WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 4 সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 4 সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 4 সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
West Bengal Board 10th History Solutions
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি
- ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ হল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের টোটার প্রচলনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরের সেনানিবাসে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমে এই বিদ্রোহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
- ১৮৫৭-র বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতগণ একমত নন। একে কেউ কেউ নিছক ‘সিপাহি বিদ্রোহ’, কেউ ‘গণবিদ্রোহ’, কেউ কেউ ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে সুপ্রকাশ রায় প্রমুখ ‘কৃষক অভ্যুত্থান’, বীর সাভারকার রতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’, রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘সামন্তশ্রেণির বিদ্রোহ’, সুশোভন সরকার প্রমুখ এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। আবার অনেক ভারতীয় ইতিহাসবিদ একে ‘মহাবিদ্রোহ’ বলেও অভিহিত করেছেন।
- ভারতের সর্বস্তরের মানুষ ১৮৫৭-র ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ সমর্থন করলেও শিক্ষিত বাঙালিদের একটি অংশ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি বড়ো অংশ বরং ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে কল্যাণকর বলে মনে করত। তাই মহাবিদ্রোহ যখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে চরম রূপ নেয়, তখন শিক্ষিত বাঙালিদের সমর্থনের অভাবে এই বিদ্রোহ বাংলায় গতি হারিয়ে ফেলে।
- মহাবিদ্রোহের পর মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন নীতি ও আদর্শের কথা প্রকাশ করেন যা ‘মহারানির ঘোষণাপত্র’ নামে পরিচিত।
- উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ প্রভৃতির ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এই কারণে ড. অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময় গড়ে ওঠা সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ (১৮৩৬ খ্রি.), ‘জমিদার সভা’ (১৮৩৮ খ্রি.), ‘হিন্দুমেলা’ (১৮৬৭ খ্রি.), ‘ভারতসভা’ (১৮৭৬ খ্রি.), ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ (১৮৮৫ খ্রি.) প্রভৃতি।
- কালীনাথ রায়চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায়ের বেশ কয়েকজন অনুগামীর উদ্যোগে কলকাতায় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন সাংবাদিক ও লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৯৯-১৮৫৯ খ্রি.)।
- দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ ‘জমিদার সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ ধনী ব্যক্তি এই সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘জমিদার সভা’-র প্রধান কর্মসূচি ও লক্ষ্য ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করা।
- নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘হিন্দুমেলা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রথম সম্পাদক হন জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সদস্য জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সহ-সম্পাদক হন নবগোপাল মিত্র। রাজা কমলকৃয় বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রমানাথ ঠাকুর, পিয়ারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্টদাস পাল প্রমুখ ‘হিন্দুমেলা’-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে হিন্দুধর্মের অতীত গৌরবগাথা ছড়িয়ে দেওয়া, দেশীয় ভাষা চর্চা করা, জাতীয় প্রতীকগুলিকে মর্যাদা দেওয়া প্রভৃতি।
- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতসভা’ বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে ওঠে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ‘ভারতসভা’র প্রথম অধিবেশন বসে। ভারত ও ইংল্যান্ডে একসঙ্গে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ, পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২২ বছর করা, ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.) ও ‘অস্ত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.) বাতিল প্রভৃতি দাবিতে ‘ভারতসভা’ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
- ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা গ্রন্থ এবং বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা চিত্র ভারতের জাতীয়তাবোধের বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করে। সাহিত্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’, স্বামী বিবেকানন্দ রচিত ‘বর্তমান ভারত’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘গোরা’ এবং চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘ভারতমাতা’।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়তাবাদী ও দেশাত্মবোধমূলক ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচনা করেন। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীন ভারতমাতার দুর্দশার চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে বিদ্রোহের আহবান জানান। আনন্দমঠের সন্তানদলের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের হাত থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করা।
- স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ (১৯০৫ খ্রি.) গ্রন্থটি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বিবেকানন্দ তাঁর গ্রন্থে দেশবাসীকে পাশ্চাত্যের অনুকরণ বাদ দিয়ে ভারতমাতার মুক্তির জন্য কাজ করতে আহ্বান করেন। তিনি বলেন যে, প্রত্যেক ভারতবাসী জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। এই গ্রন্থে তিনি ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন তুলে ধরে দেশবাসীকে সজাগ করেন।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গোরা’ (১৯১০ খ্রি.) উপন্যাসটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে। এই উপন্যাসে তিনি ব্রিটিশ-বিরোধিতা ও স্বদেশপ্রেমের আদর্শ প্রচার করেছেন। তিনি জাতীয়তাবাদকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন।
- বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘ভারতমাতা’ (১৯০৫ খ্রি.) নামের চিত্রটি শিক্ষিত ও প্রগতিশীল ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। হিন্দুদের ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর অনুকরণে আঁকা চতুর্ভুজা ‘ভারতমাতা’ বৈয়ব সন্ন্যাসিনীর পোশাক পরিহিতা। তাঁর চার হাতে রয়েছে বেদ, ধানের শিষ, জপের মালা ও শ্বেতবস্ত্র। এর দ্বারা অবনীন্দ্রনাথ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের যুগে ভারতীয়দের মধ্যে স্বদেশিয়ানা ও জাতীয়তাবাদী অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
- শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আঁকা বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করেন। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হল ‘অদ্ভুত লোক’(১৯১৫খ্রি.), ‘বিরূপ বজ্র’(১৯১৭ খ্রি.) এবং ‘নয়া হুল্লোড় (১৯২১ খ্রি.)। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে বাঙালি ‘বাবু’ সমাজের মনোভাব, পাশ্চাত্যের প্রতি একশ্রেণির বাঙালির মোহ, বাংলার নারীসমাজের দুর্দশা, বাঙালিয়ানা প্রভৃতির প্রভাব খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
TOPIC – A. ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- সিপাহিদের বিদ্রোহ: স্যার জন লরেন্স, জন সিলি, চার্লস রেস প্রমুখ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এবং অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ ভারতীয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, এই বিদ্রোহে যোগদানকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা। এই বিদ্রোহে সারা ভারতের সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ যোগ দেয়নি। দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড়ো অংশ বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। শিখ ও গোরখা সেনারা বরং বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সহায়তা করেছিল। কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেছেন, “এই বিদ্রোহ ছিল একান্তভাবেই সিপাহিদের অভ্যুত্থান।”
- সামন্তদের বিদ্রোহ: রজনীপাম দত্ত, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন, মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, নানা সাহেব, লক্ষ্মীবাই, কুনওয়ার সিং প্রমুখ সামন্তশ্রেণির মানুষ এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এটি ছিল ভারতের সনাতনপন্থীদের শেষ বিদ্রোহ। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত শ্রেণি ও মৃতপ্রায় সামন্তশ্রেণির ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ।
- জনসাধারণের অংশগ্রহণ: নর্টন, ম্যালেসন, বল, জন কে প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে একটি ‘গণবিদ্রোহ’ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন এই বিদ্রোহে সামন্ত নেতাদের নেতৃত্বের কথা স্বীকার করেও তাঁর ‘১৮৫৭’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত নানা স্থানে গণবিদ্রোহের আকার নেয়। ভারতের এক বৃহৎ অঞ্চল, যথা—পশ্চিম বিহার থেকে পূর্ব পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও এই অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, স্বেচ্ছায় এই বিদ্রোহে যোগ দেয়।

- জাতীয় বিদ্রোহ: ঐতিহাসিক আউট্রাম, ডাফ, রবার্টসন, টোরি দলের নেতা ডিসরেলি, সমাজতন্ত্রবিদ কার্ল মার্কস প্রমুখ এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় যুদ্ধ। তাঁদের মতে, মুজাফফরনগর, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে সিপাহিদের সঙ্গে সংযোগ ছাড়াই অসামরিক লোকজন ও জমিদারশ্রেণির ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। সিপাহিরা সিংহাসনচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলে দেশবাসীর মনে দেশপ্রেমের মনোভাব জেগে ওঠে।
- স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ: বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার (বীর সাভারকার) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া কার্ল মার্কস, এঙ্গেল্স, পি সি জোশী, অশোক মেহতা, অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার প্রমুখ ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।
- সর্বস্তরে ব্যাপক প্রভাব : ভারতের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহের ব্যাপকতা লক্ষ করে একে মহাবিদ্রোহ নামে অভিহিত করেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় একে মহান বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। এরিক স্টোক্স বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের শেষ অধ্যায়। এই আন্দোলনে ইংরেজদের বিতাড়নের কথা ভাবা হয়েছিল।
উপসংহার: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করলেও এসব দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও বিভিন্ন যুক্তি দেওয়া হয়। যেমন—ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম—প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ এই বিদ্রোহের গণচরিত্র অস্বীকার করে বলেছেন, বিদ্রোহে যত সংখ্যক সৈন্য যোগ দিয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সৈন্য বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করেছিল। এজন্যই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। অধ্যাপক এরিক স্টোকস, বেইলি প্রমুখ মনে করেন যে, এই বিদ্রোহে স্থানীয় কৃষকদের প্রতিরোধ, জাতীয় প্রতিরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন ধারা-উপধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল।
- সপক্ষে : সাভারকারের মতামতকে সমর্থন করে কোনো কোনো পণ্ডিত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মেনে নিয়ে এর সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন।
- লন্ডনের স্মরণসভা : ভারতীয় বিপ্লবীরা লন্ডনে মহাবিদ্রোহের এক স্মরণসভায় এই বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।
- বিশ্বখ্যাত বিপ্লবসমূহের সঙ্গে তুলনা: অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার প্রমুখ বীর সাভারকারের অভিমতকে মেনে নিয়েছেন। সুশোভন সরকারের মতে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ জাতীয় সংগ্রাম বলে স্বীকার না করলে ইটালির কার্বোনারি আন্দোলনকে ইটালির মুক্তিযুদ্ধ বা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে রুশ কৃষকদের যুদ্ধকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে না।
- মার্কস ও এঙ্গেলসের অভিমত: কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেল্স এই বিদ্রোহকে ভারতীয়দের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বলে মেনে নিয়েছেন।

- জোশীর অভিমত : কমিউনিস্ট নেতা পি সি জোশী তাঁর ‘1857, in our History’ প্রবন্ধটিতে ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
- বিপক্ষে : কোনো কোনো পণ্ডিত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মানতে অস্বীকার করে এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
- সুরেন্দ্রনাথ সেনের অভিমত : ঐতিহাসিক ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর ‘Eighteen Fifty Seven’ নামক গ্রন্থে ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মেনে নেননি। তাঁর মতে, সিপাহি বিদ্রোহের নেতাদের লক্ষ্য ছিল ‘প্রতিবিপ্লব’।
- রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত: ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছেন যে, এই বিদ্রোহে ভারতের সকল অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেনি, বরং শিখ ও গোরখা সৈনিকরা এবং কোনো কোনো দেশীয় রাজা ইংরেজদের পক্ষে ছিল। এজন্য তিনি বলেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম “প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়।”
উপসংহার: কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে জাতীয়তাবাদ বা জাতীয় ঐক্যবোধ জাগ্রতই হয়নি। তাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে মেনে নেওয়া যায় না। তবে এই বিদ্রোহই যে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে প্রথম বৃহত্তম অভ্যুত্থান ছিল এবং পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছিল—সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
- সামন্তপ্রভুদের ব্যক্তিস্বার্থ: অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ সেনের মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহে জাতীয় স্তরের পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি। আসলে হতাশাগ্রস্ত সামন্তপ্রভুরা ক্ষমতার মধুভাণ্ড পাওয়ার লোভে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল মাত্র।
- প্রতিক্রিয়াশীল : ১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। ভারতে অতিদ্রুত ইংরেজ শাসন বিস্তৃত হলে এদেশের সামন্তপ্রভুরা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বিদ্রোহের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ড. সেনের মতে, এই বিদ্রোহের নেতাদের লক্ষ্য ছিল প্রতিবিপ্লব।
- ভৌমিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আশা: ১৮৫৭-র বিদ্রোহে যেসকল অসামরিক লোকজন অংশগ্রহণ করেন তাদের নেতৃত্বের রাশ ছিল জমিদার ও সামন্তপ্রভুদের হাতে। নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাই, কুনওয়ার সিং-সহ অনেক সামন্ত নেতা এই বিদ্রোহে যোগ দেন। আসলে ব্রিটিশদের সরকারি নীতির ফলে সামন্তরা যে চিরাচরিত ক্ষমতা হারান, তা পুনরায় ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যেই তাঁরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী: ১৮৫৭-র বিদ্রোহে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় যুদ্ধ।
- অসামরিক লোকজনের অংশগ্রহণ : ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ সিপাহিরা শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যেই এই বিদ্রোহে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু অসামরিক জনগণ যোগ দেয়। সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে জমিদার শ্রেণি প্রত্যেকেই ভারতকে ইংরেজদের কবল থেকে মুক্ত করতে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
- বাহাদুর শাহের নেতৃত্ব: ১৮৫৭-র বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলে দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী মনোভাব জেগে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে এই বিদ্রোহ এক জাতীয় রূপ পায়।
উপসংহারঃ ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে সামন্ততান্ত্রিক উপাদান কিংবা জাতীয়তাবাদী উপাদান নিশ্চয় ছিল। তাই বলে এই বিদ্রোহকে পুরোপুরি সামন্ততান্ত্রিক বা পুরোপুরি জাতীয় বিদ্রোহ বলা যুক্তিযুক্ত নয়। এই দুই ধারার বাইরেও নানা ধারা এর মধ্যে সক্রিয় ছিল। এই বিষয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- স্বত্ববিলোপ নীতি : লর্ড ডালহৌসি তাঁর স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা একে একে ঝাঁসি, সাতারা, নাগপুর, সম্বলপুর-সহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য দখল করেন। ফলে ওইসব রাজ্যের শাসকরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
- রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন : ব্রিটিশরা কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা ও নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করে। এর ফলে এসব রাজ্যের শাসকরা ক্ষুব্ধ হয়।
- ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের অত্যাচার: উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা তাদের অধস্তন ভারতীয় কর্মচারীদের ঘৃণা ও অবজ্ঞা করত। ভারতীয় কর্মচারীরা কারণে-অকারণে ব্রিটিশ কর্মচারীদের কাছে হেনস্থার শিকার হত। অত্যাচারিত এই ভারতীয়দের মনে এভাবে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
- ব্রিটিশ-আশ্রিত রাজ্যে ক্ষোভ : ব্রিটিশ সরকার ত্রিবাঙ্কুর-সহ ব্রিটিশ আশ্রিত কয়েকটি রাজ্যের সেনাদের ভাতা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে তারা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
উপসংহার: এতে সন্দেহ নেই যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক অধিকারচ্যুত বিভিন্ন ভারতীয় শাসক ও তাঁদের অধীনস্থ জনগণের ক্ষোভ এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত
- অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অর্থ ও সম্পদ একনাগাড়ে লুণ্ঠন করলে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজকোশ শূন্য হয়ে পড়ে। দেশের আর্থিক দুর্দশা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
- অবশিল্পায়ন: ব্রিটিশ কোম্পানির শোষণমূলক শিল্প ও বাণিজ্যনীতির ফলে ভারতে অবশিল্পায়ন ঘটে। ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্য বিনাশুল্কে ভারতে ঢুকলে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- বেকারত্ব বৃদ্ধি : ভারতের বস্ত্রশিল্প-সহ বিভিন্ন কুটিরশিল্প ধ্বংস হলে এসব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ও কারিগরদের একটি বড়ো অংশ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। আবার ব্রিটিশদের একচেটিয়া বাণিজ্যের ফলে দেশীয় ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়।
- রাজস্ব বৃদ্ধি: ব্রিটিশরা ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার প্রজাদের ওপর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব চাপিয়ে দেয়।
- ব্রিটিশ সহযোগীদের শোষণ: ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী দেশীয় জমিদার, মহাজন প্রমুখও প্রজাদের ওপর নানাভাবে শোষণ চালায়। ফলে প্রজাদের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
উপসংহার: ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সাধারণ ভারতবাসীকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীর মতে, অর্থনৈতিক ক্ষোভের প্রকোপই সাধারণ মানুষকে সংগ্রামমুখী করেছিল।
- শাসক-শাসিত সম্পর্ক: ঔপনিবেশিক ভারতে ইংরেজ শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান ও বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং ভারতীয়রা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে পড়ে।
- ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সর্বত্র ইংরেজরা ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখত। বহু ইউরোপীয় ক্লাবের দরজায় লেখা থাকত, “কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।” ওয়ারেন হেস্টিংস বলেছেন, “কয়েক বছর আগে পর্যন্ত অধিকাংশ ইংরেজ ভারতীয়দের প্রায় বর্বর মনে করত।”
- ভারতীয়দের রক্ষণশীল মনোভাব : ভারতীয়রা এদেশে বিদেশি শ্বেতাঙ্গ শাসন কখনোই মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। মুঘল শাসনের পতন ঘটানোর জন্য মুসলিমরা ব্রিটিশদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল। আবার সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করা, বিধবাবিবাহের প্রচলন প্রভৃতির জন্যও রক্ষণশীল হিন্দুরা ব্রিটিশদের ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিল।
- ব্রিটিশ কর্মচারীদের অত্যাচার: ব্রিটিশ প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের অত্যাচার ও ব্যভিচার ভারতীয়দের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিও চরম অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হত। এই কারণে ভারতবাসী ব্রিটিশদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল।
উপসংহার: ভারতবাসীর প্রতি তীব্র অত্যাচার, ঘৃণা, অবমাননা, লাঞ্ছনা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতীয় সমাজকে বারুদের স্তূপে পরিণত করে। এই স্তূপে যথা সময়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংযোগ ঘটিয়ে ব্যারাকপুরের সিপাহি মঙ্গল পান্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সূচনা করেন।
উপসংহার: এনফিল্ড রাইফেল-এর কার্তুজের ঘটনাকে অনেকে মহাবিদ্রোহের প্রকৃত কারণ বলে মনে করলেও ঐতিহাসিক সি বল এই কাতুর্জের ঘটনাকে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ বলে মনে করেন না। তিনি দেখিয়েছেন যে, বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সিপাহিরা এই কার্তুজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেন।
- দিল্লি: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে বিদ্রোহী সিপাহিরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সিংহাসনচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৭৭৫-১৮৬২ খ্রি.)-কে বিদ্রোহের নেতা বলে ঘোষণা করে। মুঘল শাসনের উত্তরাধিকারী এবং অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রতীক হিসেবে তাঁর নামে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ ছিলেন নামসর্বস্ব নেতা মাত্র।
- কানপুর : কানপুরে মহাবিদ্রোহের নেতা ছিলেন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর দত্তক পুত্র নানা সাহেব (প্রকৃত নাম গোবিন্দ ধন্দু পন্থ)। তিনি কানপুর থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে নিজেকে ‘পেশোয়া’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর তাঁতিয়া টোপি (প্রকৃত নাম রামচন্দ্র পাণ্ডুরঙ্গ টোপি) এবং হাকিম আজিমুল্লা–ও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
- অযোধ্যা : অযোধ্যার বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী ছিলেন বেগম হজরত মহল। তিনি লখনউয়ের সিপাহি এবং অযোধ্যার জমিদার ও কৃষকদের সহায়তায় এক সর্বাত্মক বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে তোলেন।
- ঝাঁসি: ঝাঁসিতে সিপাহি বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন বিধবা রানি লক্ষ্মীবাই। ইংরেজ সেনাপতি হিউ রোজ ঝাঁসি আক্রমণ করলে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শেষপর্যন্ত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কাল্লির যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্ব পরবর্তীকালে ভারতবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা দিয়েছিল।
- বিহার: বিহারে সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ও সংগঠক ছিলেন রাজপুত বীর কুনওয়ার সিং। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন এবং এর পরে মারা যান।
- ফৈজাবাদ : ফৈজাবাদের মৌলবি আহম্মদুল্লা সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অবশেষে তিনি ইংরেজদের অনুগত এক রাজার হাতে নিহত হন।
উপসংহার: ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের নেতৃবর্গ মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলে সারা দেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ সর্বভারতীয় চরিত্র নেয়।
- ব্রিটিশ শাসনের ওপর আস্থা: শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তদের একটি বড়ো অংশ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের ওপর অগাধ আস্থা রাখত। তারা ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে কল্যাণকর বলে মনে করত এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহেরও বিরোধী ছিল।
- সিপাহিদের সাফল্যে অবিশ্বাস: বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজদের বিতাড়নের পর কেউ ভারতে জাতীয় রাষ্ট্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে কি না এই বিষয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সন্দিহান ছিল। তাই তারা ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি।
- খ্যাতনামা বাঙালিদের অভিমত : [i] হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় বিদ্রোহীদের নৃশংস, বর্বর এবং নরহত্যাকারী দস্যু বলে অভিহিত করেন।[ii] রাজনারায়ণ বসু ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে ‘নৈরাজ্যবাদী’ এবং নানা সাহেব, আজিমউল্লার মতো বিদ্রোহী নেতাদের ‘অন্যায়কারী দানব’ বলে অভিহিত করেন। [iii] সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, এই বিদ্রোহে জনগণের সমর্থন ছিল না।
- বাংলায় বিদ্রোহের দুর্বলতা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত তীব্র হলেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের সমর্থনের অভাবে এই বিদ্রোহ বাংলায় খুব একটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
- পরিণাম : শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা প্রথমদিকে বিদ্রোহকে সমর্থন না করলেও বিদ্রোহ দমনে সরকার যে নিষ্ঠুর দমননীতির আশ্রয় নেয় তা শিক্ষিতদের চোখ খুলে দেয়। তারা উপলব্ধি করে যে, ব্রিটিশ শাসন কখনও ভারতীয়দের কল্যাণ করবে না। এই চেতনা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে।
উপসংহার: সব শিক্ষিত বাঙালিই মহাবিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিল এবং ইংরেজদের সমর্থন বা সহযোগিতা করেছিল—এ কথা বলা ভুল হবে। এই যুগে বিদ্যাসাগরের মতো কিছু ব্যতিক্রমী চরিত্র অবশ্যই ছিল।
- ভারত শাসন আইন: মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ভারত শাসন আইন’ (১৮৫৮ খ্রি.)-এর দ্বারা ভারতে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটায় এবং মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন।
- ঘোষণাপত্র প্রকাশ: মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন নীতি ও আদর্শের কথা প্রকাশ করেন।

- ঘোষণাপত্রের বক্তব্য: মহারানির ঘোষণাপত্রের দ্বারা জানানো হয় যে—–[i] ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। [ii] স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হবে। [iii] দেশীয় রাজাদের দত্তক গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে। [iv] ব্রিটিশরা ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তার করবে না। [v] জাতিধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি যোগ্য ভারতীয়কে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার প্রদান করা হবে। [vi] সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সন্ধিগুলি মেনে চলবে।
উপসংহার: মহারানির ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলি ঘোষণাপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই ক্রমশ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর ক্ষোভ, হতাশা, ঘৃণা বাড়তেই থাকে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – B সভাসমিতির যুগ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার গঠন : উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার প্রসারের ফলে ভারতীয়দের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ হল এই সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম।
- প্রতিষ্ঠা : টাকির জমিদার কালীনাথ রায় চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায়ের বেশ কয়েকজন অনুগামীর উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। যোগেশচন্দ্র বাগল-এর মতে, এটিই ছিল বাঙালি তথা ভারতীয়দের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

- সভাপতি : বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর। সাংবাদিক ও লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৯৯-১৮৫৯ খ্রি.) এই সভায় সভাপতিত্ব করেন।
- প্রতিষ্ঠা : টাকির জমিদার কালীনাথ রায় চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায়ের বেশ কয়েকজন অনুগামীর উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। যোগেশচন্দ্র বাগল-এর মতে, এটিই ছিল বাঙালি তথা ভারতীয়দের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
- বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উদ্দেশ্য:
- সরকারের সমালোচনা:ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অপশাসনের সমালোচনা করা ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার অন্যতম উদ্দেশ্য।
- শোষণের প্রতিবাদ: সরকার এক আইনের দ্বারা নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপ করে। এই কর প্রতিহত করা ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
- জনস্বার্থ রক্ষা: ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে বিভিন্ন আবেদনপত্র জমা দেওয়া বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
- পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে কলকাতার প্রগতিশীল সমাজের একাংশ উদ্যোগী ছিলেন। তারা বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার মাধ্যমে সেই উদ্যোগ সফল করার চেষ্টা করেন।
- ভারতসভার গঠন : উনিশ শতকে ভারতে গড়ে-ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘ভারতসভা’ বা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’।
- প্রতিষ্ঠা: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভার প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন।
- প্রথম অধিবেশন: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভার প্রথম অধিবেশন বসে।
- ভারতসভার উদ্দেশ্য: ভারতসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি ছিল নিম্নরূপ —
- জনকল্যাণ: ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা এবং সার্বিক কল্যাণসাধন করা ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
- জনমত গঠন: ধারাবাহিক প্রচারের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠন ছিল ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
- ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা: ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ও অনৈক্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করতে পারে। এই বিভেদ দূর করে ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ভারতসভার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
- রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা: দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা ছিল ভারতসভা প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
- রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করা: দেশবাসীর মধ্যে প্রচার চালিয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে ভারতসভা উদ্যোগী হয়েছিল।
- গণ আন্দোলন গড়ে তোলা: ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে ‘এদেশে শক্তিশালী গণ আন্দোলন গড়ে তোলাও ছিল ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
- প্রতিষ্ঠা: ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে (১৯ মার্চ) দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে কলকাতায় জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার পর ‘ভূমিমালিক সমিতি’ নামে এটি অধিক পরিচিতি লাভ করে।
- সদস্য : জমিদার সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন জমিদার এবং ধনী ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ বড়ো বড়ো ভূস্বামী। বাংলার ব্যাবসাবাণিজ্যে নিযুক্ত বেসরকারি ব্রিটিশরাও জমিদার সভার সদস্য হতে পারত। তবে সাধারণ মানুষ জমিদার সভার সদস্য হওয়ার বিশেষ সুযোগ পেত না।
- উদ্দেশ্য : জমিদার সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জমিদার শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে সভার সদস্যরা কলকাতার ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা চালায়। তারা লন্ডনের ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং সোসাইটির সভাপতি জর্জ থম্পসনকে লন্ডনে ভূমিমালিক সমিতির প্রতিনিধি নিয়োগ করে।
- কর্মসূচি: জমিদার সভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে— [i] জমিদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানায়। [ii] তারা ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে। [iii] তারা ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানোর দাবি জানায়। [iv] তারা নিষ্কর জমি ভোগদখলের অধিকার পুনঃপ্রবর্তন বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। [v] শাসনসংস্কারের জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানায়। [vi] তারা সরকারের কাছে পুলিশবিভাগ, বিচারবিভাগ ও রাজস্ববিভাগের সংস্কারের দাবি জানায়।
- অবদান : জমিদার সভা ভারতে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার সূচনা করে। এই সভার আবেদনে সরকার ১০ বিঘা পর্যন্ত ব্রশ্নোত্তর জমির খাজনা মকুব করে। ড. রাজেন্দ্রলাল মিত্র মনে করেন যে, জমিদার সভাই ছিল ভারতের স্বাধীনতার অগ্রদূত।
- বিলুপ্তি: বাংলার বাইরে জমিদার সভা তাদের প্রভাব বিস্তারে সফল হয়নি। তা ছাড়া ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জমিদার সভা ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তবে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব কোনোরকমে টিকে ছিল। পরবর্তীকালে এর স্থান দখল করে নেয় বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি।
উপসংহার: জমিদার সভা ছিল একান্তভাবেই জমিদার ও বানিয়াদের একটি সংগঠন। এর সদস্যরা এর আভিজাত্য রক্ষায় সর্বদা যত্নবান থাকতেন। ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনেও তারা সচেষ্ট থাকতেন। তবে এই সংগঠন ভারতে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সংগঠনের অনুকরণে পরবর্তীকালে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। ফলে এদেশে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
- প্রতিষ্ঠা: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভার প্রথম অধিবেশন বসে।

- সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগ : সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভাকে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে লখনউ, মিরাট, লাহোর, সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলে শীঘ্রই ভারতসভার শাখা স্থাপিত হয়।
- কর্মসূচি : ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারতসভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এগুলি হল— [i] ভারতীয়দের জনমত গঠন করা, [ii] রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা, [iii] হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা, [iv] স্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ ভারতীয়দের রাজনৈতিক গণ আন্দোলনে শামিল করা ইত্যাদি।
- আই সি এস পরীক্ষার বয়স নিয়ে আন্দোলন: ব্রিটিশ সরকার আই সি এস বা ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯ বছর করে। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একইসঙ্গে ইংল্যান্ড ও ভারতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ এবং এই পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২২ বছর করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
- লিটনের দমনমূলক আইনের বিরোধিতা: ভারতসভা চরম স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসন লর্ড লিটনের তীব্র দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। যেমন— [i] লিটন দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ভারতসভা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। [ii] লিটন অস্ত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.) প্রণয়ন করে সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করেন। এর বিরুদ্ধে ভারতসভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে পরবর্তী বড়োলাট লর্ড রিপন এই আইন প্রত্যাহার (১৮৮১ খ্রি.) করেন।
- ইলবার্ট বিল আন্দোলন: লর্ড রিপন-এর (১৮৮০-৮৪ খ্রি.) পূর্বে এদেশে কোনো ভারতীয় বিচারক কোনো ইংরেজের বিচার করার অধিকারী ছিল না। রিপন ইলবার্ট বিল-এর দ্বারা ভারতীয় বিচারকদের এই অধিকার দিলে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা এই বিলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। বিলের সমর্থনে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতসভাও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
- অন্যান্য আন্দোলন: কৃষকদের ওপর সরকার ও জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার, শোষণমূলক আমদানি ও শুল্ক আইন, সম্পদের নিষ্ক্রমণ, আসামের চা-বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে ভারতসভা আন্দোলন চালায়। ভারতসভা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-পরিষদ গঠন, স্বায়ত্ত্বশাসন প্রবর্তন, প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন, মদ্যপান নিবারণ প্রভৃতির দাবিতেও আন্দোলন সংগঠিত করে।
উপসংহার: ভারতসভার নেতৃবৃন্দের সহায়তায় এবং সুরেন্দ্রনাথের সক্রিয় উদ্যোগে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বা অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ড. অমলেশ ত্রিপাঠী সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনকে ‘জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া’ বলে অভিহিত করেছেন। কেন-না, এই সম্মেলনের প্রেরণায় অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসলে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশনে যোগ দেন। এর ফলে কংগ্রেস অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- রাজনৈতিক আন্দোলনের তাগিদ : মহাবিদ্রোহের পর দ্রুত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। এই সময় ভারতীয়রা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
- সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা : উনিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকে এদেশে নানা সভাসমিতি গড়ে উঠতে থাকে। প্রথমে বাংলায় এবং পরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও অনুরূপ সভাসমিতি গড়ে উঠতে থাকে।
- নামকরণ : উনিশ শতকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের উদ্যোগে একের পর এক সভাসমিতি গড়ে ওঠার জন্য কেম্ব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ড. অনিল শীল এই যুগকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।
- বিভিন্ন সভাসমিতি : উনিশ শতকে ভারতে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—[i] বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, [ii] জমিদার সভা, [iii] ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, [iv] হিন্দুমেলা, [v] ভারতসভা, [vi] জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি।
উপসংহার: উনিশ শতকে গড়ে ওঠা সভাসমিতিগুলি নিজেদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের পক্ষে নানান দাবিদাওয়া আদায়ে সচেষ্ট হয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠতে থাকে।
- বাংলায় সূত্রপাত : ব্রিটিশ শাসনকালে সর্বপ্রথম বাংলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। পরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও অনুরূপ সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে।
- উদ্দেশ্য : ভারতীয়দের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এইসব সভাসমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে সভাসমিতিগুলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া পেশ করত।
- উচ্চবিত্তদের প্রাধান্য : সাধারণত সমাজের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তরাই এইসব সংগঠনের সদস্য হতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন।
- সীমিত প্রভাব : এই সময়ের রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলির প্রভাব ছিল খুবই সীমিত। দেশের সাধারণ দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে এবং গ্রামাঞ্চলে এর বিশেষ প্রভাব পড়েনি।
- ধীরগতির কার্যকলাপ : প্রথমদিকের সংগঠনগুলির রাজনৈতিক কার্যকলাপের গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। প্রকৃতপক্ষে ‘ভারতসভা’ (১৮৭৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনগুলির রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: উনিশ শতকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সভাসমিতি ভারতবাসীর রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত এই সমিতিগুলি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিজেদের কর্মকাণ্ডে শামিল করতে পারেনি।
- যুক্তিতর্কের সুযোগ : ব্রিটিশদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলিতে যেমন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্ক চলত, তেমনই বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতেও যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে আলোচনা চলত।
- ভারতীয়দের স্বার্থের অনুকূল বিষয়ের আলোচনা: ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের যেসব কাজকর্মে ভারতীয়দের স্বার্থ জড়িত ছিল, সেসব বিষয় নিয়ে এই সভায় আলোচনা হত।
- করের বিরোধিতা: ব্রিটিশ সরকার ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের দ্বারা নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপ করলে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা এর প্রতিবাদ করে।
উপসংহার: রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে যেসব চিন্তা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, ভারতে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাই প্রথম সেসব বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য এই প্রতিষ্ঠানকে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়।
- প্রতিষ্ঠা : পণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তাঁর সহযোগিতায় নবগোপাল মিত্র (১৮৪০-৯৪ খ্রি.) ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে চৈত্র সংক্রান্তির দিন কলকাতায় হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য সংগঠনটি ‘চৈত্রমেলা’ নামেও পরিচিত ছিল। হিন্দুমেলার প্রথম সম্পাদক হন জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সহ-সম্পাদক হন নবগোপাল মিত্র।
- উদ্দেশ্য : ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল—[i] সাধারণ মানুষের মধ্যে হিন্দুধর্মের অতীত গৌরবগাথা ছড়িয়ে দেওয়া, [ii] দেশীয় ভাষা চর্চা করা, [iii] জাতীয় প্রতীকগুলিকে মর্যাদা দেওয়া, [iv] এদেশে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার প্রতিরোধের চেষ্টা করা, [v] দেশবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা জাগিয়ে তোলা প্রভৃতি।
- বার্ষিক সম্মেলন : হিন্দুমেলার প্রথম বার্ষিক সভায় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মলিন মুখচন্দ্র মা ভারত তোমারি’ গানটি গাওয়া হয়। পরবর্তী বার্ষিক সভাগুলিতে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গাও ভারতের জয়’ গানটি গাওয়া হত। এই গানটি দেশপ্রেমিকদের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে।
- রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্ব: সেই সময়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসু ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় ১৪ বছরের কিশোর রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা ‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
- বিশিষ্ট সদস্য: ‘হিন্দুমেলা’র সদস্যদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা কমলকৃয় বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রমানাথ ঠাকুর, পিয়ারি চরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্টদাস পাল প্রমুখ।
উপসংহার: একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হিন্দুমেলা বা চৈত্রমেলা ভারতের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল পাশাপাশি দেশের যুবসম্প্রদায়কে ঐতিহ্যমুখী করে তুলতেও হিন্দুমেলার অবদান অনস্বীকার্য।
- হিন্দুধর্মের ঐতিহ্য প্রচার : ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে প্রচার করা।
- পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অগ্রগতি রোধ: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্রুতগতিতে প্রসারিত হতে থাকে। হিন্দুমেলার মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
- দেশাত্মবোধের প্রসার : ভারতবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা জাগিয়ে তোলা হিন্দুমেলার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যে হিন্দুমেলার পরিচালকরা দেশীয় ভাষা চর্চা, জাতীয় প্রতীকগুলিকে মর্যাদা দান, দেশের জয়গান গাওয়া, দেশাত্মবোধক কবিতা পাঠ, দেশীয় শিল্পের প্রসার, দেশীয় শরীরচর্চা প্রভৃতির উদ্যোগ নেয়।
উপসংহার: হিন্দুমেলার কার্যাবলির মধ্য দিয়ে এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়িত হয়েছিল। হিন্দুমেলা প্রাদেশিকতার গণ্ডি অতিক্রম করে ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা ও দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
- হিন্দুধর্মের প্রাধান্য: ‘হিন্দুমেলা’য় হিন্দুধর্মকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে নবগোপাল মিত্র হিন্দু-ভারতের পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিন্দুমেলার এই ভাবধারাকে সমর্থন করেনি।
- রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভাব: হিন্দুমেলা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে শুধু দেশাত্মবোধের প্রচারের উদ্যোগ নেয়। এই কারণে তা ফলপ্রসূ হয়নি।
- ভারতসভার জনপ্রিয়তা: হিন্দুমেলার পরবর্তীকালে ‘ভারতসভা’র প্রতিষ্ঠার পর এই সভা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতসভার উপস্থিতিতে হিন্দুমেলা ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে থাকে।
- সক্রিয়তার অভাব: ১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশবিরোধী যে সক্রিয়তার প্রয়োজন ছিল হিন্দুমেলা সেই সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ হিন্দুমেলা থেকে দূরে সরে যায়।
উপসংহার: বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতীয়দের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ও জাতীয়তাবাদ প্রসারে হিন্দুমেলা বা চৈত্রমেলার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। এই সংগঠন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের দ্বারা সবার জন্য উন্মুক্ত করার কাজে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়।
- আই সি এস-এর বয়স নিয়ে আন্দোলন: ব্রিটিশ সরকার আই সি এস পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করলে ভারতসভা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। তারা পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২২ বছর করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।
- সংবাদপত্র আইনের বিরোধিতা: বড়োলাট লর্ড লিটন ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ভারতসভা এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
- অস্ত্র আইনের বিরোধিতা: লর্ড লিটন অস্ত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.) প্রণয়ন করেন। এই আইনে ভারতীয়দের সরকারের অনুমতি ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ হয়। এর বিরুদ্ধে ভারতসভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে পরবর্তী বড়োলাট লর্ড রিপন এই আইন প্রত্যাহার (১৮৮১ খ্রি.) করেন।
- ইলবার্ট বিল আন্দোলন: লর্ড রিপন ‘ইলবার্ট বিল’-এর দ্বারা ভারতীয় বিচারকদের ইংরেজদের বিচার করার অধিকার দিলে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা বিলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে বিলের সমর্থনে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতসভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
- কৃষকদের স্বার্থে আন্দোলন: কৃষকদের ওপর সরকার ও জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার, শোষণমূলক আমদানি ও শুল্ক আইন, সম্পদের নিষ্ক্রমণ, আসামের চা-বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে ভারতসভা আন্দোলন চালায়।
- অন্যান্য আন্দোলন: ভারতসভা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-পরিষদ গঠন, স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন, প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন, মদ্যপান নিষিদ্ধ করা প্রভৃতির দাবিতেও আন্দোলন চালায়।
- স্বদেশি আন্দোলন: ভারতসভা বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫ খ্রি.) বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ভারতসভা একটি ‘জাতীয় ভাণ্ডার’-ও গড়ে তোলে।
উপসংহার: উপরিউক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও ভারতসভা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-পরিষদ গঠন, স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন, প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন, মদ্যপান নিষেধ করা প্রভৃতির দাবিতেও আন্দোলন চালিয়েছিল। ভারতসভা প্রকৃত অর্থে জাতীয় কংগ্রেসের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছিল।
- দেশব্যাপী প্রচার : ভারতসভাকে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেন।
- বিভিন্ন শাখা স্থাপন : সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে লখনউ, মিরাট, লাহোর, সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলে শীঘ্রই ভারতসভার বেশ কিছু শাখা স্থাপিত হয়।
- আন্দোলনে নেতৃত্বদান: সুরেন্দ্রনাথ ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ভারতসভাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। [i] তিনি আই সি এস পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২২ বছর করার দাবি জানান। [ii] লর্ড লিটন কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ ও ‘অস্ত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.)-এর বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। [iii] তিনি ইলবার্ট বিল-এর সমর্থনে আন্দোলন গড়ে তোলেন। [iv] কৃষকদের স্বার্থরক্ষার দাবিতেও তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন।
- সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন: সুরেন্দ্রনাথের সক্রিয় উদ্যোগে কলকাতায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বা অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়।
- কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা : ড. অমলেশ ত্রিপাঠী ‘সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন’-কে ‘জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা, এই সম্মেলনের প্রেরণায় অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।
- কংগ্রেসকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা: ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসলে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশনে যোগ দেন। এর ফলে কংগ্রেস অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
উপসংহার: জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে সুরেন্দ্রনাথই প্রথম ভারতবাসীকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পরে কংগ্রেস গড়ে উঠলে তিনি সদলবলে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ভারতীয়দের রাজনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। তাঁকে ‘রাষ্ট্রগুরু’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
- ইলবার্ট বিলের মূল কথা: বিচারব্যবস্থায় বর্ণবৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে রিপনের পরামর্শে তাঁর আইনসচিব ইলবার্ট একটি বিল রচনা করেন। এতে ভারতীয় বিচারকরা শ্বেতাঙ্গদের বিচার করারও অধিকার পায়। এটি ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত।
- সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা : ইলবার্ট বিলের দ্বারা ভারতীয় বিচারকরা শ্বেতাঙ্গদেরও বিচার করার অধিকার পেলে ইউরোপীয় ও ভারতীয় বিচারকদের মধ্যে সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- শ্বেতাঙ্গদের ক্ষোভ ও আন্দোলন : লর্ড রিপন ইলবার্ট বিলের মাধ্যমে ভারতের কৃষ্ণাঙ্গ বিচারকদের শ্বেতাঙ্গদের বিচার করার অধিকার দিলে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়। ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গরা শীঘ্রই তীব্র আন্দোলন শুরু করে। তারা কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার ব্রানসনের নেতৃত্বে ‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলন চালাতে থাকে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্দোলন চালানোর উদ্দেশ্যে তারা দেড় লক্ষ টাকার বেশি চাঁদা সংগ্রহ করে। বহু স্থানে আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয় এবং রিপনের প্রাণ সংশয়ের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
- ভারতসভার আন্দোলন: ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা আন্দোলন শুরু করলে লালমোহন ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারতসভা ইলবার্ট বিলের সমর্থনে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিলের সমর্থনে দেশের নানা প্রান্তে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
- লেখনীতে প্রতিবাদ: ইলবার্ট বিলের সমর্থনে ‘অমৃতবাজার’ এবং ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকায় প্রচার চলতে থাকে। বিলটির বিষয়ে ইউরোপীয়দের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করা হয়। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নেভার নেভার’ কবিতায় ইংরেজদের বিদ্রূপ করে লেখেন—
গেল রাজ্য, গেল মান, হাঁকিল ইংলিশম্যান,ডাক ছাড়ে ব্রানসন, কেসুরিক, মিলার—নেটিভের কাছে খাড়া, নেভার, নেভার।
- পরিণতি: সরকার শেষপর্যন্ত ইউরোপীয়দের কাছে নতি স্বীকার করে বিলটিতে প্রচুর সংশোধন করে। ফলে বিলটির আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
উপসংহার: ইলবার্ট বিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মনে করেন যে, বিলটিকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিলটির দ্বারা ভারতীয়রা ব্রিটিশদের প্রকৃত চেহারা চিনতে পারে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC -C লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- গ্রন্থের রচনাকাল: ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচনা করেন।
- ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা: বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ভারতের ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি এদেশে ব্রিটিশ শাসনের করুণ অবস্থাটিকে তাঁর রচনায় ফুটিয়ে তোলেন এবং ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকল ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
- দেশকে মা বলে সম্বোধন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশভূমিকে ‘মা’ বলে অভিহিত করেছেন। ফলে উপন্যাসটি স্বদেশপ্রেমের একটি নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।
- নারীদের প্রতি সম্মান : ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র নারী জাতিকে সম্মান করেছেন। কল্যাণী, বীণা প্রভৃতি নারী চরিত্রের জীবনধারা ও সংগ্রামশীল মানসিকতার মধ্যে তিনি সমগ্র নারীজাতির অন্ধকারময় দিকটি তুলে ধরেছেন এবং ভারতের সমগ্র নারীজাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন।

- বন্দেমাতরম মন্ত্রের উদ্ভাবন : ‘বন্দেমাতরম’ হল ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগীত যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘জাতীয় মন্ত্রে’ পরিণত হয়। বিপ্লবীরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে থাকে। ‘বিপ্লববাদের জননী’ রূপে পরিচিত ভিকাজি রুস্তমকামা (মাদাম কামা) ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পরাধীন ভারতে ‘জাতীয় পতাকা’ তৈরি করলে সেখানে ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রটি স্থান পায়।
- সন্তান দলের আদর্শ প্রচার : বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে একটি সন্তান দলের কল্পনা করেছেন। এই দল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, মুখে বন্দেমাতরম মন্ত্র নিয়ে কামানের সামনে রুখে দাঁড়ায়। সন্তান দল কল্পনার মধ্য দিয়ে তিনি ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছেন।
- পাশ্চাত্য শিক্ষার সমালোচনা: বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতীয়দের ব্রিটিশ করণিক তৈরি করতে পারবে, কিন্তু এই শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো মানুষই ব্রিটিশ বিরোধিতায় অংশ নেবে না।
- দেশপ্রেমের প্রতিষ্ঠা : বঙ্কিমচন্দ্র সর্বদা দেশকে ঈশ্বর ও মা হিসেবে পুজো করেছেন। তিনি বলতেন—“Patriotism is Religion and Religion is Patriotism”, অর্থাৎ দেশপ্রেমই হল ধর্ম এবং ধর্মই হল দেশপ্রেম।
উপসংহার: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল। এই গ্রন্থটি ভারতবাসীর কাছে জাতীয়তাবাদের গীতা হিসেবে গণ্য হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশংসা করে বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঋষি’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে, তিনি শুধু সাহিত্য সৃষ্টি করেননি, তিনি একটি জাতির সৃষ্টি করেছেন।
- আত্মবিশ্বাস : স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে পরাধীনতার গ্লানি দূর করে আত্মবিশ্বাসী হতে বলেন। তিনি ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে দেশবাসীকে বলেন, “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই—ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।”
- স্বদেশের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা : বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের নিন্দা করেন এবং ভারতবাসীকে নিজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আস্থাবান হতে বলেন।
- ভারতমাতার বন্দনা: বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে বলেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। এখানে মা বলতে তিনি দেশমাতাকে বুঝিয়েছেন। তিনি ভারতবাসীকে বলেন যে, অন্যান্য দেবদেবী বাদ দিয়ে আগামী ৫০ বছর ভারতমাতাই যেন সবার একমাত্র আরাধ্য দেবী হন। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন, “যে দেশপ্রেম বঙ্কিমচন্দ্রে ছিল কবিকল্পনা, বিবেকানন্দের রচনায় তা একটি অবয়ব নিল।”
- শিকাগো বক্তৃতা: বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে আয়োজিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে উপস্থিত থেকে সেখানে ভারতের অদ্বৈত বেদান্তের কথা বিশ্ববাসীকে শোনান এবং বিশ্ববাসী ভারতের উদার ধর্মীয় ঐতিহ্যের কথা শুনে মুগ্ধ হয়। এতে ভারতীয় ঐতিহ্যের মর্যাদা বাড়ে।
- মানবধর্ম প্রচার : বিবেকানন্দ জাতিগঠনের উদ্দেশ্যে মানবধর্মের কথা বলেন। তাঁর ধর্ম হল ‘মানুষ তৈরির ধর্ম’। এই মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যেই তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
- নবভারতের স্বপ্ন: বিবেকানন্দ ভারতের সাধারণ শ্রমজীবী ও তথাকথিত নীচজাতির উন্নতির মাধ্যমে এক নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি বলেন, “নূতন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ-জঙ্গল পাহাড়-পর্বত থেকে।”
- ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন: বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে জাতিভেদ ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে বলেন। তিনি বলেন যে, অতীতের বিভিন্ন যুগে ভারতে শূদ্ররা নিপীড়িত হয়েছে। কালের চক্রেই একদিন শূদ্ররা ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। তাই বিভেদ নয়, একতাই ভারতের উন্নতির একমাত্র পথ।
উপসংহার: ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের অসামান্য ভূমিকার কথা স্মরণ করে ঐতিহাসিক আর জি প্রধান তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ বলেছেন, “বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবন গঠনকর্তা। তিনিই ইহার প্রধান নেতা।”
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

- গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বর্ণনা: স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে বৈদিক যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন।
- ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: বিবেকানন্দ উপলব্ধি করতেন যে, পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্য প্রয়োজন ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা। তিনি ভারতীয় সমাজের বর্ণবৈষম্য ও দলিত বা শূদ্রদের প্রতি বঞ্চনার তীব্র নিন্দা করে সকল ভারতীয়ের ঐক্যের কথা বলেছেন।
- শূদ্র জাগরণের প্রত্যাশা : বিবেকানন্দ বলেছেন যে, বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত শূদ্রদের দমিয়ে রাখা হয়েছে। তাই এবার ভারতে শূদ্র জাগরণ ঘটবে এবং শূদ্র-সহ সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্য থাকবে।
- দেশপ্রেমের আদর্শ : বিবেকানন্দ তাঁর গ্রন্থে ভারতবাসীকে স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তিনি বলেন—“ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, …. ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।” তাঁর আকুল আহ্বানে যুবসমাজের মনে স্বদেশপ্রেমের ঝড় বয়ে যায়।
- দেশমাতার মুক্তি : ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে বিবেকানন্দ বলেছেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছেড়ে তিনি ভারতমাতার মুক্তির জন্য দেশবাসীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। দেশমাতার কাছে তিনি আবেদন জানান, “আমায় মানুষ করো।”
উপসংহার: বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে স্বদেশপ্রেমের যে আদর্শ ও বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন তা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে অন্য মাত্রা এনেছিল।
- প্রকৃত ভারতের রূপ: ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতে গিয়ে ভারতবর্ষের সত্যিকারের রূপটি চিনতে পারে।
- গোরার উদ্যোগ: গোরা উপলব্ধি করে, শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চেয়ে পল্লিগ্রামের মানুষ অনেক বেশি সহজসরল। কিন্তু যথাযথ শিক্ষার প্রসার না ঘটার ফলে এদের মধ্যে অনেকেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এরা প্রয়োজনে মানুষকে সহায়তা বা বিপদে ভরসা না দিয়ে বরং সামাজিক আচারবিচারের কথা বলে মানুষে-মানুষে বিভাজন তৈরি করে। গোরা এরূপ সমাজের ওপর তীব্র আঘাত হেনে তাকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছে।
- ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্বহীনতা: ভারতীয় সভ্যতার প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ করে গোরা একসময় উগ্র হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু পরে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সে উপলব্ধি করে, ধর্মীয় পরিচয় একমাত্র বা সবচেয়ে বড়ো পরিচয় নয়।
- ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা : রবীন্দ্রনাথের গোরা সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়। সে সংকল্প করে, স্বদেশের প্রতি স্বদেশবাসীর শ্রদ্ধা সে ফিরিয়ে আনবেই, তারপর অন্য কাজ। হিন্দুসভ্যতার বিরোধী জনৈক মিশনারির বিরুদ্ধে সে সম্মুখ বিতর্কে অংশগ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নেয়।
- দেশাত্মবোধের প্রচার : মহিম বা কৃষ্ণদয়ালের মতো দু-একজন স্বার্থপর ব্যক্তি ছাড়া ‘গোরা’উপন্যাসে উল্লেখিত ব্রা সমাজের অধিকাংশ সদস্যই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। “মা, তুমিই আমার মা’, “আমি ভারতীয়”—গোরার এসব উক্তি ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা হলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক। মূলত তার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসীর মধ্যে প্রকৃত স্বদেশপ্রেমের আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন।
- প্রেক্ষাপট: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের সমান্তরাল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই উদ্দেশ্যে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫ খ্রি.) সময় হিন্দুদের ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর অনুকরণে তিনি ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি অঙ্কন করেন।
- স্বদেশিয়ানার বিকাশ : অবনীন্দ্রনাথের চতুর্ভুজা ‘ভারতমাতা’-র চার হাতে রয়েছে বেদ, ধানের শিষ, জপের মালা ও শ্বেতবস্ত্ৰ । এগুলি মূলত ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এগুলির দ্বারা শিল্পী স্বদেশি আন্দোলনের যুগে দেশবাসীর মনে স্বদেশিয়ানা ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
- শান্তির প্রতীক হিসেবে গুরুত্ব: অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’-র হাতে কোনো অস্ত্র নেই। এর দ্বারা অবনীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশি ভাবনায় সশস্ত্র আন্দোলনকে দূরে রেখেছেন।
- জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার : বিশ শতকের ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে মিছিলের সামনে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি রাখা হত। নবজাগ্রত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনই ছিল ‘ভারতমাতা’ অঙ্কনের অনুপ্রেরণা।

- বিতর্ক: ‘ভারতমাতা’র চিত্রটির মধ্যে কেউ কেউ হিন্দু স্বাদেশিকতার প্রভাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ বাস্তবে হিন্দু স্বাদেশিকতার উগ্র সমর্থক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। ভগিনী নিবেদিতা ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন।
উপসংহার: ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী স্বদেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। এই চিত্রটির মধ্য দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ভারতবাসীর সামনে অহিংস জাতীয়তাবাদের প্রতিচ্ছবিটি তুলে ধরেছেন।
- বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্র: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র সংকলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘অদ্ভুত লোক’ (১৯১৫ খ্রি.), ‘বিরূপ বজ্ৰ’ (১৯১৭ খ্রি.) এবং ‘নয়া হুল্লোড় (১৯২১ খ্রি.)। তাঁর আঁকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র হল জাতাসুর, পরভৃতের কাকলি, বিদ্যার কারখানা, বাক্যন্ত্র প্রভৃতি।
- উচ্চবিত্তদের সমালোচনা : গগনেন্দ্রনাথের বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রে সমাজের ধনী ও অভিজাত শ্রেণির ক্রিয়াকলাপের সমালোচনা করা হয়েছে। তাদের অহংকার, সামাজিক চালচলন, রীতিনীতি, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব প্রভৃতি নানা বিষয় ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে নিন্দার দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে।

- ‘বাবু’ সংস্কৃতির সমালোচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ‘বাবু’ নামে পরিচিত শিক্ষিত ও পাশ্চাত্যের অনুরাগী একশ্রেণির বাঙালির সমালোচনা ফুটে উঠেছে গগনেন্দ্রনাথের চিত্রে। একটি কার্টুনে দেখা যায় যে, এক বাঙালি বাবু ‘সাহেব’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইলেও সমাজে তিনি ‘বাবু’ বলেই পরিচিত হন। বিবাহ সম্পর্কে বাঙালিদের দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে উঠে এসেছে।
- পাশ্চাত্যানুরাগের সমালোচনা: পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধ ভক্ত একশ্রেণির বাঙালির সমালোচনা ফুটে উঠেছে গগনেন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিত্রে। একটি চিত্রে দেখা যায়, একজন বাঙালি নারী বাংলার শাড়ি এবং ইউরোপের জুতো পরে ইউরোপীয় পুরুষের সঙ্গে নৃত্য করছেন।
- নিম্নরুচির সমালোচনা: সমকালীন কিছু বাঙালির নিম্নরুচি গগনেন্দ্রনাথের চিত্রে নিন্দিত হয়েছে। ‘খল ব্রাহ্মণ’ চিত্রটিতে দেখা যায়, জনৈক ব্রাক্ষ্মণ ধর্মের প্রতি অনুরাগের পরিবর্তে মাংস, মদ ও মহিলায় অনুরক্ত।
- নারীর প্রতি কুদৃষ্টির সমালোচনা: নারীজাতির দুর্দশার চিত্র গগনেন্দ্রনাথের কোনো কোনো ব্যঙ্গচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। একটি চিত্রে তিনি স্বামীর মত্ততা এবং তার স্ত্রীর আচরণ সম্পর্কে এঁকেছেন।
- জাতপাতের সমালোচনা: ‘জাতাসুর’ নামে একটি ব্যঙ্গচিত্রে গগনেন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজব্যবস্থার জাতপাত ও বর্ণবৈষম্য ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন।
উপসংহার: ব্যঙ্গচিত্রের মধ্য দিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। চিত্রশিল্পে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরিয়ে ব্যঙ্গচিত্রকে ঔপনিবেশিক সমালোচনার হাতিয়ার করে তিনি ‘ব্যঙ্গচিত্রের জনক’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC D বিবিধ
অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর
- স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ : লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা ঝাঁসি, সাতারা, নাগপুর, সম্বলপুর, তাঞ্জোর, কর্ণাটক-সহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য দখল করলে সেসব রাজ্যের রাজারা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়।
- অর্থনৈতিক শোষণ : ব্রিটিশ শাসনে ভারতে চরম অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হয়। রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়, কুটির শিল্প ধ্বংস হলে বেকারত্ব বাড়ে।
- ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সর্বত্র ইংরেজরা ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখত। বহু ইউরোপীয় ক্লাবের দরজায় লেখা থাকত ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।
- ভারতীয় কর্মচারীদের অবজ্ঞা : ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা ভারতীয় রাজকর্মচারীদের খুবই ঘৃণা ও হেনস্থা করত।
- ভারতীয়দের রক্ষণশীল মনোভাব: ভারতীয়রা এদেশে বিদেশি শ্বেতাঙ্গ শাসন কখনোই মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। মুঘল শাসনের পতন ঘটানোর জন্য মুসলিমরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। আবার সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন প্রভৃতির জন্যও রক্ষণশীল হিন্দুরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল।
- ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি বৈষম্য: ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সেনারা নানা বৈষম্যের শিকার হয়। ব্রিটিশ সেনারা ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে নানা দুর্ব্যবহার করত।
- ধর্মীয় অসন্তোষ : খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রকাশ্যে ভারতীয়দের ধর্মের নিন্দা করত এবং তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালাত।
- প্রত্যক্ষ কারণ : সরকার সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড নামক রাইফেল চালু করে। গোরু ও শূকরের চর্বি মিশিয়ে এর টোটা তৈরি হত বলে গুজব ছড়ায়। এই টোটা দাঁত দিয়ে কেটে ধর্মনাশের আশঙ্কায় ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ শুরু করে।
উপসংহার: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০০ বছর পর অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধের এক শতাব্দী পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই বিদ্রোহ ছিল এক গণ অভ্যুত্থান। তবে প্রথম দিকে এই বিদ্রোহ সাফল্য লাভ করলেও পরে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
- বহরমপুরে বিক্ষোভ: সর্বপ্রথম মুরশিদাবাদের বহরমপুর সেনানিবাসের ১১ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহিরা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিক্ষোভ দেখায়।

- মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহ ঘোষণা : ব্যারাকপুর সেনানিবাসের ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহিরা অভ্যুত্থান ঘটায়। এখানকার সিপাহি মঙ্গল পান্ডে (১৮২৭-৫৭ খ্রি.) ২৯ মার্চ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সরকার মঙ্গল পাণ্ডেকে গ্রেফতার করে। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। তিনি হলেন বিদ্রোহের প্রথম শহিদ।
- সেনা বিদ্রোহের প্রসার ব্যারাকপুরের সেনা অভ্যুত্থানের খবর শীঘ্রই দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১০ মে মিরাট এবং ১১মে দিল্লি সেনানিবাসে বিদ্রোহ শুরু হয়।
- জনগণের অংশগ্রহণ: সিপাহি বিদ্রোহ ক্রমে অযোধ্যা, কানপুর, লখনউ, এলাহাবাদ, মোরাদাবাদ, ফৈজাবাদ, ঝাঁসি, পাটনা প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার: ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ মূলত উত্তর ভারত জুড়েই হয়েছিল, দক্ষিণ-ভারতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
- বিদ্রোহের বিচ্ছিন্নতা: ভারতের সর্বত্র একযোগে বিদ্রোহ না হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। ফলে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে বিদ্রোহ দমন সহজ হয়।
- শিখ-গোর্খাদের সহযোগিতা: বিদ্রোহের সময় শিখ, গোর্খা প্রভৃতি সৈন্যরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সমর্থন জানায় এবং বিদ্রোহ দমনে সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা করে।
- নেতৃত্বের অভাব: বিদ্রোহ পরিচালনা করার মতো কোনো সর্বভারতীয় নেতৃত্ব ছিল না। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নেতারা ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ বা পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্রোহ পরিচালনা করলে বিদ্রোহ তার গতি হারিয়ে ফেলে।
- দেশীয় রাজ্যের সহযোগিতা: কাশ্মীর, রামপুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সহযোগিতা করে। সিন্ধিয়া ও রাজপুত রাজারা বিদ্রোহীদের সহযোগিতা না করে নিরপেক্ষ নীতি নেয়। ফলে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সুবিধা হয়।
- শিক্ষিত শ্রেণির অসহযোগিতা: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ১৮৫৭-এর বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন না জানিয়ে বিদ্রোহ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে এবং ইংরেজদের প্রতি অনুরাগ দেখায়। ফলে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সুবিধা হয়।
- দক্ষ সেনানায়কের অভাব: বিদ্রোহীদের মধ্যে দক্ষ ও যোগ্য সেনানায়কের যথেষ্ট অভাব ছিল। অন্যদিকে ইংরেজ বাহিনীতে হ্যাভেলক, নীল, আউট্রাম প্রমুখ সুদক্ষ সেনাপতিগণ ছিলেন।
- ব্রিটিশ-শক্তির পরাক্রম: সিপাহিদের তুলনায় ব্রিটিশবাহিনীর অস্ত্রশক্তি ও নৌশক্তি অনেক বেশি ছিল। ব্রিটিশরা ইংল্যান্ড, পারস্য ও মালয় থেকে বহু সৈন্য ও অস্ত্র এনে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে।
উপসংহার: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও এটি ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ সংগ্রাম। এই বিদ্রোহের পরই ভারতে কোম্পানিরাজের অবসান ঘটে এবং সূচনা হয় ব্রিটিশরাজের।
- সংবাদপত্র: উনিশ শতকে প্রথম বঙ্গদেশে এবং পরে অন্যান্য প্রদেশে সংবাদপত্রের প্রকাশ শুরু হয়। ‘সমাচার দর্পণ’, ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ‘সমাচার চন্দ্ৰিকা’, ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘বামাবোধিনী’, ‘বঙ্গদর্শন’ প্রভৃতি সংবাদপত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। এর ফলে ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে।
- রাজনৈতিক সংগঠন: উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জমিদার সভা, পুনা সার্বজনিক সভা, হিন্দুমেলা, ভারতসভা, জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি। এসব সংগঠন নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে।
- দেশাত্মবোধক সাহিত্য: ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয় সাহিত্যিকদের লেখা বিভিন্ন সাহিত্য ও গ্রন্থ দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবোধের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করে। যেমন— দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’, ‘স্বামী বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা ‘স্বাধীনতা হীনতায়’ প্রভৃতি।
- দেশাত্মবোধ চিত্রকলা: ঔপনিবেশিক আমলের শেষ শতকে বিভিন্ন ভারতীয় চিত্রকর দেশাত্মবোধক বিভিন্ন ছবি আঁকেন। এগুলিও ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধের বিকাশে সহায়তা করে। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’, ‘ভারতমাতা’ প্রভৃতি।
