wb 10th Bengali

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 3 আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি

WBBSE 10th Class Bengali Solutions Chapter 3 আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি

West Bengal Board 10th Class Bengali Solutions Chapter 3 আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি

West Bengal Board 10th Bengali Solutions

কবি পরিচিতি

জন্ম: কবি শঙ্খ ঘোষ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি (২২ মাঘ, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। চাঁদপুর বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত। কবির পৈতৃক বাসস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানরিপাড়ায়। তাঁর মায়ের নাম অমলাবালা ঘোষ, বাবা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ।
ছাত্রজীবন: বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান চিত্তপ্রিয়ের শৈশবশিক্ষার শুরু বাড়িতেই। পাবনা জেলার পাক্‌শি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভরতি হন। তাঁর বাবা ছিলেন সেই স্কুলের প্রধানশিক্ষক। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন বিশ্বভারতীর লোকশিক্ষা সংসদের আদ্যভারতী পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। পরের বছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাঁচটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন ও সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এক্ষেত্রেও তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই শঙ্খ ঘোষ বিএ পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে তিনি এমএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান পান।
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন: ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কৃত্তিবাস পত্রিকা প্রকাশিত হলে তার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যাতেই শঙ্খ ঘোষ ‘দিনগুলি রাতগুলি’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবাসী কলেজে তিনি কিছুকাল অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মুরশিদাবাদে জঙ্গিপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। ১৯৫৬-য় তাঁর লেখা কিশোরপাঠ্য জীবনীগ্রন্থ বিদ্যাসাগর প্রকাশিত হয়। সে বছর তিনি যোগ দেন বহরমপুর গার্লস কলেজে, বিবাহ করেন শ্রীমতী প্রতিমা বিশ্বাসকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিনগুলি রাতগুলি। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিটি কলেজের অধ্যাপক হয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৬৩-তে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করলেন বাংলা ভাষায় বিশ্বকবিতা সংকলন সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত। বইটি উৎসর্গ করলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ যে ভারতকোষ গ্রন্থ প্রকাশ করে, শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তার সহসম্পাদকবৃন্দের মধ্যে অন্যতম। এর পরের বছর তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬৭-তে প্রকাশিত হয় এখন সময় নয়, নিহিত পাতালছায়া কাব্যগ্রন্থ। সে বছরই অক্টোবরে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনটারন্যাশনাল ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি প্রথমবার বিদেশযাত্রা করেন। ১৯৬৮-তে তিনি দেশে ফেরেন এবং পরের বছর তাঁর কালের যাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৭১-এ বেরোয় নিঃশব্দের তর্জনী, ছন্দের বারান্দা প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থ। পরের বছর প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ আদিম লতাগুল্মময়, কিশোর উপন্যাস সকালবেলার আলো। ১৯৭৩-এ নির্মাল্য আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে সম্পাদনা করলেন সতীনাথ গ্রন্থাবলী, অনুবাদ করলেন স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর লেখা গ্রন্থ ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ নামে। ১৯৭৪-এ প্রকাশিত হল কাব্যগ্রন্থ মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়। এ বছরই কিছুকাল তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসার পদে কাজ করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকের পদ সামলান। এই সময়েই প্রকাশিত হয় তুমি তো তেমন গৌরী নওকাব্যগ্রন্থ। ১৯৭৯-তে কিউবার কবিতার বঙ্গানুবাদ করলেন নিকোলাস গ্যিয়েনের চিড়িয়াখানা ও অন্যান্য কবিতা নামে। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ কাব্যগ্রন্থটি। সে বছরই প্রকাশ পায় এ আমির আবরণ প্রবন্ধগ্রন্থ। কুন্তক ছদ্মনামে লেখেন শব্দ নিয়ে খেলা বইটি। ১৯৮১-তে প্রকাশিত হয় উর্বশীর হাসি। ১৯৮৫-তে নির্মাণ আর সৃষ্টি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রহর জোড়া ত্রিতাল কাব্যগ্রন্থের জন্য শঙ্খ ঘোষ ত্রিবান্দ্রমের ‘কুমারন আসান পুরস্কার’ লাভ করেন।
১৯৮৩-তে প্রকাশিত হয় ছোটোদের জন্য ছড়া সংকলন রাগ করো না রাগুনি। ১৯৮৪-তে মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, বন্ধুরা মাতি তরজায় কাব্যগ্রন্থ এবং কল্পনার হিস্টিরিয়া প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৫-তে বেরোয় জার্নার্ল, ১৯৮৬-তে ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম, হয়বদন, বহুল দেবতা বহুস্বর ১৯৮৭-তে প্রকাশিত হয় কবিতার মুহূর্ত, ধুম লেগেছে হৃৎকমলে, সব কিছুতেই খেলনা হয় কাব্যগ্রন্থগুলি। ১৯৮৯-এ কবিতা লেখা কবিতা পড়া প্রবন্ধগ্রন্থের প্রকাশ। সে বছর ধুম লেগেছে হৃৎকমলে গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া রবীন্দ্র পুরস্কারের টাকা শঙ্খ ঘোষ নির্যাতিত ও অসহায় মেয়েদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য তুলে দেন শ্রীশিবশঙ্কর চক্রবর্তী মহাশয়ের হাতে।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা সুপুরিবনের সারি নামের কিশোরপাঠ্য উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে তিনি অবসর নেন। অসমের কমলকুমারী ফাউন্ডেশন থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য পান ‘কমলকুমারী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর কালচার’। টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট তাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। এরপর একের পর এক প্রকাশিত হয় তাঁর লাইনেই ছিলাম বাবা, ছন্দোময় জীবন, কথা নিয়ে খেলা, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, কবির অভিপ্রায়, এখন সব অলীক, প্রহর জোড়া ত্রিতাল, আমন যাবে লাট্টু-পাহাড়, বইয়ের ঘর, শবের উপর সামিয়ানা, সময়ের জলছবি, ছোট্ট একটা স্কুল, ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার, ইশারা অবিরত, এই শহরের রাখাল, ইছামতীর মশা, বড়ো হওয়া খুব ভুল, দামিনীর গান, জলই পাষাণ হয়ে আছে, বল তো দেখি কেমন হতো, সামান্য অসামান্য, ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ, অবিশ্বাসের বাস্তব, ইরাকি কবিতার ছায়ায়, শহর পথের ধুলো, আরোপ আর উদ্‌দ্ভাবন, বটপাকুড়ের ফেনা, কথার পিঠে কথা, ইকবাল থেকে অনুবাদ, প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। পুরস্কার ও সম্মান: শঙ্খ ঘোষ সারাজীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ বাবরের প্রার্থনা। ১৯৭৭-এ মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় কাব্যগ্রন্থের জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘নরসিংহ দাস পুরস্কার’ দিল, বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পান ‘নক্ষত্র পুরস্কার’ এবং ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’। ১৯৯৫-তে ভারতীয় ভাষা পরিষদ তাঁকে ‘স্বর্ণাঞ্চল পুরস্কার’ এবং ১৯৯৮-এ মধ্যপ্রদেশ সরকার তাঁকে ‘কবীর সম্মান’ দেয়। সে বছরই কবিতার মুহূর্তগ্রন্থের জন্য পান ‘শিরোমণি পুরস্কার’। গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ কাব্যগ্রন্থের জন্য কে কে বিড়লা ফাউন্ডেশন তাঁকে ‘সরস্বতী সম্মান’ জ্ঞাপন করে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘গঙ্গাধর মেহের জাতীয় পুরস্কার’ দান করে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পান ‘অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতি পুরস্কার’, ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট। ২০০৬-এ শঙ্খ ঘোষ পান বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিলিট। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দিয়ে ভূষিত করে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কারে সম্মানিত হন।

উৎস

শঙ্খ ঘোষের জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি নেওয়া হয়েছে।

সারসংক্ষেপ

আমাদের পৃথিবী আজ সংকটের মুখোমুখি। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ধর্মান্ধতা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে কবি শঙ্খ ঘোষ ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি রচনা করেন। আমাদের ডান কিংবা বাম উভয় দিকেই রয়েছে ধ্বংসের নিশ্চিত ইঙ্গিত। মাথার ওপরে কিংবা পায়ের নীচে প্রতিমুহূর্তে প্রতিবন্ধকতা। নানারকম বাধায় আমাদের বেঁচে থাকাই সমস্যার হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় মানুষের অস্তিত্বই আজ সংকটের সামনে। প্রেরণা খুঁজে নেওয়ার মতো কোনো ইতিহাসও আমাদের নেই। কেননা ইতিহাস এখানে ক্ষমতাবানদের দ্বারা বিকৃত। তাই প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় জীবন অনিশ্চিত। এই অবস্থায় বিরোধী শক্তিকে আটকাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলতে হবে।
অন্যের দাসত্ব করতে গিয়ে আমরা আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে অন্যের পায়ে সমর্পণ করে ফেলেছি। নিজেদের ঐতিহ্যকে ভুলে অন্যের চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসকে গ্রহণ করে আমার বেঁচে রয়েছি। এই বেঁচে থাকার আড়ালে রয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। এরই মধ্যে দু-চারজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এখনও আছেন, যাঁরা মানুষে মানুষে একাত্মতার কথা বলেন। এই একাত্মতাই হল আমাদের পৃথিবীর প্রাণশক্তি। পারস্পরিক প্রীতিই সভ্যতাকে বাঁচাতে পারে। এই চেষ্টাই এখন সকলকে করতে হবে।

নামকরণ

নামকরণ যে-কোনো সাহিত্যিক রচনায় প্রবেশের চাবিকাঠি। তাই সাহিত্যে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর এই নামকরণ নানান দিক থেকে হতে পারে। আমাদের আলোচ্য ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটির নামকরণ কতখানি প্রাসঙ্গিক তা বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নানারকম সংকটের মধ্য দিয়ে আজকের পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি বিষয়গুলি মানবতার বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এই অবস্থায় মানুষের অস্তিত্বই আজ সংকটের সামনে। প্রেরণা খুঁজে নেওয়ার মতো কোনো ইতিহাসও আমাদের নেই, কারণ ইতিহাস এখানে ক্ষমতাবানদের দ্বারা বিকৃত। তাই অন্ধ ও ভিখারি হয়ে বেঁচে থাকাই আজ মানুষের নিয়তি। সাধারণ মানুষ এখানে কোনো মর্যাদাই পায় না। তবুও যাবতীয় শুভবুদ্ধির অবসান এখনও হয়নি। সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু মানুষ আজও সম্প্রীতির কথা বলে, মানুষে মানুষে মিলনের কথা বলে। আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’—কবিতার দুটি স্তবকে ধ্রুবপদের মতো পঙ্ক্তিটিকে দু-বার ব্যবহার করেছেন কবি। মিলনের আকাঙ্ক্ষা এতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্যঞ্জনার দিক থেকে নামকরণটি তাই অত্যন্ত সার্থক হয়েছে।

আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি কবির কোন্ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত?
(ক) ‘নিহিত পাতাল ছায়া’
(খ) ‘পাঁজরে দাড়ের শব্দ’
(প) ‘দিনগুলি রাতগুলি’
(ঘ) ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’
২. জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়-
(ক) ২০০২ খ্রিস্টাব্দে
(খ) ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে
(প) ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে
(ঘ) ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে
৩. জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা-
(ক) ১৮টি
(খ) ২৫টি
(গ) ৩১টি
(ঘ) ৩৫টি
৪. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থের-
(ক) ১ সংখ্যক কবিতা
(খ) ১০ সংখ্যক কবিতা
(প) ২৫ সংখ্যক কবিতা
(ঘ) ৩১ সংখ্যক কবিতা
৫. জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল—
(ক) ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ
(খ) ২০০৪-২০০৬ খ্রিস্টাব্দ
(গ) ২০০৭-০৮ খ্রিস্টাব্দ
(ঘ) ২০০০-০৩ খ্রিস্টাব্দ
৬. জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থটি কবি শঙ্খ ঘোষ যাঁদের উৎসর্গ করেন, তাঁরা হলেন-
(ক) জয়দেব আর সেবন্তী
(খ) অভীক আর মালঞ্চ
(গ) অরিজিৎ আর রীণা
(ঘ) শ্রীজাত আর দুর্বা
৭. “আমাদের ডান পাশে ……….” –
(ক) খাদ
(খ) ধ্বস
(গ) প্রান্তর
(ঘ) বন
৮. ‘আমাদের বাঁয়ে’ রয়েছে-
(ক) গিরিখাত
(খ) বোমারু বিমান
(গ) পর্বত
(ঘ) অরণ্য
৯. ‘আমাদের মাথায়’-
(ক) গিরিখাদ
(খ) বোমারু
(গ) পর্বত
(ঘ) অরিজিৎ আর রীণা
১০. আমাদের ‘পায়ে পায়ে’ রয়েছে-
(ক) ভারী জুতো
(খ) হিমানীর বাঁধ
(গ) কাঁটা তার
(ঘ) ভিক্ষুকের দল
১১. “পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ”—“হিমানী’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ-
(ক) জল
(খ) আগুন
(গ) তুষার
(ঘ) পর্বত
১২. ‘আমাদের পথ’-
(ক) নেই
(খ) ফাঁকা পড়ে আছে
(গ) তৈরি করতে হবে
(ঘ) জনাকীর্ণ হয়ে আছে
১৩. “আমাদের ঘর গেছে উড়ে”—কীসের দ্বারা উড়ে গেছে?
(ক) বন্যার দ্বারা
(খ) বোমারুর দ্বারা
(গ) যুদ্ধের দ্বারা
(ঘ) ভূমিকম্পের দ্বারা ক
১৪. কাছে ও দূরে কী ছড়ানো আছে?
(ক) বোমারু বিমানের ভগ্নাংশ
(খ) যুদ্ধে মৃত মানুষের দেহ
(গ) শিশুদের শব
(ঘ) কবির আত্মীয়স্বজনের মৃতদেহ
১৫. “আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?”—কবির মনে এই প্রশ্ন জেগেছে, কারণ-
(ক) তাঁর ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, আত্মজদের মৃত্যু ঘটেছে
(খ) তাঁর আর কোনো পথ নেই
(গ) তাঁর চারিদিকে অজস্র বাধা
(ঘ) সবকটিই সঠিক

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. কবি শঙ্খ ঘোষ কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর – কবি শঙ্খ ঘোষ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
২. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি কবি শঙ্খ ঘোষের কোন্ কাব্যগ্রন্থের কবিতা?
উত্তর –‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি কবি শঙ্খ ঘোষের জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
৩. জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলি কোন্ সময়ের মধ্যে রচিত?
উত্তর –কবি শঙ্খ ঘোষের জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি ২০০০২০০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত।
৪. জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থটি কত খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়?
উত্তর – জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থটি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়।
৫. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থের কত সংখ্যক কবিতা?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি জলই পাষাণ হয়ে আছে কাব্যগ্রন্থের ৩১ সংখ্যক কবিতা।
৬. কবিতার কথকের ডান পাশে কীসের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের ডান পাশে ধসের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে।
৭. কবিতার কথক তার বাম দিকে কী দেখছেন?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথক তার বাম দিকে দেখছেন গভীর গিরিখাত।
৮. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের মাথার ওপরে কী উড়ে বেড়াচ্ছে?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের মাথার ওপরে উড়ে বেড়াচ্ছে ‘বোমারু’ অর্থাৎ বোমারু বিমান।
৯. “আমাদের মাথায় বোমারু”—‘বোমারু’ শব্দটির দ্বারা কবি কোন্ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছেন?
উত্তর – ‘বোমারু’ কথাটির দ্বারা কবি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
১০. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের পায়ে পায়ে কীসের বাঁধ?
উত্তর – আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ।
১১. “পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ।”—“হিমানীর বাঁধ’ বলতে কবি কীবুঝিয়েছেন? 
উত্তর – হিংসার উন্মত্ততা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাকে দুঃসহ করে তুলেছে। পাহাড়ি পথকে বরফ যেমন দুর্গম করে তোলে তেমনই এই হিংসা সভ্যতার গতিপথকে দুর্গম করে তোলে।
১২. “আমাদের পথ নেই কোনো””— এরকম মন্তব্যের কারণ কী?
উত্তর – সম্পূর্ণ প্রতিকূল ও অস্থির পরিবেশে এ কথা মনে হয়েছে যে আমাদের কোনো পথ নেই। কেননা যে-কোনো দিকে পা বাড়ালেই চূড়ান্ত অঘটন ঘটবে।
১৩. “আমাদের ঘর গেছে উড়ে”—কথাটির অর্থ পরিস্ফুট করো।
উত্তর – শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি স্বার্থের জন্য দুর্বল দেশগুলির ওপর বোমারু বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করেছে। সে-কারণে ‘আমাদের’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ঘর উড়ে গেছে।
১৪. “ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে!”—কী ছড়ানো রয়েছে? 
উত্তর – শঙ্খ ঘোষ রচিত ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কথকের বিবৃতি অনুযায়ী কাছে-দূরে মানবশিশুর মৃতদেহ ছড়ানো রয়েছে।
১৫. “আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?”—কবিতার কথকের মনে এমন সংশয়ের কারণ কী? 
উত্তর – শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের মনে এমন সংশয় জেগেছে। কেননা বেদনাভরা চোখ মেলে তিনি চারদিকে সন্তানদের মৃতদেহ দেখেছেন, যা তাঁকে ভীত করে তুলেছে।
১৬. “আমাদের পথ নেই আর”—‘পথ’ শব্দটি উদ্ধৃত অংশে কোন্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতা থেকে নেওয়া ওপরের আলোচ্য অংশে ‘পথ’ শব্দটি ‘উপায়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৭. “আমাদের পথ নেই আর”—তাহলে আমাদের করণীয় কী? [মাধ্যমিক ২০১৭] [শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশন
উত্তর – আমাদের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কবি হাতে হাত রেখে সংঘবদ্ধভাবে থাকার ডাক দিয়েছেন।
১৮. “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”—বেঁধে বেঁধে থাকার উদ্দেশ্য কী?
উত্তর – বেঁধে বেঁধে থাকার উদ্দেশ্য বিপদকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার শক্তি সংগ্রহ করা।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ”—’গিরিখাদ’ কী? এই উল্লেখের কারণ আলোচনা করো। 
উত্তর – ‘গিরিখাদ’: দুটি পর্বতের মধ্যভাগের সরু নীচু জায়গা যা পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বাস্তবে তা অতি বিপজ্জনক।
‘গিরিখাদ’-এর উল্লেখের কারণ: বর্তমানে সাধারণ মানুষ এক সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সেই সংকটজনক পরিস্থিতিতে প্রতি পদক্ষেপে রয়েছে বিপদের সম্ভাবনা। ‘বাঁয়ে গিরিখাদ’ আপাতভাবে পথের দুর্গম চরিত্রকে বোঝায়। সেই পথে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে তা সভ্যতার সংকটকেই বোঝায়। ‘গিরিখাদ’-এর উল্লেখ করা হয়েছে এই বিপদের প্রতীক হিসেবেই।
২. “আমাদের মাথায় বোমারু”—বোমারু কী? মন্তব্যটির অর্থ বিশ্লেষণ করো। 
উত্তর – বোমারুর অর্থ: ‘বোমারু’ কথাটির অর্থ যুদ্ধবিমান।
অর্থ বিশ্লেষণ: পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের বীভৎসতা আর হিংস্র উন্মত্ততা লক্ষ করেছেন কবি। এতে একদিকে সমাজজীবনে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে;অন্যদিকে মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে উঠেছে। যুদ্ধবিমান সেই বিপন্নতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ‘বোমারু’ হল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতীক। মাথার উপরে তার আনাগোনা প্রতিমূহুর্তে বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা তৈরি করে। কারণ যুদ্ধ মানেই মানুষের মৃত্যু এবং আশ্রয়হীনতা।
৩. “আমাদের পথ নেই কোনো”—এই পথ না থাকার তাৎপর্য কী?
উত্তর – উৎস: উদ্ধৃত অংশটি শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতা থেকে গৃহীত। তাৎপর্য: বর্তমানে হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ ক্রমশ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা তাকে কোথাও স্থির থাকতে দিচ্ছে না। আদর্শবোধের ভাঙন ক্রমশই এত তীব্রতর হচ্ছে যে মানুষের চেতনা কোন্ পথে যাবে তা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডান দিকে ধ্বংসের তাণ্ডব, বাম দিকেও মৃত্যুফাঁদ। এরই পাশাপাশি মাথার ওপরে বোমারু বিমানের হানা আর চলতে গেলে পায়ে পায়ে প্রতিবন্ধকতা। এভাবেই মানুষের কাছে চলার পথ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক অন্ধকার এবং আদর্শহীনতা গ্রাস করছে আমাদেরকে।
৪. “আমাদের ঘর গেছে উড়ে।”—কাদের ঘর, কেন উড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন কবি? 
উত্তর – উদ্দিষ্ট: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় আমাদের অর্থাৎ নিরীহ সাধারণ মানুষের ঘরের কথা বলা হয়েছে।
ঘর উড়ে যাওয়ার কারণ: বর্তমান বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা দুর্বল রাষ্ট্রগুলি আক্রান্ত হচ্ছে। বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে সেইসব দুর্বল রাষ্ট্রগুলির ওপর। এরফলে নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় মানুষদের ঘর উড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবাজ দেশগুলি বিমান নিয়ে হানা দিচ্ছে। যেখানে সেখানে বোমাবর্ষণ করছে সেই ‘বোমারু বিমান’। এর ফলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ, আলোচ্য অংশে কবি এই আশ্রয়হীনতার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
৫. “আমাদের শিশুদের শব/ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।”— মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর – পৃথিবীজোড়া অনিশ্চয়তা, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক আদর্শহীনতা ইত্যাদি সমাজকে অস্থির করে তুলছে। পৃথিবীজুড়ে যেন ধ্বংসলীলা চলছে। আর যে-কোনো যুদ্ধ অথবা সন্ত্রাসে শিশুহত্যার ঘটনা ঘটে যথেষ্টই। এই নারকীয় দৃশ্য কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যে ঘটে তা নয়, ঘটতে পারে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তেই। এ শুধু অমানবিকতার প্রকাশ নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিনাশ। একই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কবি এই ধ্বংসলীলায় উদাসীন থাকতে পারেননি।
৬. “আমরাও তবে এইভাবে / এ মুহূর্তে মরে যাব না কি?”— এখানে ‘আমরা’ কারা? এই সংশয়ের কারণ কী?
উত্তর – ‘আমরা’র পরিচয়: এখানে ‘আমরা’ বলতে কবি সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছেন।
সংশয়ের কারণ: যুদ্ধে উন্মত্ত পৃথিবীতে অনবরত চলে বোমাবর্ষণ, গোলাগুলি, রক্তপাত। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরীহ মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। মাথার উপরে বোমারু বিমান, চলার পথে অজস্র প্রতিকূলতা। যুদ্ধের অন্তরে চলার পথ নেই, মানুষ আশ্রয়হীন। যুদ্ধ শুধু ধ্বংস নয়, ডেকে আনে মৃত্যুকেও। বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে পড়ে থাকে শিশুদের মৃতদেহ। আর মৃত্যুভয় তাড়া করে সকল মানুষকেই। এ কারণেই কবির মনে সংশয় দেখা দিয়েছে।
৭. “আমাদের পথ নেই আর”—পথ না থাকার কারণ কী? এজন্য কী করা দরকার বলে কবি মনে করেছেন?
উত্তর – পথ না থাকার কারণ: আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের থাবায় আর যুদ্ধবাজদের আক্রমণে সাধারণ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। নিরীহ সাধারণ মানুষ আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। মানুষের আদর্শহীনতা, স্বার্থপরতা চলার পথকে দুর্গম করেছে। মাথার উপরে বোমারু বিমানের আনাগোনা ধ্বংস ও মৃত্যুকে নিশ্চিত করেছে। মানুষ নিরাশ্রয় হয়েছে। শিশুদের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। এই পরিস্থিতিতে তাদের আর বেঁচে থাকার পথ নেই বলে কবি মনে করেন।
করণীয় কাজ: বর্তমান সংকটজনক অবস্থায় সাধারণ মানুষকে হাতে হাত রেখে সংঘবদ্ধভাবে থাকা দরকার বলে কবি মনে করেছেন।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর 
১. “আমাদের ডান পাশে ধ্বস/আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ”—সমগ্র কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যের তাৎপর্য লেখো।
উত্তর – উৎস: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষের বিপন্ন অবস্থাকে ছোঁয়ার চেষ্টা। প্রসঙ্গ: বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেকগুলি সংকট। একুশ শতকের শুরু থেকেই পৃথিবীজুড়ে এই সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গেই কবি আলোচ্য উদ্ধৃতিটির উল্লেখ করেছেন। তাৎপর্য: সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা নির্বিচারে আক্রান্ত হয়েছে একের পর এক দেশ। মানুষের বর্বরতা, ধর্মান্ধতা ‘হিমানীর বাঁধ’এর মতো চলার পথকে বন্ধ করে দিচ্ছে। ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে মৃত্যু আর রক্তাক্ততায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। সাধারণ মানুষ আশঙ্কায় ভুগছে—“আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না। কি?” এই অবস্থায় প্রয়োজন ছিল আদর্শবোধের প্রতিষ্ঠা, যা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারত আমাদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানেও কোনো সম্ভাবনা কবি দেখতে পাচ্ছেন না। ‘ডান পাশ’ এবং বাঁ-দিক অর্থাৎ সর্বত্রই ধ্বংস এবং মৃত্যুর হাতছানি। ‘সম্পর্কের উৎসব’ নামক গদ্যরচনায় কবি লিখেছিলেন—“নতুন শতাব্দীর মানুষকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে তার আয়োজন। … যেখানে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আর অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ শুধু মানুষ পরিচয়েই মেলাতে পারেন হাত…।” কিন্তু দিশাহীন চারপাশে কবি সেই আদর্শের আলো খুঁজে পাচ্ছেন না, যা পথ দেখাতে পারে।
২. “আমাদের শিশুদের শব— / ছড়ানো রয়েছে কাছে দুরে।” কোন্ পরিস্থিতিতে কবি ‘শিশুদের শব’ দেখেছেন? এই ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ কেন?
উত্তর – পরিস্থিতি: শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় সময় এবং সমাজের নানারকম অস্থিরতাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। চারপাশে শুধু ধ্বংসের আয়োজন। ‘ডানপাশে ধ্বস’ আর ‘বাঁয়ে গিরিখাদ’ যেন বিপদের প্রতীক। মাথায় বোমারু বিমানের আনাগোনা যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে। আর যুদ্ধ মানেই ধ্বংস আর মৃত্যু। যার পরিণতিতে মানুষের চলার পথ ধ্বংস হয়, মানুষ নিরাশ্রয় হয়। আর এই ধ্বংস উন্মত্ততাই শিশুদের মৃত্যু ঘটায়। ‘কাছে দূরে’ অর্থাৎ বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে পড়ে থাকে শিশুদের মৃতদেহ।
ঘটনাটির তাৎপর্য: শিশুদের মৃত্যু সভ্যতার জন্য সর্বনাশের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। যুদ্ধ কত নিষ্ঠুরতা নিয়ে আসে এই ঘটনা তার প্রতীক। শিশুদের মৃত্যু সাধারণ মৃত্যুর থেকে আলাদা। কারণ, শিশুরা ভবিষ্যতের সমাজ গঠনের কারিগর। তাদের মৃত্যু ঘটার অর্থই হল সভ্যতার ভবিষ্যতে শূন্যতা সৃষ্টি হওয়া। দ্বিতীয়ত, শিশুদের মৃত্যু সমাজের বাকি অংশের মানুষদেরও মৃত্যু ভয়ে শঙ্কিত করে তোলে। “আমরাও তবে এইভাবে/এ মুহূর্তে মরে যাব না কি?” “কাছে দুরে’ ‘শিশুদের শব’ সাধারণ মানুষকে নিজেদের বিষয়ে ভীত করে তোলে। তারা বিপন্নবোধ করে, আর তার মুলে থাকে শিশুদের মৃত্যু।
৩. “আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি”—এমনটা মনে হচ্ছে কেন? 
উত্তর – শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় সমাজসভ্যতার অস্থির স্বরুপকে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধ, ভেদবুদ্ধি, আদর্শহীনতা ইত্যাদি সভ্যতার গতিপথকে রুদ্ধ করে তুলেছে। ‘ডান পাশে ধ্বস’ আর ‘বাঁয়ে গিরিখাদ’ চলার পথকে করেছে বিপৎসংকুল। মাথার উপরে যুদ্ধবিমান ধ্বংস ও মৃত্যুর ছায়াকে দীর্ঘতর করে তুলেছে। বরফ যেমন চলার পথকে দুর্গম করে তোলে সেভাবেই যুদ্ধ, আদর্শের অভাব, স্বার্থপরতা ইত্যাদি এগিয়ে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের তাণ্ডবে মানুষ নিরাশ্রয় হয়। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে—“আমাদের ঘর গেছে উড়ে/আমাদের শিশুদের শব—/ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।” ধ্বংসের এই প্রচণ্ডতা শিহরিত করে সাধারণ মানুষদেরকেও। সর্বনাশের আশঙ্কা সংক্রমিত হয়। জীবনের অগ্রগতিই শুধু অবরুদ্ধ হয় না। তার অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ে। মৃত্যুভয় ছুঁয়ে যায় সকলকেই। আশঙ্কিত মানুষদের তখনই মনে হয়—“আমরাও তবে এইভাবে/এই মুহূর্তে মরে যাব না কি?”

আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর

বহুৰিকল্পীয় প্রশ্ন [MCQ] ও উত্তর

ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।

১.“আমাদের ইতিহাস নেই/অথবা এমনই ইতিহাস—” হয়তো আমাদের ইতিহাসটা এমনই যে—
(ক) আমরা চিরকালের ভিখারি হিসেবে চিহ্নিত
(খ) আমাদের কথা কেউ জানে না
(গ) আমাদের কথা সকলেই জানে
(ঘ) আমরা মিলেমিশে থাকতেই অভ্যস্ত
২. “আমাদের চোখমুখ ঢাকা”—পঙ্ক্তিটির মর্মার্থ হল –
(ক) আমাদের পরিচয় কোনোদিনই প্রকাশ পায় না
(খ) আমরা পরিচয় দিতে লজ্জা পাই
(গ) আমরা পরিচয় দিতে ঘৃণা বোধ করি
(ঘ) আমাদের পরিচয়ের কেউ তোয়াক্কা করে না
৩. “আমরা ভিখারি বারোমাস”—কবির এমন মনে হওয়ার কারণ-
(ক) মানুষের দারিদ্র্য দেখে তিনি কুণ্ঠিত
(খ) মানুষের চাহিদা দেখে তিনি লজ্জিত
(গ) মানুষের হতাশা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ
(ঘ) মানুষের দুঃখে তিনি কাতর
৪. “আমরা ভিখারি ………..” –
(ক) সারামাস
(খ) আটমাস
(গ) দশমাস
(ঘ) বারোমাস
৫. “আমাদের কথা কে বা জানে”—এ কথা তাদের মনে হয়, যারা-
(ক) ভিখারি
(খ) সাধারণ মানুষ
(গ) উদ্বাস্তু
(ঘ) কবিৰ
৬. “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।”—আমাদের ‘দোরে দোরে’ ফেরার অর্থ-
(ক) ভিক্ষা করা
(খ) মানুষের পাশে দাঁড়ানো
(গ) মানুষের সাহায্যের প্রত্যাশা
(ঘ) ভ্রমণের নেশা আমাদের পেয়ে বসেছে
৭. “কিছুই কোথাও যদি নেই”, তবু-
(ক) ভিক্ষুকের মতো দ্বারে দ্বারে ঘোরা শেষ হবে না
(খ) এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা পরস্পর হাতে হাত রেখে বাঁচতে চান
(গ) মানুষের মন থেকে সব কিছু হারানোর ভয় দূর হবে না
(ঘ) মানুষ মনে করে, জীবন থেকে কিছুই হারিয়ে যায়নি

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “আমাদের ইতিহাস নেই— ” এ কথা বলা হয়েছে কেন?
উত্তর – শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় “আমাদের ইতিহাস নেই” –বলার কারণ হল বক্তা যাদের প্রতিনিধি, সেই সাধারণ মানুষ কোনোদিনই ইতিহাসে ঠাঁই পায় না।
২. “অথবা এমনই ইতিহাস” —ইতিহাস থেকে থাকলে তার স্বরূপটি কেমন?
উত্তর – শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার কথকের সমাজের ইতিহাস থেকে থাকলেও সেখানে সকলেরই চোখ-মুখ ঢাকা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দিয়ে সেখানে কেউই ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি।
৩. “আমরা ভিখারি বারোমাস -এ কথা বলার কারণ কী?
উত্তর – সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও বিপুল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করে কবি শঙ্খ ঘোষ ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
৪. “পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে/পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” —এমন কথা মনে হয়েছে কেন?
উত্তর – শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষ যেন অন্য কোনো গ্রহের জীব। তারা এতটাই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যে পৃথিবীর বাঁচা-মরার খবর যেন তাদের কাছে নেই।
৫. “আমাদের কথা কেবা জানে” —কাদের কথা কেউ জানে না?  
উত্তর – দরিদ্র, ঘরহারা, নিপীড়িত মানুষের কথা কেউ জানে না, কেউ তাদের খবর রাখে না।
৬. “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।”—এর কারণ কী?
উত্তর – দুর্যোগে সব-হারানো অসহায় মানুষ সাহায্যের আশায় মানুষেরই [যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুল] দরজায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। জীবনযাপনের গ্লানি নিয়ে তাদের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে সাহায্যের আশায়।
৭. “কিছুই কোথাও যদি নেই”—কোথাও কিছু না থাকার মতো অবস্থা যখন, তখন কী করণীয়?
উত্তর – চারিদিকে অসীম শূন্যতার হাহাকারের দিনে যে কজন ‘মানুষ’ রয়েছেন, তাঁরা যেন হাতে হাত রেখে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন, সংঘবদ্ধভাবে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নেন।
৮. “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” এ কথা বলার কারণ কী?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কথাটির দ্বারা কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যে-কোনো বাধাই মানুষের ঐক্যের দ্বারা আটকানো সম্ভব।
৯. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি কয়টি স্তবকে বিন্যস্ত। প্রতিটি স্তবকে কয়টি করে পঙ্ক্তি আছে?
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি দুটি স্তবকে বিন্যস্ত। প্রতিটি স্তবকে ১২টি করে পক্তি রয়েছে।

ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

১. “আমাদের ইতিহাস নেই”—কে, কেন এ কথা বলেছে?
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: কবি শঙ্খ ঘোষ স্বয়ং সাধারণ মানুষের হয়ে কথাটি বলেছেন। এ কথা বলার কারণ : ইতিহাস আসলে জাতির আত্মবিকাশের গৌরবময় কাহিনি, তার ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার। কিন্তু যখন সেই ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় কোনো ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, ধর্মসম্প্রদায় কিংবা রাজনীতির দ্বারা, তখন ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে। ক্ষমতাবানরা নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলে। মানুষ একসময় ভুলে যায় তার প্রকৃত ইতিহাস, আর চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসকেই নিজের বলে মেনে নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতকে তুলে ধরতে গিয়েই কবি এ কথা বলেছেন।
২. “আমাদের চোখমুখ ঢাকা/আমরা ভিখারি বারোমাস”‘ভিখারি’ শব্দটির তাৎপর্য স্পষ্ট করো। 
উত্তর – প্রসঙ্গ : কবি আমাদের ইতিহাস প্রসঙ্গে কথাটি বলেছেন। তাৎপর্য : ক্ষমতাবান শাসকরা নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসকে এমনভাবে রচনা করতে চায়, যেন তা শুধু তাদেরই। আর সাধারণ মানুষ অসহায়ের মতো সেই ইতিহাসকেই নিজেদের ইতিহাস বলে মেনে নেয়। তৈরি হয় বঞ্চনার ইতিহাস। মানুষ ‘ভিখারি’ হয়ে থাকে ইতিহাসহীনতার কারণে। এই হীন কাজের দ্বারা জীবিকানির্বাহকে কটাক্ষ করেই কবি উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
৩. “পৃথিবী হয়তো গেছে মরে”—কবি কেন এ কথা বলেছেন?
উত্তর – শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবি তার চারপাশের সমাজে, অস্থিরতা ও ধ্বংসের ছবি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেখানে চলার পথে প্রতিমুহূর্তে বাধা, মাথার উপরে বোমারু বিমানের আনাগোনা। যুদ্ধের তাণ্ডবে মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আবার ক্ষমতাবানদের শাসনে মানুষদের অধিকারের কোনো স্বীকৃতি নেই। অন্যের অনুগ্রহে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। মনুষ্যত্বের এই বিপর্যয় ঘটার পরেও পৃথিবীর টিকে থাকা সম্ভব কিনা তা নিয়ে কবির মনে সংশয় জেগেছে।
৪. “আমাদের কথা কে -বা জানে।”—এই মন্তব্যের দ্বারা কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন লেখো।
উত্তর – ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণ আজকের পৃথিবী পরিচালিত হয় ক্ষমতাবান শাসকদের দ্বারা। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু ক্ষমতাশালীরাই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা : সাধারণ মানুষ সেখানে থাকে উপেক্ষিত। দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ানোটাই তার নিয়তি। অর্থাৎ অন্যের দয়ার ওপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকা ছাড়া তার অন্য কোনো গতি নেই। এই মানুষেরা হয়তো দক্ষতা কিংবা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত মূল্য পায় না। অন্যের করুণা বা দয়ার ওপরেই তাদের নির্ভর করে থাকতে হয়।
৫. “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।”— ‘আমরা’ কারা? তাদের সম্পর্কে এ কথা বলার কারণ কী? 
উত্তর – আমাদের পরিচয়: উল্লিখিত অংশে ‘আমরা’ বলতে সাধারণ মানুষদের বোঝানো হয়েছে।
এ কথা বলার কারণ : সমাজব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ উপেক্ষিত। সব কিছুই পরিচালিত হয় ক্ষমতাবানদের ইচ্ছায়। তারাই ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘চোখ মুখ ঢাকা’ অবস্থায় অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে সাধারণ মানুষদের বাঁচতে হয়। তারা বেঁচে থাকে প্রভাবশালীদের দয়া নিয়ে। অন্যের দয়ার ওপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকাটাই যেন তাদের নিয়তি। সমাজে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাহীন সাধারণ মানুষ তাই ক্ষমতাবানদের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায়।
৬. “তবু তো কজন আছি বাকি”—এই মন্তব্যের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর – উৎস: শঙ্খ ঘোষ রচিত ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতাংশটি গৃহীত। তাৎপর্য : পৃথিবীজুড়ে সামাজিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে আদর্শহীনতার বিস্তার আমাদের দিভ্রান্ত করছে। এর পাশাপাশি পৃথিবীজুড়ে চলছে হত্যালীলা। এই অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষই যখন হতাশাগ্রস্ত তখনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দু-একজন মানুষ অন্তত বেঁচে আছে, যারা পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে না দাঁড়ালে এই ভয়ংকর সময়ে বিপদকে রুখে, শান্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না। একতার শক্তিতেই এভাবে দিনবদলের স্বপ্ন দেখেন কবি, স্বপ্ন দেখেন প্রতিরোধের।
৭. ‘আর আরো হাতে হাত রেখে…..” – এই হাতে হাত রাখার দরকার কী? কবি ‘আরো’ শব্দটি কেন ব্যবহার করেছেন? 
উত্তর – হাতে হাত রাখার প্রয়োজনীয়তা : সমাজ জীবনের অস্থিরতা মানুষকে বিপন্ন করে তোলে। যুদ্ধ আহ্বান করে ধ্বংস ও মৃত্যুকে। মানুষ আশ্রয়হীন হয়। শিশুদের মৃতদেহ পড়ে থাকে এখানে ওখানে। সাধারণ মানুষের ইতিহাস স্বীকৃতি পায় না। ভিখারিবৃত্তি করে বেঁচে থাকতে হয়। সাধারণ মানুষ অন্যের অনুগ্রহে বেঁচে থাকে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সব মানুষের একসঙ্গে থাকার প্রয়োজন বলেই কবি মন্তব্যটি করেছেন।
‘আরো’ শব্দটি ব্যবহারের তাৎপর্য: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায় দরকার হৃদয়ে বন্ধন। সম্প্রীতিই থাকে, লড়াই-এর শক্তি দিতে। মানুষের সমাজবদ্ধতা ও সম্প্রীতিকে দৃঢ়তর করার প্রয়োজনেই কবি ‘আরো’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

১. “আমাদের ইতিহাস নেই”—এই ইতিহাস না থাকার কথা বলে কবি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন সমগ্র কবিতা অবলম্বনে লেখো।
উত্তর – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় সাধারণত মানুষের ইতিহাসহীনতার দুটি পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। শিকড়-বিচ্ছিন্নতা: ইতিহাস হল প্রকৃতপক্ষে কোনো জাতির এবং সভ্যতার আত্মবিকাশের কাহিনি। তাই অতীতের ওপরে দাঁড়িয়ে যখন বর্তমানকে তৈরি করা যায় তখনই তা যথাযথ হয়। একেই বলা যায় ঐতিহ্যের বিস্তার, যা ভবিষ্যৎকে সুদৃঢ় ও সুনিশ্চিত করে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের প্রকৃত ইতিহাস থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি। শঙ্খ ঘোষ যখন তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় আমাদের ইতিহাস না থাকার কথা বলেন, তখন তা আসলে দেশ এবং জাতির এই শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতার দিকেই ইঙ্গিত করে। ইতিহাসের বিকৃতি: শুধু ইতিহাস না থাকা নয়, বিকৃত ইতিহাসের কারণে পথ হারানো মানুষের কথাও কবি বলেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যারাই যখন ক্ষমতায় থেকেছে ইতিহাসকে তারা তখন নিজেদের মতো করে, নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করেছে। যথার্থ মানুষের ইতিহাস কোনো দাম পায়নি। সে ইতিহাসে তাই “আমাদের চোখমুখ ঢাকা/আমরা ভিখারি বারোমাস।” প্রথাগত ইতিহাস মানুষকে অন্ধ করে তোলে, চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসকে নিজেদের ইতিহাস বলে মেনে নিতে হয়। উপসংহার: ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে গিয়ে বর্তমানের সংকটে তাই বাঁচার পথ খুঁজে পাওয়া ক্রমশই অসম্ভব হয়ে ওঠে।
২. “আমরা ভিখারি বারোমাস।”—’আমরা’ কারা? তারা নিজেদের ভিখারি বলেছে কেন কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো।
উত্তর – ‘আমরা যারা: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার উল্লিখিত অংশে ‘আমরা’ বলতে সাধারণ মানুষদের বোঝানো হয়েছে।
ভিখারি বলার কারণ: আমাদের সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হয় বিত্তবান ও ক্ষমতাবান মানুষদের দ্বারা। সমাজের অধিকাংশ যে সাধারণ মানুষ তারা সব দিক দিয়েই উপেক্ষিত থাকে। ইতিহাসে তাদের কোনো স্বীকৃতি ঘটে না। যে ইতিহাস তাদের দেওয়া হয় তা বিকৃত ইতিহাস। সাধারণ মানুষ এখানে সমস্তরকম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দিন কাটায়। “আমাদের চোখমুখ ঢাকা” অর্থাৎ মানুষ নিজের মতো করে সব কিছু দেখতে পায় না কিংবা নিজেদের কথা বলতে পারে না। ক্ষমতাশালীদের অনুগ্রহের উপরে নির্ভর করে তাদের জীবন কাটাতে হয়। এই মানুষদের কথা কেউ জানে না, তারা খ্যাতিহীন, প্রচারের আলো তাদের থেকে অনেক দূরে থাকে। কিন্তু এরাই সভ্যতার ধারক। তাই এদের দুরবস্থায় পৃথিবীর অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। বারোমাস ‘ভিখারি’ হয়ে থাকা বলতে এই অন্যের দয়ার ওপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকাকেই বোঝানো হয়েছে। উপসংহার: “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।”—যুদ্ধ কিংবা রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের পাশাপাশি এই মানবিক লাঞ্ছনা যেন মানবসভ্যতার এক অসহায় অবস্থাকেই স্পষ্ট করে দেয়।
৩. “তবু তো কজন আছি বাকি”—এই ‘কজন’ কারা? তাদের থাকার গুরুত্ব সমগ্র কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো। 
উত্তর – ‘কজন’-এর পরিচয়: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ‘কজন’ বলতে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের বোঝানো হয়েছে।
গুরুত্ব বিশ্লেষণ : আমাদের চারপাশের এক অস্থির সময়কে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেখানে মানুষের চলার পথে অজস্র বাধা। সাম্রাজ্যবাদীদের লোভ যুদ্ধকে ডেকে আনছে। মানুষ নিরাশ্রয় হচ্ছে। মৃত্যু ও মৃত্যুর আতঙ্ক তাড়া করছে সকলকে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবন আরও বেশি করে বিপন্ন হয়ে পড়ছে ক্ষমতাবানদের অত্যাচারে। তাদের ইতিহাসকে স্বীকার করা হয় না। ক্ষমতাবানদের অনুগ্রহের উপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় এই সব মানুষদের। সব মিলিয়ে সভ্যতা এবং পৃথিবীর বিপন্নতাকে কবি লক্ষ করেছেন তার অভিজ্ঞতায়। কিন্তু আশাবাদী কবি মনে করেছেন এই ধ্বংস-যুদ্ধ-লাঞ্ছনা কখনও সভ্যতার শেষকথা হতে পারে না। সমাজে এখনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছে। স্বার্থপরতা, আদর্শহীনতা যুদ্ধ উন্মত্ততা কিংবা লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে এই মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হলে সভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব। তাদের উদ্দেশ্য করেই তাই কবির আন্তরিক আহ্বান “আয় আরো হাতে হাত রেখে—আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।” অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সম্প্রীতিই সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে।
8. “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”–কবি কাদের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন? এভাবে থাকার প্রয়োজন কেন? 
উত্তর – উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবি সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছেন।
এভাবে থাকার প্রয়োজনীয়তা: অস্থির সময়ে পৃথিবী জুড়ে অনিশ্চয়তা, ধ্বংস আর মৃত্যুর ছবি প্রত্যক্ষ করেছেন কবি। সেখানে নানা বাধার কারণে চলার গতি রুদ্ধ, পথ দুর্গম। মাথার উপরে বোমারু বিমানের আনাগোনা। ধ্বংস ও মৃত্যুর নিশ্চিত আগমন। যুদ্ধের কারণে মানুষ আশ্রয়হীন হচ্ছে, চারপাশে পড়ে আছে মৃত শিশুদের দেহ। এদিকে যারা ক্ষমতাবান তাদের ইচ্ছায় সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অবদানের ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের অধিকারকেও স্বীকার করা হচ্ছে না। এককথায় সাধারণ মানুষেরা, সমাজে যারা সংখ্যায় বেশি, তারাই দয়া ভিক্ষা করে বেঁচে আছে। এভাবে মনুষ্যত্বের এই বিপর্যয়ের পরেও পৃথিবী টিকে আছে—এমন কথা বলা যায় কি না, তা নিয়ে কবির মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। কিন্তু আশাবাদী কবি শেষপর্যন্ত বিশ্বাস করেন যে এই যুদ্ধ-হত্যা-বঞ্চনা কখনও চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না। সমাজে এখনও অনেক শুভবোধসম্পন্ন মানুষ আছে। তারা যদি একত্রিত হয় তাহলে অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে পারবে। তার জন্যই দরকার একসঙ্গে থাকা, সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করা, হাতে হাত রাখা।

সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

১. আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”—কবির এই আহ্বানের প্রয়োজনীয়তা কবিতা অবলম্বনে লেখো।
উত্তর – অস্থির সংকটকালের ছবি: শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় অস্থির সময়ে মানুষের সংকটের ছবিকে তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক আদর্শহীনতা যেমন মানুষকে ঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে তেমনই সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মান্ধতার মতো অসুখ সমাজকে রক্তাক্ত করছে। অস্তিত্বের সংকটে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। “আমাদের পথ নেই কোনো/আমাদের ঘর গেছে উড়ে/আমাদের শিশুদের শব/ছড়ানো রয়েছে কাছে দুরে।” প্রকৃত ইতিহাসহীনতা: এই সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রেরণা সংগ্রহ করার মতো কোনো ইতিহাসও আমাদের নেই। কারণ ক্ষমতাবান শাসকেরা যে ইতিহাস আমাদের উপহার দিয়েছে তা বিকৃত এবং তাদের মতো করে গড়ে তোলা। এখানে ‘ভিখারি’ হয়ে বেঁচে থাকাটাই মানুষের নিয়তি। মুক্তির পথ সন্ধান: এই হতাশার মধ্যেই মুক্তির পথ খুঁজেছেন কবি। তাঁর মনে হয়েছে, কোথাও কিছু না থাকলেও এমন কিছু মানুষ এখনও সমাজে রয়েছে যারা তৈরি করবে সম্প্রীতির এবং সৌভ্রাতৃত্বের পথ। সেকারণেই দরকার পরস্পরের হাত ধরা। কোনো পথ দেখতে না পাওয়ার সময়ে হাতে হাত রেখে বেঁধে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
২. শঙ্খ ঘোষের আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবির সমাজভাবনার যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর – আদর্শহীনতা: কবিকে ব্যথিত করেছে রাজনৈতিক আদর্শহীনতা। ডান দিকে ধস আর বাম দিকে গিরিখাত জীবনের চলার পথকেই দুর্গম করে তোলে। মাথার ওপরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাণ্ডব, চারপাশে ধর্মান্ধতা, মধ্যযুগীয় বর্বরতা ইত্যাদি যেন ক্রমশই পথকে ধূসর করে দেয়। মৃত্যুর আতঙ্ক তাড়া করে সব মানুষকেই। প্রকৃত ইতিহাসের অভাব: যে জাতীয়তার ধারণা মানুষের সঙ্গে মানুষকে আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধতে পারত তা-ও বিরল। কারণ, “আমাদের ইতিহাস নেই”। তাই ইতিহাসের সত্যকে মানুষ পায় না, যা তাদের পথ দেখাতে পারে। ক্ষমতাবান শাসকেরা নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে ইতিহাস তৈরি করে নেয়। সাধারণ মানুষ সেখানে উপেক্ষিত হয়।— “আমাদের কথা কেবা জানে/ আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।” মানব মৈত্রীর সেতুবন্ধন: তবুও কিছু মানুষ থেকে যায়, মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার সেতুবন্ধ তৈরি করাই যাদের কাজ। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘এ আমরা কী করছি’ গদ্যরচনায় লিখেছিলেন—“আমাদের রাষ্ট্রনায়কেরা এমন এক মৃঢ় অহমিকা প্রকট করে তুলতে চাইছেন দেশবাসীর মনে, ফ্যাসিবাদ যার সুনিশ্চিত পরিণাম। অথচ আজও মানুষের মনে এক স্বাভাবিক মিলনক্ষুধা আছে, এক দেশের মানুষকে আর-এক দেশের মানুষ অন্তরঙ্গ ভালোবাসাতেই জড়িয়ে নিতে চায় আজও …”। এই ভালোবাসা আর মানবমৈত্রীর কথাই কবি উচ্চারণ করেছেন ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায়।
৩. “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”—কবিতায় কবিচেতনার কোন্ অভিনবত্ব লক্ষ করা যায় আলোচনা করো।
উত্তর – মনুষ্যত্বের বার্তা প্রকাশ: চারপাশের অশান্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি রচিত। রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামি, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার, ধর্মীয় উগ্রতা এবং ক্রমশ চেপে বসা আদর্শহীনতা—ইত্যাদির বিস্তার কোনো পথের সন্ধান দেয় না, বরং এক আশ্রয়হীনতার দিকে নিয়ে যায়। মানুষ ক্রমশই যেন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। যে ইতিহাস প্রেরণা হতে পারত, তা-ও ক্ষমতাবানদের দ্বারা বিকৃত। একতার বার্তা: এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে টিকে থাকাটাই সন্দেহের। তবুও পারস্পরিক মিলনের পথ ধরেই মানুষকে চলতে হবে। একতাই পারে এই সংকট থেকে মানুষকে মুক্ত করতে। সেই একতার কথাই কবি এখানে বলেছেন। অনবদ্য প্রকাশশৈলী: মনুষ্যত্বের এই বার্তাকে প্রকাশ করা যদি কবিতার বিষয় হয়, তাহলে তাকে রূপ দিতে গিয়ে এক অনায়াস শব্দশৈলী ও প্রকাশরীতি কবি অনুসরণ করেছেন। লক্ষ করার মতো বিষয় হল, কবিতায় অন্ত্যমিল থাকলেও তা হয়েছে দ্বিতীয়-র সঙ্গে চতুর্থ, ষষ্ঠ-র সঙ্গে অষ্টম—এই ধারা মেনে। উত্তমপুরুষের জবানিতে কথা বলায় কবি যেন সব মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। উপসংহার: শব্দ ব্যবহারে জটিলতা এড়িয়ে তিনি কবিতাকে আন্তরিক করে তুলেছেন। সময়ের বিপন্নতা, আর তা থেকে মুক্তির চেষ্টা—দুটোই তাই আবেগময় হয়ে উঠেছে।
8. “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”—এই পঙ্ক্তিটির পুনরাবৃত্ত হওয়ার কারণ কবিতাটি অবলম্বনে আলোচনা করো।
উত্তর – তাৎপর্য: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার নামটিই পঙ্ক্তি হিসেবে কবিতায় দুবার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কবিতার দুটি স্তবক এবং স্তবকের শেষ পঙক্তি হিসেবেই “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” শব্দবন্ধটি এসেছে। সমগ্র বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে এই পঙ্ক্তি দুটি আলাদা তাৎপর্য বহন করে। একতার প্রয়োজনীয়তা: কবিতার প্রথম স্তবকে ডান পাশে ধ্বংস আর বাঁ-দিকে গিরিখাদ-এর উল্লেখে কবি বোঝাতে চেয়েছেন পথের দুর্গমতা। এই পথ আসলে সভ্যতার পথ। সেখানে মাথার উপরে বোমারু বিমান। এই পথ চলার মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে আসে নিরাশ্রয়তা। শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সেই মৃত্যুভয় সমস্ত মানুষকেই তাড়া করে। আর তখনই কবি উপলব্ধি করেন যে, আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। বেঁচে থাকার একটাই উপায় আছে। আর তা হল ঐক্যের এবং সম্প্রীতির। সেজন্যই আমাদের বেঁধে বেঁধে থাকতে হবে। সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা: দ্বিতীয় স্তবকে কবি এনেছেন সভ্যতার অন্তঃশুন্যতার কথা। সাধারণ মানুষের সেখানে স্বীকৃতি নেই। ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাবানরা। ফলে তৈরি হয় সাধারণ মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস। দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বই সেখানে সংশয়ের সামনে পড়ে। মানুষের সভ্যতাকে তাদের কৃপাপ্রার্থী হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। যুদ্ধ-ধ্বংস- প্রবঞ্চনা ইত্যাদির মধ্য রক্ষার জন্য তাই দরকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। উপসংহার: এভাবে মৃত্যু আর বিনষ্টিকে অতিক্রম করে কবি আসলে শোনাতে চেয়েছেন একতার ও সম্প্রীতির প্রয়োজনের কথা। ধ্বংসোম্মুখ সভ্যতার বিশল্যকরণী তা। এই তাৎপর্যেই “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।” পঙ্ক্তির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন কবি। এটিই হয়ে উঠেছে কবিতার মূল সুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *