : প্রথম পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা দরিদ্র চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে।
- পেশা থেকে বিতাড়ন : সরকার বহু চুয়াড়কে তাদের পাইকের পেশা থেকে বিতাড়িত করে।
- রাজস্ব বৃদ্ধি: জমিদারদের ওপর রাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে জমিদার ও চুয়াড় কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়।
- দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ : জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং, মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা বিভিন্ন জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের বিদ্রোহে শামিল করতে সক্ষম হন। প্রায় ১৫০০ অনুগামী নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং চুয়াড়রা প্রায় ৩০টি গ্রামে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্রোহে অসামান্য অবদানের জন্য রানি শিরোমণি ‘মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই’ নামে পরিচিত হন।
- বিদ্রোহের অবসান : প্রবল বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ পুলিশ ও কর্মচারীরা বিদ্রোহের মূলকেন্দ্র রায়পুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শীঘ্রই পরিস্থিতি পালটে যায়। সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনা এসে বিদ্রোহী জমিদার আদিবাসী চুয়াড়দের পরাজিত করে। রানি শিরোমণিকে হত্যা এবং দুর্জন সিংকে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।
উপসংহার: চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল লক্ষ করা যায়। যেমন—[1] ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে পশ্চাৎপদ চুয়াড়রা বিদ্রোহ শুরু করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। [2] এই বিদ্রোহে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে শামিল হয়। [3] চুয়াড়দের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এখানকার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়। বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি বিশেষ জেলা গঠন করা হয়।
- সোচ্চার প্রতিবাদ: এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সাঁওতালরা ইংরেজ আশ্রয়পুষ্ট জমিদার ও মহাজনশ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তাদের সোচ্চার প্রতিবাদ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে প্রেরণা দিয়েছিল।
- অন্য বর্ণের মানুষের যোগদান: সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবল সাঁওতালদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাঁওতাল বিদ্রোহে বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে।
- প্রেরণা : সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে চাষিদের বিদ্রোহের আগুন থেমে যায়নি। পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গরিব ও নিম্নবর্ণের সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ প্রেরণা জুগিয়েছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, “সাঁওতাল বিদ্রোহ আপসহীন গণসংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”
- সরকারি নমনীয়তা: বিদ্রোহের পর সরকার সাঁওতালদের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। [i] সাঁওতালদের পৃথক ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং সাঁওতাল-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামে জেলা গঠন করা হয়। [ii] ঘোষণা করা হয় যে, সাঁওতাল পরগনায় ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না। [iii] সাঁওতালদের ওপর ঋণের সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয়। [iv] সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারি ছাড়া অন্যদের প্রবেশ এবং বাঙালি মহাজনদের বসবাস নিষিদ্ধ হয়। এভাবে ভারতীয় জনজীবন থেকে সাঁওতালরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
- খ্রিস্টধর্মের প্রসার: সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাঁদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যবোধ জাগরিত করেন।
- মহাবিদ্রোহের পদধ্বনি: সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পদধ্বনি। এই বিদ্রোহে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। পরবর্তীকালে সংঘটিত সিপাহি বা মহাবিদ্রোহে তা সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। সুপ্রকাশ রায় বলেন, “এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিল এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ।”
- স্বাধীনতা সংগ্রাম: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।
- বীরত্ব: সাঁওতাল বিদ্রোহে দরিদ্র কৃষকদের স্বাধীনতা লাভ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। সাঁওতালরা সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনীর সামনে তিরধনুক, বর্শা, কুড়ুল প্রভৃতি নিয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আন্দোলনকে উৎসাহিত করে।
উপসংহার: সাঁওতাল বিদ্রোহে ইংরেজরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে সাঁওতালরা যাতে আর বিদ্রোহ করতে না পারে, সেজন্য তাদের দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করা হয়। উপযুক্ত শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যের সুযোগ না দিয়ে সরকার তাদের অনুন্নত করে রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে বিদ্রোহের পরও সাঁওতালদের অসন্তুষ্টি থেকেই যায়।
- আর্থিক সমৃদ্ধি : ব্রিটিশ সরকার দেশীয় আদিবাসীদের অধিকার ধ্বংস করে ভারতের সুবিস্তৃত অরণ্যগুলির কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ একচেটিয়াভাবে হস্তগত করার উদ্যোগ নেয়। এভাবে নিজের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির উদ্দেশ্য সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তন করে।
- রেলপথ নির্মাণ : ব্রিটিশ সরকার এদেশে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দ্রুত ও ব্যাপক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রেলপথ এবং রেলের কামরা নির্মাণের জন্য যে প্রচুর পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন ছিল তা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সরকার এদেশের অরণ্যগুলির ওপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।
- জাহাজ নির্মাণ : ব্রিটিশ সরকার এদেশে সীমান্ত সুরক্ষা এবং ব্রিটেনের জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজ নির্মাণের কর্মসূচি নেয়। জাহাজ নির্মাণের জন্য যে প্রচুর পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন ছিল তা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সরকার অরণ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করে।
- বিনোদন : বনাঞ্চলে শিকার করা ছিল এদেশের ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ, রাজকর্মচারী এবং তাদের অনুগত দেশীয় রাজাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বনাঞ্চলে এই শিকারের বিষয়টি অবাধ করার উদ্দেশ্যে সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তনের প্রয়োজন বোধ করে।
- সম্পর্কের অবনতি : ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার প্রথমদিকে আপাতভাবে আদিবাসীদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরোধ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার অরণ্যের অধিকার থেকে আদিবাসীদের বঞ্চিত করলে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
- আদিবাসী বসতির পরিবর্তন : ব্রিটিশদের হাতে অরণ্যের অধিকার হারানোর ফলে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে তারা অনেকেই অরণ্য অঞ্চল ছেড়ে অন্য কোনো কাজের উদ্দেশ্যে দূরবর্তী নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
- সাঁওতাল বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) অন্যতম কারণ ছিল আদিবাসী সাঁওতালদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া। সরকার সাঁওতালদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে তারা সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে।
- মুন্ডা বিদ্রোহ: আদিবাসী মুন্ডা বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। অরণ্যের অধিকার হারিয়ে মুন্ডারা ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে যা ‘উলঘুলান’ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা।
উপসংহার: অরণ্য ছাড়া আদিবাসী উপজাতিরা ছিল মাতৃহারা শিশুর মতোই অসহায়। তাই আদিবাসী উপজাতিদের থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। এসব বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহগুলি নিঃসন্দেহে কোম্পানি সরকারকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলেছিল।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষকদের ওপর ভূমিরাজস্বের বোঝা বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে দিলে কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে যায়।
- ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা: ইংরেজরা ভারতের চিরাচরিত আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে তাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে। ভারতীয় সমাজে এরূপ বিদেশি হস্তক্ষেপে দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ত্রুটি: সরকার প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩ খ্রি.) ফলে কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা হারায় এবং জমির মালিকানা চলে যায় একশ্রেণির নতুন জমিদারদের হাতে। তারা নিজের ইচ্ছামতো কৃষকদের ওপর কর বৃদ্ধি করে।
- অত্যাচার : জমিদার শ্রেণি কর আদায়ে কৃষকদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন শুরু করে এবং যখনতখন কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করতে থাকে।
- খাদ্যাভাব: সরকার কৃষকদের ধানের পরিবর্তে নীল, পাট, তুলো প্রভৃতি চাষে বাধ্য করলে কৃষকদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়।
- ঋণের জাল : মহাজন শ্রেণি দরিদ্র প্রজাদের নানাভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে দেয়। ফলে প্রজাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
- কুটিরশিল্প ধ্বংস: ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ঘটার পর সেখানকার শিল্পজাত পণ্য ভারতের বাজারগুলি দখল করে নিলে ভারতের কুটিরশিল্প ধ্বংস হয় এবং শিল্পী ও কারিগররা বেকার হয়ে পড়ে।
উপসংহার: সীমাহীন শোষণ-নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতের কৃষকও আদিবাসী সম্প্রদায় বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। তাদের বিদ্রোহগুলি বহুক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালের বৃহৎ সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
- বাসস্থান: ভারতের উপজাতি বা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সাধারণত তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অরণ্যসংকুল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করত।
- অরণ্যসম্পদ সংগ্রহ: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আদিবাসীরা অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার প্রভৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।
- জীবিকানির্বাহ: আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি অরণ্যের সম্পদ ভোগ এবং বিক্রি দুই-ই করত। তারা কঠোর পরিশ্রম করে বনভূমি পরিষ্কার করে, অনুর্বর পতিত জমি উদ্ধার করে সেখানে চাষবাস শুরু করে।
- অরণ্যে সরকারি আধিপত্য: ব্রিটিশ সরকার এদেশে নতুন নতুন শহরের নির্মাণকার্য, জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রয়োজনে ভারতের অরণ্য সম্পদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।
- আদিবাসীদের অধিকারহরণ: সরকার নানা বাধানিষেধের মাধ্যমে আদিবাসীদের অরণ্যের বনজ সম্পদ আহরণের অধিকার কেড়ে নেয়। এ ছাড়া অরণ্য সনদ, বনবিভাগ গঠন, অরণ্য আইন প্রবর্তন প্রভৃতির ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের অরণ্যের অধিকার হারাতে থাকে।
- খাজনা আরোপ: আদিবাসীরা নিজ পরিশ্রমে যে কৃষিজমি উদ্ধার করে তার ওপর সরকার খাজনা নির্ধারণ করে। ব্রিটিশ সরকারের এই অরণ্যনীতির ফলে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়।
উপসংহার: সামগ্রিকভাবে অরণ্যই ছিল আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর জীবনজীবিকার মূল উৎস। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার অরণ্যের ওপর হস্তক্ষেপ করলে এইসব সহজসরল মানুষগুলোর ওপর তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ নেমে আসে।
- অরণ্য সনদ, ১৮৫৫ খ্রি.: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ‘অরণ্য সনদ’ পাস করে। এর দ্বারা সরকার অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। অরণ্যের শাল, সেগুন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও জীবিকায় টান পড়ে।
- বনবিভাগ গঠন: ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বনবিভাগ গঠন করে। দিয়েত্রিখ ব্র্যান্ডিস নামে জনৈক জার্মানকে বনবিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
- প্রথম অরণ্য আইন, ১৮৬৫ খ্রি.: সরকার ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস করে এদেশের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করে এবং অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় এনে সেখানে নিজের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যে ঘেরা যে- কোনো ভূমিই হল সরকারি সম্পত্তি।
- দ্বিতীয় অরণ্য আইন, ১৮৭৮ খ্রি.: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ‘অরণ্য আইন’-এর দ্বারা সরকার অরণ্যের ওপর নিজের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
উপসংহারঃ ব্রিটিশ সরকারের এই সকল পদক্ষেপের ফলে অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের শতসহস্র বছরের অরণ্যের অধিকার হারিয়ে এক চরম দুর্দশার শিকার হয়। ফলে তারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
অরণ্য আইন: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সরকারি বনবিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অরণ্য আইন ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অরণ্য আইন পাস করে ব্রিটিশ সরকার বনভূমির ওপর তাদের অধিকার নিশ্চিত করে।
অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য: এদেশে অরণ্য আইন প্রণয়নের নানা উদ্দেশ্য ছিল। যেমন- [1] ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের পর কোম্পানির জাহাজ নির্মাণের জন্য ওক কাঠের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে কোম্পানি ভারতীয় বনজ সম্পদের দিকে নজর দেয়। [2] উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতে রেলপথের নির্মাণ ও তার বিস্তার শুরু হলে রেললাইনের স্লিপার নির্মাণ ও অন্যান্য কাজে কাঠের প্রয়োজন দেখা দেয়, যার ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে বনভূমি সংরক্ষণের তাগিদ দেখা দেয়। [3] ভারতের অরণ্যগুলিতে বসবাসকারী উপজাতিরা যাতে যথেচ্ছভাবে গাছ কাটতে না পারে সেদিকেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
উপসংহার: উনিশ শতকের শেষের দিকে ঔপনিবেশিক সরকার দ্বারা অরণ্য আইন প্রণয়নের ফলে অরণ্য জীবন অশান্ত হয়ে ওঠে এবং নানা বিদ্রোহ দেখা দেয়।
- ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৮৬৫ খ্রি : ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস করে। এর দ্বারা—
- এদেশের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করা হয়।
- সরকার অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় আনে।
- সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যে ঘেরা যে-কোনো ভূমিই হল সরকারের সম্পত্তি।
- ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৮৭৮ খ্রি.: ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস করে। এর দ্বারা—
- ব্রিটিশ সরকার ভারতে অরণ্যের ওপর নিজের অধিকার আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
- অরণ্যের ওপর আদিবাসীদের অধিকার ধ্বংস করা হয়।
- ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৯২৭ খ্রি.: ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে অপর একটি ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস করে। এই আইনের দ্বারা অরণ্যকে—[i] সংরক্ষিত অরণ্য, [ii] সুরক্ষিত অরণ্য ও [iii] গ্রামীণ অরণ্য—এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। কোন্ কোন্ বিষয়গুলি ‘অরণ্য বিষয়ক অপরাধ’ অর্থাৎ, অরণ্যের অভ্যন্তরে কোন্ কোন্ কাজ নিষিদ্ধ, অরণ্য আইন লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে তা উল্লেখ করা হয়।
উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইনগুলির মাধ্যমে আদিবাসীদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেয়। ফলে আদিবাসী সম্প্রদায় জীবনজীবিকার উৎস হারিয়ে শেষপর্যন্ত চুরি-ডাকাতি শুরু করে অথবা বসতি ছেড়ে অন্যত্র ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
- বিদ্রোহ কী? কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনগোষ্ঠী সুসংগঠিত বা অসংগঠিতভাবে যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা সাধারণভাবে বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- বৈশিষ্ট্য: বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—[i] বিদ্রোহ স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। [ii] বিদ্রোহ পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিতভাবে শুরু হতে পারে। [iii] বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে। [iv] বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে পূর্বতন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে না।
- উদাহরণ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে রংপুর বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি হল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। [i] ভারতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ছিল স্বল্পকালীন বিদ্রোহ, আবার চিনের তাইপিং বিদ্রোহ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। [ii] নীল বিদ্রোহ পরিকল্পিতভাবে শুরু হলেও সিপাহি বিদ্রোহ অপরিকল্পিতভাবে শুরু হয়েছিল। [iii] নীল বিদ্রোহ সফল হওয়ায় সরকার নীল কমিশন গঠন করে নীলচাষিদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়। [iv] সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয় সিপাহিদের দুর্দশা দূর হয়নি। [v] অনেকসময় বিদ্রোহ এক বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে বহুবার বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। · এগুলি বহুক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও প্রচলিত ব্যবস্থার কিছু-না-কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
- অভ্যুত্থান কী? অভুত্থান বলতে বোঝায় কোনো দেশ বা সমাজে কিংবা প্রশাসনে কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম। এক্ষেত্রে নিজেদের নেতা বা প্রভুদের বিরুদ্ধেই তাদের অধীনস্থ মানুষ সংগ্রাম করে।
- বৈশিষ্ট্য: অভ্যুত্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল –[i] নিজ গোষ্ঠীর ক্ষুব্ধ লোকজন অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পতন বা পরিবর্তন ঘটাতে চায়। [ii] অভ্যুত্থানের দ্বারা শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। [iii] অভ্যুত্থান সফল বা ব্যর্থ যা-ই হোক না কেন তাতে সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে না।
- উদাহরণ: অভ্যুত্থানের প্রধান উদাহরণগুলি হল— [i] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একাংশের উদ্যোগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ। [ii] ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সেনাদের একাংশের নেতৃত্বে নৌবিদ্রোহ, [iii] বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান সরকারের পতন (১৯৮৫ খ্রি.) ঘটিয়ে তাঁর সেনাপতি এরশাদের ক্ষমতা দখল।
উপসংহার: প্রচলিত ব্যবস্থার বদলের পরিবর্তে ক্ষমতার হস্তান্তরই হয়ে ওঠে অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্যে। তাই বিপ্লব বা বিদ্রোহের মধ্যে যে ব্যাপক আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, ততটা সম্ভাবনা অভ্যুত্থানের মধ্যে থাকে না।
- বিপ্লব কী? বিপ্লব কথার অর্থ হল কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন। কোনো দেশ বা সমাজে জনগণ প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন ঘটালে তাকে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করা হয়।
- বৈশিষ্ট্য: বিপ্লবের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—[i] বিপ্লব হল মানুষের সফল আন্দোলন। [ii] বিপ্লবের দ্বারা দেশ বা সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল হয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু হয়। [iii] বিপ্লবের দ্বারা প্রচলিত ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
- উদাহরণ: বিপ্লবের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল –[i] অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে সংঘটিত শিল্পবিপ্লব, [ii] ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের দ্বারা ইউরোপের শিল্পব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সে পূর্বতন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন ঘটে।
উপসংহার: সব পরিবর্তনই বিপ্লব নয়। বিপ্লবের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে, অবশ্যই তাকে ইতিবাচক হতে হয়। অর্থাৎ বিপ্লব হল সেই আমূল পরিবর্তন, যা হবে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, ক্ষুধা থেকে অন্নের দিকে, শূন্যতা থেকে পূর্ণতার দিকে।
- বিদ্রোহের কারণ: রংপুর বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল—[i] দেবী সিংহ দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা নিয়ে সেখানকার জমিদার ও প্রজাদের ওপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেন এবং নানা নতুন কর আরোপ করেন। [ii] রাজস্ব আদায়ে এখানকার জমিদার ও কৃষকদের ওপর চরম অত্যাচার শুরু হয়। রংপুর পরগনায় এই অত্যাচার চরমে ওঠে। কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চলতে থাকে। [iii] কৃষকরা গোরুবাছুর, সম্পত্তি, এমনকি নিজ সন্তানদের বিক্রি করেও দেবী সিংহের শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারত না।
- বিদ্রোহের সূত্রপাত: দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরের কাজীর হাট, কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি তেপা গ্রামে মিলিত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি ‘রংপুর বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
- স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা: বিদ্রোহীরা একটি ‘স্থানীয় স্বাধীন সরকার’ গঠন করে। এই সরকারের নবাব বা নেতা হন নুরুলউদ্দিন এবং তাঁর সহকারী নেতা হন দয়ারাম শীল।
- বিদ্রোহের প্রসার: বিদ্রোহীরা দেবী সিংহকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং তার রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। বহু কর্মচারী নিহত হয়। বিদ্রোহের ব্যয় নির্বাহের জন্য ‘ডিং খরচা’ নামে চাঁদা ধার্য করা হয়।
- বিদ্রোহ দমন: রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ড বিদ্রোহ দমনে সুবিশাল ব্রিটিশবাহিনী পাঠান। মোগলহাট ও পাটগ্রামের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা সেনাপতি ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশবাহিনীর কাছে পরাজিত হলে বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। ব্রিটিশবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য বিদ্রোহীকে হত্যা করে।
উপসংহার: রংপুর বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জমিদার ও কৃষকদের মিলিত এই বিদ্রোহ যতটা দেবী সিংহের বিরুদ্ধে ছিল, ঠিক ততটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনাস্থার প্রকাশ।
- চুয়াড়দের পরিচয়: আদিবাসী চুয়াড় বা চোয়াড় জনগোষ্ঠী বাংলার মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ- পশ্চিমাংশে বসবাস করত। চুয়াড়রা কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকদের কাজও করত। কাজের বিনিময়ে তারা জমিদারদের কিছু নিষ্কর জমি ভোগ করত।
- বিদ্রোহের কারণ: প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল—[i] ব্রিটিশ কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ জমিজমা কেড়ে নিলে তাদের জীবিকানির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। [ii] কোম্পানি চুয়াড়দের কৃষিজমির ওপর রাজস্বের হার যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়। [iii] রাজস্ব আদায়কারী ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা চুয়াড়দের ওপর চরম অত্যাচার চালাতে শুরু করে।
- বিদ্রোহের সূচনা: ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়।
- বিদ্রোহের প্রসার: জগন্নাথ সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড়রা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে চুয়াড়রা ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে আবার বিদ্রোহ শুরু করে।
উপসংহার: চুয়াড়দের প্রথম পর্বের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও চুয়াড়দের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই আগুন চুয়াড়দের দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের সময় দাবানলের চেহারা নেয়।
- দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের সূচনা: ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ চুয়াড়দের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে পরবর্তীকালে ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ শুরু হয়।
- বিদ্রোহের কারণ: দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) বিভিন্ন কারণ ছিল—[i] ব্রিটিশ সরকার ও তাদের কর্মচারীরা আদিবাসী চুয়াড় এবং স্থানীয় জমিদারদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। [ii] ইংরেজরা দরিদ্র চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে। [iii] সরকার বহু চুয়াড়কে তাদের পাইকের পেশা থেকে বরখাস্ত করে। [iv] জমিদারদের ওপর রাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে জমিদার ও চুয়াড় কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়।
- বিদ্রোহের প্রসার: জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং, মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি প্রমুখ। তাঁরা বিভিন্ন জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের বিদ্রোহে শামিল করতে সক্ষম হন। দুর্জন সিং প্রায় ১৫০০ জন অনুগামী নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং প্রায় ৩০টি গ্রামে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। বিদ্রোহীরা সরকারি দপ্তরেও আক্রমণ চালায়।
- বিদ্রোহের অবসান: বিদ্রোহীদের চাপে ইংরেজ পুলিশ ও কর্মচারীরা বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র রায়পুর ছেড়ে পালিয়ে গেলেও শীঘ্রই সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনা এসে বিদ্রোহী জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের পরাজিত করে। রানি শিরোমণিকে হত্যা এবং দুর্জন সিংকে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।
উপসংহার: এই বিদ্রোহের পর চুয়াড়দের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার চুয়াড়-অধ্যুষিত এলাকায় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘জঙ্গলমহল’ নামে একটি বিশেষ জেলা (১৮০০ খ্রি.)।
- সশস্ত্র উপজাতি বিদ্রোহ: চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল সশস্ত্র আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ।
- ব্রিটিশ-বিরোধিতা: চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল মূলত ব্রিটিশ-বিরোধী একটি বিদ্রোহ। ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে চুয়াড় সম্প্রদায় গর্জে উঠেছিল।
- জমিদার-কৃষক ঐক্য: চুয়াড় বিদ্রোহ দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি। বরং দেশীয় জমিদাররা ব্রিটিশ-বিরোধী এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে আদিবাসী চুয়াড় কৃষকদের নিজেদের পক্ষে শামিল করেছিল।
- দীর্ঘস্থায়িত্ব: চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ-বিরোধী এই বিদ্রোহ চলে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
- দুটি পর্যায়: দীর্ঘস্থায়ী চুয়াড় বিদ্রোহে দুটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। প্রথম পর্যায়টি শুরু হয়েছিল ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় পর্যায়টি চলেছিল ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে।
উপসংহার: অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধ ছিল আদিবাসী চুয়াড়দের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই প্রবণতাই তাদের বিদ্রোহমুখী করেছিল এবং ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইকে দীর্ঘস্থায়ী করেছিল।
- দমনপীড়ন: চুয়াড় বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজ পুলিশবাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালায়। তারা রানি শিরোমণিকে হত্যা করে এবং দুর্জন সিংকে গ্রেফতার করে।
- বিদ্রোহের পথপ্রদর্শক: ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে পশ্চাৎপদ চুয়াড়রা বিদ্রোহ শুরু করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। কেননা, নিরক্ষর চুয়াড়রা অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ শুরু করেছিল তা ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায় শুরু করে আরও অন্তত এক শতাব্দী পরে।
- জমিদার ও কৃষকদের ঐক্য: চুয়াড় বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে নয়, অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। জমিদার ও চুয়াড় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহে শামিল হয়।
- জঙ্গলমহল গঠন: চুয়াড়দের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এখানকার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়। বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করা হয়।
উপসংহার: চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষকবিদ্রোহ। সেদিনের দুর্গম ‘জঙ্গলমহল’ অর্থাৎ আজকের বাঁকুড়ার একাংশের কৃষক-সম্প্রদায় আজও চুয়াড় বিদ্রোহের স্মরণে গর্ববোধ করেন।
- রাজস্ব আদায়: আগে কোলরা রাজস্ব দিতে অভ্যস্ত ছিল না। কিন্তু ছোটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু করে। বহিরাগত (দিকু) হিন্দু, মুসলিম ও শিখ মহাজনদের হাতে এখানকার জমির ইজারা দিয়ে তাদের হাতে রাজস্ব আদায়ের অধিকার তুলে দেওয়া হয়।
- রাজস্ব বৃদ্ধি: জমিদাররা দরিদ্র কোলদের ওপর রাজস্বের পরিমাণ অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয় এবং নতুন নতুন কর আরোপ করে। এই কর আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর চরম অত্যাচার চালানো হয়। কোলদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পানীয় মদের ওপর উচ্চহারে কর ধার্য করা হয়।
- জমি থেকে উৎখাত : ইজারাদাররা কোলদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকে, এমনকি জমি থেকেও তাদের উৎখাত করতে শুরু করে।
- নির্যাতন: কোলদের ওপর নানাভাবে নির্মম নির্যাতন চালানো হত। এক্ষেত্রে অনেকসময়ই কোল রমণীদের মর্যাদা নষ্ট করা হত এবং নানা অজুহাতে কোল পুরুষদের বন্দি করে রাখা হত।
- অর্থনৈতিক শোষণ: রাস্তা তৈরির জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কোলদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। কোলদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের খাদ্যশস্যের পরিবর্তে আফিম চাষে বাধ্য করা হত।
- কোল ঐতিহ্য ধ্বংস : কোলদের নিজস্ব আইনকানুন, বিচারপদ্ধতি প্রভৃতি ধ্বংস করে তাদের ওপর জোর করে ব্রিটিশদের আইনকানুন ও বিচারপদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া হত। তাই কোলরা ক্ষুব্ধ হয়েই বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
উপসংহারঃ এইসব শোষণ, নির্যাতন ও উৎপীড়নের অবসান ঘটাতে বুদ্বু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে আদিবাসী কোলরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এদের সঙ্গে মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি উপজাতি যোগ দিলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
- কোল বিদ্রোহের সূচনা : ব্রিটিশ কোম্পানি কোল-অধ্যুষিত অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেই অঞ্চল বহিরাগত জমিদারদের ইজারা দেয়। এরপর থেকে কোলদের ওপর সরকার, জমিদার ও মহাজনদের তীব্র শোষণ শুরু হয়। এর প্রতিবাদে ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আদিবাসী কোলরা শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে যা ‘কোল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
- বিদ্রোহের কারণ: কোল বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল— [i] কোলদের ওপর রাজস্ব বৃদ্ধি, [ii] রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে কোলদের ওপর অত্যাচার, [iii] জমি থেকে কোলদের উৎখাত, [iv] কোলদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, [v] কোলদের বেগার শ্রমদানে বাধ্য করা, [vi] কোলদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করা প্রভৃতি।
- বিদ্রোহের প্রসার : কোল বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর তা দ্রুত সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ ও পালামৌ জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সিংরাই, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা প্রমুখ ।
- বিদ্রোহের অবসান : বিদ্রোহীরা ইংরেজ কর্মচারী, জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বহু লোককে হত্যা করে। শীঘ্রই ক্যাপটেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালায় এবং বহু আদিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করলে বিদ্রোহ বন্ধ হয়ে যায়।
- ফলাফল : কোল বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলি ছিল – [i] বিদ্রোহের ফলে কোল অধ্যুষিত অঞ্চলে সরকারি নীতির কিছু পরিবর্তন ঘটে। [ii] কোলদের জন্য ‘দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি’ নামে একটি পৃথক ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় (১৮৩৪ খ্রি.)। [iii] সেখানে ব্রিটিশ আইনকানুনের পরিবর্তে কোলদের নিজস্ব আইনকানুন চালু করা হয়। [iv] জমিদাররা যেসব জমি দখল করে নিয়েছিল তা কেড়ে নিয়ে কোলদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
উপসংহারঃ ব্রিটিশ শাসনকালে উপজাতি বিদ্রোহের ইতিহাসে কোল বিদ্রোহ ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ব্রিটিশ শাসকদের সাথে কোলদের এই অসম লড়াইয়ে কোলদের পরাজয় ছিল এই বিদ্রোহের দুঃখজনক পরিণতি।
- আদিবাসীদের বিদ্রোহ: কোল বিদ্রোহে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল আদিবাসী কোলরা। তাদের সঙ্গে নিম্নবর্ণের অন্যান্য চাষি, কামার, কুমোর প্রভৃতি মানুষও যোগদান করে।
- ঐক্যবদ্ধতা: বিদ্রোহ চলাকালীন আদিবাসী কোলরা ইংরেজ শাসক, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছিল।
- অরণ্যের অধিকার : কোলদের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে অরণ্য সম্পদের ওপর কোলদের চিরাচরিত অধিকার রক্ষার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছিল।
- ব্রিটিশ বিরোধিতা: কোল বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ ও বহিরাগত জমিদার। চার্লস মেটকাফ-এরমতে, ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানোই বিদ্রোহীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
- বিদ্রোহের বার্তা: বিদ্রোহী কোলরা নাকাড়া বাজিয়ে, আমগাছের শাখা বা যুদ্ধের তির বিলি করে নিজেদের মধ্যে বিদ্রোহের বার্তা ছড়িয়ে দিত।
- সহযোগিতার অভাব: কোল বিদ্রোহের প্রতি শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার অভাব লক্ষ করা গিয়েছিল।
উপসংহার: শহরে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলেও কোলরা যেভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত করে, তাতে ইংরেজরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। চার্লস মেটাকাফ স্বীকার করেছেন, বিদ্রোহী কোলদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো।
- ব্রিটিশ নীতির পরিবর্তন: কোল বিদ্রোহের ফলে কোল-অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ কোম্পানি তাদের নীতির কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটায়।
- দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি: ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে কোল উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে কোলদের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি অঞ্চল গঠন করে।
- ব্রিটিশ আইন বাতিল : দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি অঞ্চলে ব্রিটিশ আইন বাতিল হবে এবং কোলদের নিজস্ব আইনকানুন কার্যকর হবে বলে সরকার ঘোষণা করে।
- জমি ফেরত : জমিদাররা কোলদের যেসব জমিজমা অন্যায়ভাবে দখল করে নিয়েছিল তা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে কোলদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
উপসংহার: কোল বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার কোলদের প্রতি কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাদের প্রতি শোষণের মাত্রা হ্রাস পায়নি। তার ওপর কোলদের এলাকায় খাজনার হার ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
- বিদ্রোহের কারণ : ভিল বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল—[i] ইংরেজরা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ভিলদের বসতি অঞ্চল খান্দেশ দখল করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। [ii] ভিলদের ওপর উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব চাপানো হয় এবং তা আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালানো হয়। [iii] ভিলদের বসতি অঞ্চলে ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন ভিলরা মেনে নিতে পারেনি। [iv] মাড়োয়ারি সাউকার ও মহাজনরা সুকৌশলে ভিলদের ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে। সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর নিদারুণ অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হত।
- বিদ্রোহের সূচনা: ভিলদের ওপর নানা ধরনের শোষণ ও অত্যাচারের ফলে তারা ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহীদের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন মহারাষ্ট্রের নেতা ত্রিম্বকজি। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীদের নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন সেওয়ারাম।
- ব্যর্থতা : কর্নেল আউট্রামের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ভিল বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালালে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ভিল বিদ্রোহ থেমে যায় ।
- গুরুত্ব : ভিল বিদ্রোহের ফলে—[i] বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ভিলরা ঐক্যবদ্ধ হয়। [ii] মাড়োয়ারি মহাজন শ্রেণি গুজরাট ও রাজস্থান অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়।
উপসংহার: তীব্র দমনপীড়ন সত্ত্বেও ভিলদের বিদ্রোহের আগুন কখনোই একেবারে নিভে যায়নি। তাই ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে আপাতদৃষ্টিতে বিদ্রোহ থেমে গেলেও পরবর্তীকালে ১৮২৫, ১৮৩৬ এবং ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভিল জাতি বারবার বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল।
- কোম্পানির আধিপত্য : ইংরেজরা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ভিলদের বসতি অঞ্চল খান্দেশ দখল করে সেই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ভিলরা ক্ষুব্ধ হয়।
- ভূমিরাজস্ব আরোপ: ইংরেজ কোম্পানি ভিল অঞ্চলে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু করে। এই রাজস্বের পরিমাণ শীঘ্রই অত্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে দরিদ্র ভিলরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- উৎপীড়ন : ব্রিটিশ কোম্পানি ভিল কৃষকদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালায়।
- ভিলদের ঐতিহ্য বাতিল : ব্রিটিশ কোম্পানি ভিল অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেই অঞ্চলে ভিলদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে এবং ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে। ভিলরা এই ব্রিটিশ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি।
- মহাজনদের শোষণ: মাড়োয়ারি সাউকার ও মহাজনরা সুকৌশলে ভিলদের তীব্র ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে। ভিলরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর নিদারুণ অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হত।
উপসংহারঃ ব্রিটিশ আধিপত্য, উপজাতিদের ওপর অত্যাচার, উৎপীড়ন এবং ভিলদের নিজস্ব আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থার ওপর আঘাতের ফলে ভিল জাতি বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই ভিলরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল—এ কথা অস্বীকার করা যায় না।
- রাজস্ব আরোপ: আদিবাসী সাঁওতালরা অরণ্য অঞ্চলের পতিত জমি উদ্ধার করে চাষবাস করে সেই জমিকে উর্বর করে তোলে। ব্রিটিশ শাসনকালে সরকার-নিযুক্ত জমিদাররা সেই জমির ওপর উচ্চহারে রাজস্ব চাপালে সাঁওতাল কৃষকরা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
- অন্যান্য কর : ভূমিরাজস্ব ছাড়াও সরকার, জমিদার প্রমুখ সাঁওতালদের ওপর বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ফলে দরিদ্র সাঁওতালদের দুর্দশা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
- মহাজনদের শোষণ : সাঁওতালরা নগদে ভূমিরাজস্ব ও অন্যান্য কর পরিশোধ করতে গিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হত। পরবর্তীকালে ঋণের দায়ে তার জমি, ফসল, বলদ কেড়ে নেওয়া হত।
- ব্যবসায়ীদের প্রতারণা : বহিরাগত ব্যবসায়ীরা কেনারাম নামক বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনার সময় এবং বেচারাম নামক বাটখারা ব্যবহার করে নিজেদের পণ্যগুলি সাঁওতালদের কাছে বিক্রির সময় ঠকাত।
- রেলপথ নির্মাণ : সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের কাজে সাঁওতাল শ্রমিকদের নিয়োগ করে তাদের খুব কম মজুরি দেওয়া হত। তা ছাড়া রেলের ঠিকাদার ও ইংরেজ কর্মচারীরা সাঁওতাল পরিবারগুলির ওপর নানাভাবে অত্যাচার করত।
- সাঁওতাল আইন বাতিল: সরকার সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচারপদ্ধতি বাতিল করে সাঁওতাল এলাকায় ইংরেজদের জটিল আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে।
- খ্রিস্টধর্ম প্রচার : খ্রিস্টান মিশনারিরা সাঁওতালদের ধর্মকে অবজ্ঞা করত এবং সুকৌশলে সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত।
- নীলচাষ: নীলকর সাহেবরা সাঁওতাল কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নীলচাষে বাধ্য করত।
উপসংহারঃ নানা দিক থেকে শোষণ ও নিপীড়নের ফলে একসময় সাঁওতালদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর তারা সিধু, কানু ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে।
- বিদ্রোহের কারণ : সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল— [i] সাঁওতাল কৃষকদের ওপর বিপুল পরিমাণ ভূমিরাজস্ব এবং অন্যান্য কর আরোপ, [ii] নগদে রাজস্ব পরিশোধের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে মহাজনদের হাতে দরিদ্র সাঁওতালদের উচ্চ সুদে ঋণের জালে জড়ানো, [iii] পণ্য ক্রয়বিক্রয়ে ব্যবসায়ীদের দ্বারা সরল সাঁওতালদের প্রতারণা, [iv] রেলের কাজে নিযুক্ত সাঁওতাল শ্রমিকদের কম মজুরি প্রদান, [v] সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচার ব্যবস্থার বদলে ব্রিটিশ ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া, [vi] সাঁওতালদের নীলচাষে বাধ্য করা প্রভৃতি।
- বিদ্রোহের প্রসার : ক্ষুব্ধ সাঁওতালরা ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইংরেজ কোম্পানি, দেশীয় জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ। ৩০ জুন প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে জড়ো হয়ে শোষণমুক্ত স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা রেলস্টেশন, থানা, ডাকঘর প্রভৃতি আক্রমণ করে এবং বহু জমিদার ও মহাজনকে হত্যা করে।
- বিদ্রোহের অবসান : সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে বিশাল ব্রিটিশবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিধু, কানু-সহ বেশ কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। প্রায় ২৩ হাজার বিদ্রোহীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বহু বিদ্রোহীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই নিষ্ঠুরতার ফলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্রোহ থেমে যায়।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালের প্রথম পর্বে আদিবাসী কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম ব্যাপক আকার ধারণ করে। পি. সি. যোশী বলেছেন যে, সাঁওতাল বিদ্রোহের একটি বিশেষ দিক ছিল স্বাধীনতার কামনা, সাঁওতাল অঞ্চল ও সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা।
- সর্বস্তরের অংশগ্রহণ : সাঁওতাল বিদ্রোহে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের এবং সব বয়সের সাঁওতালরা অংশগ্রহণ করে। ফলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার নেয়।
- গণবিদ্রোহ: সাঁওতালরা ছাড়াও স্থানীয় নিম্নবর্ণের বিভিন্ন মানুষ যেমন—কামার, কুমোর, তাঁতি, গোয়ালা, ডোম প্রভৃতি বর্ণ ও পেশার মানুষও সাঁওতাল বিদ্রোহে অংশ নেয়। ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রকৃত গণবিদ্রোহে পরিণত হয়।
- অসম অস্ত্রের লড়াই : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল সাঁওতাল ও ইংরেজ বাহিনীর মধ্যে অসম অস্ত্রশস্ত্রের লড়াই। আদিবাসী সাঁওতালরা সেকেলে তিরধনুক, বল্লম নিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়।
- ব্রিটিশ-বিরোধিতা : সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ শক্তির আধিপত্য লুপ্ত করাই ছিল বিদ্রোহীদের মূল লক্ষ্য।
- ব্রিটিশ সহযোগীদের বিরোধিতা: শুধু ব্রিটিশ শাসন নয়, ব্রিটিশদের সহযোগী বহিরাগত জমিদার ও মহাজনদের বিরোধিতা এবং তাদের ধ্বংসসাধনও বিদ্রোহীদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
- আক্রমণের কেন্দ্র: সাঁওতাল বিদ্রোহীদের আক্রমণের মূল কেন্দ্র ছিল থানা, ডাকঘর, রেলস্টেশন, ইউরোপীদের বাংলো, জমিদার ও মহাজনদের বাড়ি প্রভৃতি।
উপসংহার: সাঁওতাল বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছিল ঠিকই, তবে এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
- আদিবাসী বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী বা উপজাতি সাঁওতালদের বিদ্রোহ। আদিবাসী সাঁওতালরাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি।
- কৃষকবিদ্রোহ: সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষকবিদ্রোহ। দরিদ্র ও শোষিত আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকরা জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
- ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু জমিদার বা মহাজন- বিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। এই বিদ্রোহ ছিল স্পষ্টতই ব্রিটিশ-বিরোধী। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে বলেন যে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোই এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল।
- গণবিদ্রোহ: সাঁওতাল কৃষকদের উদ্যোগে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও স্থানীয় কামার, কুমোর, তেলী, গোয়ালা, মুসলিম তাঁতি, চামার, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায় ও পেশার মানুষও এই বিদ্রোহে শামিল হয়। তাই নরহরি কবিরাজ একে সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র জনগণের মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।
- ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ: কেউ কেউ সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মের প্রভাব দেখতে পেলেও এই বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ধর্মকেন্দ্রিক ছিল না। বিদ্রোহী সাঁওতালরা ঈশ্বরকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। বরং তারা চিৎকার করে বলত— “ঈশ্বর মহান, কিন্তু তিনি থাকেন বহু বহু দূরে। আমাদের বাঁচাবার কেউ নেই।”
উপসংহার: বিতর্ক থাকলেও এ কথা সত্য যে, বহুমুখী অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাঁওতাল উপজাতির এই বিদ্রোহ এক আপসহীন সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছিল।
- বিদ্রোহের কারণ: মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল— [i] জমিতে মুন্ডাদের চিরাচরিত যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা (খুঁৎকাঠি প্রথা) বাতিল করা, [ii] মুন্ডাদের নিজস্ব আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করা, [iii] মুন্ডাদের ওপর ভূমিরাজস্বের হার বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের নতুন কর আরোপ, [iv] মুন্ডা শ্রমিকদের বেগার শ্রমদানে বাধ্য করা, [v] মুন্ডাদের জমিজমা বহিরাগত জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা দখল, [vi] মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরণ প্রভৃতি।
- ক্ষোভের সূত্রপাত : বিরসা এক নতুন ধর্ম প্রচার করে মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি মুন্ডাদের খাজনা দিতে নিষেধ করেন এবং বিদেশিদের বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়ে এক স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। এর ফলে তাঁকে দুই বছর (১৮৯৫-৯৬ খ্রি.) জেলে থাকতে হয়।
- বিদ্রোহের প্রসার : বিরসা ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সেনাদল গঠন করে নতুন উদ্যমে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। খুঁটি, রাঁচি, চক্রধরপুর, বুন্দু, তামার, তোরপা, কারা বাসিয়া প্রভৃতি স্থানে তাঁর গোপন ঘাঁটি গড়ে ওঠে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। ইংরেজ কর্মচারী, পুলিশ, জমিদার, মহাজনদের পাশাপাশি থানা, গির্জা প্রভৃতির ওপরও আক্রমণ চলে।
- বিদ্রোহের অবসান : প্রবল বিক্রমে লড়াই করেও বিদ্রোহী মুন্ডারা শেষপর্যন্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। বহু বিদ্রোহীর ফাঁসি বা কারাদণ্ড হয়। এভাবে বিদ্রোহ থেমে যায়। বিরসা মুন্ডা রাঁচি জেলে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
উপসংহার: মুন্ডা উপজাতিদের বিদ্রোহ ছিল এক অর্থে কৃষকবিদ্রোহ। দরিদ্র মুন্ডা কৃষকরাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান চালিকাশক্তি। নরহরি কবিরাজও মুন্ডা বিদ্রোহকে কৃষকবিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।
- প্রথম জীবন: বিরসা মুন্ডা ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলার উলিহাত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুগান মুন্ডা ছিলেন একজন বর্গাচাষি। বিরসা বাল্যকালে খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন।
- ধর্মপ্রচার : বিরসা ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। তিনি নিজেকে অবতার বলে ঘোষণা করেন এবং দাবি করেন যে, তিনি ভগবানের দর্শন পেয়েছেন। তিনি মহাপ্লাবনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি মুন্ডা সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারের বিরোধিতা করেন, পশুবলি বন্ধ এবং মাদক বর্জন করার কথা বলেন। তিনি মুন্ডাদের উপবীত ধারণ করতে বলেন।
- প্রথম আন্দোলন : ১৮৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সরকারি বনবিভাগ মুন্ডা গ্রামের পতিত জমি অধিগ্রহণ করতে শুরু করলে বিরসা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।
- বিদ্রোহের সূচনা : বিরসা ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করে সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করনে। ২৪ ডিসেম্বর (১৮৯৯ খ্রি.) বিদ্রোহের দিন ঠিক হয়।
- বিদ্রোহের প্রসার: ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিরসার নেতৃত্বে বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা সরকারি অফিস, থানা, ইংরেজ পুলিশ ও কর্মচারীদের আক্রমণ করতে থাকে।
- মৃত্যু: প্রবল বিক্রমে লড়াই করেও বিরসার বাহিনী শেষপর্যন্ত ব্রিটিশবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। বিরসাকে রাঁচি জেলে বন্দি করা হয়। সেখানে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
উপসংহার: মুন্ডা সমাজে বিরসা মুন্ডা ছিলেন ত্রাতাস্বরূপ। তাঁর অসামান্য প্রতিভা মাত্র একুশ বছর বয়সেই তাঁকে মুন্ডাদের নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল।
- ঐক্য : বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের ঐক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বিরসা প্রথমে নতুন ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে মুন্ডাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরে প্রবল বিদ্রোহের সময় এই ঐক্য আরও জোরদার হয়। পরবর্তীকালে বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও বিরসার ঐক্যবদ্ধ অনুগামীরা ‘বিরসাইট’ বা ‘বিরসা সম্প্রদায়’ প্রতিষ্ঠা করে।
- আদিবাসী বিদ্রোহ: মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি আদিবাসী বা উপজাতি বিদ্রোহ। কারণ আদিবাসী মুন্ডারাই ছিল এই বিদ্রোহের চালিকাশক্তি।
- কৃষকবিদ্রোহ : মুন্ডা বিদ্রোহে মূলত কৃষকরা অংশ নিয়েছিল। এজন্য অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ মুন্ডা বিদ্রোহকে ‘কৃষকবিদ্ৰোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।
- ব্রিটিশ বিরোধিতা : মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল ভারতের ব্রিটিশ-বিরোধী একটি গণসংগ্রাম। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোই ছিল বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য।
- স্বাধীনতার দাবি: মুন্ডা বিদ্রোহে স্বাধীনতার দাবি খুবই স্পষ্ট ছিল। বিরসা মুন্ডা বিদেশিদের বিতাড়িত করে স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।
উপসংহার: মুন্ডা বিদ্রোহে ধর্মীয় ভাবধারার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বিদ্রোহের নেতা বিরসা মুন্ডা নিজেকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হিসেবে তুলে ধরে প্রচার করেছিলেন যে তিনি ‘ঈশ্বরের আদেশ’ অনুযায়ী মুন্ডাদের উদ্ধারের কাজে নেমেছেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – B ধর্ম-প্রভাবিত বিদ্রোহ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ: উত্তর ভারত থেকে আসা সন্ন্যাসী ও ফকিররা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্রোহ চালায়। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক, চিরাগ আলি, মজনু শাহ প্রমুখ।
- চুয়াড় বিদ্রোহ : মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার কিছু অংশে আদিবাসী চুয়াড় সম্প্রদায় বসবাস করত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের স্থানীয় জমিদারদের ওপর অত্যাচার চালালে জমিদারদের পক্ষ নিয়ে এই চুয়াড় সম্প্রদায়ের লোকেরা বিদ্রোহ করে। এটি ইতিহাসে ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ প্রথম পর্যায়ে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়।
- সন্দীপ বিদ্রোহ: বঙ্গোপসাগরের বুকে কয়েকটি ছোটোবড়ো দ্বীপ নিয়ে সন্দীপ অঞ্চলটি গড়ে উঠেছিল। এখানে দরিদ্র জনগণ ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী গোকুল ঘোষালের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা সন্দীপ বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- বারাণসী বিদ্রোহ: অযোধ্যার নবাবের অধীনস্থ বারাণসীর জায়গিরদার ছিলেন বলবন্ত সিং। বলবস্তের পুত্র চৈত্য সিংহের আমলে এখানকার নির্যাতিত কৃষকরা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যা বারাণসী বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- রংপুর বিদ্রোহ: দেবী সিংহ নামে জনৈক ব্যক্তি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছ থেকে দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা নেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেবী সিংহ কৃষকদের ওপর ভয়ানক শোষণ ও অত্যাচার শুরু করলে তার বিরুদ্ধে কৃষকরা ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এটি রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- পলিগার বিদ্রোহ : পলিগার জাতি দক্ষিণ ভারতে বেলারি, কুর্নল, কুডাপ্পা, অনন্তপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করত। পলিগাররা ব্রিটিশ কোম্পানি ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা পলিগার বিদ্রোহ (১৭৮৩-১৮০৫ খ্রি.) নামে পরিচিত।
- পাইক বিদ্রোহ : বাংলা ও উড়িষ্যার পাইকরা ছিল জমিদারদের অস্ত্রবাহক ও শান্তিরক্ষক। তারা বিদ্যাধর মহাপাত্রের নেতৃত্বে, ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা পাইক বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- ভিল বিদ্রোহ : গুজরাট, মহারাষ্ট্র-সহ পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিল উপজাতির কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ কোম্পানি শোষণ ও অত্যাচার চালালে তারা ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শক্তিশালী বিদ্রোহ সংগঠিত করে। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ভিলরা ১৮২৫, ১৮৩৬ ও ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে আবার বিদ্রোহ করে।
- ফরাজি আন্দোলন : ফরিদপুর জেলার হাজি শরিয়ত উল্লাহ ইসলাম ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ‘ফরাজি’ নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এই আন্দোলন ক্রমে ইংরেজ কোম্পানি ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়ে ফরিদপুর, ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। হাজি শরিয়ত উল্লাহের পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা এবং পরে দুদু মিঞার পুত্র নোয়া মিঞা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- পাগলপন্থী বিদ্রোহ : ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরের রাজবংশী, হাজং, হাত্রি, দালু এবং মুসলমান-সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮২৫-২৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করে। এতে নেতৃত্ব দেন ফকির করিম শাহের পুত্র টিপু শাহ।
- ওয়াহাবি আন্দোলন ও বারাসাত বিদ্রোহ: তিতুমিরের নেতৃত্বে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ২৪ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, ঢাকা, রাজশাহি, মালদহ প্রভৃতি জেলায় শক্তিশালী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে যা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। তিতুমির এই সময় বারাসাতে এক বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখান থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার ও মহাজনদের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ দেন। এটি বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- কোল বিদ্রোহ: ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী কোলদের ওপর ব্রিটিশ কোম্পানির অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ ও অত্যাচার নেমে আসে। এর বিরুদ্ধে কোলরা ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- সাঁওতাল বিদ্রোহ: ছোটোনাগপুর, পালামৌ, সিংভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী সাঁওতালরা ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এটি সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।
- নীল বিদ্রোহ : নীলকর সাহেবরা নদিয়া, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, মুরশিদাবাদ, রাজশাহি, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলার চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করলে এবং তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালালে চাষিরা ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তীব্র আন্দোলন সংগঠিত করে। এটি নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন দিগম্বর বিশ্বাস, বিরুচরণ বিশ্বাস, মেঘাই সর্দার, বিশ্বনাথ সর্দার প্রমুখ।
- মোপালা বিদ্রোহ : দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী কৃষিজীবী মোপালারা জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সংগঠিত করে তা মোপালা বিদ্রোহ (১৮৭৩-৯৬ খ্রি.) নামে পরিচিত।
- মুন্ডা বিদ্রোহ : ছোটোনাগপুর অঞ্চলের মুন্ডা কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনরা উৎপীড়ন চালালে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিদ্রোহ করে। এটি মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) নামে পরিচিত।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- বিদ্রোহের কারণ : সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল~[i] কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর রাজস্বের বোঝা চাপানো হলে তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। [ii] তারা ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীর শোষণ ও অত্যাচারে ক্রমশ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। [iii] কোম্পানি তাদের তীর্থযাত্রার ওপর কর বসায়। [iv] কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বাংলার মধ্যে প্রবেশের জন্য নানা বাধার সৃষ্টি করে। [v] কোম্পানি সন্ন্যাসী ও ফকিরদের দরগায় যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
- বিদ্রোহের প্রসার: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহ ধীরে ধীরে ঢাকা, নাটোর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহ, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ অন্তত ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে।
- নেতৃত্ব : প্রথমদিকে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানি প্রমুখ। বিদ্রোহের শেষদিকে মজনু শাহ, মুশা শাহ, চিরাগ আলি প্রমুখ নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।
- বিদ্রোহের অবসান : বিদ্রোহীরা প্রথমদিকে ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য পেলেও পরবর্তীকালে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশবাহিনী নিষ্ঠুর দমননীতির দ্বারা বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।
উপসংহার: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম কৃষকবিদ্রোহ। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় শুরু হয়ে এই বিদ্রোহ বিক্ষিপ্তভাবে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
- দান হ্রাস : ব্রিটিশ সরকার বাংলার জমিদার ও কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা চাপালে সন্ন্যাসী ও ফকিররা জমিদারদের কাছ থেকে দানের পরিমাণ কম পেতে থাকে।
- বাংলায় প্রবেশে বাধা : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বাংলায় প্রবেশ করতে এবং ধর্মচর্চা করতে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা হয়। কোম্পানি দরগায় ফকিরদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
- ভূমিরাজস্ব ও কর : যেসব সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস ও কৃষিকাজ করতে শুরু করেন তাদের ওপর সরকার ও জমিদাররা ভূমিরাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেন। ভূমিরাজস্ব ছাড়াও তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করা হয়।
- রেশম ব্যাবসা : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকেই রেশম ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের কাছ থেকে প্রায়ই কাঁচা রেশম ও রেশমি পণ্য জোর করে ছিনিয়ে নিত।
- শোষণ ও অত্যাচার: কোম্পানির কর্মচারী ও জমিদাররা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর নানাভাবে শোষণ এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য যথেষ্ট উৎপীড়ন চালাত।
- তীর্থকর: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের তীর্থযাত্রার ওপর সরকার কর বসায় এবং তাদের ধর্মাচরণে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে।
- নির্যাতন: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হয়। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে অন্তত ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয়।
- মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ : ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীরা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের নানাভাবে শোষণ করতে থাকে।
উপসংহার: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর ঘটে চলা এইসব অন্যায়ের ফলেই ক্ষুব্ধ সন্ন্যাসী ও ফকিররা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। এই বিদ্রোহ পরবর্তী কৃষকবিদ্রোহগুলির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
- বিদ্রোহের সূচনা : ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয় । বিদ্রোহ শীঘ্রই নাটোর, রংপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, কোচবিহার, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
- আক্রমণ: বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব দপ্তর, জমিদারদের বসতবাড়ি, গোলাঘর প্রভৃতি আক্রমণ করে। সাধারণ মানুষের ওপর বিদ্রোহীরা কোনো আক্রমণ চালায়নি।
- বিদ্রোহীদের সাফল্য : বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে বিদ্রোহীরা বীরত্বের পরিচয় দেয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশবাহিনী বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হয়। ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপটেন টমাস নিহত হন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীদের আক্রমণে ক্যাপটেন এডওয়ার্ডস নিহত হন এবং তাঁর বাহিনী বিধ্বস্ত হয়।
- বিদ্রোহীদের পরাজয় : ব্রিটিশবাহিনীর চরম দমনপীড়নের ফলে বিদ্রোহীরা ক্রমে পিছু হঠতে থাকে। সাংগঠনিক দুর্বলতা, অনৈক্য প্রভৃতির ফলে বিদ্রোহীরা শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিদ্রোহ থেমে যায়।
উপসংহার: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বিদ্রোহ বহু ক্ষেত্রেই সংঘাতের রূপ নিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা সাফল্যও পেয়েছিল। তবে প্রচণ্ড দমন-পীড়নের ফলে এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি।
- দীর্ঘস্থায়িত্ব : সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ৪০ বছর ধরে (১৭৬৩-১৮০২ খ্রি.) এই বিদ্রোহ চলে ৷
- কৃষকদের বিদ্রোহ: বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ও ফকিররা একদিকে ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিল, অন্যদিকে কৃষিকাজ করে তারা জীবিকানির্বাহ করত।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য : সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য লক্ষ করা যায়। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী এবং নেতৃত্বদানকারী উভয়ের মধ্যেই হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ ছিল।
- ব্রিটিশের বিরোধিতা : ব্রিটিশ বিরোধিতাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য। বিদ্রোহীরা ইংরেজ কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব দপ্তর প্রভৃতি আক্রমণ করে।
- জমিদারের বিরোধিতা: বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধেও তাদের বিদ্রোহ পরিচালিত করে। বিদ্রোহীরা জমিদারদের বাসভবন, গোলাঘর প্রভৃতিতে আক্রমণ চালায়।
উপসংহার: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ব্রিটিশ প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। সমকালীন সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীরা সন্ন্যাসীদের ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত।
- সন্ত্রাসবাদী চরিত্র : লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী চরিত্র লক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বিদ্রোহ ছিল ‘হিন্দুস্থানের যাযাবর’ ও ‘পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব’। তবে হেস্টিংসের মত গ্রহণযোগ্য নয়।
- কৃষকবিদ্রোহ: কারও কারও মতে, এই বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষকবিদ্রোহ। সন্ন্যাসী ও ফকিররা ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান পেশা। উইলিয়াম হান্টার, এডওয়ার্ড ও গ্যারাট একে ‘কৃষকবিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।
- স্বাধীনতার সংগ্রাম : কেউ কেউ মনে করেন, এই বিদ্রোহ ছিল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। লেস্টার হ্যাচিনসন মনে করেন, বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের হাত থেকে নিজ দেশ ও ধর্মকে রক্ষা করা।
- দুর্বলতা : সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আন্তরিকতা থাকলেও তাদের সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর অংশের সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে শামিল হয়নি। এজন্য বিদ্রোহ কখনোই তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে জোরদার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাব, উন্নত যোগাযোগের অভাব, ধর্মীয় ভেদাভেদ প্রভৃতি কারণে এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
- ইসলামের শুদ্ধিকরণ : তিতুমির মনে করতেন, বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামধর্মে বহু কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। এজন্য ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুসারে ইসলামকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিতুমির শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেন।
- খাজনা আদায়ে অত্যাচার : প্রথম জীবনে তিতুমির বিভিন্ন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ করতেন। এই সময় তিনি খাজনা আদায়ের জন্য দরিদ্র কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেন।
- সংগঠন প্রতিষ্ঠা : তিতুমির জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। এর ফলে জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বেধে যায়।
- কৃম্নদেব রায়ের অত্যাচার : পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে এবং যারা তিতুমিরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। এতে তিতুমিরের অনুগামীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
উপসংহার: ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ইংরেজ ও তার পৃষ্ঠপোষক জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মুসলিমদের সশস্ত্র প্রতিবাদ। তাদের সঙ্গে হিন্দু কৃষকরা যোগ দিলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
- তিতুমিরের নেতৃত্ব বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মির নিসার আলি বা ডিভূমির (১৭৮২-১৮৩১ খ্রি.)। তিনি জমিদার ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলমানদের নিয়ে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে তোলেন। এতে জমিদার ও নীলকররা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
- ওয়াহাবিদের ওপর অত্যাচার: জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমিরের সংঘর্ষ শুরু হলে ব্রিটিশবাহিনীও তিতুমিরের বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নেমে পড়ে। পুঁড়ার জমিদার কৃয়দেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে বা দাড়ি রাখলে তাকে জরিমানা দিতে হবে, কেউ তিতুমিরকে বাড়িতে আশ্রয় দিলে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
- কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ : বিভিন্ন কারণে তিতুর বাহিনীর সঙ্গে কৃষ্ণদেব রায়ের সংঘর্ষ বাধে। তিতুমির ৩০০ জন অনুগামী-সহ কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করলে সংঘর্ষে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয় এবং বহু পুরোহিত নিহত হন।
- নিজেকে ‘বাদশাহ’ ঘোষণা : তিতুমির বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মৈনুদ্দিন এবং সেনাপতি হন গোলাম মাসুম। তিনি নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন স্থানের জমিদারদের কাছে কর দাবি করেন। এই ঘটনা ‘বারাসাত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ২৪ পরগনা, নদিয়া, ঢাকা, খুলনা, যশোহর, রাজশাহি, মালদহ-সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিতুমিরের আন্দোলন প্রসারিত হয়।
- পরাজয়: জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ কোম্পানির মিলিত বাহিনী ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমিরের বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং কামানের আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করে দেয়। তিতুমির ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো মৃত্যু বরণ করেন (১৯ নভেম্বর, ১৮৩১ খ্রি.)।
উপসংহার: তিতুমিরের নেতৃত্বাধীন ওয়াহাবি আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে তিতুমিরের মৃত্যু হয়। তাঁর অসংখ্য অনুগামী ইংরেজদের হাতে বন্দি হয়। এর ফলে বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
- শুদ্ধিকরণ : বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলামের কুসংস্কারগুলি দূর করা এবং পবিত্র কোরান-নির্দেশিত পথে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটানো।
- জমিদার-বিরোধিতা: ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের আধিপত্য ধ্বংস করা।
- ব্রিটিশবিরোধিতা : ইংরেজ কোম্পানি যেহেতু বাংলার অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের রক্ষাকর্তা ছিল সেহেতু ওয়াহাবি আন্দোলন শীঘ্রই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
- স্বাধীনতা : ওয়াহাবি আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বিদেশি ব্রিটিশ শাসন ও দেশীয় জমিদারদের আধিপত্য ধ্বংস করে স্বাধীনতা এবং নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা।
উপসংহার: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের শুরু থেকেই এই আন্দোলনে মুসলিম প্রাধান্য ছিল। কারণ ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতেই ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়। তথাপি বহু নির্যাতিত ও দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দুও মুসলিমদের সঙ্গে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।
- জমিদার-বিরোধিতা : বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল গুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। তিতুমির হিন্দু-মুসলিম উভয় শ্রেণির জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুগামীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাই ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, “তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারের বিরুদ্ধে।”
- ব্রিটিশবিরোধিতা : বারাসাত বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হলেও শেষপর্যন্ত তা ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়। বারাসাত- বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করে তিতুমির নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। ড. শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, “এই আন্দোলন ছিল প্রবলভাবে ব্রিটিশবিরোধী।”
- কৃষক ঐক্য : ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষক ঐক্যের একটি মূর্ত প্রতীক। মুসলিম কৃষকরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, “এই বিদ্রোহ হল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এক কৃষকবিদ্রোহ।”
- নিম্নবর্গের শ্রেণিসংগ্রাম : তিতুমিরের ডাকে সমাজের নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষ বারাসাত বিদ্রোহে শামিল হয়। বহু দরিদ্র হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।
উপসংহার: ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিতুমির দরিদ্র, সাধারণ কৃষকদের রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙিনায় আনতে সক্ষম হন। ড. রণজিৎ গুহও মনে করেন যে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই।
- ধর্মীয় আন্দোলন : ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিহারীলাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ বারাসাত বিদ্রোহের মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িক’ অর্থাৎ ধর্মীয় চরিত্র দেখতে পেয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, এই আন্দোলন ছিল ‘ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড এবং হিন্দু-বিরোধী। ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ‘হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত আক্রমণ।
- অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন : কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ ইসলামি উন্মাদনা দেখতে পাননি। তাই হান্টার, থর্নর্টন প্রমুখ মনে করেন যে, এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক।
- শোষণের বিরোধিতা: নরহরি কবিরাজ, ড. কেয়ামুদ্দিন আহমদ প্রমুখ মনে করেন, বারাসাত বিদ্রোহ ছিল অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ-বিরোধী এক আন্দোলন। শোষণ ও অত্যাচারের বিরোধিতাই ছিল বিদ্রোহের মূল কথা।
- কৃষকবিদ্রোহ : ওয়াহাবি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা মুসলিম কৃষক হলেও তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। তাই অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরীর মতে, “ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক আন্দোলন”
উপসংহার: মূলত কৃষক আন্দোলন হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের ধর্মীয় চরিত্রকে অস্বীকার করা যায় না। অর্থনৈতিক জীবনের সাথে জড়িত ও ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় ঠিকই, তবে এই আন্দোলন ভবিষ্যৎ কৃষক আন্দোলনগুলির পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।
- আরব দেশে সূত্রপাত : অষ্টাদশ শতকে আবদুল ওয়াহাব নামে জনৈক ব্যক্তি আরব দেশে ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ নামক মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। তাঁর নামানুসারে সাধারণভাবে এটি ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামেই বেশি পরিচিত।
- ভারতে সূত্রপাত : আঠারো শতকের প্রথমদিকে দিল্লির মুসলিম সন্তু শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র আজিজ ভারতে ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ওয়াহাবি আন্দোলনের ভাবধারা প্রচার করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে সমাজকে পবিত্র করা।
- ভারতে প্রসার : উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির বাসিন্দা সৈয়দ আহমেদ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে এদেশে ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’র ভাবধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনিই ছিলেন ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রবর্তক।
- বাংলায় প্রসার : উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজেও শুদ্ধি- করণের উদ্দেশ্যে ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’র ভাবধারা প্রচারিত হয়। বাংলায় এই ভাবধারার প্রচারে মুখ্য ভূমিকা নেন তিতুমির বা মির নিসার আলি।
- তিতুমিরের আদর্শ: তিতুমিরের অনুগামীরা প্রচার করেন যে, ব্রিটিশ শাসনে ভারত ‘দার-উল-হারব’ অর্থাৎ বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে। তাই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ পবিত্র ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে।
উপসংহার: ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ আসলে ওয়াহাবি আন্দোলনেরই একটি আদর্শগত দিক। বাংলায় এই আদর্শের পুরোধা তিতুমির ‘তরিকাই- মহম্মদীয়া’ বা মহম্মদ নির্দেশিত পথকে জমিদার, নীলকর ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ইংরেজদের বিরুদ্ধে কাজে লাগান এবং তাদের হটিয়ে এক নতুন ব্যবস্থা প্রণয়নের স্বপ্ন দেখেন।
- উৎপত্তি : ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ‘ইসলাম-নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’ বা ‘ইসলাম ধর্মের আদর্শে বিশ্বাস’। ফরিদপুর জেলার হাজি শরিয়ত উল্লাহ (১৭৮১-১৮৩৭ খ্রি.) ইসলামধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ‘ফরাজি’ নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন।
- আদর্শ: হাজি শরিয়ত উল্লাহ ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে ‘দার- উল-হারব’ বা ‘বিধর্মীর দেশ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের কলমা (আল্লার প্রতি বিশ্বাস), নামাজ (আল্লার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা), রোজা (উপবাস), জাকাত (দানধ্যান), হজ (তীর্থযাত্রা) প্রভৃতি পালনের পরামর্শ দেন।
- রাজনৈতিক রূপ : ফরাজি আন্দোলন শীঘ্রই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। হাজি শরিয়ত উল্লাহ তাঁর অনুগামীদের জমিদার ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। আন্দোলন ফরিদপুর জেলায় শুরু হয় এবং তা ধীরে ধীরে ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর, ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
- দুদু মিঞার ভূমিকা : শরিয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞার (১৮১৯-১৮৬২ খ্রি.) নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষক আন্দোলনে শামিল হয়। তিনি ঘোষণা করেন যে, জমির মালিক আল্লাহ, তাই কৃষকরা অন্য কাউকে খাজনা দিতে বাধ্য নয়। দুদু মিঞা একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী ও গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তুলে অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বাসভবন আক্রমণ করেন।
- নোয়া মিঞার ভূমিকা : দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা আন্দোলনকে ধীরে ধীরে ধর্মীয় রূপ দেন। ক্রমে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
উপসংহার: শরিয়ত উল্লাহ ও দুদু মিঞার উত্তরসূরি নোয়া মিঞার আমলে ফরাজি আন্দোলনের ধর্মীয় চরিত্র এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে হিন্দুরা এই আন্দোলন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ড. অভিজিৎ দত্ত বলেছেন যে, হিন্দু- বিরোধিতা, জোর করে অর্থ আদায়, নেতৃত্বের অভাব প্রভৃতির ফলে ফরাজি আন্দোলন তার গতি হারিয়ে ফেলে।
- ইসলামের শুদ্ধিকরণ : বাংলায় ইসলামের শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম ফরাজি আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রবর্তক হাজি শরিয়ত উল্লাহ তাঁর অনুগামীদের পবিত্র কোরানের আদর্শগুলি মেনে চলার পরামর্শ দেন।
- রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ: ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে ফরাজি আন্দোলন শুরু হলেও এই আন্দোলন শীঘ্রই রাজনৈতিক রূপ নেয়। অত্যাচারী ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়।
- অত্যাচারের বিরোধিতা : ফরাজি আন্দোলনকারীরা অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বাসভবন আক্রমণ করে তাদের আধিপত্য ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়।
- সংগঠন নির্মাণ : ইংরেজ বাহিনী, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে সমগ্র ফরাজিদের সংগঠন গড়ে তোলা হয়।
- পঞ্চায়েত ব্যবস্থা: দুদু মিঞা ইসলামের অনুকরণে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করেন।
- মুসলিম প্রাধান্য: ফরাজি আন্দোলনে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের সর্বাধিক প্রাধান্য দেখা যায়। আন্দোলনে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল না।
উপসংহার: ইসলামের আদর্শকে সামনে রেখে সংগঠিত ফরাজি আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাই শেষপর্যন্ত এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ইসলামীয় প্রাধান্যই সবচেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
- ধর্মীয় আন্দোলন : দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের উদ্যোগে পরিচালিত হলেও ফরাজি আন্দোলন ছিল মূলত একটি ধর্মীয় আন্দোলন। ইসলাম ধর্মের সংস্কারই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
- কৃষক আন্দোলন: ফরাজি আন্দোলনে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখে কেউ কেউ একে কৃষক আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ মনে করেন যে, ফরাজি আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয় যুক্ত থাকলেও এটি ছিল মূলত কৃষক আন্দোলন।
- ব্রিটিশ-বিরোধিতা : কেউ কেউ মনে করেন যে, ফরাজি আন্দোলনকারীরা বাংলা থেকে বিদেশি ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল। ড. অভিজিৎ দত্ত মনে করেন যে, ফরাজি আন্দোলন জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণ বৈপ্লবিক রূপ দান করেছিল।
- হিন্দু-বিরোধিতা : কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু দরিদ্র হিন্দুও ফরাজি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে ফরাজি আন্দোলনের হিন্দু-বিরোধিতা প্রকট হয়ে উঠলে হিন্দুরা শীঘ্রই আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়।
- উদ্দেশ্যহীনতা: অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরী মনে করেন যে, ফরাজি আন্দোলন প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন থেকে কৃষক আন্দোলনে পরিণত হলেও আন্দোলনকারীরা জমিদারি প্রথা বা নীলচাষের বিলোপ চায়নি। তাদের ব্রিটিশ বিরোধিতাও ছিল ধোঁয়াটে।
উপসংহার: ফরাজি আন্দোলন এক অর্থে কৃষক আন্দোলন হলেও এর মধ্যে ধর্মীয় প্রাধান্যই ছিল বেশি। তাই কেউ কেউ এই আন্দোলনকে মুসলিম সম্প্রদায়ের পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন।
- পরিচয় : ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর পরগনার রাজবংশী, হাজং, হাত্রি দালু, মুসলিম-সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের লোকেরা ফকির করিম শাহ এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ-র নেতৃত্বে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি পাগলপন্থী বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- আন্দোলনের কারণ : পাগলপন্থী আন্দোলনের প্রধান কারণগুলি ছিল—[i] ইঙ্গ-ব্রয় যুদ্ধে (১৮২৪-২৬ খ্রি.) ইংরেজদের যে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় হয়েছিল তা পূরণ করার উদ্দেশ্যে সরকার ময়মনসিংহ জেলার কৃষকদের খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। [ii] ব্রিটিশদের সহযোগী জমিদাররাও কৃষকদের ওপর তীব্র শোষণ চালায়। [iii] ব্রিটিশ শাসন ময়মনসিংহের চিরাচরিত গ্রামীণ কাঠামো ভেঙে দেয় ৷
- আন্দোলনের প্রসার : করিম শাহ এই বিদ্রোহ শুরু করলেও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহর নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। টিপু ৫ হাজার অনুগামী নিয়ে শেরপুরের জমিদারকে আক্রমণ করেন। বিদ্রোহীরা থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়, শহরে লুঠপাট চালায় এবং ময়মনসিংহের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও করে।
- বিদ্রোহীদের ঘোষণা : বিদ্রোহীরা ঘোষণা করে যে—[i] তারা আর জমিদারের আধিপত্য মানবে না। [ii] তারা সামরিক রাস্তা তৈরির কাজ করবে না বা এ কাজে কোনো ধরনের সাহায্যও করবে না। [iii] তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না বলেও জানিয়ে দেয়।
- গুরুত্ব: পাগলপন্থী বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। [i] এই বিদ্রোহে কৃষকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। [ii] এই বিদ্রোহ ভবিষ্যতে বড়ো ধরনের বিদ্রোহের পথ প্রস্তুত করে।
উপসংহার: ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হলেও পাগলপন্থীরা যেভাবে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জেহাদ গড়ে তুলেছিল, তা সত্যই বিস্ময়কর। অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরির মতে, পাগলপন্থীদের আন্দোলন জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – C নীল বিদ্রোহ ও পাবনার কৃষকবিদ্রোহ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- নীলচাষের প্রণালী: বাংলায় মূলত দুটি পদ্ধতিতে নীলচাষ হত—
- এলাকা চাষ : এলাকা চাষের ক্ষেত্রে নীলকররা নিজেদের খাস জমিতে দূর থেকে সস্তায় শ্রমিক এনে নীলচাষ করত। এক্ষেত্রে প্রতি ১০ হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য খরচ পড়ত আড়াই লক্ষ টাকা।
- বে-এলাকা বা রায়তি চাষ: বে-এলাকা বা রায়তি চাষের ক্ষেত্রে নীলকররা চাষিদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে তাদের নিজের জমিতেই চাষ করাতে বাধ্য করত। এই রায়তি চাষে জমি, লাঙল, সার, বীজ ও অন্যান্য সব খরচ চাষিদের বহন করতে হত। নীল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, এই পদ্ধতিতে প্রতি ১০ হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য নীলকরের খরচ পড়ত মাত্র ২০ হাজার টাকা। তাই নীলকররা সর্বদা চাষিকে বে-এলাকা বা রায়তি চাষে বাধ্য করত।
- দাদন প্রথা: নীলকররা নীলচাষের জন্য চাষিকে বিঘা পিছু মাত্র ২ টাকা অগ্রিম দাদন দিত। কোনো চাষি একবার দাদন নিলে তা আর কখনোই নীলকরের খাতায় পরিশোধ হত না। আবার দাদন না নিলে চাষির গোরুবাছুর নীলকুঠিতে নিয়ে আটকে রাখা হত।
- জমির মাপে কারচুপি : নীলকরের কাছ থেকে দাদন নিয়ে যে জমিতে চাষিকে নীলচাষ করতে হত তা মাপের সময় নীলকররা ব্যাপক কারচুপি করত। তারা গড়ে প্রতি আড়াই বিঘা জমিকে ১ বিঘা বলে গণ্য করত। ফলে চাষিকে নীলচাষে নিজের প্রচুর জমি ব্যবহার করতে হত।
- চাষির লোকসান: নীলচাষ করে চাষির প্রচুর আর্থিক লোকসান হত। নীল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, এক বিঘা জমিতে নীলচাষে চাষির খরচ পড়ত ১৩ টাকা ৬ আনা। সেই নীল বিক্রি করে চাষি পেত মাত্র ৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘা নীলচাষে চাষির লোকসান হত ৭ টাকা ৬ আনা।
- অত্যাচার: নীলকর সাহেবরা ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী। তাঁরা নীলচাষ করতে না চাইলে নীলকরদের লাঠিয়াল, পাইক, বরকন্দাজ প্রমুখ চাষিকে নীলকুঠিতে এনে আটকে রাখত এবং চাষিদের ওপর নির্মম দৈহিক অত্যাচার চালাত। চাষির স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্যদের ওপরও নানা ধরনের নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হত। এমনকি চাষির বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত।
- ইংরেজ শাসকদের অবিচার: অত্যাচারিত চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে ইংরেজ শাসকদের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কখনও ন্যায়বিচার পেত না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা বিচারে তাদের স্বজাতীয় শ্বেতাঙ্গদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করত। সমকালীন সংবাদপত্রে দেখা যায় যে, আদালতের কাঠগড়ায় নীলকররা বসার চেয়ার পেতেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা নীলকরদের বাংলোতে আনন্দ-উৎসবে যোগ দিতেন। ফলে বিচারব্যবস্থাও নীলচাষিদের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল।
- চাষিদের দুর্দশা: নীলকর সাহেবরা চারিকে ধানচারের পরিবর্তে জমিতে নীলচাষে বাধ্য করত। ফলে চাবি ধান উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং চাষির ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এ নীলচাষ আর্থিক লোকসানের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়। ম্যাজিস্ট্রেট নীল কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিয়ে “ইংল্যান্ডে নীলের যে সকল বাক্স গৌছার তা বাংলার চাবির রঞ্জিত।”
উপসংহার: ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, “এ বিদ্রোহ স্পানিক বা সাময়িক নয়, উহার নির্মিত্ত যে কত গ্রাম্য বীর ও নেতাদের উদয় হইয়াছিল ইতিহাসের পাতায় তাহাদের নাম নাই।” তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেছেন যে, তাঁদের কাছে নীল বিদ্রোহ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চেয়েও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছিল।
- স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ: নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরদের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব সম্পর্কে অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় মন্তব্য করা হয়েছে যে, নীল বিদ্রোহ দেশের মানুষকে রাজনৈতিক চেতনা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শিক্ষা দিয়েছিল।
- শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নজর : নীল বিদ্রোহকে উপলক্ষ্য করে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রামগঞ্জের সাধারণ গরিব মানুষ ও কৃষকদের প্রতি নজর দেয়। ফলে শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে নীল বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীদের সংযোগ ঘটে।
- রাজনৈতিক চেতনা: নীল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার ও শোষণের আসল রূপ শিক্ষিত সমাজের চোখে ধরা পড়ে। এর ফলে দেশবাসীর রাজনৈতিক চেতনাও বৃদ্ধি পায়।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের চাষিরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং একসঙ্গে আন্দোলনে শামিল হয়।
- গান্ধিজির আন্দোলনের অগ্রদূত: নীল বিদ্রোহকে বিশ শতকে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস অসহযোগ (১৯২০-২২ খ্রি.) ও আইন অমান্য আন্দোলনের (১৯৩০-৩৪ খ্রি.) অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে সম্ভবত নীল বিদ্রোহের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই গান্ধিজি বিহারের চম্পারনে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন।
- জাতীয়তাবোধ: নীল বিদ্রোহ সামন্তপ্রথা ও ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে। শিশির ঘোষের ভাষায়, “এই নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলনের ও সংঘবন্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দেয়।”এই বিদ্রোহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে শেষপর্যন্ত তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত করে।
- নীল কমিশন: নীল বিদ্রোহের ফলে সরকারও নড়েচড়ে বসে। বিদ্রোহের পর নীলচাষিদের ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তৎকালীন বাংলার ছোটোলাট জন পিটার গ্রান্ট ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ (৩১ ডিসেম্বর) নীল কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্টে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের বহু তথ্য উঠে আসে।
উপসংহার: নীলচাষিদের ওপর নির্মম অত্যাচার বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চোখ খুলে দিয়েছিল। এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
- বিদ্রোহের কারণ: নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল—[i] নীলচাষ করে চাষিরা আর্থিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হত। এদিকে নীলচাষ করে খাদ্যশস্য চাষ বন্ধ থাকায় চাষিদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দিত। [ii] নীলকর সাহেবরা চাষিদের জোর করে নীলচাষে বাধ্য করত। নীলচাষে রাজি না হলে চাষিকে আটক, শারীরিক নির্যাতন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি করা হত। [iii] নীলকররা চাষিকে বিঘা প্রতি ২ টাকা অগ্রিম দাদন দিয়ে চাষিকে এমনভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলত যে তা চাষি কোনোদিনই শোধ করতে পারত না। আবার দাদন গ্রহণ না করলে চাষির গোরুবাছুর নীলকুঠিতে নিয়ে আটকে রাখা হত। [iv] কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হত এবং চাষির জরিমানা ও কারাদণ্ড হত। [v] চাষিরা অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েও ন্যায়বিচার পেত না।
- বিদ্রোহের প্রসার: তীব্র শোষণ ও অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বাংলার প্রায় ৬০ লক্ষ নীলচাষি বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। [i] আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তারা নীলকরদের শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা চাপিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করার বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। [ii] অভিযোগের কোনো প্রতিকার না পেয়ে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাষিরা দাদন নিতে অস্বীকার করে এবং নীলচাষ বয়কট করে। [iii] নদিয়া, যশোহর, পাবনা, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহি, খুলনা, মালদহ, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলার বহু চাষি চরম নির্যাতন ভোগ করেও নীলচাষে রাজি হয়নি। [iv] আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে চাষিরা বর্শা, তরবারি, লাঠি প্রভৃতি নিয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। [v] বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির একাংশ নীলচাষিদের পক্ষ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা চাষিদের পক্ষে কলম ধরে ৷ দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেন।
- বিদ্রোহের অবসান: বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট পূর্ববাংলা সফরে এলে হাজার হাজার নীলচাষি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে তাদের করুণ অবস্থার কথা তাঁকে জানান। শেষপর্যন্ত তিনি নীল কমিশন (১৮৬০ খ্রি.) গঠন করেন। এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলায় জোরপূর্বক নীলচাষ নিষিদ্ধ হলে নীল বিদ্রোহ থেমে যায়।
- ফলাফল ও গুরুত্ব: নীল বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। [i] এই বিদ্রোহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। [ii] বিদ্রোহের পর সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। [iii] সরকার ‘অষ্টম আইন’ (১৮৬৮ খ্রি.)-এর দ্বারা ‘নীলচুক্তি আইন’ বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং জানায় যে নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন। [iv] নীলকরদের অত্যাচার, ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মর্মস্পর্শী বিবরণ, লং সাহেবের কারাবাস, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু প্রভৃতি জাতীয় চেতনাকে শক্তিশালী করে।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ : আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে নীলচাষিরা তাদের ওপর নীলকরদের শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা চাপিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করার বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন।
- নীলচাষ বয়কট : অভিযোগ জানিয়ে কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাষিরা দাদন নিতে অস্বীকার করে এবং নীলচাষ বয়কট করে। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী চৌগাছায় দিগম্বর বিশ্বাস ও বিরুচরণ বিশ্বাস নীলচাষ বয়কট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। নদিয়া, যশোহর, পাবনা, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহি, খুলনা, মালদহ, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলার বহু চাষি চরম নির্যাতন ভোগ করেও নীলচাষে রাজি হয়নি।
- সশস্ত্র সংগ্রাম : আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। তারা নীলকুঠি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দেয় এবং রাস্তাঘাটে নীলকরদের লাঞ্ছিত করতে থাকে।
- শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভূমিকা : বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির একাংশ নীলচাষিদের পক্ষ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। [i] ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় চাষিদের পক্ষে কলম ধরেন এবং চাষিদের সাধ্যমতো সাহায্য করেন। [ii] দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মর্মস্পর্শী চিত্র আঁকেন। [iii] মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করে তা খ্রিস্টান পাদরি লং সাহেবের নামে প্রকাশ করলে লং সাহেবের জরিমানা ও কারাদণ্ড হয়।
- ছোটোলাটের কাছে আবেদন : ইতিমধ্যে বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট পূর্ববাংলা সফরে এলে হাজার হাজার নীলচাষি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে তাদের করুণ অবস্থার কথা তাঁকে জানান।
উপসংহার: শেষপর্যন্ত বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট নীলচাষিদের অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ‘নীল কমিশন’ গঠন করেন (১৮৬০ খ্রি.)। এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলায় জোর করে নীলচাষ নিষিদ্ধ হলে নীল বিদ্রোহ ক্রমে থেকে যায়।
- নদিয়ার কৃষক নেতা: নীলবিদ্রোহের কৃষক নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের দিগম্বর বিশ্বাস, বিচরণ বিশ্বাস এবং আসাননগরের মেঘাই সর্দার। ইংল্যান্ডের কৃষকবিদ্রোহের নেতা ওয়াট টাইলারের নামানুসারে দিগম্বর ও বিয়চরণ বিশ্বাস ‘বাংলার ওয়াট টাইলার’ নামে পরিচিত হন।
- অন্যান্য জেলার কৃষক নেতা: নদিয়ার বাইরে অন্যান্য জেলার নীল বিদ্রোহের কৃষকনেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, খুলনার কাদের মোল্লা, মালদহের রফিক মণ্ডল, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার, সুন্দরবন অঞ্চলের রহিমউল্লা, মল্লিকপুরের পাঁচু শেখ প্রমুখ। বিশ্বনাথ সর্দার বিদ্রোহে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়ে ‘বিশে ডাকাত’ নামে পরিচিত হন।
- জমিদারদের নেতৃত্ব বেশ কয়েকজন জমিদারও চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নড়াইলের রামরতন রায়, সাধুহাটির মথুরানাথ আচার্য, রানাঘাটের শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চন্ডীপুরের শ্রীহরি রায় প্রমুখ। রামরতন রায় বিদ্রোহে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়ে ‘বাংলার নানাসাহেব’ নামে পরিচিত হন।
- শিক্ষিত সমাজের নেতৃত্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের কেউ কেউ নীল বিদ্রোহে পরোক্ষে নেতৃত্ব দেন। হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দরিদ্র নীলচাষিদের নানা পরামর্শ ও সহায়তা দেন। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মাধ্যমে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
উপসংহার: বাংলার বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে নীল বিদ্রোহ প্ৰকৃত অর্থেই একটি গণবিদ্রোহে পরিণত হয়। এই বিদ্রোহে শিক্ষিতসমাজের পরোক্ষ নেতৃত্বদান বিদ্রোহকে আরও শক্তিশালী করে।
- পত্রিকার সম্পাদকদের ভূমিকা: নীলকরদের অত্যাচারের বিরোধিতা করে নীল বিদ্রোহকে সমর্থন জানিয়ে যেসব পত্রিকার সম্পাদক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া ঈশ্বরগুপ্তের ‘সম্বাদ প্রভাকর’, অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, মার্শম্যানের ‘সমাচার দর্পণ’, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ‘সোমপ্রকাশ’ প্রভৃতি পত্রিকায় সম্পাদকরা নিয়মিত নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার ও নীল বিদ্রোহের সংবাদ পরিবেশন করতে থাকেন।
- লেখকদের ভূমিকা: নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করে যেসব সাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করে খ্রিস্টান মিশনারি জেমস লং-এর নামে প্রকাশ করেন। এই অপরাধে লং সাহেবের কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা জরিমানা হলে সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন সিংহ আদালতে সেই জরিমানার টাকা পরিশোধ করে দেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বিদ্রোহে নীলচাষিদের উৎসাহ দিতেন।
- আইনজীবীদের ভূমিকা : খ্যাতনামা আইনজীবী শম্ভুনাথ পণ্ডিত ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেন। নীলকররা চাষিদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তাঁদের নামে অসংখ্য মিথ্যা মামলা করে। এইসব মামলা চলানোর সামর্থ্য চাষিদের ছিল না। এই পরিস্থিতিতে নীলকরদের ভয় উপেক্ষা করে আইনজীবীদের কেউ কেউ চাষিদের পাশে দাঁড়ান এবং বিনা পারিশ্রমিকে চাষিদের পক্ষে মামলায় সওয়াল করেন।
উপসংহার: নীল বিদ্রোহে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধুমাত্র কৃষকদের সহায়তাই নয়, এই বিদ্রোহকে তাঁরা পরোক্ষভাবে সর্বজনীন করে তোলেন।
- শক্তিশালী বিদ্রোহ: অত্যাচারিত নীলচাষিদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে অন্যান্য কৃষকবিদ্রোহের তুলনায় নীল বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। তৎকালীন বড়োলাট লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেছেন যে, তাঁদের কাছে নীল বিদ্রোহ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের চেয়েও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছিল।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অত্যাচারিত কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। ফলে বিদ্রোহীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য দেখা যায়।
- জমিদারদের যোগদান : বাংলার কৃষকদের সঙ্গে বহু জমিদারও নীলকরদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহে যোগ দেয়। এইসব জমিদারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নড়াইলের রামরতন রায়, সাধুহাটির মথুরানাথ আচার্য, রানাঘাটের শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চণ্ডীপুরের শ্রীহরি রায় প্রমুখ।
- সংবাদপত্রে ভূমিকা: নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণ এবং নীল বিদ্রোহের নানা ঘটনা তৎকালীন সংবাদপত্রগুলিতে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হত। এসব পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘বামাবোধিনী’, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি।
- শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের যোগ: উনিশ শতকে বাংলার বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে একমাত্র নীল বিদ্রোহই কলকাতা তথা বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন ও সহযোগিতা পায়।
উপসংহার: বাংলায় নীল বিদ্রোহ এক সামগ্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য এই বিদ্রোহকে অনন্যতা দিয়েছে ।
- জমিদার-নীলকর বিরোধ : অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত মনে করেন যে, নীল বিদ্রোহ ছিল আসলে বাঙালি জমিদারদের সঙ্গে বিদেশি নীলকরদের সংঘাত। তাঁর মতে, গ্রামবাংলায় নীলকরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালি জমিদারদের স্বার্থে আঘাত লাগে। এজন্য জমিদারদের নির্দেশে কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয় ৷
- কৃষকবিদ্রোহ: নীল বিদ্রোহ ছিল একটি কৃষকবিদ্রোহ। কোনো কোনো জমিদার বিদ্রোহে অংশ নিলেও মূলত কৃষকদের স্বার্থেই এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ও তারাই বিদ্রোহের অগ্রভাগে ছিল।
- গণ আন্দোলন : অনেকে নীল বিদ্রোহকে প্রকৃত গণ আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। তৎকালীন বাংলার ছোটোলাট জন পিটার গ্রান্ট একে ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকা’য় লেখা হয়েছে, “এটা একটা বিদ্রোহ, সমগ্র দেশই এতে যোগ দিয়েছে?”
- জাতীয় আন্দোলন : কেউ কেউ নীল বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলনের সমান বলে মনে করেন। ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, “এ বিদ্রোহ স্থানিক বা সাময়িক নয়, উহার নিমিত্ত যে কত গ্রাম্য বীর ও নেতাদের উদয় হইয়াছিল ইতিহাসের পাতায় তাহাদের নাম নাই।” তৎকালীন বড়োলাট লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেছেন, যে, তাঁদের কাছে নীল বিদ্রোহ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের চেয়েও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছিল।
উপসংহার: নীলচাষিদের সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে তা দাবানলের জন্ম দিয়েছিল। নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই বিদ্রোহ যে ব্রিটিশ সরকারকে এক বিরাট ধাক্কা দিয়েছিল এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
- নীল কমিশন: বিদ্রোহের পর সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্ট থেকে নীলকরদের চরম অত্যাচার ও নির্যাতনের কাহিনি প্রকাশিত হয়। ফরিদপুরের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নীল কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “ইংল্যান্ডে নীলের যে সকল বাক্স পৌঁছায় তা বাংলার চাষির রক্তে রঞ্জিত।”
- অষ্টম আইন: সরকার ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অষ্টম আইন’-এর দ্বারা ‘নীলচুক্তি আইন’ বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং জানায় যে, নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন।
- যোগসূত্র: নীল বিদ্রোহ নীলকরদের এবং তাদের রক্ষক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চাষিদের মধ্যে, চাষি ও জমিদারদের মধ্যে, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে ওঠে।
- জাতীয় চেতনার উন্মেষ: নীল বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। নীলকরদের অত্যাচার, ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মর্মস্পর্শী বিবরণ, লং সাহেবের কারাবাস, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু প্রভৃতি এই জাতীয় চেতনাকে শক্তিশালী করে।
- মহাজনদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি: মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্লেয়ার ক্লিং মনে করেন যে, নীলকরদের পতনের ফলে নিম্নবর্গের কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়।
উপসংহার: নীলবিদ্রোহের ব্যাপকতা ও বিদ্রোহের প্রতি বিপুল গণসমর্থন নীলচাষ সম্পর্কে ইংরেজ সরকারকে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করেছিল। এই বিদ্রোহ যেভাবে বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, তা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পটভূমি প্রস্তুত করেছিল।
- বিদ্রোহের কারণ : পাবনা বিদ্রোহের কারণ ছিল—[i] দশম আইন’ (১৮৫৯ খ্রি.)-এর দ্বারা কৃষককে জমির মালিকানা ও পাট্টা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জমিদাররা আইন ফাঁকি দিয়ে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করতে থাকে। [ii] জমিদাররা কৃষকদের খাজনা ক্রমাগত বাড়াতে থাকে। [iii] কৃষকের জমির মাপে কারচুপি করেও খাজনা বাড়ানো হয়। [iv] কৃষকদের ওপর প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপকর আরোপ করা হয়। [v] জমিদাররা কৃষকদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করে।
- বিদ্রোহের সূচনা: উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে পাবনার ক্ষুব্ধ কৃষকরা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। পাবনার ইউসুফশাহী পরগনায় প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়।
- বিদ্রোহের প্রসার: বিদ্রোহী কৃষকরা ‘দি পাবনা রায়ত লিগ’ গঠন করে জমিদারদের বেআইনি খাজনা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই লিগ কৃষকদের মামলা চালাতে সহায়তা করে। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ সমগ্র পাবনা জেলা-সহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর রাজশাহি প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
- নেতৃত্ব : পাবনা বিদ্রোহে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়, শম্ভুনাথ পাল, ক্ষুদিমোল্লা প্রমুখ। বিদ্রোহে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়ে ঈশানচন্দ্ৰ ‘বিদ্রোহী রাজা’ নামে পরিচিত হন।
- বিদ্রোহের অবসান: পাবনা বিদ্রোহ মূলত জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ায় মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একাংশ বিদ্রোহীদের সমর্থন করেননি। এই পরিস্থিতিতে বিদ্রোহীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার এবং ১৮৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ বিদ্রোহকে দুর্বল করে দেয়।
উপসংহার: জমিদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত পাবনা বিদ্রোহ সমকালীন অন্যান্য কৃষকবিদ্রোহের মতোই হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল। তবে বিদ্রোহীদের হাতে নিহতের ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি।
- অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ: পাবনা বিদ্রোহ একটি অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। কেননা, জমিদাররা হিন্দু বলে কৃষকেরা তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি, জমিদাররা অত্যাচারী ও শোষক ছিল বলে কৃষকরা বিদ্রোহ করেছিল।
- বিদ্রোহের পন্থা: পাবনা বিদ্রোহে কৃষকরা কোনো চরমপন্থী বা বৈপ্লবিক দাবি করেনি। খাজনা বন্ধ ছাড়া কৃষকরা অন্য কোনো প্রতিরোধের পথেও যায়নি। তারা জমিদারদের মিথ্যা মামলা লড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য কেউ কেউ মনে করেন যে, পাবনা বিদ্রোহ ছিল একটি আইন-মাফিক বিদ্রোহ।
- জমিদার-বিরোধিতা: পাবনা বিদ্রোহে অত্যাচারিত কৃষকরা মূলত জমিদারদের বিরোধিতা করে। কারণ, বিদ্রোহীরা জমিদারদের দ্বারাই প্রত্যক্ষ শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়।
- সীমাবদ্ধ বিদ্রোহ: পাবনা বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা বিশেষ দেখা যায়নি। বরং বিদ্রোহীরা সরকারকে খাজনা দিতে চায় এবং সরাসরি মহারানির প্রজা হওয়ার দাবি জানায়। এজন্য কেউ কেউ একে সীমাবদ্ধ বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেন।
- রাজনৈতিক চেতনার অভাব: পাবনা বিদ্রোহে ব্রিটিশ-বিরোধিতার অভাব লক্ষ করে কেউ কেউ মনে করেন যে, এই বিদ্রোহে রাজনৈতিক চেতনার অভাব ছিল। কারণ, ব্রিটিশ শক্তিই ছিল এদেশে কৃষকদের দুর্দশার মূল কারণ—এ কথা বিদ্রোহীরা বুঝতে পারেনি।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – D বিবিধ
অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর
- বিদ্রোহের কারণ: চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল— [i] ব্রিটিশ কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ জমিজমা কেড়ে নিলে তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। [ii] কোম্পানি চুয়াড়দের কৃষিজমির ওপর রাজস্বের হার যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়। [iii] রাজস্ব আদায়কারী ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা চুয়াড়দের ওপর চরম অত্যাচার চালাতে শুরু করে। [iv] ইংরেজরা দরিদ্র চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে। [v] সরকার বহু চুয়াড়কে তাদের পাইকের পেশা থেকে বিতাড়িত করে।
- বিদ্রোহের প্রসার: [i] প্রথম পর্যায়ে বিদ্রোহে জগন্নাথ সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড়রা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে চুয়াড়রা ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে আবার বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু এই বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়। [ii] বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিংহ, মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি প্রমুখের নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ শুরু হয়। দুর্জন সিংহ প্রায় ১৫০০ অনুগামী নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং প্রায় ৩০টি গ্রামে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। বিদ্রোহীরা সরকারি দপ্তরে আক্রমণ চালায়।
- বিদ্রোহের অবসান: ইংরেজ পুলিশবাহিনী চুয়াড় বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালায়। রানি শিরোমণিকে হত্যা এবং দুর্জন সিংকে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।
- গুরুত্ব: চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল— [i] নিরক্ষর চুয়াড়দের বিদ্রোহ ভারতের শিক্ষিত সমাজের চোখ খুলে দেয়। [ii] এই বিদ্রোহে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়। [iii] বিদ্রোহের পর সরকার দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি জেলা গঠন করে।
উপসংহার: সর্বপ্রথম আদিবাসী চুয়াড় সম্প্রদায়ই বিদ্রোহের মাধ্যমে এদেশে ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। পরবর্তীকালে তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়গুলির ব্রিটিশ-বিরোধিতার পথ চুয়াড়রাই তৈরি করে দিয়েছিল, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
- নেতাদের মধ্যে অনৈক্য: উনিশ শতকে ওয়াহাবি আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহে ধর্মীয় প্রভাব যথেষ্ট বেশি দেখা যায়। এর ফলে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং অত্যাচারী শোষকদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে লড়াই করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
- পরিকল্পনার অভাব : কৃষকবিদ্রোহগুলি সফল করার জন্য যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল সেদিকে বিদ্রোহীরা বিশেষ নজর দেয়নি। ফলে মাঝপথে অধিকাংশ বিদ্রোহ দিশা হারিয়ে ফেলে।
- আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা : রংপুর, পাবনা, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি অধিকাংশ বিদ্রোহই ছিল আঞ্চলিক। বিদ্রোহরত অঞ্চলের বাইরে বিদ্রোহের প্রভাব না থাকায় সরকার ও জমিদারদের বাহিনী সহজেই বিদ্রোহগুলি দমন করতে সক্ষম হয়।
- উন্নত যোগাযোগের অভাব: উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে বিদ্রোহীদের মধ্যে সর্বদা ভালো যোগাযোগ গড়ে উঠত না। ফলে সর্বত্র একই মাত্রায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
- সুদক্ষ নেতৃত্বের অভাব : বেশ কিছু বিদ্রোহ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উৎপত্তি লাভ করে। কিন্তু সেই বিদ্রোহগুলি সফল করার জন্য যে সুদক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল তা অনেক বিদ্রোহেই ছিল না। ফলে বিদ্রোহগুলি শুরু হওয়ার কিছুকালের মধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
- দমনপীড়ন: বিদ্রোহীদের ওপর ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের তীব্র দমনপীড়ন অধিকাংশ বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। বারাসাত বিদ্রোহে ব্রিটিশ কামান তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা গুঁড়িয়ে দেয়। সাঁওতাল বা মুন্ডা বিদ্রোহে অসংখ্য বিদ্রোহীকে ফাঁসি বা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়।