WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 5 বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ-বিশ শতকের প্রথমভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 5 বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ-বিশ শতকের প্রথমভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 5 বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ-বিশ শতকের প্রথমভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
West Bengal Board 10th History Solutions
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি
- ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। এই সময় এদেশে আধুনিক ছাপাখানা, পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতির প্রসার ঘটে।
- অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ভারতের অন্যান্য স্থানে ছাপাখানা স্থাপিত হয়। জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এবং চার্লস উইলকিনস ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চানন কর্মকার, সুরেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ উন্নত বাংলা অক্ষরের টাইপ তৈরি করেন।
- বাংলায় আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সুলভে প্রচুর মুদ্রিত বইপত্র সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার শুরু হয়। শ্রীরামপুরের ছাপাখানা-সহ হিন্দুস্তানি প্রেস, পারসিয়ান প্রেস ও সংস্কৃত প্রেস থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বইপত্র ছাপা হত। এসব বইপত্র সস্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেলে শিক্ষার প্রসারের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
- উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে ছাপাখানা (১৮০০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এখান থেকে বাংলা, হিন্দি-সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেল এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ, বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রভৃতি মুদ্রিত দেশবাসীর হাতে পৌঁছে যেতে থাকে।
- শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে গ্রামবাংলার সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড বাংলায় গণশিক্ষা প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে ‘শিশুশিক্ষা’, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বাল্যশিক্ষা প্রভৃতি প্রাথমিক শিক্ষা-বিষয়ক বইপত্রের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
- ছাপাখানার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণশিল্পের ব্যাবসায়িক বাজার গড়ে ওঠে। ছাপাখানাগুলিতে বিভিন্ন বইপত্র, সংবাদপত্র, মিলিটারি বিল, ভাতার ফর্ম, সামরিক বাহিনীর বিধিবিধান প্রভৃতি ছাপার কাজ চলতে থাকে। বইপত্র ছাপা, বাঁধাই প্রভৃতি কাজের সঙ্গে প্রচুর লোক যুক্ত হয়ে পড়েন। বইপত্র ও সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা গড়ে ওঠে। ক্রমে বই, সংবাদপত্র প্রভৃতি বিক্রির এক সুগঠিত বাজার গড়ে ওঠে।
- মুদ্রণশিল্পের উন্নতিতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি ছাপাখানা এবং ছাপাখানার সঙ্গে একটি স্টুডিয়ো প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এখান থেকেই ভারতে প্রসেস প্রিন্টিং শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। তিনি উন্নতমানের ছবি ছাপার কৌশল উদ্ভাবন করেন এবং হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। সাদাকালোর যুগে তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় রঙিন ছবি ছাপতে শুরু করেন।
- মুদ্রণশিল্পের বিকাশের পরবর্তীকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট, কলকাতার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন, যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদি।
- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটে। এই শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভারতীয় চিন্তাবিদ সরব হয়ে দেশীয় ধাঁচে শিক্ষার উন্নতির চেষ্টা করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির থেকে পৃথক, পরিকাঠামোগতভাবে অভিনব এক শিক্ষানীতির বিষয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নিজস্ব শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দ্বারা দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন পথ দেখান। তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে ব্রত্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কলাবিদ্যার পাশাপাশি এখানে অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ সমস্ত ব্যাবহারিক বিজ্ঞানের পাঠদান শুরু হয়।
- রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষানীতিতে প্রকৃতি ও মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। তিনি প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য প্রকৃতির সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি। পল্লিগ্রামের মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি কৃষিকাজের উন্নতির বিষয়ে নানা ভাবনাচিন্তা করেন।
TOPIC – A বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- প্রেক্ষাপট : বঙ্গদেশে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগে হাতে লেখা পুথিপত্রের সাহায্যে শিক্ষাগ্রহণের কাজ চলত। এই বইয়ের মূল্য খুব বেশি হত বলে এই সময় নিম্নবিত্ত দরিদ্র সমাজে শিক্ষার প্রসারের বিশেষ সুযোগ ছিল না। তাই এই সময় বাংলার শিক্ষাদান মূলত সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তা ছাড়া এই সময় শিক্ষা বলতে মূলত ছিল দীর্ঘ আরবি বা সংস্কৃত কবিতা বা শাস্ত্রের বক্তব্য মুখস্থ করা। এককথায়, ছাপা বইপত্র বাজারে আসার আগে বাংলায় শিক্ষার প্রসার ছিল খুবই সীমাবদ্ধ।
- ছাপা বইয়ের সহজলভ্যতা : ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে ছাপাখানায় ছাপা প্রচুর সংখ্যক সুদৃশ্য বইপত্র বাজারে আসতে শুরু করে। একদিকে এসব মুদ্রিত বইয়ের জোগান ছিল বিপুল, অন্যদিকে এগুলি দামেও ছিল সস্তা। ফলে দরিদ্র, সাধারণ শিক্ষার্থী ও পাঠকদের হাতে সহজেই ছাপা বইপত্র পৌঁছে যায়। বাংলার ছাপাখানাগুলি থেকে মাতৃভাষা বাংলায় ছাপা প্রচুর বইপত্র বাজারে আসতে শুরু করলে শিক্ষার্থীরা নিজের মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে বাংলায় ব্যাপক শিক্ষাবিস্তার শুরু হয়।
- শ্রীরামপুর ছাপাখানার অবদান : খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে শিক্ষার প্রসারে ভীষণ সুবিধা হয়। এশিয়ার তৎকালীন সর্ববৃহৎ এই ছাপাখানা থেকে বাংলাসহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য প্রভৃতির অনুবাদ, হিতোপদেশ, বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য বিপুল সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক এই ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়।
- পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ : ছাপাখানাগুলির মুদ্রিত বইপত্র বিনামূল্যে বা সস্তায় ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হলে তার অধীনে বেশ কয়েকটি স্কুল গড়ে ওঠে। এইসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে পাঠ্যপুস্তকের হাজার হাজার কপি শ্রীরামপুরের ছাপাখানায় ছাপায়। ফলে শহর ও গ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যেসব সাধারণ মানুষ বিদ্যাশিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের হাতে ছাপাখানায় মুদ্রিত সুন্দর ঝকঝকে পাঠ্যবই পৌঁছে যায়।
- শিশুশিক্ষার জন্য বই প্রকাশ : বাংলার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ছাপাখানাগুলিতে প্রচুর সংখ্যক শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র ছাপা হতে থাকে। এসব মুদ্রিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মদনমোহন তর্কালংকারের ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ প্রভৃতি। বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’-এর তাঁর জীবদ্দশাতেই মোট ১৫২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং বইটির ৩৫ লক্ষেরও বেশি কপি পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায়। ১৮৬৯-১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ১২ বছরের মধ্যে ৪১ লক্ষেরও বেশি শিশুশিক্ষার বই ছাপা হয়।
- অন্যান্য পাঠ্যবই প্রকাশ : বিদ্যালয় স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের প্রচুর পাঠ্যবই ছাপাখানাগুলিতে মুদ্রিত হয়ে সস্তায় বাংলার সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে যায়। এরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য পাঠ্যবই ছিল গোবিন্দপ্রসাদ দাস রচিত ‘ব্যাকরণ সার’, প্রাণলাল চক্রবর্তী রচিত ‘অঙ্কবোধ’, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, আনন্দকিশোর সেন রচিত ‘অর্থের সার্থকতা’, দীননাথ সেন রচিত ‘বাংলাদেশ ও আসামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ এবং ‘ঢাকা জেলার ভূগোল এবং সংক্ষেপে ঐতিহাসিক বিবরণ’ প্রভৃতি। এইসব বইপত্র বাংলার গ্রামগঞ্জে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সংবাদপত্রের ভূমিকা : ঊনবিংশ শতকে বাংলার ছাপাখানাগুলি থেকে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে বাংলায় গণশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মার্শম্যান সম্পাদিত মাসিক ‘দিগদর্শন’ ও সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেট’, রামমোহন রায় সম্পাদিত ‘সম্বাদ কৌমুদী, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সম্বাদ প্রভাকর’, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ প্রভৃতি।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- ভারতে মুদ্রণযন্ত্র : অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে মুদ্রণশিল্পের পথ চলা শুরু হয়।
- বাংলায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: পোর্তুগিজ মিশনারিরা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বাংলায় আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে আসে। পরে ১৭৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস অগাস্টাস হিকি কলকাতায় এবং ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিনস চুঁচুড়ায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
- বাংলা অক্ষরের সূচনা: পোর্তুগিজ মিশনারিরা প্রথমে নিজেদের দেশে রোমান হরফে বাংলা বই ছাপিয়ে এদেশে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে চার্লস উইলকিনস প্রথম বাংলা অক্ষর তৈরি করেন। কিছুকাল পর হুগলি জেলার সুদক্ষ স্বর্ণশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার বাংলা অক্ষরের উন্নত টাইপ তৈরি করেন।
- সুরেশচন্দ্র মজুমদারের অক্ষর: পঞ্চানন কর্মকারের পরবর্তীকালে সুরেশচন্দ্র মজুমদার ‘লাইনো টাইপ’ নামক আরও উন্নত বাংলা অক্ষরের টাইপ তৈরি করেন। এই অক্ষরে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালেদ রচিত ‘এ ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামক পূর্ণাঙ্গ বইটি প্রকাশের (১৭৭৮-৭৯ খ্রি.) মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় বই ছাপা শুরু হয়।
- পূর্ববঙ্গে ছাপাখানা: ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গে প্রথম রংপুরে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকায় ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। এভাবে উনিশ শতকের শেষভাগে বাংলার নানা প্রান্তে ছাপাখানার প্রসার ঘটে।
উপসংহার: উনিশ শতকে বাংলায় গড়ে ওঠা ছাপাখানাগুলিকে কেন্দ্র করে বই ছাপা, কাগজ শিল্প, বই বাঁধাইয়ের কাজ প্রভৃতিতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়। পাঠ্যপুস্তকের জন্য প্রয়োজনীয় চিত্র, ম্যাপ এবং হরফ নির্মাণকারী শিল্পীদের গুরুত্ব বাড়ে।
- বাংলা অনুবাদ : শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কেরির নির্দেশনায় বাইবেল, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের উদ্যোগে রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য প্রভৃতির বাংলা অনুবাদ।
- বাংলা গদ্য সাহিত্য বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রসারে শ্রীরামপুর ছাপাখানা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড। ফলে সাধারণ পাঠকদের হাতে বাংলা সাহিত্য পৌঁছোনোর সুযোগ আসে।
- পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ: শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে ছাত্রদের উপযোগী অসংখ্য পাঠ্যপুস্তক ছাপা হতে থাকে। এইসব পাঠ্যপুস্তক সাধারণ ছাত্রদের হাতে কম দামে বা বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি সুন্দর ঝকঝকে পাঠ্যপুস্তকের হাজার হাজার কপি শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়।
- গণশিক্ষার প্রসার : শ্রীরামপুর ছাপাখানায় মুদ্রিত বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুদিত গ্রন্থ, বিভিন্ন বাংলা সাহিত্য এবং পাঠ্যপুস্তক সুলভে বাংলার সাধারণ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। ফলে বাংলায় গণশিক্ষার ব্যাপক প্রসার শুরু হয়।
উপসংহার: শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা থেকে প্রথম দিকে ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে’র পাঠ্যবইগুলি ছাপানো হলেও পরবর্তীকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে এখান থেকে প্রচুর পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে বাংলায় গণশিক্ষার প্রসার আরও দ্রুততর হয়।
- ছাপাখানা স্থাপন : শ্রীরামপুর মিশনের খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়ম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন যা এশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাপাখানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
- শ্রীরামপুর ত্রয়ীর উদ্যোগ : শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড (শ্রীরামপুর ত্রয়ী) এর উদ্যোগে বাংলায় গণশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৮০১-১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে ৪০টি ভাষায় ২ লক্ষেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
- অনুবাদ প্রকাশ : শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া, উড়িয়া, মারাঠি, সংস্কৃত প্রভৃতি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির অনুবাদ ছাপা হয়।
- অন্যান্য ছাপার কাজ : ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য পাঠ্যপুস্তক, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র, বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রভৃতিও শ্রীরামপুরের ছাপাখানা থেকে ছাপা হয়।
- দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুবিধা : শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা থেকে প্রচুর বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের ফলে সাধারণ মানুষের হাতে খুব কম দামে বা বিনামূল্যে বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। ফলে গ্রাম-বাংলার দরিদ্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।
উপসংহারঃ শ্রীরামপুরের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ফলে মুদ্রিত বইয়ের দাম জনসাধারণের নাগালে চলে আসে। এর ফলে যে শিক্ষা শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা ক্রমে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা : উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানা থেকে বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত-সহ বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়ে সুলভে গ্রামগঞ্জের সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হতে থাকে।
- বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : কেরি সাহেবের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রীরামপুর ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে ৬,৭০৩ জন ছাত্র নিয়ে ১০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন বাংলায় প্রথম মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নারীশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- কলেজ প্রতিষ্ঠা : উইলিয়াম কেরি ও তাঁর দুই সহযোগী সারা জীবনের সজ্জিত অর্থ ব্যয় করে শ্রীরামপুরে একটি ডিগ্রি কলেজ (১৮১৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি কলেজ।
- বাংলা ভাষায় শিক্ষার প্রসার: কেরি সাহেব উপলব্ধি করেছিলেন, গ্রামবাংলায় গণশিক্ষার প্রসারের জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করা। এজন্য তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা চালান।
- প্রগতিশীলতা: কেরি সাহেব ভারতের প্রাচীন পিছিয়ে পড়া শিক্ষারীতির পরিবর্তে আধুনিক সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মন থেকে যাবতীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন।
উপসংহার: শিক্ষার প্রসারে উইলিয়াম কেরি ও তাঁর শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অসামান্য। গবেষক বিশাল মঙ্গলবাদী তাঁর ‘উইলিয়াম কেরির অবদান নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, যে সকল ধর্মযাজক নিজেদের সুবিধার জন্য জনগণকে সত্যান্বেষণের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতেন, উইলিয়াম কেরি সেই যাজকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষকে আত্মিক শক্তি দিলেন।
- চার্লস উইলকিনস-এর উদ্যোগ : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী চার্লস উইলকিনস ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ছাপার কাজের প্রয়োজনে তিনি সর্বপ্রথম বাংলা অক্ষর বা হরফের টাইপ বা নকশা তৈরি করেন। তবে সেই সমস্ত অক্ষরগুলি ছিল অত্যন্ত সাধারণ বা নিম্নমানের।
- পঞ্চানন কর্মকারের উদ্যোগ : চার্লস উইলকিনস-এর পরবর্তীকালে সুদক্ষ স্বর্ণশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার উন্নত বাংলা অক্ষরের ছাঁচ বা টাইপ তৈরি করেন। তাঁকে বাংলা টাইপের জনক বলা হয়। তাঁর তৈরি করা টাইপেই শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানায় বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ছাপার কাজ শুরু হয়।
- মনোহর কর্মকারের উদ্যোগ : পঞ্চানন কর্মকার অক্ষরের টাইপ তৈরির কৌশল তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকারকে শিখিয়ে যান। ফলে পরবর্তীকালে মনোহর বাংলা অক্ষর তৈরিতে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেন এবং আরও উন্নত বাংলা অক্ষর বা হরফ তৈরি করেন।
- সুরেশচন্দ্র মজুমদারের উদ্যোগ: পঞ্চানন কর্মকারের পর সুরেশচন্দ্র মজুমদার বাংলা টাইপ বা অক্ষর তৈরিতে আরও দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি ‘লাইনো টাইপ’ নামক আরও উন্নত এক ধরনের বাংলা অক্ষর বা টাইপ তৈরি করেন।
উপসংহার: চার্লস উইলকিনস সাহেবের হাত ধরে বাংলা অক্ষর বা হরফ বা নকশার যাত্রা শুরু হলেও পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর জামাই মনোহর কর্মকারের দক্ষতায় তা অনেক বেশি মার্জিত হয়। পরে সুরেশচন্দ্র মজুমদারের ‘লাইনো টাইপ’ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে বাংলা অক্ষরকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
- পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ : বাংলার ছাপাখানাগুলিতে স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রচুর পরিমাণ পাঠ্যপুস্তক ছাপা হতে থাকে। এইসব পাঠ্যপুস্তকের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি। ছাপাখানায় মুদ্রিত বইপত্রের সুন্দর মুদ্রণ এবং কম দাম হওয়ায় তা গ্রামবাংলার সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাতেও পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়। এই সব বইগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
- অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশ: ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের পর থেকে বাংলায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য প্রভৃতির অনুবাদ, বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। এগুলি সুলভে বাংলার সাধারণ পাঠকদের হাতে পৌঁছে যায়।
- সংবাদপত্রাদি প্রকাশ: ছাপাখানাগুলি থেকে বাংলা ও ইংরেজিতে বেশকিছু সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রও প্রকাশিত হতে থাকে। এইসব সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলিতে দৈনন্দিন সংবাদ ছাড়াও নিয়মিত বিভিন্ন জ্ঞানমূলক বিষয়ের আলোচনা স্থান করে নেয়।
- নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক রচনা করে তা কম খরচে বা বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হলে তার অধীনে বেশ কয়েকটি স্কুল গড়ে ওঠে।
উপসংহার: ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত সুলভ বইপত্র সাধারণ মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। ফলে বাংলায় শিক্ষার ব্যাপক ও দ্রুত প্রসার শুরু হয়।
- শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র প্রকাশ: বাংলায় ছাপাখানার প্রসারের ফলে এইসব ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বিভিন্ন বইপত্রের হাজার হাজার কপি সুলভে বাংলার গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে যায়। বাংলার শিশুদের মধ্যে সহজে প্রাথমিক শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গ্রন্থকার শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র রচনা করেন।
- প্রাথমিক উদ্যোগ: বাংলার শিশুশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশন প্রণীত ‘লিপিধারা’ (১৮১৫ খ্রি.), রাধাকান্ত দেব রচিত ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২১ খ্রি.), স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘বর্ণমালা’ (সম্ভবত ১৮৫৩-৫৪ খ্রি.), ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক দুই খণ্ডে রচিত ‘শিশুসেবধি’ (১৮৫৪ খ্রি.) প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এইসব বই খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
- মদনমোহন তর্কালঙ্কার: বাংলায় শিশুশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ‘শিশুশিক্ষা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রকাশের পর সেটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভের ফলে ‘শিশুশিক্ষা’র প্রথম ভাগ ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে, ‘শিশুশিক্ষা’র দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এবং পরবর্তীকালে এর তৃতীয় ভাগ ও ‘বোধোদয়’ শিরোনামে চতুর্থ ভাগ প্রকাশিত হয়। ‘শিশুশিক্ষা’ বাংলার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘শিশুশিক্ষা’-কে বাংলার প্রথম ‘প্রাইমার’ বলা হয়।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : শিশুদের বর্ণশিক্ষা ও শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুই খণ্ডে ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এটি শীঘ্রই ‘শিশুশিক্ষা’র জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করে যায়। দুই পয়সা মূল্যের পাতলা এই বইটি বাংলার শিক্ষাজগতে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি ঘটায়।
- রামসুন্দর বসাক : রামসুন্দর বসাক ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বাল্যশিক্ষা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি পূর্ববঙ্গের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সহজপাঠ’ নামক শিশুশিক্ষা-বিষয়ক একটি বই লেখেন। এটিও শিশুশিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট অবদান রাখে। পশ্চিমবঙ্গের নানা বিদ্যালয়ে এই বইটি পাঠ্য বইরূপে স্বীকৃত ছিল।
উপসংহার: ছাপাখানাগুলিতে শিশুদের জন্য মুদ্রিত বইগুলি বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং শিশুশিক্ষার বিস্তারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগে এই অগ্রগতির মোটেই সম্ভাবনা ছিল না।
- গণশিক্ষার দিকে যাত্রা: ইতিপূর্বে হাতে লেখা বইয়ের দাম খুব বেশি হত। তাই এসব বই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল এবং শিক্ষাদান ব্যবস্থা ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ছাপা বই দামে সস্তা হওয়ায় তা সাধারণ মানুষ কেনার ও পড়ার সুযোগ পায়। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঘটে যা গণশিক্ষার প্রসারের পটভূমি তৈরি করে।
- পাঠ্যবইয়ের সহজলভ্যতা : ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রচুর পরিমাণ মুদ্রিত ও দামে সস্তা পাঠ্যবই বাজারে আসতে থাকে। ফলে বইয়ের অভাব দূর হয় এবং শিক্ষাবিস্তারের পথ মসৃণ হয়।
- মাতৃভাষায় শিক্ষা : ছাপাখানার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ভাষাশিক্ষা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি বই, বোধিনী বা সহায়িকা বই বাংলা ভাষায় ছাপা হতে থাকে। ফলে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়।
- শিশুশিক্ষা : ছাপা বই শিশুশিক্ষার অগ্রগতি ঘটাতে সহায়তা করে। ছাপাখানায় মুদ্রিত মদনমোহন তর্কালংকারের ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’র মতো বইগুলি শিশুশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
- উচ্চশিক্ষা : আশিস খাস্তগীর উল্লেখ করেছেন যে, উনিশ শতকের মধ্যভাগে ব্যাপক পরিমাণে পাঠ্যবই প্রকাশ হতে থাকলে তা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে। ফলে, বাঙালির উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি অনেক সহজ হয়।
- নারীশিক্ষার অগ্রগতি : উনিশ শতকের শেষার্ধে নারীশিক্ষার দাবি ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সুলভ ছাপা বই নারীদের হাতে পৌঁছালে নারীশিক্ষার গতি ত্বরান্বিত হয়।
উপসংহার: ছাপা বই একদিকে শিক্ষার বিস্তারে ভূমিকা নিয়েছিল, অন্যদিকে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
- শিশুশিক্ষা-বিষয়ক বইপত্র: বাংলার ছাপাখানাগুলিতে শিশুশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বই ছাপা হয়। এইসব বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাক রচিত ‘বাল্যশিক্ষা’ প্রভৃতি। এইসব বই থেকেই বাংলার শিশুরা বাংলা বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হয়।
- বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যবই: শিশুশিক্ষার বই ছাড়াও ছাপাখানাগুলিতে বিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়। ঊনবিংশ শতকের এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল গোবিন্দ প্রসাদ দাস রচিত ‘ব্যাকরণ সার’, প্রাণলাল চক্রবর্তী রচিত ‘অঙ্কবোধ’, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, আনন্দকিশোর সেন রচিত অর্থের সার্থকতা’, দীননাথ সেন রচিত ‘বাংলাদেশ ও আসামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং ‘ঢাকা জেলার ভূগোল এবং সংক্ষেপে ঐতিহাসিক বিবরণ’ প্রভৃতি।
- সহায়ক বইপত্র: ঊনবিংশ শতকে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও ছাপাখানার মালিকরা ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন সহায়ক বইপত্র প্রকাশ করতেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এইসব বইয়ের যথেষ্ট চাহিদাও ছিল।
উপসংহার: বাংলা ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের জন্য পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে ছাপাখানাগুলিতে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। মুদ্রিত পাঠ্যবইগুলি বাংলার শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছালে শিক্ষার প্রসারে আরও গতি আসে।
- পাঠ্যবই প্রকাশ : শিক্ষার্থীদের অক্ষরজ্ঞানসহ গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য প্রভৃতি বিভিন্ন পাঠ্য বিষয়ের বইপত্র ছাপাখানার মালিকরা তাঁদের ছাপাখানায় ছাপতে থাকেন। কয়েক দশকের মধ্যেই পাঠ্যবইয়ের একটি বৃহৎ বাজার গড়ে ওঠে। এইসব বই বিক্রি করে মালিকদের ব্যাবসার দ্রুত প্রসার ঘটে।
- অন্যান্য বইপত্র প্রকাশ : ছাপাখানার মালিকরা সাহিত্য, কবিতা, নাটক, গানের বই, ধর্মগ্রন্থ, অনুবাদ গ্রন্থ, ভ্রমণকাহিনি, চিকিৎসাশাস্ত্র, গবেষণামূলক গ্রন্থ, অভিধান প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বইপত্র ছেপে পাঠককুলের একটি বড়ো বাজার তৈরি করেন। ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সহায়ক বইপত্র ছেপে ব্যাবসার আরও বৃদ্ধি ঘটান।
- পত্রপত্রিকা প্রকাশ : অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে পরবর্তী এক শতকের মধ্যে বাংলায় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের পত্রপত্রিকা ছিল। এসব পত্রপত্রিকা ছাপার ফলে ছাপাখানার ব্যাবসার আরও প্রসার ঘটে।
- অন্যান্য মুদ্রণ: ব্রিটিশ শাসনকালে অফিস-আদালতের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ফলে এইসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাগজপত্র মুদ্রণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মিলিটারি বিল, ভাতার ফর্ম, সামরিক বাহিনীর বিধিবিধান, সার্কুলার, বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতি কাগজপত্র ছাপার কাজ শুরু হলে ছাপাখানার ব্যাবসা বৃদ্ধি পায়।
- আনুষঙ্গিক ব্যাবসা: ছাপাখানার ব্যাবসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে এর সঙ্গে যুক্ত আনুষঙ্গিক ব্যাবসারও ধারাবাহিক প্রসার ঘটতে থাকে। যেমন—কাগজ বিক্রি, বই বাঁধাই, বই বিক্রি ইত্যাদি।
- ছাপাখানার সংখ্যাবৃদ্ধি: ছাপার কাজের ব্যাবসায়িক চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে কলকাতায় ছাপাখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় ১৭টি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারতে ১,০৯৪টি ছাপাখানা ছিল। এর মধ্যে বাংলা প্রদেশেই ছিল ২২৯টি ছাপাখানা।
উপসংহার: যে-কোনো শিল্প গড়ে ওঠে বাজারে তার চাহিদার ওপর নির্ভর করে। বইয়ের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে আঠারো-উনিশ শতকে মুদ্রণশিল্প একটি উজ্জ্বল, লাভজনক ও সম্ভাবনাময় ব্যাবসা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
- ছাপাখানার জগতে যাত্রা: বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দেবার পর বিকল্প জীবিকা হিসেবে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৬০০ টাকা ঋণ নিয়ে বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে অংশীদার হিসেবে নিয়ে কলকাতায় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
- বর্ণমালার সংস্কার : বই মুদ্রণের ক্ষেত্রে অক্ষর বা বর্ণমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের পূর্বে শব্দ বোঝানোর ক্ষেত্রে বাংলা অক্ষরের মধ্যে কিছু গণ্ডগোল ছিল। যেমন—বর্গীয় জ ও অন্তঃস্থ য় হরফের আলাদা আলাদা উচ্চারণের হরফ বসানোর ক্ষেত্রে ‘য’ হরফের মাধ্যমেই কাজ চালিয়ে দেওয়া হত। বিদ্যাসাগর এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান। তিনি ‘খ’ বর্ণটির নীচের ফুটকি দেওয়ার পদ্ধতি চালু করে অন্তঃস্থয় উচ্চারণের হরফ তৈরি করেন। ‘ড’ ও ‘ঢ’-এর ক্ষেত্রেও যথাক্রমে ‘ড়’ও ‘ঢ়’ হরফের প্রচলন করেন। ঋ-কার (), ‘উ-কার’ () ও ‘ঊ-কার’ () লেখার প্রচলনও তিনিই করেন।
- প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ : বিদ্যাসাগরের ছাপাখানা থেকে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটি হল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সংরক্ষিত মূল অন্নদামঙ্গল কাব্যের পাণ্ডুলিপিটি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর কৃষ্ণনগরে আসেন এবং বইটি সংগ্রহ করেন। এরপর তাঁর সম্পাদিত এই গ্রন্থটি তাঁর ছাপাখানা থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
- পুস্তকের ব্যাবসা: ছাপানো বই বিক্রির কাজেও বিদ্যাসাগর এগিয়ে আসেন। তাঁর নিজস্ব ছাপাখানায় উৎপাদিত পুস্তক বিক্রির উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি’ ও ‘কলিকাতা পুস্তকালয়’ নামে দুটি বইয়ের দোকান খোলেন। তাঁর নিজের লেখা ‘বর্ণপরিচয়’ বইটির দুটি খণ্ড (প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ) বিক্রি করে তিনি কয়েক হাজার টাকা উপার্জন করতেন।
- জনশিক্ষার প্রসার : ছাপাখানায় মুদ্রিত বইপত্র বাজারে আসার আগে হাতে লেখা বইগুলির দাম অত্যন্ত বেশি হত। আর মুদ্রিত বইগুলির দাম সেই তুলনায় অনেক কম হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসে। ফলে জনশিক্ষার প্রসারে ছাপাখানা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
- বৌদ্ধিক বিকাশ: ছাপাখানা জনগণের বৌদ্ধিক বিকাশেও সহায়তা করেছিল। ছাপাখানার ফলে নানান ধরনের বই সব বয়সের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়ে। এইভাবে পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটতে থাকে।
- নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির আত্মপ্রকাশ: ছাপাখানার বিস্তারের ফলে এই পেশাকে কেন্দ্র করে এক নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই শ্রেণি ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করে বইপত্র প্রকাশ ও বিক্রির লাভজনক ব্যাবসা শুরু করে। বইয়ের বিপুল বিক্রির ফলে তারা দিন দিন অর্থনৈতিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: ছাপাখানা প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। অক্ষর সাজানো, সাদা কাগজে বই ছাপা, বই বাঁধাই-সহ নানা কাজের জন্য ছাপাখানাগুলি লোক নিয়োগ করত। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান গড়ে ওঠে।
উপসংহার: প্রথম পর্বে ছাপাখানাগুলি বাংলায় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। পরবর্তী পর্বে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের পর শিক্ষার প্রসারে আরও গতি আসে। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যাসাগরের জনশিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতি উদ্যোগে ছাপাখানারও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
- শিক্ষানবিশ : ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য নামে গ্রন্থটি থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। গঙ্গাকিশোর প্রথম জীবনে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিষ্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ করতেন। এখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তিনি পরবর্তীকালে কলকাতায় এসে বই প্রকাশের কাজ শুরু করেন।
- সচিত্র বই: গঙ্গাকিশোর ফেরিস এন্ড কোম্পানি প্রেস থেকে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কবি ভারতচন্দ্রের সচিত্র অন্নদামঙ্গল কাব্যটি ছাপেন। এটিই ছিল বাঙালিদের সম্পাদনায় প্রথম সচিত্র বই। তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পী রামচাঁদ রায়ের আঁকা ছবি এই বইয়ে ব্যবহার করা হয়।
- বাঙালি গেজেটি প্রেস : অন্নদামঙ্গলের ব্যাপক বিক্রিতে উৎসাহিত হয়ে গঙ্গাকিশোর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস স্থাপন করেন। এটি ছিল বাঙালি মালিকানায় প্রথম ছাপাখানা। তিনি এখান থেকে নিজ সম্পাদনায় বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশ করতে থাকেন।
- বিভিন্ন বই : অন্নদামঙ্গল কাব্য ছাড়াও গঙ্গাকিশোর বিভিন্ন বই প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘এ গ্রামার ইন ইংলিশ এন্ড বেঙ্গলি’, ‘গণিত নামতা ব্যাকরণ লিখবার আদর্শ’, ‘দায়ভাগ’, ‘চিকিৎসার্ণব’, ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’, ‘দ্রব্যগুণ’ প্রভৃতি।
উপসংহার: বাঙালিদের মধ্যে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই ছিলেন প্রথম সংবাদপত্র সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রথম বাংলা সচিত্র বইয়ের প্রকাশক। তাঁর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে এরপর থেকে বহু বাঙালি নিজেদের উদ্যোগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে বইপত্র ও সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে প্রবেশ করেন।
- ইউ রায় অ্যান্ড সন্স প্রতিষ্ঠা: উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিদেশ থেকে আধুনিক উন্নত মুদ্রণযন্ত্র এনে কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। এখানে তিনি মুদ্রণের কাজে উন্নতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান।
- হাফটোন ব্লক তৈরি : উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানায় কাঠের পরিবর্তে তামা ও দস্তার পাতে অক্ষর বা ছবি খোদাই করে মুদ্রণের প্রয়োজনীয় ব্লক তৈরি করেন। তিনি অন্ধকার ঘরে বসে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ লক্ষ করে হাফটোন ব্লক তৈরির সূত্র উদ্ভাবন করেন। এর ফলে মুদ্রণশিল্প অনেক উন্নত হয়।
- ছবির ব্যবহার : উপেন্দ্রকিশোর বইয়ের প্রচ্ছদ ও বইয়ের ভেতরে লেখার সঙ্গে বিভিন্ন ছবির মুদ্রণ উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। এই বিষয়ে তিনি ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন, ডায়াফ্রাম পদ্ধতি, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়োটাইপ, রিপ্রিন্ট প্রভৃতি পদ্ধতি ব্যবহার করে রংবেরঙের নানা ছবি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
- স্টুডিয়ো স্থাপন : উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানার সঙ্গে ছবি আঁকার একটি স্টুডিয়ো খোলেন। এখানে তিনি আধুনিক ফোটোগ্রাফি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। এর ফলে সাদাকালো ছবি প্রচলনের যুগে তিনি ছোটোদের জন্য রংবেরঙের বিভিন্ন বই প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তিনি আধুনিক ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণশিল্প সম্পর্কে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর পুত্র সুকুমার রায়কে ইংল্যান্ডে পাঠান (১৯১১ খ্রি.)।
- প্রকাশনা: বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পর মুদ্রণশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়ে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ছাপাখানা থেকে ছোটোদের জন্য নিজের লেখা রঙিন বই একের পর এক প্রকাশ করতে থাকেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সেকালের কথা’, ‘টুনটুনির বই’, ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রভৃতি।
উপসংহার: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কর্তৃক বাংলার মুদ্রণশিল্পের আধুনিকীকরণের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন এবং ‘ইউ এন রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর উদ্যোগগুলি বাংলার মুদ্রণশিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – B বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (আই এ সি এস)
- প্রতিষ্ঠা: পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত গবেষণা, অধ্যয়ন, বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতার আয়োজন প্রভৃতির উদ্দেশ্যে বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪ খ্রি.) ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই কলকাতায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (সংক্ষেপে আই এ সি এস) প্রতিষ্ঠা করেন।
- পত্রিকা: আই এ সি এস থেকে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স নামে বিজ্ঞান-বিষয়ক জার্নাল প্রকাশিত হয়। এই জার্নালে এখানকার বিজ্ঞানী ও গবেষকদের গবেষণাকর্ম নিয়মিত প্রকাশিত হত।
- খ্যাতনামা গবেষকগণ: এখানকার গবেষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সুব্রত্মণ্যম চন্দ্রশেখর, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃষ্ণান প্রমুখ।
- রমন ক্রিয়া: এখানে গবেষণা করে বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন তাঁর বিখ্যাত রমন ক্রিয়া (রমন এফেক্ট) আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
- কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ
- প্রতিষ্ঠা: বিশিষ্ট আইনজীবী স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ বা ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- খ্যাতনামা শিক্ষকগণ: সে যুগের খ্যাতনামা শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশির কুমার মিত্র প্রমুখ কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদান করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় এখানে বিশ্বমানের শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এর যোগসূত্র স্থাপিত হয়।
- খ্যাতনামা শিক্ষার্থীগণ: এখানে পড়াশোনা করে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেন।
- বসু বিজ্ঞান মন্দির
- প্রতিষ্ঠা: ভারতে একটি আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সে যুগের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (৩০ নভেম্বর) কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর মুন্সিগঞ্জের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের বৃহদংশ এই প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যয় করেন।
- বিষয়-বৈচিত্র্য: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানের মৌলিক গবেষণা চালানোই ছিল বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে এখানে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়।
- বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট
- প্রতিষ্ঠা: তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে (২৫ জুলাই) কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট নামে একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট-এর সঙ্গে মিলে যায়।
- বিষয়-বৈচিত্র্য: কলাবিভাগের পাশাপাশি এখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণা কর্ম প্রকাশের জন্য এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।
উপসংহার: বাংলার বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দীর্ঘ গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র বসু ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল্স প্রতিষ্ঠা করে দেশকে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখান। সত্যেন্দ্রনাথ বোস এবং মেঘনাদ সাহা স্বাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনে যুক্ত থেকে দেশ গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- যুক্তিবাদের প্রসার: পেশায় চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস দূর করে তাদের যুক্তিবাদের সমর্থক হতে বলেন। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ হলেই, সমাজ কুসংস্কারমুক্ত হবে।
- আই এ সি এস-এর প্রতিষ্ঠা: দেশীয় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার বিশিষ্ট বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার উইজিন লাঁতো-র সহায়তায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা’ (সংক্ষেপে IACS) প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠান যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়।
- পরিচালন সমিতি: মহেন্দ্রলাল সরকার আমৃত্যু ‘আই এ সি এস’ এর সম্পাদক। লেন। এ ছাড়াও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির সদস্যপদ অলংকৃত করেন। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি এর অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
- অধিকর্তা নিয়োগ: ‘আই এ সি এস’-কে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সঞ্চালনার উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রলাল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে অধিকর্তা পদে নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ড. নীলরতন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা পদে নিযুক্ত হন।
- গবেষণা : এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা, অধ্যয়ন এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতার সুব্যবস্থা করা হয়। উক্ত গবেষণা ও বক্তৃতা প্রদানের কাজে মহেন্দ্রলাল দেশবিদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের এখানে শামিল করেন।
- গবেষণাপত্র : গবেষক অধ্যাপকদের বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক কাজগুলি প্রকাশের জন্য আই এ সি এস ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়াও দেশবিদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায় এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হত।
- বিজ্ঞানী ও আবিষ্কার : ড. মহেন্দ্রলাল সরকার আই এ সি এস-এ সমকালীন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের যুক্ত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বোস, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সুব্রক্ষ্মণ্যম চন্দ্রশেখর, মেঘনাদ সাহা, কে. এস. কৃয়াণ প্রমুখ। এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেই বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন তাঁর বিখ্যাত ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় ‘নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
উপসংহার: আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের আই এ সি এস বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমনের নোবেল পুরস্কার লাভ প্রভৃতি এই প্রতিষ্ঠানকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যান। সমাজসংস্কারের কাজেও মহেন্দ্রলালের অসামান্য অবদান রয়েছে।
- শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা : বাংলার সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’। কলেজটি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে শিবপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং এর নতুন নাম হয় ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’। এই কলেজ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ডিগ্রি প্রদান শুরু করে।
- কারিগরি শিক্ষার প্রসারের দাবি: উনিশ শতকের শেষ দিকে কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্রগুলিতে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের দাবি জানানো শুরু হয়। এর পরিণতি হিসেবে কলকাতায় ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন’ (১৯০৪ খ্রি.), ‘যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ (১৯০৬ খ্রি.) প্রভৃতি গড়ে ওঠে।
- বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে দেশে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় । সেই সূত্রেই বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্যে আইনজীবী তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই কলকাতায় ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ নামে একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে বাংলার বহু শিক্ষিত যুবক কারিগরিবিদ্যা লাভ করে স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।
- CET: দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ও ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ’ একত্রে মিশে যায়। এর নতুন নাম হয় ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল’। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ বা CET।
- জ্ঞানচর্চার শাখা : CET-এ কলাবিভাগের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়।
- জার্নাল প্রকাশ: CET-এর ছাত্রছাত্রীরা ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এই জার্নালের প্রথম সংখ্যাটি তাঁরা স্বদেশি আন্দোলনের যুগের সেই সকল আত্মত্যাগীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন যাঁরা জাতীয় শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসক ও শিল্পপতিরা কারিগরি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অদক্ষ বলে মনে করত। এজন্য তারা কারিগরি শিক্ষার পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করায় বাংলায় কারিগরি শিক্ষার যথার্থ প্রসার ব্যহত হয়। তবে স্বাধীনতার পরে ভারতে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল ভারতের বিভিন্ন শহর-সহ পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’ (১৯৫১ খ্রি.)-র প্রতিষ্ঠা।
- চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন: বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করে জগদীশচন্দ্র টানা এক বছর চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু ওই কাজে তাঁর স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চা ছেড়ে ক্রাইস্ট কলেজে ভরতি হয়ে যান।
- পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহ: ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানবিভাগে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এই কাজে তাঁর প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন রেভারেন্ড ফাদার লাফোন্ট। পরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজে যোগ দেন। এই সময় থেকেই তাঁর প্রকৃত গবেষণা জীবনের সূচনা হয়।
- পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা: জগদীশচন্দ্র পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিদ্যুত্তরঙ্গের আলোকধর্মী প্রবণতার মধ্যে প্রতিফলন, সমবর্তী বিচ্ছুরণ, সর্বমোট প্রতিফলন, প্রতিসরণ প্রভৃতি। তাঁর এই গবেষণাগুলি বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচিত করে।
- বেতার বার্তা আবিষ্কার: জগদীশচন্দ্র তাঁর আকাশ-তরঙ্গ ও বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গ গবেষণার সূত্র ধরে বেতার বার্তার সূত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘ক্রিস্ট্যাল রিসিভার’ যন্ত্রের দ্বারা তিনি কোনোরকম তারের সংযোগ ছাড়াই শব্দ আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করেন। নিজের বাসভবন থেকে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত তাঁর কর্মস্থল প্রেসিডেন্সি কলেজে শব্দ প্রেরণের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর এই যন্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণ করেন।
- উদ্ভিদবিদ্যার গবেষণা: পদার্থবিদ্যার পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদবিদ্যার ক্ষেত্রেও গবেষণার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র প্রথম প্রমাণ করে যে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তাঁর এই আবিষ্কার উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে।
- গবেষণামূলক রচনা: জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান গবেষণামূলক অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এগুলি ‘দ্য ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন’, ‘প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি’-সহ বিখ্যাত পত্রপত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত হত।
- বসু বিজ্ঞান মন্দির : জগদীশচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা (১৯১৫ খ্রি.) দেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (৩০ নভেম্বর) কলকাতায় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ বা ‘বোস ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘দ্য ভয়েস অব লাইফ’ শিরোনামে স্বাগত ভাষণে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।
উপসংহার: পরাধীন ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রগতিতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অসামান্য অবদান ছিল। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা জগদীশচন্দ্র বসুকে গ্যালিলিয়ো-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন—“ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি/তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।”
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্যশিক্ষারযথেষ্টপ্রসা
রঘটে।এর ফলেবাংলারশিক্ষার্থীরা পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা সম্পর্কে অবহিত হয়। এভাবে বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়। - প্রাথমিক উদ্যোগ: বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রথম দিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ছিল স্যার উইলিয়াম জোনস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.)। এই সোসাইটির পত্রিকায় বিজ্ঞান-বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হত। এ ছাড়া রসায়নবিদ জন ম্যাকে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজে রসায়নশাস্ত্র সম্পর্কে পড়ানো শুরু করেন।
- বিজ্ঞান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সরকার এবং কোনো কোনো বিশিষ্ট ভারতীয় মনীষীর উদ্যোগে বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই সব প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রভৃতি।
- কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : বাংলায় বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৮৫৬ খ্রি.), অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন (১৯০৪ খ্রি.), যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৯০৬ খ্রি.) প্রভৃতি।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার যে সূত্রপাত ঘটেছিল তা কিছুকালের মধ্যেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভিত্তির ওপরই স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার পথচলা শুরু হয় ।
- প্রতিষ্ঠা : বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো-র সহায়তায় বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪ খ্রি.) ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে (২৯ জুলাই) কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা লাভের পর এই প্রতিষ্ঠানটি যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়।
- পরিচালনা: ড. মহেন্দ্রলাল সরকার আমৃত্যু আই এ সি এস-এর সম্পাদক ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ। প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতা করেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
- অধিকর্তা : আই এ সি এস-এর প্রথম অধিকর্তা ছিলেন প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় (১৯১২ খ্রি.)। পরবর্তীকালে ড. নীলরতন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা পদে নিযুক্ত হন।
- উদ্যোগ: আই এ সি এস-এর কর্তৃপক্ষের সক্রিয় উদ্যোগে ও পরিচালনায় এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা, বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতা প্রদান, গবেষণাপত্র প্রকাশ প্রভৃতির ব্যবস্থা হয়। গবেষকদের গবেষণামূলক কাজ প্রকাশের জন্য এখান থেকে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
উপসংহার: ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (আই এ সি এস) এর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ড. মহেন্দ্রলাল সরকার ভারতে প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সূচনা করেন। ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সহায়তা ও দক্ষ পরিচালন গোষ্ঠী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অধিকর্তা পদে যোগদান এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেছে।
- প্ৰতিষ্ঠা : বিখ্যাত চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো-র সহযোগিতায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এটি যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়।
- গবেষণা: এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত মৌলিক গবেষণা এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এসব গবেষণা ও বক্তৃতা প্রদানের কাজে দেশবিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী অংশ নিয়েছেন।
- গবেষণাপত্র প্রকাশ: নিজেদের বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক কাজগুলি প্রকাশের জন্য আই এ সি এস ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। এ ছাড়া দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও বিজ্ঞান পত্রিকায় এখানকার গবেষক ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজ প্রকাশিত হত।
- খ্যাতনামা বিজ্ঞানী: আই এ সি এস-এর বিজ্ঞান গবেষণার কাজের সঙ্গে বিভিন্ন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, সুব্রম্মণ্যম চন্দ্রশেখর, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃয়ান প্রমুখ।
- গবেষণা বিদ্যালয়: বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এখানে একটি সক্রিয় গবেষণা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এতে এক্স রশ্মি, আলোকবিজ্ঞান, চুম্বকত্ব, রমন ক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে নানা মৌলিক গবেষণার কাজ হয়।
উপসংহার: ‘আই এ সি এস’-এর প্রতিষ্ঠা বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণাপত্র প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- যুক্তিবাদের প্রচার : পেশায় চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস দূর করে তাদের যুক্তিবাদের সমর্থক হতে বলেন।
- আই এ সি এস-এর প্রতিষ্ঠা : পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত মৌলিক গবেষণা, বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতার আয়োজন প্রভৃতি উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রলাল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা’ (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা (আই এ সি এস) প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁকো তাঁকে এ কাজে বিশেষ সহায়তা করেন।
- বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ : মহেন্দ্রলালের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আই এ সি এস তার নিজস্ব পত্রিকা প্রকাশ করে। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামক এই পত্রিকাতে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রকাশিত হত।
উপসংহার: বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে মহেন্দ্রলালের উদ্যোগ বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে অনেক ধাপ এগিয়ে দেয়। জগদীশচন্দ্র বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন। এখানে গবেষণা করেই চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন ‘রমন ক্রিয়া’ (রমন এফেক্ট) আবিষ্কার করেন, যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
- মৌলিক গবেষণা : কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সক্রিয় সহযোগিতা পেয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণার কাজ করার সুযোগ পান। ফলে বিজ্ঞানচর্চার যথেষ্ট মানোন্নয়ন ঘটে।
- খ্যাতনামা শিক্ষার্থী: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে পড়াশোনা এবং বিজ্ঞানসাধনা করে বহু শিক্ষার্থী পরবর্তীকালে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই রকম শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
- খ্যাতনামা শিক্ষক : সেই যুগের বহু স্বনামধন্য শিক্ষক ও বিজ্ঞানী কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদান করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশিরকুমার মিত্র প্রমুখ। তাঁদের পরিশ্রমে এখানে বিশ্বমানের শিক্ষাদানব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এর যোগসূত্র স্থাপিত হয়।
- শিক্ষকদের উদ্যোগ: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের বিভিন্ন শিক্ষক দেশ ও সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানকার শিক্ষক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল্স’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের যুবসমাজকে সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী না থেকে স্বনির্ভর হতে উৎসাহিত করেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা স্বাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন-এ যুক্ত থেকে দেশ গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক আমলে ‘কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ’ দেশীয় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে। বিশিষ্ট অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে এবং কৃতী ছাত্রদের সাফল্যে এই প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
- বিভিন্ন শাখা: বসু বিজ্ঞান মন্দির-এ পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়।
- উন্নত গবেষণা : জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বিশ্বমানের উন্নত গবেষণার ব্যবস্থা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মুন্সিগঞ্জের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের একটি বড়ো অংশ এখানে ব্যয় করেন। গবেষণার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জগদীশচন্দ্র বসুকে অর্থ সাহায্য করেন।
- ক্রেসকোগ্রাফ আবিষ্কার: বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দীর্ঘ গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র বসু ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন, প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরও প্রাণ এবং অনুভূতি শক্তি আছে। এখানকার গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল হল জগদীশচন্দ্র বসু কর্তৃক রেডিয়ো আবিষ্কার যা বর্তমানে বিশ্বের বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ স্বীকৃতিলাভ করেছে।
- আন্তর্জাতিক খ্যাতি: বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞানচর্চায় বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অবদান আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে। এখানকার গবেষকগণ পরবর্তীকালে ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞানচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছেন।
উপসংহার: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়। আধুনিক গবেষণাগারে জগদীশচন্দ্র বসুর ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কার এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেছে।
- জাতীয় শিক্ষার উদ্যোগ : স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম উদ্যোগ ছিল বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এই উদ্দেশ্যে আইনজীবী তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট নামে একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
- সমন্বয়: দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ একত্রে মিশে যায় এবং বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল নাম গ্রহণ করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বা CET।
- কার্যক্রম : উভয় প্রতিষ্ঠান মিশে যাওয়ার পর কলাবিভাগের পাশাপাশি এখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়। এর ফলে বাংলার বহু শিক্ষিত যুবক কারিগরি বিদ্যা লাভ করে স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।
- জার্নাল: কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-র ছাত্রছাত্রীরা ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এই জার্নালের প্রথম সংখ্যাটি তারা স্বদেশি আন্দোলনের যুগের সেই সকল আত্মত্যাগীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে যাঁরা জাতীয় শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
উপসংহার: বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় শিক্ষার দ্বারা বাংলার যুবকদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলা। বলা বাহুল্য যে, এই প্রতিষ্ঠান তার উদ্দেশ্যপূরণে সফল হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – C ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা ও বিশ্বভারতী
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- প্রতিষ্ঠা : সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গড়ে ওঠে। এর প্রথম সম্পাদক হন রাসবিহারী ঘোষ।
- আর্থিক সহায়তা : জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
- উদ্দেশ্য : জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল—জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে শিক্ষাদান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
- কার্যক্রম : পরিষদের কর্তৃপক্ষ নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান, কারিগরি প্রভৃতি শিক্ষার বিষয়ে নিজেরাই পাঠক্রম তৈরি করে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ হন অরবিন্দ ঘোষ। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
- বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা : বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে শিক্ষাদরদি তারকনাথ পালিত ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট একসঙ্গে মিশে গিয়ে হয় বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল।
- ব্যর্থতা : বিভিন্ন কারণে শেষপর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। এগুলি হল—[i] জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতি সরকারের স্বীকৃতি ছিল না। এজন্য বহু ছাত্র এই শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী ছিল না। [ii] এই শিক্ষা গ্রহণের পর যে ডিগ্রি পাওয়া যেত তা দিয়ে সরকারি চাকরি লাভের সুযোগ ছিল না। [iii] পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কিছুদিনের মধ্যেই প্রবল অর্থসংকটের শিকার হয়।
উপসংহার: শেষপর্যন্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নিলে স্বদেশি আন্দোলনও থেমে যায়। সেই সঙ্গে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্মও বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেলেও বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল যথারীতি চলতে থাকে। পরবর্তীকালে এটি যাদবপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সবশেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
- আশ্রমের নামকরণ: রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ধর্মচর্চা করার উদ্দেশ্যে ভুবনডাঙ্গায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই স্থানের নতুন নামকরণ করেন ‘শান্তিনিকেতন’।
- ব্রক্ষ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে ব্ৰত্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি সুবিস্তৃত প্রাকৃতিক পরিবেশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের ও অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর ভবন নির্মাণ করেন।
- বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি আদর্শ শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন যার নাম হয় ‘বিশ্বভারতী’।
- বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: অবশেষে তিনি বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের সন্নিকটে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- পল্লি সংগঠন: গ্রামীণ মানুষকে পল্লিজীবনের নানাদিক সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই ছিল কবির উদ্দেশ্য। ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লেনার্ড এলমহার্স্ট। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যে ‘শিক্ষাসত্র’টি প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটিই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনিকেতনে স্থাপিত হয়। এখানে ‘শিক্ষাসত্র’ বিদ্যালয়টিকে শান্তিনিকেতনের ‘পাঠভবন’-এর আদলে স্থাপন করা হয়েছিল।
- কৃষির উন্নয়ন: গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল কৃষিকাজ। তাই রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনের বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে কৃষির উন্নতির উদ্যোগ নেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘পল্লিশিক্ষাসদন’ নামে এখানে একটি কৃষি মহাবিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। সঙ্গে গ্রামীণ শিল্পোৎপাদন ও গো-পালন চলতে থাকে।
- স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রসার: শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শ্রীনিকেতনকে মডেল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে এখানে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘শিশু ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- শিক্ষার প্রসার: শিক্ষার প্রসার ঘটানো ছিল শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগকে সকল স্তরের জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘লোক-শিক্ষা সংসদ’ স্থাপন করা হয়।
উপসংহার: শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন উভয়ই ছিল গ্রাম। রবীন্দ্রনাথের সাধের দুই গ্রামেই তাঁর স্বপ্ন ডানা মেলতে পেরেছিল। বর্তমানে এই দুটি স্থান রবীন্দ্র ঐতিহ্যের পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়।
- অরণ্য ধ্বংসের বিপদ: রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, সকল জীব বৃক্ষদের অবলম্বন করে বেঁচে থাকে। কিন্তু আজ মানুষ নির্মমভাবে বন ধ্বংস করে মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন অরণ্যের সংরক্ষণ। ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “অনেক মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরাই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছের ওপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিতে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ, বিস্তৃত হয়ে মানুষ তাকেই ধ্বংস করেছে।”
- প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা: রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, “এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে…।” তিনি শান্তিনিকেতনে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই তাঁর আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসবকে জোরদার করে তোলেন।
- গ্রামের উন্নয়নের ভাবনা: পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জমিদারির দেখাশোনার দায়িত্ব (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ) পেয়ে রবীন্দ্রনাথ গ্রামে এসে গ্রামবাংলার আসল রূপটি চিনতে পারেন। তাই তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের পথ ছেড়ে গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লিগ্রামের মঙ্গলের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই ভারতের প্রাণ। গ্রামের উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। শিলাইদহে ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’ এবং পতিসরে হাসপাতাল স্থাপন ছাড়াও তিনি গ্রামে তাঁতের কাজ, মৃৎশিল্প প্রভৃতি কুটিরশিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেন। জমিদারির প্রজাদের বিবাদের মীমাংসার জন্য সালিশি সভারও আয়োজন করেন তিনি।
- কৃষির উন্নয়ন: রবীন্দ্রনাথ পল্লিগ্রামের মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে কৃষিকাজের উন্নতির বিষয়ে বিভিন্ন রকম চিন্তাভাবনা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র স্থাপন করে সেখানে ট্র্যাক্টর, পাম্পসেট ও জৈব সার ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব আনেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ির ৮০ বিঘা জমিতে আধুনিক কৃষিখামার গড়ে তোলেন।
- কৃষিবিদ্যা শিক্ষা: সেযুগে ধনী বাঙালি পরিবারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাদের সন্তানদের আই সি এস বা ব্যারিস্টার বানানো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে কৃষিবিদ্যা শিখতে বিদেশে পাঠান। চাষের কাজে বৈজ্ঞানিক প্রথায় উন্নত বীজ, সার, সেচ প্রভৃতি ব্যবহার করে জনসাধারণের উন্নতিবিধানই ছিল তার এই উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য।
- হিতৈষী তহবিল: রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে প্রজাদের বকেয়া খাজনার ওপর সামান্য হিতৈষীশুল্ক ধার্য করে এবং জমিদারি থেকে তার সমপরিমাণ অর্থ ভরতুকি দিয়ে ‘হিতৈষী তহবিল’ গড়ে তোলা হয়। এই তহবিলের অর্থ গ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদের সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, চাষিদের বিপদকালে সাহায্যদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যয় করা হত।
- সম্প্রীতি: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর করা। তিনি জমিদারি দেখাশোনা করতে এসে তাঁর কর্মক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-চন্ডা
লের ভেদাভেদ দূর করে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। - অন্যান্য উদ্যোগ: রবীন্দ্রনাথ আধুনিক পঞ্চায়েতের ধাঁচে গ্রামের পরিচালন কাঠামো গড়েছিলেন। তিনি গ্রামে সমবায়সমিতি প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দেন এবং স্বল্প সুদে চাষিদের ঋণদানের জন্য পতিসর কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। চাষিরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় তার জন্য তিনি ‘টেগোর অ্যান্ড কোং’ (১৮৯৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে ন্যায্য মূল্যে তাদের দ্বারা উৎপাদিত ধান ও পাট কিনে বাজারে বিক্রির দায়িত্ব নেন।
উপসংহার: ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার শিশুকালেই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে আমার খুব একটি সহজ ও নিবিড় যোগ ছিল।” প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের এই সহাবস্থান তাঁর শিক্ষাচিন্তায় সর্বদা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- বয়কট আন্দোলন : লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ করলে এর বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করে ছাত্রদের এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কারণ, দীঘির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত ব্রিটিশদের অফিস-আদালতের কেরানিই তৈরি করত।
- শিক্ষাক্ষেত্রে বিকল্প উদ্যোগ : স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে বিদেশি সবকিছু বয়কট করে এর বিকল্প হিসেবে দেশীয় জিনিসপত্রের ব্যবহার শুরু হয়। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে স্বদেশি ধাঁচের একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সম্ভবত প্রসন্নকুমার ঠাকুরই সর্বপ্রথম ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি ব্যবহার করেন।
- জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ব্যাপ্তি: স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলায় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটে ১৫০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
- জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন: এইরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে স্বদেশি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার: বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় আদর্শ অনুসারে শিক্ষাদানের কথা ভাবছিলেন। সেই সময় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ (১৯০৬) গঠিত হওয়ার সুযোগ আসে এবং এই পরিষদ জাতীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা: দেশীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতায় সরব হন ও বিকল্প স্বদেশি ধাঁচের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। সম্ভবত ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।
- বিকল্প সংস্থা গঠন: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে (১১ মার্চ) ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গড়ে ওঠে। এই পরিষদের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল—জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
- আর্থিক সহায়তা লাভ: জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করেন। এই ব্যাপারে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
- বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গঠন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকগণ এখানে শিক্ষাদান করতেন।
- বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: দেশীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়।
উপসংহার: বাংলার তৎকালীন জাতীয় নেতৃবৃন্দ একদিকে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতায় সরব ছিলেন, অন্যদিকে স্বদেশি শিক্ষার প্রচলনে ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
- উদ্দেশ্য: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল— জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
- বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা : স্বদেশি প্রথায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। সতীশচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকরা এখানে শিক্ষাদান করতেন।
- বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রেরণায় বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট। বিভিন্ন ধনবান ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি নিযুক্ত হন রাসবিহারী ঘোষ।
- সামাজিক অবদান: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে বহু শিক্ষার্থী স্নাতক হয়ে পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। এসব প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ছাত্রসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন হীরালাল রায় ও উপেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ।
উপসংহার: ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ শহর ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এই পরিষদ জাতীয় আদর্শ অনুসারে শিক্ষাদান, পাঠ্যসূচি নির্মাণ, আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করে।
- সরকারের বিরূপতা : ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে- ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকার মোটেই সুনজরে দেখেনি। সরকারি প্রতিবন্ধকতার ফলে স্বদেশি ধাঁচে গড়ে ওঠা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি পদে পদে ব্যাহত হয়েছে।
- কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা: সরকার তার নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এজন্য জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সরকারি চাকরি লাভ করার সুযোগ একেবারেই ছিল না। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের শিক্ষার্থীরা জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে।
- আর্থিক সংকট: প্রথমদিকে অনেক উৎসাহ ও আশা নিয়ে জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ শুরু হলেও কিছুকাল পর থেকে আর্থিক সংকটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্ম ব্যাহত হতে থাকে। সূচনা লগ্নে বহু আর্থিক দান পাওয়ার আশা থাকলেও অনেকাংশেই তা পূরণ হয়নি।
- অভিভাবকদের অনীহা: বেশিরভাগ অভিভাবক ও শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষার চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা গ্রহণেই বেশি আগ্রহী ছিল। ফলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন দুর্বল হতে শুরু করলে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও ক্রমে ব্যর্থ হতে থাকে।
উপসংহার: প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলেও কিছুকালের মধ্যেই এই পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলি ছিল জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিমাতৃ সুলভ আচরণ, সরকারি কর্মক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষার্থীদের প্রতি বঞ্চনা, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতি।
- জাতীয় শিক্ষার উদ্যোগ: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শুরু হলে এদেশে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়। এর জন্য ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গড়ে তোলা হয়।
- ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ পরিত্যাগ: জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করে ছাত্রদের এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কারণ, গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়ারের কাছে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা না দিয়ে শুধু ব্রিটিশদের অফিস-আদালতে কাজের জন্য কেরানি তৈরি করত। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু ছাত্রছাত্রী সেই ‘গোলামখানা’ ছেড়ে জাতীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করে।
- রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগ: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিকল্প শিক্ষানীতি দেশবাসীকে এক নতুন দিশা দেখাতে সমর্থ হয়। নিজস্ব শিক্ষানীতি নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো এবং ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বীরভূমের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনার ফলে স্বদেশি যুগে ভারতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর ফলে ভারতীয় শিক্ষা কিছুকালের মধ্যে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করতে সক্ষম হয়।
- ব্ৰাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে একটি ব্রত্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। এখানে প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
- শিক্ষাপদ্ধতি: ব্রহ্মবিদ্যালয়ে আশ্রমিক গুরুকুল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে এবং ছাত্র-শিক্ষকের ব্যবধান দূর করে শিক্ষাদান করাই ছিল ব্রহ্মবিদ্যালয়ের শিক্ষানীতির মূলকথা। এখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকত না।
- বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভাবনা: পাঠভবনের প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন, যার নাম হয় ‘বিশ্বভারতী’।
- বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: অবশেষে রবীন্দ্রনাথ বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের সন্নিকটে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে কলাবিদ্যার পাশাপাশি অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ বিভিন্ন ব্যাবহারিক শিক্ষার পাঠদান শুরু হয়।
- পর্যটন শিল্পকেন্দ্র: রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নিজের এবং অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি করান। পরবর্তীকালে আশ্রমবাসী শিল্পী ও ভাস্করদের বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মের দ্বারা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সুসজ্জিত হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
- কেন্দ্রীয় মর্যাদা: ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বধর্ম ও বিশ্বসংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
- মানুষের দুর্দশা দূর করা : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম গ্রামের সাধারণ মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পান। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই হল ভারতের প্রাণ, গ্রামের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না। এজন্য তিনি গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লিমঙ্গল সাধনের উদ্যোগ নেন।
- কৃষির উন্নতি : রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন,গ্রামের মানুষের কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকার উন্নতি না হলে তাদের প্রকৃত উন্নতি হবে না। এজন্য গ্রামের কৃষিবিদ্যার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় পাঠান। পরে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকেও তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদেশে কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য পাঠান। রথীন্দ্রনাথ, তাঁর বন্ধু ও নগেন্দ্রনাথ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষবাস এবং বীজ, সার, সেচ প্রভৃতির ব্যবহার শুরু করেন।
- কুটিরশিল্পের বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের মধ্যে কুটিরশিল্পের প্রসারের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করেন। তিনি একজন তাঁতিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে সেখানকার দরিদ্র মানুষকে তাঁতের কাজ শিখতে উৎসাহিত করেন। এ ছাড়া মৃৎশিল্প-সহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানোর বিষয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করেন।
- শিক্ষার প্রসার : গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা দূর করার উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাঁর মতে, গ্রামের মানুষের সেবা করতে হলে তাদের সম্পর্কে আগে শিক্ষালাভ করতে হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
- সম্প্রীতির প্রসার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন। সম্ভাব্য সংঘাতের অনুমান করেও তিনি হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-চণ্ডা
লের বিভেদ দূর করে কর্মক্ষেত্রে প্রাণচঞ্চলতা নিয়ে আসার কথা বলেন। তিনি বলেন, “সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে।” এই সাহা ও শেখ কোনো বিশেষ সম্প্রদায় ছিল না। তারা হল আসলে ‘আমলা’ ও ‘চাষা’।
উপসংহার: কোনো শিক্ষাই মানুষকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তাই রবীন্দ্রনাথ সকল মানুষকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে এসে বিভিন্ন মানুষের মধ্যেকার বিরাট ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিলেন।
- যান্ত্রিক ব্যবস্থা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রদানের ঔপনিবেশিক স্কুল-ব্যবস্থা একটি কারখানার মতো। তিনি বলেছেন, “ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল, মাস্টার এই কারখানার অংশ—চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়।”
- নীরস বিষয় : ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় চার দেয়ালের ভেতর শিক্ষাগ্রহণ রবীন্দ্রনাথের কাছে নীরস ঠেকেছে। তাঁর মতে, এই ব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ আসলে নীরস পাঠ্যবস্তু গ্রহণ করে শুধুমাত্র ডিগ্রি অর্জন ছাড়া আর কিছু নয়।
- সীমিত সুযোগ : রবীন্দ্রনাথের মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ কম। কারণ, এই ব্যবস্থায় কেবল শহরের একটা শ্রেণির মানুষ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর ভারতের অবশিষ্ট জনমানব অশিক্ষার অন্ধকারেই থেকে যায়।
- প্রগতি বিরোধী পদ্ধতি: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক ছিল বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ। তাই এই ব্যবস্থা প্রগতিশীলতার বিরোধী। কেন না, রবীন্দ্রনাথের মতে, বিদেশি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারা আত্মস্থ করার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
- জ্ঞানার্জনের প্রতিবন্ধক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই শিক্ষার্থীর সহজাত জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে। তাই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান শিক্ষার্থীর স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বলে তিনি মনে করতেন।
- জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় মর্যাদাকে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যর ধার করা বিদ্যাকে অনুকরণ করাই যেন প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষা সমস্যা’, ‘শিক্ষার হেরফের’, ‘স্বদেশি সমাজ’, ‘তোতাকাহিনী’ প্রভৃতি রচনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার নানান ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে তার সমালোচনা করেছেন। তিনি ভারতের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি থেকে পৃথক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন। পরবর্তীকালে নিজ উদ্যোগে তিনি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
- বিশ্ববিদ্যার সাধনা: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যা সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, “বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। সাধারণভাবে বলা চলে সে সাধনা বিদ্যার সাধনা।” তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিদ্যা উদ্ভাবন, গৌণ উদ্দেশ্য হল বিদ্যা দান।
- শিক্ষার অবারিত দ্বার : রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। দেশবিদেশের সকল পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যা সাধনার সুযোগ পায়, রবীন্দ্রনাথ তা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন।
- পাঠক্রমের বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বৈচিত্র্য আনার পক্ষপাতী ছিলেন। এজন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভবন, চিনা ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণাকেন্দ্র, পল্লি শিক্ষাভবন প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন।
- মানবসত্তার বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা”
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ নিজে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা পোষণ করতেন যেখানে মুক্তচিন্তা, সত্যানুসন্ধান, স্বাধীনতা প্রভৃতির দ্বারা মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে। তাঁর এই ভাবনা বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছিল তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে।
- অনুগত প্রজা তৈরি: মেকলের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের অনুগত এক ভারতীয় প্রজাসম্প্রদায় তৈরি করা। উড-এর ডেসপ্যাচের মূল লক্ষ্য ছিল—পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষেরা আদতে ভারতীয় হলেও চিন্তাভাবনায় হবে পুরোদস্তুর ইংরেজ, যাদের ওপরে ভর করে এদের ঔপনিবেশিক শাসন স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারবে।
- প্রাণের ছোঁয়ার অভাব: ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এদেশের ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় ঘটলেও, সেই যোগাযোগে প্রাণের ছোঁয়া ছিল না। তা ছাড়া, ওই বিজ্ঞানশিক্ষার সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার এবং দর্শনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, প্রকৃত পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে।
- নান্দনিকতার অভাব: প্রশাসনিক কাজের উপযুক্ত কর্মচারী তৈরি করাই ছিল ইংরেজদের ভাষা শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। সাহিত্য বা ভাষাশিক্ষার সাহায্যে একটা নান্দনিক মন গড়ে তোলার কোনো আগ্রহই তাদের ছিল না। ‘বিদেশি ভাষায় ব্যাকরণ’ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলা ‘বর্ষণ’ ঔপনিবেশিক ভাষাশিক্ষাকে ব্যর্থ করে দেয়।
- দেশীয় ভাষার প্রতি বঞ্চনা: শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে ইংরেজিকেই বেছেছিলেন। শাসকের ভাষায়, শাসকের দৃষ্টিতে ভারতে ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান সবকিছু শেখানো হত বলে দেশীয় ভাষা সংস্কৃতির চর্চা কমে যাচ্ছিল। ফলে, শিক্ষা সর্বজনীন না হয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের জীবন-জীবিকার উপকরণ হয়ে উঠেছিল।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এক যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই শিক্ষাধারায় শিক্ষার্থীদের স্বাধীন কোনো চিন্তাভাবনার সুযোগ ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘কেরানিগিরির কল’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – D বিবিধ
অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর
- বিদ্যার সাধনা : রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিদ্যা উদ্ভাবন, গৌণ উদ্দেশ্য হল বিদ্যাদান। বিশিষ্ট শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার সাধনা ও বিদ্যার বিকাশ ঘটান। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্যার সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
- বিষয়ের বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে কলাবিদ্যার পাশাপাশি অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন এবং সমস্ত ব্যাবহারিক বিজ্ঞানের পাঠদান শুরু হয়। মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে এখানে হিন্দি ভবন, চিনা ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র, পল্লিশিক্ষা ভবন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- শিল্পকলার উন্নতি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলার উন্নতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলা শিক্ষা তার প্রধান অঙ্গ হবে এই আমাদের সংকল্প হোক।”
- খ্যাতনামা শিক্ষকগোষ্ঠী : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় চরম উৎকর্ষ আনার উদ্দেশ্যে দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পণ্ডিতকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে ইংরেজ যুবক কৃষিবিশেষজ্ঞ লেনার্ড এলমহার্স্ট, অ্যান্ড্রুজ, পিয়ারসন, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক সিলভা লেভি ও তাঁর স্ত্রী মাদাম লেভি এখানে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া জার্মান ঐতিহাসিক উইন্টারনিস, তাঁর ছাত্র লেসনি, ব্রিটিশ শিল্পবিশারদ স্টেলা ক্রামরিশ, ইহুদি বহুভাষাবিদ স্লোমিও ফ্লাউম প্রমুখ বিদেশি শিক্ষাবিদ এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন।
- আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন : বিভিন্ন কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দেশবিদেশের বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার সমন্বয়ে বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, কলাশাস্ত্র, পল্লিশিক্ষা, কৃষি-অর্থনৈতিক গবেষণা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে এখানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
উপসংহার: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা বাস্তবায়িত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরবর্তীকালে খ্যাতির শিখরে পৌঁছোন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অস্কারবিজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি প্রমুখ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।