wb 10th Sst

WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 5 বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ-বিশ শতকের প্রথমভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 5 বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ-বিশ শতকের প্রথমভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 5 বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ-বিশ শতকের প্রথমভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

West Bengal Board 10th History Solutions

একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি

  1. ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। এই সময় এদেশে আধুনিক ছাপাখানা, পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতির প্রসার ঘটে।
  2. অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ভারতের অন্যান্য স্থানে ছাপাখানা স্থাপিত হয়। জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এবং চার্লস উইলকিনস ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চানন কর্মকার, সুরেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ উন্নত বাংলা অক্ষরের টাইপ তৈরি করেন।
  3. বাংলায় আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সুলভে প্রচুর মুদ্রিত বইপত্র সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার শুরু হয়। শ্রীরামপুরের ছাপাখানা-সহ হিন্দুস্তানি প্রেস, পারসিয়ান প্রেস ও সংস্কৃত প্রেস থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বইপত্র ছাপা হত। এসব বইপত্র সস্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেলে শিক্ষার প্রসারের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
  4. উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে ছাপাখানা (১৮০০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এখান থেকে বাংলা, হিন্দি-সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেল এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ, বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রভৃতি মুদ্রিত দেশবাসীর হাতে পৌঁছে যেতে থাকে।
  5. শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে গ্রামবাংলার সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড বাংলায় গণশিক্ষা প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে ‘শিশুশিক্ষা’, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বাল্যশিক্ষা প্রভৃতি প্রাথমিক শিক্ষা-বিষয়ক বইপত্রের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
  6. ছাপাখানার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণশিল্পের ব্যাবসায়িক বাজার গড়ে ওঠে। ছাপাখানাগুলিতে বিভিন্ন বইপত্র, সংবাদপত্র, মিলিটারি বিল, ভাতার ফর্ম, সামরিক বাহিনীর বিধিবিধান প্রভৃতি ছাপার কাজ চলতে থাকে। বইপত্র ছাপা, বাঁধাই প্রভৃতি কাজের সঙ্গে প্রচুর লোক যুক্ত হয়ে পড়েন। বইপত্র ও সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা গড়ে ওঠে। ক্রমে বই, সংবাদপত্র প্রভৃতি বিক্রির এক সুগঠিত বাজার গড়ে ওঠে।
  7. মুদ্রণশিল্পের উন্নতিতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি ছাপাখানা এবং ছাপাখানার সঙ্গে একটি স্টুডিয়ো প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এখান থেকেই ভারতে প্রসেস প্রিন্টিং শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। তিনি উন্নতমানের ছবি ছাপার কৌশল উদ্ভাবন করেন এবং হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। সাদাকালোর যুগে তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় রঙিন ছবি ছাপতে শুরু করেন।
  8. মুদ্রণশিল্পের বিকাশের পরবর্তীকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট, কলকাতার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন, যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদি।
  9. ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটে। এই শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভারতীয় চিন্তাবিদ সরব হয়ে দেশীয় ধাঁচে শিক্ষার উন্নতির চেষ্টা করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির থেকে পৃথক, পরিকাঠামোগতভাবে অভিনব এক শিক্ষানীতির বিষয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান।
  10. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নিজস্ব শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দ্বারা দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন পথ দেখান। তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে ব্রত্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কলাবিদ্যার পাশাপাশি এখানে অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ সমস্ত ব্যাবহারিক বিজ্ঞানের পাঠদান শুরু হয়।
  11. রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষানীতিতে প্রকৃতি ও মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। তিনি প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য প্রকৃতির সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি। পল্লিগ্রামের মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি কৃষিকাজের উন্নতির বিষয়ে নানা ভাবনাচিন্তা করেন।

TOPIC – A বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. * ছাপাখানায় মুদ্রিত বইপত্রের মাধ্যমে বাংলায় কীভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটে?
উত্তর – ছাপাখানায় বইয়ের মুদ্রণ ও বাংলায় শিক্ষার প্রসার
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় আধুনিক ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয় এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে ছাপাখানার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এসব ছাপাখানায় শিক্ষার্থীদের উপযোগী বহু বইপত্র ছাপা হয়ে তাদের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে বাংলায় শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটতে শুরু করে।
  1. প্রেক্ষাপট : বঙ্গদেশে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগে হাতে লেখা পুথিপত্রের সাহায্যে শিক্ষাগ্রহণের কাজ চলত। এই বইয়ের মূল্য খুব বেশি হত বলে এই সময় নিম্নবিত্ত দরিদ্র সমাজে শিক্ষার প্রসারের বিশেষ সুযোগ ছিল না। তাই এই সময় বাংলার শিক্ষাদান মূলত সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তা ছাড়া এই সময় শিক্ষা বলতে মূলত ছিল দীর্ঘ আরবি বা সংস্কৃত কবিতা বা শাস্ত্রের বক্তব্য মুখস্থ করা। এককথায়, ছাপা বইপত্র বাজারে আসার আগে বাংলায় শিক্ষার প্রসার ছিল খুবই সীমাবদ্ধ।
  2. ছাপা বইয়ের সহজলভ্যতা : ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে ছাপাখানায় ছাপা প্রচুর সংখ্যক সুদৃশ্য বইপত্র বাজারে আসতে শুরু করে। একদিকে এসব মুদ্রিত বইয়ের জোগান ছিল বিপুল, অন্যদিকে এগুলি দামেও ছিল সস্তা। ফলে দরিদ্র, সাধারণ শিক্ষার্থী ও পাঠকদের হাতে সহজেই ছাপা বইপত্র পৌঁছে যায়। বাংলার ছাপাখানাগুলি থেকে মাতৃভাষা বাংলায় ছাপা প্রচুর বইপত্র বাজারে আসতে শুরু করলে শিক্ষার্থীরা নিজের মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে বাংলায় ব্যাপক শিক্ষাবিস্তার শুরু হয়।
  3. শ্রীরামপুর ছাপাখানার অবদান : খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে শিক্ষার প্রসারে ভীষণ সুবিধা হয়। এশিয়ার তৎকালীন সর্ববৃহৎ এই ছাপাখানা থেকে বাংলাসহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য প্রভৃতির অনুবাদ, হিতোপদেশ, বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য বিপুল সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক এই ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়।
  4. পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ : ছাপাখানাগুলির মুদ্রিত বইপত্র বিনামূল্যে বা সস্তায় ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হলে তার অধীনে বেশ কয়েকটি স্কুল গড়ে ওঠে। এইসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে পাঠ্যপুস্তকের হাজার হাজার কপি শ্রীরামপুরের ছাপাখানায় ছাপায়। ফলে শহর ও গ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যেসব সাধারণ মানুষ বিদ্যাশিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের হাতে ছাপাখানায় মুদ্রিত সুন্দর ঝকঝকে পাঠ্যবই পৌঁছে যায়।
  5. শিশুশিক্ষার জন্য বই প্রকাশ : বাংলার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ছাপাখানাগুলিতে প্রচুর সংখ্যক শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র ছাপা হতে থাকে। এসব মুদ্রিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মদনমোহন তর্কালংকারের ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ প্রভৃতি। বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’-এর তাঁর জীবদ্দশাতেই মোট ১৫২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং বইটির ৩৫ লক্ষেরও বেশি কপি পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায়। ১৮৬৯-১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ১২ বছরের মধ্যে ৪১ লক্ষেরও বেশি শিশুশিক্ষার বই ছাপা হয়।
  6. অন্যান্য পাঠ্যবই প্রকাশ : বিদ্যালয় স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের প্রচুর পাঠ্যবই ছাপাখানাগুলিতে মুদ্রিত হয়ে সস্তায় বাংলার সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে যায়। এরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য পাঠ্যবই ছিল গোবিন্দপ্রসাদ দাস রচিত ‘ব্যাকরণ সার’, প্রাণলাল চক্রবর্তী রচিত ‘অঙ্কবোধ’, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, আনন্দকিশোর সেন রচিত ‘অর্থের সার্থকতা’, দীননাথ সেন রচিত ‘বাংলাদেশ ও আসামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ এবং ‘ঢাকা জেলার ভূগোল এবং সংক্ষেপে ঐতিহাসিক বিবরণ’ প্রভৃতি। এইসব বইপত্র বাংলার গ্রামগঞ্জে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  7. সংবাদপত্রের ভূমিকা : ঊনবিংশ শতকে বাংলার ছাপাখানাগুলি থেকে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে বাংলায় গণশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মার্শম্যান সম্পাদিত মাসিক ‘দিগদর্শন’ ও সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেট’, রামমোহন রায় সম্পাদিত ‘সম্বাদ কৌমুদী, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সম্বাদ প্রভাকর’, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ প্রভৃতি।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. * বাংলায় আধুনিক ছাপাখানার বা মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – বাংলায় আধুনিক ছাপাখানা বা মুদ্রণশিল্প
ভূমিকা: জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার এক শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপে মুদ্রণশিল্পের অভাবনীয় প্রসার ঘটে। ইউরোপে পোর্তুগিজরা প্রথম ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গোয়ায় এই মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
  1. ভারতে মুদ্রণযন্ত্র : অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে মুদ্রণশিল্পের পথ চলা শুরু হয়।
  2. বাংলায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: পোর্তুগিজ মিশনারিরা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে আসে। পরে ১৭৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস অগাস্টাস হিকি কলকাতায় এবং ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিনস চুঁচুড়ায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
  3. বাংলা অক্ষরের সূচনা: পোর্তুগিজ মিশনারিরা প্রথমে নিজেদের দেশে রোমান হরফে বাংলা বই ছাপিয়ে এদেশে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে চার্লস উইলকিনস প্রথম বাংলা অক্ষর তৈরি করেন। কিছুকাল পর হুগলি জেলার সুদক্ষ স্বর্ণশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার বাংলা অক্ষরের উন্নত টাইপ তৈরি করেন।
  4. সুরেশচন্দ্র মজুমদারের অক্ষর: পঞ্চানন কর্মকারের পরবর্তীকালে সুরেশচন্দ্র মজুমদার ‘লাইনো টাইপ’ নামক আরও উন্নত বাংলা অক্ষরের টাইপ তৈরি করেন। এই অক্ষরে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালেদ রচিত ‘এ ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামক পূর্ণাঙ্গ বইটি প্রকাশের (১৭৭৮-৭৯ খ্রি.) মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় বই ছাপা শুরু হয়।
  5. পূর্ববঙ্গে ছাপাখানা: ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গে প্রথম রংপুরে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকায় ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। এভাবে উনিশ শতকের শেষভাগে বাংলার নানা প্রান্তে ছাপাখানার প্রসার ঘটে।

উপসংহার: উনিশ শতকে বাংলায় গড়ে ওঠা ছাপাখানাগুলিকে কেন্দ্র করে বই ছাপা, কাগজ শিল্প, বই বাঁধাইয়ের কাজ প্রভৃতিতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়। পাঠ্যপুস্তকের জন্য প্রয়োজনীয় চিত্র, ম্যাপ এবং হরফ নির্মাণকারী শিল্পীদের গুরুত্ব বাড়ে।

2. * বাংলায় গণশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানার কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর – গণশিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর ছাপাখানার ভূমিকা
ভূমিকা: শ্রীরামপুর মিশনের খ্রিস্টান মিশনারি ও বিশিষ্ট ভাষাবিদ উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত বইপত্র কম দামে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছোতে শুরু করলে বাংলা ভাষায় গণশিক্ষার প্রসার সম্ভব হয়।
  1. বাংলা অনুবাদ : শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কেরির নির্দেশনায় বাইবেল, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের উদ্যোগে রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য প্রভৃতির বাংলা অনুবাদ।
  2. বাংলা গদ্য সাহিত্য বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রসারে শ্রীরামপুর ছাপাখানা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড। ফলে সাধারণ পাঠকদের হাতে বাংলা সাহিত্য পৌঁছোনোর সুযোগ আসে।
  3. পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ: শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে ছাত্রদের উপযোগী অসংখ্য পাঠ্যপুস্তক ছাপা হতে থাকে। এইসব পাঠ্যপুস্তক সাধারণ ছাত্রদের হাতে কম দামে বা বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি সুন্দর ঝকঝকে পাঠ্যপুস্তকের হাজার হাজার কপি শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়।
  4. গণশিক্ষার প্রসার : শ্রীরামপুর ছাপাখানায় মুদ্রিত বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুদিত গ্রন্থ, বিভিন্ন বাংলা সাহিত্য এবং পাঠ্যপুস্তক সুলভে বাংলার সাধারণ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। ফলে বাংলায় গণশিক্ষার ব্যাপক প্রসার শুরু হয়।

উপসংহার: শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা থেকে প্রথম দিকে ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে’র পাঠ্যবইগুলি ছাপানো হলেও পরবর্তীকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে এখান থেকে প্রচুর পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে বাংলায় গণশিক্ষার প্রসার আরও দ্রুততর হয়।

3. শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কীভাবে একটি অগ্রণী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল?
উত্তর –
ভূমিকা: ডেনমার্ক থেকে আগত শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা নিজেদের, ধর্মীয় প্রচারসহ বেশকিছু জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে সেখানে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানা প্রাচ্যের মুদ্রণশিল্পে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে।
  1. ছাপাখানা স্থাপন : শ্রীরামপুর মিশনের খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়ম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন যা এশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাপাখানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
  2. শ্রীরামপুর ত্রয়ীর উদ্যোগ : শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড (শ্রীরামপুর ত্রয়ী) এর উদ্যোগে বাংলায় গণশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৮০১-১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে ৪০টি ভাষায় ২ লক্ষেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
  3. অনুবাদ প্রকাশ : শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া, উড়িয়া, মারাঠি, সংস্কৃত প্রভৃতি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির অনুবাদ ছাপা হয়।
  4. অন্যান্য ছাপার কাজ : ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য পাঠ্যপুস্তক, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র, বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রভৃতিও শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে ছাপা হয়।
  5. দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুবিধা : শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা থেকে প্রচুর বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের ফলে সাধারণ মানুষের হাতে খুব কম দামে বা বিনামূল্যে বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। ফলে গ্রাম-বাংলার দরিদ্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।

উপসংহারঃ শ্রীরামপুরের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ফলে মুদ্রিত বইয়ের দাম জনসাধারণের নাগালে চলে আসে। এর ফলে যে শিক্ষা শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা ক্রমে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

4. *শিক্ষার প্রসারে উইলিয়াম কেরি ও শ্রীরামপুর মিশনের অবদান কী?
উত্তর – শিক্ষার প্রসারে উইলিয়াম কেরি ও শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা
ভূমিকা: খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি ভারতে আসার আগে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা মূলত উচ্চসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। উইলিয়াম কেরি বাংলায় এসে শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কেরির উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশন বাংলায় গণশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
  1. ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা : উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানা থেকে বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত-সহ বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়ে সুলভে গ্রামগঞ্জের সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হতে থাকে।
  2. বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : কেরি সাহেবের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রীরামপুর ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে ৬,৭০৩ জন ছাত্র নিয়ে ১০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন বাংলায় প্রথম মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নারীশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  3. কলেজ প্রতিষ্ঠা : উইলিয়াম কেরি ও তাঁর দুই সহযোগী সারা জীবনের সজ্জিত অর্থ ব্যয় করে শ্রীরামপুরে একটি ডিগ্রি কলেজ (১৮১৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি কলেজ।
  4. বাংলা ভাষায় শিক্ষার প্রসার: কেরি সাহেব উপলব্ধি করেছিলেন, গ্রামবাংলায় গণশিক্ষার প্রসারের জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করা। এজন্য তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা চালান।
  5. প্রগতিশীলতা: কেরি সাহেব ভারতের প্রাচীন পিছিয়ে পড়া শিক্ষারীতির পরিবর্তে আধুনিক সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মন থেকে যাবতীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন।

উপসংহার: শিক্ষার প্রসারে উইলিয়াম কেরি ও তাঁর শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অসামান্য। গবেষক বিশাল মঙ্গলবাদী তাঁর ‘উইলিয়াম কেরির অবদান নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, যে সকল ধর্মযাজক নিজেদের সুবিধার জন্য জনগণকে সত্যান্বেষণের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতেন, উইলিয়াম কেরি সেই যাজকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষকে আত্মিক শক্তি দিলেন।

5. *ছাপার কাজে আধুনিক বাংলা অক্ষর বা হরফ নির্মাণের অগ্রগতির বিবরণ দাও।
উত্তর – আধুনিক বাংলা অক্ষর বা হরফ
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে বাংলায় ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটে এবং বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বইপত্রের প্রকাশ শুরু হয়। বাংলা ভাষায় বই ছাপার প্রয়োজনে এই সময় আধুনিক বাংলা হরফের উদ্ভব এবং তার নানা বিবর্তন ঘটে।
  1. চার্লস উইলকিনস-এর উদ্যোগ : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী চার্লস উইলকিনস ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ছাপার কাজের প্রয়োজনে তিনি সর্বপ্রথম বাংলা অক্ষর বা হরফের টাইপ বা নকশা তৈরি করেন। তবে সেই সমস্ত অক্ষরগুলি ছিল অত্যন্ত সাধারণ বা নিম্নমানের।
  2. পঞ্চানন কর্মকারের উদ্যোগ : চার্লস উইলকিনস-এর পরবর্তীকালে সুদক্ষ স্বর্ণশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার উন্নত বাংলা অক্ষরের ছাঁচ বা টাইপ তৈরি করেন। তাঁকে বাংলা টাইপের জনক বলা হয়। তাঁর তৈরি করা টাইপেই শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানায় বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ছাপার কাজ শুরু হয়।
  3. মনোহর কর্মকারের উদ্যোগ : পঞ্চানন কর্মকার অক্ষরের টাইপ তৈরির কৌশল তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকারকে শিখিয়ে যান। ফলে পরবর্তীকালে মনোহর বাংলা অক্ষর তৈরিতে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেন এবং আরও উন্নত বাংলা অক্ষর বা হরফ তৈরি করেন।
  4. সুরেশচন্দ্র মজুমদারের উদ্যোগ: পঞ্চানন কর্মকারের পর সুরেশচন্দ্র মজুমদার বাংলা টাইপ বা অক্ষর তৈরিতে আরও দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি ‘লাইনো টাইপ’ নামক আরও উন্নত এক ধরনের বাংলা অক্ষর বা টাইপ তৈরি করেন।

উপসংহার: চার্লস উইলকিনস সাহেবের হাত ধরে বাংলা অক্ষর বা হরফ বা নকশার যাত্রা শুরু হলেও পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর জামাই মনোহর কর্মকারের দক্ষতায় তা অনেক বেশি মার্জিত হয়। পরে সুরেশচন্দ্র মজুমদারের ‘লাইনো টাইপ’ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে বাংলা অক্ষরকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

6. * ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় শিক্ষার প্রসারে ছাপাখানার কীরূপ ভূমিকা ছিল ?
উত্তর – শিক্ষার প্রসারে ছাপাখানার ভূমিকা
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই ছাপাখানাগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
  1. পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ : বাংলার ছাপাখানাগুলিতে স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রচুর পরিমাণ পাঠ্যপুস্তক ছাপা হতে থাকে। এইসব পাঠ্যপুস্তকের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি। ছাপাখানায় মুদ্রিত বইপত্রের সুন্দর মুদ্রণ এবং কম দাম হওয়ায় তা গ্রামবাংলার সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাতেও পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়। এই সব বইগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
  2. অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশ: ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের পর থেকে বাংলায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য প্রভৃতির অনুবাদ, বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। এগুলি সুলভে বাংলার সাধারণ পাঠকদের হাতে পৌঁছে যায়।
  3. সংবাদপত্রাদি প্রকাশ: ছাপাখানাগুলি থেকে বাংলা ও ইংরেজিতে বেশকিছু সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রও প্রকাশিত হতে থাকে। এইসব সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলিতে দৈনন্দিন সংবাদ ছাড়াও নিয়মিত বিভিন্ন জ্ঞানমূলক বিষয়ের আলোচনা স্থান করে নেয়।
  4. নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক রচনা করে তা কম খরচে বা বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হলে তার অধীনে বেশ কয়েকটি স্কুল গড়ে ওঠে।

উপসংহার: ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত সুলভ বইপত্র সাধারণ মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। ফলে বাংলায় শিক্ষার ব্যাপক ও দ্রুত প্রসার শুরু হয়।

7. * বাংলায় শিশুশিক্ষার প্রসারে ছাপাখানার কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর – বাংলায় শিশুশিক্ষার প্রসারে ছাপাখানার ভূমিকা
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগের মধ্যে ছাপাখানার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ছাপাখানার প্রসার বাংলার শিশুশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  1. শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র প্রকাশ: বাংলায় ছাপাখানার প্রসারের ফলে এইসব ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বিভিন্ন বইপত্রের হাজার হাজার কপি সুলভে বাংলার গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে যায়। বাংলার শিশুদের মধ্যে সহজে প্রাথমিক শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গ্রন্থকার শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র রচনা করেন।
  2. প্রাথমিক উদ্যোগ: বাংলার শিশুশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশন প্রণীত ‘লিপিধারা’ (১৮১৫ খ্রি.), রাধাকান্ত দেব রচিত ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২১ খ্রি.), স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘বর্ণমালা’ (সম্ভবত ১৮৫৩-৫৪ খ্রি.), ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক দুই খণ্ডে রচিত ‘শিশুসেবধি’ (১৮৫৪ খ্রি.) প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এইসব বই খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
  3. মদনমোহন তর্কালঙ্কার: বাংলায় শিশুশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ‘শিশুশিক্ষা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রকাশের পর সেটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভের ফলে ‘শিশুশিক্ষা’র প্রথম ভাগ ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে, ‘শিশুশিক্ষা’র দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এবং পরবর্তীকালে এর তৃতীয় ভাগ ও ‘বোধোদয়’ শিরোনামে চতুর্থ ভাগ প্রকাশিত হয়। ‘শিশুশিক্ষা’ বাংলার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘শিশুশিক্ষা’-কে বাংলার প্রথম ‘প্রাইমার’ বলা হয়।
  4. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : শিশুদের বর্ণশিক্ষা ও শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুই খণ্ডে ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এটি শীঘ্রই ‘শিশুশিক্ষা’র জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করে যায়। দুই পয়সা মূল্যের পাতলা এই বইটি বাংলার শিক্ষাজগতে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি ঘটায়।
  5. রামসুন্দর বসাক : রামসুন্দর বসাক ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বাল্যশিক্ষা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি পূর্ববঙ্গের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
  6. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সহজপাঠ’ নামক শিশুশিক্ষা-বিষয়ক একটি বই লেখেন। এটিও শিশুশিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট অবদান রাখে। পশ্চিমবঙ্গের নানা বিদ্যালয়ে এই বইটি পাঠ্য বইরূপে স্বীকৃত ছিল।

উপসংহার: ছাপাখানাগুলিতে শিশুদের জন্য মুদ্রিত বইগুলি বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং শিশুশিক্ষার বিস্তারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগে এই অগ্রগতির মোটেই সম্ভাবনা ছিল না।

8. ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করো।
উত্তর – ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক
ভূমিকা: ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা তথা ভারতে আধুনিক মুদ্রণব্যবস্থা চালু হলে মানুষের হাতে প্রচুর ছাপা বইপত্র আসতে থাকে। এসব ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছাপা বই একদিকে যেমন শিক্ষার অগ্রগতি ঘটায়, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার অগ্রগতি ছাপা বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি করে।
  1. গণশিক্ষার দিকে যাত্রা: ইতিপূর্বে হাতে লেখা বইয়ের দাম খুব বেশি হত। তাই এসব বই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল এবং শিক্ষাদান ব্যবস্থা ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ছাপা বই দামে সস্তা হওয়ায় তা সাধারণ মানুষ কেনার ও পড়ার সুযোগ পায়। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঘটে যা গণশিক্ষার প্রসারের পটভূমি তৈরি করে।
  2. পাঠ্যবইয়ের সহজলভ্যতা : ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রচুর পরিমাণ মুদ্রিত ও দামে সস্তা পাঠ্যবই বাজারে আসতে থাকে। ফলে বইয়ের অভাব দূর হয় এবং শিক্ষাবিস্তারের পথ মসৃণ হয়।
  3. মাতৃভাষায় শিক্ষা : ছাপাখানার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ভাষাশিক্ষা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি বই, বোধিনী বা সহায়িকা বই বাংলা ভাষায় ছাপা হতে থাকে। ফলে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়।
  4. শিশুশিক্ষা : ছাপা বই শিশুশিক্ষার অগ্রগতি ঘটাতে সহায়তা করে। ছাপাখানায় মুদ্রিত মদনমোহন তর্কালংকারের ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’র মতো বইগুলি শিশুশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
  5. উচ্চশিক্ষা : আশিস খাস্তগীর উল্লেখ করেছেন যে, উনিশ শতকের মধ্যভাগে ব্যাপক পরিমাণে পাঠ্যবই প্রকাশ হতে থাকলে তা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে। ফলে, বাঙালির উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি অনেক সহজ হয়।
  6. নারীশিক্ষার অগ্রগতি : উনিশ শতকের শেষার্ধে নারীশিক্ষার দাবি ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সুলভ ছাপা বই নারীদের হাতে পৌঁছালে নারীশিক্ষার গতি ত্বরান্বিত হয়।

উপসংহার: ছাপা বই একদিকে শিক্ষার বিস্তারে ভূমিকা নিয়েছিল, অন্যদিকে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

9. *বাংলা পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে ছাপাখানার উদ্যোগের পরিচয় দাও।
উত্তর – বাংলা পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে ছাপাখানার উদ্যোগ
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগের মধ্যে ছাপাখানার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ছাপাখানাগুলিতে বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রিত হয়ে সেগুলি শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যায়। যেমন—
  1. শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র: বাংলার ছাপাখানাগুলিতে শিশুশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বই ছাপা হয়। এইসব বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাক রচিত ‘বাল্যশিক্ষা’ প্রভৃতি। এইসব বই থেকেই বাংলার শিশুরা বাংলা বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হয়।
  2. বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যবই: শিশুশিক্ষার বই ছাড়াও ছাপাখানাগুলিতে বিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়। ঊনবিংশ শতকের এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল গোবিন্দ প্রসাদ দাস রচিত ‘ব্যাকরণ সার’, প্রাণলাল চক্রবর্তী রচিত ‘অঙ্কবোধ’, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, আনন্দকিশোর সেন রচিত অর্থের সার্থকতা’, দীননাথ সেন রচিত ‘বাংলাদেশ ও আসামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং ‘ঢাকা জেলার ভূগোল এবং সংক্ষেপে ঐতিহাসিক বিবরণ’ প্রভৃতি।
  3. সহায়ক বইপত্র: ঊনবিংশ শতকে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও ছাপাখানার মালিকরা ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন সহায়ক বইপত্র প্রকাশ করতেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এইসব বইয়ের যথেষ্ট চাহিদাও ছিল।

উপসংহার: বাংলা ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের জন্য পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে ছাপাখানাগুলিতে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। মুদ্রিত পাঠ্যবইগুলি বাংলার শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছালে শিক্ষার প্রসারে আরও গতি আসে।

10. *বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে ছাপাখানা ও মুদ্রণশিল্প কীভাবে নতুন ব্যাবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?
অথবা, বাংলার ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর – ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগ
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য ছাপাখানা স্থাপিত হয়। ছাপাখানার প্রসারের ফলে মুদ্রণশিল্প একটি প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারি ব্যাবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
  1. পাঠ্যবই প্রকাশ : শিক্ষার্থীদের অক্ষরজ্ঞানসহ গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য প্রভৃতি বিভিন্ন পাঠ্য বিষয়ের বইপত্র ছাপাখানার মালিকরা তাঁদের ছাপাখানায় ছাপতে থাকেন। কয়েক দশকের মধ্যেই পাঠ্যবইয়ের একটি বৃহৎ বাজার গড়ে ওঠে। এইসব বই বিক্রি করে মালিকদের ব্যাবসার দ্রুত প্রসার ঘটে।
  2. অন্যান্য বইপত্র প্রকাশ : ছাপাখানার মালিকরা সাহিত্য, কবিতা, নাটক, গানের বই, ধর্মগ্রন্থ, অনুবাদ গ্রন্থ, ভ্রমণকাহিনি, চিকিৎসাশাস্ত্র, গবেষণামূলক গ্রন্থ, অভিধান প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বইপত্র ছেপে পাঠককুলের একটি বড়ো বাজার তৈরি করেন। ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সহায়ক বইপত্র ছেপে ব্যাবসার আরও বৃদ্ধি ঘটান।
  3. পত্রপত্রিকা প্রকাশ : অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে পরবর্তী এক শতকের মধ্যে বাংলায় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের পত্রপত্রিকা ছিল। এসব পত্রপত্রিকা ছাপার ফলে ছাপাখানার ব্যাবসার আরও প্রসার ঘটে।
  4. অন্যান্য মুদ্রণ: ব্রিটিশ শাসনকালে অফিস-আদালতের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ফলে এইসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাগজপত্র মুদ্রণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মিলিটারি বিল, ভাতার ফর্ম, সামরিক বাহিনীর বিধিবিধান, সার্কুলার, বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতি কাগজপত্র ছাপার কাজ শুরু হলে ছাপাখানার ব্যাবসা বৃদ্ধি পায়।
  5. আনুষঙ্গিক ব্যাবসা: ছাপাখানার ব্যাবসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে এর সঙ্গে যুক্ত আনুষঙ্গিক ব্যাবসারও ধারাবাহিক প্রসার ঘটতে থাকে। যেমন—কাগজ বিক্রি, বই বাঁধাই, বই বিক্রি ইত্যাদি।
  6. ছাপাখানার সংখ্যাবৃদ্ধি: ছাপার কাজের ব্যাবসায়িক চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে কলকাতায় ছাপাখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় ১৭টি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারতে ১,০৯৪টি ছাপাখানা ছিল। এর মধ্যে বাংলা প্রদেশেই ছিল ২২৯টি ছাপাখানা।

উপসংহার: যে-কোনো শিল্প গড়ে ওঠে বাজারে তার চাহিদার ওপর নির্ভর করে। বইয়ের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে আঠারো-উনিশ শতকে মুদ্রণশিল্প একটি উজ্জ্বল, লাভজনক ও সম্ভাবনাময় ব্যাবসা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।

11. বাংলার ছাপাখানা ও মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাখ্যা করো। ছাপাখানার ফলাফল বা প্রভাবগুলিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
উত্তর – বাংলার ছাপাখানা ও মুদ্রণে বিদ্যাসাগরের অবদান
ভূমিকা: বাংলার শিক্ষার প্রসারে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসামান্য অবদান রয়েছে। শিক্ষার সংস্কার থেকে শিক্ষার প্রসার—উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর আন্তরিক উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি ছাপাখানা ও মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েন।
  1. ছাপাখানার জগতে যাত্রা: বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দেবার পর বিকল্প জীবিকা হিসেবে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৬০০ টাকা ঋণ নিয়ে বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে অংশীদার হিসেবে নিয়ে কলকাতায় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
  2. বর্ণমালার সংস্কার : বই মুদ্রণের ক্ষেত্রে অক্ষর বা বর্ণমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের পূর্বে শব্দ বোঝানোর ক্ষেত্রে বাংলা অক্ষরের মধ্যে কিছু গণ্ডগোল ছিল। যেমন—বর্গীয় জ ও অন্তঃস্থ য় হরফের আলাদা আলাদা উচ্চারণের হরফ বসানোর ক্ষেত্রে ‘য’ হরফের মাধ্যমেই কাজ চালিয়ে দেওয়া হত। বিদ্যাসাগর এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান। তিনি ‘খ’ বর্ণটির নীচের ফুটকি দেওয়ার পদ্ধতি চালু করে অন্তঃস্থয় উচ্চারণের হরফ তৈরি করেন। ‘ড’ ও ‘ঢ’-এর ক্ষেত্রেও যথাক্রমে ‘ড়’ও ‘ঢ়’ হরফের প্রচলন করেন। ঋ-কার (), ‘উ-কার’ () ও ‘ঊ-কার’ () লেখার প্রচলনও তিনিই করেন।
  3. প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ : বিদ্যাসাগরের ছাপাখানা থেকে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটি হল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সংরক্ষিত মূল অন্নদামঙ্গল কাব্যের পাণ্ডুলিপিটি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর কৃষ্ণনগরে আসেন এবং বইটি সংগ্রহ করেন। এরপর তাঁর সম্পাদিত এই গ্রন্থটি তাঁর ছাপাখানা থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
  4. পুস্তকের ব্যাবসা: ছাপানো বই বিক্রির কাজেও বিদ্যাসাগর এগিয়ে আসেন। তাঁর নিজস্ব ছাপাখানায় উৎপাদিত পুস্তক বিক্রির উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি’ ও ‘কলিকাতা পুস্তকালয়’ নামে দুটি বইয়ের দোকান খোলেন। তাঁর নিজের লেখা ‘বর্ণপরিচয়’ বইটির দুটি খণ্ড (প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ) বিক্রি করে তিনি কয়েক হাজার টাকা উপার্জন করতেন।
ছাপাখানার প্রভাব বা ফলাফল
ছাপাখানার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বা ফলাফল লক্ষ করা যায়। যেমন—
  1. জনশিক্ষার প্রসার : ছাপাখানায় মুদ্রিত বইপত্র বাজারে আসার আগে হাতে লেখা বইগুলির দাম অত্যন্ত বেশি হত। আর মুদ্রিত বইগুলির দাম সেই তুলনায় অনেক কম হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসে। ফলে জনশিক্ষার প্রসারে ছাপাখানা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
  2. বৌদ্ধিক বিকাশ: ছাপাখানা জনগণের বৌদ্ধিক বিকাশেও সহায়তা করেছিল। ছাপাখানার ফলে নানান ধরনের বই সব বয়সের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়ে। এইভাবে পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটতে থাকে।
  3. নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির আত্মপ্রকাশ: ছাপাখানার বিস্তারের ফলে এই পেশাকে কেন্দ্র করে এক নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই শ্রেণি ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করে বইপত্র প্রকাশ ও বিক্রির লাভজনক ব্যাবসা শুরু করে। বইয়ের বিপুল বিক্রির ফলে তারা দিন দিন অর্থনৈতিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
  4. কর্মসংস্থান সৃষ্টি: ছাপাখানা প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। অক্ষর সাজানো, সাদা কাগজে বই ছাপা, বই বাঁধাই-সহ নানা কাজের জন্য ছাপাখানাগুলি লোক নিয়োগ করত। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান গড়ে ওঠে।

উপসংহার: প্রথম পর্বে ছাপাখানাগুলি বাংলায় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। পরবর্তী পর্বে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের পর শিক্ষার প্রসারে আরও গতি আসে। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যাসাগরের জনশিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতি উদ্যোগে ছাপাখানারও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

12. বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল?
উত্তর – বাংলার মুদ্রণশিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের অবদান
ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রথম বাংলায় আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বাঙালিও মুদ্রণশিল্পের বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বাক্ষর রাখেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।
  1. শিক্ষানবিশ : ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য নামে গ্রন্থটি থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। গঙ্গাকিশোর প্রথম জীবনে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিষ্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ করতেন। এখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তিনি পরবর্তীকালে কলকাতায় এসে বই প্রকাশের কাজ শুরু করেন।
  2. সচিত্র বই: গঙ্গাকিশোর ফেরিস এন্ড কোম্পানি প্রেস থেকে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কবি ভারতচন্দ্রের সচিত্র অন্নদামঙ্গল কাব্যটি ছাপেন। এটিই ছিল বাঙালিদের সম্পাদনায় প্রথম সচিত্র বই। তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পী রামচাঁদ রায়ের আঁকা ছবি এই বইয়ে ব্যবহার করা হয়।
  3. বাঙালি গেজেটি প্রেস : অন্নদামঙ্গলের ব্যাপক বিক্রিতে উৎসাহিত হয়ে গঙ্গাকিশোর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস স্থাপন করেন। এটি ছিল বাঙালি মালিকানায় প্রথম ছাপাখানা। তিনি এখান থেকে নিজ সম্পাদনায় বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশ করতে থাকেন।
  4. বিভিন্ন বই : অন্নদামঙ্গল কাব্য ছাড়াও গঙ্গাকিশোর বিভিন্ন বই প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘এ গ্রামার ইন ইংলিশ এন্ড বেঙ্গলি’, ‘গণিত নামতা ব্যাকরণ লিখবার আদর্শ’, ‘দায়ভাগ’, ‘চিকিৎসার্ণব’, ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’, ‘দ্রব্যগুণ’ প্রভৃতি।

উপসংহার: বাঙালিদের মধ্যে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই ছিলেন প্রথম সংবাদপত্র সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রথম বাংলা সচিত্র বইয়ের প্রকাশক। তাঁর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে এরপর থেকে বহু বাঙালি নিজেদের উদ্যোগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে বইপত্র ও সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে প্রবেশ করেন।

13. বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা আলোচনা করো। 
অথবা, মুদ্রণশিল্পে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কীভাবে বিপ্লব এনেছিলেন?
উত্তর – মুদ্রণশিল্পের ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান
ভূমিকা: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫ খ্রি.) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে ঊনবিংশ শতকে নিম্নমানের মুদ্রণশিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হন।
  1. ইউ রায় অ্যান্ড সন্স প্রতিষ্ঠা: উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিদেশ থেকে আধুনিক উন্নত মুদ্রণযন্ত্র এনে কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। এখানে তিনি মুদ্রণের কাজে উন্নতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান।
  2. হাফটোন ব্লক তৈরি : উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানায় কাঠের পরিবর্তে তামা ও দস্তার পাতে অক্ষর বা ছবি খোদাই করে মুদ্রণের প্রয়োজনীয় ব্লক তৈরি করেন। তিনি অন্ধকার ঘরে বসে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ লক্ষ করে হাফটোন ব্লক তৈরির সূত্র উদ্ভাবন করেন। এর ফলে মুদ্রণশিল্প অনেক উন্নত হয়।
  3. ছবির ব্যবহার : উপেন্দ্রকিশোর বইয়ের প্রচ্ছদ ও বইয়ের ভেতরে লেখার সঙ্গে বিভিন্ন ছবির মুদ্রণ উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। এই বিষয়ে তিনি ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন, ডায়াফ্রাম পদ্ধতি, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়োটাইপ, রিপ্রিন্ট প্রভৃতি পদ্ধতি ব্যবহার করে রংবেরঙের নানা ছবি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
  4. স্টুডিয়ো স্থাপন : উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানার সঙ্গে ছবি আঁকার একটি স্টুডিয়ো খোলেন। এখানে তিনি আধুনিক ফোটোগ্রাফি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। এর ফলে সাদাকালো ছবি প্রচলনের যুগে তিনি ছোটোদের জন্য রংবেরঙের বিভিন্ন বই প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তিনি আধুনিক ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণশিল্প সম্পর্কে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর পুত্র সুকুমার রায়কে ইংল্যান্ডে পাঠান (১৯১১ খ্রি.)।
  5. প্রকাশনা: বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পর মুদ্রণশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়ে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানা থেকে ছোটোদের জন্য নিজের লেখা রঙিন বই একের পর এক প্রকাশ করতে থাকেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সেকালের কথা’, ‘টুনটুনির বই’, ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রভৃতি।

উপসংহার: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কর্তৃক বাংলার মুদ্রণশিল্পের আধুনিকীকরণের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন এবং ‘ইউ এন রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর উদ্যোগগুলি বাংলার মুদ্রণশিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *ভারতের সর্বপ্রথম কবে, কারা, কোথায় আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে?
উত্তর – ভারতে সর্বপ্রথম ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজরা গোয়ায় আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
2. * কারা প্রথম মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে বাংলা বই ছাপায় ?
উত্তর – পোর্তুগিজ মিশনারিরা সর্বপ্রথম পোতুর্গালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে বাংলা বই ছাপায় এবং তা বাংলায় নিয়ে আসে।
3. *আধুনিক ছাপাখানায় ব্যবহারের উপযোগী বাংলা অক্ষরের টাইপ নির্মাণে কাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে?
উত্তর – আধুনিক ছাপাখানায় ব্যবহারের উপযোগী বাংলা অক্ষরের টাইপ প্রথম তৈরি করেন চার্লস উইলকিনস। পরবর্তীকালে তাঁর সহযোগী পঞ্চানন কর্মকার আরও উন্নত টাইপ তৈরি করেন। পরবর্তীকালে সুরেশচন্দ্র মজুমদার আরও উন্নত বাংলা টাইপ তৈরি করে বাংলা মুদ্রণব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে তোলেন।
4. *কলকাতায় প্রথম মুদ্রিত বই কোন্‌টি?
উত্তর – ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস অগাস্টাস হিকি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ছাপাখানায় ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে দুটি ইংরেজি ক্যালেন্ডার ছাপা হয়। এই ক্যালেন্ডার আংশিক বইয়ের আকারের হওয়ায় কেউ কেউ একে কলকাতায় মুদ্রিত প্রথম বই বলে মনে করেন।
5. ‘জাইলোগ্রাফি’ পদ্ধতি কী ?
উত্তর – খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে চিনে কাঠ বা পাথরের ব্লকের দ্বারা মুদ্রণকৌশল আবিষ্কৃত হয়। ব্লকের দ্বারা এই মুদ্রণ পদ্ধতি ‘জাইলোগ্রাফি’ নামে পরিচিত।
6. বাংলার ছাপাখানার বিকাশে পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর – বাংলার ছাপাখানার বিকাশে পঞ্চানন কর্মকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। [1] তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার ছাপাখানার হরফ নির্মাণের অন্যতম রূপকার। [2] তিনি বাংলা ছাপাখানায় সচল ধাতু হরফের প্রচলন করেছিলেন।
7. *সুরেশচন্দ্র মজুমদার কে ছিলেন?
উত্তর – সুরেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন আনন্দবাজার প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি রাজশেখর বসুর পরামর্শে বাংলা অক্ষর নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে টাইপ’ নামে এক উন্নত বাংলা অক্ষরের টাইপের নির্মাণ করেন।
৪. লাইনো টাইপ কী?
উত্তর – ‘লাইনো টাইপ’ হল সুরেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক নির্মিত এক ধরনের উন্নত বাংলা অক্ষরের টাইপ। এই প্রকার টাইপে পুরো লাইন ধরে ছাপা হত এবং কোনো ধরনের পরিবর্তন করতে চাইলে পুরো লাইনটিকেই নতুন রূপে বানাতে হত।
9. ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলায় গণশিক্ষার পরিস্থিতি কীরূপ ছিল?
উত্তর – ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলায় মুদ্রিত বই না থাকায় হাতে লেখা বই ছিল শিক্ষার মাধ্যম। এই বহুমূল্য বই সমাজের মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা কিনলেও তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। এজন্য তখন বাংলায় গণশিক্ষার প্রসার ঘটেনি।
10. বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে বটতলা প্রকাশনার গুরুত্ব কী?
উত্তর – বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে বটতলা প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। [1] এই প্রকাশনীতে কম খরচে বেশি বই ছাপা হত। [2] এই ছাপায় হ্যান্ডমেড পেপারের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। ফলে স্বদেশি কারিগরির মুনশিয়ানা ফুটে ওঠে। এ ছাড়া পুঁথি, পাঁচালি এবং অনুবাদ সাহিত্যের প্রকাশনার প্রসার ঘটে।
11. *ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা বাংলায় শিক্ষার প্রসারে কী ধরনের সুবিধা করে দেয়?
উত্তর – আধুনিক ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা বাংলায় শিক্ষার প্রসারে নানাভাবে সহায়তা করে। [1] ছাপাখানায় মুদ্রিত বিপুল সংখ্যক বই অল্প সময়ে পাঠক ও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। [2] ছাপাখানায় মুদ্রিত বইয়ের মূল্য হাতে লেখা বইয়ের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় দরিদ্র ও সাধারণ পড়ুয়ারা ছাপাখানার বইপত্র কিনতে সক্ষম হয়। [3] ছাপাখানাগুলিতে বহু বাংলা বই মুদ্রিত হওয়ায় মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়।
12. *‘শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্রের নাম লেখো।
উত্তর – শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত দুটি উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র ছিল মাসিক ‘দিগদর্শন’ (১৮১৮ খ্রি.) এবং সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮ খ্রি.)।
13. শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে কোন্ কোন্ ভাষায় বইপত্র প্রকাশিত হয়?
উত্তর – শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে বাংলা, হিন্দি, অহমীয়া, উড়িয়া, মারাঠি, সংস্কৃত-সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বইপত্র প্রকাশিত হয় ।
14. শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে কোন ধরনের বইপত্র প্রকাশিত হয়?
উত্তর – শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে ‘বাইবেল’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন সাহিত্যের অনুবাদ, হিতোপদেশ, বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রভৃতি বইপত্র প্রকাশিত হয়।
15. বাংলার ছাপাখানা বিকাশে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের অবদান কী?
উত্তর – বাংলার ছাপাখানার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল, এখান থেকে—[1] বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। [2] প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন সাহিত্যের অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। [3] বিভিন্ন স্কুল পাঠ্যবই প্রকাশিত হয়। [4] ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’, ‘বেঙ্গল গেজেট’-সহ বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
16. *‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থটি কবে, কোথা থেকে প্রকাশ করেন ?
উত্তর – রামরাম বসু ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থটি ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে প্রকাশ করেন।
17. *উইলিয়াম কেরি কে ছিলেন?
উত্তর – উইলিয়াম কেরি ছিলেন শ্রীরামপুরের একজন খ্রিস্টান মিশনারি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি আধুনিক ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা। শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বাংলা ভাষার উন্নতির ক্ষেত্রেও তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে।
18. *রামরাম বসু কে ছিলেন?
উত্তর – রামরাম বসু ছিলেন শ্রীরামপুর মিশনের মিশনারি উইলিয়াম কেরির মুনশি। তিনি ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
19. *শিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর ছাপাখানার অবদান কী ?
উত্তর – শিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর ছাপাখানার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এখানে সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, সমাজসংস্কার প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে বইপত্র ছাপা হত। বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রসারে এই ছাপাখানার ভূমিকা ছিল অসীম।
20. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য কোন্ কোন্ ছাপাখানা থেকে বইপত্র ছাপা হত?
উত্তর – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রীরামপুর ছাপাখানা, হিন্দুস্তানি প্রেস, পারসিয়ান প্রেস, সংস্কৃত প্রেস প্রভৃতি ছাপাখানা থেকে বইপত্র ছাপা হত।
21. *শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে বিপুল সংখ্যক বইপত্র ছাপার একটি পরিসংখ্যান দাও।
উত্তর – শ্রীরামপুর ছাপাখানায় ১৮০১-৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত ৪০টি ভাষায় ২ লক্ষেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
22. শিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর মিশনারিদের কী উদ্যোগ ছিল ?
উত্তর – শ্রীরামপুর মিশনারিরা শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশে ৬,৭০৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ১০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এ ছাড়া নারীশিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষার জন্য শ্রীরামপুরে এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি কলেজ (১৮১৮ খ্রি.) প্রভৃতিও তাঁদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়।
23. বাংলায় মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কোন্ কোন্ নতুন পেশার সৃষ্টি হয়?
উত্তর – বাংলায় মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কাগজ উৎপাদন, কাগজ বিক্রি, বই ছাপানো, বই বাঁধাই, বই বিক্রি প্রভৃতি নতুন পেশার সৃষ্টি হয়।
24. *ঢাকায় প্রথম কে, কবে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – ঢাকায় প্রথম আলেকজান্ডার বারবেখ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
25. * বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হওয়ার আগে বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত শিশুশিক্ষা-বিষয়ক কয়েকটি বাংলা গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর – বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হওয়ার আগে বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত শিশুশিক্ষা-বিষয়ক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল শ্রীরামপুর মিশন প্রণীত ‘লিপিধারা’ (১৮১৫ খ্রি.), রাধাকান্ত দেব রচিত ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২১ খ্রি.), স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘বর্ণমালা’ (সম্ভবত ১৮৫৩-৫৪ খ্রি.), ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক দুই খণ্ডে রচিত ‘শিশুসেবধি (১৮৫৪ খ্রি.) প্রভৃতি।
26. মদনমোহন তর্কালঙ্কার কে ছিলেন?
উত্তর – মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম পণ্ডিত এবং নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক মদনমোহন বাংলা ভাষার বিকাশ ও বাংলায় শিশুশিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি শিশুদের শিক্ষার জন্য ‘শিশুশিক্ষা’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থটি লেখেন।
27. ‘স্থানীয় স্কুল সম্বন্ধে আভাস’ কী?
উত্তর – শ্রীরামপুর মিশনের মিশনারি জোশুয়া মার্শম্যান বাংলার গ্রামাঞ্চলে বাংলা ভাষায় গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনা ‘স্থানীয় স্কুল সম্বন্ধে আভাস’ নামে পরিচিত।
28. *শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের অবদান কী?
উত্তর – বাংলার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ‘শিশুশিক্ষা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ‘শিশুশিক্ষা’র প্রথম ভাগ ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এবং পরবর্তীকালে তৃতীয় ভাগ ও ‘বোধোদয়’ শিরোনামে চতুর্থ ভাগ প্রকাশিত হয়। ‘শিশুশিক্ষা’ বাংলার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
29. *বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে সেগুলি থেকে মুদ্রিত কয়েকটি জনপ্রিয় পাঠ্যবইয়ের নাম লেখো।
উত্তর – বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে সেগুলি থেকে বিভিন্ন বইপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গোবিন্দ প্রসাদ দাস রচিত ‘ব্যাকরণ সার’, প্রাণলাল চক্রবর্তী রচিত ‘অঙ্কবোধ’, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, আনন্দকিশোর সেন রচিত ‘অর্থের সার্থকতা’, দীননাথ সেন রচিত ‘বাংলাদেশ ও আসামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ এবং ‘ঢাকা জেলার ভূগোল’ এবং ‘সংক্ষেপে ঐতিহাসিক বিবরণ’ প্রভৃতি।
30. প্রথম সচিত্র বাংলা বই কোন্‌টি? এই বইয়ের চিত্রগুলি কে আঁকেন?
উত্তর – প্রথম সচিত্র বইটি হল কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল (১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে)।
মূলত বাঙালি চিত্রশিল্পীরা অন্নদামঙ্গল বইটির ছবিগুলি এঁকেছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামচাঁদ রায়।
31. ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সেগুলিতে কী ধরনের বইপত্র ছাপা হত?
উত্তর – ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সেগুলিতে বিভিন্ন অনুবাদ গ্রন্থ, পাঠ্যবই, শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বই, সাহিত্য-বিষয়ক বইপত্র, কবিতার বই, নাটক, গানের বই, ভ্রমণকাহিনি, চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক বইপত্র প্রভৃতি ছাপা হত।
32. *ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সেগুলিতে বইপত্র ছাড়া কী ধরনের মুদ্রণের কাজ হত?
উত্তর – ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সেগুলিতে বিভিন্ন ধরনের বইপত্র ছাড়া মিলিটারি বিল, ভাতা প্রদানের ফর্ম, সামরিকবাহিনীর বিধিবিধান, সরকারি নির্দেশিকা প্রভৃতি মুদ্রণের কাজ হত।
33 * ভারত তথা এশিয়ার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র কোন্‌টি? এটি কবে প্রথম প্রকাশিত হয় ?
উত্তর – ভারত তথা এশিয়ার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হল হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘হিকি’স গেজেট।
হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘হিকি’স গেজেট’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে।
34. হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ সংবাদপত্রটির গুরুত্ব কী ছিল?
উত্তর – ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জেমস অগাস্টাস হিকি প্রকাশিত বেঙ্গল গেজেট পত্রিকাটির গুরত্ব হল– [1] এটি ছিল এশিয়া তথা ভারতের প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। [2] এই পত্রিকা থেকে সমকালীন বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানা যায়।
35. অনারেবল কোম্পানিজ প্রেসে কী ধরনের ছাপার কাজ হত?
উত্তর – অনারেবল কোম্পানিজ প্রেসে বিভিন্ন সরকারি কাগজপত্র, বেসরকারি বইপত্র, এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকা ‘এশিয়াটিক রিসার্চেস’ প্রভৃতি ছাপা হত।
36. *ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে বাংলার ছাপাখানাগুলিতে প্রথমদিকে কী ধরনের ছাপার কাজ হত?
উত্তর – ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে বাংলার ছাপাখানাগুলিতে প্রথমদিকে সরকারি কাগজপত্ৰ, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পাঠ্যবই, পঞ্জিকা, ভ্রমণকাহিনি, চিকিৎসাবিজ্ঞান-বিষয়ক বই, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, গানের বই, ব্যাকরণ, অভিধান, ইউরোপের ঘটনাবলি নিয়ে লেখা বই প্রভৃতি ছাপার কাজ হত।
37. *ছাপাখানাগুলিতে স্কুলকলেজের নীতিশিক্ষা-বিষয়ক কোন্ কোন গ্রন্থ ছাপা হত?
উত্তর – ছাপাখানাগুলিতে স্কুলকলেজের নীতিশিক্ষা-বিষয়ক ‘হিতোপদেশ’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘তোতা ইতিহাস’, ‘বোধোদয়’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘নীতিকথা’ প্রভৃতি গ্রন্থ ছাপা হত।
38. *ছাপাখানাগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোন্ কোন্ বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপা হত?
উত্তর – ছাপাখানাগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, গণিত, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, কারিগরিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, নীতিশিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপা হত।
39 ঊনবিংশ শতকে বাংলায় ছাপাখানার প্রসারের একটি পরিসংখ্যান দাও।
উত্তর – কলকাতায় ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় ১৭টি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারতে ১০৯৪ টি ছাপাখানা ছিল। এর মধ্যে বাংলা প্রদেশে ছিল ২২৯টি ছাপাখানা।
40. ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপা বইয়ের প্রকৃতি কীরূপ ছিল ?
উত্তর – উনিশ শতকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপা বইগুলির প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য ছিল—[1] বইগুলির মুদ্রণ ও সাজসজ্জা আকর্ষণীয় করার চেষ্টা হত। [2] ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক এবং সহায়ক পুস্তক প্রচুর প্রকাশিত হত। [3] অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাবসায়িক লাভই বই প্রকাশের অন্যতম লক্ষ্য হত।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

একটি বাক্যে উত্তর দাও

1. ‘Compendio Spiritual Da Vida Christa’ নামে গ্রন্থটি কোথায় মুদ্রিত হয়েছিল ?
উত্তর – ‘Compendio Spiritual Da Vida Christa’ নামে গ্রন্থটি পোর্তুগিজদের গোয়ার মুদ্রণযন্ত্রে (১৫৬১ খ্রি.) মুদ্রিত হয়েছিল।
2. ‘Compendio Spiritual Da Vida Christa’ বইটি কোথায় সংরক্ষিত আছে?
উত্তর – ‘Compendio Spiritual Da Vida Christa’ বইটি নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
3. কোন্ ছাপাখানায় কলকাতার প্রথম ক্যালেন্ডার মুদ্রিত হয় ?
উত্তর – জেমস অগাস্টাস হিকি-এর ছাপাখানায় কলকাতার প্রথম ক্যালেন্ডার মুদ্রিত হয়।
4. প্রথম কোন বাঙালি ছাপাখানার জন্য অক্ষরের ছাঁচ বা টাইপ তৈরি
উত্তর – পঞ্চানন কর্মকার প্রথম বাঙালি হিসেবে ছাপাখানার জন্য অক্ষরের ছাঁচ বা টাইপ তৈরি করেন।
5. বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন্ সাহেবের নাম জড়িত?
উত্তর – বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অ্যান্ড্রুজ সাহেবের নাম জড়িত।
6. কোন্ বছর শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়? 
উত্তর – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ।
7. শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা কোনটি?
উত্তর – শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা হল ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮ খ্রি.)।
৪. ঢাকা প্রেস কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – ঢাকা প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
9. চিনে কবে মুদ্রণশিল্পের আবিষ্কার হয় ?
উত্তর – ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনে মুদ্রণশিল্পের আবিষ্কার হয়।
10. চিনের মুদ্রণপ্রযুক্তি কাদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছেছিল ?
উত্তর – চিনের মুদ্রণপ্রযুক্তি আরবদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছেছিল।
11. বোম্বাইয়ে কবে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয়?
উত্তর – বোম্বাইয়ে ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয়।
12. কে, কবে চুঁচুড়ায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর – চুঁচুড়ায় প্রথম চার্লস উইলকিনস ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
13. বাংলার প্রথম সংবাদপত্র কোনটি?
উত্তর – বাংলার প্রথম সংবাদপত্র ‘দিগদর্শন’ (১৮১৮ খ্রি.)।
14. ঢাকায় প্রথম কবে ছাপাখানা স্থাপিত হয়?
উত্তর – ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
15. পূর্ববঙ্গের কোথায়, কবে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয়?
উত্তর – পূর্ববঙ্গের রংপুরে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে।
16. ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থটি কে রচনা করেন ?
উত্তর – ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’-টি রচনা করেন রাধাকান্ত দেব।
17. ‘পাখি সব করে রব’ কবিতাটি কার লেখা ?
উত্তর – ‘পাখি সব করে রব’ কবিতাটি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা।
18. ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত গোবিন্দপ্রসাদ দাস রচিত উল্লেখযোগ্য পাঠ্যবই কোন্‌টি?
উত্তর – ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত গোবিন্দপ্রসাদ দাস রচিত উল্লেখযোগ্য পাঠ্যবই হল ‘ব্যাকরণ সার’।
19. অষ্টাদশ শতকে কোন্‌টি কলকাতার সবচেয়ে বড়ো ছাপাখানা ছিল?
উত্তর – অষ্টাদশ শতকে কলকাতার সবচেয়ে বড়ো ছাপাখানা ছিল ‘অনারেবল কোম্পানিজ প্রেস’।
20. বাবুরাম কত খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – বাবুরাম ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।
21. আনুমানিক কবে, কোন্ দেশে সর্বপ্রথম মুদ্রণশিল্পের উদ্ভব ঘটে?
উত্তর – আনুমানিক ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে চিনে সর্বপ্রথম মুদ্রণশিল্পের উদ্ভব ঘটে।
22. কে, কবে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন?
উত্তর – জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন।
23. কে ‘ছাপাখানার জনক’ নামে পরিচিত?
উত্তর – জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ ‘ছাপাখানার জনক’ নামে পরিচিত।
24. ভারতের কোথায়, কারা প্রথম আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন ?
উত্তর – ভারতের গোয়ায় পোতুর্গিজরা প্রথম আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন।
25. সবচেয়ে পুরোনো বাংলা মুদ্রিত বইয়ের নমুনা কোথায় পাওয়া যায়?
উত্তর – সবচেয়ে পুরোনো বাংলা মুদ্রিত বইয়ের নমুনা পাওয়া যায় ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মুদ্রিত একটি বইয়ে।
26. বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম চিত্রিত গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর – বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম চিত্রিত গ্রন্থটি হল ১৮১৬ সালে কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির ছাপাখানা থেকে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের উদ্যোগে প্রকাশিত রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য।
27. বাংলা মুদ্রণশিল্পে পঞ্চানন কর্মকারের অবদান কী ?
উত্তর – পঞ্চানন কর্মকার উন্নত বাংলা অক্ষরের ছাঁচ বা টাইপ তৈরি করেন।
28. লাইনো টাইপ দিয়ে প্রথম কোন্ বইটি ছাপা হয়?
উত্তর – লাইনো টাইপ দিয়ে প্রথম ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালেদ রচিত ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ) বইটি প্রকাশিত হয়।
29. শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত একটি বাংলা সাহিত্যের নাম লেখো।
উত্তর – শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত একটি বাংলা সাহিত্য হল রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র।
30. শিশুশিক্ষা-বিষয়ক প্রথম উল্লেখযোগ্য বাংলা বই কোনটি?
উত্তর – শিশুশিক্ষা-বিষয়ক প্রথম উল্লেখযোগ্য বাংলা বই হল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা ‘শিশুশিক্ষা’।
31. কে, কৰে ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থটি রচনা করেন?
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
32. এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকার নাম কী ছিল?
উত্তর – এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকার নাম ছিল ‘এশিয়াটিক রিসার্চেস’।
33. ‘বিদ্যাসাগর সাট’ বলতে কী বোঝো?
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা মুদ্রণের কাজে সহায়তার জন্য অক্ষর সংযোজনের বিশেষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতি ‘বিদ্যাসাগর সাট’ নামে পরিচিত।
34. ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থের চিত্রগুলি কে এঁকেছেন?
উত্তর – ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থের চিত্রগুলি এঁকেছিলেন শিল্পী রামচাঁদ রায়।
35. প্রথম কোথায় প্রসেস প্রিন্টিং-এর বিকাশ শুরু হয়?
উত্তর – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে ছাপাখানায় প্রথম প্রসেস প্রিন্টিং-এর বিকাশ শুরু হয়।
36. কে ‘টুনটুনির বই’ রচনা করেন?
উত্তর – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘টুনটুনির বই’ রচনা করেন।
37. ‘শিশুসেবধি’ গ্রন্থটি কে রচনা করেন?
উত্তর – ‘শিশুসেবধি’ গ্রন্থটি রচনা করেন ক্ষেত্রমোহন দত্ত।

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. সর্বপ্রথম. ………. আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
উত্তর – জার্মানিতে
2. ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ………. কলকাতায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর – জেমস অগাস্টাস হিকি
3. ……….. ছাপাখানাটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ ছাপাখানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
উত্তর – শ্রীরামপুরের
4. ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ………. পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
উত্তর – সমাচারচন্দ্রিকা
5. সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ………..।
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
6. প্রথমদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য পাঠ্যপুস্তক ছাপা হত ………. ছাপাখানা থেকে।
উত্তর – শ্রীরামপুরের
7. শিক্ষার্থীদের হাতে কম খরচে বা বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ……….. গঠিত হয়।
উত্তর – ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি
৪. ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে …………. টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
উত্তর – ১০৩9.
9. ………. তৈরি করা অক্ষরে উইলিয়াম কেরি বাইবেলের বাংলা অনুবাদ ছাপেন।
উত্তর – পঞ্চানন কর্মকারের
10. ………… উদ্যোগে শিশুশিক্ষা-বিষয়ক ‘লিপিধারা’ গ্রন্থটি প্রণীত হয়।
উত্তর – শ্রীরামপুর মিশনের
11. ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত কেদারেশ্বর চক্রবর্তীর লেখা বইটি হল ………..।
উত্তর – বাঙ্গালার ইতিহাস
12. ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ বইটি প্রকাশ করেন ………..।
উত্তর – গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
13. ……….. গ্রন্থটি বাংলার প্রথম ‘প্রাইমার’ গ্রন্থ নামে পরিচিত।
উত্তর – শিশুশিক্ষা
14. প্রথম সচিত্র বাংলা বই হল ………..।
উত্তর – অন্নদামঙ্গল
15. উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ……….. জেলায়।
উত্তর – ময়মনসিংহ
16. উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানার সঙ্গে একটি ……….. খোলেন।
উত্তর – স্টুডিয়ো
17. উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছোটোদের জন্য ……….. পত্রিকা প্রকাশ করেন।
উত্তর – সন্দেশ
18. ……….. ‘হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং’ নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন।
উত্তর – উপেন্দ্রকিশোর

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. বাংলার ক্যাসটন বলা হয়—
(a) পঞ্চানন কর্মকারকে
(b) সুরেশচন্দ্র মজুমদারকে
(c) চার্লস উইলকিনসকে
(d) জেমস অগাস্টাস হিকিকে
উত্তর – (c) চার্লস উইলকিনসকে
2. ‘বাংলা মুদ্রণশিল্পের জনক’ নামে পরিচিত ছিলেন—
(a) জেমস অগাস্টাস হিকি
(b) নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড
(c) চার্লস উইলকিনস
(d) মার্শম্যান
উত্তর – (c) চার্লস উইলকিনস
3. মুদ্রণযন্ত্রে সর্বপ্রথম বাংলা বই ছাপা হয়—
(a) রোমান হরফে
(b) বাংলা হরফে
(c) সংস্কৃত হরফে
(d) হিন্দি হরফে
উত্তর – (a) রোমান হরফে
4. বাংলা ভাষায় প্রথম ছাপা বই হল—
(a) বর্ণপরিচয়
(b) এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ
(c) মঙ্গল সমাচার মতিয়ের
(d) অন্নদামঙ্গল
উত্তর – (d) অন্নদামঙ্গল
5. কলকাতায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) মার্শম্যান
(b) জেমস অগাস্টাস হিকি
(c) গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
(d) উইলিয়াম কেরি
উত্তর – (b) জেমস অগাস্টাস হিকি
6. হালেদ রচিত গ্রন্থটি কার তৈরি করা অক্ষরে মুদ্রিত হয়?—
(a) পঞ্চানন কর্মকারের
(b) মনোহর কর্মকারের
(c) চার্লস উইলকিনস-এর
(d) সুরেশচন্দ্র মজুমদারের
উত্তর – (c) চার্লস উইলকিনস-এর
7. ভারতে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব হল—
(a) ফরাসিদের
(b) ইংরেজদের
(c) পোর্তুগিজদের
(d) ভারতীয়দের
উত্তর – (c) পোর্তুগিজদের
৪. শ্রীরামপুরে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) উইলিয়াম কেরি
(b) চার্লস উইলকিনস
(c) অগাস্টাস হিকি
(d) জোশুয়া মার্শম্যান
উত্তর – (a) উইলিয়াম কেরি
9. উইলিয়াম কেরি ছিলেন—
(a) ইংরেজির শিক্ষক
(b) বাংলার শিক্ষক
(c) গণিতের শিক্ষক
(d) বিজ্ঞানের শিক্ষক
উত্তর – (b) বাংলার শিক্ষক
10. বটতলা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত বই হল—
(a) চৈতন্যচরিতামৃত
(b) নববাবু বিলাস
(c) বর্ণপরিচয়
(d) লোরচন্দ্রাণী
উত্তর – (b) নববাবু বিলাস
11. শ্রীরামপুর ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে
12. ‘সিটি বুক সোসাইটি’ (১৮৯৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
(b) সত্যজিৎ রায়
(c) সন্দীপ রায়।
(d) যোগীন্দ্রনাথ সরকার
উত্তর – (d) যোগীন্দ্রনাথ সরকার
13. কলকাতা সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) দ্বারকানাথ ঠাকুর
(b) গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
(c) মার্শম্যান
(d) বিদ্যাসাগর
উত্তর – (d) বিদ্যাসাগর
14. ‘দিগদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন-
(a) উইলিয়াম কেরি
(b) মার্শম্যান
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রামমোহন রায়
উত্তর – (b) মার্শম্যান
15. এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়-
(a) চুঁচুড়ায়
(b) ঢাকায়
(c) কলকাতায়
(d) শ্রীরামপুরে
উত্তর – (d) শ্রীরামপুরে
16. ছাপাখানার জনক বলা হয়-
(a) সুরেশচন্দ্র মজুমদারকে
(b) পঞ্চানন কর্মকারকে
(c) চার্লস উইলকিনসকে
(d) গুটেনবার্গকে
উত্তর – (d) গুটেনবার্গকে
17. ছাপাখানার প্রথম বাঙালি ব্যবসায়ী হলেন-
(a) গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
(b) পঞ্চানন কর্মকার
(c) সুরেশচন্দ্র মজুমদার
(d) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার
উত্তর – (a) গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
18. প্রথম সচিত্র বাংলা বইয়ের নাম-
(a) অন্নদামঙ্গল
(b) বর্ণপরিচয়
(c) শিশুশিক্ষা
(d) সন্দেশ
উত্তর – (a) অন্নদামঙ্গল
19. বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ছাপা বই হল-
(a) বর্ণপরিচয়
(b) শিশুশিক্ষা
(c) হিতোপদেশ
(d) প্রতাপাদিত্য চরিত্র
উত্তর – (d) প্রতাপাদিত্য চরিত্র
20. ‘বার্তাবহ যন্ত্র’ নামে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়-
(a) কলকাতায়
(b) শ্রীরামপুরে
(c) রংপুরে
(d) ঢাকায়
উত্তর – (c) রংপুরে
21. ‘বর্ণমালা’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে—
(a) লন্ডন চার্চ মিশনারি
(b) ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি
(c) শ্রীরামপুর মিশন
(d) স্কুল বুক সোসাইটি
উত্তর – (d) স্কুল বুক সোসাইটি
22. বাংলায় শিশুশিক্ষা-বিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থটি ছিল—
(a) বাল্যশিক্ষা
(b) বর্ণপরিচয়
(c) শিশুশিক্ষা
(d) বর্ণমালা
উত্তর – (b) বর্ণপরিচয়
23. ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থটি রচনা করেন—
(a) মদনমোহন তর্কালঙ্কার
(b) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রামসুন্দর বসাক
উত্তর – (a) মদনমোহন তর্কালঙ্কার
24. পূর্ববঙ্গে শিশুশিক্ষা-বিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থটি ছিল—
(a) বর্ণপরিচয়
(b) বাল্যশিক্ষা
(c) শিশুশিক্ষা
(d) বর্ণমালা
উত্তর – (b) বাল্যশিক্ষা
25. বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল—
(a) ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে
26. গীতগোবিন্দ মুদ্রিত হয়—
(a) হিন্দি প্রেস থেকে
(b) সংস্কৃত প্রেস থেকে
(c) উর্দু প্রেস থেকে
(d) বেঙ্গলি প্রেস থেকে
উত্তর – (b) সংস্কৃত প্রেস থেকে
27. বাংলার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র কোনটি?
(a) সোমপ্রকাশ
(b) গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা
(c) বাঙ্গাল গেজেট
(d) বেঙ্গল গেজেট
উত্তর – (d) বেঙ্গল গেজেট
28. কোন ধরনের ছাপার কাজ করে ছাপাখানার ব্যাবসার সর্বাধিক প্রসার ঘটে?
(a) অনুবাদ গ্রন্থ
(b) ধর্মগ্রন্থ
(c) পাঠ্যবই
(d) সরকারি কাগজপত্র
উত্তর – (c) পাঠ্যবই
29. উপেন্দ্রকিশোর আধুনিক ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণশিল্প সম্পর্কে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কাকে বিদেশ পাঠান?
(a) সুখলতা রাওকে
(b) সুকুমার রায়কে
(c) সত্যজিৎ রায়কে
(d) সন্দীপ রায়কে
উত্তর – (b) সুকুমার রায়কে
30. ভারতে ‘হাফ টোন প্রিন্টিং’ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন—
(a) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
(b) সুকুমার রায়
(c) পঞ্চানন কর্মকার
(d) চার্লস উইলকিন্স
উত্তর – (a) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

TOPIC – B বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. * ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
ভূমিকা: ব্রিটিশ সরকার ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের বিভিন্ন অফিস-আদালত প্রতিষ্ঠা করলে এসব স্থানে কাজের জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনে সরকার ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের আধুনিক শিক্ষার সূচনা করে। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা হয় বাংলায়। এই সময় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বাংলা তথা ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  1. ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (আই এ সি এস)
    1. প্রতিষ্ঠা: পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত গবেষণা, অধ্যয়ন, বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতার আয়োজন প্রভৃতির উদ্দেশ্যে বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪ খ্রি.) ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই কলকাতায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (সংক্ষেপে আই এ সি এস) প্রতিষ্ঠা করেন।
    2. পত্রিকা: আই এ সি এস থেকে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স নামে বিজ্ঞান-বিষয়ক জার্নাল প্রকাশিত হয়। এই জার্নালে এখানকার বিজ্ঞানী ও গবেষকদের গবেষণাকর্ম নিয়মিত প্রকাশিত হত।
    3. খ্যাতনামা গবেষকগণ: এখানকার গবেষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সুব্রত্মণ্যম চন্দ্রশেখর, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃষ্ণান প্রমুখ।
    4. রমন ক্রিয়া: এখানে গবেষণা করে বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন তাঁর বিখ্যাত রমন ক্রিয়া (রমন এফেক্ট) আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
  2. কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ
    1. প্রতিষ্ঠা: বিশিষ্ট আইনজীবী স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ বা ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়।
    2. খ্যাতনামা শিক্ষকগণ: সে যুগের খ্যাতনামা শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশির কুমার মিত্র প্রমুখ কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদান করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় এখানে বিশ্বমানের শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এর যোগসূত্র স্থাপিত হয়।
    3. খ্যাতনামা শিক্ষার্থীগণ: এখানে পড়াশোনা করে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেন।
  3. বসু বিজ্ঞান মন্দির
    1. প্রতিষ্ঠা: ভারতে একটি আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সে যুগের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (৩০ নভেম্বর) কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর মুন্সিগঞ্জের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের বৃহদংশ এই প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যয় করেন।
    2. বিষয়-বৈচিত্র্য: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানের মৌলিক গবেষণা চালানোই ছিল বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে এখানে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়।
  4. বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট
    1. প্রতিষ্ঠা: তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে (২৫ জুলাই) কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট নামে একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট-এর সঙ্গে মিলে যায়।
    2. বিষয়-বৈচিত্র্য: কলাবিভাগের পাশাপাশি এখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণা কর্ম প্রকাশের জন্য এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।

উপসংহার: বাংলার বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দীর্ঘ গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র বসু ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল্স প্রতিষ্ঠা করে দেশকে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখান। সত্যেন্দ্রনাথ বোস এবং মেঘনাদ সাহা স্বাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনে যুক্ত থেকে দেশ গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

2. ভারতের বিজ্ঞান আন্দোলনে মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদান কী?
অথবা, ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষা ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদান কী? 
উত্তর – ভারতের বিজ্ঞান শিক্ষা ও আন্দোলনে মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদান
ভূমিকা: ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় যাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪ খ্রি.)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এম. ডি ডিগ্রিধারী মহেন্দ্রলাল অ্যালোপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথি—–চিকিৎসার এই দুই পদ্ধতিতেই দক্ষতা অর্জন করেন। ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদানগুলির মধ্যে রয়েছে-
  1. যুক্তিবাদের প্রসার: পেশায় চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস দূর করে তাদের যুক্তিবাদের সমর্থক হতে বলেন। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ হলেই, সমাজ কুসংস্কারমুক্ত হবে।
  2. আই এ সি এস-এর প্রতিষ্ঠা: দেশীয় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার বিশিষ্ট বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার উইজিন লাঁতো-র সহায়তায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা’ (সংক্ষেপে IACS) প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠান যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়।
  3. পরিচালন সমিতি: মহেন্দ্রলাল সরকার আমৃত্যু ‘আই এ সি এস’ এর সম্পাদক। লেন। এ ছাড়াও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির সদস্যপদ অলংকৃত করেন। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি এর অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
  4. অধিকর্তা নিয়োগ: ‘আই এ সি এস’-কে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সঞ্চালনার উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রলাল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে অধিকর্তা পদে নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ড. নীলরতন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা পদে নিযুক্ত হন।
  5. গবেষণা : এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা, অধ্যয়ন এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতার সুব্যবস্থা করা হয়। উক্ত গবেষণা ও বক্তৃতা প্রদানের কাজে মহেন্দ্রলাল দেশবিদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের এখানে শামিল করেন।
  6. গবেষণাপত্র : গবেষক অধ্যাপকদের বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক কাজগুলি প্রকাশের জন্য আই এ সি এস ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়াও দেশবিদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায় এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হত।
  7. বিজ্ঞানী ও আবিষ্কার : ড. মহেন্দ্রলাল সরকার আই এ সি এস-এ সমকালীন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের যুক্ত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বোস, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সুব্রক্ষ্মণ্যম চন্দ্রশেখর, মেঘনাদ সাহা, কে. এস. কৃয়াণ প্রমুখ। এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেই বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন তাঁর বিখ্যাত ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় ‘নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

উপসংহার: আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের আই এ সি এস বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমনের নোবেল পুরস্কার লাভ প্রভৃতি এই প্রতিষ্ঠানকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যান। সমাজসংস্কারের কাজেও মহেন্দ্রলালের অসামান্য অবদান রয়েছে।

3. উনিশ শতকে বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ সম্পর্কে যা জান লেখো।
অথবা, বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। 
উত্তর – বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ও বিজ্ঞান শিক্ষার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। এর ফলে বাংলা কারিগরি শিক্ষার দ্রুত প্রসার ও অগ্রগতি শুরু হয়। এ বিষয়ে কয়েকজন ইংরেজ ও ভারতীয়র উদ্যোগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
  1. শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা : বাংলার সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’। কলেজটি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে শিবপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং এর নতুন নাম হয় ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’। এই কলেজ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ডিগ্রি প্রদান শুরু করে।
  2. কারিগরি শিক্ষার প্রসারের দাবি: উনিশ শতকের শেষ দিকে কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্রগুলিতে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের দাবি জানানো শুরু হয়। এর পরিণতি হিসেবে কলকাতায় ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন’ (১৯০৪ খ্রি.), ‘যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ (১৯০৬ খ্রি.) প্রভৃতি গড়ে ওঠে।
  3. বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে দেশে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় । সেই সূত্রেই বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্যে আইনজীবী তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই কলকাতায় ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ নামে একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে বাংলার বহু শিক্ষিত যুবক কারিগরিবিদ্যা লাভ করে স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।
  4. CET: দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ও ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ’ একত্রে মিশে যায়। এর নতুন নাম হয় ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল’। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ বা CET।
    1. জ্ঞানচর্চার শাখা : CET-এ কলাবিভাগের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়।
    2. জার্নাল প্রকাশ: CET-এর ছাত্রছাত্রীরা ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এই জার্নালের প্রথম সংখ্যাটি তাঁরা স্বদেশি আন্দোলনের যুগের সেই সকল আত্মত্যাগীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন যাঁরা জাতীয় শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

উপসংহার: ব্রিটিশ শাসক ও শিল্পপতিরা কারিগরি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অদক্ষ বলে মনে করত। এজন্য তারা কারিগরি শিক্ষার পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করায় বাংলায় কারিগরি শিক্ষার যথার্থ প্রসার ব্যহত হয়। তবে স্বাধীনতার পরে ভারতে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল ভারতের বিভিন্ন শহর-সহ পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’ (১৯৫১ খ্রি.)-র প্রতিষ্ঠা।

4. জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা উল্লেখ করে “বসু বিজ্ঞান মন্দির” প্রতিষ্ঠা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা
ভূমিকা: বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭ খ্রি.) ছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতের আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার পুরোধা। প্রাথমিক পর্বে তাঁর জজ ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও পিতার নির্দেশে তিনি বিজ্ঞান সাধনায় মন দেন এবং পরবর্তীকালে একজন বড়োমাপের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার দিকগুলি ছিল—
  1. চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন: বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করে জগদীশচন্দ্র টানা এক বছর চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু ওই কাজে তাঁর স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চা ছেড়ে ক্রাইস্ট কলেজে ভরতি হয়ে যান।
  2. পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহ: ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানবিভাগে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এই কাজে তাঁর প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন রেভারেন্ড ফাদার লাফোন্ট। পরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজে যোগ দেন। এই সময় থেকেই তাঁর প্রকৃত গবেষণা জীবনের সূচনা হয়।
  3. পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা: জগদীশচন্দ্র পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিদ্যুত্তরঙ্গের আলোকধর্মী প্রবণতার মধ্যে প্রতিফলন, সমবর্তী বিচ্ছুরণ, সর্বমোট প্রতিফলন, প্রতিসরণ প্রভৃতি। তাঁর এই গবেষণাগুলি বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচিত করে।
  4. বেতার বার্তা আবিষ্কার: জগদীশচন্দ্র তাঁর আকাশ-তরঙ্গ ও বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গ গবেষণার সূত্র ধরে বেতার বার্তার সূত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘ক্রিস্ট্যাল রিসিভার’ যন্ত্রের দ্বারা তিনি কোনোরকম তারের সংযোগ ছাড়াই শব্দ আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করেন। নিজের বাসভবন থেকে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত তাঁর কর্মস্থল প্রেসিডেন্সি কলেজে শব্দ প্রেরণের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর এই যন্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণ করেন।
  5. উদ্ভিদবিদ্যার গবেষণা: পদার্থবিদ্যার পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদবিদ্যার ক্ষেত্রেও গবেষণার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র প্রথম প্রমাণ করে যে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তাঁর এই আবিষ্কার উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে।
  6. গবেষণামূলক রচনা: জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান গবেষণামূলক অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এগুলি ‘দ্য ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন’, ‘প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি’-সহ বিখ্যাত পত্রপত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত হত।
  7. বসু বিজ্ঞান মন্দির : জগদীশচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা (১৯১৫ খ্রি.) দেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (৩০ নভেম্বর) কলকাতায় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ বা ‘বোস ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘দ্য ভয়েস অব লাইফ’ শিরোনামে স্বাগত ভাষণে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।

উপসংহার: পরাধীন ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রগতিতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অসামান্য অবদান ছিল। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা জগদীশচন্দ্র বসুকে গ্যালিলিয়ো-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন—“ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি/তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।”

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – ঔপনিবেশিক বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাংলায় পাশ্চাত্য ধাঁচের আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার অস্তিত্ব ছিল না। ঊনবিংশ শতক থেকে বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ শুরু হয়।
  1. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্যশিক্ষারযথেষ্টপ্রসারঘটে।এর ফলেবাংলারশিক্ষার্থীরা পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা সম্পর্কে অবহিত হয়। এভাবে বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়।
  2. প্রাথমিক উদ্যোগ: বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রথম দিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ছিল স্যার উইলিয়াম জোনস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.)। এই সোসাইটির পত্রিকায় বিজ্ঞান-বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হত। এ ছাড়া রসায়নবিদ জন ম্যাকে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজে রসায়নশাস্ত্র সম্পর্কে পড়ানো শুরু করেন।
  3. বিজ্ঞান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সরকার এবং কোনো কোনো বিশিষ্ট ভারতীয় মনীষীর উদ্যোগে বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই সব প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রভৃতি।
  4. কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : বাংলায় বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৮৫৬ খ্রি.), অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন (১৯০৪ খ্রি.), যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৯০৬ খ্রি.) প্রভৃতি।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার যে সূত্রপাত ঘটেছিল তা কিছুকালের মধ্যেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভিত্তির ওপরই স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার পথচলা শুরু হয় ।

2. *ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (আই এ সি এস)-এর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সম্পর্কে কী জান?
অথবা, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার স্মরণীয় কেন?
উত্তর – আই এ সি এস-এর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা
ভূমিকা: আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণার উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক ভারতে যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স বা আই এ সি এস।
  1. প্রতিষ্ঠা : বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো-র সহায়তায় বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪ খ্রি.) ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে (২৯ জুলাই) কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা লাভের পর এই প্রতিষ্ঠানটি যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়।
  2. পরিচালনা: ড. মহেন্দ্রলাল সরকার আমৃত্যু আই এ সি এস-এর সম্পাদক ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ। প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতা করেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
  3. অধিকর্তা : আই এ সি এস-এর প্রথম অধিকর্তা ছিলেন প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় (১৯১২ খ্রি.)। পরবর্তীকালে ড. নীলরতন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা পদে নিযুক্ত হন।
  4. উদ্যোগ: আই এ সি এস-এর কর্তৃপক্ষের সক্রিয় উদ্যোগে ও পরিচালনায় এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা, বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতা প্রদান, গবেষণাপত্র প্রকাশ প্রভৃতির ব্যবস্থা হয়। গবেষকদের গবেষণামূলক কাজ প্রকাশের জন্য এখান থেকে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।

উপসংহার: ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (আই এ সি এস) এর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ড. মহেন্দ্রলাল সরকার ভারতে প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সূচনা করেন। ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সহায়তা ও দক্ষ পরিচালন গোষ্ঠী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অধিকর্তা পদে যোগদান এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেছে।

3. * ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (আই এ সি এস)-এর প্রতিষ্ঠা এবং বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS)-এর অবদান লেখো।
উত্তর – আই এ সি এস
ভূমিকা: বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা ও চর্চার উদ্দেশ্যে উনিশ শতকে ভারতে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স বা আই এ সি এস।
  1. প্ৰতিষ্ঠা : বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো-র সহযোগিতায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এটি যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়।
  2. গবেষণা: এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত মৌলিক গবেষণা এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এসব গবেষণা ও বক্তৃতা প্রদানের কাজে দেশবিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী অংশ নিয়েছেন।
  3. গবেষণাপত্র প্রকাশ: নিজেদের বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক কাজগুলি প্রকাশের জন্য আই এ সি এস ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। এ ছাড়া দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও বিজ্ঞান পত্রিকায় এখানকার গবেষক ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজ প্রকাশিত হত।
  4. খ্যাতনামা বিজ্ঞানী: আই এ সি এস-এর বিজ্ঞান গবেষণার কাজের সঙ্গে বিভিন্ন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সুব্রম্মণ্যম চন্দ্রশেখর, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃয়ান প্রমুখ।
  5. গবেষণা বিদ্যালয়: বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এখানে একটি সক্রিয় গবেষণা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এতে এক্স রশ্মি, আলোকবিজ্ঞান, চুম্বকত্ব, রমন ক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে নানা মৌলিক গবেষণার কাজ হয়।

উপসংহার: ‘আই এ সি এস’-এর প্রতিষ্ঠা বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণাপত্র প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

4. বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল?
উত্তর – বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদান
ভূমিকা: বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে মহেন্দ্রলাল সরকারের অসামান্য অবদান রয়েছে।
  1. যুক্তিবাদের প্রচার : পেশায় চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস দূর করে তাদের যুক্তিবাদের সমর্থক হতে বলেন।
  2. আই এ সি এস-এর প্রতিষ্ঠা : পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত মৌলিক গবেষণা, বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতার আয়োজন প্রভৃতি উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রলাল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা’ (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা (আই এ সি এস) প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁকো তাঁকে এ কাজে বিশেষ সহায়তা করেন।
  3. বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ : মহেন্দ্রলালের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আই এ সি এস তার নিজস্ব পত্রিকা প্রকাশ করে। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামক এই পত্রিকাতে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রকাশিত হত।

উপসংহার: বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে মহেন্দ্রলালের উদ্যোগ বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে অনেক ধাপ এগিয়ে দেয়। জগদীশচন্দ্র বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন। এখানে গবেষণা করেই চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন ‘রমন ক্রিয়া’ (রমন এফেক্ট) আবিষ্কার করেন, যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

5. *আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের কী ভূমিকা ছিল? অথবা, বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের উৎকর্ষ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা
ভূমিকা: লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সময় স্বদেশি বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষাদরদি স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  1. মৌলিক গবেষণা : কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সক্রিয় সহযোগিতা পেয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণার কাজ করার সুযোগ পান। ফলে বিজ্ঞানচর্চার যথেষ্ট মানোন্নয়ন ঘটে।
  2. খ্যাতনামা শিক্ষার্থী: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে পড়াশোনা এবং বিজ্ঞানসাধনা করে বহু শিক্ষার্থী পরবর্তীকালে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই রকম শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
  3. খ্যাতনামা শিক্ষক : সেই যুগের বহু স্বনামধন্য শিক্ষক ও বিজ্ঞানী কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদান করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশিরকুমার মিত্র প্রমুখ। তাঁদের পরিশ্রমে এখানে বিশ্বমানের শিক্ষাদানব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এর যোগসূত্র স্থাপিত হয়।
  4. শিক্ষকদের উদ্যোগ: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের বিভিন্ন শিক্ষক দেশ ও সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানকার শিক্ষক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল্স’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের যুবসমাজকে সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী না থেকে স্বনির্ভর হতে উৎসাহিত করেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা স্বাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন-এ যুক্ত থেকে দেশ গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক আমলে ‘কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ’ দেশীয় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে। বিশিষ্ট অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে এবং কৃতী ছাত্রদের সাফল্যে এই প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

6. *বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’-এর অবদান সংক্ষেপে লেখো।
অথবা, বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের উৎকর্ষ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – বিজ্ঞানচর্চায় বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অবদান / উৎকর্ষ
ভূমিকা: ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে যেসকল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট। ভারতের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
  1. বিভিন্ন শাখা: বসু বিজ্ঞান মন্দির-এ পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়।
  2. উন্নত গবেষণা : জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বিশ্বমানের উন্নত গবেষণার ব্যবস্থা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মুন্সিগঞ্জের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের একটি বড়ো অংশ এখানে ব্যয় করেন। গবেষণার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জগদীশচন্দ্র বসুকে অর্থ সাহায্য করেন।
  3. ক্রেসকোগ্রাফ আবিষ্কার: বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দীর্ঘ গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র বসু ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন, প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরও প্রাণ এবং অনুভূতি শক্তি আছে। এখানকার গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল হল জগদীশচন্দ্র বসু কর্তৃক রেডিয়ো আবিষ্কার যা বর্তমানে বিশ্বের বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ স্বীকৃতিলাভ করেছে।
  4. আন্তর্জাতিক খ্যাতি: বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞানচর্চায় বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অবদান আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে। এখানকার গবেষকগণ পরবর্তীকালে ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞানচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছেন।

উপসংহার: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়। আধুনিক গবেষণাগারে জগদীশচন্দ্র বসুর ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কার এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেছে।

7. *বাংলার কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট-এর অবদান লেখো। 
অথবা, কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’-এর কী ভূমিকা ছিল ?
অথবা, টীকা লেখো: বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট।
উত্তর – বাংলার কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট
ভূমিকা: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে তারকনাথ পালিত (১৮৩১-১৯১৪ খ্রি.) কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।
  1. জাতীয় শিক্ষার উদ্যোগ : স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম উদ্যোগ ছিল বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এই উদ্দেশ্যে আইনজীবী তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট নামে একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
  2. সমন্বয়: দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ একত্রে মিশে যায় এবং বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল নাম গ্রহণ করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বা CET।
  3. কার্যক্রম : উভয় প্রতিষ্ঠান মিশে যাওয়ার পর কলাবিভাগের পাশাপাশি এখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়। এর ফলে বাংলার বহু শিক্ষিত যুবক কারিগরি বিদ্যা লাভ করে স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।
  4. জার্নাল: কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-র ছাত্রছাত্রীরা ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এই জার্নালের প্রথম সংখ্যাটি তারা স্বদেশি আন্দোলনের যুগের সেই সকল আত্মত্যাগীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে যাঁরা জাতীয় শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

উপসংহার: বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় শিক্ষার দ্বারা বাংলার যুবকদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলা। বলা বাহুল্য যে, এই প্রতিষ্ঠান তার উদ্দেশ্যপূরণে সফল হয়েছিল।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *ব্রিটিশ শাসনকালে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – ব্রিটিশ শাসনকালে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হল ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’, ‘কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ’, ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’, ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’, ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ প্রভৃতি।
2. * ব্রিটিশ শাসনকালে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – ব্রিটিশ শাসনকালে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৮৫৬ খ্রি.), কলকাতায় ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন’ (১৯০৪ খ্রি.), যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৯০৬ খ্রি.) প্রভৃতি।
3. *কে, কবে, কোথায় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন?
অথবা, IACS কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তর – বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো-র সহায়তায় বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন।
4. ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?
উত্তর – ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল– [1] পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত গবেষণা এবং [2] বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতার আয়োজন।
5. উনিশ শতকে বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর ভূমিকা কী ছিল?
অথবা, বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে IACS-এর ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর – উনিশ শতকে বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। [1] এখানে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত গবেষণা চলত। [2] দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও গবেষক এখানে গবেষণা করেছেন ও বিজ্ঞান-বিষয়ক বহু বক্তৃতা প্রদান করেছেন। [3] এখানকার গবেষণার কাজ প্রকাশের উদ্দেশ্যে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে নিজস্ব জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।
6. *মহেন্দ্রলাল সরকার কে ছিলেন?
অথবা, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার কেন স্মরণীয় ?
উত্তর – ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪ খ্রি.) ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। তিনি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে (২৯ জুলাই) কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠা করেন।
7. *কে, কোথায় গবেষণা করে ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেন?
উত্তর – বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স বা আই এ সি এস-এ গবেষণা করে রমন এফেক্ট আবিষ্কার করেন।
8. * মেঘনাদ সাহা কোন্ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন? এখানে কোন বিষয়ে মৌলিক গবেষণার কাজ চলত ?
উত্তর – মেঘনাদ সাহা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
এই গবেষণা বিদ্যালয়ে এক্স রশ্মি, আলোকবিজ্ঞান, চুম্বকত্ব, রমন ক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে নানা মৌলিক গবেষণার কাজ চলত।
9. *কারা, কবে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – আইনজীবী ও শিক্ষাদরদি স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
10 *কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষকের নাম লেখো।
উত্তর – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশির কুমার মিত্র প্রমুখ।
11. *কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর নাম লেখো যারা পরবর্তীকালে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেন।
উত্তর – সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী যাঁরা পরবর্তীকালে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেন।
12. *তারকনাথ পালিত কে ছিলেন?
উত্তর – স্যার তারকনাথ পালিত ছিলেন একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ও শিক্ষাদরদি। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের যুগে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী ঘোষের সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
13. * রাসবিহারী ঘোষ কে ছিলেন?
উত্তর – স্যার রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ও শিক্ষাদরদি। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের যুগে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তারকনাথ পালিতের সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
14. *কে, কবে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন? বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?
উত্তর – খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।
বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োফিজিক্স, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানের গবেষণার ব্যবস্থা করা।
15. *বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কোন্ কোন্ বিষয়ে গবেষণা হত?
উত্তর – বসু বিজ্ঞান মন্দিরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োফিজিক্স, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানের গবেষণা হত।
16. ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুরে কী উদ্দেশ্যে টেকনিকাল কলেজ স্থাপিত হয় ?
উত্তর – স্বদেশি আন্দোলনের যুগে বাংলায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে যাদবপুরে টেকনিকাল কলেজ স্থাপিত হয়।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

একটি বাক্যে উত্তর দাও

1. আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান কোনটি?
উত্তর – আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানটি হল ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা আই এ সি এস।
2. আই এ সি এস-এর নিজস্ব পত্রিকার নাম কী ছিল?
উত্তর – আই এ সি এস-এর নিজস্ব পত্রিকার নাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’।
3. ‘টেক’ কাদের প্রকাশিত জার্নাল ?
উত্তর – ‘টেক’ হল ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’-এর ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশিত জার্নাল।
4. কে ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা করেন।
5. বর্তমানে কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ কলকাতার কোথায় অবস্থিত ?
উত্তর – বর্তমানে ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ কলকাতার যাদবপুরে অবস্থিত।
6. কে, কবে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর – স্যার উইলিয়াম জোনস ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
7. কারিগরি শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত দুটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।
উত্তর – কারিগরি শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত দুটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হল জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট।
8. কারা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন ?
উত্তর – গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
9. CET-এর পুরো নাম কী ?
উত্তর – CET-এর পুরো নাম হল ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’।
10. কারা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন?
উত্তর – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন তারকনাথ পালিত এবং রাসবিহারী ঘোষ।

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষ ………… লক্ষ টাকা ও জমি দান করেন।
উত্তর – ৪২
2. কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের রাজাবাজার ক্যাম্পাসটি ………… শিক্ষাপ্রাঙ্গণ নামে পরিচিত।
উত্তর – রাসবিহারী ঘোষ
3. কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসটি …………. শিক্ষাপ্রাঙ্গণ নামে পরিচিত।
উত্তর – তারকনাথ পালিত
4. রসায়নবিদ ………. ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজে রাসায়নশাস্ত্র শিক্ষাদান শুরু করেন।
উত্তর – জন ম্যাক
5. ………… আবিষ্কারে জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান আজ বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে।
উত্তর – বেতার

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স গড়ে ওঠে-
(a) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে
2. IACS বা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) ড. মহেন্দ্রলাল সরকার
(b) তারকনাথ পালিত
(c) রাসবিহারী ঘোষ
(d) জগদীশচন্দ্র বসু
উত্তর – (a) ড. মহেন্দ্রলাল সরকার
3. IACS-এর প্রথম অধিকর্তা হলেন-
(a) মহেন্দ্রলাল সরকার
(b) জগদীশচন্দ্র বসু
(c) মেঘনাদ সাহা
(d) প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়
উত্তর – (d) প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়
4. প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ী ভারতীয় বৈজ্ঞানিক ছিলেন—
(a) জগদীশচন্দ্র বসু
(b) প্রফুল্লচন্দ্র রায়
(c) চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন
(d) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (c) চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন
5. ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর যে বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন—
(a) জগদীশচন্দ্র বসু
(b) সি ভি রমন
(c) প্রফুল্লচন্দ্র রায়
(d) সত্যেন্দ্রনাথ বসু
উত্তর – (b) সি ভি রমন
6. বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন যে বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার তিনি হলেন—
(a) গোলক চন্দ্ৰ নন্দী
(b) পলাশ চন্দ্র নন্দী
(c) রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জি
(d) শিবচন্দ্র নন্দী
উত্তর – (a) গোলক চন্দ্ৰ নন্দী
7. কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ছিল—
(a) জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
(b) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
(c) অহিংস অসহযোগ আন্দোলন
(d) স্বদেশি আন্দোলন
উত্তর – (d) স্বদেশি আন্দোলন
৪. বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) জগদীশচন্দ্র বসু
(b) সত্যেন্দ্রনাথ বসু
(c) চন্দ্রমুখী বসু
(d) আনন্দমোহন বসু
উত্তর – (a) জগদীশচন্দ্র বসু
9. ‘টেগোর অ্যান্ড কোং’ প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) দ্বারকানাথ ঠাকুর
(b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
10. উদ্ভিদের প্রাণ আছে—তা কে প্রমাণ করেন?
(a) প্রফুল্লচন্দ্র রায়
(b) চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন
(c) জগদীশচন্দ্র বসু
(d) মেঘনাদ সাহা
উত্তর – (c) জগদীশচন্দ্র বসু
11. ‘জাতীয় প্রযুক্তিবিদ্যার পথিকৃৎ’ বলা হয় –
(a) রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে
(b) মেঘনাদ সাহাকে
(c) ড. মহেন্দ্রলাল সরকারকে
(d) প্রমথনাথ বসুকে
উত্তর – (a) রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে
12. কে প্রথম ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি ব্যবহার করেন?
(a) প্রসন্নকুমার ঠাকুর
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (a) প্রসন্নকুমার ঠাকুর
13. জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি ছিলেন-
(a) নবগোপাল মিত্র
(b) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
(c) হীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (d) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
14. জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়—
(a) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে
15. নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে কে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না?
(a) স্যার রাসবিহারী ঘোষ
(b) ইউজিন লাঁফো
(c) চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন
(d) আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
উত্তর – (a) স্যার রাসবিহারী ঘোষ
16. প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়—
(a) শিবচন্দ্রকে
(b) সুরেশচন্দ্রকে
(c) কেশব চন্দ্রকে
(d) গোলক চন্দ্ৰকে
উত্তর – (d) গোলক চন্দ্ৰকে
17. ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
(a) রাসবিহারী ঘোষ
(b) তারকনাথ পালিত
(c) মহেন্দ্রলাল সরকার
(d) নীলরতন সরকার
উত্তর – (b) তারকনাথ পালিত
18. ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’-এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন—
(a) জগদীশচন্দ্র বসু
(b) তারকনাথ পালিত
(c) মহেন্দ্রলাল সরকার
(d) অরবিন্দ ঘোষ
উত্তর – (d) অরবিন্দ ঘোষ
19. বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হলেন—
(a) রাজনারায়ণ বসু
(b) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
(c) তারকনাথ পালিত
(d) অরবিন্দ ঘোষ
উত্তর – (d) অরবিন্দ ঘোষ
20. ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে
21. “বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট” প্রতিষ্ঠিত হয়-
(a) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে
22. Bengal Technical Institute কত সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়?
(a) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে
23. ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কার করেন—
(a) সত্যেন্দ্রনাথ বসু
(b) জগদীশচন্দ্র বসু
(c) আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
(d) সি ভি রমন
উত্তর – (b) জগদীশচন্দ্র বসু
24. ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটি রচনা করেন—
(a) শিশিরকুমার ঘোষ
(b) সি ভি রমন
(c) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) জগদীশচন্দ্র বসু
উত্তর – (d) জগদীশচন্দ্র বসু
25. ‘রেজোন্যান্ট যন্ত্র’ কে আবিষ্কার করেন?
(a) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) মেঘনাদ সাহা
(c) জগদীশচন্দ্র বসু
(d) সি ভি রামন।
উত্তর – (c) জগদীশচন্দ্র বসু
26. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ‘বিজ্ঞান কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে
27. কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়—
(a) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে
28. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Radio Physics বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) শিশিরকুমার মিত্রের নেতৃত্বে
(b) আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে
(c) সতীশচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে
(d) শিশিরকুমার ঘোষের নেতৃত্বে
উত্তর – (a) শিশিরকুমার মিত্রের নেতৃত্বে

TOPIC – C ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা ও বিশ্বভারতী

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. * ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ
ভূমিকা: লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা দ্বিখণ্ডিত করার পর স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বাংলায় স্বদেশি আদলে একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর বাস্তব রূপায়ণ হল জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা।
  1. প্রতিষ্ঠা : সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গড়ে ওঠে। এর প্রথম সম্পাদক হন রাসবিহারী ঘোষ।
  2. আর্থিক সহায়তা : জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
  3. উদ্দেশ্য : জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল—জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে শিক্ষাদান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
  4. কার্যক্রম : পরিষদের কর্তৃপক্ষ নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান, কারিগরি প্রভৃতি শিক্ষার বিষয়ে নিজেরাই পাঠক্রম তৈরি করে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ হন অরবিন্দ ঘোষ। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
  5. বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা : বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে শিক্ষাদরদি তারকনাথ পালিত ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট একসঙ্গে মিশে গিয়ে হয় বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল।
  6. ব্যর্থতা : বিভিন্ন কারণে শেষপর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। এগুলি হল—[i] জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতি সরকারের স্বীকৃতি ছিল না। এজন্য বহু ছাত্র এই শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী ছিল না। [ii] এই শিক্ষা গ্রহণের পর যে ডিগ্রি পাওয়া যেত তা দিয়ে সরকারি চাকরি লাভের সুযোগ ছিল না। [iii] পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কিছুদিনের মধ্যেই প্রবল অর্থসংকটের শিকার হয়।

উপসংহার: শেষপর্যন্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নিলে স্বদেশি আন্দোলনও থেমে যায়। সেই সঙ্গে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্মও বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেলেও বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল যথারীতি চলতে থাকে। পরবর্তীকালে এটি যাদবপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সবশেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

2. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?
উত্তর – শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য
ভূমিকা: শান্তিনিকেতন ছিল বর্তমান বীরভূম জেলার বোলপুরের সন্নিকটে অবস্থিত একটি গ্রাম। আগে এই স্থানের নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। এই স্থান কলকাতার ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত মানুষের পদার্পণে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।
  1. আশ্রমের নামকরণ: রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ধর্মচর্চা করার উদ্দেশ্যে ভুবনডাঙ্গায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই স্থানের নতুন নামকরণ করেন ‘শান্তিনিকেতন’।
  2. ব্রক্ষ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে ব্ৰত্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি সুবিস্তৃত প্রাকৃতিক পরিবেশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের ও অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর ভবন নির্মাণ করেন।
  3. বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি আদর্শ শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন যার নাম হয় ‘বিশ্বভারতী’।
  4. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: অবশেষে তিনি বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের সন্নিকটে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিসংস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সুরুল গ্রামে একটি কুঠিবাড়ি কিনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে পল্লি সংগঠনের কাজ শুরু করেন। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল-
  1. পল্লি সংগঠন: গ্রামীণ মানুষকে পল্লিজীবনের নানাদিক সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই ছিল কবির উদ্দেশ্য। ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লেনার্ড এলমহার্স্ট। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যে ‘শিক্ষাসত্র’টি প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটিই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনিকেতনে স্থাপিত হয়। এখানে ‘শিক্ষাসত্র’ বিদ্যালয়টিকে শান্তিনিকেতনের ‘পাঠভবন’-এর আদলে স্থাপন করা হয়েছিল।
  2. কৃষির উন্নয়ন: গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল কৃষিকাজ। তাই রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনের বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে কৃষির উন্নতির উদ্যোগ নেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘পল্লিশিক্ষাসদন’ নামে এখানে একটি কৃষি মহাবিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। সঙ্গে গ্রামীণ শিল্পোৎপাদন ও গো-পালন চলতে থাকে।
  3. স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রসার: শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শ্রীনিকেতনকে মডেল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে এখানে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘শিশু ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  4. শিক্ষার প্রসার: শিক্ষার প্রসার ঘটানো ছিল শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগকে সকল স্তরের জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘লোক-শিক্ষা সংসদ’ স্থাপন করা হয়।

উপসংহার: শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন উভয়ই ছিল গ্রাম। রবীন্দ্রনাথের সাধের দুই গ্রামেই তাঁর স্বপ্ন ডানা মেলতে পেরেছিল। বর্তমানে এই দুটি স্থান রবীন্দ্র ঐতিহ্যের পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়।

3. প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 
অথবা, প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রচিন্তা ব্যাখ্যা করো। 
উত্তর –
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাকে মানুষ ও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় বলে মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের সমন্বয় গড়ে তোলা দরকার। তাঁর শিক্ষাভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাঁর প্রকৃতি ভাবনা।
  1. অরণ্য ধ্বংসের বিপদ: রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, সকল জীব বৃক্ষদের অবলম্বন করে বেঁচে থাকে। কিন্তু আজ মানুষ নির্মমভাবে বন ধ্বংস করে মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন অরণ্যের সংরক্ষণ। ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “অনেক মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরাই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছের ওপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিতে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ, বিস্তৃত হয়ে মানুষ তাকেই ধ্বংস করেছে।”
  2. প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা: রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, “এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে…।” তিনি শান্তিনিকেতনে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই তাঁর আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসবকে জোরদার করে তোলেন।
  3. গ্রামের উন্নয়নের ভাবনা: পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জমিদারির দেখাশোনার দায়িত্ব (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ) পেয়ে রবীন্দ্রনাথ গ্রামে এসে গ্রামবাংলার আসল রূপটি চিনতে পারেন। তাই তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের পথ ছেড়ে গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লিগ্রামের মঙ্গলের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই ভারতের প্রাণ। গ্রামের উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। শিলাইদহে ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’ এবং পতিসরে হাসপাতাল স্থাপন ছাড়াও তিনি গ্রামে তাঁতের কাজ, মৃৎশিল্প প্রভৃতি কুটিরশিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেন। জমিদারির প্রজাদের বিবাদের মীমাংসার জন্য সালিশি সভারও আয়োজন করেন তিনি।
  4. কৃষির উন্নয়ন: রবীন্দ্রনাথ পল্লিগ্রামের মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে কৃষিকাজের উন্নতির বিষয়ে বিভিন্ন রকম চিন্তাভাবনা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র স্থাপন করে সেখানে ট্র্যাক্টর, পাম্পসেট ও জৈব সার ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব আনেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ির ৮০ বিঘা জমিতে আধুনিক কৃষিখামার গড়ে তোলেন।
  5. কৃষিবিদ্যা শিক্ষা: সেযুগে ধনী বাঙালি পরিবারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাদের সন্তানদের আই সি এস বা ব্যারিস্টার বানানো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে কৃষিবিদ্যা শিখতে বিদেশে পাঠান। চাষের কাজে বৈজ্ঞানিক প্রথায় উন্নত বীজ, সার, সেচ প্রভৃতি ব্যবহার করে জনসাধারণের উন্নতিবিধানই ছিল তার এই উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য।
  6. হিতৈষী তহবিল: রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে প্রজাদের বকেয়া খাজনার ওপর সামান্য হিতৈষীশুল্ক ধার্য করে এবং জমিদারি থেকে তার সমপরিমাণ অর্থ ভরতুকি দিয়ে ‘হিতৈষী তহবিল’ গড়ে তোলা হয়। এই তহবিলের অর্থ গ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদের সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, চাষিদের বিপদকালে সাহায্যদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যয় করা হত।
  7. সম্প্রীতি: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর করা। তিনি জমিদারি দেখাশোনা করতে এসে তাঁর কর্মক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-চন্ডালের ভেদাভেদ দূর করে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন।
  8. অন্যান্য উদ্যোগ: রবীন্দ্রনাথ আধুনিক পঞ্চায়েতের ধাঁচে গ্রামের পরিচালন কাঠামো গড়েছিলেন। তিনি গ্রামে সমবায়সমিতি প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দেন এবং স্বল্প সুদে চাষিদের ঋণদানের জন্য পতিসর কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। চাষিরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় তার জন্য তিনি ‘টেগোর অ্যান্ড কোং’ (১৮৯৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে ন্যায্য মূল্যে তাদের দ্বারা উৎপাদিত ধান ও পাট কিনে বাজারে বিক্রির দায়িত্ব নেন।

উপসংহার: ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার শিশুকালেই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে আমার খুব একটি সহজ ও নিবিড় যোগ ছিল।” প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের এই সহাবস্থান তাঁর শিক্ষাচিন্তায় সর্বদা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।
উত্তর – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
ভূমিকা: ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education বা NCE) প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ:
  1. বয়কট আন্দোলন : লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ করলে এর বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করে ছাত্রদের এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কারণ, দীঘির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত ব্রিটিশদের অফিস-আদালতের কেরানিই তৈরি করত।
  2. শিক্ষাক্ষেত্রে বিকল্প উদ্যোগ : স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে বিদেশি সবকিছু বয়কট করে এর বিকল্প হিসেবে দেশীয় জিনিসপত্রের ব্যবহার শুরু হয়। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে স্বদেশি ধাঁচের একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সম্ভবত প্রসন্নকুমার ঠাকুরই সর্বপ্রথম ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি ব্যবহার করেন।
  3. জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ব্যাপ্তি: স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলায় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটে ১৫০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
  4. জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন: এইরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে স্বদেশি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার: বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় আদর্শ  অনুসারে শিক্ষাদানের কথা ভাবছিলেন। সেই সময় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ (১৯০৬) গঠিত হওয়ার সুযোগ আসে এবং এই পরিষদ জাতীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

2. *জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে জাতীয় নেতৃবৃন্দের উদ্যোগ কীরূপ ছিল?
উত্তর – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতি
ভূমিকা: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এদেশে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন।
  1. ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা: দেশীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতায় সরব হন ও বিকল্প স্বদেশি ধাঁচের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। সম্ভবত ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।
  2. বিকল্প সংস্থা গঠন: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে (১১ মার্চ) ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গড়ে ওঠে। এই পরিষদের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল—জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
  3. আর্থিক সহায়তা লাভ: জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করেন। এই ব্যাপারে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
  4. বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গঠন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকগণ এখানে শিক্ষাদান করতেন।
  5. বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: দেশীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়।

উপসংহার: বাংলার তৎকালীন জাতীয় নেতৃবৃন্দ একদিকে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতায় সরব ছিলেন, অন্যদিকে স্বদেশি শিক্ষার প্রচলনে ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

3. *জাতীয় শিক্ষার প্রসারে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা কেমন ছিল?
উত্তর – জাতীয় শিক্ষার প্রসারে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা
ভূমিকা: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বদেশি বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে-ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ জাতীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  1. উদ্দেশ্য: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল— জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
  2. বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা : স্বদেশি প্রথায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। সতীশচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকরা এখানে শিক্ষাদান করতেন।
  3. বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রেরণায় বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট। বিভিন্ন ধনবান ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি নিযুক্ত হন রাসবিহারী ঘোষ।
  4. সামাজিক অবদান: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে বহু শিক্ষার্থী স্নাতক হয়ে পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। এসব প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ছাত্রসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন হীরালাল রায় ও উপেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ।

উপসংহার: ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ শহর ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এই পরিষদ জাতীয় আদর্শ অনুসারে শিক্ষাদান, পাঠ্যসূচি নির্মাণ, আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করে।

4. *জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার কেন ব্যর্থ হয় ?
উত্তর – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার ব্যর্থ হওয়ার কারণ
ভূমিকা: লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত করলে এই সময় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে নেতৃবৃন্দ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই উদ্যোগ বিভিন্ন কারণে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। যেমন—
  1. সরকারের বিরূপতা : ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে- ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকার মোটেই সুনজরে দেখেনি। সরকারি প্রতিবন্ধকতার ফলে স্বদেশি ধাঁচে গড়ে ওঠা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি পদে পদে ব্যাহত হয়েছে।
  2. কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা: সরকার তার নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এজন্য জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সরকারি চাকরি লাভ করার সুযোগ একেবারেই ছিল না। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের শিক্ষার্থীরা জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে।
  3. আর্থিক সংকট: প্রথমদিকে অনেক উৎসাহ ও আশা নিয়ে জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ শুরু হলেও কিছুকাল পর থেকে আর্থিক সংকটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্ম ব্যাহত হতে থাকে। সূচনা লগ্নে বহু আর্থিক দান পাওয়ার আশা থাকলেও অনেকাংশেই তা পূরণ হয়নি।
  4. অভিভাবকদের অনীহা: বেশিরভাগ অভিভাবক ও শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষার চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা গ্রহণেই বেশি আগ্রহী ছিল। ফলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন দুর্বল হতে শুরু করলে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও ক্রমে ব্যর্থ হতে থাকে।

উপসংহার: প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলেও কিছুকালের মধ্যেই এই পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলি ছিল জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিমাতৃ সুলভ আচরণ, সরকারি কর্মক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষার্থীদের প্রতি বঞ্চনা, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতি।

5. *শিক্ষা সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক ধারণার বিরোধিতায় গৃহীত কয়েকটি উদ্যোগের উল্লেখ করো।
উত্তর – শিক্ষা সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক ধারণার বিরোধিতায় গৃহীত কয়েকটি উদ্যোগ
ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে এদেশে আধুনিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেনি। ব্রিটিশ সরকার এদেশে সুপরিকল্পিতভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটায়। তবে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে বহু ভারতীয় মনীষী এর বিকল্প হিসেবে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে উদ্যোগী হন।
  1. জাতীয় শিক্ষার উদ্যোগ: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শুরু হলে এদেশে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়। এর জন্য ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গড়ে তোলা হয়।
  2. ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ পরিত্যাগ: জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করে ছাত্রদের এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কারণ, গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়ারের কাছে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা না দিয়ে শুধু ব্রিটিশদের অফিস-আদালতে কাজের জন্য কেরানি তৈরি করত। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু ছাত্রছাত্রী সেই ‘গোলামখানা’ ছেড়ে জাতীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করে।
  3. রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগ: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিকল্প শিক্ষানীতি দেশবাসীকে এক নতুন দিশা দেখাতে সমর্থ হয়। নিজস্ব শিক্ষানীতি নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো এবং ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বীরভূমের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনার ফলে স্বদেশি যুগে ভারতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর ফলে ভারতীয় শিক্ষা কিছুকালের মধ্যে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করতে সক্ষম হয়।

6. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীর উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে টীকা লেখো।
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীর উদ্যোগ/ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.) নিভৃতে ধর্মচর্চা করার উদ্দেশ্যে বীরভূম জেলার বোলপুরের নিকটবর্তী ভুবনডাঙ্গায় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভুবনডাঙ্গার নতুন নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। দেবেন্দ্রনাথ ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে এখানে উপাসনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
  1. ব্ৰাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে একটি ব্রত্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। এখানে প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
  2. শিক্ষাপদ্ধতি: ব্রহ্মবিদ্যালয়ে আশ্রমিক গুরুকুল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে এবং ছাত্র-শিক্ষকের ব্যবধান দূর করে শিক্ষাদান করাই ছিল ব্রহ্মবিদ্যালয়ের শিক্ষানীতির মূলকথা। এখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকত না।
  3. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভাবনা: পাঠভবনের প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন, যার নাম হয় ‘বিশ্বভারতী’।
  4. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: অবশেষে রবীন্দ্রনাথ বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের সন্নিকটে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে কলাবিদ্যার পাশাপাশি অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ বিভিন্ন ব্যাবহারিক শিক্ষার পাঠদান শুরু হয়।
  5. পর্যটন শিল্পকেন্দ্র: রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নিজের এবং অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি করান। পরবর্তীকালে আশ্রমবাসী শিল্পী ও ভাস্করদের বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মের দ্বারা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সুসজ্জিত হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
  6. কেন্দ্রীয় মর্যাদা: ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বধর্ম ও বিশ্বসংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

7. * রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনায় মানুষ সম্পর্কে কী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনার মানুষ
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তাঁর শিক্ষাচিন্তার বিষয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। তাঁর শিক্ষাভাবনায় মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তিনি শিক্ষাভাবনার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
  1. মানুষের দুর্দশা দূর করা : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম গ্রামের সাধারণ মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পান। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই হল ভারতের প্রাণ, গ্রামের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না। এজন্য তিনি গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লিমঙ্গল সাধনের উদ্যোগ নেন।
  2. কৃষির উন্নতি : রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন,গ্রামের মানুষের কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকার উন্নতি না হলে তাদের প্রকৃত উন্নতি হবে না। এজন্য গ্রামের কৃষিবিদ্যার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় পাঠান। পরে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকেও তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদেশে কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য পাঠান। রথীন্দ্রনাথ, তাঁর বন্ধু ও নগেন্দ্রনাথ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষবাস এবং বীজ, সার, সেচ প্রভৃতির ব্যবহার শুরু করেন।
  3. কুটিরশিল্পের বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের মধ্যে কুটিরশিল্পের প্রসারের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করেন। তিনি একজন তাঁতিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে সেখানকার দরিদ্র মানুষকে তাঁতের কাজ শিখতে উৎসাহিত করেন। এ ছাড়া মৃৎশিল্প-সহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানোর বিষয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করেন।
  4. শিক্ষার প্রসার : গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা দূর করার উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাঁর মতে, গ্রামের মানুষের সেবা করতে হলে তাদের সম্পর্কে আগে শিক্ষালাভ করতে হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
  5. সম্প্রীতির প্রসার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন। সম্ভাব্য সংঘাতের অনুমান করেও তিনি হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-চণ্ডালের বিভেদ দূর করে কর্মক্ষেত্রে প্রাণচঞ্চলতা নিয়ে আসার কথা বলেন। তিনি বলেন, “সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে।” এই সাহা ও শেখ কোনো বিশেষ সম্প্রদায় ছিল না। তারা হল আসলে ‘আমলা’ ও ‘চাষা’।

উপসংহার: কোনো শিক্ষাই মানুষকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তাই রবীন্দ্রনাথ সকল মানুষকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে এসে বিভিন্ন মানুষের মধ্যেকার বিরাট ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিলেন।

৪. রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কী ছিল? 
উত্তর – রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে “শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।” কিন্তু তাঁর আমলে ভারতে যে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা রবীন্দ্রনাথের মনঃপুত হয়নি। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপকে তিনি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে যেমন দেখেছিলেন, তার কয়েকটি দিক—
  1. যান্ত্রিক ব্যবস্থা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রদানের ঔপনিবেশিক স্কুল-ব্যবস্থা একটি কারখানার মতো। তিনি বলেছেন, “ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল, মাস্টার এই কারখানার অংশ—চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়।”
  2. নীরস বিষয় : ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় চার দেয়ালের ভেতর শিক্ষাগ্রহণ রবীন্দ্রনাথের কাছে নীরস ঠেকেছে। তাঁর মতে, এই ব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ আসলে নীরস পাঠ্যবস্তু গ্রহণ করে শুধুমাত্র ডিগ্রি অর্জন ছাড়া আর কিছু নয়।
  3. সীমিত সুযোগ : রবীন্দ্রনাথের মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ কম। কারণ, এই ব্যবস্থায় কেবল শহরের একটা শ্রেণির মানুষ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর ভারতের অবশিষ্ট জনমানব অশিক্ষার অন্ধকারেই থেকে যায়।
  4. প্রগতি বিরোধী পদ্ধতি: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক ছিল বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ। তাই এই ব্যবস্থা প্রগতিশীলতার বিরোধী। কেন না, রবীন্দ্রনাথের মতে, বিদেশি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারা আত্মস্থ করার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
  5. জ্ঞানার্জনের প্রতিবন্ধক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই শিক্ষার্থীর সহজাত জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে। তাই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান শিক্ষার্থীর স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বলে তিনি মনে করতেন।
  6. জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় মর্যাদাকে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যর ধার করা বিদ্যাকে অনুকরণ করাই যেন প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষা সমস্যা’, ‘শিক্ষার হেরফের’, ‘স্বদেশি সমাজ’, ‘তোতাকাহিনী’ প্রভৃতি রচনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার নানান ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে তার সমালোচনা করেছেন। তিনি ভারতের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি থেকে পৃথক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন। পরবর্তীকালে নিজ উদ্যোগে তিনি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

9. বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তার পরিচয় দাও।
উত্তর – বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা
ভূমিকা: প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত—এ কথা রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষাভাবনায় প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর শিক্ষা ভাবনার এই বৈশিষ্ট্যটি বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
  1. বিশ্ববিদ্যার সাধনা: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যা সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, “বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। সাধারণভাবে বলা চলে সে সাধনা বিদ্যার সাধনা।” তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিদ্যা উদ্ভাবন, গৌণ উদ্দেশ্য হল বিদ্যা দান।
  2. শিক্ষার অবারিত দ্বার : রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। দেশবিদেশের সকল পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যা সাধনার সুযোগ পায়, রবীন্দ্রনাথ তা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন।
  3. পাঠক্রমের বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বৈচিত্র্য আনার পক্ষপাতী ছিলেন। এজন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভবন, চিনা ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণাকেন্দ্র, পল্লি শিক্ষাভবন প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন।
  4. মানবসত্তার বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা”

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ নিজে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা পোষণ করতেন যেখানে মুক্তচিন্তা, সত্যানুসন্ধান, স্বাধীনতা প্রভৃতির দ্বারা মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে। তাঁর এই ভাবনা বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছিল তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে।

10. ঔপনিবেশিক শিক্ষার ধারাটিকে কীভাবে সমালোচনা করা যেতে পারে?
অথবা, ভারতের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে তুমি কীভাবে সমালোচনা করবে? 
উত্তর – ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার সমালোচনা
ভূমিকা: প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা ভারতবাসীর ওপর নিজেদের পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। তবে বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা শুরু হয়। এর পরিণতিতে জাতীয় নেতৃত্ব ও ভারতীয় শিক্ষাবিদরা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
  1. অনুগত প্রজা তৈরি: মেকলের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের অনুগত এক ভারতীয় প্রজাসম্প্রদায় তৈরি করা। উড-এর ডেসপ্যাচের মূল লক্ষ্য ছিল—পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষেরা আদতে ভারতীয় হলেও চিন্তাভাবনায় হবে পুরোদস্তুর ইংরেজ, যাদের ওপরে ভর করে এদের ঔপনিবেশিক শাসন স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারবে।
  2. প্রাণের ছোঁয়ার অভাব: ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এদেশের ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় ঘটলেও, সেই যোগাযোগে প্রাণের ছোঁয়া ছিল না। তা ছাড়া, ওই বিজ্ঞানশিক্ষার সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার এবং দর্শনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, প্রকৃত পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে।
  3. নান্দনিকতার অভাব: প্রশাসনিক কাজের উপযুক্ত কর্মচারী তৈরি করাই ছিল ইংরেজদের ভাষা শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। সাহিত্য বা ভাষাশিক্ষার সাহায্যে একটা নান্দনিক মন গড়ে তোলার কোনো আগ্রহই তাদের ছিল না। ‘বিদেশি ভাষায় ব্যাকরণ’ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলা ‘বর্ষণ’ ঔপনিবেশিক ভাষাশিক্ষাকে ব্যর্থ করে দেয়।
  4. দেশীয় ভাষার প্রতি বঞ্চনা: শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে ইংরেজিকেই বেছেছিলেন। শাসকের ভাষায়, শাসকের দৃষ্টিতে ভারতে ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান সবকিছু শেখানো হত বলে দেশীয় ভাষা সংস্কৃতির চর্চা কমে যাচ্ছিল। ফলে, শিক্ষা সর্বজনীন না হয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের জীবন-জীবিকার উপকরণ হয়ে উঠেছিল।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এক যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই শিক্ষাধারায় শিক্ষার্থীদের স্বাধীন কোনো চিন্তাভাবনার সুযোগ ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘কেরানিগিরির কল’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. *জাতীয় শিক্ষা বলতে কী বোঝ ?
উত্তর – লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা দ্বিখণ্ডিত করলে এর বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় ভারতে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করে এর বিকল্প হিসেবে স্বদেশি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয় তা জাতীয় শিক্ষা নামে পরিচিত।
2. *জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে আর্থিক সহায়তা করেন এমন কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করো।
উত্তর – জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
3. জাতীয় শিক্ষায় ডন সোসাইটির কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর – সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ডন সোসাইটি (১৯০২ খ্রিস্টাব্দ)- র কার্যাবলি ও এখান থেকে প্রকাশিত ‘ডন’ পত্রিকা জাতীয় শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আদর্শবোধ, ধর্মবোধ, নীতিবোধ, জাতীয়তাবোধ, চরিত্রগঠন প্রভৃতির বিকাশে ডন সোসাইটি চেষ্টা চালায়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে (৫ নভেম্বর) সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভায় জাতীয় শিক্ষার পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনের সঙ্গে মিশে গিয়ে জাতীয় শিক্ষাকে আরও সমৃদ্ধ করে।
4. *বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষকের নাম লেখো।
উত্তর – বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষক ছিলেন রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ।
5. *জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করো। অথবা, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হওয়ার দুটি কারণ লেখো।
উত্তর – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণগুলি ছিল—[1] সরকারি বাধার ফলে জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হয়। [2] জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি লাভের সুযোগ ছিল না। [3] এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট আর্থিক সংকটের শিকার হয়। [4] শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জাতীয় শিক্ষার চেয়ে বরং ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিলেন।
6. জাতীয় শিক্ষার গুরুত্ব কী ছিল?
উত্তর – জাতীয় শিক্ষার প্রধান গুরুত্বগুলি ছিল – [1] এই শিক্ষা ব্রিটিশ সরকারের বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। [2] এই শিক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তীকালে একদল দেশপ্রেমিক তরুণের আত্মপ্রকাশ ঘটে। [3] জাতীয় শিক্ষার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ভারতে শিক্ষাদান ও গবেষণার কাজে যথেষ্ট সাফল্য দেখায়।
7. *কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কী?
উত্তর – কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি হল বাংলার একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট একসঙ্গে মিলে যায় এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।
৪. শিশুশিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা কী ছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুমনকে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি চাইতেন বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন শিশুমনকে ছুঁয়ে যাক। নৈসর্গিক পরিবেশের মধ্যে শিশুদের বড়ো করে তোলাই তাঁর শিক্ষার লক্ষ্য ছিল।
9. *ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোর বিরুদ্ধে বাংলায় গড়ে ওঠা দুটি উদ্যোগ উল্লেখ করো।
উত্তর – ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোর বিরুদ্ধে বাংলায় গড়ে ওঠা দুটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হল – [1] ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের ব্যবস্থা করা এবং [2] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা।
10. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষা কী?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন’। এক কথায়, পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেকে জাতির উপযোগী, দক্ষ ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা।
11. *রবীন্দ্রনাথের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বা কাজ কী?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য বা কাজগুলি হল— [1] বিদ্যার উৎপাদন, [2] বিদ্যা দান, [3] মুক্ত-চিন্তার চর্চা এবং [4] সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রভৃতি।
12. শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল—
[1] প্রাচীন ভারতের ‘তপোবন’ কেন্দ্রিক আশ্রমিক শিক্ষাধারা চালু করে নিভৃতে আধ্যাত্মিক সাধনা ও বিদ্যাচর্চা করা।
[2] প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীর নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলা।
13. *কে, কবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন্ কোন্ বিষয় পড়ানো হত?
উত্তর – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলার বোলপুরের নিকটবর্তী শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়, অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ সমস্ত ব্যাবহারিক বিজ্ঞান পড়ানো হত।
14. *বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষকের নাম লেখো।
উত্তর – বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষক ছিলেন ইংরেজ যুবক কৃষিবিশেষজ্ঞ লেনার্ড এলমহার্স্ট, এনড্রুজ, পিয়ারসন, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক সিলভাঁ লেভি ও তাঁর স্ত্রী মাদাম লেভি। এ ছাড়া জার্মান ঐতিহাসিক উইন্টারনিৎস, তাঁর ছাত্র লেসনি, ব্রিটিশ শিল্পবিশারদ স্টেলা ক্রামরিশ, ইহুদি বহুভাষাবিদ স্লোমিথ ফ্লাউম প্রমুখ।
15. *বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের উন্নতির উদ্দেশ্যে গৃহীত কয়েকটি পদক্ষেপ উল্লেখ করো।
উত্তর – বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের উন্নতির উদ্দেশ্যে যেসব যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা হল – [1] বিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা শিক্ষকদের বিশ্বভারতীতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, [2] দেশবিদেশের বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা গ্রন্থাগারে সংগ্রহ করা এবং [3] বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান।
16. *বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষার্থীর নাম লেখো।
উত্তর – বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষার্থী ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি প্রমুখ।
17. *রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর শিক্ষানীতির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর – রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর শিক্ষানীতির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল— [1] প্রকৃতি ও মানুষের সান্নিধ্যে শিক্ষাদান এবং [2] শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন।
18. *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাবনা সম্পর্কে কী জান?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
19. *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রজাকল্যাণের ক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নেন ?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রজাকল্যাণে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেন। যেমন- [1] তিনি হিতৈষী তহবিল প্রতিষ্ঠা করে  তহবিলের অর্থ গ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদের সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, চাষিদের সহায়তা প্রভৃতি কাজে ব্যয় করেন, [2] তাঁর উদ্যোগে শিলাইদহে মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয় ও পতিসরে হাসপাতাল স্থাপিত হয়, [3] তিনি কৃষকদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি প্রভৃতি উদ্দেশ্যে নানা উদ্যোগ নেন, [4] সালিশি সভা গঠন করে গ্রামীণ বিরোধের মীমাংসার ব্যবস্থা করেন।
20. *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক গঠিত ‘হিতৈষী তহবিল’ কী?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়ে প্রজাকল্যাণের উদ্দেশ্যে ‘হিতৈষী তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন করেন। প্রজাদের সদ্য বকেয়া খাজনার ওপর সামান্য হিতৈষীবৃত্তি ধার্য করে এবং জমিদারি থেকে তার সমপরিমাণ অর্থ ভরতুকি দিয়ে এই তহবিল গঠন করা হয়। গ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদের সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, চাষিদের বিপদকালে সাহায্যদান প্রভৃতি উদ্দেশ্যে এই তহবিলের অর্থ ব্যয় করা হত।
21. *কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করা হত?
উত্তর – কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গোলদীঘির নিকটে অবস্থিত ছিল। এখানে পড়াশোনা করে প্রধানত ব্রিটিশদের অফিস-আদালতে কেরানি তৈরি হত। এজন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করতেন।
22. জাতীয় শিক্ষা পরিষদ স্থাপনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল – [1] জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরিশিক্ষা দান করা, [2] শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, [3] নৈতিক শিক্ষা দান করা, [4] মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
23. * কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী ধরনের উদ্যোগ নেন?
উত্তর – কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—[1] শিলাইদহে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র স্থাপন করে সেখানে ট্র্যাক্টর, পাম্পসেট ও জৈব সার ব্যবহার চালু করেন। [2] শিলাইদহে কৃষি খামার গড়ে তোলেন। [3] পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। [4] উন্নত কৃষিবিদ্যা শেখার উদ্দেশ্যে নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে বিদেশে পাঠান।
24. * কে, কবে টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেন? এর উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেন।
টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে কৃষিজ পণ্য কিনে তা বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা।
25. বিশ্বভারতী কীভাবে গড়ে উঠেছিল ? 
অথবা, কত খ্রিস্টাব্দে কে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
উত্তর – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ধর্মচর্চা করার উদ্দেশ্যে ভুবনডাঙ্গায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ভুবনডাঙ্গার স্নিগ্ধতা, নিবিড়তা ও বিরাজমান শান্তি লক্ষ করে দেবেন্দ্রনাথ এর নামকরণ করেন ‘শান্তিনিকেতন’। তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দেশান্তিনিকেতনে ব্রক্ষ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি আদর্শ শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। সেই মতো তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
26. ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কী ছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেননি, আবার বর্জনও করেননি। তিনি দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন।
27. রবীন্দ্রনাথ কী উদ্দেশ্যে ‘শ্রীনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
অথবা, শ্রীনিকেতন কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর – রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো। এর মধ্যে ছিল গ্রামে কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। এই উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ‘পল্লিসংগঠন কেন্দ্র’ স্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন শ্রীনিকেতন।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ শক্তিশালী হয় ……… আন্দোলনের সময়।
উত্তর – স্বদেশি
2. ……… সভাপতিত্বে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।
উত্তর – সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
3. বোলপুরের নিকটবর্তী শান্তিনিকেতনের আগের নাম ছিল ………।
উত্তর – ভুবনডাঙ্গা
4. রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে ………. প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর – ব্রহ্মবিদ্যালয়
5. বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ………।
উত্তর – শান্তিনিকেতনে
6. ……… বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
উত্তর – বিশ্বভারতী
7. কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠার (১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে) মধ্য দিয়ে ……….উৎসব শুরু করেন।
উত্তর – বৃক্ষরোপণ
৪. রবীন্দ্রনাথ ……….. কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর – পতিসরে
9. রবীন্দ্রনাথ ………. কৃষিখামার প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর – শিলাইদহে

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তর নির্বাচন করো

1. বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন—
(a) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (b) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
2. জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের—
(a) ২ জুন
(b) ১১ মার্চ
(c) ১ জুলাই
(d) ২ জুলাই
উত্তর – (d) ২ জুলাই
3. ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে কবিগুরু নিজস্ব শিক্ষানীতির পরীক্ষানিরীক্ষার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন—
(a) যাদবপুর
(b) শিলাইদহ
(c) কলকাতা
(d) শান্তিনিকেতন
উত্তর – (b) শিলাইদহ
4. বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়—
(a) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (b) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে
5. শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—
(a) ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে
উত্তর – (c) ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে
6. শান্তিনিকেতনে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন—
(a) প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর
(b) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (b) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
7. রবীন্দ্রনাথ আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপন করেন—
(a) বীরভূমে
(b) শান্তিনিকেতনে
(c) কলকাতায়
(d) শিলাইদহে
উত্তর – (b) শান্তিনিকেতনে
৪. বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন—
(a) ব্রজেন্দ্রনাথ শীল
(b) বিধুশেখর ভট্টাচার্য
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (d) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
9. বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) স্বামী বিবেকানন্দ
(d) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
10. শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব হিসেবে পালন করা হয়—
(a) ২৫ বৈশাখ।
(b) ২৫ আষাঢ়
(c) ২২ শ্রাবণ
(d) ২২ অগ্রহায়ণ দিনটি
উত্তর – (c) ২২ শ্রাবণ
11. নীচের কোন্ ব্যক্তি ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন?
(a) মহেন্দ্রলাল সরকার
(b) তারকনাথ পালিত
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর – (d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

TOPIC – D বিবিধ

অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর

1. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে একটি উৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়?
অথবা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের বিষয়টি উল্লেখ করো।
উত্তর – বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ
ভূমিকা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চিন্তাভাবনা করেন। এই লক্ষ্যে তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্যোগে বিশ্বভারতী শীঘ্রই একটি উৎকৃষ্ট উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
  1. বিদ্যার সাধনা : রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিদ্যা উদ্ভাবন, গৌণ উদ্দেশ্য হল বিদ্যাদান। বিশিষ্ট শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার সাধনা ও বিদ্যার বিকাশ ঘটান। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্যার সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
  2. বিষয়ের বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে কলাবিদ্যার পাশাপাশি অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন এবং সমস্ত ব্যাবহারিক বিজ্ঞানের পাঠদান শুরু হয়। মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে এখানে হিন্দি ভবন, চিনা ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র, পল্লিশিক্ষা ভবন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  3. শিল্পকলার উন্নতি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলার উন্নতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলা শিক্ষা তার প্রধান অঙ্গ হবে এই আমাদের সংকল্প হোক।”
  4. খ্যাতনামা শিক্ষকগোষ্ঠী : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় চরম উৎকর্ষ আনার উদ্দেশ্যে দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পণ্ডিতকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে ইংরেজ যুবক কৃষিবিশেষজ্ঞ লেনার্ড এলমহার্স্ট, অ্যান্ড্রুজ, পিয়ারসন, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক সিলভা লেভি ও তাঁর স্ত্রী মাদাম লেভি এখানে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া জার্মান ঐতিহাসিক উইন্টারনিস, তাঁর ছাত্র লেসনি, ব্রিটিশ শিল্পবিশারদ স্টেলা ক্রামরিশ, ইহুদি বহুভাষাবিদ স্লোমিও ফ্লাউম প্রমুখ বিদেশি শিক্ষাবিদ এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন।
  5. আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন : বিভিন্ন কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দেশবিদেশের বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার সমন্বয়ে বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, কলাশাস্ত্র, পল্লিশিক্ষা, কৃষি-অর্থনৈতিক গবেষণা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে এখানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।

উপসংহার: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা বাস্তবায়িত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরবর্তীকালে খ্যাতির শিখরে পৌঁছোন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অস্কারবিজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি প্রমুখ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

The Complete Educational Website

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *