WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 6 বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
WBBSE 10th Class Social Science Solutions History Chapter 6 বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
West Bengal Board 10th Class Social Science Solutions History Chapter 6 বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
West Bengal Board 10th History Solutions
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপঞ্জি
- গান্ধিজির নেতৃত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে উত্তেজিত জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করে ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারলে গান্ধিজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
- অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর জেলার বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, বীরভূমের জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশাহির সোমেশ্বর চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
- যুক্তপ্রদেশে (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) গৌরীশঙ্কর মিশ্র, ইন্দ্রনারায়ণ ত্রিবেদী প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কিষান সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবা রামচন্দ্র ছিলেন এই সভার প্রধান নেতা।
- অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুক্তপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি জেলায় ‘একা’ বা ‘একতা’ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর প্রধান নেতা ছিলেন মাদারি পাশি।
- গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলির কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে সত্যের পথে থেকে যে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন তা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। সেখানকার মেয়েরা তাঁকে ‘সর্দার’ উপাধি দেন। বারদৌলি সত্যাগ্রহে মিঠুবেন প্যাটেল, মণিবেন প্যাটেল, সারদা মেহতা, ভক্তি বাই প্রমুখ সক্রিয় নেতৃত্ব দেন।
- গান্ধিজি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল গুজরাটের ডান্ডিতে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরির মাধ্যমে লবণ আইন ভঙ্গ করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন।
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময় উত্তরপ্রদেশে রফি আহমেদ কিদোয়াই, কালিকা প্রসাদ, অঞ্জনি কুমার, কেরলে কেলাপ্পান, অন্ধ্রে বাল রামকৃয় প্রমুখ কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বিহারে কিষান সভা গঠনে নেতৃত্ব দেন স্বামী সহজানন্দ, যদুনন্দন শৰ্মা প্রমুখ।
- ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে লখনউ-এ স্থাপিত সর্বভারতীয় কিষান সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন স্বামী সহজানন্দ এবং প্রথম সম্পাদক ছিলেন এন জি রঙ্গ |
- গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ‘ভারত ছাড়ো’ বা ‘আগস্ট আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই আন্দোলনে গান্ধিজির স্লোগান ছিল ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’।
- বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, লিয়াকত হোসেন, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী প্রমুখ কংগ্রেস নেতার উদ্যোগে শ্রমিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শ্রমিক ধর্মঘট ও হরতাল পালনে নেতৃত্ব দেন প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, প্রেমতোষ বসু, অপূর্বকুমার ঘোষ, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বি পি ওয়াদিয়া, এন এম জোশী, জোসেফ ব্যাপ্তিস্তা, প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, সুরেন্দ্রনাথ হালরদার প্রমুখ শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ (AITUC) গঠিত হয়। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায়।
- শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বাংলায় কংগ্রেসের ভেতরে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এই দলের নাম হয় ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অব বেঙ্গল’।
- ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অব বেঙ্গল’-এর প্রথম সভাপতি ছিলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং যুগ্মসম্পাদক ছিলেন হেমন্তকুমার সরকার ও কুতুবউদ্দিন আহমদ। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন প্রদেশের শাখাগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘সারা ভারত ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ গঠিত হয়। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন আর এস নিম্বকার।
- ‘সারা ভারত ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’-র উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মুখপত্র ছিল নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘লাঙ্গল’, মুজাফফর আহমেদ সম্পাদিত ‘গণবাণী’, সন্তোষকুমারী গুপ্তা সম্পদিত ‘শ্রমিক’, এস এ ডাঙ্গে সম্পাদিত ‘সোশ্যালিস্ট’, সন্তোষ সিং সম্পাদিত ‘কীর্তি’, সিঙ্গারাভেল্লু চেট্টিয়ার সম্পাদিত ‘লেবার-কিষান গেজেট’ প্রভৃতি।
- ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মুজাফফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, মিরাজকর, পি সি জোশী, গঙ্গাধর অধিকারী, শিবনাথ ব্যানার্জি-সহ ৩৩ জন্য শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্ত করে।
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বি টি রণদিভে, সোমনাথ লাহিড়ি প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ‘রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি, মহম্মদ সাফিক প্রমুখের সহায়তায় মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতের বাইরে রাশিয়ার তাসখন্দে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের মাটিতে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, কানপুরে।
- মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন থেকে ‘ভানগার্ড অব ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স’ নামে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করে তা ডাকযোগে ভারতে পাঠাতেন।
- মানবেন্দ্রনাথ রায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘লিগ অব র্যাডিক্যাল কংগ্রেসমেন’ এবং কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- আচার্য নরেন্দ্র দেব ও জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি’ বা ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সম্পাদক ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ।
- সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দল গঠন করেন। এটি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে একটি পৃথক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
TOPIC – A কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়: কংগ্রেস নেতাদের উদ্যোগের অভাবে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের সময় কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি। ড. সুমিত সরকার বলেছেন যে, ‘সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির অভাবে এই আন্দোলনে কৃষকদের যুক্ত করা যায়নি। তা ছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকরা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল।
- অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময়: অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২ খ্রি.) সময় গান্ধিজির ডাকে সারা দেশের বহু কৃষক এই আন্দোলনে শামিল হয়।
- বাংলা: বাংলার মেদিনীপুর, পাবনা, কুমিল্লা, রাজশাহি, বগুড়া, রংপুর, বীরভূম, দিনাজপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলার বহু কৃষক আন্দোলনে অংশ নেয়।
- বিহার: বিহারের ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, দ্বারভাঙ্গা, মধুবনী, সীতামারি প্রভৃতি জেলার কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে।
- যুক্তপ্ৰদেশ: যুক্তপ্রদেশে (বর্তমান উত্তরপ্রদেশে) বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ রাজ্যের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি জেলার কৃষকরা একতাবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে শামিল হয় যা একা আন্দোলন নামে পরিচিত।
- অন্যান্য প্রদেশ: অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার কৃষকরা, পাঞ্জাবের অকালী শিখ ও জাঠ কৃষকরা, উড়িষ্যার কিছু কিছু অঞ্চলের কৃষকরা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তীকালে কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল গুজরাটের দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে বারদৌলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮ খ্রি.) করেন।
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময়: আইন অমান্য আন্দোলনেও (১৯৩০-৩৪ খ্রিস্টাব্দে) বিভিন্ন প্রদেশের কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
- উত্তরপ্রদেশ: রায়বেরিলি, আগ্রা, বারাবাঁকি, লখনউ, প্রতাপগড়-সহ উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে এখানে আইন অমান্য আন্দোলন প্রকৃত গণ আন্দোলনে পরিণত হয়।
- বিহার: স্বামী সহজানন্দ, যদুনন্দন শৰ্মা প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত কিষান সভা বিহারে কৃষকদের আন্দোলনে শামিল করে।
- বাংলা: বাংলার কাঁথি, মহিষাদল, আরামবাগ, শ্রীহট্ট প্রভৃতি স্থানে কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দেয়।
- গুজরাট: গুজরাটের সুরাট, বারদৌলি, খেদা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যায়।
- অন্যান্য প্রদেশে: কেরলর কেলাপ্পান এবং অন্ধ্রে বাল রামকৃয় কৃষকদের খাজনা বন্ধে উৎসাহিত করেন। মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, পাঞ্জাবেও সেচকর ও রাজস্ব কমানোর দাবিতে কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দেয়।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরাও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
- বিহার: বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের আদিবাসী কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দেয়। বিহারের ৮০ শতাংশ থানাই আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়।
- বাংলা: বাংলার মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমা, পটাশপুর থানা, খেজুরী থানা, দিনাজপুরের বালুরঘাট প্রভৃতি এলাকায় আন্দোলনরত কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
- গুজরাট: গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ, ব্রোচ প্রভৃতি জেলায় কৃষকরা গেরিলা আক্রমণ চালায়।
- উড়িষ্যা: উড়িষ্যার তালচেরে আন্দোলনকারী কৃষকরা চাষি মল্লা- রাজ প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে।
উপসংহার: বিশ শতকে কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হলেও ভারতের সর্বত্র কৃষকদের এই আন্দোলনে শামিল করা যায়নি। কোনো কোনো কংগ্রেস নেতা কৃষকদের খাজনা বন্ধের আন্দোলনে শামিল করে জমিদারদের ক্ষিপ্ত করতে চাননি। কেন না, জমিদাররা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থক ছিল। বহু ক্ষেত্রে মুসলিম কৃষকরা কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।
- বাংলা : অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র বাংলার মেদিনীপুর জেলার বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং খাজনা বন্ধের ডাক দেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত কৃষক ব্রিটিশ দমননীতি উপেক্ষা করে অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হয়। এ ছাড়া বাংলার পাবনা, রংপুর, কুমিল্লা, দক্ষিণ দিনাজপুর, বীরভূম প্রভৃতি স্থানেও কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
- বিহার : বিহারের কৃষকদের মধ্যেও অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। সেখানকার জমিদার শ্রেণি কৃষকদের ওপর খাজনা বৃদ্ধি করে এবং খাজনা প্রদানে অক্ষম ব্যক্তির ওপর চরম অত্যাচার চালায়। এর প্রতিবাদে বিহারের কৃষক শ্রেণি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন বিহারের মুঙ্গের, পূর্নিয়া, ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
- রাজস্থান : অসহযোগ আন্দোলনের যুগে পশ্চিম ভারতের রাজস্থানে কৃষকবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই অঞ্চলে বিজয় সিং পথিক ও মানিক লাল ভার্মার নেতৃত্বে সংঘটিত বিজোরিয়াতে সামন্ততন্ত্র বিরোধী কৃষকবিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলনে কৃষকদের প্রধান দাবি ছিল জমির ওপর কৃষকদের পূর্ণ অধিকার প্রদান করা।
- যুক্তপ্রদেশ : অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষকবিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল যুক্তপ্রদেশ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মদনমোহন মালব্য যুক্তপ্রদেশের এলাহাবাদে কিষান সভা গঠন করে। এই সভার প্রধান কর্মসূচি ছিল—[i] কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, [ii] শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, [iii] কৃষকদের স্বার্থ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করা। যুক্তপ্রদেশের এলাহাবাদ, প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, ফৈজাবাদ, অযোধ্যা প্রভৃতি স্থানে কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে অযোধ্যার বরদৈ তালুকে মাদারি পাসির নেতৃত্বে সংঘটিত এক আন্দোলন (১৯২১-২২ খ্রি.) ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ও বামপন্থী আন্দোলন: বেশিষ্ট্য ও পবা
- অন্ধ্ৰপ্ৰদেশ : অসহযোগ আন্দোলনের কালে দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলায় ব্যাপক কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শুরু পর্যন্ত এখানকার কৃষকরা সরকারকে খাজনা বন্ধের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের মে পর্যন্ত আধা-উপজাতি রাম্পা কৃষকরা আন্দোলন করে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় সীতারাম রাজু।
- গুজরাট : অসহযোগ আন্দোলনের সময় গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুকে বিশিষ্ট গান্ধিবাদী নেতা বল্লভভাই প্যাটেল খাজনা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন যা বারদৌলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮ থ্রি.) নামে পরিচিত। আন্দোলনে কৃষকরা তাৎক্ষণিক সাফল্যও পায়। সেখানকার আন্দোলনকারী মহিলারা বল্লভভাই প্যাটেলকে ‘সর্দার’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
- কেরল : কেরলের মালাবার উপকূলের মুসলিম কৃষকদের মোপলা বলা হত। এই অঞ্চলে রাজস্বের হার খুবই বেশি ছিল। সেইসঙ্গে এখানকার জেনমি বা জমিদারেরা মুসলিম কৃষকদের ওপর ব্যাপক শোষণ-অত্যাচার চালাত। এর প্রতিবাদে মোপলা কৃষকরা স্থানীয় জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অবশ্য এই বিদ্রোহে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার আভাস পেয়েছেন।
উপসংহার: অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভারতের কৃষকরা গান্ধিজির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। ফলে ভারতের নানা প্রান্তে কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু মানুষ গান্ধিজিকে দেবতা রূপে পুজো করতে শুরু করে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, গ্রামের অত্যাচারী জমিদার ও মহাজন শ্রেণির মানুষের হাত থেকে গান্ধিজি তাদের রক্ষা করবে।
- ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রথম শ্রেণির নেতাদের সঙ্গে আলাপ- আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে (২৯ মার্চ) ভারতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বাধীন এই প্রতিনিধি দল বা ‘ক্রিপস মিশন’ জানায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ বা স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু গান্ধিজি পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। তিনি এই প্রস্তাবটিকে “ফেল পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী তারিখের চেক” বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
- গান্ধিজির ভূমিকা : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গান্ধিজি স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, এটিই ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আদর্শ সময়। এজন্য তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘Do or Die’-এর ডাক দেন।
- ভারতের দিকে জাপানের অগ্রগতি : ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। তাই জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর মিত্রজোটকে পরাজিত করে ভারতের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভব করেন।
- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের জন্য ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ খাবার পাঠানো হতে থাকে। এর ফলে ভারতে খাদ্যদ্রব্য-সহ অন্যান্য পণ্যের মূল্যও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। মূল্যবৃদ্ধি ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে।
- সেনাদের ওপর অত্যাচার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যদের দূরদেশে বিপদসংকুল যুদ্ধক্ষেত্রগুলিতে পাঠানো হয় । নিয়মিত বেতন না পাওয়া, এই পদে কর্মরত শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদের চেয়ে কম বেতন পাওয়া, অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ, শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার প্রভৃতি ছিল ভারতীয় সেনাদের নিত্যসঙ্গী। বহু ভারতীয় সৈন্যের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের কখনও পদোন্নতি বা উচ্চপদে নিয়োগের সুযোগ ছিল না। এইসব ঘটনা ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করেছিল।
- কৃষকশ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ : বাংলা, বিহার, আসাম ও উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা ছিল ভূমিহীন, দরিদ্র ও খেত-মজুর। তাদের ওপর করের বোঝা, উৎপন্ন ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া প্রভৃতি ঘটনা তাদের ক্ষুব্ধ করে এবং আন্দোলনে উৎসাহ জোগায়।
- শ্রমিকশ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে ভারতের শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়। কিন্তু মালিকশ্রেণি তাদের মজুরি বৃদ্ধি করেনি। বরং যুদ্ধের ডামাডোলে শিল্পপণ্য বিক্রি ব্যাহত হলে কলকারখানাগুলি থেকে বহু শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। ফলে ক্ষুব্ধ শ্রমিকশ্রেণি আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
- আন্দোলনের ব্যাপ্তি : সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সকলের যোগদানের ফলে এটি প্রকৃত অর্থে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে সম্পাদিত “The Indian Nation in 1942’ গ্রন্থে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে।
- স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন : ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য তারা সব ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা—এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। ড. অম্বাপ্রসাদ বলেছেন, “১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে।”
- ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি : ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রমাণ করে যে, মুক্তিসংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। বড়োেলাট লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন, “ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়েছে। পুনরায় এই ধরনের একটি আন্দোলন হলে তা মোকাবিলা করার শক্তি সরকারের নেই।”
- কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি : ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ৪২-এর আন্দোলন হল চূড়ান্ত পর্যায়। কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব আরও ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার : মুসলিম লিগ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলেও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর- সহ বহু স্থানের মুসলমানগণ এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং আন্দোলনে নানাভাবে সহায়তা করে। ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য যে, এইসময় কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি।
উপসংহার: ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল এক ব্যাপক আন্দোলন। এই আন্দোলনকে সামনে রেখে দেশপ্রেমিক ভারতবাসী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বড়োলাট লিনলিথগো বলেছেন, “১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে এত বড়ো বিদ্রোহ আর হয়নি।” এই আন্দোলন ১৯৪৭ –এর স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- রাজস্ব বৃদ্ধি: দেশের দরিদ্র কৃষকদের ওপর সরকার বারবার রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়।
- জমিদার ও তালুকদারদের শোষণ: সরকারের ঘনিষ্ঠ জমিদার ও তালুকদাররা কৃষকদের ওপর বিভিন্নভাবে শোষণ ও অত্যাচার চালায়।
- স্বাধীনতার স্বপ্ন: কৃষকরা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেছিল।
উপসংহার: বিংশ শতকের কৃষক আন্দোলনগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। এসব আন্দোলনে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস-সহ বামপন্থী দলগুলি চেষ্টা চালায়।
- কংগ্রেসের ভূমিকা: কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের শামিল করার বা খাজনা প্রদান বন্ধে কৃষকদের উৎসাহিত করার বিশেষ উদ্যোগ নেয়নি। অরবিন্দ ঘোষ আশঙ্কা করেন যে, কৃষকরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করলে দেশপ্রেমিক জমিদাররা ক্ষুব্ধ হবেন। এজন্য ড. সুমিত সরকার বলেছেন যে, ‘সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির অভাবে এই আন্দোলনে কৃষকদের যুক্ত করা যায়নি।’
- বাংলায় কৃষক আন্দোলন: কংগ্রেস উদ্যোগ না নিলেও বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে বাংলার কৃষকরা স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে সীমিতভাবে শামিল হয়। বহু কৃষক পরিবারে বিলাতি পণ্য বর্জন করা হয়। কৃষক পরিবারের রান্নাঘরে বিলাতি চিনি, লবণ প্রভৃতির ব্যবহার বন্ধ হয়।
- মুসলিম কৃষকদের ভূমিকা: বাংলার হিন্দু কৃষকদের একাংশ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলেও পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকরা আন্দোলনে যোগ না দিয়ে বরং বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল। কারণ তারা মনে করেছিল যে, পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকদের কাছে বঙ্গভঙ্গ মঙ্গলজনক।
- দলিত কৃষকদের ভূমিকা: পূর্ববঙ্গের হিন্দু দলিত কৃষকশ্রেণি, বিশেষ করে নমঃশূদ্র কৃষকরা রাজেন্দ্রলাল মণ্ডলের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল।
উপসংহার: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা ছিল সীমিত। তথাপি কংগ্রেসের সহযোগিতা ছাড়াই বেশ কিছু অঞ্চলে কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রশংসার দাবি রাখে।
- উপযুক্ত কর্মসূচীর অভাব: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অভিভাবক জাতীয় কংগ্রেস উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করে আন্দোলনে কৃষকদের শামিল করার চেষ্টা করেনি। অধ্যাপক ড. সুমিত সরকারের মতে, ‘সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি’র অভাবে এই আন্দোলনে কৃষকদের যুক্ত করা যায়নি।
- জমিদার ঘেঁষা নীতি : বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেস দেশপ্রেমিক জমিদারদের সহযোগিতা লাভের আশা করত। এজন্য তারা কৃষক আন্দোলনকে উসকে দিয়ে জমিদারদের ক্ষুব্ধ করতে চায়নি। অরবিন্দ ঘোষ আশঙ্কা করেন যে, কৃষকরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করলে দেশপ্রেমিক জমিদাররা ক্ষুব্ধ হবেন। ফলে কংগ্রেস নেতৃত্ব কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেননি।
- উচ্চবর্ণের নেতৃত্ব: ড. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাই ছিলেন উচ্চজাতিভুক্ত হিন্দু জমিদার। তারা তৃণমূল স্তরে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হন। অধ্যাপক সুমিত সরকারও কৃষকশ্রেণিকে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের শরিক করে নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন।
- নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা : কৃষিপ্রধান ভারতের যে-কোনো গণ আন্দোলনের মূলভিত্তি হল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকশ্রেণির অংশগ্রহণ। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অদূরদর্শী হওয়ায় তারা এই চরম সত্যটিকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন এবং কৃষকদের আন্দোলনে আকৃষ্ট করা থেকে বিরত থাকেন।
- আগ্রহের অভাব : বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন ভদ্রলোক শ্রেণি ও কৃষকশ্রেণির মধ্যে বিরাট ফারাক তৈরি করে। ফলে সাধারণ কৃষকরা তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণির নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়নি।
উপসংহার: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি সক্রিয় ও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ না করায় আন্দোলন কিছুটা হলেও দুর্বল হয়। অধ্যাপক সুমিত সরকারও বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের স্থায়িত্বের অভাব ও ব্যর্থতার জন্য কৃষকশ্রেণির অনাগ্রহকে দায়ী করেছেন।
- পূর্ববঙ্গ : বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে পূর্ববঙ্গের দরিদ্র মুসলিম কৃষকরা জমিদারের অতিরিক্ত শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে। ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মুসলিম কৃষকদের আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।
- পাঞ্জাব : লর্ড মিন্টোর শোষণমূলক আইনের প্রতিবাদে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের কিছু এলাকায় কৃষকরা আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। এখানকার শিক্ষিত কৃষকশ্রেণি অন্যান্য কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কাজে বিশেষ ভূমিকা নেয়। লালা লাজপত রায়, অজিত সিংহ প্রমুখও কৃষকদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেন।
- বিহার : বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়কালে বিহারের চম্পারণ জেলার মতিহারিবেতিয়া অঞ্চলে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা অনুসারে সরকার কৃষকদের জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করলে কৃষকরা সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে নামে।
- মেবার: মেবারের উদয়পুর অঞ্চলের ‘বিজোলিয়া’ নামে জমিদারি এলাকার কৃষকদের ওপর প্রায় ৮৫ ধরনের কর ও উপকর চাপানো হয়। এর প্রতিবাদে এখানকার অগণিত কৃষক উদয়পুরের মহারানার বিরুদ্ধে কর বন্ধের আন্দোলন শুরু করে। এতে নেতৃত্ব দেন সীতারাম দাস নামে জনৈক সাধু।
উপসংহার: বঙ্গবঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় কৃষক সমাজের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বিচ্ছিন্নভাবে তাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে। কিন্তু কংগ্রেসের সহযোগিতার অভাবে, আবার কোথাও সাম্প্রদায়িক কারণে কৃষকদের এই আন্দোলন ব্যাপক ও সর্বভারতীয় চরিত্র লাভ করতে পারেনি।
- বাংলা: বাংলার মেদিনীপুর, পাবনা, কুমিল্লা, রাজশাহি, বগুড়া, রংপুর, বীরভূম, দিনাজপুর ও বাঁকুড়া জেলার কৃষকরা কংগ্রেসের অসহযোগ ও বয়কট আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে। মেদিনীপুরে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, রাজশাহিতে সোমেশ্বর চৌধুরী, বীরভূমে জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- বিহার: বিহারের ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, দ্বারভাঙ্গা, মধুবনী, সীতামারি জেলার কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
- যুক্তপ্রদেশ
- কিষান সভার উদ্যোগ: যুক্তপ্রদেশে (উত্তরপ্রদেশ) বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কিষান সভা (১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে) রায়বেরিলি, প্রতাপগড়, সুলতানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনকে চরম রূপ দেয়।
- একা আন্দোলন: ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি জেলায় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে শামিল হয় যা একা আন্দোলন নামে পরিচিত।
- চৌরিচৌরার ঘটনা: ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে (৫ ফেব্রুয়ারি) উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে উত্তেজিত কৃষকরা থানায় আগুন লাগিয়ে ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারে।
- অন্যান্য রাজ্যে : অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার কৃষকরা, পাঞ্জাবের অকালী শিখ ও জাঠ কৃষকরা, উড়িষ্যার কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
- অসহযোগ আন্দোলনের পর: গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহ করে নিলেও বিভিন্ন স্থানে কৃষক আন্দোলন চলতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বারদৌলি সত্যাগ্রহ। কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল গুজরাটের দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন সংগঠিত করেন।
উপসংহার: অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হলে অসহযোগ আন্দোলন প্রকৃত অর্থে সর্বভারতীয় চরিত্র লাভ করে। তবে যেসব স্থানে কৃষকদের আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয় সেগুলিকে মহাত্মা গান্ধি সমর্থন করেননি।
- কংগ্রেসের আন্দোলন: কংগ্রেস নেতারা ‘স্বরাজ’ বা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে বাংলার বহু কৃষক এই আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়।
- আন্দোলনের প্রসার: অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকবিদ্রোহের প্রসার ঘটে। মেদিনীপুর, পাবনা, বগুড়া, বীরভূম, রাজশাহি, রংপুর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায় কৃষকরা কংগ্রেসের অসহযোগ ও বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।
- মেদিনীপুর: মেদিনীপুরে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, স্বচ্ছল প্রভৃতি সর্বস্তরের কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদারদের খাজনা ও চৌকিদারি কর দেওয়া বন্ধ করে।
- বীরভূম: বীরভূম জেলার জিতেন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে।
- পূর্ববঙ্গ: খিলাফত আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার মুসলিম কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা জমিদার-জোতদারদের সামাজিক বয়কট শুরু করে। রাজশাহি জেলায় সোমেশ্বর চৌধুরীর নেতৃত্বে কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়।
উপসংহারঃ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠলে তা অসহযোগ আন্দোলনেরও শক্তি বৃদ্ধি করে। কৃষক আন্দোলনের এইরকম সংঘটিত রূপ এর আগে দেখা যায়নি।
- ‘একা’ নামকরণ: ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষ ও ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে কৃষক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারী কৃষকরা একতাবদ্ধ থাকার শপথ নেওয়ায় এই আন্দোলনের নাম হয় ‘একা’ বা ‘একতা’ আন্দোলন।
- নেতৃত্ব: একা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মাদারি পাশি ও বাবা গরিবদাস। এই আন্দোলন উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অযোধ্যা অঞ্চলের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
- কারণ: একা আন্দোলনের প্রধান কারণগুলি ছিল—[i] কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ নতুন কর আরোপ, [ii] কর আদায়ে চরম অত্যাচার, [iii] প্রভুর জমি ও খামারে কৃষককে বিনা বেতনে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা প্রভৃতি।
- শপথ: আন্দোলনকারীরা শপথ গ্রহণ করে যে, তারা—[i] অতিরিক্ত কর দেবে না, [ii] বেগার শ্রম দেবে না, [iii] অপরাধীদের সাহায্য করবে না, [iv] জমি থেকে উৎখাত করলেও তারা জমি ছেড়ে যাবে না, [v] তারা পঞ্চায়েতের যাবতীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।
- কংগ্রেসের ভূমিকা: প্রথমদিকে কংগ্রেস একা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালেও কিছুকাল পর এই আন্দোলনে হিংসার প্রবেশ ঘটলে কংগ্রেস ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়।
উপসংহার: একা আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে কংগ্রেস ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ সরে গেলে আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ওপর তীব্র সরকারি দমননীতির ফলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস নাগাদ এই আন্দোলন থেমে যায়।
- কৃষকদের অবস্থা: বারদৌলি তালুকের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ছিল নিম্নবর্ণের কালিপরাজ সম্প্রদায়ভুক্ত। সীমাহীন দারিদ্র্য, সামাজিক অবজ্ঞা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
- আন্দোলনের কারণ: ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর বন্যায় বারদৌলি অঞ্চলের প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। কৃষকরা দুর্ভিক্ষের শিকার হওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদের ওপর প্রথমে ৩০ শতাংশ এবং পরে তা কমিয়ে প্রায় ২২ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করে। ফলে কৃষকরা বিদ্রোহী হয়।
- প্যাটেলের নেতৃত্ব: বারদৌলি সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কৃষকরা গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি এখানে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। বারদৌলির কৃষক-রমণীরা তাঁকে ‘সর্দার’ উপাধি দেন।
- অন্যান্য নেতৃত্ব: আন্দোলনে নরহরি পারিখ, রবিশংকর ব্যাস, মোহনলাল পান্ডে প্রমুখ সর্দার প্যাটেলকে সহযোগিতা করেন। মিঠুবেন প্যাটেল, মণিবেন প্যাটেল, সারদা মেহতা, ভক্তি বাই প্রমুখ নারী এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
- প্রভাব: আন্দোলনের সমর্থনে বোম্বাই বিধানসভার সদস্য কে এম মুনশি ও লালজি নারাণজি পদত্যাগ করেন। গান্ধিজিও বারদৌলিতে এসে আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কথা ঘোষণা করেন। শেষপর্যন্ত সরকার নিযুক্ত এক কমিটি ৬.০৩ শতাংশ খাজনা বৃদ্ধি অনুমোদন করলে কৃষকরা তা দিতে রাজি হয়।
উপসংহার: বারদৌলির কৃষকদের শক্তিশালী আন্দোলনে শেষপর্যন্ত ইংরেজ সরকার হার মানতে বাধ্য হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার শেষপর্যন্ত ‘ব্লুমফিল্ড-ম্যাক্সওয়েল তদন্ত কমিটি’ গঠন করে বর্ধিত রাজস্বের হার কমাতে বাধ্য হয়।
- কারণ: আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার পিছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলি ছিল—–[i] দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, বিশ্ব-অর্থনীতিতে মহামন্দা প্রভৃতির ফলে ভারতীয় অর্থনীতির দুর্দশা, [ii] সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার, [iii] বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সক্রিয়তা, [iv] ব্রিটিশ বাণিজ্যনীতির ফলে ভারতীয় বাণিজ্যের ক্ষতি প্রভৃতি।
- আন্দোলনের সূচনা: গান্ধিজি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ ৭৮ জন অনুগামী নিয়ে সমুদ্রের উপকূলে গুজরাটের ডান্ডি নামক স্থানে লবণ আইন অমান্য ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ৬ এপ্রিল সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করে সরকারি আইন ভঙ্গের মাধ্যমে তিনি এই আন্দোলনের সূচনা করেন।
- আন্দোলনের প্রসার: আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তা শীঘ্রই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, গুজরাট, বোম্বাই, মাদ্রাজ, কর্ণাটক প্রভৃতি অঞ্চলে প্রসার লাভ করে।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গান্ধিবাদী নেতা খান আবদুল গফ্ফর খান (সীমান্ত গান্ধি)-এর নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।
- ব্যর্থতা: ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকারের বিভেদনীতি, ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা, বর্ণহিন্দু ও দলিত হিন্দুদের মধ্যে বিরোধ প্রভৃতির ফলে এই আন্দোলন দুর্বল হতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত কংগ্রেস ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে (৮ মে) আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।
উপসংহার: আইন অমান্য আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সংগ্রাম একেবারে থেমে যায়নি। পরবর্তীকালে ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এর চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা গিয়েছিল।
- উত্তরপ্রদেশ: রায়বেরিলি, আগ্রা, বারাবাঁকি, লখনউ, প্রতাপগড়-সহ উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে এখানে আইন অমান্য আন্দোলন প্রকৃত গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। উত্তরপ্রদেশে আন্দোলনরত কৃষকরা সরকার, জমিদার ও তালুকদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। রফি আহমেদ কিদোয়াই, কালিকা প্রসাদ, অঞ্জনি কুমার প্রমুখ এখানকার কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- বিহার: আইন অমান্য আন্দোলনের প্রভাবে স্বামী সহজানন্দ, যদুনন্দন শৰ্মা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বিহারে কিষান সভা গঠন করেন। বিহারে কৃষক আন্দোলন মূলত অহিংস পথে চললেও মুঙ্গের ও মুজফ্ফরপুর থানা আক্রমণের মতো সহিংস ঘটনাও ঘটে।
- বাংলা: জোতদারদের বিরুদ্ধে বাংলার মেদিনীপুর জেলার কাঁথি ও মহিষাদলে কৃষকরা আন্দোলনে অংশ নেয়। এ ছাড়া আরামবাগ, শ্রীহট্ট প্রভৃতি স্থানেও কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
- গুজরাট: গুজরাটের সুরাট, বারদৌলি, খেদা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যায়। পুলিশের অত্যাচার সত্ত্বেও বহু স্থানে কৃষকরা অন্তত ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খাজনা দেওয়া বন্ধ রাখে।
- অন্যান্য প্রদেশ: অন্যান্য প্রদেশেও কৃষকরা আন্দোলনে শামিল হয়। [i] কংগ্রেস নেতা কেলাপ্পান কেরলে কৃষকদের নিয়ে সত্যাগ্রহ চালান। [ii] অন্ধ্রপ্রদেশে বাল রামকৃষ্ণের নেতৃত্বে কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। [iii] পাঞ্জাবে জলসেচ কর ও রাজস্ব হ্রাসের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলন চালায়। [iv] মধ্যপ্রদেশ ও কর্ণাটকের কৃষকরাও খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
উপসংহার: আইন অমান্য আন্দোলন থেমে যাওয়ার পরও কৃষক আন্দোলন ধীরগতিতে চলতে থাকে। এই পর্বে বামপন্থী ও কমিউনিস্টরা কৃষকদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।
- গণ আন্দোলন: উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি, আগ্রা, বারাবাঁকি, লখনউ, প্রতাপগড়-সহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং এই আন্দোলন প্রকৃত গণ আন্দোলনের রূপ নেয়।
- খাজনা প্রদান বন্ধ: উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে সরকার, এমনকি জমিদার এবং তালুকদারদেরও খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পুলিশি নির্যাতন সত্ত্বেও তারা খাজনা দিতে রাজি হয়নি।
- নেতৃত্ব: উত্তরপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন রফি আহমেদ কিদোয়াই, কালিকা প্রসাদ, অঞ্জনি কুমার প্রমুখ।
- কংগ্রেসের উদ্যোগ: কংগ্রেস দল প্রথম থেকেই উত্তরপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কৃষকদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
- বামপন্থীদের উদ্যোগ: কমিউনিস্ট এবং সমাজতন্ত্রীরাও কৃষকদের আন্দোলনে যুক্ত হয়। গান্ধিজি কৃষকদের কিছু খাজনা দেওয়ার কথা বললেও বামপন্থীরা তাতে রাজি হয়নি।
উপসংহার: উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের আইন অমান্য আন্দোলন জনমনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছোয় যে, কৃষকদের সমর্থন ছাড়া এখানে কোনো আন্দোলন গড়ে উঠতে পারত না।
- নেতৃত্ব: আইন অমান্য আন্দোলনের পরবর্তীকালে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পি সি জোশী, অজয় ঘোষ, রাম মনোহর লোহিয়া, জয় প্রকাশ নারায়ণ, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, বঙ্কিম মুখার্জি, মোহন সিং প্রমুখ।
- কিষান সভার ভূমিকা: এই সময়ের কৃষক আন্দোলনে কিষান সভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে লখনউতে সর্বভারতীয় কিষান সভা স্থাপিত হয়। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন বিহারের স্বামী সহজানন্দ এবং প্রথম সম্পাদক ছিলেন উত্তরপ্রদেশের এন জি রঙ্গ। এর প্রথম অধিবেশনে জওহরলাল নেহরু উপস্থিত ছিলেন।
- কৃষক-কল্যাণমূলক আইন: কৃষক আন্দোলনের চাপে বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেসি মন্ত্রীসভাগুলি কৃষকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি আইন পাস করে।
- পদযাত্রা: অন্ধ্রপ্রদেশের কিষান সভার উদ্যোগে প্রায় ২ হাজার কৃষক ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ১৩০ দিন ধরে প্রায় ১৫০০ মাইল পদযাত্রা করে কৃষকদের দুর্দশার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে কৃষক আন্দোলন আবার গতিশীল হয়ে ওঠে।
উপসংহার: আইন অমান্য আন্দোলনের পরবর্তীকালে বিভিন্ন বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নেতাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানের কৃষক আন্দোলনগুলি চলতে থাকে। পরবর্তীকালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক আন্দোলন পুনরায় অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
- প্রেক্ষাপট: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি যুক্ত হয়ে পড়ে। তাদের সংগঠিত করে কৃষক আন্দোলন জোরদার করার উদ্দেশ্যে এই সময় জাতীয়তাবাদী, বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
- এন জি রঙ্গ প্রমুখের উদ্যোগ: প্রথমে এন জি রঙ্গ এবং ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ কিষান সভা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তাঁরা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতীয় কৃষক ও কৃষিশ্রমিক যুগ্ম সংস্থা নামককৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
- কিষান সভা প্রতিষ্ঠা: এরপর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উত্তরপ্রদেশের লখনউ শহরে এর প্রথম অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিহারের কৃষক নেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী।
- লক্ষ্য: কিষান সভার প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল –[i] জমিদারি ও মহাজনি প্রথার বিলোপ, [ii] ভূমিরাজস্ব ও খাজনার পরিমাণ হ্রাস, [iii] বেগার প্রথার অবসান, [iv] সেচব্যবস্থার উন্নতি, [v] বনজ সম্পদ সংগ্রহের চিরাচরিত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, [vi] জাতীয় আন্দোলনে কৃষকদের শামিল করা প্রভৃতি।
- গুরুত্ব: নিখিল ভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠার ফলে [i] কৃষকশ্রেণির ওপর শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকরা সচেতন হয়ে ওঠে। [ii] ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃষকরা আরও বেশি সংখ্যায় যোগ দিতে থাকে।
উপসংহার: কিষান সভা ব্রিটিশবিরোধী কৃষক আন্দোলনের এক প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে দেয়। রুশ ঐতিহাসিক জি. কাতোভস্কি নিখিল ভারত কিষান সভার প্রতিষ্ঠাকে ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা বলেউল্লেখ করেছেন।
- আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ; জাতীয় কংগ্রেস ৭ আগস্ট বোম্বাইঅধিবেশনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরের দিনই জাতীয় স্তরের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে।
- গণ আন্দোলন: নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের পর দেশবাসী শীর্ষ নেতাদের ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাংলা, বিহার,উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ, আসাম ইত্যাদি রাজ্যের কৃষক, নারী, ছাত্র প্রভৃতি সর্বস্তরের ভারতবাসী এই আন্দোলনে শামিল হয়। ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শীঘ্রই গণ আন্দোলনে পরিণত হয়।
- আন্দোলনের ব্যাপকতা: আন্দোলনকারীরা সরকারি দমননীতি উপেক্ষা করে বিলাতি পণ্য ও ব্রিটিশ স্কুলকলেজ বর্জন, মিছিল-মিটিং, বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা, রেল-টেলিগ্রাফ-টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, থানা আক্রমণ প্রভৃতি কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
- বাংলায় আন্দোলন: বাংলায় মেদিনীপুরের তমলুক, কাঁথি, পটাশপুর, খেজুরী, বালুরঘাট প্রভৃতি স্থানে ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রবল আকার নেয়। তমলুকে ব্রিটিশ সরকারের বিকল্প তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সতীশচন্দ্র সামন্ত ছিলেন এই সরকারের প্রধান। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায় ও সুশীলচন্দ্র ধাড়া। মেদিনীপুরের ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান।
- জাতীয় নেতৃবৃন্দ: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিভিন্ন নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, নরেন্দ্র দেব, যোগেশ চ্যাটার্জি, অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনি, ঊষা মেটা, অচ্যুৎ পট্টবর্ধন প্রমুখ।
উপসংহার: ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত জাতিধর্মনির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রকৃত গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন—“বিয়াল্লিশের বিদ্রোহ ছিল মূলত সৈনিকের যুদ্ধ। তাঁরা স্বাধীনতার শহীদের মতো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।”
- উদ্দেশ্য: জমিদার ও অবস্থাপন্ন কৃষকরা কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে এবং জাতীয়তাবাদী লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। নিম্নবর্ণের দরিদ্র কৃষকরা স্বপ্ন দেখেছিল যে, তাদের আন্দোলন সফল হলে দেশে স্বাধীনতা আসবে এবং দরিদ্র কৃষকদের দুর্দশা দূর হবে।
- বিহারে আন্দোলন: বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের আদিবাসী কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দেয়। বিহারের ৮০ শতাংশ থানাই আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়। বিহারের দ্বারভাঙ্গার জমিদার আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার সরকারি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি বন্দি কৃষকদের মুক্তির জন্যও তিনি উদ্যোগ নেন।
- বাংলায় আন্দোলন: বাংলার মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমা, পটাশপুর থানা, খেজুরী থানা, দিনাজপুরের বালুরঘাট প্রভৃতি এলাকায় আন্দোলনরত কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
- গুজরাটে আন্দোলন: গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ, ব্রোচ প্রভৃতি জেলায় কৃষকরা গেরিলা আক্রমণ চালায়। সুরাটে কৃষকরা রেলপথ অবরোধ করে, রেল-যোগাযোগ ছিন্ন করে এবং সরকারি নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়।
- উড়িষ্যায় আন্দোলন: উড়িষ্যার তালচেরে আন্দোলনকারী কৃষকরা চাষি মল্লা-রাজ প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে।
উপসংহার: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সারা ভারতে সংগঠিত কৃষক আন্দোলনগুলি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে। এই সময় জমিদারদের বিরোধিতা নয়, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতাই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
- লক্ষ্য: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদানকারী বাংলার কৃষকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল—[i] ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভ। [ii] শোষণমুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটানো।
- আন্দোলনের প্রসার: বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমা, পটাশপুর থানা, খেজুরী থানা, দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট প্রভৃতি এলাকার কৃষকরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ও জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
- আন্দোলনকারী কৃষক: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলার রাজবংশী, আদিবাসী, নমঃশূদ্র প্রভৃতি সম্প্রদায়ের চাষিরা আন্তরিকভাবে শামিল হয়। তবে পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকদের একটি বড়ো অংশ আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। কেন না, তারা সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে নিজেদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের চিহ্নিত করেছিল।
- কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা: কমিউনিস্ট পার্টি ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে কৃষকদের দূরে সরে থাকার নির্দেশ দেয়। তবে পার্টির নির্দেশ বহু কৃষক অমান্য করে।
উপসংহার: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বাংলায় সংগঠিত কৃষক আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। বাংলার বিভিন্ন স্থানে পার্টির নির্দেশ অমান্য করে কমিউনিস্টদের আন্দোলনে যোগদান আন্দোলনগুলিকে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে।
- মহারাষ্ট্র: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের দহনু ও উমাবরগাঁ তালুকে জমিদার ও ইজারাদারদের শোষণের বিরুদ্ধে ভারলিস উপজাতির আন্দোলন শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেন বামপন্থী নেতা দালভী ও পারুলেকর। এই আন্দোলনের ফলে বেগার প্রথা ও ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে।
- বিহার: বিহারে বকস্ত নামে জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলন করে। এটি বকস্ত আন্দোলন নামে পরিচিত।
- ত্রিবাঙ্কুর: ত্রিবাঙ্কুরের পুন্নাপ্রা-ভায়লার অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমিকরা কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আন্দোলন চালায়। এর ফলে স্বাধীনতা লাভের পর ত্রিবাঙ্কুরের ভারতভুক্তি সহজ হয়।
- বাংলা: বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোহর, মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি জেলার বর্গাদার বা ভাগচাষিরা উৎপন্ন ফসলের ২/৩ অংশ পাওয়ার দাবিতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন শুরু করে। এটি তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত।
- হায়দ্রাবাদ: হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানা অঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ কৃষক ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন শুরু করে। এটি তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
উপসংহার: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরবর্তীকালে সংঘটিত কৃষক আন্দোলনগুলির অধিকাংশই ছিল বিচ্ছিন্ন এবং বহুক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রবণতা যুক্ত। অধিকাংশ আন্দোলনে বামপন্থীদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
- জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ: জমিদারি প্রথা ছিল কৃষকদের দুর্দশার অন্যতম কারণ। তাই কিষান সভা জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের দাবি জানায়।
- কৃষিঋণ মকুব: কৃষকরা ঋণ নিয়ে অনন্তকাল ঋণের জালে জড়িয়ে থাকত। কিষান সভা এই ঋণ মকুবের দাবি জানায়।
- বেগার প্রথার অবসান: জমিদারের জমিতে কৃষকদের যে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হত বা বেগার শ্রম দিতে হত, কিষান সভা এই প্রথার অবসানের দাবি করে।
- খাজনা হ্রাস: কৃষকদের খাজনার হার অন্তত ৫০ শতাংশ হ্রাস করার জন্য কিষান সভা দাবি জানায়।
- বনজ-সম্পদে অধিকার: ইতিপূর্বে ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন পাস করে ভারতীয়দের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। প্রকৃতির বনজ-সম্পদ আহরণে কৃষকদের অধিকার দানের জন্য কৃষকসভা দাবি জানায় ।
- জমি প্রদান: সরকারের অনাবাদী জমি এবং জমিদারের খাস জমি কৃষকদের হাতে প্রদানের জন্য কিষান সভা দাবি করে।
উপসংহার: কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, তাদের দাবিদাওয়া আদায় এবং তাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা কিষান সভা স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্রিটিশ-বিরোধী গণ আন্দোলনগুলিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। ফলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ফলবতী হয়।
- অসহযোগ আন্দোলন: কংগ্রেসের উদ্যোগে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে কৃষক আন্দোলনও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের উদ্যোগে বাংলার মেদিনীপুর, পাবনা, কুমিল্লা, রাজশাহি, বগুড়া, রংপুর, বীরভূম, দিনাজপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায়, বিহারের ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, দ্বারভাঙ্গা, মধুবনী প্রভৃতি জেলায়, যুক্তপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর প্রভৃতি জেলায় কৃষক আন্দোলন চলে।
- একা আন্দোলন: ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষ ও ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা অঞ্চলে মাদারি পাশি ও বাবা গরিবদাসের নেতৃত্বে ‘একা’ নামে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।
- বারদৌলি সত্যাগ্রহ: জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি অঞ্চলে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এক শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল।
- আইন অমান্য আন্দোলন: কংগ্রেসের উদ্যোগে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য শুরু হলে কৃষক আন্দোলন আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। উত্তরপ্রদেশের আগ্রা, রায়বেরিলি, বারাবাঁকি, লখনউ, প্রতাপগড়, বাংলার মেদিনীপুর, শ্রীহট্ট, বিহারের বিভিন্ন স্থানে, গুজরাটের সুরাট, বারদৌলি, খেদা প্রভৃতি জেলায় কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলন: কংগ্রেসের নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, সাঁওতাল পরগনা, বাংলার মেদিনীপুর, দিনাজপুর, গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ, ব্রোচ, উড়িষ্যার তালচের প্রভৃতি জেলায় শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে।
উপসংহারঃ সমগ্র বিশ শতক জুড়ে ভারতে সংগঠিত কৃষক আন্দোলনগুলি কংগ্রেসের নেতৃত্বে সমৃদ্ধ হয়। প্রাথমিক পর্বে কংগ্রেস কৃষকদের স্বার্থ উপেক্ষা করলেও পরবর্তীকালে তারা কৃষকদের স্বার্থের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ফলে কৃষকরা কংগ্রেসি রাজনীতির ঘনিষ্ঠ হয়।
- বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্ব: অরবিন্দ ঘোষের মতো কেউ কেউ এমন আশঙ্কা করেছিলেন যে কৃষকদের স্বার্থযুক্ত আন্দোলনে সক্রিয়তা দেখালে দেশপ্রেমিক জমিদাররা কংগ্রেসের প্রতি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাই কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের শামিল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। যদিও পাঞ্জাবে লর্ড মিন্টো কর্তৃক ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ক্যানাল আইনের বিরুদ্ধে লালা লাজপত রায় ও অজিত সিংহদের যুক্ত হতে দেখা যায়।
- অসহযোগ আন্দোলন পর্ব: অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ভারতের নানা স্থানে জমিদার বিরোধিতা, খাজনা বন্ধ, বিভিন্ন প্রকার কর বন্ধ, লুঠতরাজ, ছোটোখাটো সংঘর্ষ প্রভৃতির মাধ্যমে কৃষক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলার মেদিনীপুর জেলায় বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন হয়। কংগ্রেসে নেতৃত্বাধীন ‘একা আন্দোলন’, ‘বারদৌলি সত্যাগ্রহ’ প্রভৃতিতে কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব আন্দোলনে মাদারি পাসি, বাবা গরিব দাস, বল্লভভাই প্যাটেল-সহ বিভিন্ন কংগ্রেস নেতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
- আইন অমান্য আন্দোলন পর্ব : আইন অমান্য আন্দোলন কালে বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কেরল, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব-সহ নানা স্থানে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনগুলির সাথে কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলি যুক্ত হয়ে পড়ে। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট দলগুলি কৃষকদের খাজনা দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেয়। আইন অমান্য আন্দোলন থেমে যাওয়ার পরও বামপন্থী ও কমিউনিস্ট দলগুলির নেতৃত্বে ধীর গতিতে কৃষক আন্দোলন চলতে থাকে।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্ব : ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক কৃষকরা, এমনকি খেতমজুর শ্রেণিও সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্টিফেন হেনিংহ্যামের মতে, পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে কৃষকরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি দলগতভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও বহু কমিউনিস্ট নেতা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। হিতেশরঞ্জন সান্যাল দেখিয়েছেন যে, মেদিনীপুর জেলায় কৃষকসভার বহু সদস্য পার্টির নির্দেশ অমান্য করে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়।
উপসংহার: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আবার বামপন্থী ও কমিউনিস্ট দলগুলির লড়াকু নেতৃত্ব যেভাবে কৃষক আন্দোলনগুলিকে সর্বাত্মক করে তোলে তা কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – B শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ এবং উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতি
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় : বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের সময় বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে শ্রমিক আন্দোলন, সক্রিয় হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ মিছিল-মিটিং-এ অংশ নেয়, বিলাতি পণ্য বর্জন করে এবং ধর্মঘটে শামিল হয়। [i] মুচিরা বিদেশি জুতো সারাতে, রাঁধুনিরা রান্নায় বিদেশি দ্রব্য ব্যবহার করতে, ধোপারা বিলাতি কাপড় কাচতে অস্বীকার করে। [ii] কলকাতার বিভিন্ন কলকারখানা, ছাপাখানা, চটকল, রেলওয়ে, ট্রাম কোম্পানি, হাওড়ায় বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি, বরিশালে সেটেলমেন্ট, জামালপুরে রেল ওয়ার্কশপ, বাউড়িয়ায় জুটমিল, তুতিকোরিনে বস্ত্র কারখানা, বোম্বাই ও রাওয়ালপিন্ডিতে অস্ত্র কারখানা ও রেলওয়ে ওয়ার্কশপ প্রভৃতিতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
- অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময়: এসময় ভারতে অন্তত ৪৫০টি শ্রমিক ধর্মঘট হয়। মাদ্রাজ শ্রমিক ধর্মঘটের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কলকাতার বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, রেলওয়ে, ট্রাম কোম্পানি, বন্দর, পাটকল, জামশেদপুরে টাটা ইস্পাত কারখানা, রানিগঞ্জের কয়লাখনি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয়। বোম্বাই, কানপুর, শোলাপুর, জামালপুর প্রভৃতি শহরেও ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময়: কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। মহারাষ্ট্র, বাংলা, আসাম, মাদ্রাজ-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। [i] মহারাষ্ট্রের শোলাপুর, নাগপুর ও বোম্বাইয়ে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয়। বোম্বাইয়ে রেল-শ্রমিকরা রেললাইনে অবরোধ করে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালায়। [ii] বাংলায় কলকাতার বিভিন্ন চটকল, পরিবহণ ও শিল্পকারখানা, কুলটির লৌহ-ইস্পাত কারখানা, রানিগঞ্জের কয়লাখনি প্রভৃতির শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। [iii] করাচি বন্দর, হীরাপুরে লৌহ- ইস্পাত কারখানা, আসামের ডিগবয় তৈলশোধনাগার, মাদ্রাজের শিল্পকারখানার শ্রমিকরাও এই ধর্মঘটে শামিল হয়।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়: কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণিকে কংগ্রেস পরিচালিত ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়। তা সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রেণির একটি বড়ো অংশ এই সময় নানা আন্দোলনে শামিল হয় এবং বিভিন্ন কলকারখানায় ধর্মঘট করে। জামশেদপুরে টাটা ইস্পাত কারখানা শ্রমিক ধর্মঘটে ১৩ দিন বন্ধ থাকে। আমেদাবাদের বস্ত্র-শ্রমিকরা ৩ মাসেরও বেশি সময় ধর্মঘট চালিয়ে যায়। দিল্লি, বোম্বাই, লখনউ, কানপুর, নাগপুর, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর প্রভৃতি স্থানের শ্রমিকরা সপ্তাহব্যাপী ধর্মঘট ও হরতাল পালন করে।
উপসংহার: কংগ্রেসের পরিচালিত বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি অংশগ্রহণ করলেও কংগ্রেস দলের তুলনায় কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকশ্রেণির ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এজন্য কমিউনিস্টদের দমনের উদ্দেশ্যে সরকার বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেয় এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা (১৯৩৪ খ্রি.) করে।
- প্রতিকূলতা : ভারতে বামপন্থী রাজনীতি ও আন্দোলনের প্রসারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিকূলতা ছিল। একদিকে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রতিরোধে সরকার যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। অন্যদিকে সমাজের উচ্চস্তরে কংগ্রেসের প্রাধান্য থাকায় সেখানে বামপন্থী ভাবধারা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়। এজন্য মানবেন্দ্রনাথ রায়কে ভারতের বাইরে, রাশিয়ার তাসখন্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’-র প্রতিষ্ঠা (১৭ অক্টোবর, ১৯২০ খ্রি.) করতে হয়। মুজাফফর আহমেদও বাংলায় গোপনে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রচার চালান।
- দমননীতি: সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে, বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাকে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা প্রভৃতিতে ফাঁসিয়ে বামপন্থী ভাবধারা ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়।
- কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থা: কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া বিভিন্ন কংগ্রেস নেতার নেতৃত্বে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও বামপন্থী ভাবধারার প্রসার ঘটে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পট্টবর্ধন, ইউসুফ মেহের আলি, অশোক মেহতা, মিনু মাসানী প্রমুখ কংগ্রেস নেতা ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল’ গঠন করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন এই দলের সম্পাদক।
- লক্ষ্য: ভারতের বামপন্থী রাজনীতি ও আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল কৃষক ও শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি ঘটানো। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনই ছিল বামপন্থীদের প্রধান উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস । মাদ্রাজের কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গারাভেল্লু চেট্টিয়ার ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে গয়া কংগ্রেসে ঘোষণা করেন যে, “আমি একজন কমিউনিস্ট। আমরা এখনই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই, পরে সমাজতন্ত্র।”
- গণভিত্তি: ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি-সহ বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলি দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণিকে জাতীয় আন্দোলনগুলিতে শামিল করার ক্ষেত্রে বামপন্থী দলগুলির সর্বাধিক ভূমিকা ছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলি ছাড়াও বামপন্থীদের উদ্যোগে কৃষক ও শ্রমিকরা বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়ে বামপন্থী রাজনীতির গণভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।
উপসংহার: কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের নীতি গ্রহণ করে, কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং দেশভাগের ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিরোধী নীতি গ্রহণ করে।
- শ্রমিক আন্দোলনের কারণ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রমিকদের উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ শিল্পপণ্য বিক্রি করে মালিকশ্রেণি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু শ্রমিকদের কোনো বেতন বাড়েনি, কাজের সময় কমেনি বা অন্য কোনো সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়নি। শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো, বেতন বৃদ্ধি করা, শিল্পে দেশীয় উদ্যোগ বৃদ্ধি, ভারতীয়দের হাতে স্বায়ত্তশাসন প্রদান প্রভৃতি দাবিতে তারা ক্ষুব্ধ ছিল।
- নেতৃত্ব: গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বি পি ওয়াদিয়া, এম এন যোশী, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, সুরেন্দ্রনাথ হালদার-সহ বেশ কিছু শ্রমিক নেতা এই আন্দোলনে যোগদান করেন। গান্ধিজির ডাকে এবং শ্রমিক নেতাদের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকরা অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হয়।
- এ আই টি ইউ সি: অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বামপন্থী নেতারা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ গড়ে তোলেন। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায়। এই সভার মধ্য দিয়ে সমগ্র শ্রমিক সম্প্রদায়কে জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণের ডাক দেওয়া হয়।
- ধর্মঘট: অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের উদ্যোগে সারা ভারতে প্রায় ৪৫০টি ধর্মঘট হয়। কলকাতা ও মাদ্রাজে রেল, ট্রাম কোম্পানি, বন্দর, পাটকল, জামশেদপুরের লৌহ ইস্পাত কারখানা, রানিগঞ্জের কয়লাখনি প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ব্যাপক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়।
- ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির ভূমিকা: ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে শ্রমিক আন্দোলনও আপাতত গতি হারায়। পরে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দল শ্রমিক-কৃষকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
মূল্যায়ন: ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। গান্ধিজির অহিংস আদর্শে পরিচালিত হয়ে শ্রমিকশ্রেণি আন্দোলনের সূচনা করেন। দ্রুত এই আন্দোলন দেশের বিভিন্ন কলকারখানায় ছড়িয়ে পড়ে।
- মহারাষ্ট্রে ধর্মঘট: আইন অমান্য আন্দোলনের সময় মহারাষ্ট্রের শোলাপুর, নাগপুর ও বোম্বাই-এ ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত হয়। শোলাপুরে বস্ত্র শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ক্ষিপ্ত শ্রমিকরা রেলস্টেশন, থানা, আদালত ও সরকারি দপ্তরে আক্রমণ চালায়। বোম্বাইয়ে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক স্বাধীনতার দাবি জানায়। বোম্বাইয়ের রেল শ্রমিকরা রেললাইনে শুয়ে, রেল অবরোধ করে আইন অমান্য করে।
- বাংলায় ধর্মঘট: আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলকাতার বিভিন্ন চটকল, পরিবহণ ও শিল্পকারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। এ ছাড়া কুলটির লৌহ-ইস্পাত কারখানা, রানিগঞ্জের কয়লাখনি প্রভৃতি স্থানের শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।
- অন্যান্য স্থানে ধর্মঘট: গান্ধিজি গুজরাটের ডান্ডি নামক স্থানে ব্রিটিশ সরকারের লবণ আইন ভেঙে আইন অমান্য করেন। এই আন্দোলনে গান্ধিজির সঙ্গে বহু শ্রমিক অংশ নেয়। এ ছাড়া করাচি বন্দর, হীরাপুরে লৌহ-ইস্পাত কারখানা, আসামের ডিগবয় তৈলশোধনাগার, মাদ্রাজের শিল্পকারখানার শ্রমিকরাও ধর্মঘটে শামিল হয়।
- কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা: শ্রমিকদের আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বি টি রণদিভে, সোমনাথ লাহিড়ী প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতার নেতৃত্বে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রমিক ধর্মঘটে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় ভূমিকা থাকায় সরকার প্রথম ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
- অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব: আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থনৈতিক মহামন্দার কুপ্রভাবে ভারতীয় শ্রমিকরাও অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়। শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস, শ্রমিক ছাঁটাই, বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতির ফলে শ্রমিকশ্রেণি ঘোর সংকটে পড়ে। বাংলার বিভিন্ন চা-বাগান বন্ধ হয়ে যায় এবং বিদেশে চা রপ্তানি ব্যাহত হয়। ফলে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
- শ্রমিক শ্রেণির পুনর্জাগরণ: ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিকদের আন্দোলনও দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর ১৯৩৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেস ৭টি প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করলে শ্রমিকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা দেখা দেয়। আবার নতুন করে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠতে থাকে এবং শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়।
মূল্যায়ন: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) পর ভারতে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক আন্দোলন আবার সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়। শ্রমিকদের সহযোগিতায় আইন অমান্য আন্দোলন শক্তিশালী রূপ ধারণ করে। তবে আইন অমান্য আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হতে থাকলে শ্রমিক আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে।
- বামপন্থার প্রসার: জাতীয় কংগ্রেসে গান্ধিজির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থার বিশেষ প্রসার ঘটতে শুরু করে। কংগ্রেসের বামপন্থী নেতৃবৃন্দ তাঁদের ভাবাদর্শকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন বোধ করেন।
- সংগঠনের শাখা পরিচালনা: বিভিন্ন কারখানায় গড়ে ওঠা শ্রমিক সংগঠনগুলিকে পরিচালনা করা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এজন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দেয়। বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্ট পার্টি, ঢাকেশ্বরী মিল শ্রমিক ইউনিয়ন, বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন-সহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এই পার্টির দ্বারা পরিচালিত হত।
- আন্দোলন পরিচালনা: বামপন্থীরা দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছিল। এই উদ্দেশ্যে বামপন্থীদের উদ্যোগে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- সর্বভারতীয় রূপ: সারা দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি ছিল সেই কেন্দ্রীয় সংগঠন।
- আন্দোলন: ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি কৃষক ও শ্রমিকদের নিজ দলের ছত্রছায়ায় এনে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে এবং তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকে।
- শ্রেণিসংগ্রাম: ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি তার প্রতিষ্ঠাকালীন ইস্তেহারপত্রে ঘোষণা করেছিল যে এই দল শ্রেণিসংগ্রামের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে বৃহত্তর দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে। সেই অনুসারে এই দল মেহনতি মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা ও আর্থসামাজিক মুক্তির উদ্দেশ্যে কাজ করে যায়।
- জমিদারি প্রথার বিলোপ: ভারতীয় কৃষিব্যবস্থায় প্রচলিত জমিদারি ব্যবস্থার অবসানের উদ্দেশ্যে ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ও চেষ্টা চালায়।
- পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ: ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং প্রায় ১২৫০০ ভোট পায়।
- কারামুক্তিতে সহায়তা: ব্রিটিশ সরকার ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে কারারুদ্ধ করে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিচার শুরু করে। ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি আইনি লড়াই ও অন্যান্য উদ্যোগের মাধ্যমে অভিযুক্তদের মধ্যে ২৫ জনকে কারামুক্ত করতে সক্ষম হয়।
- মুখপত্র প্রকাশ: ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টির বিভিন্ন শাখা নিজেদের দলীয় মুখপত্র প্রকাশ করে কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে দলীয় বার্তা প্রচারের উদ্যোগে নেয়। এসব পত্রপত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘লাঙল’। এ ছাড়া ছিল ‘গণবাণী’, ‘লাল নিশান’, ‘জাগরণ’, ‘কীর্তি’ প্রভৃতি।
- যুব শাখা: এই পার্টি নিজ ভাবধারা সমাজে ব্যাপকভাবে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের যুব শাখা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এর নাম হয় ‘যুব কমরেডস লিগ’। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠায় পি সি জোশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- বৈপ্লবিক কাজ: নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সি মার্টিন, মানবেন্দ্রনাথ রায়, হরি সিং, ড. মাহমুদ, সি. হোয়াইট, মি. ব্যানার্জি প্রভৃতি ছদ্মনাম ব্যবহার করে বৈপ্লবিক কাজকর্ম চালান। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তিনি ‘হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা’য় (১৯১০ খ্রি.) অভিযুক্ত হয়ে ৪ বছর কারাবাসে কাটান। মুক্তিলাভের পর তিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে গিয়ে বার্লিনে ‘ভারতীয় বিপ্লবী কমিটি’ গঠন করেন।
- কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা: মানবেন্দ্রনাথ লেনিনের আমন্ত্রণে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় যান এবং মস্কোয় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগ দেন। এরপর তিনি অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি, মহম্মদ সাফিক প্রমুখের সহযোগিতায় রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (১৭ অক্টোবর, ১৯২০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
- পত্রিকা: মানবেন্দ্রনাথ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন থেকে ‘ভ্যানগার্ড অব ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করে তা ডাকযোগে ভারতের নানা অঞ্চলে পাঠাতে থাকেন। পত্রিকাটির নাম কয়েকবার পরিবর্তন করলেও ব্রিটিশ সরকার বারবার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে।
- ভাবধারা প্রচার: মানবেন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতা ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচারের কাজে নেমে পড়েন। তাঁর প্রেরণায় মুজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে কলকাতায় এবং এস এ ডাঙ্গের নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচারিত হয়।
- কংগ্রেসে
যোগদান: মানবেন্দ্রনাথ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ফিরে এলে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি ৬ বছর কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরে লিগ অব র্যাডিক্যাল কংগ্রেসমেন (১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসুকে সভাপতি পদে সমর্থন জানান।
- র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গঠন: কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারা প্রসারের বিশেষ সম্ভাবনা না থাকায় মানবেন্দ্রনাথ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে (১৯৪০ খ্রি.) ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ গঠন করেন।
উপসংহারঃ মানবেন্দ্রনাথ রায় আমৃত্যু বামপন্থী ভাবধারা ও আন্দোলনের প্রসারে নিরলস লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন’, ‘ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা’, ‘বিজ্ঞান ও কুসংস্কার’, ‘নব মানবতাবাদ’: একটি ইস্তেহার’ প্রভৃতি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে দেরাদুনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যু হয়। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ তাঁকে ‘সারা বিশ্বে বিচরণকারী নিঃসঙ্গ সিংহ’ বলে অভিহিত করেছে।
- কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা: বাংলায় মুজাফফর আহমেদ, হেমন্তকুমার সরকার প্রমুখ কমিউনিস্টরা শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ গঠন করেন (১৯২৫ খ্রি.)। এই পার্টির অনুকরণে বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে অনুরূপ পার্টি গড়ে ওঠে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’।
- মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা: ঔপনিবেশিক সরকার কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩২ জন কমিউনিস্ট নেতা বা শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে এক মামলা শুরু করেন, যা মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এই মামলায় মুজফ্ফর আহমেদ, কিশোরীলাল ঘোষ, ধরণী গোস্বামী, গোপেন চক্রবর্তী, রাধারমণ মিত্র, গোপাল বসাক এবং শিবনাথ মুখোপাধ্যায় অভিযুক্ত হন।
- হালিমের কলকাতা কমিটি : মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরবর্তীকালে আবদুল হালিম প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন বজায় রাখেন। হালিমের নেতৃত্বে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটি।
- ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের উদ্যোগ: ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে গঠিত হয় ইন্ডিয়ান প্রলেতারিয়ান রেভলিউশনারি পার্টি’। পরবর্তীকালে এই পার্টি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করে।
উপসংহার: বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন ছিল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত্তির রূপকার। বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
- কংগ্রেসে কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ: সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে কমিউনিস্ট নেতারা জাতীয় কংগ্রেস ও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বামপন্থার কাজ চালিয়ে যান। এভাবে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারা ক্রমে প্রবল হতে শুরু করে।
- কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠা: আচার্য নরেন্দ্র দেব ও জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল-এর প্রতিষ্ঠা হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক। এই দলের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাম মনোহর লোহিয়া, অচ্যুত পট্টবর্ধন, ইউসুফ মেহের আলি প্রমুখ।
- সমাজতন্ত্রী দলের উদ্যোগ: কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারার প্রসার ঘটাতে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়। এই দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষক ও শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী করা, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন, বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, দেশীয় রাজতন্ত্র ও জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি প্রভৃতি। এই দলের প্রভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কৃষিসংস্কার, ভূমিসংস্কার, শিল্প-বিরোধ সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ে নজর দিতে বাধ্য হয়।
- কিষান কংগ্রেস: কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্টরা ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারত কিষান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এন জি রঙ্গ এর সভাপতি এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই পার্টি জমিদার ও বেগার প্রথার উচ্ছেদ, কৃষিঋণ মকুব, খাজনা হ্রাস প্রভৃতি দাবি জানায়। এই দলের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
- তরুণ নেতৃত্ব: তরুণ কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরু মনে করতেন যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে এদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের অবসান ঘটানো দরকার। এরজন্য তাঁরা এদেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। সুভাষচন্দ্র বসু মনে করতেন যে, এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন হল ভারতীয়দের দারিদ্র্যের মূল কারণ। এই শাসনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়োজনে সশস্ত্র বিপ্লবকেও সমর্থন করেন। তিনি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন।
উপসংহার: কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারার প্রসার কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতাদের বিশেষভাবে খুশি করতে পারেনি। বামপন্থীদের সহায়তায় বামপন্থী ভাবধারার অনুগামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে গান্ধিজি খুশি হতে পারেননি। এই পরিস্থিতিতে নেহরু গান্ধিজির প্রতি আনুগত্য জানালেও গান্ধি-সুভাষ বিরোধের কারণে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। ফলে ফরওয়ার্ড ব্লক ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে একটি পৃথক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
- ব্রিটিশ বিরোধিতা: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে শ্রমিকরা প্রাথমিক পর্বে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের দাবি জানায়। তাদের বিশ্বাস ছিল ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করলে তাদের অবস্থার উন্নতি হবে।
- শ্রমিকদের দাবি: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের দাবিদাওয়াগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তাদের কাজের সময়কাল কমানো, বেতন বৃদ্ধি, বিনা ব্যয়ে চিকিৎসার সুযোগ, বিমার বন্দোবস্ত, ভাতার প্রচলন, সন্তানদের জন্য শিক্ষার সুযোগ প্রভৃতি।
- ধর্মঘট পালন: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কমিউনিস্ট দল উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ না করার আহ্বান জানায়। কিন্তু শ্রমিকরা কলকারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং স্থানে স্থানে ধর্মঘট ও হরতাল পালন করে। কমিউনিস্ট নেতারা ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে দূরে থাকলেও বহু শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেয়।
- শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ভারতের সর্বত্র শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলা, বিহার, দিল্লি, বোম্বাই, লখনউ, মাদ্রাজ, কানপুর, নাগপুর প্রভৃতি স্থানে শ্রমিক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
- খণ্ডযুদ্ধ: শ্রমিকদের ধর্মঘট ও আন্দোলনকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে সরকার পুলিশ ও সেনাদলের দ্বারা আন্দোলনকারীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন শুরু করে। ফলে সেনা ও পুলিশের সাথে শ্রমিকদের সংঘাত বাধে। বোম্বাইয়ের রাজপথে সেনা ও পুলিশের সাথে শ্রমিকদের খণ্ডযুদ্ধে প্রায় ২৫০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
উপসংহার: পূর্ববর্তী শ্রমিক আন্দোলনগুলিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে এই দল শ্রমিকশ্রেণিকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। অবশ্য কমিউনিস্ট নেতাদের এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ হয়নি। অধ্যাপক আদিত্য মুখার্জী বলেছেন যে, পার্টি লাইন আলাদা হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ কমিউনিস্ট কর্মীরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
- কম মজুরি: শিল্পকারখানাগুলিতে কর্মরত শ্রমিকদের দিনে প্রচুর সময় কাজ করতে বাধ্য করা হলেও তাদের খুব কম মজুরি দেওয়া হত। ফলে শ্রমিকদের আর্থিক দুর্দশা কোনোদিন কাটত না।
- দুরবস্থা দুরবস্থা ছিল শ্রমিকদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, অসুখবিসুখে চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া প্রভৃতির ফলে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
- অশিক্ষা: আর্থিক সংকট ও কারখানার কাজে প্রচুর সময় ব্যয় হওয়ায় শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের বিশেষ সুযোগ ছিল না।
- নেতৃত্ব: বিভিন্ন কারণে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে কংগ্রেস ও বামপন্থী নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে শামিল করতে সক্ষম হন।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শোষিত শ্রমিকশ্রেণি সংঘবদ্ধ আন্দোলনের যে উদ্যোগ নেয় তাতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে কংগ্রেস, বামপন্থী-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এর ফলে স্বদেশি, অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো প্রভৃতি আন্দোলনগুলিতে শ্রমিকশ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
- প্ৰতিবাদ: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে সেদিন শ্রমিকরা এর প্রতিবাদে বিভিন্ন মিছিল-মিটিং ও জমায়েতে অংশ নেয়।
- বয়কট আন্দোলন: শ্রমিক-মজুররা স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিলাতি পণ্য বর্জন করে। ময়মনসিংহের মুচিরা বিদেশি জুতো সারাতে, বরিশালের উড়িয়া রাঁধুনিরা রান্নায় বিদেশি দ্রব্য ব্যবহার করতে, কালীঘাটের ধোপারা বিলাতি কাপড় কাচতে আপত্তি জানায়।
- হরতাল ধর্মঘট: কলকাতার বিভিন্ন কলকারখানা, ছাপাখানা, চটকল, রেলওয়ে ও ট্রাম কোম্পানির শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। হাওড়ায় বার্ন কোম্পানি, বরিশালে সেটেলমেন্ট, জামালপুরের রেল ওয়ার্কশপ, বাউড়িয়ার জুটমিল, তুতিকোরিনে বস্ত্র কারখানা, বোম্বাই ও রাওয়ালপিন্ডিতে অস্ত্র কারখানা ও রেলওয়ে ওয়ার্কশপ প্রভৃতিতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
- নেতৃত্ব: বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, লিয়াকত হোসেন, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী প্রমুখ কংগ্রেস নেতা শ্রমিক ধর্মঘটে উৎসাহ প্রদান করেন। প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, প্রেমতোষ বসু, অপূর্বকুমার ঘোষ, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শ্রমিক নেতাও শ্রমিকদের ধর্মঘট ও হরতালে নেতৃত্ব দেন।
- দমননীতি: শ্রমিক আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার তীব্র দমনপীড়ন চালায়। বোম্বাইয়ে পুলিশ ও সেনার গুলিতে ১৬ জন শ্রমিক মারা যায় এবং ৫০ জন আহত হয়। অন্যত্রও কঠোর দমনপীড়ন চলে।
উপসংহার: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের তুলনায় শ্রমিকদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে শ্রমিকরা বাংলার নানা স্থানে বিদেশি পণ্য বয়কটে অংশ নেয়। সরকারের তীব্র দমননীতির ফলে এই সময় শ্রমিকদের আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তা পরবর্তীকালের শ্রমিক আন্দোলনগুলিকে প্রভাবিত করে।
- মিছিল ও জমায়েত: লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে বাংলার বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক ও মজুররা প্রতিবাদ মিছিল ও জমায়েতে যোগ দেয়।
- বয়কট: বাংলার বিভিন্ন জেলার শ্রমিক ও মজুররা বিলাতি পণ্য বয়কট করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে। ময়মনসিংহের মুচিরা বিদেশি জুতা সারাতে, বরিশালের উড়িয়া রাঁধুনিরা রান্নায় বিদেশি দ্রব্য ব্যবহার করতে, কালীঘাটের ধোপারা বিলাতি কাপড় কাচতে আপত্তি জানায়।
- রেল ধর্মঘট: বাংলার বিভিন্ন স্থানে রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কর্মচারীরা ব্যাপক ধর্মঘট শুরু করে এবং রেলওয়ে মেস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। জামালপুর, খড়গপুর, আসানসোল প্রভৃতি স্থানের রেল ওয়ার্কশপ-এর কর্মচারীরাও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।
- চট্টকলে ধর্মঘট: কলকাতার সন্নিহিত বাউড়িয়া জুটমিল, বজবজে ক্লাইভ জুটমিল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের চটকল শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।
- অন্যান্য ধর্মঘট: এ ছাড়া কলকাতার ট্রাম কোম্পানি, ছাপাখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। বরিশাল সেটেলমেন্ট, হাওড়ার বার্ন কোম্পানি প্রভৃতির শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।
- কুলি ও মেথরদের ধর্মঘট: কলকাতা পুরসভার ২ হাজার কুলি এবং মেথরও ধর্মঘটে শামিল হয়। এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের সমর্থনে কলকাতায় মিছিল বের হয়।
- আন্দোলনের অবসান: আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন শুরু হলে বাংলার শ্রমিক আন্দোলন দিশাহারা হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণ আন্দোলন ক্রমে দুর্বল হতে শুরু করলে শ্রমিক আন্দোলনও গতি হারিয়ে ফেলে।
উপসংহার: বাংলার বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে শ্রমিকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতায় সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের কঠোর দমননীতি এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সরকার কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার ফলে বাংলার শ্রমিক আন্দোলন তার গতি হারায়।
- প্রেক্ষাপট: ভারতের শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কমিউনিস্ট ভাবধারা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করলে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এই সময়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আই এল ও প্রতিষ্ঠিত হলে এর সদস্যপদ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারতের শ্রমিক নেতারা আগ্রহ প্রকাশ করে।
- শ্রমিক সম্মেলন: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্য সফল করতে নিখিল ভারত শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর মাদ্রাজে আয়োজিত এই সম্মেলনে ১৮টি শ্রমিক ইউনিয়নের ৮০৬ জন প্রতিনিধি যোগ দেয়।
- গঠন: মাদ্রাজে সংগঠিত শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘নিখিল ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ বা All India Trade Union Congress (AITUC) গঠিত হয়। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায়, সহসভাপতি ছিলেন জোসেফ ব্যপ্তিস্তা এবং সম্পাদক ছিলেন দেওয়ান চমনলাল ৷
- কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি: নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংগঠনের সঙ্গে কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলে। অবশ্য গান্ধিজি এই সংগঠন সম্পর্কে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি।
উপসংহার: বিংশ শতাব্দীতে শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতা ও বামপন্থী ভাবধারার প্রসার ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। রুশ বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত এই সংগঠন শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তিদানের স্বপ্ন দেখেছিল।
- লক্ষ্য: অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানকারী শ্রমিকদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো, বেতন বৃদ্ধি করা, ভারতীয়দের হাতে স্বায়ত্তশাসন দান প্রভৃতি।
- নেতৃত্ব: অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুরেন্দ্রনাথ হালদার প্রমুখ।
- ধর্মঘটের ব্যাপকতা: বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক, মজুর ও কুলিরা অসহযোগ আন্দোলনের সময় ধর্মঘট চালায়। ১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় অন্তত ১৩৭টি শ্রমিক ধর্মঘট হয়। আর এই সমস্ত ধর্মঘটে ২,৪৪,১৮০ জন শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছিল।
- বিভিন্ন স্থানে ধর্মঘট: অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। [1] কলকাতার রেলওয়ে, ট্রাম কোম্পানি, বন্দর, পাটকল প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট চলে। [ii] ইস্টবেঙ্গল রেল এবং স্টিমার কোম্পানির শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে। [iii] চাঁদপুরে স্টিমার ধর্মঘট হয়। [iv] কয়লাখনি, চা বাগান প্রভৃতি স্থানের শ্রমিকরাও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।
উপসংহার: অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের যুগে শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল বাংলা। ভারতে অন্যান্য স্থানের তুলনায় বাংলার শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। তবে অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
- পেজেন্টস পার্টির বাংলা শাখা: কাজি নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, সামসুদ্দিন হুসেন প্রমুখের উদ্যোগে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কংগ্রেস দলের মধ্যে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এই দলের নাম হল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অব বেঙ্গল।
- পেজেন্টস পার্টির সর্বভারতীয় শাখা: বাংলার অনুকরণে বিভিন্ন প্রদেশে শীঘ্রই এই পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। এই শাখাগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক হন আর এস নিম্বকার।
- উদ্যোগ: এই দল শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করতে থাকে যে, শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীনতা না পেলে রাজনৈতিক দিক থেকে স্বাধীনতার কোনো মূল্যই থাকবে না। পেজেন্টস পার্টির নেতারা রাজনৈতিক আন্দোলন ও শ্রেণি সংগ্রাম সম্পর্কে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে থাকেন।
- মুখপত্র: বিভিন্ন প্রদেশে এই পার্টির মুখপত্র প্রকাশের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চলতে থাকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’, ‘শ্রমিক’, ‘সোশ্যালিস্ট’ ‘কীর্তি’, ‘লেবার-কিষান-গেজেট’ প্রভৃতি।
- আন্দোলন: এই দলের পরিচালনায় বোম্বাইয়ে রেল, ছাপাখানা, পৌরসভা, বন্দর প্রভৃতির শ্রমিকরা শক্তিশালী সরকার-বিরোধী আন্দোলন করে।
- মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা: এই দলের আন্দোলনে আতঙ্কিত হয়ে সরকার এই দলের বহু নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৯ খ্রি.) অভিযুক্ত করলে তাদের আন্দোলনের গতি দুর্বল হয়ে যায়।
উপসংহার: ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি-র মূল লক্ষ্য ছিল কৃষক-শ্রমিক স্বার্থে কাজ করা। এই দল তাদের মুখপত্রের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষকে বামপন্থী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। জমিদারি প্রথা বিলোপ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দান প্রভৃতির পক্ষে এই সংগঠন প্রস্তাব গ্রহণ করে।
- হুইটলি কমিশন গঠন: শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে। এই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে হুইটলি কমিশন গঠন করে। সরকার বোঝাতে চায় যে, ভারতের শ্রমিকদের উন্নয়নের বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকার বেশি আগ্রহী।
- শিল্প-বিরোধ ও জন নিরাপত্তা বিল: কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারের উদ্দেশ্যে বড়োলাট লর্ড আরউইন তীব্র দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি শিল্প-বিরোধ বিল পাস করে শ্রমিক ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করেন এবং জন নিরাপত্তা বিল পাস করে কমিউনিস্টদের দমন করার চেষ্টা করেন।
- মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা: কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার রোধ করার উদ্দেশ্যে সরকার ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে তাদের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৯ খ্রি.) অভিযুক্ত করে। এই নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফফর আহমেদ, মিরাজকর, পি সি জোশী, গঙ্গাধর অধিকারী, শিবনাথ শাস্ত্রী, ধরণী গোস্বামী, এস এ ডাঙ্গে, মকবুল হুদা, ফিলিপ স্প্ল্যাট, বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি প্রমুখ।
- কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ: শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে কমিউনিস্ট পার্টির যথেষ্ট ভূমিকা লক্ষ করে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে।
উপসংহার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী ভাবধারার যথেষ্ট প্রসার ঘটে। এই ভাবধারার প্রভাবে এই সময় শ্রমিক আন্দোলনও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সরকার তীব্র দমনপীড়ন, কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার প্রভৃতির দ্বারা শ্রমিক, আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চালায়।
- মজুরি হ্রাস: আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দেওয়া হয়।
- অর্থনৈতিক মন্দা: ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা বা মহামন্দা দেখা দিলে শ্রমিকদের ওপরও এই মন্দার প্রভাব পড়ে।
- বেকারত্ব: মহামন্দার ফলে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেলে বহু শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে।
- কলকাতা: আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের রেলওয়ে, ট্রাম কোম্পানি, চটকল, পরিবহণ ব্যবস্থা-সহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।
- অন্যত্র: কলকাতার বাইরে বাংলার বিভিন্ন স্থানেও শ্রমিক, মজুর, কুলিরা আন্দোলনে শামিল হয়। কুলটির লৌহ-ইস্পাত কারখানা, রানিগঞ্জের কয়লাখনি প্রভৃতি স্থানের শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।
উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার দ্বারা শ্রমিক আন্দোলনকে দুর্বল করতে সমর্থ হলেও শ্রমিকরা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলন ব্যাপক হয়ে ওঠে।
- কমিউনিস্টদের প্রসার: ১৯২০-এর দশকের শুরু থেকে ভারতের কমিউনিস্টরা দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক যোগ দেয় এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।
- সরকারের উদ্বেগ : কমিউনিস্ট ভাবধারা ও কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের দ্রুত প্রসারে সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের দমন ও শ্রমিক আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাকে জড়িয়ে দেয়।
- মামলার রায় : ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় প্রকাশিত হয়। মামলায় ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফফর আহমেদ, শিবনাথ ব্যানার্জি, ধরণী গোস্বামী, এস এ ডাঙ্গে, পি সি জোশী, ফিলিপ স্প্ল্যাট, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমুখ। মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্টদের যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ হয়।
উপসংহারঃ ব্রিটিশ সরকার ভারতে বামপন্থী আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু করে। এই মামলার রায়ে ৩৩ জন গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট নেতার কারাদণ্ড হলে ভারতে বামপন্থী আন্দোলন সংকটের মুখে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যে সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে বামপন্থী আন্দোলন আপাতত স্তিমিত হয়ে পড়ে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
একটি বাক্যে উত্তর দাও
ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো
শূন্যস্থান পূরণ করো
বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ
সঠিক উত্তর নির্বাচন করো
TOPIC – C বিবিধ
অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নোত্তর
- আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্ব: বিশ শতকে ভারতে [i] বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫ খ্রি.) [ii] অহিংস অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০ খ্রি.) [iii] আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০ খ্রি.) [iv] ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২ খ্রি.)–এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে কংগ্রেস সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
- কৃষক আন্দোলন: বিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনগুলিতে কৃষক সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। কংগ্রেস দলও কৃষকদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।
- শ্রমিক আন্দোলন: কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন আন্দোলনে দেশের শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করে কংগ্রেসের আন্দোলনকে জোরালো করে তোলে। কংগ্রেসি আন্দোলনের বাইরেও শ্রমিকরা ধর্মঘট, বিক্ষোভ, হরতাল প্রভৃতিতে যুক্ত হয়। কংগ্রেস এসব আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়।
- বামপন্থী আন্দোলন: বিশ শতকের দুইয়ের দশক থেকে ভারতে বামপন্থী ও কমিউনিস্ট ভাবধারা এবং আন্দোলনের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির ওপর কমিউনিস্ট দলের সর্বাধিক প্রভাব ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের উদ্যোগে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও বামপন্থী ভাবধারা জনপ্রিয় হয়।
- কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি: বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়।
উপসংহার: বিশ শতকে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শাখা সক্রিয় হয়ে তাদের আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকদের শামিল করার চেষ্টা করে। তবে কৃষক ও শ্রমিকদের ওপর কংগ্রেসের তুলনায় বামপন্থী দলগুলির বেশি প্রভাব ছিল এবং তাদের আন্দোলনেই বামপন্থী দলগুলি শক্তিশালী হয়েছিল।
- বয়কট: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে বিলাতি সামগ্রী বর্জন ও বিদেশি সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু হয়। এই ধারা ‘বয়কট’ আন্দোলন নামে পরিচিত।
- স্বদেশি: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে বিলাতি পণ্য বর্জন করে তার পরিবর্তে স্বদেশি পণ্য ব্যবহার ও প্রসার, স্বদেশি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ধারা স্বদেশি আন্দোলন নামেপরিচিত।
- জাতীয় শিক্ষা: আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা- প্রতিষ্ঠানগুলি ত্যাগ করতে শুরু করে। পাশাপাশি, সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
- বিপ্লবী কার্যকলাপ; বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে গুপ্ত-বিপ্লবী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের শেষপর্বে আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “প্রকাশ্যে কংগ্রেসের মাধ্যমে এবং গোপনে বিপ্লবীদের মাধ্যমে অরবিন্দ যুগপৎ আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। তার অনুসারীরা পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদে ঝুঁকে পড়ে।
- কারণ: অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পিছনে প্রধান কারণগুলি ছিল—–[i] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভে ব্যর্থতা, [ii] দেশজুড়ে মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, [iii] দমনমূলক রাওলাট আইন পাস, [iv] জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, [v] ব্রিটিশ শক্তি কর্তৃক তুরস্কের ব্যবচ্ছেদ ও তুরস্কের সুলতানের (খলিফা) ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি।
- আন্দোলনের সূচনা: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। গান্ধিজি ‘স্বরাজ’ অর্জনকে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপরই সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
- আন্দোলনের প্রসার: অসহযোগ আন্দোলনে ইতিবাচক অর্থাৎ গঠনমূলক এবং নেতিবাচক অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক—উভয় ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়। একদিকে বিলিতি পণ্য, সরকারি স্কুলকলেজ, আদালত, আইনসভা প্রভৃতি বর্জন শুরু হয়, অন্যদিকে দেশীয় পণ্যের প্রসার, দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।
- নেতৃত্ব: চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, বিঠলভাই প্যাটেল, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, সীতারামাইয়া প্রমুখ অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলেন।
- আন্দোলন প্রত্যাহার; ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে উত্তেজিত জনতা থানায় আগুন লাগিয়ে ২২ জন পুলিশকে হত্যা করলে অহিংস মতাদর্শে বিশ্বাসী গান্ধিজি আন্দোলন প্রত্যাহার (২৫ ফেব্রুয়ারি) করে নেন।
উপসংহার: গান্ধিজি চৌরিচৌরার ঘটনার ফলে আন্দোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। কেউ কেউ একে ‘জাতীয় বিপর্যয়’, ‘পর্বতপ্রমাণ ভুল’ প্রভৃতি বলে অভিহিত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি গান্ধিজির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।